মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১০
সাদিয়া
রজনী বোধহয় তখন ১০ টার উপরে।
ইহাম নিজের বরাদ্দকৃত রুমে একা বসে আছে। নভেম্বর মাসের শেষ দিক চলে। তবুও ঠান্ডার খুব বেশি কোনো নাম দাম নেই। পার্বত্য এলাকা বিধায় হিমেল হাওয়া বয় শরীরে। খুব ভোরে মৃদু কুয়াশাও দেখা যায়। অথচ শহরে গরমের অন্ত নেই।
মৃদু কুয়াশাচ্ছন্ন রাত্তির। অনেকটা উঁচুতে তাদের অবস্থানরত কটেজটা। ইট পাথরের তৈরি হলেও ভেতরটা দেখলে নিঃসন্দেহে কেউ বলবে কাঠের তৈরি ঘর। চারিদিকে ঘন গাছপালার ভিড়ে কাঠের কুটিরের ফিল দিতেই বুঝি তাদের এই ব্যবস্থা। বেশ আরাম আর স্বস্তি পাওয়া যায় রুমের ভেতর। দৃষ্টি অদূরে মৃদু নীহার ঘেরা আবছা গাছপালার দিকে নিবদ্ধ থাকলেও তার অবচেতন মন আওড়াচ্ছে মায়রা কে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার। হুটহাট বেয়াদব টাও মনে চলে আসে তার। এই অনাকাঙ্ক্ষিত আগমনের কারণ কি?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মেয়েটা কি কাল খুব জোর দেখিয়েছে তার উপর? বারবার স্বামী স্ত্রী কথাটাও উল্লেখ করছিল। আচ্ছা মেয়েটা চায় কি? মায়ের কাছে কিছু বলায় মেয়েটা কি রাগ ঝাড়ল? আর কি যেন বলেছিল সে? তার ব্যক্তিগত রুমটা ওর হবে? হঠাৎ গাধা মেয়েটা এমন কেন বলল? কি বুঝাতে চাইল সে? কি জানি ওতসব ভাবনা আসছে কেন তার মাথায়। কিন্তু বিবেকের ঘর থেকে গইবি আওয়াজ ভাসছে কানে। তারা আলোড়ন তুলে কিছু একটা বলতে ব্যস্ত। কি মনে করে সে নিজের ফোনটা তুলে নিল টেবিলের উপর থেকে। হোয়াটসএপে গিয়ে চেক করে নিল মায়রা এক্টিভ কি না। ওকে লাইনে না পেয়ে সরাসরি কল দিন নাম্বারে। কিন্তু ফোনটা বন্ধ। বিরক্ত ভাব নিয়ে টেবিলের উপর আবার রেখে দিতে চাইলেও স্বস্তি পেল না। তাই কন্টাক্ট লিস্টে গিয়ে শাশুড়ির নাম্বারটা খুঁজে খুঁজে বের করল। প্রচন্ড দ্বিধা জড়তা নিয়ে অবশেষে কল করেই ফেলল ফাতেমা বেগমের নাম্বারটায়।
একা একটা ঘরে টিভিতে মন বসাতে পারছেন না ফাতেমা বেগম। ছেলে মেয়ে স্বামী কেউ নেই বাড়িতে। স্বামী মহিন সাহেব অফিস থেকে একটু পরই চলে আসবেন। ফাঁকা বাসায় কাজও শেষ হয়ে গিয়েছে। টিভিতে উনার পছন্দের সিরিয়াল চলছে তবুও বুঝি উনি শান্তি পাচ্ছেন না। বড্ড নিঃসঙ্গ বোধ উনাকে বিহ্বল করে তুলছে ক্রমশ। আচমকা ঘর থেকে কল টোনের আওয়াজ পেতেই হন্তদন্ত হয়ে ড্রয়িংরুম থেকে উঠলেন। বসার রুম পেড়িয়ে যেতেযেতে কলটা কেটেও গেল। কপাল কুঁচকে মধ্যবয়সী ফাতেমা বেগম চেক করতে গেলেন কে কল দিল। তবে তার আগেই স্কিনে বড় বড় অক্ষরে লেখা ভেসে উঠল “ইহাম বাবা।” সময় ক্ষয় না করে তিনি কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শান্ত ভাবে সালাম আসতেই তৃপ্তি প্রশান্তি তে মুচকি হেসে উঠেন তিনি। হাসি মুখে সালামের জবাব নিয়ে নিজেই বললেন,
“ইহাম বাবা কেমন আছো?”
ওপাশ থেকে ক্ষীণ অথচ ভরাট গলায় জবাব দিল,
“জ্বি ভালো আছি আম্মু। আপনি কেমন আছেন? আব্বু ভালো আছেন?”
মুচকি হাসলেন ফাতেমা বেগম। ধীরে এগিয়ে গিয়ে আবারও বসলেন সোফায়। ছেলেটা আসলে ভীষণ মার্জিত নম্র স্বভাবের। মেপেঝেপে কথা বলতে জানে। প্রফুল্ল চিত্তে উত্তর দিলেন তিনি,
“এই তো বাবা আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ ভালোই রাখছেন। তোমার কি খবর বাবা? খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করো তো নাকি?”
“জ্বি আম্মু। আসলে আমি মায়রার ফোনে কল দিয়েছিলাম কিন্তু ওর ফোনটা বন্ধ আসছে। আপনি কি একটু ওকে ডেকে দিবেন?”
ইহামের কথায় কপাল কুঁচকে আনলেন তিনি। মেয়েটা কি জামাই কে জানায়নি? কই তাকে জিজ্ঞাস করার পর তো সে বারবার বলেছে ইহাম সব জানে অনুমতি নিয়েছে সে। তবে কি মেয়ে উনার কাছে মিথ্যে বলল? এই কারণেই তিনি একদম রাজি হয়নি যেতে দিতে।
অক্ষুণ্ণ কন্ঠে তিনি বলেন,
“বাবা মায়রা তো তুহিনের সাথে আজ ট্যুরের জন্যে বের হয়েছে। কেন তুমি কিছু জানো না?”
বড্ড ইতস্তত বোধে পড়ে গেল ইহাম। ভেতরের বিচলিত ভাব বাড়ল তার। সম্মানীয় শাশুড়ি কে কি করে বলে উনার বেয়াদব মেয়েটার সাথে সে কথা বলে না। তাদের মাঝে কোনো রকম বাক্যব্যয়ের আগেই বাকবিতণ্ডা লাগে। আজই বোধহয় প্রথম সে স্বেচ্ছায় কল দিয়েছে মায়রা কে। বিয়ের তিন মাস হতে চলল অথচ নিজ থেকে সে কোনোদিন কল দেয়নি ওই মেয়েটাকে। তার অবচেতন মন ঠিক এই মুহূর্তে অনুধাবন করল বিষয়টা আসলেই ঠিক দায়িত্বহীন কিংবা ঔচিত্য বিহীন সীমায় স্খলিত। খানিক অস্বস্তি হলেও
নরম স্বরে বলল,
“আসলে ব্যস্ততা বেড়েছে তো। কাজের খুব চাঁপ। তাই আরকি…”
“ঠিক আছে ঠিক আছে বাবা। আমি বুঝতে পেরেছি। আমার মেয়েটাও হয়েছে। ও বলল তুমি নাকি পারমিশন দিয়েছো তাই তো আমি ওকে তুহিনের সাথে সিলেট যেতে দিতে রাজি হয়েছি। যদি জানতাম তুমি কিছু জানো না তবে..”
ফাতেমা বেগমের কথা সম্পূর্ণ হবার পূর্বেই আঁতকে উঠল ইহাম। সেই সঙ্গে কপালে কয়েক ভাঁজ পড়ল তার। হঠাৎ কেমন উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল,
“কোথায় বললেন? কোথায় গিয়েছে মায়রা?”
ফোনের ওপাশের উৎকণ্ঠটা বুঝি ফাতেমা বেগম খানিক ধরতে পারলেন। তিনি একটু নীরব থেকে বললেন,
“কেন বাবা কি হয়েছে? কোনো সমস্যা সিলেটে?”
বিরক্ত বিক্ষোভে চোখ মুখ এক করে তীক্ষ্ণ নয়নজোড়া বুজে আনল ইহাম। ছোটছোট আকারে ছাটা চুল গুলি আঙ্গুলের ফাঁকে ঢুকিয়ে ভেতরের অশান্ত আলোড়ন টা বুঝার চেষ্টা করল। মুখের ভাব বিকৃত করে আচমকা ঠোঁট ফেরে বলে উঠল,
“শীট।”
হঠাৎই বুক মুচড়ে উঠল ফাতেমা বেগমের। ছেলেমেয়েদের শঙ্কায় ভীত হয়ে গেল উনার হৃদয়। ফোনের ওপাশে শত মাইল দূরে থাকা ইহামের ভাবভঙ্গি কিংবা কথার ধরণ কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি। তবুও ভেতরটা অজানা ভয়ে খচখচ করছে উনার। শঙ্কিত কন্ঠে তিনি থেমে থেমে বললেন,
“ই– ইহাম বাবা কি হ-হয়েছে?”
চট করে ইহাম নিজের উদ্বিগ্নতা টা ধরতে পারল। চোখ খুলে দুই সেকেন্ড ভেবেই স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দিল,
“তেমন কিছু নয় আম্মু। আপনি শুধুশুধু টেনশন নিয়েন না। আসলে মায়রার সাথে একটু কথা বলার ছিল। আমার কাছে তো তুহিনের নাম্বার নেই। আপনি কি তার নাম্বারটা একটু দিতে পারবেন?”
প্রয়োজনের বাহিরে আর কথা বাড়ালো না ইহাম। সে চুপ করতেই সংশয় জড়ানো কন্ঠে ফাতেমা বেগম বলার চেষ্টা করলেন,
“ঠিক আছে। তবে সত্যি কোনো চিন্তার কারণ নেই তো বাবা?”
“একদম না। আপনি চিন্তা করবেন না। আহ, তুহিনের নাম্বারটা দিবেন আম্মু?”
“আমি নাম্বারটা খাতায় তুলে তোমায় কল করছি বাবা।”
“আচ্ছা রাখছি তবে।”
ইহাম কল কাটতেই তার মুখে আবারও চিন্তার গম্ভীর ভাব ফুটে উঠেছে। এই প্রথম মায়রা কে নিয়ে বেশ চিন্তা হচ্ছে তার। চোখে মুখে করুণ একটা ভাবের সাথে ক্ষোভ মিলেমিশে একাকার হয়ে উঠেছে। মিশ্র অনুভূতিতে বড্ড চঞ্চল তার ভেতর। চিন্তিত মুখশ্রী তে এক হাত কটিদেশে ঠেকিয়ে অন্য হাত দিয়ে চোখ মুখ ঢাকল সে। কিছুক্ষণ ওভাবেই নীরব থেকে তার বেসামাল দুশ্চিন্তা আর উদবেগ হজম করার চেষ্টা করল। শান্ত স্থির থাকলেও তার ভেতরটা অস্থির শঙ্কায় ব্যাকুল হয়ে উঠছে। সিলেটের বর্তমান অবস্থা মুটেও ভালো না। বিশিষ্ট জনপ্রিয় এক রাজনীতিবিদ কে গলা কে টে হ ত্যার কারণে বর্তমানে সিলেট গরম হয়ে আছে। অ বরোধ গাড়ি ভা ঙচুর সহ নানান স’হিংসতা বিরাজ করছে সিলেটে। এমন অরাজক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তে কি করে তারা সিলেট যেতে পারল? আর তুহিনই বা কেমন ভাই বোন কে নিয়ে ট্যুরে চলে গিয়েছে ঢেংঢেং করে? মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল ইহাম। তার চিত্ত তীব্র ব্যাকুল অশান্ত। তুহিনের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত রাগে চোখ মুখ গরম হয়ে উঠল তার। ইচ্ছা হচ্ছে ওকে সামনে পেলে ঠাটিয়ে দুইগালে দুটো চ র দিতে। আর মায়রা? ওই গাধা নির্বোধ মেয়েটা? ওকে সামনে পেলে তো…
