মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪৮

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪৮
সাদিয়া

৯ এপ্রিল।
সময়ঃ রাত ১১ টা
ইহাম বসে আছে আযহার পাটোয়ারির সামনে। চোখে মুখে কেমন চাঁপা হিংস্রতা অসম ক্ষোভ। যেন হায়নার মতো তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে একটু সুযোগের কারণে। এই বুঝি সকল হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর উপর।
এদিকে ক্যাপ্টেনের এমন ভয়াল দৃশ্য দেখে জান যায় যায় অবস্থা। ওই শান্তশিষ্ট অথচ হিংস্র তীক্ষ্ণ চাউনি দেখে কলিজা কমড়ে ধরছে আযহার পাটোয়ারির। সোফার সাথে শিঁটিয়ে বসে আছে ভীত হয়ে। চোখে মুখে জীবনের আতঙ্ক।

ইহাম টুলের উপর বসে খানিক নুয়ে একটা সিগারেট ধরালো। এক টান দিয়ে কেমন চিতাবাঘের নজরে তাকালো। যেন শিকার বসে আছে। মলিন হাসল ইহাম কিছু ভেবে।
“তুই আজ যেই মেয়েটার গায়ে হাত দিয়েছিস সে আমার কি হয় জানিস?”
খুব শান্ত ভাবে প্রশ্ন করল ইহাম। তবুও ফাঁকা ঘরে ওর কন্ঠ গায়ের লোম জাগিয়ে তুলে আযহারের। ঢোক গিলে।
“কিরে জা’নোয়ারের বাচ্চা উত্তর দিচ্ছিস না কেন?”
হঠাৎ ধমকে উঠে ইহাম। চোখ গুলিও রক্ত লাল হয়ে বড় বড় করেছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তোর নোংরা হাত যাকে ছুঁয়েছে বাই’ঞ্জোদ যেই হাত দিয়ে ওকে আঘাত করেছিস তুই ওই নারীটা আমার ব্যক্তিগত নারী। খুব কাছের। দেখ তাকিয়ে দেখ বুকের এই দিকটার একমাত্র মালকিন সে। ওই নারীটা শুধুমাত্র আমার বউ নয়। আমার বুকের অধিকারিণী কিংবা এর চেয়েও বেশি। ও আমার কি আমি সেটাই বুঝতে পারলাম না আজ পর্যন্ত আর না আমি বুঝলাম ভালোবাসা কি। আমি শুধু জানি ওই বেয়াদব নারীটা একমাত্র আমার এবং খুব দামী। ধরে নে এই দুনিয়ার সকল কিছুর উর্ধ্বে। দুর্ভাগ্যবশত আমি সেটা বুঝাতেই পারি না।”
ইহামের প্রাণহীন হাসিটা আরেকটু বাড়ল। বেদনা সুরে বলল, “আর আমার সেই দামী নারীটাকে তুই আঘাতে আঘাতে পিষ্ট করলি। হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় নিথর হয়ে পড়ে আছে সে।”

মুহূর্তে দুঃখ ভারাক্রান্ত মুখশ্রী টা কেমন হিংস্র পাষণ্ড দেখালো। আক্রোশে দাঁত খিঁচে এনে বলল আবার, “তোর জীবনটা কি আরামে সুখে কাটবে ভেবেছিস? তোকে এই দুনিয়ায় নিশ্বাস নিতে দিবো আমি ফাহাদ ইহাম চৌধুরী? এটা মনে হয় তোর?”
প্রশ্ন টা ক্ষিপ্ত সুরে ছুঁড়ে সেকেন্ড দুই শকুনি নজর দেয়। ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে আযহার পাটোয়ারি। ইহামের চোখমুখে র’ক্ত, ক্ষোভ, হিংস্র ভাব সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে তাকে কেমন ভয়ংকর অমানুষের মতো লাগছে।
“কলিজা টেনে ছিঁড়ে বের করে নিয়ে আসবো না? যার কারণে আমি ফাহাদ ইহাম চৌধুরীর ব্যক্তিগত সম্পদ হাসপাতালের বিছানায় তাকে আমি কবরে শুয়াবো। কসম।”

