মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১৭
সাদিয়া
বান্দরবনের ট্যুর অসম্পূর্ণ করে আসার পর থেকে তুহিন টিকিটের জন্যে দৌড়ঝাঁপ পারছে। খুব তাড়াতাড়ি মালয়েশিয়া চলেও যাবে।
তুহিন তার বাবা মহিন সাহেব ও ফাতেমা বেগম কে এক সাথে এনে বসালো। মহিন সাহেব নিজের চশমা ঠিক করতে করতে বলেন,
“কি বাবা? কিসের এত জরুরি তলব বলো তো?”
তুহিন বাবার প্রশ্নের জবাব দিল না। বরং মাকে আদর করে বসতে বলল,
“বসো তো আম্মা আমি তোমাদের কিছু বলতে চাই।”
“কি বলতে চাস বলতো বাবা? টাকা পয়সা লাগবে কিছু প্রয়োজন?”
“না আব্বা। আসলে আমি অন্য একটা গুরুত্ব পূর্ণ কথা বলতে চাই তোমাদের।”
ছেলের ইতস্তত ভাব দেখে বাবা মা দুজনই ভীত শঙ্কিত। ছেলের কি হলো আবার? কি বলতে চায় সে? দুজনই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। তুহিন নিজেকে শান্ত করল। নরম স্বাভাবিক গলাতেই বলল,
“আব্বা আমি আসলে মায়রার ননদ শিফুকে পছন্দ করি।”
মহিন সাহেব হতবাকে তাকিয়ে রইলেন। ফাতেমা বেগমের কপাল কুঁচকে গেল। উনি চিন্তিত সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললেন,
“মাথা খারাপ হয়ে গেছে তুহিন? কি বলছিস এসব?”
তুহিন চকিত হলো না। বরং আগের মতো স্বাভাবিক গলায় জানাল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“হ্যাঁ আম্মা। বিষয়টা কিভাবে নিবে জানি না তবুও তোমাদের সরাসরিই বলছি আমি মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে চাইছিলাম তোমরা ওদের ফ্যামিলি কে জানাও। আমি না হয় কাবিন করে রেখে গেলাম ওখান থেকে এসে..”
রেগে গেলেন মহিন সাহেব। গর্জে বললেন,
“বেহায়া হয়ে গিয়েছো তুহিন? মুখে যা আসছে বলে যাচ্ছো। ভেবেছো কি বলছো তুমি?”
“আব্বা আমি সব ভেবেই বলছি। মাফ করো আমায়। আমি ওকে পছন্দ করি। তোমরা দয়া করে ওদের সাথে একটু কথা বলো। আমায় ভুল বুঝো না।”
“ফাতেমা নিজের ছেলেকে বুঝাও কি যাতা বলছে ও? ওর কি মাথা খারাপ হয়েছে? বুঝবান হয়েও অবুঝের মতো কথা বলছে। পছন্দ করে ভালো কথা তাই বলে ওইটুক একটা মেয়েকে? শিফু অনেক ছোট সে কি ভুলে গেছে?”
স্বামীর রাগান্বিত মুখ ও কথায় অসহায় হয়ে গেলেন ফাতেমা বেগম। কি বলবেন এখন বুঝে পাচ্ছেন না তিনি। ছেলে কি করে এত বাচ্চা একটা মেয়েকে পছন্দ করতে পারল? স্বামীর রাগে ভয়ে তটস্থ হয়ে তিনি নিবিনিবি গলায় বললেন,
“বাবা তুই এসব কি কথা বলিস? শিফু মা….”
“আমার ওকে ভালো লাগে আম্মা। পছন্দ করি।”
উত্তেজিত কন্ঠে মহিন সাহেব বলে উঠলেন,
“পছন্দ করা দোষের নয়। তাই বলে ওত ছোট একটা মেয়েকে? তাও বলছো কাবিনের কথা। তোমার মাথাটা একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে তুহিন।”
“মায়রাও তো ছোট আব্বা। তাহলে ওকে বিয়ে দিলে কেন?”
