মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪৯

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪৯
সাদিয়া

Operation FN-72 (Feni Sector) মিশনের সমস্ত বিবরণ দিতে গিয়ে ইহাম বিরাট এক প্যাঁচ লাগিয়েছে। সচরাচর তার কাজে কখনো তেমন ভুল হয়নি। খুব দায়িত্বের সাথে নিজের কাজ সম্পূর্ণ করে। কিন্তু ফেনীর মিশন থেকে আসার পর মাথায় কাজ করছিল কেবল মায়রা। মেয়েটা তখনো অসুস্থ অবস্থায় ছিল। একটা মাস পরই তার পরীক্ষা। সারাটা জীবনের একটা ব্যাপার। ঠিকভাবে পরীক্ষা দিতে পারবো কিনা, কবে সুস্থ হবে তা নিয়ে ইহামের মাথায় ছিল বিস্তর চিন্তা। তার রেশ ধরেই বোধহয় সিচুয়েশনাল রিপোর্ট জমা দিতে গিয়ে ৪ টা বুলেট মিসিং ছিল। পরবর্তীতে CO এ যখন তার সেই ভুলটা ধরে সহজাত ভাবে ইহাম নিজের ভুল স্বীকার করে নেয়। নিজের অপারগতা কিংবা ভুল স্বীকার করে। এর জন্যে অবশ্য সিহাবুউদ্দীন সাহেবের কাছে তার কড়া কথাও শুনতে হয়। কিন্তু বিষয়টা সেখানেই ইতি টানে।

এপ্রিলের সেই ঘটনার ভয়াবহ ফলাফল আসে জুলাই এ। জুন মাসের ২৪ তারিখ ইহাম এক্সিডেন্ট করেছিল। সৌম্যই তখন তাকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছে। এরপরে তার খুঁটিনাটি সব বিষয়ে দেখাশুনা করেছে ইবরাহিম নিজে। ইহাম বারবার বারণ করে দেওয়ার পরও ছেলেটা নিজ দায়িত্বে এসে তার কি প্রয়োজন সব খোঁজ নিয়েছে। সেদিন ক্যান্টনমেন্টের আসরে ইহাম কথার কথার বলেছিল “ইবরাহিমের কারণেই তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে পেরেছি” ওই একটা কথাই সৌম্যের মনে দাগ কেটেছিল। আগে থেকেই সে ইবরাহিম কে এতটা পছন্দ করত না। তার কারণও ইহামের তার প্রতি অগাধ ভ্রাতৃত্ব বোধ। তার ধারনা ক্যাপ্টেন সবার থেকে ইবরাহিম কেই বেশি প্রাধান্য দেয়। সেদিনের ওই কথা সৌম্যকে হিংসাত্মক এক মনোভাব এনে দেয়। পুরো দুইটা দিন ক্ষোভে পুড়ে সৌম্য CO সিহাবুউদ্দীন সাহেবের কাছে ইহামের নামে নালিশ করে। আযহার পাটোয়ারি কে নিজ ক্ষোভে খু’ন করা, মিশন কমপ্লিট করে দুইদিন লেইট করা সব জানায় উনার কাছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তখনি ইহামের মাথায় পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে। শখের আদরের চাকরি নিয়ে পড়ে টানাটানি। সিহাবুউদ্দীনের সাথে তার ভালো সম্পর্ক থাকলেও প্রফেশনাল কোনো কাজে কোনো ছাড়া নেই। সবকিছুর একটা নিয়ম বাধ্যবাধকতা থাকে। ইহামের মিথ্যে রিপোর্ট প্রদান আর দায়িত্বের প্রতি অবহেলার কারণে তাকে বহিষ্কার করার কথা উঠে। বিষয়টা নিয়ে ডিপার্টমেন্টে জানাজানি হলে সবাই আপসেট হয় ইহামের মতো একজন সৈনিকের পদত্যাগের জন্যে।

পরে তার টিম মেম্বারের সকলে এমনকি সৌম্য নিজেও গিয়ে CO এর কাছে সব কিছু বলে। আযহার পাটোয়ারির মতো এতো দাগি আসামী যাকে পুলিশ বহুদিন ধরে ধরতে পারছে না। চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, অস্ত্র পাচার, এমনকি সীমান্ত দিয়ে নারী পাচারকারী ওই কুখ্যাত দুর্ধর্ষ আসামী কি কি করেছে তার ডিটেল্স পেশ করে। সৌম্য নিজের অভিযোগের দায়ভারও নিজের কাঁধে তুলে নেয়। আযহার পাটোয়ারির অপরাধ আর ক্ষতির দিক বিবেচনা করলে প্রত্যক্ষ এবং কি পরোক্ষ ভাবে দেখা যায় ইহাম কোনো ভুল কাজ করেনি। সব দিক পর্যবেক্ষণ করে ইহাম কে কিছু কড়া নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এরপর এমন ভুল হলে সোজা বহিষ্কার করা হবে তাও জানিয়ে দেওয়া হয়। যদিও সবটা সময় ইহাম কেবল নীরব ছিল।

রমজান মাস চলে। সময় গুলিও দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। এদিকে ওই পাষাণ মানুষটাও কল করে না। নিজের ইগো নিয়ে বসে আছে। থাকুক নিজের ইগো নিয়ে বসে। আর কারো রাগ অভিমান কিছু নেই নাকি? খালি উনারই রাগ আর ইগো আছে। বাকি সবার অনুভূতি কি ফিঁকে নাকি? এদিকে বুক জ্বলে যায় মায়রার। ভালোবাসার টানে হৃদয় পুড়ে প্রতিনিয়ত। রাতের আঁধারে বিছানায় শুয়ে কেবল বালিশ ভেজায়। রোজা রেখে দিনও কাটে না তার। ভাইয়াটাও বিদেশে, কাছে থাকলে কোনো না কোনো ভাবে তাকে খুঁচিয়ে হলেও হাসাতো, খুনসুটি করত। সময় গুলি বড্ড তিক্ত যায় মায়রার। তবুও সে নিজ থেকে কল করে না ওই কঠিন পাষাণ মানবটাকে। সে ফোন দিবেও না। মায়রাও দেখতে চায় কতদিন ওই লোক নিজের ইগো নিয়ে তার থেকে দূরে সরে শান্তি পায়।

তবে এটা ঠিক ইহামের অনুভূতি সম্পর্কে সে স্পষ্ট। লোকটা তার খেয়াল রাখে, সুবিধা অসুবিধার কথাও মাথায় রাখে। তাই বলে এতটা মূল্যহীন হয়ে থাকবে নাকি? ওই কঠিন মনের লোকটা কখনো তাকে ভালোবাসা প্রকাশ, করেনি এমনকি কতদিন সে নিজ থেকে জিজ্ঞেস করেছে “আপনি আমায় ভালোবাসেন ক্যাপ্টেন সাহেব?” লোকটা নির্দ্বিধায় সবসময় না করে এসেছে। এমন গম্ভীর চাঁপা স্বভাবের কঠোর লোক এই জীবনে সে দেখেনি। সব মানা যায় তাই বলে কথায় কথায় তাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলবে? ওই লোকটার জীবনে কোনো দামই নেই তার? ওই পাষাণ মানুষটা তাকে ভালো না বাসলেও সে তো মনের সবটা দিয়ে ভালোবাসে। তাই বলে কি সব মেনে নিবে? রাগ উঠলে তাকেই কেন এভাবে কথা শুনাতে হবে। ওই লোকটা কিভাবে বলতে পারল তাকে ছেড়ে দিবে?

কলিজা চিড়া যন্ত্রণায় হুহু করে কেঁদে উঠে মায়রা। নাক টানে খুব করে। মন কি চাইছে কিছুই বুঝতে পারছে না। যোহরের নামজের সময় ২ টার দিকে বসেছিল এখন আছড়ের আজান দিবে। কোরআন তিলাওয়াত করে বসে বসে কেঁদেছে। ঢাকায় ফিরে ওই একরোখা লোকটা তাকে ছেড়ে দিবে ভাবনাটা কিছুতেই মনে আসছে না। কিন্তু সে জানে ওই জেদী রাগী লোকটা যা বলে তা করেই।

আছড়ের সময় হয়ে এসেছে। রোজার এই সময়টা তার শরীর আর যেন চলে না। সারাদিন সময় না গেলেও আছড়ের পর বিছানা থেকে উঠতে তার মনটায় চায় না। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আসে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। নাক টেনে টেনে মায়রা চোখের পানি মুছছে অনবরত। শরীর অসাড় লাগছে।
“ছেড়ে দিলে ছেড়ে দিক। তাই বলে কথার আঘাত করবে নাকি? আমার দাম যদি ওই পাষাণ লোকটার কাছে নাই থাকবে তাহলে ছেড়ে দেওয়াই ভালো। আমি কি মানুষ না? বউ হয়েছি বলে যা খুশি তাই করবে? আমার ব্যথাটা কি উনার কাছে ব্যথা লাগে না? স্বামী হয় বলে সব সহ্য করেই থাকতে হবে কেন? আমায় যদি ভালো করে আদর করে নাই রাখতে পারবে তবে রাখার দরকার নেই। আমি তো অভদ্র বেয়াদব মেয়ে। এরপর উনি না হয় আরেকটা ভদ্র আদব জানা মেয়েকে বিয়ে…”

বাকি কথা শেষ করতে পারল না মায়রা। মুখ ফস্কে বলা কথাখানা মস্তিষ্ক ধরতে পেরেই ভেতরে আলোড়ন শুরু হলো। বন্ধ ঘরে ঠোঁট উল্টে জোরেশোরে কেঁদে উঠল মেয়েটা।
আজ রোজার পনেরো। ইহাম নিজের ডিউটি করে সবে ফিরেছে। সোফায় ক্লান্ত শরীরটা হেলিয়ে দিল। খালি একটা ফ্ল্যাট। একটা সংসার করতে সাজাতে যা যা লাগে সব আছে এখানে শুধু সংসার করার মতো অপর মানুষটাই নেই। মায়রার সাথে যখন তার একটু একটু মিলামিশা হয়। ওই বেয়াদব মেয়েটার ঘাড়ত্যাড়ামি কথার অবাধ্যতায় অতিষ্ঠ হয়ে যায় সে। ঠিক যখন থেকে মনে হলো ওই বেয়াদব মেয়েটা তাকে পাগল করে ছাড়বে। ওই ত্যাড়া মেয়েটাকে ছাড়া তার দিন কেমন অসম্পূর্ণ। সব কেমন ফাঁকা লাগে কোনো কিছুতেই স্বস্তি পায়না।

তখন থেকেই সে কোয়াটারের জন্যে উঠে পড়ে লাগে। মায়রার টেস্ট পরীক্ষার পর তাকে এখানে আসতে বললে মেয়েটা যখন না করেছিল তখন তার রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছিল। ওই বেয়াদব মেয়েটা কিছুতেই নিজ থেকে তার মনের গোপন কথা আকাঙ্ক্ষা গুলি ধরতে পারেনা। এখনো পারেনা। অথচ সে চায় মায়রা তার কাজে বুঝুক মেয়েটাকে সে কতটা চায়। মুখ ফুটে বলার আগে তার চোখের ভাষা আর নিশ্বাসের গতি দেখে টের পাক তার স্পন্দন জুড়ে কেবল মেয়েটা বিচরণ করছে। তার বেসামাল রাগ কিংবা অনুভূতি গুলিও সযত্নে নিজের করে নিজের মতো সামলে নিক। কিন্তু বোকা মেয়েটা তার মুখের না বলা একটা কথা আর রাগে থেমে যায়। তবে তার ভেতরের না বলা অনুভূতি কিংবা চোখের অব্যক্ত ভাষা সে বুঝে না। বড় নির্বোধ মেয়ে।

পরীক্ষার পর মায়রা যখন আবদার করল তাকে নিয়ে আসার তখন সে চিন্তায় মগ্ন। একে তো তার কাজের চাঁপ বেড়েছিল তারউপর রোজা। সে সবসময় ভেবেছে একা একলা একটা পরিবেশে মেয়েটা রোজা রেখে সব দিক সামলাতে পারবে না হঠাৎ করে। তারউপর এই ঈদে ছুটিও নেই তার। প্রথম বাবা মা ছাড়া ঈদ এতদূর কাটিয়ে মেয়েটা শান্তি পাবে না তাই সব ভেবে না করেছিল। মেয়েটার শান্তির কথা সে ভেবলেও ওই বেয়াদব মেয়েটাই তার সকল শান্তি কেড়ে নিল।
বেদনা মিশ্রিত তুচ্ছ হাসল ইহাম। ঠোঁটে লেগে আছে অবজ্ঞা।

“আমার রাগ। এটাই আমার ভুল মায়রা? এতটা বোকা এত নির্বোধ তুমি? আমার চোখের ভাষা না বলা অনুভূতি কিছুতেই কিছু বুঝো না? আমারও অনুভূতি আছে শুধু আমার প্রকাশের ভাষাটা নেই। তা কি নিজ থেকে বুঝা যায় না? কেবল আমার রাগ করে কথাই দেখো আমার অনুতাপ তোমায় কষ্ট দিয়ে কথা বলার পর আমার প্রতি কথায় তোমার প্রতি অনুশোচনা তা দেখতে পাওনা? মানলাম আমি বদরাগী। শা’লা নিজের রাগটা নিজেই কন্ট্রোল করতে পারিনা। তোমায় আর কি বলি? আমায় একটুও বুঝো না কোন মায়রা? নিজ থেকে কি এই কঠিন লোকটাকে বুঝা যায় না? আমার রাগের মাথায় বলা কথা গুলির জোর এত বেশি যে আমায় ছেড়ে চলে যাবে এটা বলাও সহজ? জোর করে কাউকে আটকে রাখা যায়? তুমি তো সেই শুরু থেকেই বলে এসেছো তোমায় ছেড়ে দিতে। কখনো বলেছি আমি ছেড়ে দিবো? অথচ তুমি এখন শক্ত দৃঢ় ভাবে চাও আমার থেকে মুক্তি। মুক্তি যদি তোমায় শান্তি দেয় তবে এই ফাহাদ ইহাম চৌধুরী তোমায় সেই শান্তি উপহার দিবে মেয়ে।”
একলা ঘরে কথাগুলি বলতে বলতে ইহামের এক চোখের কোণে কখন পানি চলে এসেছে সে টেরই পেলনা। বুঝার সাথে সাথে খুব দ্রুত সেই পানি মুছে নিল। যেন তা নিজের থেকে নিজেই আড়াল করল।

“তুই কি পাগল হয়েছিস? বিয়ের ছয়মাস কাটতে না কাটতেই এ কোন ধরনের অলক্ষ্মীর গান গাইছিস হ্যাঁ? তোর আব্বুর কানে গেলে উপায় আছে? গলা কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিবে। মিথিলা তুই বল ওকে। কোন পাগলের প্রলাপ বকছে সে?”
উত্তেজিত ফাতেমা বেগম দিশেহারা হয়ে যাচ্ছেন মেয়ের কথা শুনে। মাথাটাতা খারাপ অবস্থা। মেয়ে কোন অলক্ষুণের কথা বলে? ইহামের মতো একটা ছেলে এই যুগে পাওয়া যায়? এত ভালোবাসে ছেলেটা অথচ মেয়ের মাথায় কোন ভীমরতি ভর করল?
“গলা কেটে দেওয়ার হলে তাই করো। কিন্তু আমি ও বাসায় যাবো না।”
মায়রার কথা শুনে বিচলিত হন ফাতেমা বেগম। মাথায় হাত রেখে অধৈর্যের মতো প্রশ্ন করেন মিথিলার দিকে তাকিয়ে,

“তুই শুনতে পাচ্ছিস মিথিলা কি বলছে ও? সুখে থাকতে ভূতে কিলায় কথায় আছে না? ওর কি সুখ সহ্য হচ্ছে না? বুঝা ওকে। আমার মাথাটাতা নষ্ট হয়ে যাবে এই অলক্ষুণে মেয়ের কথা শুনে।”
“ওকে আমি অনেক বুঝিয়েছি মামি কিন্তু নিজের জেদ ধরেই বসে আছে।”
খাটের এক কোণায় বসে আছে মায়রা। মুখ মলিন বিষণ্ণ। অদৃশ্য হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত। ভেতরে যেই প্রাণটা আছে সেটাও যেন আজ নিস্তেজ প্রায়। বিছানার শেষ মাথায় বসে কপাল চাপড়ান ফাতেমা বেগম। মেয়ের জন্যে হায়হায়ও করেন। উদ্বিগ্ন হয়ে মিথিলার দিকে তাকিয়ে বলেন,

“নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে। এখনো জামাই তুলে নেয়নি, সংসার করেনি। একসাথে থাকছেও বা কয়দিন? তবুও ওর প্রতি ছেলেটার যে টান তা কয়জনের মাঝে দেখা যায় আজকাল? পুরুষ মানুষ সারাদিন কত ঝামেলায় থাকে। দুনিয়ার সাথে লড়াই করে। তারউপর ছেলেটা আবার স্পেশাল ফোর্সে আছে। শুনেছি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলে সবসময়। এত সব কিছু সামলে ব্যাটা মানুষের মন কি আর সবসময় নরম থাকে? তাই বলে ঘরের মহিলারা নিজের স্ত্রীই যদি স্বামীকে না বুঝে তো আর কে বুঝবে? সবসময় আদরে সোহাগে কথা বলা যায়? এত সময় দেওয়া যায়? বউ কে সব কিছু বুঝতে হয়না? স্বামীর মনমেজাজ খারাপ থাকে বউ কে একটু বকাবকি করে তাই বলে স্ত্রী কি সংসার না করার কথা বলে? ওই অপয়া কি বলে রে মিথিলা? ওরে একটু বুঝা। না হয় রাগের মাথায় একটু বকেছেই। পুরুষ মানুষের রাগ হলে কত কিছুই করে। ঠান্ডা হলে কি আর এসব ঝামেলা থাকে? ও কেন বুঝতে চাইছে না?”
মায়ের কথা শুনে ভেতরটা আরো ফেঁপে যায় মায়রার। কেঁদে বলে, “তো কি বলতে চাইছো? উনার যখন যখন রাগ উঠবে তখন আমায় যা খুশি বলে আঘাত করবে আর আমি কিছু বলতে পারব না? সব সহ্য করতে হবে? উনার দোষটা তোমরা দেখতে পাচ্ছো না তাই না?”

“মা রে সংসার জীবন কি এতই সহজ? এটা তো আস্তে আস্তে যত্ন করে নিজের মতো তৈরি করে নিতে হয়। কাঁদামাটি শুরুতেই কি জিনিসপত্র বানানোর জন্যে উপযোগী হয়? এটাকে আস্তে ধীরে আলতো হাতে উপযোগী করে নিতে হয়। তারপর নিজের ইচ্ছা মতো আকৃতি দেওয়া যায়। সংসারটাও তো তেমনি। তোকে তো সময় নিয়ে সবটা উপযোগী করে নিতে হবেরে। জামাই একটু বকাবকি করলেই কি রাগ করতে হবে? ছেড়ে দেওয়ার কথা বলতে হবে? আল্লাহ নারাজ হয় এসব শুনলে।”

মায়রা হু হু করে কাঁদে। ফাতেমা বেগম তপ্ত শ্বাস ফেলে বলেন,
“সংসার জীবনটা অনেক কঠিন রে মা। সব মেয়েরাই বিয়ের পরপর এমন কিছু ঝামেলায় পড়ে সব কঠিন লাগে। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যায়। জামাই একটু বকলে তুই নীরব থাকবি। শান্ত হয়ে গেলে পরে বলবি কোনটা তোর খারাপ লেগেছে। সংসারে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। মানিয়ে নিতে হয়।”
মায়ের কথায় রেগে যায় মায়রা। ভেতরের চাঁপা কষ্ট সইতে না পেরে চেঁচিয়ে বলে,

“তো আমিও সব মেনে নিবো? যা বলবে সব সহ্য করব? আমার নিজের কোনো দাম নেই না আমার কাছে? আমি বসেবসে ভাত নষ্ট করি এসব শুনেও মেনে নিবো? লোকটা আমায় বলবে উনি উনার মতোই থাকবে পুষালে আমি যেন উনার সাথে থাকি না হয় চলে যাই। এই তো? এভাবে থাকতে বলছো? যখনই রাগ হবে তখনি আমায় অপমান করে কথা বলবে আর আমি কিছু না বলে ভালো বউ হিসেবে চুপচাপ সহ্য করব? কেন? পারব না আমি। আমার কাছে আমার আর আমার অনুভূতির দাম আছে। আমার কষ্টেরও দাম আছে। উনার সাথে এভাবে আমার পুষাবে না তাই আমি থাকতেও পারব না।”

শেষের কথা গুলি মায়রা যেন নিজেকে দিয়ে জোর করে বলিয়েছে। তার আহত হৃদয় বিষয়টা এখনো মেনে নিতে পারে না যে লোকটা তাকে ছেড়ে দিবে। ওই লোকটার সাথে আজ কতদিন কথা হয়না বলে দমটা বন্ধ বন্ধ হয়ে আসছে। ওই পেটানো শরীরের ঘাম মেশানো পারফিউমের ঘ্রাণ শুকতে হৃদয়টা আনচান করে। শক্ত প্রস্থ বুকটায় ঝাঁপিয়ে পড়ার কতশত সেই নীরব আহাজারি। সব কিছুর যাঁতাকলে হাপিয়ে উঠছে মেয়েটা। নিজেকে পাগল পাগল লাগে ওই লোকটার স্মৃতি মনে হলে। বাসায় তার আব্বু নেই। ফাঁকা বাড়ি পেয়ে আর মনের সুখে গলা ফাটিয়ে কাঁদে।
মেয়ের কান্না আর কথায় ফাতেমা বেগমের কোমল মন মুচড়ায়। তবুও মেয়ের ইচ্ছাকে প্রশ্রয় না দিয়ে তিনি শক্ত গলায় বলেন,

“এই গাধা মেয়েকে কে বুঝাবে সংসার টিকাতে হলে কত কিছু যে করতে হয়। কত কিছু সহ্য করতে হয় তার কোনো ধারনা আছে ওর? ও জীবন সম্পর্কে কতটুক ধারনা রাখে? কতটুক জানে ও? ওর শাশুড়ি যে সেদিন রাগে ওকে বকল এরপর থেকে যে উনার ব্যবহার বদলে গেছে তা নিয়ে ও জানে কিছু? ইহাম যে নিজের মাকে কথা শুনিয়েছে তাকে বকেছে বলে সে সম্পর্কে ও জানে? ওর শাশুড়ি ওকে কত আদর করত অথচ ছেলের মুখে বউ কে নিয়ে এসব বলায় তিনি কষ্ট পেয়েছেন বলে নিজেকে দূরে রাখছেন। সেদিনও তো আমার বাসায় এলো না। এসব নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা আছে? আর হাসপাতালে ও যখন মরার মতো শুয়ে ছিল তখন ওই ছেলেটার আহাজারি আর পাগলামি কি দেখেছিল? এত সুন্দর ভদ্র ভালো একটা ছেলে পেয়ে শান্তি লাগছে না তার তাই না? ওর রাগটাই বড় হয়ে গিয়েছে ওর কাছে যে ছেলেটা যে ওকে কত ভালোবাসে তা দেখছে না।”

ফুঁপায় মায়রা। গলা দিয়ে কান্নার শব্দও বের হচ্ছে না শরীরটা এত ক্লান্ত। “ভালোবাসা না ছাই। তোমরা ওই লোকটার বাহিরটাই দেখো ভেতরের চাঁপা আর রুক্ষ ভাবটা চোখে পড়ে না?” মনে মনে এই কথা গুলি বিক্ষুব্ধ করে।
মিথিলা নীরব থেকে বলে, “কেন এমন করছিস মায়রা? বিষয়টা একটু বুঝ।”
“যে যাই বলো আমি কিছু শুনব না। ওই লোকের ইগো যদি আমার চেয়ে বড় আর দামী হয় তো সে তার ইগো নিয়েই থাক আমায় লাগবে না। উনি যতক্ষণ নিজের ইগো ভুলে গিয়ে তার ভুলের অনুশোচনা না করে আর রাগ কন্ট্রোল করতে না পারে ততক্ষণ আমি কারো কথা শুনব না। যার কাছে আমি বেশি, আমার সব কিছু বাড়াবাড়ি। যার কাছে আমার কোনো সম্মান নেই, যে আমার কষ্টের চেয়ে বেশি নিজের রাগ কে প্রধান্য দিতে পারে, যে আমায় নিয়ে বিরক্তবোধ করে যার কাছে আমি অতিরিক্ত তার কাছে আমার না থাকাই ভালো হবে।”

বাচ্চাসুলভ কথা গুলি বলেই মায়রা বিদেয় হয় সেই ঘর থেকে। ফাতেমা বেগম তখন মাথায় হাত দিয়ে দুশ্চিন্তা গ্রস্ত হয়ে বসেন। পরশু দিন মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ইফতার আর কাপড়চোপড় নিয়ে যাওয়ার কথা উঠেছে। শিরিন বেগম নিজেই বললেন মায়রাকেও নিয়ে যেন যাওয়া হয়। মেয়েকে এই কথা বলতে মেয়ে কোন অলক্ষুণে কথা শুনালো?

পরদিন দুপুর ১২ টা বাজতেই বাসায় অনেক আওয়াজ শুনা যায়। সারারাত কেঁদে সেহেরি খেয়ে ঘুমিয়েছিল মায়রা। তাই দেরি করে উঠেছে। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই এত আওয়াজ শুনে কপাল কুঁচকায় মায়রা। বাড়িতে শুধু আম্মু আর মিথিলা আপু থাকার কথা। আব্বু তো এই সময় অফিসে। তবে এত মানুষের আওয়াজ কেনো?
উৎসুক মায়রা টাওয়াল ব্যালকুনির রসিতে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বের হয়। হঠাৎ করে নিজের বাসায় শাশুড়ি কে দেখে চমকে যায় সে। বুকে কেমন ভয় হয়। সবসময় হাসিখুশি থাকা ভদ্র মহিলার মুখটা কেমন থমথমে। হসপিটালে বকা দেওয়ার পর থেকে শাশুড়ি কে ভয়ে ভয়ে কথা কম বলে। চোখের সামনে অপ্রত্যাশিত ভাবে উনাকে দেখে কেমন ইতস্তত বোধ করে। বিচলিত হয়ে কেমন হাঁসফাঁস করতে থাকে।
শিরিন বেগম এগিয়ে আসেন। মায়রার সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর সুরে বলেন, “মুখটা শুকনো করে রেখেছো কেন? শাশুড়ি কে দেখে খুশি হওনি বোধহয়?”

গলার টোনে মায়রা ভেতরে গুটিয়ে যায়। অস্বস্তি হলেও হাসে অল্প। মাথা নত করে বলে, “একদম না মা। কখন এলেন? আসুন ঘরে বসি।”
মায়রাকে নিয়ে তিনি তার রুমে যান। শিরিন বেগম তাকিয়ে দেখেন মায়রা উনাকে ভয় পাচ্ছে। শান্ত গলায় তিনি বলেন, “আমার উপর কি এখনো রেগে আছো তুমি?”
প্রশ্ন টা শুনে অপ্রস্তুত হয় মায়রা। মাথা তুলে বলে, “এ এমন করে বলছেন কেন মা? আপনি গুরুজন একটু বকতেই পারেন ভুল করলে।”
শিরিন বেগম মায়রার মুখে হাত দিয়ে চুমু খায়। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,

“যখন ছেলের মা হবে তখন বুঝবে। ছেলের মা হওয়া এত সহজ নয়। বিরাট ধৈর্যের বিষয়। কারণ আমি মনে করি একটা ছেলেকে ২৫/২৬ বছর নিজের মতো করে পেলে চোখের সামনে সেই ছেলের সব দায়িত্ব ভালোলাগা খারাপ লাগা বউ এর হাতে অপর্ন করে দিয়ে সেই বউ কে নিয়ে ছেলের হাসিখুশি আহ্লাদী জীবন দেখাটাও একটা ধৈর্যের বিষয়। সব ছেলের মায়েরা এমনটা করতে পারে না। তাই তো বেশিরভাগ ছেলের মায়েরা ছেলে আর ছেলের বউএর মায়া মহব্বত দেখে আধিখ্যেতা ভেবে নাক শিটকায়। বউকে সহ্য করতে পারে না বলে ছেলের কাছে কানও ভাঙ্গায়। তাই আমি মনে করি ছেলে আর ছেলের বউ এর সুখি জীবন দেখে আত্মতৃপ্তি পাওয়াও একটা ধৈর্যের বিষয়। আগে ছেলের মা হও তখন বুঝবে।”
এতএত কথার মাঝে মায়রার কানে বারবার লাগছে “ছেলের মা হও” বাক্যটা। এক মিশ্র অনুভূতিতে তলিয়ে গিয়েছে সে। বিচলিত ভেতরটা কোনো এক কারণে ছটফটে করে নিশ্বাস আটকে আসছে তার। ইচ্ছাকৃত ভাবেই যেন সে নিশ্বাসটা আটকে রেখেছে।

“অনেক চিন্তা করলাম একটা বিষয় নিয়ে। যেহেতু আমি একটা ছেলের মা এর পাশাপাশি মেয়েরও মা তাই আমি সবটাই বুঝি। আমার ছেলেকে আমি ভালোবাসি। আমার ছেলে যেমন আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ আমার ছেলের ভালো থাকাটাও আমার কাছে ততটা গুরুত্ব রাখে। ছেলে যদি বউ কে নিয়ে ভালো থাকতে পারে, হাসি খুশি আর আনন্দ থাকতে পারে তবে তাতে আমার হিংসে করার কি আছে? আমার ছেলের বউ তাকে আমি প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেই বা যাবো কেন? আমার ছেলের কাছে আমি তার মা’ই থাকবো আর তার বউ, বউই থাকবে। কেউ কারো জায়গা নিতে পারবে না। আমার ছেলে যদি নিজের স্ত্রী কে নিয়ে আনন্দ থাকে তবে সেটা আমার কাছেও আনন্দ হবে। ছেলের বউ কে নিয়ে ক্ষোভ পুষা কিংবা ছেলের বউকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে কুটনামি করার মতো ঘৃণ্যত কাজ আর দুটো নেই।”

কেন যেন মায়রা আবেগে কান্না করছে। তার ভেতরটাও জ্বলছে। শাশুড়ি কে দেখে বারবার ওই পাষাণ লোকটার কথা মনে আসছে। সব দিকের সব কিছু ঠিক শুধু ওই মানুষটার মাঝেই যেন কিন্তু ঠেকেছে। মনের মাঝে ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করে রাখা কিছু আশা আকাঙ্ক্ষা এ মুহূর্তে তাকে বড্ড পু’ড়াচ্ছে। মায়রা হেঁচকি তুলে শাশুড়ির কাছে প্রশ্ন করে,
“আপনাকে কি আমি একটু জড়িয়ে ধরতে পারি?”
জবাবে শিরিন বেগম কিছু বললেন না। উল্টে তিনি নিজেই হাত বাড়িয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরেন তাকে।
দুপুর দুপুরই মায়রা কে নিয়ে শিরিন বেগম আর ইসহাক চৌধুরী মার্কেটে যেতে চেয়েছিলেন শপিং করিয়ে দিতে। কিন্তু তাতে বাদ সাধলেন ফাতেমা বেগম। তিনি কিছুতেই ইফতারের আগে বেয়াই বেয়ান দের ছাড়বেন না। উনার কথা ইফতারে পর যেখানে খুশি সেখানে যাক। উনার আশকারা পেয়ে শিফুটাও লাফিয়ে উঠে। বলে রোজার দিন এই ভর দুপুর মাথায় করে সে কোথাও যাবে না। শিরিন বেগম মায়রার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলে “তুমি কি বলো মায়রা?” জবাব সে বলেছিলো,