চোখের পলকে ইহাম কেমন বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল আযহারের উপর। হায়নার মতো ছিঁড়ে খেতে চাইল। ডান হাতের বগলের কাছে অনবরত ঘুষি দিতে লাগল। মারতে মারতে এক পর্যায়ে হাত ভেঙ্গে ঝুলে পড়তে দেখে ফোঁসফোঁস করে দম নিল ইহাম। ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে আযহার পাটোয়ারির গগনবিদায়ক আর্তনাদ দেখে বাঁকা ঠোঁটে ইহাম।
“বিশ্বাস কর আমার বেয়াদব জানের নীরব ছটফটানি আর যন্ত্রণা দেখে আমার ভেতরটা যতটা উতলা হয়েছিল যতটা কষ্ট পাচ্ছিলাম তোর আর্তনাদে ঠিক ততটাই শান্তি পাচ্ছি।”

ইহাম হাটু ভাঁজ করে নুয়ে আযহার পাটোয়ারির চুল মুঠো করে ধরে সেটা উপরে তুলে ভেতরের অগ্নিগিরি ক্ষোভের চোটে এত শক্তিতে ফ্লোরে বারি দেয় যে মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বের হতে থাকে। আযহারের চিৎকার বাড়ে আরো। নির্জন খালি জায়গায় সেই চিৎকার আরো বেশি কানে বাজে। ইহাম পাষণ্ডর মতো কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে উঠে দাঁড়ায়। পায়ের সাহায্যে তাকে উল্টো করে শুয়িয়ে পরপর দুটো গুলি করে হাটুর দিকে। এর পরের টা পিঠে। র’ক্তে ফ্লোর ভেসে যায়। আযহার পাটোয়ারির গলা দিয়ে গ্যারগ্যার শব্দ আসে। এরপর ইহাম আবার লাথি দিয়ে সোজা করে তাকে। বুকের ঠিক হৃদপিন্ড বরাবর একটা বুলেট ছুড়ে যেন বেঁচে থাকার কোনো চান্স না থাকে। পরপর আরো দুটি গুলি বুকের বা পাশে বসিয়ে দিতেই দেখা যায় জঘন্য এক অপরাধী আযহার পাটোয়ারির চোখ উল্টে গিয়েছে দেহ নিথর হয়ে এসেছে। মলিন খসখসে এক হাসি টেনে ইহাম আবারও হাটু ভাঁজ করে। ফিসফিস করে বলে,

“তোকে হাজার কুচি করার সাধটা মিটাতে পারলাম না কেবল ফরেনসিক রিপোর্টটার জন্যে। তোকে মেরেও সেই তৃপ্তিটা পেলাম না আমি জা’নোয়ারর বাচ্চা। ইচ্ছে ছিল তোর র’ক্ত মাংস নদীর জলে ভাসিয়ে দিতে। আফসোস কষ্ট থেকে বাঁচলি।”
আগের সিগারেট টা ফেলে দিয়েছিল সেই কখন। আবারও সে একটা সিগারেট জ্বালালো। নিকোটিনের তপ্ত ধোয়া টেনে পা বাড়ায় সামনের দিকে। সেই বিষাক্ত ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে একটু থমকায়। পিঠ পিছনে এক পলক চেয়ে ভীষণ গম্ভীর স্বরে আওড়ায় “ইনকাউন্ডার।”

৪ জুলাই,
রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে ইহামের। চাঁপা এক ক্ষোভে ভেতরে অগ্নিগিরি হচ্ছে। ক্যান্টনমেন্টের রাস্তা দিয়ে বেগে বের হয়ে আসছিল সে। পথিমধ্যেই সৌম্য কে দেখে থমকে দাঁড়ায়। শীতল চাউনি ছুড়ে। তাকে এভাবে তাকাতে দেখে ছেলেটা কি জানি লজ্জা নাকি অনুতাপে দৃষ্টি নত করে নিল। মাথাটা নুয়ে করুণ অপরাধের ছলে ভেতরটা ছটফট করছে সৌম্যের।

ইহাম খুব ভালো করে সৌম্য কে পরখ করল। এরপর অদ্ভুত ভাবে শান্ত স্বরে বলল, “আমি আমার প্রতিটা টিম মেম্বার কে নিজের আপন ভেবে এসেছি। মনে করেছি এটা আমার আরেকটা পরিবার। টিমের সবাই কে অন্তরের গভীরে জায়গা দিয়েছিলাম। কিন্তু হায় আফসোস আমি কাউকে বুঝাতেই পারি না কিছু। সবাই আমার উপরের রুক্ষ কঠিন ভাবটাই দেখে। আমার ভেতরের অনুভূতি গুলিকে সকলের সামনে মুক্ত করতে আমি সবসময়ই অক্ষম।”
ইহামের কন্ঠে কেমন চাঁপা একটা কষ্ট লুকিয়ে আছে যেন। সৌম্য অনুতপ্ত চোখে তাকিয়ে দেখল মানুষটার ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ বেদনার হাসি।

“আমি বোধহয় এমনই একটা কঠিন পাষাণ লোক সে ঠিকঠাক ভাবে নিজের মনের অভিব্যক্ত টা প্রকাশ করতে পারে না। আমি কি ফিল করি সেটা কেউ বুঝেও না। তাদের কাজে প্রমাণ করে দিলেও তারা যেন আমার ওই চাঁপা স্বভাবের মুখের না বলা কথার দিকেই তাকিয়ে থাকে। মানুষ এতটা অবুঝ কেন সৌম্য?”
ছেলেটা ভীষণ অপরাধে গুটিয়ে গিয়েছে একদম। চাঁপা কষ্টে কিছু বলতেও পারছে না।
“কখনো আমার কোনো কাজেই কি সেটা ফিল করতে পারোনি সৌম্য? ঠিক কোন কারণে এমনটা করলে তা আমি সত্যি বুঝতে পারছি না। আমি আমার টিম মেম্বারের কাছেই আপন হতে পারলাম না। যার কারণে আমার টিমের, আমার ভাবনার আপনজনই আমার পিঠ পিছে ছু’ড়ি মারল। এত অক্ষমতা এত ব্যর্থতা নিয়ে আমার বোধহয় চাকরিটা ছেড়ে দেওয়াই ভালো।”

ইহাম দুপদাপ পায়ে কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই কম্পিত ভেজা কন্ঠে ডাকল সৌম্য “ক্যাপ্টেন” বলে।
পা থামিয়ে ইহাম একটু ঘাড় বাঁকালো। সৌম্য কে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই বলে উঠল, “আমি সবসময় চেয়ে এসেছি আমার কারণে আমার কোনো টিমমেম্বার যেন আঘাত না পায়, ওরা যেন সবসময় ভালো আর খুশিতে থাকে। তুমি যেটা করেছো তাতে তুমি খুশি থাকলেই আমি খুশি সৌম্য।” অতঃপর খুব দ্রুততার সাথে সে জায়গা ত্যাগ করে।
কেমন পাথরের মতো বসে আছে ইহাম। যেন কোনো কিছুর গভীরে ঢুকে গিয়েছে সে। নীরবে ইবরাহিম এসে জায়গা নিয়ে দাঁড়ালো। ক্ষীণ স্বরে ডাকল। তার ডাকে ইহাম ঘাড় তুলে তাকিয়ে একটু মলিন হাসি দিতেই ছেলেটা কেমন হুড়মুড় করে তার পায়ের কাছে ফ্লোরটায় বসে গেল। খুব অনুনয়ের সাথে বলল,

“ক্যাপ্টেন আপনি প্লিজ মন খারাপ করবেন না।”
“বোকা ছেলে। পাথর কে জিজ্ঞেস করছে মন আছে কি না।”
“প্লিজ ক্যাপ্টেন ছোট ভাই হিসেবে আবদার করছি একটু সময় দিন আমাদের। আমরা সবটাই ঠিক করে নিবো। আমি মন খারাপ করবেন না।”
“উপর মহল থেকে আমাকে যদি বহিষ্কার করে তবে সেটা করতে দাও ইবরাহিম। আর কেউ না জানুক তুমি তো জানো মাথা নুয়ে থাকার মতো মানুষ নই আমি। বউ এর কারণে শখের চাকরি না হয় গেলো।”
“সৌম্য কিভাবে যে এমন একটা কাজ করতে পারল।”

“আমার টিমমেম্বার দের কে আমি আপন করতে পারিনি তুমি ওকে দোষারোপ করছো কেন?”
“কারণ ও এমনটা আমার কারণেই করেছে। ও আমায় হিংসে করে। আপনার পিঠ পিছনে আঘাত করার মানুষটাও তো সে নয়। আপনার প্রতি তার সম্মান আর শ্রদ্ধাও তো কম নয় তার। শুধু মাত্র আমার উপর ক্ষোভ প্রকাশ করতে এমনটা করে ফেলেছে। আমাকে আপনি ওর থেকে বেশি স্নেহ করেন সব কাজে মূল্যায়ন বেশি করেন এটা ওর ব্যক্তিগত ধারনা সেই ক্ষোভের বশেই হয়তো এমন কাজটা করে ফেলেছে।”
ইবরাহিমের কথা গুলি মনোযোগ দিয়ে শুনে ইহাম। এরপর সেভাবে বসেছিল সেভাবেই ঠোঁট কা’মড়ে অমসৃণ হাসল।
“হায়রে মনুষ্যজাতি! আমার চাঁপা স্বভাব আর রাগ বুঝি আমার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াবে।”

একটা সিগারেট টানতে টানতে ইহাম কল দিল মায়রার ফোনে। মেয়েটাকে তখন রাগের মাথায় এত এত কথা বলে তার ভেতরটা খুব জ্বলছে। এই হুট করে রাগ চলে আসার বিষয়টায় নিজেই ত্যক্ত সে। রাগটা মাথায় উঠে গেলে সামলে উঠতে পারছে না আজকাল। তখন কি বলে না বলে নিজেও হয়তো তা জানে না। এবার বোধহয় খুব বেশিই বাজে ভাবে বলে ফেলেছে। মেয়েটা নিশ্চয় খুব কষ্ট পেয়েছে। কেঁদেকেটে গাল ফুলিয়েছে নিশ্চয়ই।
এক ঘন্টায় মায়রা নিজেকে অনেকটা শক্ত করে নিয়েছে। মুখ চেঁপে বোবা চিৎকার গুলি থামানোর চেষ্টা করে কেবল নীরবে চোখের পানি গুলি ঝড়িয়েছে। এবার নিজেকে খুব করে শাসিয়ে দৃঢ় করেছে। তবে সেই থেকে যে একটা তব্দা হয়ে আছে একটুও পরিবর্তন করে নি তা। যেন অতি শোকে পাথর হয়ে গিয়েছে এমন।

“মায়রা? মা মায়রা রে? দরজা খোল।”
মায়ের ডাকে কোনো রকম পরিবর্তন হয়নি মায়রার মুখশ্রীর। সে সেই যে বিছানার উপর পাথরের মতো জমে ছিল এখনো তা। হাটু গুলি দুই হাতে জড়িয়ে ধরে প্রাণহীন জড়বস্তুর মতো পড়ে আছে। যেন চোখের পাতাও নড়ে না। সে জানে মা কেন তাকে ডাকছে। তবুও পুরো নির্বিকার।
“কি রে মা দরজা খোল? মায়রা?”
সাড়াশব্দ না পেয়ে ফাতেমা বেগম ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করেন, “বলছিলাম তোর ফোন নাকি বন্ধ? জামাই কল দিচ্ছিল তোকে।”

“তোমার ফোনটাও বন্ধ করে রেখে দাও। তবুও বিরক্ত করো না দয়া করে” গমগম স্বরে জবাব দিল মায়রা।
“বলছিলাম একটু কথা বলে দেখ না। ঝগড়া করেছিস? শুধু শুধু..”
মায়ের কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই মায়রা চেঁচিয়ে জবাব দেয়, “বেশি বাড়াবাড়ি করলে এখনি আমি ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাবো। দু চোখ যেদিকে যায় সেদিকেই চলে যাবো।”
মেয়ের এমন কথা শুনে ফাতেমা বেগম বাকহারা। ফোনের ওপাশে থাকা ইহামও শুনল সে কথা। গলা কেঁশে নিজ থেকেই জানাল,

“ঠিক আছে আম্মু ওকে আর বিরক্ত করবেন না। হয়তো একটু রেগে আছে ঠিক হয়ে যাবে। আমি পরে কল দিবো।”
কল কেটে দিয়ে হাসপাস করল ইহাম। দেখেছো মেয়েটা দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে? সব কিছুতে তার ত্যাড়ামি না করলে ভালো লাগে না। অথচ সে নিজের দিকটা একটু ভেবেও দেখছে না। তার ইগো যেন বিবেকের পথ আটকে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটার সাথে কথা না বলেও একদণ্ড শান্তি পাচ্ছে না। ফাঁপর লাগছে বুকটা। মস্তিষ্কে একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে, রাগে না হয় একটু বকেই দিয়েছে সে তাই বলে এত রেগে থাকবে। কাছের মানুষ গুলি কি একটুও বকতে পারবে না? আজব। বারবার ঠোঁট গোল করে দম ছাড়ছে সে।
রাত তখন ১২ টার উপরে।

ঘুমানোর আগে রোজ ইহামের সাথে কথা বলা যে মায়রার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। তাই বোধহয় আজ একটু ফাঁকাফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে কি যেন নেই সাথে। কি মনে করে ফোনটা অন করল। সাথে সাথে ম্যাসেজ বক্সটায় অসংখ্য বার্তা এসে ভীর জমালো। মায়রা সব গুলি ম্যাসেজ মনোযোগ দিয়ে দেখল।
“এ্যাই মায়রা ভুল হয়েছে এত রাগ করতে হবে কেন? প্লিজ ফোনটা তুলো।”
“মানছি বকেছি তাই বলে এতটা রেগে যাবে নাকি?”
“দেখো আমার এবার খুব রাগ লাগছে। কি শুরু করলে তুমি? একটু না হয় বকেছিই তাই বলে এমন টা করতে হবে? আর যাই হোক কথা না বলার মানে কি? মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে আমার। তুমি আগে আমার সাথে কথা বলো। সত্যি বিরক্ত হচ্ছি আমি।”

শেষের কয়েকটা ম্যাসেজ শুধু এই ধরনেরই। তা দেখে মলিন হাসল মায়রা। লোকটা বড্ড স্বার্থপর টাইপের। সবার আগে নিজেরটা বুঝে। নিজের সুবিধা অসুবিধা ভালো লাগা খারাপ লাগা তার কাছে আগে প্রাধান্য। আর বাকি কে কি ভাবল মনে করল তাতে তার কিছুই যায় আসে না। তার ব্যবহার তার কথায় আর কেউ মন খারাপ করল না কষ্ট পেল তাতে সে হয়তো তোয়াক্কা করে না। করলে কি আর এমন নীরব হুমকি ছাড়ে?
ফোনটা বন্ধ করবে এমন সময়ই তার ফোনে ইহামের কল আসে। তখন রাত ১২ টা বেজে ৪৫ মিনিট। ফোন বেজে কেটে গেলেও মায়রা কল ধরে না। আবার আসে কল। কেটে যায়। অবশেষ নিজেকে শক্ত করে কল রিসিভ করে সে।

“এই মায়রা কোথায় ছিলে তুমি?”
“….
“মায়রা কথা বলো। শুনতে পাচ্ছো না কথা?”
“….
“ওই বেয়াদব মেয়ে সাড়া দিচ্ছো না কেন?”
ম্লান হাসল মায়রা। ওপাশ থেকে লোকটার অস্থির ভাব টের পেল।
“আমাকে আপনি আদৌও মানুষ মনে করেন কিনা তাই দেখছিলাম।”
মেয়েটার থমথমে রুক্ষ গলা শুনে ইহাম স্তম্ভিত হয়। কিছু সময় নীরব থেকে নরম সুরে বলে,
“তখন রাগের মাথায় কি বলেছি মনে নেই। কিছু মনে করো না।”

ফিক করে হাসির আওয়াজ শুনা গেল। মায়রা কাঠকাঠ গলায় জানায়, “ধনুক থেকে একটা ফলা বের হয়ে গেলে সেটা কি আর ফিরানো যায় ক্যাপ্টেন সাহেব? মানুষের মুখের কথাও তেমনি। একবার বের হলে ফেরানোর উপায় বন্ধ।”
কপাল কুঁচকে আসে ইহামের। মেয়েটার হলো কি? আজ একটু অন্য সুরেই কথা বলছে যেন। বাকি সময় হলে তো রাগারাগি করে কিংবা ত্যাড়ামি। আজ এমন শান্ত অথচ একটা রুক্ষ ভাব আছে।
“লিসেন মায়রা, তুমি তো জানো আমি একটু রাগী। যখন রাগ উঠে কি থেকে কি…”

“এসব নিয়ে আমি কিছু শুনতে চাই না। আর না কোনো আগ্রহ আছে।”
“কি বলতে চাও মায়রা?”
“আমি আর কিছুই বলতে চাই না আপনাকে। আমার সব বলা ফুরিয়েছে।”
“মানে?”
“মানে হলো এটাই আমি এবার সত্যি আপনার থেকে গুটিয়ে নিলাম নিজেকে।”
“মায়রা? রেগে আছো মানলাম। তোমার মাথা ঠিক নেই। কি বলছো নিজেও বুঝতে পারছো না। কাল কথা বলব এখন তুমি ঘুমাও।”

“আমি সত্যি এতদিন বুঝতে পারিনি সব কিছু তবে এখন ঠিকটা বুঝতে শিখেছি।”
মায়রার এমন শক্ত কথায় কপালে বিস্ময়ের সাথে চিন্তার উদয় হয় ইহামের। কন্ঠে কোনো হেয়ালি নেই আর না রাগ। যেন প্রতি কথার মাঝে ফুটে উঠছে অদম্য আত্মবিশ্বাস।
“আমি একদিন আপনায় বলেছিলাম না খুব সহজে যে জিনিস পাওয়া যায় তার দাম সস্তা হয়? আমি হয়তো আপনার কাছে তেমনি কিছু একটা। খুবই নগণ্য খুবই সস্তার।”
বিস্মিত কন্ঠে শুধায় ইহাম, “এত কঠিন কথা বলছো কেন মেয়ে? এসব কি যা তা বলছো? কেন বলছো এসব? এসব তোমায় মানায় না।”

“কঠিন কথা বলে যদি কষ্ট গুলিকে ভুলে ভালো থাকা যায় তবে কঠিন কথাই ভালো ক্যাপ্টেন সাহেব।”
“দেখো মায়রা আমার কথায় হয়তো তুমি অভিমান করে আছো। আচ্ছা একটু রেগে বকেছি বলে তুমি রাগ করেছো মানছি এখন যখন আমি নিজ থেকে সবটা ভুলে বিষয়টা মিটিয়ে নিতে চাইছি তখন এসব আজেবাজে কথার মানে কি? হাজবেন্ট হিসেবে তোমাকে বকার অধিকার কি আমি রাখি না?”
“কিছু ভুল জীবনে খুব কঠিন হলেও উপকারী। হয়তো আমাদের না হওয়া সংসারে আপনার অন্ন ধ্বংস না করার একটা উপকার আমার এই সিদ্ধান্ত।”
এতক্ষণ ধৈর্য রাখলেও আর পারছে না ইহাম। মেজাজটা হুট করে চটে গিয়েছে। এতটা সময় মেয়েটার সাথে কথা না বলে কি দারুণ যন্ত্রণায় পুড়েছে শুধু সেই জানে। অথচ মাথামোটা অবুঝ মেয়েটা আর তাকে বুঝল কই? দাঁত কেটে বলল,

“বেশি বেড়ো না মায়রা। এবার বাড়াবাড়ি করছো তুমি।”
মলিন হাসল মায়রা। “আপনার বাড়াবাড়ি টা বেশি না? আমার একটু টাই আপনার কাছে বেশি বেশি?”
“ইউর ফাকিং ইমোশন।”
“সেটাই” হাসিটা চওড়া হলো মায়রার। “যার কাছে গোটা আমি টার কোনো মূল্য নেই সে আর আমার ইমোশনের কি মূল্যায়ন করবে?”
“মায়রা তোমার এই ড্রামা বন্ধ করো। আর মেজাজটা চটিও না।”
“আপনার মেজাজ খারাপ মানেই তো আমাকে কথার আঘাতে পিষ্ট করা? যা নয় তা বলে অপমান করা কষ্ট দেওয়া? এতটাই সস্তা হয়ে গিয়েছি? যে আমিও একটা মানুষ আমারও কষ্ট হয় এই ভাবনাটুকও আর আপনার মাঝে কাজ করে না? নাকি স্বার্থপর এই আপনিটা শুধুই নিজের দিকটা চিন্তা করেন? বাকি সবার অনুভূতি আপনার কাছে ফিকে লাগে?”

“ইয়েস আই এম। আমি এমনই আগে বলিনি? এত দিনেও বুঝোনি? হ্যাঁ আমার কাছে আমি ইম্পরট্যান্ট। আমার মন আমার স্বভাব আমার কাছে অনেক দামী। এনি প্রবলেম? যা খুশি করো তুমি।”
মায়রা শান্ত অথচ মজবুত কন্ঠে বলল, “এখানে আর কি করার আছে? যে সম্পর্কটা গলায় কাটা বিঁধার মতো সবসময় যন্ত্রণা দেয়, একে অপরকে সম্মান দিতে জানে না, অপর মানুষটার মন দুঃখ আঘাতের যার কোনো মূল্য নেই সেই সম্পর্কটা বাড়তে না দেওয়াই ভালো।”
ওপাশে থাকা মানুষটা বোধহয় ক্রোধে দপদপ করছে অগ্নিশিখার মতো। তার কথাগুলি বুঝি লোকটার শরীরে আগুন লাগিয়েছে। তাই বোধহয় গট করে কল কেটে গেল।

মিথিলা আপু কল করছে বারবার। মন মরা হয়ে মায়রা রিসিভ করল।
“হ্যাঁ আপু বলো।”
“কেমন আছিস শরীর সব ভালো?”
“হুম।”
“এডমিশনের প্রিপারেশন নিচ্ছিস?”
“না।”
“কেন রে? পরীক্ষা শেষ হয়েছে কতদিন আগে ধারনা আছে তোর? এভাবে না পড়লে চান্স পাবি?”

“জীবনের পরীক্ষাতে যখন ফেল করে ফেললাম তখন আর কোন পরীক্ষার আশা করব বলোতো?”
মিথিলা সাথে সাথে জবাব দেয় না। একটু সময় নিয়ে আস্তে করে বলে, “ইহাম ভাই আমায় কল দিয়েছিল।”
মায়রা শুনে একটু আশ্চর্য হলো। তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। মানুষটার সাথে কথা হয়না আজ ৬ দিন। প্রথম ৪ দিন কল না দিলেও এরপর কল দিয়েছিল বেশ অনেক বার কিন্তু সে ধরেনি। কষ্ট হয় ভেতরটা সারাক্ষণ পুড়ে নিজের ব্যর্থতা আর ওই আনন্দ মাখা মুহূর্ত গুলির কথা ভেবে। তবুও নিজেকে কঠোর বেড়াজালে আবদ্ধ করেছে। লোকটাকে ভালোবাসে তাই বলে নিজের সবটুকু ওই রাগী বদমেজাজি আর স্বার্থপর লোকটার পায়ের নিচে ফেলে ভালোবাসতে হবে? বারবার তাকে অপমান করে আঘাত দিয়ে কথা বলতে বলতে লোকটার কি স্বভাব হয়ে গিয়েছে না তা? এতটাই সস্তা?

“ভালো হয়েছে কথা বলো। আমায় বলার কি আছে?”
“তুই নাকি উনার সাথে কথা বলিস না। ঝামেলা করছিস?”
কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়েছে মায়রার। ওই দাম্ভিক লোকটা না নিজের ব্যাপার অন্যজনের সাথে আলোচনা করতে পছন্দ করে না তবে?
“কিরে আছিস?”
“হু বলো।”
“কি বলব? তুই উনার ফোন ধরিস না কথা বলিস না? কেন সেটা বল?”
“যে মানুষটা আমায় সহ্য করতে পারে না যার কাছে আমি বেশি বেশি তার সাথে আমি কথা বলতে যাবো কেন বলো তো?”

“মায়রা বেশি করছিস এবার। রাগে না হয় একটু কিছু বলেছেই তাই বলে তুই এমন করবি?”
“রাগ উনারই আছে। আর তার রাগ ঝাড়ার মানুষ কেবল আমিই। উনার যখন তখন রাগ উঠবে উনি সেটা সামলাতে পারবেন না বলে আমায় যা খুশি তা বলবে অপমান করবে কষ্ট দিবে আর তুমি সেটা মেনে নিতে বলছো আপু?”
মিথিলা একটু ইতস্তত বোধ করে। বলে, “দেখ মানুষ তো তার উপরই বেশি রাগ দেখায় যাকে সে ভালোবাসে কাছের মানুষ ভাবে। এমন না যে উনি শুধু তোকে বকাবকি করেন কিংবা রাগ দেখান যত্নও তো করে। তোর প্রতি ভাইয়া কতটা কেয়ারিং তা পরিবারের সবাই জানে। তোর থেকে দূরে থেকেও তোর প্রতি সবসময় খেয়াল রাখে ভাইয়া। শুধুমাত্র তোর হাত ধরেছিল বলে ছেলেটার কি অবস্থাই না করেছিল উনি? ফেনীর ঘটনাটাও কি ভুলে গিয়েছিস তুই? তোকে কষ্ট দিয়েছে বলে আঘাত করেছে বলে একেবারে ইনকাউন্ডার করে দিলো লোকটাকে তুই ই তো বলেছিস। তাহলে এখন এমন করছিস কেন? উনি একটু রাগী। এই তো? একটা মানুষের খালি খরাপ দিক দেখলেই চলে না। ভালো দিক গুলিও পাশে রাখতে হয়।”

“হ্যাঁ উনি আমার কেয়ার করে। যত্ন নেয়। আবার রাগ উঠলে অপমান করে আঘাত দিয়ে কথা বলতেও ভুলে না। উনার কথা একেবারে অন্তরে গিয়ে বিঁধে। তো তুমি বলতে চাইছো উনার ভালো দিক ভেবে খারাপ সাতখুন মাফ? রাগ উঠলে উনি তো আর কারো সাথে এমন করে না কেবল আমিই উনার কাছে সস্তা। আমাকে উনি মানুষ হিসেবেও কি একটু সম্মান দেয়? আঘাত দিয়ে কথা বলার সময় উনি বুঝে উনি ঠিক আমায় কতটা কষ্ট দিচ্ছে? উনার যখনই রাগ হবে আমাকে যা খুশি বলবে। যেই সম্পর্কের কোনো দাম নেই উনার কাছে আর না আছে ভালোবাসা অপর মানুষটার অনুভূতি গুলি যার কাছে ফিকে এমন টক্সিক সম্পর্ক টেনে ভবিষ্যতে আর কষ্টের বুঝা বাড়ানোর দরকার নেই।”

“ভালোবাসা শুধু মুখে বললেই হয়? কাজে বুঝা যায় না?”
“উনার ভালোবাসা প্রকাশ পায় এমন কিছু করেছে উনি?”
“তুই চাইছিস টা কি মায়রা? উনার সাথে খোলামেলা আলোচনা কর।”
“যেই লোকটা রাগের মাথায় আমায় ছেড়ে দিতে পারে, না হওয়া সংসারে ভাতের খুটাও সহ্য করতে হয় আর শুনতে হয় না পুষালে যেন চলে যাই সেই সংসারটা বাস্তবে রূপ দিতে চাই না। উনি ভালো না বাসুক আমার ভালোবাসার দাম আছে। সেটা আমি কারো অবহেলা অপমান কিংবা তোপে কারো পায়ে বিকিয়ে দিতে পারব না।”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪৭

মিথিলা চুপচাপ শুনল। মায়রাও চোখ মুখ আর কন্ঠ কেমন তেজী আর দৃঢ়। একটা কঠোর ভাব স্পষ্ট এঁটে আছে।
মিথিলা কিছু বলার পূর্বেই কানে এলো একটা হীম শীতল গাঢ় কন্ঠ, “মিথিলা তোমার বোন কে বলে দিও আমার যতটুক ক্লিয়ার হওয়া দরকার ছিল তা ডান। ওর চাওয়া আমি অপূর্ণ রাখব না। ঠান্ডা মেজাজেই বলছি ও যদি আমার নামের পাশ থেকে দূরে যেতেই চায় তবে আমি ওর ইচ্ছা কে সম্মান জানাই। ঈদের পর ঢাকা ফিরে আমি ফাহাদ ইহাম চৌধুরী ওর মুক্তির পথ করে দিবো। এন্ড দ্যাটস দ্যা লাস্ট ডিসিশন।”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪৯