মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৯
সাদিয়া
মজিদ পাহাড়ির সাথে চাকরির সূত্রলগ্ন থেকেই ইহামের দ্বন্দ্বের সম্পর্ক। সরাসরি সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট পদে নিযুক্ত হবার পর এক অপারেশনে গিয়ে তার মজিদ পাহাড়ির সাথে প্রথম সাক্ষাৎ। মজিদ পাহাড়ি তখন তার দুরদর্শিতার কারণেই আটক হয়েছিল। পরে অবশ্য কিভাবে ছাড়া পেয়েছে তা ধারনা নেই। তবে এখন আন্দাজ করতে পারছে ভয়ংকর দুর্বৃত্তের লিডার ওই মজিদ কেবল তাকে ঘায়েল করতেই ফিরে এসেছে এই এলাকায়। প্রচণ্ড চতুর আর ধূর্ত ওই মজিদ কে একেবারে কাবু করা মুটেও সহজ নয়। বয়স ৪০ এর উপরে হলেও দেখতে শুনতে গায়ে বেশ বল আছে। দস্যু একটা ভাবও আছে। যদিও এখন সে দেখেনিও কেমন হয়েছে এতগুলি মাসের ব্যবধানে। এখনো তাদের সরাসরি সাক্ষাৎ টা হয়নি।
মোটামুটি অনেকটা ঘায়েল কিভাবে করা যায় মজিদ কে সেই মিটিং শেষ করেই ইহাম আবার কটেজের ব্যালকুনিতে এসে দাঁড়াল। অলিভ গ্রীন কালারের টাউজারের প্যাকেট থেকে ফোনটা বের করেই তাতে কল লাগাল মায়ের ফোনে।
শায়লা বেগম তখন ফাতেমা বেগমের সাথে গল্প করতে করতে বিকেলের নাস্তা রেডি করছেন। হঠাৎ উনার ফোনে কল আসায় পকোরার ডো মাখা এঁটো হাতে তিনি এগিয়ে গেলেন টেবিলে রাখা ফোনের উপর। ছেলের কল পেয়ে খানিক ঘাবড়ালেন তিনি। অস্থির হৃদয় নিয়ে ফোন রিসিভ করলেন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আসসালামু আলাইকুম আম্মা।”
“ওলাইকুম আসসালাম বাবা। কেমন আছিস বাবা?”
“ভালো আছি আম্মা। তোমরা কেমন আছো?”
ছেলের প্রশ্নে খানিক বিচলিত হলেন শায়লা বেগম। উনাকে নীরব দেখে ইহাম আবার প্রশ্ন করল,
“কি হলো আম্মা? বাসায় কি কোনো সমস্যা হয়েছে? মায়রা কি আমাদের বাসায় এসেছে?”
চিন্তিত হলেন ভদ্র মহিলা। তার মানে ছেলের সাথে বউমার কথাতটা হয়। মায়রা কি বলে দিয়েছে ইসহাক চৌধুরীর অসুস্থতার কথা? একটু দমলেন তিনি। ইতস্তত বোধ করে জবাব দিলেন,
“হ্যাঁ বাবা মায়রা ওর মা আর ভাই আমাদের বাসায় এসেছে দুপুর দিকে। আসলে তোর বাবা একটু অসুস্থ তাই মায়রা আম্মা কে দেখতে চাইছিলেন তিনি।”
বাবার অসুস্থের কথা শুনে অস্থির হলো ইহামের কঠোর হৃদয়। আশ্চর্যে কপাল কুঁচকে এলো তার। উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল,
“আব্বা অসুস্থ? আর তুমি আমাকে একবার বলো নি আম্মা?”
হু হু করে উঠল শায়লা বেগমের হৃদয়। একমাত্র আদরের ছেলে বাবা বলতে প্রাণ। এই কথা শুনে কেমন তেড়ে উঠে মাবুদ ভালো জানেন। শায়লা বেগম কে আবারও নীরব থাকতে দেখে ইহাম গলার শান্ত আওয়াজ ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঁচু করল। খেঁক গলায় শুধালো,
“কি হলো আম্মা? আব্বা অসুস্থ আর সেই কথা তুমি আমাকে বলার প্রয়োজন মনে করলে না? আমাকে এটা জানানোর দরকার ছিল না?”
মন খারাপের বিষণ্ণতা শায়লা বেগমের চোখে মুখে। স্বামীর অসুস্থতা একমাত্র বড় ছেলের দূরত্ব উনাকে কতটা অসহায় করেছেন তা যেন চোখে মুখে ফুটেছে উনার। মলিন মুখে উদ্রেক কন্ঠে জানালেন শায়লা বেগম,
“তুই একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে গিয়েছিস। কি করছিস কত ব্যস্ত আছিস তা আমি কি করে জানব? তাই তে তোকে ঝামেলা দিতে চাইনি এই কারণেই বলা হয়নি তোকে।”
প্রচণ্ড বিরক্ত ভাব ফোঁটে উঠল ইহামের চোখে মুখে। বিতৃষ্ণা অভিভঙ্গি নিয়ে নিঃসম্পূহ স্বরে বলল,
“ডাটা অন করো আমি ভিডিও কল দিচ্ছি।”
“রাখ বাবা। আমার ফোনে এমবি শেষ। তুই মায়রা নয়তো শিফুর ফোনে কল দে।”
আর কোনো জবাব না দিয়ে ইহাম উৎকণ্ঠিত হয়ে কল কাটল। যত দ্রুত সম্ভব হোয়াটসএপে গিয়ে কল লিস্টে থাকা মায়রার নাম্বারটা ঢেঙ্গিয়ে শিফুর নাম্বার খুঁজতে উদগ্রীব হলো।
রাগি কঠোর ভঙ্গিমায় কথা বলা ভাইয়ের সাথে শিফু খুব একটা সহজ নয়। বরং বাবার চেয়ে ভাই কে বেশি ভয় পায় সে। বাঘ সিংহের চেয়ে বোধহয় তার শক্ত ভার গলায় কথা বলা ভাইয়ের প্রতি সে ভীত। শিফু ক্যামেরা টা ব্যাকে রেখেই নিজের রুম থেকে এগিয়ে যেতে লাগল বাবার রুমের দিকে। স্কিনে ভাসছে এ্যাশ কালার টাইটফিইট উঁচু মাসেল দেখানো হাফহাতার টিশার্ট গায়ে দেওয়া একটা অস্থির মুখ। শিফু দ্রুত নিজের পা বাবার রুমের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলে ফোনের স্কিনেই কপাল কুঁচকে তাকাল ইহাম। বিষয়টা একটু খেয়াল করতে সত্বর বলে উঠল,
“ওয়েট শিফু।”
ভাইয়ের নিষেধ আঞ্জা পেয়েই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল শিফু। ফোনের স্কিনে ভাসা দৃশ্য দেখে ইহাম নিজেও। কপালের ভাঁজ আরো সরু হলো তার। এটা কি আদৌও সম্ভব? এটা ওই অভদ্র বেয়াদব মেয়েটাই? বিস্মিত নজরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে ইহাম।
ইসহাক চৌধুরী শুয়ে আছেন বিছানায়। তার পাশেই বসে মায়রা মাঝারি আকার একটা প্লেট থেকে আঙ্গুল তুলে খোসা ছাড়িয়ে তা মুখে দিচ্ছে উনার। দুজন বোধহয় কিছু নিয়ে কথাও বলছে। খানিক সময় নির্বাক থেকে মোটা গলায় বলে উঠল ইহাম,
“আব্বার কাছে ফোনটা দে।”
রোবটের মতো স্থির থাকা শিফু দ্রুত বাবার কাছে গেল দরজার কাছ থেকে। বাবার হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে চঞ্চল কন্ঠে বলল,
“আব্বু ভাইয়া কল দিয়েছে। কথা বলো।”
ফোঁস করে একদম নিশ্বাস ছাড়ল শিফু। পাশেই মায়রা কে তার দিকে কুঞ্চন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃদু হাসার চেষ্টা করল মেয়েটা।
“ভাবি আমি যাই? তুমি বরং কথা শেষ হলে আমায় ডাক দিও।”
শিফু এক দৌড় দিয়ে ঘর থেকে বের হলো। ড্রয়িংরুম পেরিয়ে তার ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়েই খেয়াল করল তুহিন কে।
“শিফু টিফু এগিয়ে আসো। স্নেক নিয়ে তোমার সাথে একটু গবেষণা করি।”
শিফু তুহিনের দিকে তাকিয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। ধড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিতেই মুচকি হেসে উঠল ছেলেটা।
নিজের রুমে একা একা বসে আছে মায়রা বিবশ চিত্তে। তার ভাবনার মূল কেন্দ্রে ক্যাপ্টেন ফাহাদ ইহাম চৌধুরী। আচ্ছা ওই লোকটার হৃদয় কি দিয়ে তৈরি? কলেজে শাড়ি পড়া দেখা ওই মেয়েটাকে কি খুব ভালোবাসে সে? তাই তার থেকে সবসময় এড়িয়ে যায়? মানুষটা কি বুঝতে পারে না কিছুই? বাবা মার কথায় বিয়ে যখন করেছেই তাহলে দায়িত্ব নিতে সমস্যা কি উনার? কেন এতটা অবহেলা করে ওই মানুষটা? আচ্ছা উনি বারবার কেন তাকে অভদ্র আর বেয়াদব বলে? সত্যি কি সে খুব বেশি বেয়াদবি করে নাকি? ওই মানুষটার সাথে একেবারে গলে যাওয়া কি তার সমীচীন? কই বিয়ের আড়াই মাসেও তো একবার তাকে কল দেয় নি মানুষটা। একটু খুঁজ নেয়নি তার। উল্টে তাকে প্রথম সাক্ষাতেই কত ভয়ংকর একটা কথা বলে দিল অনায়াসে। তবুও যদিও একটু ভালো ব্যবহার করে দুই একটা কথা বলত। হতে পারে সে কষ্টের তাড়নায় সেদিন একটু রাগ দেখিয়েছে কিন্তু সেই পাষাণ মানুষটা কি করল? তাকে কি ভালো করে বুঝিয়ে একটু কিছু বলা যেত না? বরঞ্চ তাকে অভদ্র বেয়াদব তকমা দিয়েছে সে। তাকে অনায়াসেই বলে দিল তার প্রতি ওই মানুষটার কোনো আগ্রহই নেই। তাকানোর সময় নেই। এই কষ্ট গুলি এই যন্ত্রণা গুলি ওই মানুষটা কেন একটুও বুঝার চেষ্টা করে না? এত যাতনা পাবার পরও কি করে একেবারে হাওয়াই মিঠাই হয়ে যাবে সে?
“তাহলে এটাই থাকল কাল বা পরশুই আমরা রওনা দিবো রাঙ্গামাটি। কি বলিস?”
আচমকা ভাইয়ের মুখে এ কথা শুনে চমকে উঠল মায়রা। সকল বিবশ ভাব মুহূর্তে পরিবর্তন হলো বিস্ময়ে। কপাল কুঁচকে সে তার ঘরের বাহিরে ভাইয়ের কথায় আড় পাতল।
“আচ্ছা তুই সব কিছু রেডি করে সকলকে ইনফর্ম করে দে।”
ফোনের ওপাশের কথা শুনা হলো না মায়রার। তবে তার ভাই হু হ্যাঁ ওকে ওকে করতে করতে কল কাটল। তুহিন পা বাড়ানোর আগেই বিদ্যুৎ গতিতে মায়রা এগিয়ে এলো। হুট করে জড়িয়ে ধরল ভাইয়ের হাত। শুরু হলো আকুতি মিনুতি। পায়ে পর্যন্ত পড়ল তার ভাইয়ের। অবশেষে তেলবাজি করতে করতে বজ্জাৎ ভাই জানাল,
“ঠিক আছে তাহলে তোর ননদকেও রাজি করতে হবে।”
বিস্ময় হতবাকে মায়রা প্রশ্ন করল,
“ভাইয়া মাথা ঠিক আছে তোমার? ও অনেক ছোট। তুমি ওকে…”
“দরকার পরলে কাবিন করে ১০ বছর রাখব। তবুও ওই কালনাগিনী কেই চাই আমার। বাকিটা তুই ভাব যেতে চাস নাকি না।।”
মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৮
শিষ বাজাতে বাজাতে তুহিন চলে গেল। মায়রা পড়ল এক চিন্তায়। কিছুক্ষণ দুটানা করতে করতে স্থির করল নিজের মন। আচমকা ইহাম কে কল্পনা করতে করতে অনমন্যস্ক হয়ে বিড়বিড় করল,
“আমি যা ভেবে আপনার দারস্থো হচ্ছি সেটা আদৌও সম্ভবপর হবে কি ক্যাপ্টেন ফাহাদ ইহাম চৌধুরী?”