মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩৭

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩৭
সাদিয়া

মেদিনীর বুকে সন্ধ্যা নামবে নামবে ভাব। এখনো বোধ হয় ৬ টা বাজেনি। ইহাম ঠান্ডা স্বভাবে দাঁড়িয়ে আছে ইবরাহিমের সামনে। কোনো চঞ্চলতা কিংবা অস্থিরতা নেই। আগাগোড়া সবটাই শীতল নীরবতায় ডুবে আছে। তার এই হিংস্র নীরবতাই যেন নৃশংস কোনো কিছুর পূর্বাভাস ছড়িয়ে দেয়। ইবরাহিম সূক্ষ্ম নজরে দেখে ইহামের ধ্বংসাত্মক স্তব্ধতা। সে এত গভীরে চিন্তা করেও ক্যাপ্টেনের মননের কোনো ঠাউর করতে পারছে না। শুনশান নীরবতা কে পা পিষে হঠাৎ থমথমে কন্ঠে ইহাম বলে উঠে,

“তোমার উপর আমার পরিবারের দায়িত্ব দিলাম কয়েক ঘন্টার জন্যে। বিশেষ করে আমার বউটার যেন কোনো রকম বিপদ না ছুঁই এইখানেও। গট ইট?”
ইহামের ইঙ্গিত পূর্ণ কথা চট করেই ইবরাহিম বুঝে গেল। উদগ্রীব হলো তার ভেতরও। খুব ভালো ভাবে অনুধাবন করে নিল ক্যাপ্টেন যে কোন ভয়ংকর কাজ করতে উদ্যত হয়েছে। চিন্তিত ইবরাহিম শঙ্কিত কন্ঠে জবাব দেয়,
“ক্যাপ্টেন আমিও যাবো। আমাকেও নিয়ে যান।”
“বোকার মতো কথা বলো না ইবরাহিম, আই উইল হ্যান্ডেল ইট। তোমাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এখানে। এখানে কোনো রকম অঘটন ঘটুক সেটা চাইছি না। তুমি শুধু CO কে আপডেট জানিয়ে দিও মিশন কমপ্লিট হয়নি। দেরি হতে পারে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আশপাশটায় শকুনি নজর বুলিয়ে ইহাম পা বাড়িয়ে দিতেই অদ্ভুত কাঁপন গলায় ইবরাহিম ডেকে উঠল,
“ক্যাপ্টেন প্লিজ। আপনি একা যাবেন না। এদিকটা আমি পুরো সিকিউরিটির ব্যবস্থা করছি। তবুও আমায় নিয়ে যান। ওখানে আপনি একা..”
“ইবরাহিম” মাঝ কথাতেই থামিয়ে দিল তাকে ইহাম। কাঁধে হাত রেখে সরল চোখে তাকাল ইবরাহিমের চোখের দিকে। শান্ত কন্ঠে জানাল “আমার টিমের সবচেয়ে দুঃসাহসী সোল্ডার তুমি। আমার সহকারী হওয়ার সাথে সাথে খুব আপন জনও। তোমার উপর আমার সবটা ফ্যামিলির দায়িত্ব দিয়ে গেলাম। একটুও যেন হেলাফেলা না হয় ইবরাহিম ভাই আমার।”
ক্যাপ্টেনের এই করাল খরস্রোত প্রবাহের মাঝেও শীতল কন্ঠের আবেগি স্পর্শ ইবরাহিমের ভেতরে শিরশির করে দিল। করুণ চোখে কেবল তাকিয়ে রইল ইহামের দিকে। ক্যাপ্টেন আবারও আশপাশটা জহুরি নজর নিক্ষেপ করে এগিয়ে গেল নিঃশব্দে। তার যাওয়ার পানে কেবল ইবরাহিম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ভেতরটা ভার অনুভব করছে। কেন যেন আজ খুব বেশি ভয় হচ্ছে ওই মানুষটার জন্যে।

