মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১৯
সাদিয়া
নাগাতার ইহাম কল দিয়েই যাচ্ছে মায়রার ফোনে। মেয়েটা বিরক্ত মুখে চোখের পানি নির্গত করতে করতে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতেই ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। একবার দুবার রিং হয়ে হয়ে কেটে যাবার পর আবারও কল আসছে। কিন্তু মেয়েটা না ফোন কেটে দিচ্ছে আর না ধরছে। এক নজরে অবহেলায় বিছানার উপর পড়ে থাকা মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে নাক টানছে। টপটপ করে পড়া পানিতে গাল ভিজে একাকার তার। গায়ের ওড়নাটাও অনেক খানি ভিজে উঠেছে। ইহাম আবারও কল দিয়েছে। মায়রা নাক টেনে চোখের পানি মুছল। পাশ থেকে মিথিলা এবার নীরবতাকে মাড়িয়ে শান্ত গলায় বলল,
“কি হচ্ছে মায়রা? বাচ্চামি না করে কলটা ধর। তাহলেই তো ক্লিয়ার হয়ে যায়।”
“না ধরব না কল। ওই অসভ্য চরিত্রহীন লোকটার কল আমি কিছুতেই ধরব না। হি ইজ আ চিটার। ফোন করতে করতে মরে যাক সে।”
“এটা কি ঠিক বল? আর তুই যেটা করলি সেটার বেলায়?”
“ঠিক হয়েছে। একদম বেশ করেছি। আমাকে উনি দেখাতে পারলে আমি কেন পারব না?”
“বিষয়টা তোর দিক থেকে যেমন পুরোটা সত্যি নয় ওমনটা তো উনারও হতে পারে। তুই একটু কথা বলে দেখ।”
“বুঝলাম না আপু তুমি উনার দিক টানছো কেন বলো তো? সে কি তোমায় জাদুটাদু করেছে? হঠাৎ করেই তার পক্ষ নিচ্ছ।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কারণ উনি এগুতে চাইছে আর তুই ঘাওড়ামি করে নিজের জায়গায় বসে আছিস। পরিস্থিতি না বুঝে রিয়েক্ট করা হেয়ালি করার মানে কি মায়রা? উনি কল করছে তুই একটু রিসিভ করে কথা বল উনার সাথে। দেখ কি বলে। উনার কাছে জিজ্ঞেস কর বিষয়টা নিয়ে।”
মায়রা কেঁদেকেটে কাঁদা। চোখ ফুলে গিয়েছে তার। লোকটা এতক্ষণে অসংখ্য বার কল দিয়েছে। কিন্তু আর ঝাপসা চোখ বারবার ঘন্টা খানেক আগের ওই বিচ্ছিরি দৃশ্যটা তার বুক ভার করে দিচ্ছে। ফাঁপিয়ে তুলছে তাকে। দুই হাত দিয়ে আবারও চোখের পানি মুছে ভাঙ্গা গলায় জবাব দিল,
“উনার মতো বাজে মানুষের সাথে আমার একটুও কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। উনি একটা খারাপ মানুষ।”
“আর তুই যেটা করলি?”
“বেশ করেছি। আমি একা কষ্ট পাবো উনি গা ছেড়ে ভাসবেন কেন? উনিও একটু জ্বলুক। আর জ্বলা উনি আমাকে তো চানই না। আমাকে পছন্দই করেন না।”
মায়রা আবারও কেঁদে উঠল এবার একটু শব্দ তুলে। মিথিলা আওয়াজ করে দম ছাড়ল। বিরবির করে বলল,
“মামা এত তাড়াতাড়ি তোকে কেন বিয়ে দিল মায়রা? যে বিষয়টা একটু কথা বলে ক্লিয়ার করে মিটমাট করা যায় সেখানে তুই জেদ দেখিয়ে আরো জটিল করছিস।”
বিষাদের সময় বড্ড তিক্ত কঠিন হয়। এ সময় যেন ফুরাতেই চায়না। বুকের ভেতর বিষাক্ত ছুরি একেরপর এক আঘাত করে। হৃদয়টা বিষিয়ে উঠে তীব্র যন্ত্রণায়। কাল সারারাত ঘুম হয়নি মায়রার। চোখ ফুলে টইটুম্বুর। মুখটাও ফোলা লাগছে। বিবশ মলিন চিত্তে রুমের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ গুলি ছলছল করছে পানিতে। আর ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছারখার। ঝাপসা চোখে বারবার ভেসে উঠছে কালকের দৃশ্যটা। ক্যাপ্টেন ফাহাদ ইহাম চৌধুরী একটা মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা মুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে আর সে ক্যামেরার দিকে। ওই টুক ছবি তার মনে আলোড়ন তুলেছে। এটা কি কলেজের সেই শাড়ি পরা মেয়েটা? যাকে সে পছন্দ করে। ওই মেয়েটাকে পছন্দ করলে তাকে কেন বিয়ে করল? বিয়ের পরও কি ওই মেয়েটার সাথে তার সম্পর্ক চলে? এর বেশি ভাবনা উদয় হলো না তার ভগ্নহৃদয়ে। দুমড়েমুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে তা।
নিচ থেকে আনতারা বেগম চেঁচিয়ে উঠলেন,
“মায়রা? আম্মা কই তুই? দেখ তো কে এলো? কলিংবেল বাজছে একটু খুলে দিয়ে যা মা।”
ধ্যান ভাঙ্গল মায়রার। চোখের পানিটুক মুছতে মুছতে ঘড়ির দিকে তাকাল। ১২ টা ২৪ বাজে। এই সময়ে কে আসবে? ফুপা গিয়েছে আরদে, মিথিলা আপুও তো বলল সে চলে যাবার আগেই ফিরে আসবে ৩ টা নাগাদ হবে। তাহলে? ক্ষীণ কন্ঠে ফুপি কে জিজ্ঞাস করল,
“কে এসেছে ফুপি?”
“দেখ তো মা কে এলো। ভাই কিংবা তুহিনই কি চলে এলো নাকি তোকে নিতে।”
আনতারা বেগমের হাতে তখন আতব চালের ডো। ভাই আর ভাইবউ এর জন্যে পোয়া পিঠা আর পাটিসাপটা বানাচ্ছেন। বিকেলে মায়রা চলে যাবে সাথে দিয়ে দিবেন।
মায়রা আনমনে বিষণ্ণ মুখে গিয়ে দরজা খুলে দিল। ক্লান্ত নির্ঘুম ফোলা চোখ গুলি নিয়ে সামনে তাকাতেই ভীষন আশ্চর্য হলো। বিস্ময়ে হৃদয় ধাক্কা খেলো তার। আচমকা দুই পা আপনাআপনি পিছিয়ে গেল। বিস্মিত চোখ গুলি বিমূঢ় স্থির হয়ে রইল দরজার ওপাশে। কালো শার্ট প্যান্টের আবরণে মুড়া সামনের সুদর্শন লোকটি শান্ত স্বরে বলল,
“ভেতরে আসতে দিবে নাকি এখানেই দাঁড় করিয়ে রাখবে?”
চরম পর্যায়ে বিস্ময় হতবাক কাটিয়ে কিছু বলার পূর্বেই “কে এসেছে রে আম্মা?” বলতে বলতে আনতারা বেগম এগিয়ে এলেন। দরজার ওপারে নতুন জামাইকে দেখে তিনিও বিস্ময়ে তব্দা খেলেন। হতবাকে একবার তিনি নতুন জামাইকে দেখে আবারও মেয়ের দিকে ফিরলেন। আকস্মিক ঘটনাটা উনাকে বাকরুদ্ধ করে তুলেছেন। অত্যন্ত ভদ্র ভাবে ইহামই প্রথম সালাম জানাল,
“আসসালামু আলাইকুম ফুপি। ভালো আছেন?”
ঘোর কাটিয়ে উঠতে না পারলেও স্তম্ভিত ফিরল আনতারা বেগমের। তিনি আহ্লাদ গলায় জানালেন,
“ওলাইকুম আসসালাম বাবা। আসো ভেতরে আসো।”
ইহাম ভেতরে প্রবেশ করতে করতে ঠোঁটে খানিক হাসি তুলে জানতে চাইল,
“আমাকে বোধহয় আশা করেন নি এইসময়ে। তবুও চলে এলাম।”
ভদ্র মহিলা বিব্রত বোধে পড়লেন। নতুন জামাইকে এখনো দাওয়াত করা হয়নি। অথচ জামাই নিজ থেকেই চলে এসেছে। যদিও তিনি জানেন মায়রা এখানে বলেই হয়তো জামাই এসেছে। কিন্তু উনার ভাবি তো কিছু জানায়নি। সে হিসাব উনি পরে করে নিবেন ফাতেমা বেগমের সাথে। মুখে অল্প হাসি ফুটিয়ে তিনি জবাব দিলেন,
“আসলে বাবা তুমি তো নিজের চাকরিতেই বেশি ব্যস্ত থাকো চট্টগ্রাম। ঢাকাতেও খুব বেশি আসা হয়নি এই কয়েক মাসে তাই আরকি..”
“ঠিক আছে ফুপি আপনি শান্ত হোন। এত টেনশন করতে হবে না। এই গুলি একটু রেখে দিন প্লিজ।”
পাঁচ প্যাকেট মিষ্টি আর অনেক গুলি ফলমূল। হাত ভর্তি প্যাকেট গুলি দেখে আনতারা বেগম কড়া গলায় বললেন,
“এত কিছু কে আনতে বলেছিল তোমায়? কে খাবে এসব? এতসব আনার কি দরকার ছিল?”
“প্রয়োজন ছিল ফুপি। যতই হোক নতুন জামাই বলে কথা।”
ইহাম মায়রার দিকে তাকিয়েই কথাটা বলল। মেয়েটা এখনো বোধহয় বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলাতে পারেনি। তাই তব্দা খেয়ে এখন অবধি দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। ইহাম কে ওদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আনতারা বেগম চাইলেন। মায়রা কে জোর গলায় বললেন,
“কিরে মেয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জামাই কে নিয়ে মিথিলার পাশের রুমটায় যা। একটু হাতমুখে পানি দিয়ে বিশ্রাম করুক।”
মায়রা একটু নড়েচড়ে উঠল। শান্ত চাউনি দিয়ে দেখল ইহাম কে। তার মাঝে কালকের এত বড় একটা অঘটনের কোনো রেশও দেখতে পেল না সে। মনেমনে বারবার ভাবতে লাগল এই লোকটা এখানে কেন? চট্টগ্রাম থেকে এলোই কবে?
মায়রার পিছুপিছু এগিয়ে গেল ইহাম। ঘরে ঢুকে আগে দরজা লক করল। তাকিয়ে দেখতে পেল মায়রা অদূরে চুপটি করে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। খুব বেশি প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ধীরে এগিয়ে গেল। মায়রার কাছাকাছি গিয়ে মৃদু স্বরে ডাকল, “মায়রা” বলে। ফুঁসে উঠল মেয়েটা। এতদিনের জমানো রাগ জেদ আর দমিয়ে রাখতে পারল না। অকস্মাৎ ইহামের বুকে ধাক্কা মারল। চোখ ভর্তি পানি নিয়ে ক্ষোভ মিশিয়ে শুধালো,
“কেন এসেছেন আপনি? কি চাই এখানে?”
ছেলেটা খানিক নড়ল আশাতীত ঘটনাটায়। তবুও ক্ষেপল না সে। বরং শান্ত গলায় বলল,
“মায়রা শুনো।”
“তোর কোনো কথা শুনব না আমি। তুই কেন এসেছি এখানে? চলে যা।”
“মায়রা তুই তোকারি কিন্তু আমি একদম সহ্য করতে পারি না। সাবধান করছি।”
“তাতে আমার বা*ল ছেড়া। তোর মতো অসভ্য লুচ্চা ব্যাটা কে আমি সম্মান দিব? তুলুতুলু করব ভেবেছিস? তুই একটা খারাপ লোক।”
চোখের পানি ছেড়ে আবারও ধাক্কা দেবার জন্যে যেই দুই হাত বাড়িয়েছে ওমনি ক্ষিপ্র ইহাম তার বাহু আঁকড়ে ধরল। গরম চোখের ভাষায় শান্ত ভাবে শুধালো,
“এসব কি ধরনের ব্যবহার মায়রা?”
“তুই একদম আমায় ধরবি না। হাত ছাড়। হাত ছাড় বললাম অসভ্য লুচ্চা ব্যাটা। চরিত্রের ঠিক নেই। প্রতারক একটা।”
মায়রা কেঁদেকেঁদে অস্থির ভাবে ছটফটালো ইহামের হাত ছাড়ানোর। ওই মানুষটা হাত ছাড়ছে না বলে বুঝি তার আরো রাগ হলো। চোখের পানির বেগ বাড়িয়ে আরো অস্থির হয়ে ছটফট করল। ইহাম চাঁপা ক্ষোভ গলায় ঢেলে হিসহিস করে বলল,
“অনেকক্ষণ ধরে তুইতোকারি করছো। শান্ত আছি বলে ভেবো না মেনে নিবো এর বেশি।”
“তুই আমার হাত ছা..”
কথাটা সম্পূর্ণ শেষ হবার আগে ইহাম দাঁত পিষে আগুন চোখে তাকাল মায়রার দিকে। আচমকা ডান হাতের মুঠে মায়রার দুই হাত চেঁপে শক্ত ভাবে বা হাতে পেঁচিয়ে ধরল তার ললিত কোমর। হঠাৎ এমন আক্রমণে নুয়ে গেল মায়রা। অস্বস্তিও হলো খুব। তবুও নড়েচড়ে নিজেকে ছাড়বার প্রয়াস করল। দাঁত কটমট করে কিছু বলার আগেই ইহাম ফিসফিস আওয়াজে বলল,
“একদম চুপ করে দাঁড়াও। আর একটুও নড়লে গলা চেঁপে ধরব। অনেকক্ষণ বেয়াদবি করেছো। হয়েছে কি তোমার? এত উদ্ধতপূর্ণ আচারণ করছো কেন? এটা সিনক্রিয়েট করবার জায়গা নয় তা তোমার মোটা মাথায় ঢুকে না বলদ? ফাতরামি না করলে ভালো লাগে না তাই না? আর একটুও বেয়াদবি করে দেখো তোমার হাল কি করি আমি।”
পানি ভর্তি চোখ গুলি নিয়ে মায়রা চট করে তাকাল। নির্লিপ্ত সেই চাউনিতে শতশত বোবা অভিযোগ ঠাসা ছিল। মানুষটার লাল চোখ আর রাগান্বিত মুখ দেখে খানিক ভড়কে চুপ করল সে। নীরবেই আস্তে করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। এক চুলও নড়তে পারল না ওই বলিষ্ঠ কাঠপেটা দেহের বন্ধন থেকে। বরং ইহাম আরেক ধাপ নিজের কাছে নিয়ে এলো তাকে। শান্ত গভীর দৃষ্টি দিয়ে চঞ্চল চোখে দেখছে মায়রা কে। এই মুহূর্তে তার রাগ জেদ এর বদলে অস্বস্তি হচ্ছে। কপালে সরু সরু দাগ ভেসে উঠল তার। মানুষটার চাউনি তাকে অস্থিরতায় নিয়ে গেল। কোমল কন্ঠে মৃদু আওয়াজ তুলে বলল,
“কেঁদেকেঁদে চোখ মুখের এ কি হাল করেছো বেয়াদব মেয়ে?”
মায়রা সন্দিগ্ধ নজরে তাকিয়ে দেখল লোকটাকে। পরক্ষণে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল অন্যদিক। কোনো জবাবও দিল না। আবার শান্ত গলায় বলল ইহাম,
“এদিকে তাকাও। ত্যাড়ামি না করে এদিকে তাকাও মায়রা।”
মায়রার এবার খুব কান্না পেল। হঠাৎ লোকটার নরম গলার আওয়াজ যেন তাকে ভেতরের সব ফাঁপাটা ঝেড়ে বের করে দিতে চাইছে। চেয়েও পারছে না এই নিষ্ঠুর লোকটার সামনে না কেঁদে থাকতে। অবাধ্য বেয়াদব চোখ গুলিও তার কথা শুনছে না। অনর্গল পানি পড়েই যাচ্ছে। ইহাম আরো মোলায়েম গলায় ডাকল।
“মায়রা আমার দিকে তাকাও প্লিজ।”
কান্নার বেগ বেড়ে গেল আচমকাই। থেমে থেমে ফুঁপিয়ে উঠছে মেয়েটা। লাল লাল চিকণ ঠোঁট গুলি অনবরত কাঁপছে। ফোলো গাল গুলিও রঙ্গিম হয়ে উঠেছে। সবকিছু একবার ভালো করে যাচাই করে ইহাম মৃদু আঁচে হেসে উঠল। নীরব রুমটায় লঘু আওয়াজ তুলে বলল,
“সারারাত কেঁদেছো কি আমার জন্যে?”
মানুষটার হাসি দেখে কষ্টে বুক ফেটে গেল তার। এভাবে কাঁদছে সে আর ওই লোকটা হাসছে? তার কান্নায় হাসি পাচ্ছে পাষাণ মানুষটার? একটুও কষ্ট হচ্ছে না তার? কথা বলতে গলা জড়িয়ে আসতে লাগল। তবুও থেমেথেমে জবাব দিল,
“আ আপনার জন্যে কা কাঁদব কেন? কে হন আপনি?”
“আম ইউর হাজবেন্ট ননসেন্স।”
“একদম না। আপনি আমার কেউ হন না। ছাড়ুন আমাকে। আর এখান থেকে যান।”
“আমি তোমায় নিয়ে যেতে এলাম।”
আশ্চর্য হলো মায়রা। চকিতে বিস্ময় নিয়ে তাকাল নির্বাকে। অতঃপর বলল,
“আপনি নিয়ে যাওয়ার কে? কেন যাবো আপনার সাথে? আপনি আগে আমার হাত ছাড়ুন।”
“ওই একটুও নড়বে না। ভালো করে কথা বলছি বলে ভেবো না কাল রাতের সবটা ভুলে গিয়েছি। তাই চুপচাপ থাকো।”
“আপনার সাথে আমি থাকব না। কাল বলিনি আপনায়? এরপরেও কেন এসেছেন? ছাড়ুন আমাকে। আমি আপনার সাথে কিছুতেই যাবো না। আপনি একটা খারাপ লোক। মানুষকে ঠকান মিথ্যে বলেন। চরিত্রের ঠিক নেই আপনার।”
কেঁদেকেঁদেই কথাগুলি বলল মায়রা। মেয়েটার এমন কান্নার জোর দেখে আবারও গূঢ় হাসল ছেলেটা। এটা যেন তার ধারনা ঠিক প্রমাণ পাবার হাসি। পেছন দিকের হাতের বাঁধন ছেড়ে দিল ইহাম। বা হাতটা এখনো মেয়ের কোমর জড়ানো। ডান হাতটা দিয়ে মায়রার এলোমেলো চুল গুলি আলতো করে গুছিয়ে দিল। মায়রা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইল ইহামের দিকে। মানুষটার একটু পরপর একেক রকম আচারণ তার বিরক্ত লাগছে। যন্ত্রণা দিচ্ছে। হাত ছাড়া পাবার পর সে নিজেকে ছাড়াতে চাইলে ইহাম এবার দুই হাতে তার কোমর পেঁচিয়ে ধরে। একেবারে নিজের সাথে মিশিয়ে নিতেই মায়রা থমকে যায়। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার। নিজেদের শেষ দূরত্ব টুক ঘুচিয়ে নেয় ইহাম। মন্থরগতিতে মায়রার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে শান্ত স্বাভাবিক ভাবে হীম কন্ঠে জানাল,
“আমি সবার মতো না। অন্য পুরুষের মতো খুব বেশি রোমান্টিক কিংবা আদুরেও নই। এসব আমার স্বভাব বিরোধী। আদরে আহ্লাদে গদগদ হয়ে যাওয়া আমার ধাতে নেই মায়রা।”
মায়রা নীরবে কাঁদছে। ভেতরে তার অদ্ভুত ঝড় তৈরি হয়েছে। এত কিছুর পরও এতদিনে এই মানুষটাকে সে পছন্দ করে। তার এত কাছাকাছি আসা, শরীরের মিষ্টি সুবাস, উষ্ণ নিশ্বাসের ছোঁয়া তাকে দিশেহারা করে দিচ্ছে। তবুও এই মানুষটাকে চিনে না সে। ভেতরের কথা জানে না। ওই ছবির রেশও কাটাতে পারছে না। আর ওই পছন্দের নারী? রাগে জিদ্দে কম্পিত ঠোঁট নিয়ে মায়রা আবারও নিজেকে ছাড়াতে চাইলে ইহাম বা হাতটা দিয়ে মায়রার মাথার পিছনের দিকটা ধরে রাখল। যেন একটুও নিজের কপাল থেকে সরে না যায় মায়রা। ওভাবেই প্রশ্ন করে উঠল,
“ছবিটা কি আমার আইডিতে পোস্ট করা হয়েছিল মায়রা? ওটা কি আমি পোস্ট করেছিলাম?”
স্তব্ধ হয়ে গেল মায়রা। একদম নিস্তেজ হয়ে গেল। জড় বস্তুর মতো ঠাই দাঁড়িয়ে থাকলেও চোখের পানি তার শেষ হচ্ছে না। ছবিটা যদিও ইহাম পোস্ট করেনি। ইসরাত জাহান তনয়া নামের একটা আইডি থেকে পোস্ট করা হয়েছে। তবে ছবিতে তো মানুষটা ছিল। তাহলে? মেয়েটা শাড়ি পরাও ছিল। দেখতেও সুন্দর। কলেজের শাড়ি পরা প্রথম ক্রাশ খাওয়া মেয়েটা বুঝি ওটাই। ভেতরটা জ্বলে উঠল যেন মায়রার। তবুও তার পিঠে নিজের করা একটা অকামও মনে হয়ে ঘাবড়ালো সে।
“তনয়া আমাদের কর্নেলের মেয়ে। ও পছন্দ করে আমায়। তবে আমার দিক থেকে জিরো। শুদ্ধ সভ্য মানুষটাকে কি করে তুমি চরিত্রহীন বানিয়ে দিলে?”
উত্তর দিতে পারল না সে। স্বস্তিও পেল না ইহামের উত্তরটায়। মনে হলো লোকটা মিথ্যে বলছে তাকে। আবারও আহত সুরে বলল,
“তাতে আমার কি? আমার কিছু যায় আসে না। আপনি তো আর আমার কেউ নন যে আপনি কি করেন না করেন কে আপনায় পছন্দ করল কাকে আপনি করলেন তাতে আমার মাথা ব্যথা হবে। আপনি শুধু আমায় ছাড়ুন।”
“রাতভোর কেঁদে চোখ ফুলিয়েছো কেন তবে?”
“আপনি এসে দেখেছেন আমি কেঁদেছি?”
“তোমার চোখ মুখ ফোলা কেন?”
“আনন্দে খুশিতে। আমার মনটা আজকাল খুব ভালো থাকে তাই বেশি বেশি ঘুম হয়। এই কারণেই। এবার ছাড়ুন।”
“ওয়েট। নড়ো না একদম। আগে কথা শেষ করতে দাও। কাল যে এত বার আমি কল দিলাম তুমি রিসিভ করলে না কেন?”
মায়রা নিরুত্তর। কোনো জবাবই সে দিতে পারল না। আবার ইহাম বলল,
“সেটাও বাদ দিলাম। তবে তোমার দুঃসাহসের কথা? কাল আমায় কি পাঠিয়েছিলে তুমি? এত বড় স্পর্ধা কাকে দেখালে একবার ভেবেছিলে? পরিণতি যে ভয়াবহ হতে পারে তার ধারনা তোমার হৃদয়ে স্থান পায়নি বেয়াদব মেয়ে?”
আঁতকে উঠল মায়রা। রাগে দুঃখে জিদের মাথায় যে ভয়ংকর একটা কাজ করে ফেলেছে তার ধারণা সে রাখে। তবে পরিমাণ কি হতে পারে তার ধারনা সে কাল থেকেও মনে আনেনি।
আজ থেকে ৫ মাস আগে রিফাত নামের একটা ছেলে তাকে প্রপোজ করেছিল। তারই ভার্সিটির নাম করা বড় ভাই। অনেক বুঝানোর পর ছেলেটাকে বুঝাতে সফল হয়েছিল সে প্রেমট্রেম না করে ফ্যামিলির পছন্দে বিয়ে করবে। ছেলেটা তখন বিয়ের জন্যে প্রস্তুতও ছিল না। কি মনে করে কি বুঝল সে জানে না। তখন রিফাতই তাকে রেস্টুরেন্টে খাবার অফার করেছিল একদিন। ঝামেলার ভয়ে মায়রা রাজি হয়েছিল। তখনের কিছু ছবি না চাইতেও তুলা হয়েছিল তার। ইহামের উপর জিদ করে সেই রিফাতের সাথে একটা ছবি কাল তাকে সেন্ড করেছিল। গটগট করে লিখেও দিয়েছিল,
“রিফাতের সাথে আমার সম্পর্ক আছে। আপনার থেকে ও অনেক ভালো। ওর কাছে আমি অনেক ভালোই থাকব। আপনি প্লিজ আমাকে তাড়াতাড়ি করে ডিভোর্স দিয়ে মুক্তি দিন না। আপনাকে আমার একদম অসহ্য লাগে। আপনি খুব খারাপ আর অসভ্য একটা লোকটা।”
রাগের মাথায় কাজটা করে ফেললেও পরে বুঝেছে বিষটা টকদমই ঠিক হয়নি তার। না জানি এই ঝড় কোন দিক দিয়ে বয়ে যায়।
ইহামের নিশ্বাস ভারি হলো। ঘনঘন তপ্ত নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে বা হাত জোরালো করলো মায়রার চুলের গুছে। অদ্ভুত ঘোর লাগা কন্ঠে শুধালো,
“কি বলেছিলে মনে আছে তোমার মায়রা?”
আবারও কথার ধরণ একটু পরিবর্তন মনে হলো মায়রার। ওই কন্ঠে গা শিউরেও তুলল। ভয়ও ঝুঁকে বসল তার অন্তরের দিকে। গলা কাঁপল জবাব দিতে গিয়ে। লোকটা কেমন হিংস্র রুপে বলে উঠল,
“কি হলো বলছিস না কেন মাথা মোটা? কি বলেছিলি রাতে? কাকে কি করিস? আমার কাছ থেকে কি চাই তোর?”
তুমি থেকে তুই এ নেমে যাওয়াটা একদমই ভালো ঠেকল না মায়রার কাছে। বিষয়টা বেশ সাংঘাতিক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে তার ধারনা সে করতে পেরেছে। এবার ভয়ে তার বুক কামড়ে ধরছে। ইহাম দাঁত পিষে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
“কিরে? বল কি বলেছিলি? কি চায় তোর? কথা বল। নয়তো গলা চেঁপে ধরব বেয়াদব। উত্তর দে। আমার হাতে সময় কম। উত্তর দে হারামি।”
ভয়ে কেঁপে উঠল মায়রা। ভুল করেছে সেই অনুভবই বুঝি তাকে আরে ভয় পায়িয়ে দিচ্ছে। জড়সড় করে গুটিয়ে নিচ্ছে ভেতর থেকে। চোখ দিয়ে নীরবে টপটপ করে তিন ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। কাঁপাকাঁপা ঠোঁট দিয়ে উচ্চারণ করল,
“ডি ডিভো…”
কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারল না। তার আগেই বজ্র বেগে ইহাম নিজের ঠোঁট দ্বারা কথা বন্ধ করে দিল। আচমকা অনাকাঙ্ক্ষিত অধর স্পর্শে মুষড়ে উঠল মেয়েটা। চোখ খিঁচে বন্ধ করে ইহামের কালো শার্ট খামছে ধরে নিল। অনুভব করতে পারল মানুষটা হিংস্রতার সাথে প্রগাঢ় ভাবে আঁকড়ে ধরছে তার অধর যোগল।
বেশ খানিকটা সময় পর ইহাম নিজেকে আলগা করে নেয়। অগ্নি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে হিসহিস করে বলে,
“ভুলেও এই কথাটা আর মুখে নিবে না। আর না এই ধরনের ফাতরামি করবে। ফলাফল কিন্তু খুব বাজে হবে মায়রা। কছম দিয়ে বলছি খুবই বাজে আর ভয়াবহ হবে। জীবনের প্রথম চুমু টা আমার এভাবে দিতে হলো শাস্তি রূপে। এই ধরনের সস্তা জিদ আমাকে আর দেখিও না। চুপচাপ রেডি হও। যেতে হবে আমাদের।”
বাহির থেকে আনতারা বেগমের হাকডাক শুনা গেল,
মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১৮
“মায়রা? আম্মারে এদিকে আয়। জামাই বাবা রে নাস্তা গুলি দিয়ে আয়।”
ইহাম ছেড়ে দিতেই মায়রা আর কাল বিলম্বন করল না। ছুটে দরজা পেড়িয়ে বের হয়ে গেল।