মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪০
সাদিয়া
ভেতর ঘর ভেঙ্গেচুরে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গুঁড়িয়ে যাওয়া বুঝি এখনো মায়রার বাকি ছিল কিছুটা। ভাগ্য মনে হয় সেটা সহ্য করেনি। তাই তো ব্যস্ত হয়ে এখনি রুমে প্রবেশ করল এক রমণী। যার চোখে মুখে ছিল কৌতূহল খানিক রাগ আর বিরক্ত ভাব। কপাল কুঁচকে রুষ্ট অভিমুখে তিনি এগিয়ে এসে কর্কশ গলায় বললেন,
“কি হয়েছে মায়রা? আমার ইহাম ওভাবে চলে গেল কেন?”
এই মাত্র তিনি বাসা থেকে এলেন। যতদ্রুত পারেন শর্টকাট একটু রান্না করে নিয়ে এলেন তুহিন আর ইহামের জন্যে। ছেলেটাকে এত বার করে বলার পরও সে রাজি হয়নি বাসায় যেতে। এই জন্যে রান্না শেষ করে কোনো রকম গায়ে পানি ঢেলে না খেয়েই তিনি এসেছেন হসপিটাল। কেবিনের দিকে যাবেন এমন সময় দেখেন ছেলে রেগেমেগে লাল হয়ে ছুটছে কোথাও। পিছন থেকে এত ডাকলেন তবুও শুনল না ছেলে। দেখে তিনি বেশ বুঝেছেন ইহাম কোনো কারণে খুবই রেগে। ভেতরে ঢুকে মায়রা কে কাঁদতে দেখে উনার সন্দেহই ঠিক হয়েছে।
“কি হলো? বলছো না কেন? কি হয়েছে? ইহাম রাগ করল কেন?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মায়রা জানে তার শাশুড়ি খুব ভালো মানুষ। তাকে যে খুব আদর করেন তিনি তাও জানে। ছেলের মতো মোটেও সারাক্ষণ ধমকায় না। মায়রা আম্মা মায়রা আম্মা বলে ডাকে। খুব কোমল মনের মানুষ তিনি। তবুও উনার সামনে উনারই ছেলে নিয়ে খোলামেলা এমন করে অভিযোগ সে দিতে পারছে না। চোখের পানি মুছে ক্ষীণ গলায় বলে,
“আমার সাথে ঝগড়া লেগেছে আপনার ছেলে।”
মায়রার কথা শেষ হওয়া দেরি কিন্তু শাশুড়ির রুষ্ট কর্কশ গলা ভেসে আসতে দেরি হলো না।
“মানে তুমি এই অবস্থাতেও আমার ছেলের সাথে ঝগড়া করেছো? কেমন মেয়ে তুমি? তোমার জন্যে আমার ছেলেটা দুদিন ধরে নাওয়া খাওয়া ঘুম টুম বাদ দিয়ে ছন্নছাড়া হয়ে ঘুরছে। পাগলের মতো করেছে আমার ছেলেটা তোমার জন্যে। আমরা তো ওকে নিয়ে চিন্তায় ছিলাম যে তোমার চিন্তায় চিন্তায় না আমার ছেলেটার কিছু হয়ে যায়। আমার ছেলেটা দুদিন ধরে পাগলের মতো ছটফট করেছে তোমার জন্যে আর তার সাথে তুমি ঝগড়া করেছো? কেমন মেয়ে তুমি?”
শাশুড়ির মুখে এমন ধমকানো রুক্ষ কথা আর এই রূপ দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে মায়রা। ছলছল চোখ নিয়ে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রয়েছে কেমন শাশুড়ির পানে। শুনেছিল মা আর শাশুড়ি নাকি এক হয় না। তারা সামান্য কারণে সেভাবে কষ্ট দিতে পারে নিজের মা সেটা কখনোই করে না। নিজের মার মতো কি আর শাশুড়ি ধৈর্য ধরে সবটা বুঝে নাকি? নিজ আর পর বলতেও তো একটা বিষয় আছে। মায়রার হৃদয় খানখান হয়ে যায় শাশুড়ির এমন ব্যবহার দেখে। আর যাই হোক কখনো ভাবেনি শাশুড়ির এমন ব্যবহারেরও মুখোমুখি হতে হয় বউদের। মূূলত এসব বাস্তবিক অভিজ্ঞাত তার সামনে কখনো তুলেও ধরা হয়নি। অনাকাঙ্ক্ষিত চাওয়া এবার ক্ষতবিক্ষত করে দিল তাই। আঘাতের এই বিস্ময় ভাব টা তাই কাটাতে পারছে না কোনো ভাবেই। শাশুড়ির চোখে মুখে সে দেখতে পেল তার জন্যে তীব্র রাগ আর বিরক্ত ভাব। তখনি কেবিনে ঢুকল ইসহাক চৌধুরী, মহিন সাহেব আর তুহিন।
“তুমি কিভাবে পারলে আমার ছেলের সাথে এমন করতে? ছেলেটা আমার ২ দিন ধরে কিছুই খায়নি, ঘুমায়নি সারাক্ষণ ছটফট করেছে পাগলের মতো। তোমার জ্ঞান ফিরছে না বলে মনে হয়েছে তার দমই বন্ধ হয়ে যাবে। সেই ছেলের সাথে ঝগড়া করতে তোমার একটুও বিবেকে বাঁধল মায়রা? কিভাবে পারলে এমন করতে?”
মায়রা একদম বিস্ময়ে জমে গিয়েছে। কষ্ট যাতনায় চোখ ভর্তি পানিটাও যেন গাল বেয়ে পড়তে ভুলে গিয়েছে। ভেতরটা কেবল ফেঁপে উঠছে গাঢ় ভাবে। মন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না শাশুড়ির এই রুক্ষতা। বারবার আঘাতে যেন তার ভেতরটা গুমোট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বুঝতে পারছে না শাশুড়ির এই কথা গুলি তার কলিজা এফারওফার করে দিচ্ছে কেন? নিজের মায়ের অনুরূপ জায়গা টা উনাকে দিয়েছেন বলে কি তার এত কষ্ট হচ্ছে? কই তার নিজের মাও তো কতসময় কত বকে কিন্তু কখনো তো কলিজায় লাগেনি। তবে আজ কেন মনে হচ্ছে কলিজাটা কেউ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে?
স্ত্রীর এমন রূঢ় ব্যবহার দেখে ইসহাক চৌধুরী মহিন সাহেবের নিকট বেশ লজ্জিত হলেন। দরজা থেকে এসে দ্রুত টেনে ধরলেন শিরিন বেগমের হাত। মৃদু আওয়াজে বললেন,
“কি হচ্ছে শিরিন? এসব কোন ধরনের ব্যবহার? নিজের বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছো নাকি? মেয়েটা অসুস্থ ভুলে গিয়েছো?”
লজ্জায় অপমানে মায়রা মাথা নিচু করে নেয়। সঙ্গেসঙ্গে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ল তার। ক্যানুলা যুক্ত হাতটাও ব্যথা ভুলে চেঁপে ধরল অন্য হাতে। উগলে কান্না আসছে তার। ঠোঁট চেঁপেও অশ্রু নিবারণে ব্যর্থ সে।
“তো আর কি করব? আমার ছেলেটার দিকে তাকিয়েছো একবার? ওর কষ্ট ওর ছটফটানি বুঝার চেষ্টা করেছো একবারও? ছেলেটা আমার ভেতর থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছে আর মায়রা কি করে তার সাথে ঝগড়া করে? ও তো অজ্ঞান হয়ে নিশ্চিতে ছিল কিন্তু আমরা তো সবাই দেখেছি ইহামের ছটফট অস্থির ভাব। কি পাগলের মতোই না করেছে আমার ছেলেটা। তুমি নিজেও তো ইহাম কে নিয়ে চিন্তায় ছিলে। যে ছেলেটার না কিছু হয়ে যায়। তবে এখন আমাকে থামাচ্ছো কেন? ছেলেটা আমার দুদিন ধরে দাঁতে কিছু কাটেনি। এসেছিলাম নিজের হাতে একটু খায়িয়ে দিব। আর এখন মায়রার সাথে ঝগড়া করে হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলো কোথাও।”
ইসহাক চৌধুরী ভেজার চটলেন স্ত্রীর পতি। এক পলক ঘাড় বাঁকিয়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা মহিন সাহেব কে দেখে আবার তাকালেন মাথা নুয়ে চোখের পানি ফেলতে থাকা মায়রা দিকে। এই অবস্থায় কত কষ্টই নয় পেয়ে কাঁদছে মেয়েটা। অতঃপর ভারী কন্ঠে বলে উঠলেন ইসহাক চৌধুরী,
“তাই বলে তুমি মায়রা কে দোষারোপ করবে? ঝগড়া হয়েছে কেন কার দোষ কার গুণ তা না ভেবেই মায়রা কে ব্লেম দিচ্ছো কিভাবে শিরিন। দোষ তো তোমার ছেলেরও থাকতে পারে। এক হাতে তো আর তালি বাজে না। আর ওদের পারসোনাল ব্যাপারে তুমি ইন্টারফেয়ার করছো কোন লজিকে? ওদের হাজবেন্ট ওয়াইফের বিষয় না হয় ওদের কে মিটাতে দাও। তাই বলে অযুক্তিকের মতো ওকে এই অবস্থায় দোষারোপ দেওয়ার সাহস পেলে কোথায় তুমি?”
স্বামীর কথায় শিরিন বেগম দমে গেলেন। একটু শান্তও হলেন। একবার হতবাক হয়ে তাকাতে ভুলেননি স্বামীর মুখের দিকে। তুহিন ততক্ষণে রাগ দেখেছি গজগজ করে চলে গেল। মহিন সাহেব মূর্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তখনো। ছেলেটা জেদ দেখিয়ে তখনি শিরিন বেগম কে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তিনি আটকেছেন বলে হয়তো রেগে চলে গেল। কিন্তু উনার ভেতরটাও তো শান্ত হচ্ছে না। মেয়ের চিন্তায় অশান্ত আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। করুন অসহায় চোখে এক বাবা তার কান্নারত মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়েকে ওভাবে দেখে বুক ফাটে উনার। তবে মুখ ফুটে না। গলার কাছে আসা কান্নাটা আটকানোর চেষ্টা করছেন খুব করে।
ইসহাক চৌধুরী বুঝলেন মহিন সাহেবের মনের বিষয়টা। আর যাই হোক কোনো বাবার সামনে মেয়েকে রুক্ষ ভাবে কথা বললে সেই বাবা নীরবে সেটা সহ্য করতে পারেন না। উনিও তো এক মেয়ের বাবা। ইসহাক চৌধুরী দেখলেন মহিন সাহেবের লাল হয়ে আসা কান্না আটকানো চোখ দুটি। খুব খারাপ লাগল মহিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে। বেডের উপর বসে নিঃশব্দে বসে মায়রা তখনো কাঁদছে।
“তুমি নিজেও তো মায়রার সুস্থতা নিয়ে চিন্তা করেছো। কত না দোয়া কালাম পড়ে আল্লাহর কাছে মেয়েটার জান ভিক্ষা চাইলে। নামাজে বসে সুস্থ করে দেওয়ার কথা বললে। তবে এখন এমন অবুঝের মতো ব্যবহার করছো কেন তুমি?”
শিরিন বেগম স্বামীর উপর থেকে চোখ সরিয়ে বেডে বসা কন্দনরত মায়রার দিকে তাকালেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে। ভেতরে কি হলো উনার কে জানে। চোখের পানিটা ধরে রেখে কোনো রকম টিফিন বক্সটা কেবিনে রেখেই দ্রুত সেখান থেকে চলে যান।
আস্তেধীরে ইসহাক চৌধুরী গেলেন মায়রার কাছে। পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ক্ষীণ আওয়াজে বলেন,
“কেঁদো না মা। তোমার শাশুড়ি একটু রাগি মানুষ। রাগ হলে কি বলে নিজেও জানে না। দেখবে একটু পর এসে তোমায় জড়িয়ে ধরে কান্না জুড়াবে। ওর কথায় কিছু মনে করো না মা। এখন তোমার শরীর ভালো?”
মায়রা নিরুত্তর ভাবে মাথা তুলে তাকায় শ্বশুরের পানে। পাশেই বাবা কে দেখে মেয়েটা আর সহ্য করতে পারে না। বাবা কে জড়িয়ে ধরে কিশোরী মন এবার শব্দ তুলে ফুঁপিয়ে উঠে। বাবার বুকের মাঝেই ফুঁপাতে ফুঁপাতে হেচকি উঠে। মেয়ের এই অস্থির কান্না মহিন সাহেব কে আর আটকাতে পারে না কোনো কিছু। লজ্জা কিংবা বিব্রত বোধ উপেক্ষা করে উনার চোখে দেখা দিল চিকচিকে পানি।
ক্রোধে মাথার রগ দপদপ করছে তুহিনের। সাপের মতো নিশ্বাস নিচ্ছে। মায়রা তার একমাত্র আদরের বোন। খুনসুটি, মারামারির সম্পর্ক হলেও বোনকে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। সেই আদরের পিচ্চি বোনটাকে তার সামনেই ওমন করে বলা কথা তার কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। তখনি ইচ্ছা হচ্ছিল ওই ভদ্র মহিলা কে একটু ঝেড়ে দিতে। নিহাত বাবার থামিয়ে দেওয়াতে কোনো রকম রাগ কে দমিয়ে চলে এসেছে সেখান থেকে। এর একটু পরই এসেছে শিফু। পিছন ডেকে বলে উঠেছে,
“তুহিন ভাই? আপনার জন্যে খাবার এনেছি। আসুন খাবেন।”
তুহিন অগ্নিচক্ষু নিয়ে তাকায় শিফুর দিকে। তিক্ত বিষাদ নিয়ে বলে উঠে,
“এই মেয়ে কি? এখন হঠাৎ করে বারবার ঘেঁষাঘেঁষি করছো কেন? কি চাই? অসুস্থ হওয়ার পর থেকে কি দরদ উতলে পড়ছে আমার উপর? অন্য সময় তো খুব গিয়ার দেখাও তবে আমি যে বারবার বারণ করছি সামনে না আসতে শুনো না আমার কথা?”
তুহিনের এই ধরনের কথায় কষ্ট পায় শিফু। তবে কিছু বলে না। বরং নিজেকে সামলে মৃদু হাসে।
“শুনেছি একটু আগে আম্মু কি করেছিল ভাবির সাথে। আপনার সামনে আপনার বোন কে এভাবে বলায় আপনি কষ্ট পেয়েছেন তাই না তুহিন ভাই?”
“…..
“ভাবি কে খুব ভালোবাসেন তাই না?”
“…..
“আপনার বোন যেমন আপনার কাছে দামী তাকে নিয়ে আপনি উদগ্রীব আমার ভাইয়াও কিন্তু আমায় নিয়ে খুব সচেতন আর ভালোও বাসে খুব করে। তো ভাই হিসেবে আমার প্রতি তার সচেতনা কি খুব ভুল? বলুন আপনি?”
ব্যঙ্গার্থ পূর্ণ হেসে উঠল তুহিন।
“জ্ঞান দিতে এসেছো শিফুটিফু? তোমার জ্ঞান চেয়েছি আমি? ওসব কিছু তোমার কাছেই রাখো। কি মনে করেছো এসবে কি বুঝাতে চাইছো বুঝতে পারছি না আমি? তুমি বোধহয় সকালের বলা কথা গুলির ঠিকঠাক মানে বুঝতে পারোনি। এই ট্রমা টা থেকে আমি বের হয়ে এসেছি। তবে ভুলে যেও না মন থেকে মুছে ফেলেছি। তোমাকে আমি নিজের করে চাওয়ার ইচ্ছাটাকে দমিয়ে দিলাম যত্ন করে। তাই জ্ঞানী বুলি ঝাড়তে হবে না। সময়ের অপেক্ষা করো। হুটহাট করে আমার সামনে এসে আমার জ্বালাটা আরেকটু বেশি করে বাড়িও না শিফুটিফু।”
তুহিন দপদপ করে চলে যায়। সেদিকে তাকিয়ে শিফুর চোখের পানি টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে। এক নজরে তাকিয়ে থেকে আপন মনে বিড়বিড় করে,
“ঠিক আছে তুহিন ভাই আপনাকে আমি সময়ের উপর ছেড়ে দিলাম। সময় কথা বলে আপনার টাই মানলাম। বুকের গহীনে আশার প্রদীপ জ্বেলে আমি না হয় প্রতিক্ষণে আপনার অপেক্ষার প্রহর গুণে যাবো।”
সব কিছুতে হাপিয়ে উঠা মায়রা একা নীরব কেবিনে বসে আছে। একটু আগে নিজের বাবা মা কেও বলেছে তারা যেন তাকে একটু একা থাকতে দেয়। মানসিক দিক দিয়ে বড্ড বিধ্বস্ত। এই মুহূর্তে সব কিছু তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে তার মস্তিষ্ক। থম মে’রে বসে আছে সে। চোখের চিকচিকে পানি গুলি শুধু পড়ছে অনাদরে। বারবার শাশুড়ির কিছু কথা কানে আসছে। লোকটা সত্যি দুদিন ধরে কিছু খায় নি? তার চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে? সত্যিই কি তার অজ্ঞান অবস্থায় উন্মাদের মতো করেছিল লোকটা? তবে কেন তার সামনেই লোকটা নিজেকে কঠিন দেখায়? তার জন্যে ওই কঠিন মনে যদি মায়া থেকেই থাকে তবে প্রকাশ করতে সমস্যা টা কোথায়? সবসময় নিজের কথা নিজের মাঝেই কেন চেঁপে রাখতে হবে তার? এবার চোখের পানি টপ করে পড়ল। পাশ থেকে নিজের ফোনটা তুলে নিয়ে কল দিল ইহামের নাম্বারে। একবার দুবার বারবার কল দিচ্ছে কিন্তু ওপাশ থেকে আর ফোন উঠছে না। এবার মেয়েটা কষ্টে মুখে হাত গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠল।
কেবিনের দরজায় খানিক শব্দ হতেই চমকে তাকায় মায়রা। অবুঝ মন বলে এই তো কঠিন পুরুষটা এসেছে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মায়রা দেখল একটা অচেনা পুরুষ তার কেবিনে এসেছে। সে দ্রুত চোখ মুছে নিল। নিজেকে একটু গুছিয়ে মাথা নিচু করতেই অপরিচিত মানুষটা মৃদু আওয়াজে সালাম দিল।
“আসসালামু আলাইকুম ম্যাম।
“ও ওলাইকুম আসসালাম। আপনি?”
“আমি আসলে ক্যাপ্টেনের টিমের লেফটেন্যান্ট ইবরাহিম ইসলাম।”
“ও..”
“ম্যাম আমি দুঃখিত আপনার অনুমতি না নিয়ে এখানে চলে এসেছি বলে। বাহির থেকে সবকিছুই শুনছিলাম। আপনার আর ক্যাপ্টেনের ভুল বুঝাবুঝি সম্পর্কেও একটু ধারনা আছে আমার।”
এই পর্যায়ে মায়রা ভীষন লজ্জা পেল। ইতস্তত করে মাথা নুয়ে নিল আরো।
“ম্যাম আপনাকে কিছু কথা জানানোর প্রয়োজন মনে করেছি তাই বিরক্ত করলাম..”
“জ্বি আপনি বলুন। সমস্যা নেই।”
“ম্যাম আমাদের অপারেশন টা ছিল বরিশাল। কিন্তু হঠাৎ ক্যাপ্টেন ডিপার্টমেন্ট থেকে ওটা এক্সচেঞ্জ করে ফেণীর মিশন টা বেঁচে নিয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে যখন আপনাদের ওখানে গায়ে হলুদ হচ্ছিল তখন আমরা গিয়েছিলাম মিশনে। সেখান থেকেই এক তথ্যের মাধ্যমে জানতে পারি আযহার পাটোয়ারি আপনাদের নতুন রিলেটিভ হতে যাচ্ছে। ক্যাপ্টেন প্ল্যান করে আমাদের কে আমাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিল। আর শুক্রবার আমরা সে হিসেবেই রেডি ছিলাম তবে যখনই খবর এলো আপনাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে তখন নিজ চোখে দেখেছি ক্যাপ্টেনের বিচলতা আর উদ্বিগ্নতা। ক্যাপ্টেন সবসময় সব পরিস্থিতি দৃঢ় মনোবলের সাথে ঠান্ডা মাথায় করে। তবে সেদিন দেখেছিলাম এক নতুন ক্যাপ্টেন কে। যার ভেতরটা কেবল উন্মাদনায় ছটফট করেছে।
মুহূর্তে আমাদের অর্ডার করলো প্ল্যান চেঞ্জ করতে। যেখানে ক্যাপ্টেন নিজের মৃত্যুর সামনে পড়েও স্থির থেকে পরিস্থিতি হ্যান্ডেল করেছে সেখানে সেই দিনটায় শুধু আপনার জন্যে দেখেছিলাম ক্যাপ্টেনের অস্থিরতা। পারেনি শুধু মাটি খুঁড়ে আপনায় বের করতে। পাগল পাগলের মতো অস্থির হচ্ছিল। ঠিক যতটুক সময় লেগেছে জানতে যে আপনাকে কোথায় রাখা হয়েছে ততটুক সময় উনি মনে হয় এক সেকেন্ডের জন্যে ঠিক ছিল না। আমাদের কে আবারও উনি নতুন প্ল্যান সাজিয়ে দিয়েছিলেন তৎক্ষণাৎ। কি কি না করেছে আপনার সেফটির জন্যে। যেখানে মিশনে এত সময় নষ্ট না করে আমরা নিজেদের জান বাজি রেখে মাঠে নেমে যাই সেখানে পদে পদে তিনি সময় ব্যয় করে সবটা সেট করেছেন যেন আপনার কিছু না হয়। উনার কথা একটাই ছিল। ‘ ভেতরে আমার বউ আছে। সে খুব দামী। তার গায়ে যেন একটা আঁচড়ও না লাগে। ‘ জ্যামার চালু হতে আর ফোর্স আসতে মিনিট ১০/২০ সময় লাগত। ক্যাপ্টেন সে সময় টুকও বাহিরে অপেক্ষা না করে ভেতরে প্রবেশ করেছে আপনার উদ্বিগ্নতায়। আমাদের বলে গিয়েছে ওই সময় টুক তিনি ভেতরে হ্যান্ডেল করে নিবেন।”
মায়রার গাল বেয়ে টপটপ করে পড়া পানি বিছানা ভিজিয়ে দিচ্ছে। ঠোঁট গুলি অনবরত কাঁপছে। শরীরটা মৃগী রোগীর মতো দুলছে। বারবার সেই দিনের কথা গুলি মনে পড়ছে তার। মানুষটা কি এই কারণেই তখন ওরকম শান্ত স্থির ভাবে সময় কাটিয়ে গিয়েছে? যার মাথার ভেতর ছিল নিখুঁত ছক তাকে সে ভুল বুঝে বলল তার নাকি কোনো চিন্তাই নেই। কতই না খারাপ ব্যবহার করল। একটু আগের বলা কথা গুলি মনে হতেই নিজেকে বড্ড অসহায় লাগল। মানুষটাকে রাগে যা মন চেয়েছে বলে দিয়েছে। কিন্তু এখন লোকটা কোথায় গেল? আসছে না কেন এখনো?
“শুধু তাই নয় ম্যাম। আপনার ওই অবস্থা দেখে ক্যাপ্টেন ভয়ংকর হয়ে গিয়েছিল। পাগলের মতো কোনো রকম ফেণীর হসপিটালে আনলে ডক্টর ঢাকায় শিফট করানোর কথা বলায় তিনি ডক্টরের সাথেও সিনক্রিয়েট করেছে। পরে যখন দেখল সত্যি আপনায় ঢাকায় নিয়ে আসতে হবে তখন ক্যাপ্টেন কোথা থেকে যে ২০ মিনিটের কম সময়েই সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার জোগাড় করল তা আসলেই অবাকের বিষয়।”
মায়রা বিস্ময় নিয়ে তাকায় ইবরাহিমের দিকে। ভদ্রলোকের মুখ দেখতে পায় না স্পষ্ট নিজের উপছে পড়া কান্নার কারণে।
“আপনি হয়তো জেনে থাকবেন এটা CMH হসপিটাল সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত। সেখানে ডক্টরের মুখে আপনার ক্রিটিকাল অবস্থা শুনে উনার সাথেও উদ্ধতপূর্ণ আচারণ করে বসেছিলেন ক্যাপ্টেন। সেই ডক্টর চাইলেই আর্মি কর্পসের কাছে নালিশ করতে পারতেন। আন্তঃবাহিনী নিয়ম ভঙ্গের কারণে শাস্তিও ছিল ভয়াবহ। ক্যাপ্টেন সেসবের কিচ্ছু তোয়াক্কা করেনি। এমনকি তিনি কাল রাতেই ফেণী গিয়েছিলেন আবার রাতেই ব্যাক করেন। আমরা সকলে দেখেছি ক্যাপ্টেনের উন্মাদনা। উনাকে প্রথম দেখাতে যে কেউ বলে দিতে পারত সেই সময়টায় উনি পাগল হয়ে গিয়েছেন। আপনার ওই অবস্থা যেন উনার মনকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছে প্রতিটা ক্ষণে।
মায়রা এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা আর অসম্ভব কাঁপতে থাকা শরীর নিয়ে ফোন লাগালো “পাষাণ মানব” নামে সেভ করা নাম্বারটায়।
হসপিটাল থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে ইহাম। মন মেজাজ তার খুবই তিক্ত। সব কিছুতে বিরক্তের ছোঁয়া। রাগে শরীরটা দপদপ করে জ্বলছে। মায়রার কথা গুলি তার মনে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে শরীর নিয়ে বলা কথা গুলি। সে আসলেই শরীর ছোঁয়ার বাহানা করে? কথাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে তার। খিটখিটে মেজাজে আবারও চোখ বন্ধ করে আনে সে। গাড়ি থেকে বের হয়ে একটা সিগারেট জ্বালায়। অস্থির ভঙ্গিতে সেটা টানতে থাকে। তার মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। মায়রার কথা গুলি হজমই করতে পারছে না। হঠাৎ নিয়মের স্রোতে চলা জীবনটায় কি হলো বুঝতে পারে না সে। মেয়েটার ওই বোকা আচারণ কথা যেমন সহ্য করতে পারে না আবার কথা না বলেও থাকতে পারে না। দম বন্ধ হয়ে আসে এমন লাগে। সব কিছু তখন বিরক্ত মনে হয়। এই যে এই মুহূর্তটা না পারছে কথা গুলি হজম করে নিতে আর না পারছে মেয়েটার সাথে কথা না বলে একদণ্ড স্বস্তি পেতে।
“মায়রা মায়রা, আমায় পাগল করে দিয়েছিস তুই মায়রা। আমি এখন আমার মধ্যে নেই। আমার সবটা তুই কিভাবে কন্ট্রোল করছিস বেয়াদব মেয়ে? তোর মতো মাথামোটা কি করে আমায় ডেস্পারেট বানিয়ে দিচ্ছে। আমি টোটালি আউট অফ কন্ট্রোলে চলে যাচ্ছি মেয়ে।”
চিবিয়ে চিবিয়ে একাই বলতে থাকে উদ্বিগ্ন হয়ে। কেমন অস্থির অস্থির দেখায় তাকে। ছটফট করছে যেন তার চিত্ত। যেন ভেতরের দাবানলে স্থির হতে পারছে না সে। সেই কখন থেকে ফোন ভাইব্রেট করে যাচ্ছে অথচ চেয়েও দেখছে না ইহাম। কিছুই মনঃপুত হচ্ছে না তার। একটা সময় ফোনের আওয়াজে বিরক্ত হয়ে গাড়ির ভেতর থেকে ফোন নিয়ে এসে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ায় আবারও।
স্কিনে তাকিয়ে অবাক হয় ইহাম। কপাল কুঁচকে আসে তার। মায়রা, বাবা, মা, তুহিন এমনকি ইবরাহিমের নাম্বার থেকে অসংখ্য বার কল এসেছে। খেয়াল করে দেখে ৫৮ টা কল এসেছে মায়রার নাম্বার থেকে। ভ্রু জড়ো হয়ে আসে ইহামের। সবাই হঠাৎ করে এত কল দিচ্ছে কেন? মায়রার ফোন থেকে আজ কেনই বা এত কল এলো? নাম্বারটায় কল দিতে যাবে তার আগেই আবার ইবরাহিমের নাম্বার থেকে কল এলো। সময় নষ্ট না করতেই ওপাশ থেকে ইবরাহিমের হাপানোর আওয়াজ আসে। মনে এক নিদারুণ ভয়ের বীজ রোপন হয় ইহামের। শুকনো ঢোক গিলে। আবার কোনো বিপদের শঙ্কায় দিশেহারা হয় তার হৃদয়। কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে ইবরাহিম ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করে,
“কো কোথায় আপনি ক্যাপ্টেন?”
শুকনো ঢোক গিলে নেয় ইহাম। ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন করে,
“কি হ হয়েছে ইবরাহিম? সব ঠিক আ আছে তো?”
“ক্যাপ্টেন আপনি তাড়াতাড়ি আসুন। এদিকের অবস্থা ভালো নয়।”
বুক কা’মড়ে ধরে ইহামের। বিহ্বলতা বাক রোধ করে ধরে। কোনো রকম কম্পিত গলায় প্রশ্ন করে ফের।
“ক কি হয়েছে? ম ম মায়রা….”
“ক্যাপ্টেন তাড়াতাড়ি আসুন। ম্যাম পাগলের মতো চিৎকার করছে। আপনাকে খুঁজছে। কোনো ভাবেই কেউ শান্ত করতে পারছে না। কাউকে কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। বারবার আপনার খুঁজ চাইছে। ভীষণ চিৎকার চেঁচামেচি করছে আপনার জন্যে।”
ইহাম আর কথা বলার প্রয়োজন মনে করল না। কোনো রকম ফোনটা কেটে জান হাতে নিয়েই গিয়ে গাড়িতে বসল। পাগলের মতো ক্ষিপ্রে গাড়ি ঘুরায় ছেলেটা।
দুপুরের তপ্ত রোদ মাথার উপর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। গরমে শরীর দিয়ে নোনতা পানি ঝড়ছে সবার। মায়রা এখন অবধি টেস্ট করায়নি একটাও। কাছেই ঘেঁষতে দিচ্ছে না কাউকে সেই কখন থেকে। মাথায় এখনো ভীষন যন্ত্রণা। থেমে থেমেই চোখে সব ঘোলা দেখছে। সবাই কে কেবিন থেকে বের করে দিয়েছে। চোখের সামনে বারংবার ভেসে আসছে ওই লোকটার গম্ভীর মুখখানা। কানে ভাসছে “মায়রা কোনো কিছুর আড়ালে লুকাও। জলদি। খোদার কসম লাগে কোনো বেয়াদবি করিস না জান।” আরো ফুঁপিয়ে উঠে মেয়েটা। চোখ মুখে ফুলে টইটুম্বুর। চোখ গুলি ছোটছোট হয়ে লাল হয়ে এসেছে। গা শিউড়ে উঠছে তার। “ভেতরে আমার বউ আছে। সে খুব দামী। তার গায়ে যেন একটা আঁচড়ও না লাগে।” হু হু করে কাঁদে মায়রা।
মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩৯
হঠাৎ দরজায় শব্দ পেতেই চমকে তাকায় সে। উন্মাদের মতো ছুটে আসা ইহাম কে দরজার সামনে দেখেই অসহায় ভঙ্গিতে শব্দ করে কেঁদে উঠে মেয়েটা। ক্যানুলার মুখে লাগানো স্যালাইনের নলটা খুলে তৃষ্ণার্ত পাখির মতো ছুটে যায় মানুষটার কাছে। একটা সেকেন্ড সময় নষ্ট না করে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো হামলে পড়ল লোকটার বুকে। ক্ষিপ্র গতিতে একদম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিল ইহাম কে। শক্তি দিয়ে মানুষটাকে খামছে ধরে শব্দ করে কাঁদে বুকে মুখ লুকিয়ে। থেমে থেমেই শক্ত করে নেয় নিজের হাতের বন্ধনী। পারে না শুধু ইহামের তপ্ত প্রস্থ বুকের অন্তরের গহীনে লুকাতে কিংবা আত্মায় মিশে যেতে।