“আম্মু যেহেতু বলছে ইফতার করে যেতে তাহলে থেকে যান না হয় মা। আর শিফুও তো বায়না করছে।”
যদিও ইফতারের পর তার শরীর একদমই ল্যাং ছেড়ে দেয়। বিছানা থেকে উঠার শক্তিটাও থাকেনা। তবুও প্রতিবছর রোজার ইদের শপিং ইফতারের পর রাতেই করা হয়। তখন শপিং এর একটা আমেজ মনের সকল ক্লান্তি অবসাদ দূর করে দেয়। কিন্তু এবছর তার কোনো রুচিই নেই। না আছে ইদের আমেজ আর না শপিং এর একটা উৎকণ্ঠা। বিষাদ মন কেবলই খুঁজে চলে এক ব্যক্তিগত মানুষের সঙ্গ।
মায়ের হাতে হাতে টুকটাক কাজ সেরে মাত্র এসে বসেছে মায়রা। তার রুমে তখন শিফু ফোন চালাচ্ছে। বিছানায় বসতেই শিফু এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে তাকে।

“ধন্যবাদ ভাবি। আম্মু শুধুমাত্র তোমার জন্যে রাজি হয়েছে। নয়তো রাতে যেতেই চায় না শপিং এ। অনেক কেনাকাটা করতে সময় লাগে বলে রাতে যায় না। থ্যাঙ্কস।”
মলিন হেসে মায়রা বলল, “ঠিক আছে শিফু।” একটু থামে সে। এমনি হলে শিফুর সাথে তার কথার শেষ থাকে না। কিন্তু আজ কি বলবে তাই খুঁজে পাচ্ছে না। মনে হয় তার সকল কথা জমে আছে কেবল একজনের জন্যেই।
“ভাবি তোমার কি কিছু হয়েছে? মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন?”
“কোথায়? রোজা আছি বলে হয়তো।”
“ভাবি ভাইয়ার সাথে কি ঝগড়া হয়েছে নাকি?”

মায়রা মুখে যতই বলুক সে থাকবে না হ্যানত্যান। তবুও তার আর ইহামের ঝগড়া সম্পর্কে তার আম্মু আর মিথিলা আপু ছাড়া কেউ কিছু জানে না। বিষয়টা জানাতে চায় না বলেই দ্রুত কথা ঘুরালো।
“আরে না। তে তেমন কিছুই না শিফু।” আয়নার সামনে গিয়ে মলিন হেসে বলল, “সত্যি রোজার কারণেই এমন দেখাচ্ছে। বাদ দাও। তোমার কি খবর বলো? ভাইয়ার সাথে তোমার কথা হয়?”
শিফু উদাস হয়ে জবাব দেয়, “সাপ্তাহে দশদিনে একদিন কথা হয় টুকটাক। তাও ৫ মিনিটের উর্ধ্বে নয়।”
“ভাইয়া ফিরে এসে তোমাকেই বিয়ে করবে দেখে নিও।”

শিফুর মনে উত্থান পতন হয়। চাঁপা কষ্ট গুলি একেএকে এসে ভীড় জমায় মনের আঙ্গিনায়। দূরে ঠেলে দেওয়া সেই কষ্টটুকু আর নিজের মাঝে ঠাই দিতে চায়না বলে শিফু দ্রুত বিষয়টা এড়িয়ে যায়। এই ইদে তারা কাকে কি দেয় দান করা জন্যে কত শাড়ি আর লুঙ্গি কিনা হয় তা নিয়ে কথা বলছিল। তার আড়ালে লুকিয়ে রাখা একটা যন্ত্রণা মায়রা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। এক নজরে মায়রা শিফুর কষ্ট আড়াল করা মুখের দিকে তাকিয়ে।
“ঠিক ভাইয়ের মতো হয়েছে। ভাঙ্গবে তবুও মচকাবে না। কষ্ট পাক আর যাই হোক মুখে স্বীকার করবে না। পাষাণ ভাইটার কার্বনকপি যেন।”
“কি হলো ভাবি কি ভাবছো?”
শিফুর ধাক্কায় নিজের ভাবনা থেকে বের হয় মায়রা।
“হ্যাঁ? কি বলছিলে যেন?”
“তুমি এবার ফাটিয়ে দিয়েছো ভাবি।”
“বুঝলাম না।”

“আরে ভাইয়া আম্মুর কাছে কাল টাকা পাঠিয়েছে। তোমার জন্যে ৪০ হাজার টাকা উল্লেখ করে দিয়েছে। বলেছে জামা জুতো সহ যা যা লাগে কিনতে। যদি আরো লাগে তাহলে যেন ভাইয়া কে বলে। লাগলে আরো টাকা পাঠাবে। আর আব্বুর থেকে পাওনাটা তো বাকিই আছে। তো ফাটিয়ে দিলে না বলো?”
মায়রা ম্লান হাসে। মনে মনে বিড়বিড় করে, “আমি তো টাকা পয়সা কিছু চাই নি। আমি চেয়েছি কেবল আমার একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষটাকে।”
“ভাইয়া আমায় কি বলেছে জানো ভাবি? বলেছে তোমায় যেন সুন্দর দেখে একটা পাকিস্তানি ড্রেস কিনে দিতে। ওটায় নাকি তোমায় সবচেয়ে বেশি মানাবে। কি রোমান্টিক না আমার ভাই টা?”
জবাব দেয়না মায়রা। উদাস হয়ে ভাবে, “শুধু দায়িত্ব টাই শিখলেন পাষাণ মানুষ একটা। ভালোবাসাটা আর শিখলেন কই?”

কাল ইদ অথচ মায়রার মনে কোনো আনন্দ উচ্ছ্বাস কিচ্ছুটি নেই। যা আছে সব বিষাদের তিক্ততা। ভেতরটা ভঙ্গুর হয়ে গিয়েছে কষ্ট সহ্য করতে করতে। আজ একমাসের বেশি হয় ওই দাম্ভিক পাষাণ মানুষটা তাকে না কল করেছে আর না কোনো ম্যাসেজ দিয়েছে। এত অহংকার ওই লোকের? নিজের ভেতরটা যেমন কষ্টে ক্ষতবিক্ষত তেমনি রাগ তাকে লোহা পেটানোর মতো শক্ত করে। চোখ গুলি টলমল করে উঠে ক্ষোভ আর ক্রোধে। ওই পাষাণ লোকটা যদি নিজের ইগো আত্মঅহমিকা নিয়ে থাকতে পারে তবে সে কেন পারবে না? তার জেদী মন তাকে বুঝিয়ে দেয় এই জীবন থাকতে সে ওই অহংকারী দাম্ভিক লোকটাকে কল দিবে না। সবসময় সব রাগ ভাঙ্গাতে তাকেই কেন যেত হবে? ওই লোকটা কি রাগ ভাঙ্গাতে চিনে না? নাকি জীবনে কিছু শিখেনি?

ঠিক তখনি কাকতালীয় ভাবে তার ফোনটা বেজে উঠে। বিষণ্ণ দুই চোখ জোড়া ফোনের স্কিনে “পাষাণ মানব” লেখাটা দেখে থমকে যায়। বুকটা মুচড়ে উঠে। সেখানের তীব্র আলোড়নে লম্বা করে নিশ্বাস নেয় মেয়েটা। রাগ অভিমান না অন্য কিছুর জোরে এতক্ষণ আটকে রাখা পানি ঝাড়ে মায়রা। ফোনের স্কিনে তাকিয়ে থেকে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
তার বুকচেরা অভিমান পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল সামনে। সেই যন্ত্রণা মাখা অভিমানের নিচে চাপা পড়েছিল সব ইচ্ছা। চোখের সামনে স্ক্রিনটা জ্বলছিল, তবু কলটা রিসিভ করা তার পক্ষে আর সম্ভব হয়ে উঠছে না। তীব্রতা রাগ ক্ষোভ আর অভিমান নিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কল কেটে যায়।

আবারও কল আসে। মেয়েটা নির্বিকার বসে ফুঁসছে কেবল। তার মন দুই অনুভূতিতে দোদুল্যমান। একমন বলছে, লোকটা যত পাড়ুক কল করতে থাক। সে আর রিসিভ করবে না। এতদিনেও যেহেতু কল দিতে পারেনি তবে এখন আর কল দেওয়ার কোনো দরকার নেই। কি ভেবেছে? যত পারবে আঘাত করবে কষ্ট দিবে এরপর একটু নরম কথায় সব ভুলিয়ে দিবে? হবে না। কিছুতেই হবে না। তো আরেক মন বলছিল, এতদিন পর লোকটা কল দিয়েছে আচ্ছা ফোনটা একটু ধরা উচিৎ। নিজের দূর্বলতা প্রকাশ না করে হলেও একটাবার শুনেই দেখুক না কি বলে।
পরপর দুইটা ফোন এসে কেটে গেল। চোখের পানিটুক মুছে মায়রা মনে মনে স্থির করল আরেকবার কল আসলে সে রিসিভ করবে। কিন্তু তাকে বরাবরের মতো হতাশ করে দিয়ে তৃতীয় বার আর কল এলোনা। ভীষণ রেগে গিয়ে মায়রা নিজেই কাঁদল। এ কেমন পুরুষের কাছে নিজের মন দিল সে?

চারিদিকে মাইকে ইদ মোবারকের কলরব শুরু হয়েছে। মসজিদে মসজিদে মোবারক জানিয়ে ইদের নামাজের সময় বলছে। আশপাশের বাড়ি থেকেও মানুষজনের খুশির আমেজ শুনা যাচ্ছে। কিন্তু তার মনে আছে এক ঝাঁক বিষণ্ণতা। বিকেল দিকে লোকটার দুইটা কল আসার পর আর কোনো কল না ম্যাসেজ কিছুই এলো না। ইহামের প্রতি তার রাগ আর তিক্ততা বাড়ল আরো। আর একটা বার কি কল করা যেত না? কিংবা ছোট্ট একটা ম্যাসেজ? অন্যসময় হলে তো সে কল না ধরলে আম্মুর ফোনেও কল আসে কিন্তু আজ তো আর আসেনি। দিনকে দিন মানুষটার প্রতি তার ক্ষোভ আর বিদ্বেষ বাড়ছে। এভাবে কি করে সংসার হবে তাদের? এটাই তাদের প্রথম ইদ ছিলো। অথচ লোকটা?
পাশের বাড়ির তিনটা বাচ্চাকে মেহেদি দিয়ে নিজে আর দিলো না। সব কিছু ভেবে ভেবে কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে গেল মেয়েটা।

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৪৮

খুব ভোরে আযানের পরপর ঘুম ভাঙ্গলে মায়রা আড়মোড়া ভাঙ্গে। নিস্তেজের মতো চুপটি করেই শুয়ে থাকে বিছানায়। হামি দিতে মুখের সামনে হাত আনার সময় অদ্ভুত কিছু অনুভব করে সে। ভ্রুকুটি করে হাতটা সামনে আনতেই সরু চোখে কিছু দেখে লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে। অনুভব করে চেনা পরিচিত কিছু একটা। দ্রুত গিয়ে লাইট অন করলে দেখতে পায় হাতে মেহেদি। গুটিগুটি অক্ষরে লেখা “ফাহাদ ইহাম চৌধুরী।”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৫০