তুহিন সেই কখন থেকে হাল্কা কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করছে নিজের বাবা মার সাথে ইহামের বাবা মা কেও। কিন্তু কেউ কোনো কিছু মুখে তুলার মতো পরিস্থিতিতে নেই। সবার মুখ ভার থমথমে। একটু আগে মায়রা কে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। চিকণ গড়নের মেয়েটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে বিছানায় শরীরে হাবিজাবি তার প্যাঁচানো। মেয়ের এই অবস্থা দেখে মায়রার বাবা মার সাথে ইসহাক চৌধুরী ও শিরিন বেগমও কেমন চুপষে আছে। মিষ্টি হাসি মাখা মেয়েটার এই করুণ হাল কিছুতেই মন বরদাস্ত করতে উদ্যত নয়। ইশশ মেয়েটার মুখটা পাণ্ডুর হয়ে আছে। যেন যন্ত্রণায় নীল হয়ে গিয়েছে। বিষাদ অম্বরের টুকরো বুঝি নেতিয়ে রয়েছে বিছানায়। উপস্থিত সব গুলি মানুষের হৃদয় কাঁদছে। তাদের মনের সবটুক চাওয়া ওই মেয়েটা চোখ খুলুক। সব ঠিক হোক। ইহাম স্বস্তি পাক।

“আন্টি প্লিজ আপনি অন্তত কিছু একটা মুখে নিল। আম্মুকেও একটু খাওয়ানোর চেষ্টা করুন। আপনারা এরকম করলে পরে তো হসপিটালের একটা বেডের পরিবর্তে কয়েকটা বেড দরকার হবে।”
তুহিনের কথায় ধীর ভাবে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালেন শিরিন বেগম। শান্ত দৃষ্টি মেলে দেখলেন তুহিনের পাংশুটে মুখটা। একে তো নিজে অসুস্থ তারউপর আদরের বোনের অবস্থায় ছেলেটা যতটা শক্ত দেখাতে চাইছে ততটা যেন কুলিয়ে উঠতে পারছে না। ঠিক আদলের কোথাও না কোথাও ব্যথার আনাগোনা স্পষ্ট। বড্ড মায়া হলো শিরিন বেগমের। তিনি ফোস করে দম ছাড়েন। সত্যি বলতে ছেলের বউ এর চিন্তায় উনার খিদেও পাচ্ছে না তেমন। পাশেই বসে আছেন ইসহাক চৌধুরী। উনার মুখের গভীর চিন্তার ছাপ। নির্মল চাউনিতে শিরিন বেগম তাকিয়ে আছেন স্বামীর দিকে। কিছু বলবেন তার আগেই তুহিন জোর দিয়ে বলল,

“আঙ্কেল আপনি তো অন্তত আমাকে একটু সাহায্য করুন। আপনারা সবাই যদি এরকম করেন তো সবাই কে সামলানো আমার একটা পক্ষে কি করে সম্ভব? আপনি একটু আব্বুর মুখে খাবার দিন। সকাল থেকে কিচ্ছু খায়নি।”
ইসহাক চৌধুরী মায়া মায়া চোখে তাকালেন তুহিনের দিকে। ছেলেটা খুব ভালো, ভদ্র নম্র মনের। পরিবারের প্রতি আলাদা টান আর দায়িত্ব টাও আছে। যেটা আজকালকার ছেলেদের ভেতর খুব একটা পাওয়া যায় না। সন্তুষ্ট হলেন তা উনার অভিভঙ্গি তে স্পষ্ট। পাশ ঘুরে একবার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ওপর পাশে চেয়ে দেখেন ক্লেশে ভারাক্রান্ত দুই বাবা মা কে। যাদের চোখে মুখে সবটুকু জুড়ে আদরের সন্তানের জন্যে যাতনা নুড়ে পড়ছে। তিনি এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলেন ওপর পাশে। স্বামীর দেখাদেখি উঠলেন শিরিন বেগমও।