“আমরা আর ওরা? তোমার কি মনে হয় তুমি যে অবুঝ আবদার করছো সেটা ওরা কখনো হতে দিবে? আমি যতদূর জানি ইসহাক ভাই কখনোই পড়াশুনা কমপ্লিট না করে মেয়েকে ঘর থেকে ছাড়বেন না।”
“এখনি তো ঘর ছাড়তে হচ্ছে না আব্বা। পাঁচ বছর পর আমি বাহির থেকে আসলে তখন আনুষ্ঠানিক ভাবে সব হবে এখন শুধু…”
“আমায় রাগিও না তুহিন। নিজের মুখ সামলাও। এসব অবুঝ আবদার রেখে পড়াশোনা আর ক্যারিয়ারে মন দাও। সেটা ফোকাস করাই তোমার ভালো।”
গমগম গলায় বাবার বলা কথাটা মুটেও ভালো লাগল না তুহিনের। রক্ত গরম শরীরটা ফুঁসে উঠল। ফোঁসফোঁস করতে করতে ক্ষিপ্র উঠে দাঁড়াল সে। ক্ষোভ দেখিয়ে নিজেও তেজস্বী গলায় বলে উঠল,
“তোমরা যদি কথা বলে কিছু ঠিক না করো তবে আমিও বাহিরে যাবো না। এটাই আমার শেষ কথা।”
হনহন করে তুহিন বাসা থেকে বের হয়ে গেল। ফাতেমা বেগম অসহায় মুখে তাকায় স্বামীর পানে। স্ত্রীর মুখ দেখেই বুঝেন কি বলতে চায় সে। ঘনঘন নিশ্বাস নিতে নিতে চোখ বড় করে তাকান তিনি। ধমকে জিজ্ঞাস করেন “কি হয়েছে? কি বলতে চাইছো তুমি?” স্বামীর ধমকে কেঁপে উঠেন তিনি। তবুও আমতাআমতা করে বলেন,
“এক বার যদি বলে দেখতে। ছেলে যদি সত্যি যেতে না চায়?”
“চুপ।” উঠে দাঁড়ান মহিন সাহেব। ক্রোধ নিয়ে বলেন “না যেতে চাইলে না যাক। তাই বলে ওর অবুঝ বায়না মেনে নিব আমি? নিজের ছেলেকে গিয়ে বুঝাও। ও কি আমার মেয়ের সংসার ভাঙ্গতে চাইছে? সংসার শুরু আগেই ভাঙ্গার পায়তারা শুরু করেছে নাকি?”
“এ্যাঁ, ফেলটুশ ছাত্রীর হাজবেন্ট হতে চায় না। তো তোর মতো গণ্ডারকে কে বলেছিল আমার হাজবেন্ট হতে? আমি কি কাঁদছিলাম তোকে নিজের বেরসিক জামাই বানানোর জন্যে? নাকি তোর পায়ে ল্যাটকা মেরে বসে ছিলাম যে আমার জন্যে ঠিক ভাবে বাথরুমেও যেতে পারিসনি তাই বিয়ে করেছিস? লাউয়া মাছ কোথাকার। আমি তো আর ওত খারাপ স্টুডেন্ট নই। নিহাতই সর্বোচ্চ ৭০/৭৫ পাবা মেয়ে আমি। তাই বলে আমাকে ফেলটুশ ছাত্রী বানিয়ে দিল হতচ্ছাড়াটা? ফেলের ডিম তোর মাথায় ফাটাব আমি ইতরছানা কোথাকার। আমাকে ফেলটুশ বলে অপমান করা? এবার আমি ৮০ পেয়ে দেখাবই। না না ৯০ পাবো তখন ওই ৯০ টা ডিম তোর মুখে ছুড়ব রে খবিশ হারামি।”
মায়রা রাগে গজগজ করছে। আর ভেতরটা কেবল ব্যাকুল হয়ে ছটফট করছে। রাগে শরীর জ্বলছেও তার। সব কিছুর মূলে বুঝি ওই বদ ক্যাপ্টেন টা। লোকটার সাথে তার শেষ কথা হয়েছিল আজ থেকে ঠিক নয়দিন আগে। তাদের শেষ কনভারসেশন ছিল সেদিনের ওইটুক কথাই। রাগে কটমট করতে করতে মায়রা তখন কল কেটে দিয়েছিল। তার দুইদিন পর অবশ্য মানুষটা আবার ফাতেমা বেগমের ফোনে কল দিয়েছিল সে নিজেই কথা বলেনি। অতঃপর চাঁপা জ্বলন টা সহ্য করতে না পেরে এর চারদিন পর আবার নিজেই কল দিয়েছিল সে। কিন্তু ওই পাষাণ অহংকারী মানুষটা তার মূল্যবান কল ধরেনি। আজও একটা কল অবধি করেনি। কতটা অসভ্য হলে এমন করতে পারে? কতটা অহংকারী? এই তার দায়িত্ব? তার সকল দায়িত্ব কি শুধু দেশের জন্যে? বউ পরিবার তবে একেবারের জন্যে ছেড়ে দিক ওই অঙ্গার মানুষটা। এই যে কাল বাদে পরশু তার পরীক্ষা। এখনো কত পড়া বাকি অথচ ওই অসহ্য মানুষটার চিন্তায় সে মনোযোগ দিতে পারছে না। কেবল ছটফট করছে। প্রতিদিন সময় করে সে একবার তার খোঁজ নিতে পারে না? একটু সুইট ভাবে কি তাকে ডাকা যায় না? নরম সুরে কথা বলা যায় না? কেন করে না ওইসব ওই জাঁদরেল মানুষটা? ধ্যাত কেন তার বাবা মা এমন নিরস নিস্তেজ জড়বস্তুর সাথে তার বিয়ে দিয়েছিল? তাহলে তো আর তাকে মায়ায় পরে এই দিন দেখতে হতো না।
হঠাৎ একদম ঝড়ের মতো মায়রার একটা কথা মনে হলো। সঙ্গেসঙ্গে বিস্তর চিন্তায় কপাল কুঁচকে নিল সে। বুকেও কাপড় চিপার মতো নিঙ্গড়ে উঠল। আসলেই কি ঘটনা সত্যি? চিবুক ঝুলে গেল তার বিস্ময়ে। মন বারবার বলছে,
“আচ্ছা ওই মানুষটার কোনো শারীরিক সমস্যা নেই তো? না হলে সে এমন করবে কেন? বিয়ের পরও সমস্যা ব্যতীত কি আর কেউ নতুন বউকে এমন অবহেলা করে? এত দূরে দূরে থাকে? যেন তাকে সহ্যই করতে পারে না। হয়তো লোকটা লজ্জায় তাকে কিছু জানাতে পারছে না। হতেও তো পারে। আহারে!”
মায়রা বিষণ্ণ মুখে কপাল চেঁপে ধরল। মলিন কন্ঠে একলা রুমে বিরবির করে উঠল,
“হায়রে আমার আধ ভাঙ্গা জামাই। এত সুদর্শন জামাই আমার শেষমেশ কি না অর্ধেক শক্তিবান?”
মায়রা আরো বিড়বিড় করল। বই সামনে নিয়ে চুপচাপ বসে রইল। চোখ পাতার লেখায় থাকলেও মন পাখির মতো ছটফট করে কোথায় কোথায় উড়ে বেড়াচ্ছে। তবুও জোর করে বইয়ের পাতায় মনোযোগ রাখার চেষ্টা করছে। যে করেই হোক সব সাবজেক্টে ৯০ না পেলেও ৮০ পেয়ে হলেও ওই ৮০ মুখে ঝামা ঘষার মতো ছুঁড়ে মারবে ওই ইতর লোকটার মুখে। তাকে ফেলটুশ বলা? একটা চাকরি করে বলে কি নিজেকে খুব পটু মনে করে নাকি? আরে এসব চাকরি তো তুড়ির ব্যাপার ঘুষ দিলেই কেল্লা ফতে। এসব নিয়ে আবার বড়াই হতচ্ছাড়াটার। মুখ ভেংচালো সে তুচ্ছ সুরে।
নিজের উপর যুদ্ধ করে যাও একটু পড়াতে মন বসিয়েছিল তাও মোবাইল ফোনটা সেই সংযোগ কাট করে দিল। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ফোন হাতে নিল। স্কিনে জ্বলজ্বল করা “পাষাণ ক্যাপ্টেন” নামটা দেখে আঁতকে উঠল তার কোমল বুকটা। দড়াম দড়াম করে ঢোল পেটার শব্দ হলো সেখান থেকে। ভেতরে ধুকবুকানি বাড়লেও তার ঠোঁটে একটু হাসি ফেটে উঠল। ধড়ফড় করে রিসিভ করতে গিয়েও মনে হলো পাল্টা দানের কথা। মুহূর্তে মুখ পরিবর্তন করল সে। নাক ফুলিয়ে মনে মনে ভাবল,
“ধরব না। ব্যাটা বজ্জাৎ তোর কল আমি ধরব না। কল দিতে দিতে তুই মরে যা পৃথিবীর শেষ মাথায় চলে যা। খেতা কম্বল নিয়ে জাহান্নামে যা তবুও আজ কল ধরছি না। মনে আছে? আমি কল দিয়েছিলাম তখন কার চুল ছিঁড়ছিলে তুমি? এখন আমিও তুলব না। শোধ নিব শোধ।”
একবার দুবার কল করার পরও ফোন রিসিভ হলো না। একটুপরই হোয়াটসএপে টুক করে শব্দ এলো। চকিতে একটা ম্যাসেজ দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। লজ্জা নাকি ক্ষোভে মুখ লাল হলো তা বুঝার উপায় নেই।
“সেদিন রাতে যে আমার সাথে বেহায়া গিরি করলে, আমার গা ছুঁয়ে দিলে, আমার বুকে নিজের হাত দিয়ে খামছে ধরেছিলে, আর…. থাক। তার জন্যে তো তোমাকে আমি কিছু বলিনি। আর না বারবার খোঁচিয়ে লজ্জা দিচ্ছি। তবে ফোন ধরছো না কেন মায়রা?”
মায়রা বুঝতে পারছে তার গাল গরম হয়ে আসছে। এই শীতেও তার গাল জ্বলছে। ছিঃ কি কথা। মানুষটা কি বেহায়াও? কিভাবে এসব লিখল? ছিঃ মার্কা কথা তার ঠোঁটের আগায় আসল কি করে? মাথা ঝাঁকিয়ে নষ্টা চিন্তা বাদ দিল মায়রা। ধরবে না। এখন ওই অসভ্য বেটার কল ধরাই যাবে না। আবার না বলে বসে সেই রাতে… ফোঁস করে দম ছাড়ল মায়রা। কল দিলেও ধরবে না। বলবে সে ফোনের পাশে ছিল না। ব্যাস। আবারও কল দিল। ভেতরটা কেমন ছলাৎছলাৎ করে উঠল মায়রার। পরিচিত টোনটা তার বুকে ধকধকানি বাড়িয়ে দিচ্ছে। অস্বস্তি হচ্ছে মানুষটার কথা ভেবে।
কল কেটে আবারও ম্যাসেজ টোন এলো। তাকিয়ে দেখবে না দেখবে না করেও আর পারল না চঞ্চলতা দমিয়ে রাখতে। স্পষ্ট ভাষায় লেখা আছে,
“অথরেটি থেকে ছুটি পাচ্ছি না আপাদত। চট্টগ্রাম বন্দরে এখন ঝামেলাও আছে। ছুটিতে বাড়ি গিয়ে তোমার ছুঁয়ার প্রতিশোধ নিতে না পরলেও অন্য কিছু করতে পারবো। আম্মু কে কি বলতে হবে সিলেটের কথা বলে তুমি কোথায় কোথায় ঘুরে গেলে। কি কি হলো? আমি বরং আমার শাশুড়ি কে সেটাই বলি।”
তাজ্জব বনে গেল মায়রা। হতবাক কাটছে না তার। মানুষটা এত খারাপ? তাকে মায়ের হুমকি দেখায়? রাগে গজগজ করতে করতে এবার নিজেই ফোন দিল সে। দুইবার রিং হবার পর কল রিসিভ করল। ভালোমন্দ জিজ্ঞাস না করেই শক্ত গলায় বলল,
“ভিডিও অন করো।”
মায়রার রাগ কি হলো কে জানে। রাগ ভুলে ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে তাও ভুলে গেল।শুধু হতবাক হয়ে বসে রইল। ওপাশ থেকে আবারও ভেসে এলো,
“ভিডিও অন করতে বলেছি তোমায় মায়রা। আমি মিসেস ফাহাদ ইহাম চৌধুরী কে দেখতে চাই।”
অদ্ভুত এক শিহরণ আচমকা ধাক্কা দিল মায়রার বক্ষপিঞ্জরায়। হৃদয়ের স্পন্দন ক্রমাগত বেড়ে গেল ওই টুক কথার তাণ্ডবে। শরীরে বইল ঠান্ডা বাতাস। একটু আগের উষ্ণ বুঝি ঝাঁপিয়ে এবার বরফে জমে যাবে। লজ্জায় মাথা নুয়ে আনল সে। ঠোঁটে এক টুকরো হাসিও দেখা গেল। পরক্ষণে ধমকের সুরে আবার কানে এলো,
“মায়রা অথরেটি আমার কথায় চলে না। চাইলেই আসতে পারব না। ত্যাড়ামি না করে ভিডিও অন করো। নয়তো..”
একটু সময় নিল মায়রা। নিজেকে উপর উপর একটু গুছিয়ে ভিডিও অন করল। স্কিনে ইহামের কঠোর মুখটা দেখে মাথা নুয়ালো সে। ইহাম চুপচাপ কিছুক্ষণ দেখল। অধর আড়ালে প্রসারিত করেই শক্ত গলায় বলল,
“পরশু এক্সাম প্রিপারেশন কেমন? ফেলটুশ মারবে না তো?”
মায়রার চট করে তাকাল। নাক ফুলে উঠল রাগে। মানুষটা কি তার সাথে ভালো করে কথা বলতে পারে না? তার প্যান্টের ভেতর কি বিছুটি পাতা ঢুকিয়ে দেয় নাকি কেউ? মায়রা মনে মনে ঠিকই করে নিল যতদিন এই লোক নিজ থেকে এসে তাকে না গলাবে ততদিন সে গলবেও না ভালো ভাবে কথাও বলবে না। তাতে যা হবার হবে। মায়রা ব্যাকা গলায় জবাব দিল,
“ফেলটুশ মারব আর সেই ফেলটুশের লাড্ডু গুলি আপনার মুখে চেঁপে ধরা হবে বদ মানুষটা একটা।”
“মুখে চেঁপে ধরার মতো আরো অনেক কিছুই আছে মায়রা। যেমন সবটা তুমি নিজে। আমার আবার লাড্ডু পছন্দ নয়। একদম তরজাতা সুইট ফেভারিট। তুমি চাইলে সেটা টেস্ট করাতে পারো।”
“আমি সুইট নই যে টেস্ট ক…”
কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারল না মায়রা। বিষয়টার মূল ধরতে পেরেই থমকে গেল তার ঠোঁট। কটমট করে তাকাল ইহামের দিকে। লোকটার শয়তানি হাসি দেখে তার আরো বিরক্ত লাগল। কটকট করে বলল,
“আপনি কল দিয়েছেন কেন আমায়?”
“মায়রা পরশু এক্সাম ভালো ভাবে সেটাই ফোকাস করো। পড়াশোনা বাদ দিয়ে আজেবাজে চিন্তায় সময় নষ্ট করছো তুমি।”
“আপনায় কে বলল আমি আজেবাজে চিন্তা করি?”
“মনে হলো তুমি আমায় নিয়ে বেশ চিন্তিত।”
মায়রা হাঁসপাঁস করে উঠল। কি জবাব দিবে ভাবতে লাগল সে। আমতাআমতা করে বলল,
“আমার কি আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে আপনার মতো আস্তো একটা বিপদ নিয়ে চিন্তা করব?”
“পরশু কি এক্সাম?”
“বাংলা ১ম।”
“ইংরেজি থেকে বাংলা কঠিন একটা সাবজেক্ট জানো তো? ঠিক তোমার মতো। সহজসরল লাগলেও বুঝতে গিয়ে দেখো জটিল।”
“আমি জটিল? এটাই বলছেন আপনি?”
“তুমি সুইট। আমার কিন্তু সুইট ফেভারিট।”
“আমার পড়া আছে। আপনার অসভ্য মার্কা কথা শুনার জন্যে আমি হায় হুতাশ করে বসে নেই।”
ওপাশ থেকে এবার ইহামের শান্ত গলা শুনা গেল,
“মায়রা শিফুকে বান্দরবন যাওয়ার জন্যে তুমি রাজি করিয়েছিলে তাই না?”
থমকে গেল মায়রা। কি জবাব দিবে বুঝল না। ভালো ভাবে তাকিয়ে দেখল ইহাম কে। মানুষটার শান্ত সহজ রূপটা কেমন ভড়কানোর মতো। ভীত হৃদয় ত্রাসে কথা বলল গুনগুন করে।
“জবাব দাও মায়রা।”
মায়রা মুখ কালো করে মাথা নুয়ে নিল। তা দেখে ফিচেল হাসল ইহাম। আবারও ধীর কন্ঠে শুধালো,
“সেটা তুহিনের কথাতেই তাই তো?”
সংকুচিত মুখে তাকাল মায়রা। সব উড়ে গিয়ে এবার খানিক ভয় হলো তার। মানুষটা এমন করে হাসছে কেন? সে মার কাছ থেকে শুনেছে ভাইয়ের বক্তব্য। বুঝেছেও ভাইয়ের পছন্দ। কিন্তু নিজের জন্যে শিফুকে জোর করে রাজি করানোটা তার ঠিক হয়নি। এই মানুষটা নিজের নীরব শান্ত হাসিতে যেন সেটাই বুঝাতে চাইছে।
“বিয়ে কি একদিনের ব্যাপার? তাকাও আমার দিকে মায়রা।”
আস্তেধীরে মায়রা চোখ তুলে তাকাল। করুন মুখ তার। ইহাম আবারও শান্ত গলাতেই বলল,
“বিয়েটা কি মনে হয় আমাদের মতো সবার কাছে এমন? বিয়েটা দুইটা ছেলেমেয়ের দুইটা পরিবারের সারাজীবনের একটা বন্ধন। একজনের থেকে আরেকজনের এইজ গ্যাপ বেশ গুরুত্ব পূর্ণ একটা ব্যাপার। তোমার এখনো ১৮ হয়নি আর আমার ২৮ বুঝেছে ব্যবধান টা? পরিস্থিতি টা দেখছো আমাদের দুজনের? সেখানে তুহিন অলরেডি ২৫ শিফু এখনো ১৬ এর গণ্ডিতে। ৯ বছরের ব্যবধান। সেখানে তুহিন কি ভাবে এসব কথা বলতে পারে? আর মাথা মোটা তুমি কি করলে? ভাইয়ের কথায় রাজি হয়ে গেলে গবেটের মতো?”
শেষের দুইটা বাক্য চাঁপা ধমকের সুরে বলে উঠল ইহাম। শতশত মাইল দূর থেকেই সেই ধমকে কেঁপে উঠল মায়রা। আধোআধো চোখে তাকিয়ে দেখতে পেল ইহামের লাল লাল চোখ। তা দেখেই আতঙ্ক বাড়ল মেয়েটার। চোখ গুলি তরাসে ডুবুডুবু।
“তুমি কেন ওকে রাজি করাতে গেলে? তুহিন বলবে তুমি সেটা করবে? এত বাধ্য মেয়ে তো তুমি নও। শান্ত ভাবে বলছি মায়রা জবাব দাও।”
মায়রা একটু সময় নেয়। কাঁপাকাঁপা গলায় জানায়,
“ভা ভাইয়া বলেছিল শিফু কে নিয়ে গেলে আ আমাকে নিয়ে যাবে। তা তাই..”
“তাই তুমিও গোবর মাথা নিয়ে সেটাই করলে স্টুপিড? নিয়ে যেতো না না আসতে। এখানে আসার এত তোড়জোড় করছিলে কেন তুমি? শিফুকে কেন টানতে গেলে তুমি?”
ইহামের চিৎকারে মায়রার চোখ দিয়ে এবার পানিই গড়িয়ে পড়ল। কম্পিত ঠোঁট লাল হলো। থেমে থেমে জবাব দিল,
“ভা ভাইয়া শিফু কে প..”
“জাস্ট শাটআপ ননসেন্স। তুমি বাচ্চা না মায়রা। বিবেক বুদ্ধি যে নেই তেমনটাও না।আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং টা দেখছো? তিন মাসের উপরে চলে কেউ কাউকে বুঝেছি এখনো? মিনিমাম ভালো করে কথাটা পর্যন্ত হয় না। তুমি তোমার মতো ভাবো আর আমার ভাবনাটা আমার মতো। ফলশ্রুততে সম্পর্কটা কোথায়? সব দেখেও কি করে করতে পারলে? মায়রা শিফু এখনো ছোট। তুমি কি গাধা নাকি?”
“ভাইয়া শিফুকে পছন্দ করে তাই তাদের সম্পর্কটাও ভালো হবে। কিন্তু আপনি তো আমায় পছন্দ করেন না। আপনি পছন্দ করেন অন্য শাড়ী পড়া মেয়েকে তাই আমাদের সম্পর্কটাও জায়গার দূরত্বের চেয়ে আরো বহুগুণ বেশি।” মায়রা খুব করে বলতে মন চায়ছিল কথাগুলি। কিন্তু পারছে না। মানুষটার ধমক কথা বলার ধরন তার গলা কাঁপিয়ে দিচ্ছে। নীরবে টুপটুপ করে কাঁদছে মেয়েটা। ল্যাপটপের স্কিনে মায়রার দিকে ভালো করে তাকালো। প্রতিটি বিন্দুর দিকে নজর দিল সে। লাল চোখ নাক, কাঁপা ঠোঁট সব দেখল। তার ওই কন্দনরত অবস্থা হঠাৎ বিগড়ে দিল ইহাম কে। শান্ত করতে চেয়েও পারল না। মেজাজ খুব খারাপ লাগছে তার। চেঁচিয়ে বলে উঠল,
মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১৬
“একদম আমার সামনে কাঁদবে না। কাঁদতে হলে আড়ালে কাঁদো। স্কিনের সামনে গাধার মতো কাঁদছো কেন ইডিয়ট? তোমায় কেউ খেয়ে ফেলেছে? মাথা মোটা গর্দভ একটা। এক্সাম গুলি ভালো করে দেওয়া চাই। রেজাল্ট খারাপ হলে এসে একদম মে’রে ফেলব ড্যাম ইট।”