চোখ মুখ হিংস্র করে দাঁত কাটল সে।
তুহিন ড্রাইভারের সাথেই বসে আছে। মোটমাট ঢাকা থেকে তারা ১১ জন এসেছে। তুহিন সহ ওর ৯ বন্ধু আর মায়ারা, শিফু। তুহিন পিছনে তাকিয়ে দেখল মায়রার কাঁধে শিফু মুখ হা করে ঘুমাচ্ছে। ঠোঁটের কুর্নিশ ভিজে আছে মুখের লালায়। বাদবাকি সবাই তখন ঘুমে মশগুল। তুহিন চট করে নিজের ফোনে সেই হাস্যকর দৃশ্য বন্ধী করে মুচকি হেসে উঠল। স্কিনে শিফুর ছবি দেখতে দেখতেই আচমকা ভেসে উঠল “ইহাম ভাই” নামটা। নাম্বারটা মায়ের কাছ থেকেই সংগ্রহ করে রেখেছিল যদি কখনো দরকার পড়ে সেই আশায়। ইহামের কল পেয়ে চোখ বড় হয়ে উঠে তার। চকিতে তাকায় ঘাড় বাঁকিয়ে পিছনে। দ্রুত ঘুমন্ত মায়রা কে ডেকে তুলে সে।
“আরে এই কুমড়োপটাশ তাড়াতাড়ি উঠ। দেখ তোর জামাই কল দিয়েছে?”
তুহিনের চিৎকারে মায়রার সাথে ওর পাশে থাকা শিফুও সজাগ হয়েছে। ঘুমন্ত দুই কিশোরীর সবটা বুঝতে সেকেন্ড দশএক সময় ক্ষুণ্ণ হলো। ভয়ে শিফু মায়রার হাত জড়িয়ে ধরল। ভীত কন্ঠে বলল,
“এখন কি হবে ভাবি? ভাইয়া কে ভুলেও কিন্তু বলো না আমি এসেছি। তুমি বলেছো ভাইয়া খাগড়াছড়ি আছে। আর আমরা সেদিকে যাবো না তাই আমি এসেছি..”
শিফুর কথা মাঝপথে থামিয়ে তুহিন জোর গলায় বলে উঠল,
“আরে চুপ করো ভীতুর ডিম এখন কি করব সেটা বলো।”
তুহিন প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকায় বোনের দিকে। মায়রা নিজেও শঙ্কিত। সাহস দেখিয়ে চলে এলেও মৃদু ভয় তাকে শিউড়ে দিচ্ছে। সময় নিয়ে ঢোক গিলে বলল,
“কল রিসিভ করো না ভাইয়া।”
তুহিন উত্তর দেওয়ার আগেই কলটা কেটে গেল। সবাই দীর্ঘশ্বাস ফেলার পূর্বেই হৃদয় কাঁপিয়ে আবারও ভাইব্রেট করে উঠল তার ফোনটা। আবারও ইহাম কল দিয়েছে। তুহিন সন্দিগ্ধ নজরে বোনের দিকে তাকালে তাকেও নিরুপায় দেখাল। অবশেষে পুনরায় কল কাটার আগেই রিসিভ করল সে।
“হ্যাঁলো তুহিন কোথায় আছো তোমরা?”
মোটা গলায় ধমকের সুরে বলা কথাটায় কাঁপল তুহিনও। ঢোক গিলে হাসার চেষ্টা করে জবাব দিল,
“আ আসলে ভাই আমরা তো..”
“তোমরা এই সময়ে কোন আক্কেলে সিলেট গিয়েছো বলো তো ননসেন্স? তাও আবার ওই ইডিয়ট টাকে নিয়ে?”
তুহিন বুঝল ইহামের চিন্তার কারণ। সে আশ্বাস দেবার জন্যে বলল,
“ভাইয়া আপনি চিন্তা করবেন না আমরা সেভ জায়গাতেই আছি।”
“মায়রার কাছে ফোনটা দাও।”
স্পিকারে শেষের ক্ষোভ মেশানো কথাটা আন্দাজ করতে পারল মায়রা। দ্রুত ভাইয়ের কাছ থেকে ফোনটা নিয়েই কেটে দিল তা। পরপর সেটা অফ করে ফোঁস করে দম নিল।
সারারাত তার খুব একটা ভালো ঘুম হয়নি। এক বিহ্বল চিন্তা তাকে অস্থির করে তুলেছে। বিছানায় ছটফট করতে করতে মায়রার প্রতি শুধু ক্ষোভটাই বেড়েছে তার। যতবার তুহিন বা মায়রা কে কল দিয়েছে ততবার ফোন বন্ধ পাবায় তার রাগের সাথে ব্যাকুল হয়েছে হৃদয়। মেয়েটা তার কাছে নেই, নেই কোনো যোগাযোগ অথচ কিভাবে জ্বালাচ্ছে তাকে। কোন অদৃশ্য টানে অস্থির করে তুলছে। জীপে বসে আছে ইহাম। পরনে কালো শার্টের সাথেই মেলানো কালো প্যান্ট। ফর্শা পেশিবহুল হাতে বড্ড বেশি সুভা পেয়েছে কালো ফিতার একটা স্মার্ট ওয়াচ। খুব ভোরেই সে রওনা হয়েছে। উদ্দেশ্য বান্দরবনের নীলাচল। আজ গুরুত্ব পূর্ণ কিছু একটা হতে যাচ্ছে এখানে। তাই যা পদক্ষেপ নিতে হবে তা যথা সম্ভব বেশ সাবধানেই নিতে হবে। আজকের কাজটা সম্পূর্ণ হলেই মজিদ পাহাড়িকে কাবু করতে তার খুব বেশি কসরত করতে হবে না।
সকাল তখন ৭ টার মতো বাজে। সবাই চাঁন্দের গাড়ি করে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় এগিয়ে যাচ্ছে বহু কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে। ঈষৎ কুয়াশা ঘেরা ধূসর সবুজ গাছপালা গুলি বড্ড বেশি আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে। প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্যে ঘেরা বান্দরবনের হিমেল হাওয়া গাড়ির ভেতরের প্রতিটি ব্যক্তির শরীর বেদ করে একবারে অন্তঃস্থলে গিয়ে লাগছে। সবার চোখে মুখে তখন স্তূপেস্তূপে জমা মেঘ ও পাহাড়ি সৌন্দর্যের মুগ্ধতা। প্রকৃতি যেন ডানা মেলে দিয়ে রাজত্ব করছে এখানে। মায়রা কিঞ্চিৎ প্রফুল্লের হাসি মেলে তাকিয়ে রয়েছে সেই দিকে। শিফু ছটফট করে একবার ওদিকেও দৃশ্য ও। আরেকবার অন্যদিকের দৃশ্যে ডুবে গিয়েছে। তুহিন সহ ওর বন্ধুরাও মুগ্ধ হয়ে দেখছে প্রকৃতির দ্বার খুলে দেওয়া উন্মুখ সৌন্দর্য। সরু রাস্তায় আঁকাবাঁকা পথে গাড়ি হেলে যাওয়ায় তাদের শরীরও বেঁকে আসছে। থেমে থেমে এক রোমাঞ্চকর ভয় তাদের অগাধ উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। শত ফিট উঁচুতে রাস্তায় চলা গাড়ির ভেতর থেকে নিচের অতল গাছপালায় পূর্ণ খাদ শরীর শিউড়ে দেওয়ার মতো। বিশাল বড় পাথরে বেষ্টিত পাহাড়ের পাশ দিয়ে চলা গাড়ির ভেতর থেকে সবাই হা করে বিস্মৃত নজরে তাকিয়ে অবলোকন করছে সেই মনোরম প্রকৃতির বিমুগ্ধকর দৃশ্য।
বান্দরবন শহর থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরে নীলাচল হিল সাইডের রিসোর্ট বুক করা রাখা হয়েছিল তাদের। গাড়ি থেকে নেমেই আগে রিসোর্ট এ উঠে তারা সকল ফর্মালিটি কমপ্লিট করে চেক পোস্টের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়েই বের হলো পুনরায়। পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে আগে সূর্যাস্ত দেখে তারপর ব্রেকফাস্ট করবে। এরপর ক্রমানুসারে ডাবল হ্যান্ড, টাইটানিক ভিউ, চিম্বুক পাহাড় বা কালা পাহাড়, শৈলপ্রপাত ঝর্ণা স্থান গুলিতে যাবে। যদিও সেখানে এখন খুব ভালো ভিউ পাওয়া যাবে না। বর্ষা কালে শৈলপ্রপাতের দ্বার খুলে যায়। স্বচ্ছ পানিতে কলকল করে ঝড়ে দ্বারা।
আস্তেধীরে এসে দাঁড়াল ইহাম। চোখে তার শার্ট প্যান্টের মতোই কালো রঙ এর রোদ চশমা। ভিউ পয়েন্টের প্রতিটি মানুষের দিকে নজর বুলিয়ে যাচ্ছে ইহাম। তার তীক্ষ্ণ বাজপাখির দৃষ্টি অসংগতির কোনো কিছুর দিকে। সব কিছু গাঢ় নজরে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তার আরো ৭ সহকর্মী এখানে এলোমেলো ভাবে অবস্থিত আছে সিভিল ড্রেসেই। কারো বুঝার জো নেই কারা তারা। কিংবা এখানের একজন ট্যুরিস্ট ধারণাও করতে পারবে না কি হতে যাচ্ছে এখানে। কত ভয়াবহ গা কাটা দেওয়া কান্ডও ঘটতে পারে এখানে। খুব দৃঢ়তার সাথে চোখ বুলাতে বুলাতে হঠাৎ কিছু খেয়াল করতেই থমকে দাঁড়াল ইহাম। বিস্ময় আশ্চর্য ভাবভঙ্গীমায় কপাল কুঁচকে চোখের উপর থেকে কালো চশমা সরিয়ে নিল সে। এবার স্পষ্ট দেখতে পেল তার একমাত্র বোন শিফু কে।
খুব ভালো করে নজর বুলিয়ে নিশ্চত হলো এটা শিফুই। বিস্ময় হতবাকে তার মস্তিষ্ক কিংকর্তব্যবিমূঢ়। শিফু এখানে কি করে? কি করছে সে এখানে? তার বাবা মা কেউ কিছু বলেনি তো? বাবা বাসায় অসুস্থ এখনো ঠিক ভাবে সুস্থ হয়নি অথচ শিফু এখানে কি করে আসবে? চিন্তায় চিন্তায় চোখের দৃষ্টি সরু শাণিত হয়ে আসছে ইহামের। চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে শিফু একদল লোকের সাথে এগিয়ে আসছে। দেখা দৃশ্যও যেন বিশ্বাস করতে চাইছে না এটা শিফু।
আচমকা শিফু ভাইয়ের অনুরূপ কাউকে দেখেই আঁতকে উঠল। চকিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজল মায়রা কে। রেলিং এর পাশেই দাঁড়িয়ে সেলফি তুলতে দেখা গেল তাকে। শিফু দৌড়ে সেদিক চলে গেল।
দূর থেকে শিফুর ভীত চোখ মুখে এবার নিশ্চিত হলো এটা তার বোনই। পরক্ষণে তার পাশের মোহিনী কিশোরী কে দেখেই স্তব্ধ হলো সে। কি আশ্চর্য সে না বলল তারা সিলেটে? তবে এখানে কি করছে? এই অসভ্য বেয়াদব মেয়েটা একটা ধড়ি, মিথ্যাবাদীও? ক্রোধ বিদ্বেষে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঝড়তে থাকল অগ্নিকণা।
মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৯
তেজস্বীয় ভাবে দাঁত পিষে হাত মুষ্টিমেয় করল অচিরে। দাবানল ঝাড়তে উদ্যত হবার পূর্বেই এক ভয়ংকর দৃশ্য দেখে থমকে গেল সে। বাড়ানো পা ফেলতে পারল না আর। স্তম্ভিত হয়ে কপালে আরো দৃঢ় ভাঁজ উঠে এলো। ওই মারাত্মক দৃশ্য টার জোর বুঝি থমকে দিয়েছে তার কঠোর হৃদযন্ত্রটাও।