“যাও কিছু খেয়ে নাও গিয়ে।”
রুক্ষ স্বরে বলা কথাটা শুনে মাথা তুলে তাকায় শিফু। এতক্ষণ হাত পাঁচেক দূরে বসে সবটাই দেখছিল সে। যত তুহিন ভাই এর দিকে চোখ যাচ্ছে, হৃদয়টা যেন তত পুড়ছে। খুব করে চেয়েও ভেতরের ওই দুরুদুরু শব্দ কমাতে পারছে না শিফু। সেই সাথে গলাও খুব ভারি একটা কিছু ঠেকে আছে। যেটা তাকে নিশ্বাস নিতে দিচ্ছে না কোনো ভাবে। এই বুঝি কেউ গলা চেঁপে ধরল তার।
“কি হলো? যাও গিয়ে কিছু মুখে দাও।”
“আপনি খেয়েছেন ভাইয়া।”

“এই মেয়ে একদম ভাইয়া টাইয়া বলতে হবে না তো। আমার বোন আছে। আমার আর কারো মুখে ভাইয়া ডাক শুনার প্রয়োজন নেই। তোমার মুখ থেকে তো সেটা একদম শুনতে চাই না। তাই আর ভাইয়া ডাকবে না।”
“ঠিক আছো তাহলে তুহিন বলব। কেমন?”
শিফুর কথায় তুহিন কপাল কুঁচকে এক বার তাকাল ওর দিক। পরক্ষণে দৃষ্টি ফিরিয়ে মুখ ঘুরালো। শিফুরও কপাল কুঁচকে এসেছে। ভেবেছে এটা বলার পর তুহিন ভাই হয়তো রাগ করবে কিংবা তাকে ধমক দিবে।
“আপনি খেয়েছেন?”
“আমার খাওয়া দিয়ে তুমি করো কি? তোমাকে খেতে বললাম তাই করো গিয়ে।”
“আপনি তো অসুস্থ।”
“তাতে কি? তোমার দেখছি খুব দরদ? তখন বলেছি না? মলম যেহেতু নিজে লাগাতে পারবে না তখন মলমের কথা বলতেও আসবে না। চুপচাপ গিয়ে খেয়ে নাও।”
ফোন হাতে নিয়ে হনহন করে তুহিন করিডোর পরিয়ে চলে গেল। তার যাওয়ার পিছনে শিফুও এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। তুহিন ভাই এর এই এড়িয়ে যাওয়াটাও কেমন যেন তাকে আরো ভার করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর সূক্ষ্ম ভাবে খুচাচ্ছে কিছু।

নিস্তব্ধ নিঝুম রাত ধীরেধীরে দীর্ঘসূত্রিতা টানছে। আশেপাশে সব কিছু শুনশান নীরব। নির্ঝন রাস্তার আশেপাশে কোনো রকম কোনো মানুষ, কোলাহল কিছু নেই। কেবল ফাঁকা রাস্তার দুইধার দিয়ে আসা অদ্ভুত পোকাদের শব্দ পরিবেশটা গমগম করে তুলছে।

রাত তখন ১০ টা বাজে। ইহাম তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে আছে বাংলোটার দিকে। আশেপাশে হাত বিশেকের মাঝে কোনো বাসা বাড়ি নেই। গোপন কাজ করার জন্যে হারামজাদা টা ভালো জায়গায়ই বেছে নিয়েছে। শুধুশুধু তো আর গোপনে সে অন্য কে দিয়ে খুঁজ নেয়নি। স্বাদে কি আর ঝামেলা পুহিয়ে নিজের মিশন অন্য কে দিয়ে এক্সচেঞ্জ করায়? এখানে এসেছেই তো হাসিবুল্লাহর থেকে ওই বেয়াদব মেয়েটাকে সেইফ রাখবে বলে। আর ওই জা’নোয়ারের বাচ্চা কি করল? ওর জন্যে মায়রা আজ হসপিটালের বেডে নিস্তেজ? ওই কুলাঙ্গারের জন্যে মায়রা আর তার সাথে কথা বলছে না তার দিকে তাকাচ্ছে না? হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ইহাম দাঁত চেঁপে। চোখ দিয়ে তখন হিংস্রতার দলা দলা আগুন বের হচ্ছে। ধারালো চোখে ক্রোধের মতো ভেসে উঠছে মায়রার নিস্তেজ অবস্থাটা। মাথায় ক্ষিপ্ত ভাবে কিলবিল করে উঠল আযহারের পরিণতি। মনে অঢেল বিদ্বেষ পুষে শক্ত চোয়ালে এগিয়ে গেল।

বাংলোর আশেপাশেও তেমন কোনো গার্ডের দেখা পাওয়া যায়নি। পা বাড়াতে বাড়াতেই পিছনে গুঁজে রাখা ৩০ রাইন্ডের Type 56 Rifle টা বের করে। শুঁকুনি নজরে আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করে থম ধরে দাঁড়ালো মেইন দরজার সামনে। চতুরতার সাথেই পাশ থেকে একটা ঢিল ছুঁড়ে মারল দরজার দিকে। এতে দুইটা কাজ হবে, আধুনিক প্রযুক্তির কোনো সিকিউরিটি ব্যবস্থা থাকলে সেটাও জানা যাবে, আবার ভেতর থেকে কেউ কৌতূহল কিংবা সতর্কতা কোনো একটা কিছু ভেবে তো বের হবে।

দরজা খুলে একজন কে ইতিউতি করতে দেখে ইহামের ধূর্ত মস্তিষ্ক টা মুহূর্তে ধরে নিয়েছে এখানে খুব বেশি সিকিউরিটির ব্যবস্থা নেই। আযহার যে এখানেই আছে সে ১০০% শিউর হয়েই এসেছে। মুহূর্তে ম্যাগাজিনে লোড থাকা গুলি থেকে বারুদের মতো বুলেট ছুড়ে দিল। সেই সাথে নিস্তব্ধ পরিবেশটাও কেমন ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠল। সাথে সাথে বাংলোর ভেতর থেকে থেমে থেমে বুলেট আসতে শুরু করেছে। ইহাম ভয়ংকর ভাবে পৈশাচিক হাসি হাসে। গাছের আড়াল থেকে কভার ফায়ার করতে থাকলেও তার নিশানা গুলি একটুও ভুল হচ্ছে না। কাবুকায়দায় ঠিকই গা ঘেঁষে লাগছে।

এক পর্যায়ে বাংলো থেকে যখন গুলি ছুড়া বন্ধ হলো তখন ইহামের রি’ভেলবারের ম্যাগাজিনে রাউন্ড শেষ। কোনো রকম রিস্ক নিতে চায় না বলে আগেই ইবরাহিমের পি’স্তলটা নিয়ে এসেছিল। Glock 17 9mm মডেলের পি’স্তলটায় ১৭ রাইন্ড ফুল আছে। সেটা হাতে নিয়েই সন্তপর্ণে পা বাড়ায় ভেতরের দিকে। মুহূর্তে হকিস্টিক নিয়ে কেউ একজন আক্রমণ করে তার দিকে। সেও মূলত প্রস্তুতই ছিল। এই পর্যায়ে শুরু হলো হুলুস্থুল। আযহার পাটোয়ারি দুপুর থেকেই ভয়ে কুঁকড়ে আছে। এই মুহূর্তে ইহামের হিংস্র চোখ আর ক্ষোভান্বিত মুখশ্রী দেখে তার কলিজা শুকিয়ে আসে। কেউ যেন ওর নারকীয় তাণ্ডব বন্ধ করতে পারছে না। ছেলে যে দানবীয় হয়ে উঠেছে।
একে একে সব কটাকে কাবু করে ইহাম এগোয় আযহারের দিকে। ওই আগুন লাল চোখ দেখে ভয়ে তার আত্মা কেঁপে উঠলেও নিজেকে সামলানোর চেষ্টা চালায় আযহার। পরপর শুকনো ঢোক গিলে। মরুভূমির মতো চৌচির হয়েছে গলার স্থল।

“দে দেখ” চোখে মুখে আযহারের সূক্ষ্ম আতংক। গলায় কাতর ভাব। “আ আমরা বসে কথা বলি। তুই শুধুশুধু হাইপার হচ্ছিস।”
ইহাম জবাব দেয় না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মন্থরবেগে পা চালায় আযহারের দিকে। ততই যেন ভীতু ছেলেটা আতংকে মূর্ছা যায়। ইহাম কোন ধাতুর লোক? কি করে তাকে কাবু করা যাবে? কি ভাবে তার কথা গুলি শুনানো যাবে এই দানব কে? ভাবে আযহার পাটোয়ারি।
“দে দেখ ভাই। তুই আমায় বল তোর কি চায়। তোর যা চাই আমি তাই দিবো। তবুও একটু শান্ত হয়ে বসে আমার কথা শুন।”

ইহামের কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌঁছায় কিনা তা সন্দেহ। চোখ মুখ চোয়াল এখনো প্রগাঢ় কাঠিন্যতায় ছেয়ে আছে। আগ্নেয়গিরির মতো রঙ্গিম আভা মুখাবয়বে। আগের মতোই হাতে রি’ভেলবার নিয়ে এক পা একপা করে এগিয়ে যায় আযহারের দিকে। ছেলেটা ভয়ে দেওয়ালের সাথে লাগানো সোফায় গিয়ে জড়সড় হয়ে বসে। ইহাম এদিক ওদিক তাকায়। পাশ থেকে একটা কাঁচের টিটেবিল টেনে সেখানেই শরীর ছেড়ে বসে। দুই হাটুতে দুই বাহু ঠেকিয়ে শরীরটা অনেকটা নিচের দিকে ঝুলিয়ে নেয়। ডান হাতের আঙ্গুলের মাঝে এখনো সেটা হেয়ালিপনার ছলে দেখা গেলেও বুঝায় যায় পরিকল্পনা নিয়ে বসেছে। তাই কোনো রকম চালাকি করার সাহস পেলো না আযহার পাটোয়ারি। ফেণীতে দাপটে চলা এক মাত্র প্রভাবশালী রাজনীতি বিদ আযহার পাটোয়ারি বাংলাদেশের এক দুঃসাহসী বীর সোল্ডারের সামনে কাছুমাছু করে বসে আছে।

ইহাম ওভাবেই নিচের দিকে ঝুঁকে বসে রইল কয়েক পল। আস্তেধীরে মাথাটা তুলে তার দিকে তাকাতেই থমকে যায় আযহার পাটোয়ারি। ফাহাদ ইহাম চৌধুরীর মুখে ওই ভয়ংকর এক হাসি দেখে তার বুক কাঁপে। মাত্রই না এই ছেলেটা লাভার মতো দেখালো। এখনো যে শরীর ছমছম করে দেওয়া শীতল চাউনি দিয়ে কি ভাবে হাসছে তার দিকে। নীরব এই রাতে একা বাংলোর ভেতর পড়ে আছে কয়েকটা নিথর দেহ। তাই বুঝি তার আরো গা ছমছম করছে। ভীত ঢোক গিলল আযহার।

“কিরে ভয় পাচ্ছিস?”
“তুই একটু নরমাল হো ভাই। আ আমরা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলি। তোর সব চা চাহিদ আমি পূরণ করব কথা দিলাম।”
চোখ বন্ধ করে ইহাম রুম কাঁপিয়ে হেসে উঠল। তার ওই বিদঘুটে হাসি কক্ষ জুড়ে বারবার বারি খেয়ে আরো প্রলয়ঙ্করী কোনো ধ্বনি শুনালো। হাসতে হাসতে যখন ভয়ে আযহারের ঘাম ছুটল তখন আপনাআপনি কেমন ধীর স্থীর হলো ইহাম। আবারও চোখ মুখে প্রবল ক্ষোভ আর বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে তাকায় আযহারের দিকে। বিক্ষোভ মেশানো কন্ঠে চিবিয়ে বলে,
“তুই কার গায়ে হাত তুলেছিস জানিস? এই জা’নোয়ারের বাচ্চা মা’তার। কার দিকে হাত বাড়িয়েছিস আঘাত করার জন্যে? ভেবেছিস এই কয়েক ঘন্টায়?”
ইহামের কন্ঠের আশপাশ ঘেঁষে ক্ষোভ আর তীব্র ক্রোধের ফুলকি ঝড়ছে। আযহার আবারও ঢোক গিলে। প্রাণনাশের ভয় হয় তার গাঢ় করে।

“এই জাউড়ার বাচ্চা হারামজাদা তুই কারে কষ্ট দিয়েছিস জানিস? তোর কারণে আমার প্রাণপ্রিয় বেয়াদব নারীটা হসপিটালে কি করে শুয়ে আছে জানিস তুই? নিস্তেজের মতো চোখ বন্ধ করে রেখেছে। একটা বার আমার দিকে তাকাচ্ছে না। বেয়াদব টাকে বললাম উঠতে নয়তো লাশ মাটিতে গড়াগড়ি খাবে। তবুও শুনল না সে। এবার দেখ তোর কি করি আমি।”
“আ আমি…
“হ্যাঁ তুই। তুই যতটা কষ্ট দিয়ে আমার বেয়াদব স্ত্রী কে হাসপাতালের বিছানায় শুয়িয়েছিস, বিশ্বাস কর তার চেয়ে হাজারগুন বেশি কষ্ট দিয়ে আমি তোকে কবরে সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে শুয়াব। যা ক্যাপ্টেন ফাহাদ ইহাম চৌধুরী তোকে কথা দিলো।”

শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল ঘাম ছুটে আযহার পাটোয়ারির। হাত পা কাঁপে অনবরত। ভয়ার্ত কম্পিত চোখে চেয়ে দেখে ভয়ংকর পুরুষটাকে। কখনো চোখে দেখা দিচ্ছে তীব্র অনল তো কখনো হীম শীতল স্থির চাউনি। কলিজা থরথর করে তার। কিছু বুঝে উঠার আগেই ওই হিংস্র মানুষটা কেমন বাঘের শক্ত থাবার মতো চেঁপে ধরেছে তার পাঞ্জাবির কলার। চোখের পলক ফেলার আগেই মুখে একেরপর এক থাবাং ঘুষি দিতে শুরু করেছে ইহাম। সিংহের মতো গর্জন ছেড়ে কেবল আযহারের মুখে দিচ্ছে এলোপাথাড়ি মুষ্ট্যাঘাত।
“তুই বলেছিলি না তোকে ইনকাউন্টার ঘোষণা করতে? তাও মিথ্যে এবার দেখ তোর কপালে ঘুরে ঘুরে এখানেই জম এসে হাজির হয়েছে।”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩৬

টানা ২০ থেকে ২৫ টা মুষ্ট্যাঘাতে নাজেহাল আযহার পাটোয়ারি। ঠোঁট থেঁতলে গিয়েছে। নাক মুখ দিয়ে গলগল করে র’ক্ত বের হচ্ছে। এতটুকুতেই ইহাম যেন আজ ক্লান্ত হয়েছে। যেন ভেতর থেকে কোনো শক্তিধর তার সকল শক্তি শুষে নিচ্ছে। আযহারের কলার চেঁপে রেখেই ইহাম লম্বালম্বা শ্বাস টানে। বুকের ছাতিতে অক্সিজেনের অভাব হচ্ছে। বারবার মায়রার অসহায় করুন মুখটায় কেন ভাসছে? এই বেয়াদব মেয়েটা তাকে আর এই জনমে শান্তি দিবে না? ঘাড় নুয়িয়ে ইহাম অদ্ভুত ভাবে এক গালে হেসে উঠল কিঞ্চিৎ পরিমাণ। বিড়বিড় করে আওড়ালো “আমার বেয়াদব জান”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩৮