মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪
সাদিয়া

আচমকা ঘরের ভেতরে ঢুকে এমন একটা বিভোর দৃশ্য আশা করেনি ইহাম। এক মুহূর্তের মাদকতা মিলিয়ে গিয়ে হিংস্র ক্ষোভটা কেমন বিগলিত হলো তার। রগচটা রুক্ষ মেজাজ টা সজীব হয়ে বুঝি প্রাণ ফিরে গেল। অবিলম্বে তার লাল চোখ দুটি অগ্নিগিরির মতো টগবগ করে উঠল। সেই লাভা থেকে নির্গত হওয়া তপ্ত দৃষ্টি ছুড়ল ঘরের ভেতরে থাকা অতি মাধুরী মেয়েটার দিকে।

মায়রা খুব সুন্দর করে শাড়ি পরেছে। হাফ হাতা ব্লাউজের ভেতর গলিয়ে ধবধবে ফর্শা নরম হাত গুলি সমুদ্রের বালুকার মতো চিকচিক করছে। লম্বা কোমর অব্ধি চুল গুলি উন্মুক্ত বাঁধন ছাড়া হয়ে ফ্যানের বাতাসে দিক বেদিক উড়ে চলছে। আর মেয়েটা আবলিল ভাবে শাড়ির কুচি ঠিক করে চলছে একমনে। শুধুমাত্র সে নয় যে কোনো পুরুষ চোখের সামনে এমন মোহনিয়া দৃশ্যপটে থমকে যাবে। আবেগ অনুভূতিতে মাদকতা মিশিয়ে অচিরে উচ্ছ্বাস জানাবে। ওই কামনীয় রূপে মাতোয়ারা হলেও এই মুহূর্তে ভীষণ বাজে মেজাজে আছে সে। ক্রোধে হিসহিস করছে তার বিগড়ে যাওয়া মেজাজ টা। চোয়াল শক্ত হয়ে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে রেখেছে। ওই অগ্নিফুলিঙ্গের দৃষ্টি দিয়ে আবারও চোখ বুলিয়ে নিল মায়রার অষ্টাদশীর কোমল ললিত অঙ্গে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তীব্র আক্রোশ নিয়ে শব্দ তুলে ইহাম ধড়াম করে দরজা আটকে দিল। সেই আওয়াজে মায়রা চকিতে তাকাল সামনে। ইহামের ওই অদ্ভুত লাল চোখের দৃষ্টিতে মায়রার ভ্রু আপনাআপনি কুঞ্চন হয়ে এলো। তার চিন্তিত মস্তিষ্ক ঠাউর করার অভিপ্রায়ে বিমূঢ় হলো। দেখতে দেখতেই ইহাম একদম তার কাছে চলে এসেছে। আচমকাই তার বাহু খামছে একেবারে নিজের খুব কাছে মিশিয়ে নিয়েছে অচিরে। নরম বাহুতে মায়রা খুব বেশি নখের চাঁপ অনুভব করল। ব্যথায় হাল্কা সজ্জিত মুখটা কুঁচকে এলো তার। সেদিকে বিন্দুপরিমাণ ভ্রুক্ষেপ না দেখিয়ে ইহাম দাঁতে দাঁত চেঁপে মৃদু আওয়াজে প্রশ্ন করল,
“এই মেয়ে তোমাকে না বলেছিলাম আমার সামনে শাড়ি পরে আসবে না? বারণ করার পরেও কেন একই কাজ করতে গেলে?”

মায়রা যন্ত্রণায় চোখ মুখ এক করে রেখেছে। এতক্ষণ গভীর দৃষ্টি না দিলেও ইহাম বেশ দৃঢ় নজরে তাকালও ওই শুভ্র চারু ললিত মুখশ্রীর দিকে। ওই বুজে থাকা ঘন কালো চোখের পাপড়ি রঙ যেন অমাবস্যার নিকশ কালো আঁধার। হাল্কা প্রসাধনীর প্রলেপ লাগানো তিড়তিড় করে কাঁপা ঠোঁট গুলি বড্ড ঈপ্সিত মোহিত। আতঙ্ক মেশানো ভয়ার্ত আননখানা বিস্তর মুগ্ধকর ও মনোহর। এই লাস্যময় রূপ মাধুরতা ইহামের মস্তিষ্কের নিউরন নাড়িয়ে তুলে। কড়া প্রবণতায় তার মাথা মূঢ় বিহ্বল হয়ে উঠছে। ক্ষিপ্রে চোখ বন্ধ করে নিল সে। সেভাবেই দাঁতেদাঁত চেঁপে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছে অনবরত। তবুও মায়রার বাহু থেকে এক চুল ঢিলে করল না শক্ত হিংস্র থাবা টা। অশান্ত অথচ স্থির থেকেই দম ভরে ভরে নিশ্বাস ছাড়ছে।

মায়রা তাকাল ইহামের দিকে। এই মুহূর্তে তার বুকের ভেতর উথাল ঝড় বইছে লোকটার কাছাকাছি থাকায়। লঘু অস্থিরতায় সে চঞ্চল হয়ে উঠলেও এক অবিদিত ক্ষোভের তাড়নায় দমতে পারছে না সে। পিনপিন করতে থাকা ক্ষোভটা তার চোখে সুচের মতো ধারালো হয়ে উঠল। মনে পড়ল মিথিলা আপুর সেই কথা গুলি।
“ওই বদ ক্যাপ্টেনটার কথা তুই একদম শুনবি না মায়রা। ওই লোকটা যা বলবে তুই তার উল্টো করবি। ডানে বললে বামে যাবি। দাঁড়াতে বললে শুয়ে পড়বি। যা অপছন্দ করবে সেটাই বেশি করবি। তবুও লোকটার কথা শুনবি না। কি ভেবেছে লোকটা তোকে? তুই কি হাতের মোয়া? চাইলেই পেয়ে যাবে? শুরুতেই এমন লোক কে যদি কিছু না বলিস তাহলে মাথায় চরে বসবে ওটা। তোর উপর সবসময় কর্তৃত্ব ফলাবে। ন্যূনতম দাম না দিয়ে দাসীর মতো ঘাঁটাবে দেখিস। তারচেয়ে নিজের জায়গাটা নিজে করে নে। কিছুদিন পর দেখবি এমনি সোজা হয়ে গিয়েছে। এরপর তোকে ছাড়া দেখবি কিছুই বুঝবে না। কিছুদিন পাত্তা না দিলে পুরুষ মানুষ এমনি সোজা হয়ে যাবে। নয়তো তোর উপরই চরে বসবে ওই রসকষহীন মানুষটা। পরে কপাল চাপড়েও কুল পাবি না।”

মায়রার ভেতরে এক গাঢ় দৈব্যশক্তির অনুভব করছে সে প্রবলভাবে। দৃঢ় মনটা আরো মজবুত আস্তরণে তৈরি করে নিল। আকস্মিক ক্রোধ টা দপ করে জ্বলে প্রকাণ্ড হলো তা। বিদ্বেষ নিয়ে শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নিজের বাহু থেকে ইহামের হাত ছাড়িয়ে নিল সে। ত্বরিতে ইহাম চট করে তাকাল মায়রার মুখের দিকে। হঠাৎ মেয়েটার রাগান্বিত মুখশ্রী দেখে সরু করল নিজের আঁখিপল্লব। খেয়াল করে দেখল মেয়েটা হিসহিস করছে। ছেলেটা বোধহয় আশা করেনি মায়রার এমন কাজের। তাই হয়তো সহজে আলগা হয়ে এসেছে কঠোর ভাবে ধরে রাখা হাতের বন্ধন টা।
“একদম আমার সাথে এভাবে কথা বলবেন না। এই দুনিয়ায় কি কোনো মেয়ে শাড়ি পরে না? সবাই কে কি আপনি গিয়ে গিয়ে শাড়ি পরতে বারণ করেন নাকি? আমার যখন ইচ্ছা আমি তখন শাড়ি পরব। দরকার পরলে এখন থেকে শুধু শাড়িই পরব।”

মায়রা যতটা সুন্দরি নরম স্বভাবের তার চেয়েও দেখি বেশি অভদ্র আর বেয়াদব। বড়দের মুখে মুখে কথা বলা তর্ক করা একদম টলারেট করে না ইহাম। তারউপর তার সাথেই নিজের বিয়ে করা বউ এর এই বেয়াদবি একদমই সে নিতে পারল না। তার দৃঢ় ব্যক্তিত্বে এটা মনে হয় কড়া ভাবে আঘাত করতে সক্ষম হলো। মাথায় গলগল করে বুঝি ক্রোধের উষ্ণ রক্ত বইতে লাগল ধারাপাতের ন্যায়। চোয়াল আরো দৃঢ় হয়ে উঠল তার। রক্ত চক্ষু গুলি ভীষণ ভয়ংকর ভাবে ফুটে উঠল। অবাঞ্ছিত ভাবেই ইহাম একদম চোখের পলকে মায়রা সন্নিকটে চলে এলো। বিস্তর আক্রোশ প্রতিহিংসায় সে মায়রার কোমল মোলায়েম গাল চেঁপে ধরল কঠোর ভাবে। দাঁতে দাঁত চেঁপে কটমট করে বলল,
“মেয়ে, একদম মুখে মুখে তর্ক করবে না আমার। এটা কোনো ভাবেই টলারেট করব না আমি। বেয়াদব মানুষ কে একদমই পছন্দ করি না। আর তুমি প্রথমদিনই প্রমাণ করে দিয়েছো তুমি একটা বেয়াদব।”
মায়রার দুই গাল বুঝি ভেঙ্গে আসছে। ওই কঠিন পাথর শক্ত হাতের চাঁপ যেন তার তুলতুলে গাল নিতে পারছে না। ব্যথায় গাল চূর্ণ হলেও বিদ্বেষের ছোঁয়ায় শক্ত দৃঢ় হয়ে উঠল তার হৃদয়। ক্ষোভ নিয়ে ফিসফিস করেই জানতে চাইল ইহামের কাছে।

“আর্মির একজন ক্যাপ্টেন হয়ে কি বউয়ের উপর এভাবেই নির্যাতন করবেন বলে ঠিক করেছেন আপনি? জানেন তো কারা বউয়ের গায়ে হাত তুলে? নিজেকে কি সেটাই প্রমাণ করতে চাইছেন আপনি?”
তার চতুর মস্তিষ্ক মায়রার কথার ইঙ্গিতটা ধরতে এক সেকেন্ডও ব্যয় করল না। রাগে দাঁতকপাটি আরো দৃঢ় হয়ে আসতেই সেই সঙ্গে মায়রার গালে চেঁপে ধরা হাতও তীব্র প্রখর হয়ে এলো অনিমেষ। কিছু বলতে চেয়েও পারল না সে। মায়রার মুখের কুঁচকানো ভাবে যেন স্পষ্ট হলো যন্ত্রণার কায়া। সঙ্গেসঙ্গে সে ছেড়ে দিল মায়রার কপোল। ফর্শা গালে রঙ্গিম হয়ে ভেসে উঠল আঙ্গুলের লাল লাল ছাপ। বেসামাল ক্রোধে হিসপিস করছে ইহাম। লম্বালম্বা নিশ্বাস ফেলতে ফেলতেই মৃদু ক্ষোভান্বিত গলায় বলল,
“কোনো বেয়াদব আমার বউ হতে পারে না। তোমার মতো অভদ্র একটা মেয়ে কে বউ বলেও মানতে পারছি না।”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩

মায়রার কোমল হৃদয় খুব ব্যথিত হলো ওই কঠিন কথার আঘাতে। নরম মনে সেই আঘাত ফলার মতো বিঁধল। উশৃঙ্খল পীড়া গুলি তার শ্বাসরোধ করে দিতে চাইলেও খুব চেষ্টায় ঢোক গিলে তা হজম করার প্রয়াস করল সে। বড্ড বেশি যন্ত্রণা তার চোখে পানির আকারে বের হতে চাইলেও তা সে লুকাতে ব্যস্ত হলো। নিজের উপর জোর খাটিয়ে কম্পিত কন্ঠে ইহামের কথার জবাব দিল সে।
“আমাকে বউ বলে মানার আগে আমিই আপনাকে নিজের স্বামী বলে মেনে নিতে পারছি না। আর যাই হোক কোনো দুশ্চরিত্র কাপুরুষ কে স্বামী বলে মানা যায় না।”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৫