মোহশৃঙ্খল পর্ব ১২

মোহশৃঙ্খল পর্ব ১২
মাহা আয়মাত

সকাল এগারোটা বাজে। বিছানায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মেহজা। তার নিশ্বাসের সাথে তাল মিলিয়ে ধীরে উঠছে-নামছে বুকের ওঠানামা। তার পাশে বসে আছে আরভিদ। চোখে অপার মুগ্ধতা, এক অদ্ভুত নিবেদন। মাঝেমধ্যে মেহজার মুখে এসে পড়া চুল সরিয়ে দিচ্ছে ধীরে, যত্নে, ভালোবাসায় ভরা হাতে। যেন এই চুলগুলো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, এমন কোনো সম্ভাবনাকেও সে ঠাঁই দিতে চায় না।

মেহজার কথায় কালো পাঞ্জাবি পরে আছে আরভিদ। কিন্তু তার জালেমার তো কোনো খবরই নেই! সে দিব্যি ঘুমোচ্ছে। আর ঘুমাবেই বা না কেন? এই যে ঘুম, তার জালেমার প্রথম ভালোবাসা! আরভিদের ঠোঁটের কোণে এক নিঃশব্দ হাসি খেলে যায়। তার মনে হয়, মেহজার ঘুমন্ত মুখশ্রীতে এক অপার্থিব শান্তি লুকিয়ে আছে। হঠাৎই যেন চিন্তার ভাঁজ পড়ে তার কপালে। মেয়েটা কেন বলে সে সুন্দর নয়? সে কি কখনো নিজেকে আরভিদের চোখ দিয়ে দেখেছে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

যদি দেখতে পারত, তাহলে হয়তো লজ্জায় হেসে ফেলত। নিজের সৌন্দর্যের অহংকারে নয়, বরং নিজের অজান্তে এতটা মায়াবতী হয়ে ওঠার বিস্ময়ে। নিজের এই অপার সৌন্দর্যে সে নিজেই বিমুগ্ধ হয়ে যেত, যেমনটা আরভিদ প্রতিদিন হয়। এই ভাবনার গভীরে ডুবে যেতে যেতে হঠাৎই আরভিদের মনে পড়ে যায় পুরনো এক দিনের কথা। ঠিক সাত বছর আগের তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর আর বিশেষ দিনটি, যেদিন সে প্রথমবার তার চঞ্চলারানীর প্রেমে পড়ে। ঘটনা ছিল অদ্ভুত রকমের।
তখন মেহজারের বয়স মাত্র বারো। আরভিদ তখন ছাব্বিশ বছরের এক তরুণ নেতা—আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুবলীগের সভাপতি। এই জায়গায় আসতে তার খুব একটা সময় লাগেনি। এর পেছনে দুটি বড় কারণ ছিল। এক, আরভিদের দাদা আলতামিশ কারদার ছিলেন দেশের সাবেক আইনমন্ত্রী। তিনি ছিলেন তুখোড় বুদ্ধিমান এক নেতা, যার প্রভাব ছিল সর্বত্র। প্রভাবশালী এই পদে তিনি ছিলেন প্রায় উনিশ বছর, এবং সেই সময়েই কারদার পরিবার আরও বেশি আলোচনায় আসে।

অবশ্য এর আগেও তারা সমাজে পরিচিত ছিল—উচ্চবংশীয় পরিচয় আর টাকার জোরে। দুই, আরভিদের মধ্যেও ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির প্রতি একটা টান ছিল। রাজনীতি যেন তার রক্তে মিশে আছে—ভাবনায়, কথায়, আচরণে, আত্মবিশ্বাসে। এই দুই মিলে তাকে খুব অল্প বয়সেই ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। এখন আরভিদ তার দাদার ছায়ার মতো—নির্বিকার, আত্মবিশ্বাসী, আর ক্ষমতার খেলায় দক্ষ।
সেই দিন ছিলো ১৪ অক্টোবর, মিশানের জন্মদিন। ছোট্ট পরিসরে আয়োজন করা হয়েছিল। রোজ গোল্ড থিমে ঘরটা সাজানো—ঝকমকে ফ্রিঞ্জ পর্দা আর ব্যাকড্রপের সামনে বড় বড় বেলুনের আর্ক। চারপাশে রোজ গোল্ড, হোয়াইট আর ট্রান্সপারেন্ট বেলুনে ঘরটা একদম রাজকীয় দেখাচ্ছে। আলো আর ঝিকিমিকি ছায়ায় মিশানের জন্মদিন যেন এক পরীর রাজ্যে উদযাপন! টেবিলে রাখা চকলেট কেক, পাশে কিছু স্ন্যাকস আর সফট ড্রিংকস। কারদার ম্যানরের সবাই এসেছিল সেদিন মেহজাদের বাড়িতে—শুধু আদ্রিক ছাড়া। আরভিদও সেদিন যেতে চায়নি, ব্যস্ত ছিল রাজনৈতিক কাজে, তবু ফুজির অনুরোধে শেষমেশ রাজি হয়।

ঘরের এক কোণে সোফায় বসে গম্ভীর মুখে ফোন স্ক্রোল করছিল আরভিদ। অন্য সবাই ছবি তুলছিল, হাসছিল, গল্প করছিল। কিন্তু সেদিকে তার কোনো ধ্যান নেই। আস্মিতা ও মাশরিফ মিলে কয়েকটা ছবি তোলে। তারপর মাশরিফ এসে ডাক দিলো,
— আরভিদ, এসো মিশানের সাথে একটা ছবি তুলো।
আরভিদ ফোন থেকে চোখ না তুলেই বলে,
— না আঙ্কেল, ইচ্ছে করছে না।
আস্মিতা অনুরোধের সুরে বলে,
— একটা অন্তত তুলো। তোমার বোনের জন্মদিন!
মিশানও বায়না ধরে বলে,
— ভাইয়া, প্লিজ না? একটা ছবি তোলো!
মাশরিফ হেসে বলে,
— বার্থডে গার্ল বলছে! তার কথা অন্তত ফেলো না!
আরভিদ বাধ্য হয়ে কিছুটা বিরক্তি নিয়েই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা পকেটে রেখে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় মিশানের পাশে। সামনে মাশরিফ হাতে ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে।
মাশরিফ ক্যামেরা সেট করে বলে,

— মিশান আম্মু, সামনে তাকাও।
দুজনেই ক্যামেরার দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো। মাশরিফ ছবির বোতামে চাপ দিতেই আচমকা—
এক ঝটকায়, বেগতিক গতিতে, কোথা থেকে এক নীল ফ্রক পরা মেয়ে ছুটে এসে সোজা ধাক্কা খেল আরভিদের সঙ্গে। ধাক্কাটা ছিল অপ্রত্যাশিত, হঠাৎ, এবং ভীষণ জোরে। আরভিদের ভারসাম্য একেবারে হারিয়ে গেল। সে দুলে গিয়ে পড়ে গেল সোজা সামনে রাখা টেবিলের উপর—আর তার মুখ গিয়ে পড়ে জন্মদিনের কেকের মাঝখানে! এক মুহূর্তের জন্য ঘরটা যেন স্থির হয়ে যায়। কেবল মিশানের একরত্তি কান্না ছড়ালো নীরবতা ছিঁড়ে,
— এ্যা এ্যা! আরভিদ ভাইয়া আমার কেকের উপর পড়ে কেকটা নষ্ট করে ফেলেছে! এখন আমি কেক খাবো কীভাবে?

কিন্তু কারও কানে কথাটা ঢোকে না। ঘরজুড়ে একটা অজানা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কারণ সবাই জানে, আরভিদের রাগ ঠিক ভয়ংকর। এখন যদি সেটা জ্বলে ওঠে, কেউ রেহাই পাবে না। আরভিদ ধীরে ধীরে মুখ তোলে কেক থেকে। তার সারা মুখে কেকের ক্রিম লেপ্টে আছে—দেখতে হাস্যকর লাগলেও, লালচে চোখগুলো স্পষ্ট করছিল তার অতিরিক্ত রাগ। গাল টানটান, থুতনির কাছে ক্রিম মিশে গেছে ক্রুদ্ধ চোয়ালের সাথে।
সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। রাগে তার ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে শক্ত হয়ে গেল, চোয়াল শক্ত করে দাঁত গুঁজে ধরে সে নিজের ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। তার শ্বাস ফুলে উঠছে, গায়ে যেন আগুন জ্বলে উঠেছে। এদিকে নীল ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়েটি নিরবে দাঁড়িয়ে, কাঁপতে কাঁপতে চেয়ে আছে আরভিদের দিকে। চোখে জল টলমল করছে, ঠোঁট কাঁপছে। সে নিজেও জানে না কান্না না আতঙ্ক কোনটা আগে বের হয়ে আসবে।
আস্মিতা এবার সেই মেয়েটির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ছুটে গিয়ে মেয়েটার বাহু ধরে জোরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে রাগে গর্জে ওঠেন,

— এটা কী করেছো মেহু? দিনদিন বেশি দুষ্টুমি করছো! মাথায় কিছু আছে তোমার?
আরভিদ অগ্নি দৃষ্টিতে মেহজার দিকে তাকায়, কিন্তু এক মুহূর্তে থেমে যায়। আরভিদের চোখ স্থির হয়ে গেছে ছোট্ট মেয়েটির মুখে। তীব্র রাগ নিয়ে তাকিয়ে ছিল সে, কিন্তু ঠিক পর মুহূর্তে সেই চোখে বিস্ময়, মুগ্ধতা, আর একরকম নিরব কোমলতা। মেহজার চোখের জল আটকে রাখার প্রাণপণ চেষ্টাটা তাকে থমকে দিল। আরভিদের বুকের ভেতর কী যেন ধ্বনি তুললো—অচেনা, অজানা এবং অদ্ভুত অপরিচিত এক শব্দ।
যার সাথে সে আগে কখনো পরিচিত হয়নি। সেই এক চিলতে চাহনি, সেই নির্দোষ ভয়, সেই অসহায় মুখটা—সব কিছু মিলে আরভিদের সমস্ত রাগ যেন ধীরে ধীরে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সে তাকিয়ে থাকে। পলক ফেলতে ভুলে যায়। পাশ থেকে তাহিয়া কারদার এগিয়ে এসে পরিস্থিতি আঁচ করেন। তার গলা শুকিয়ে যায়। আরভিদের মুখে সেই ক্রুদ্ধ নীরবতা দেখে মনে হয় হয়তো এইবার কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটবে।

— আরভিদ!
তাহিয়া কারদার কাছে এসে ডাকেন। হাতে টিস্যুর প্যাকেট।
— আরভিদ, টিস্যু নাও, মুখটা মুছে ফেলো।
দুইবার ডাকার পর আরভিদ যেন হুঁশে ফেরে। ধীরে ধীরে চোখ সরায় মেহজা থেকে তাহিয়ার দিকে। তাহিয়া টিস্যু বাড়িয়ে দিলে সে একবার তাকায়, আবার চোখ যায় মেহজার দিকে। তারপর একরকম বাধ্য মন নিয়ে মেহজার থেকে চোখ সরিয়ে টিস্যু নিয়ে মুখটা মুছে নেয়। এইদিকে, আস্মিতার বকাঝকিতে ছোট্ট মেহজা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রাখে। সারা শরীর তার কাঁপছে। মেয়েটা ইচ্ছে করে ধাক্কা দেয়নি, সে তো তার চাচাতো ভাই তুফিনের হাত থেকে বাঁচতে ছুটে এসেছিল।

কে জানতো ছুটে এসে সে সোজা আরভিদ ভাইয়ের সাথে ধাক্কা লাগবে? আর তিনিও গিয়ে কেকের উপর পড়ে যাবেন? আরভিদ টিস্যুতে মুখ মুছতে মুছতে আবার তাকায় মেহজার দিকে। কেন জানি, তার চোখ বারবার মেহজার দিকেই ফিরে যাচ্ছে। এই প্রথমবার! একটা ধাক্কা, একটা চাহনি, আর একচিলতে জলভেজা চোখ—আরভিদের রাগি বাস্তবতা থেকে কে যেন তাকে ছিঁড়ে নিয়ে যায় এক অজানা অনুভূতির দিকে। এতটুকু একটা মেয়ে—কিন্তু তার চোখে এমন কী আছে যে, বারবার তাকাতেই ইচ্ছে করে?
মাশরিফ এগিয়ে এসে আস্মিতার হাত থেকে মেহজার বাহু ছাড়িয়ে নিজের কাছে আনেন। তারপর আদুরে স্বরে জিজ্ঞেস করেন,

— আম্মু, তুমি এভাবে ছুটোছুটি করছিলে কেন?
ঠিক তখনই একটু দূর থেকেই মেহজার চাচাতো ভাই তুফিন অপরাধী গলায় বলে,
— চাচ্চু, মেহুর কোনো দোষ নেই। আমি ওকে ধরার জন্য ছুটছিলাম, মেহু তো শুধু আমার কাছ থেকে পালাচ্ছিলো!
আরভিদের চোখ এবার ধীরে ধীরে মেহজা থেকে সরে গিয়ে স্থির হয় তুফিনের ওপর। ছিমছাম শরীর, শ্যামলা গাত্রবর্ণ—তাকে দেখে আরভিদের মুখের শান্ত ভাবটা রাগে লাল হয়ে ওঠে। মেহজা এই ছেলেটার সাথে ছুটাছুটি করেছে! কেন জানি, সহ্য হচ্ছে না তার।
মাশরিফ ঘাড় ঘুরিয়ে তুফিনের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলেন,
— পালাচ্ছিলো কেন?
তুফিন বলে,

— আসলে মেহু আমাকে মজা করে থাপ্পড় মেরে পালিয়েছিলো। আমিও মজা করেই পেছনে দৌড়াচ্ছিলাম!
নাজনীন চোখ গোল করে বলেন,
— দেখেছো সাহস মেয়ের! নিজের থেকে পাঁচ বছরের বড় ছেলেকে কিনা থাপ্পড় দেয়!
তুফিন মাথা নেড়ে বলে,
— আরে না না, মজা করেই দিয়েছিলো! আমি কিছু মনে করিনি!
আস্মিতা বলে,
— তুমি মনে করোনি সেটা অন্য কথা, কিন্তু সে কেন তোমাকে মজা করে থাপ্পড় দেবে? বেয়াদব মেয়ে কোথাকার! হাত কেটে ফেলবো একদম!
আর ঠিক তখনই আরভিদের চোখ যায় মেহজার বুকের দিকে—আর মুহূর্তেই আগুন লেগে যায় মাথায়। মেহজার গায়ে ওড়না নেই! তাহলে কি এতোক্ষণ মেহজা এই ছেলেটার সামনে ওড়না ছাড়া ছিলো?
আরভিদ আর কিছু না ভেবে গর্জে ওঠে,

— এইভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে যা!
মেহজা কেঁপে উঠে কেঁদে ফেলে। তাহিয়া ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করে।
— আরভিদ, বাচ্চা মেয়ে… ভুল করে…
আরভিদ আবারও গর্জে উঠে থামিয়ে দেয়,
— শাট আপ মম!
তারপর কঠিন চোখে মেহজার দিকে তাকিয়ে বলে,
— আমি তোকে কি বলেছি? ভেতরে যা! আর যদি দেখি কোনো ছেলের সাথে ছুটাছুটি করেছিস, তাহলে তোর হাত পা ভেঙে ফেলবো!

মেহজা এবার আর কান্না আটকে রাখতে পারে না আরভিদের সেই ঘর কাঁপানো হুংকারের। সে হেঁচকি তুলে কান্না করতে থাকে। অর্তিহা তাড়াতাড়ি ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে ভেতরের দিকে নিয়ে যায়। আরভিদ একবার রাগমাখা চোখে তুফিনের দিকে তাকিয়ে সোজা সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। পেছন থেকে সবাই তাকে ডাকতে থাকে, কিন্তু সে কারো ডাকে সাড়া দেয় না। সেদিনই আরভিদ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরে আসে।
বাড়ি ফিরে সোজা শাওয়ার নেয়, তারপর বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে ঘুমানোর জন্য। কিন্তু চোখে ঘুম আসে না একটুও। মেহজার মুখটা বারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। মেহজার সেই ভীতসন্ত্রস্ত, জলটলটল করা চোখগুলো! সেই চোখগুলো দিয়ে তাকানো! ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা। সেগুলো কেন জানি আরভিদের মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে। না, আরভিদের মাথা থেকে যাচ্ছেও না! কিন্তু এগুলো তো মনে গেঁথে থাকার বিষয়ও না! তাহলে এভাবে আরভিদের মনে গেঁথে আছে কেন?

অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করার পর সে উঠে বসে। নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকে,
— কি হচ্ছে আমার? আমি কি মেহুর প্রেমে পড়ে গেছি? সিরিয়াসলি? আমি প্রেমে পড়েছি, তাও কিনা নিজের থেকে ১৪ বছরের ছোট একটা মেয়ের ওপর? যে এখনো মাত্র ৭ম শ্রেণিতে পড়ে? আই কান্ট বিলিভ দিস! জীবনে কত মেয়েকে রিজেক্ট করেছি, আর আজ আমি নিজেই একটা অসভ্য বেয়াদব মেয়ের প্রেমে পড়লাম? এটা কীভাবে সম্ভব? এটা আমার জীবনের প্রথম প্রেম! তাও এমন কারো জন্য, যাকে আমি ভাবতেই পারি না!

আরভিদের মনটা আনচান আনচান করে মেহজাকে দেখার জন্য। সে বেডের পাশে হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা খোঁজে, এবং পেয়ে যায়। তারপর ফোন ঘেঁটে একটা ফ্যামিলি পিক খুঁজে বের করে। যেখানে কারদার আর তালুকদার দুই পরিবারের সদস্যরা ছিল, সঙ্গে মেহজাও। আসলে মেহজার একক কোনো ছবি তার ফোনে ছিল না, থাকার কথাও না। ফ্যামিলি ছবিটা জুম করে সে মেহজার মুখটা দেখতে থাকে। কখন যে পুরো রাত কেটে ভোর হয়ে গেছে, সে নিজেও টের পায় না। ফজরের আজান কানে আসতেই হুঁশ ফেরে। সে আর কোনো দেরি না করে কল দেয় আভীর কারদারের ফোনে। দু’বার রিং হওয়ার পর ফোনটা রিসিভ হয়।
— হ্যালো? আরভিদ? এত রাতে কল করছো কেন? সবকিছু ঠিক আছে?
আরভিদ ঠাণ্ডা গলায় বলে,

— এখন বাজে ৪টা ১৩। ঠিক ১০টা ৩০-এ সবাইকে কারদার ম্যানরের লিভিং রুমে চাই।
একটিও বাড়তি কথা না বলে সে কল কেটে দেয়। আভীর কিছু বলার সুযোগই পায় না। এরপর আরভিদ উঠে শাওয়ার নেয়, তারপর রুমে রাখা ইলেকট্রনিক কেটলি দিয়ে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি বানায়। ধীরে ধীরে কফিটা শেষ করে, তারপর ট্রেজারার লাক্সারি ব্ল্যাক প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে সেটা লাইটার দিয়ে ধরায়। তারপর সিগারেট টা শেষ করে ঠিক ১০টা ২৯ মিনিটে সে রুম থেকে বের হয়। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে লিভিং রুমে দাঁড়াতেই ঘড়িতে ১০টা ৩০ বাজে।
তার সামনে তখন সবাই—তাহিয়া, আভীর, আফির, নাজনীন আর অর্তিহা—লিভিং রুমে উপস্থিত। আরভিদের কলের পরে তারা কেউই দেরি করেনি। সবাই জানে, এক মিনিট দেরি মানেই আরভিদের রাগের ঝড়। আরভিদ ধীরপায়ে গিয়ে সোফায় বসে পড়ে। লিভিং রুমে এক মুহূর্তের নীরবতা, সবাই একে-অপরের দিকে তাকায় — চোখে প্রশ্ন, মনে উদ্বেগ।
আভীর কারদার নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করে,

— কি হয়েছে, আরভিদ? এমন জরুরি কী হলো যে, সবাইকে একসাথে এখনই আসতে বললে?
আরভিদ গম্ভীর মুখে ধীরে ধীরে চোখ তোলে। গলার স্বর ভারী,
— আমি মেহুকে…
তাহিয়া কারদার তৎক্ষণাৎ থামিয়ে দেয় কথা, কিছুটা অনুরোধের স্বরে বলেন,
— ছেড়ে দাও না আরভিদ! সে তো একটা বাচ্চা মেয়ে! এখন তুমি কি ওকে মারবে নাকি?
আরভিদের ভ্রু কুঁচকে যায় যায়। তাকায় তাহিয়া কারদারের দিকে,
— আমি কখন বললাম, আমি ওকে মারবো?
তাহিয়া বলেন,
— তাহলে? তুমি মেহুকে কী করবে?
আরভিদ চোখে অদ্ভুত দৃঢ়তা নিয়ে উত্তর দেয়,
— আমি ওকে বিয়ে করবো।
আভীর হতাশার কণ্ঠে বলেন,
— কী বলছো আরভিদ! তাহিয়া তো বললই, ও এখনো ছোট। একটা ভুল তো হয়ে গেছে, তাই বলে তুমি বিয়ে করে শাস্তি দেবে?

আরভিদ অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকায়।
— তোমরা কী আমাকে সাইকো ভাবো? লাইক, সিরিয়াসলি, তোমরা ভাবছো আমি শাস্তি দেওয়ার জন্য মেহুকে বিয়ে করতে চাই?
আফির মাথা নাড়িয়ে বলেন,
— হ্যাঁ, তা না হলে আর কী? তোমার যে রাগের বহর! এত সহজে মেহুকে ছেড়ে দিয়েছো, সেটাই তো আমার কাছে অস্বাভাবিক লেগেছে!
আরভিদের আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গলার স্বর নরম হয়ে আসে,
— আমি মেহুকে শাস্তি দেওয়ার জন্য বিয়ে করতে চাই না। বরং আমি…
আভীর এবার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন,
— বরং তুমি?
আরভিদ দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
— আমি মেহুর প্রেমে পড়ে গেছি! আর আমি ওকেই বিয়ে করব!
তাহিয়া অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন,
— তাই বলে? নিজের অর্ধেকেরও কম বয়সী একটা মেয়েকে নিয়ে এসব ভাবছো?
আভীর থামিয়ে দিয়ে বলেন,

— আহ তাহিয়া, থামো! ও আমার ছেলের প্রথম প্রেম! আমি সেটা বিফলে যেতে দেব না! মেহুর বিয়ে হবে তোমার সঙ্গেই!
তাহিয়া চিন্তিত স্বরে বলেন,
— কিন্তু মাশরিফ ভাই কি রাজি হবেন বলে মনে হয়?
আভীর চোখে দৃঢ়তা এনে বলেন,
— রাজি না হলে তুলে এনে বিয়ে করিয়ে দেব! আমি আমার ছেলের কোনো চাওয়া অপূর্ণ রাখব না!
আরভিদ গম্ভীর স্বরে বলে,
— তুলে আনতে হবে না! সেটা করতে হলে আমি তোমাকে বলতাম না। তুমি আঙ্কেল আর ফুজির সঙ্গে কথা বলো!
আভীর মাথা নেড়ে আশ্বস্ত হয়ে বলেন,
— আচ্ছা, সেটা বলব। কিন্তু তুমি কি এখনই বিয়ে করতে চাও?
আরভিদ মাথা নাড়ে,

— না, এখন না। বিয়ে করব, যখন মেহু বড় হবে। তার আগে ও আমার আমানত, আর সেই হিসেবেই ওকে রাখতে বলবে। আমি আমার আমানতের খেয়ানত একটুও সহ্য করব না!
এই কথা বলে আরভিদ উঠে দাঁড়ায় এবং সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়।
নাজনীন কারদার ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
— এভাবেও প্রেম হয় নাকি? ধাক্কা দিয়ে কেকের উপর ফেলে দেওয়ায় প্রেমে পড়ে গেছে? অবশ্য, আজকালকার ছেলেমেয়েদের প্রেম বলতেই এসব বোঝায়!
সেদিন রাতেই আভীর আস্মিতা আর মাশরিফের সঙ্গে মেহজা ও আরভিদের বিয়ের প্রসঙ্গে কথা বলেন। মাশরিফ শুরুতে সাফ না করে দেন। তাঁর যুক্তি—মেহজা আর আরভিদের বয়সের পার্থক্য অনেক, তাছাড়া আরভিদ রাগী স্বভাবের আর মেহজা অত্যন্ত জেদি। উনার মতে, দুজনেই আগুন! আর আগুনের সঙ্গে আগুনের মিলন মানেই তো বিস্ফোরণ, শান্তি নয়। তবুও আস্মিতা আভীরকে আশ্বাস দেয়, মেহজার বিয়ে আরভিদের সাথেই হবে। মেহজা কেবল আরভিদেরই হবে।

মেহজার স্বামী আরভিদই হবে। সেই জন্মদিনের ঘটনার পর থেকেই মেহজার আর তেমন করে আরভিদের সামনে আসে না। আর সামনে এলেও, ভদ্রতার খাতিরে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস কর পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে তার কথা। সে ইচ্ছাকৃতভাবেই এড়িয়ে চলে আরভিদকে। আরভিদও জোর করে না কারণ কয়েকদিন থাকুক নিজের মতো করে। বিয়ের পরে তো আর তাকে এড়িয়ে চলতে পারবে না! এর ঠিক চার বছর পর, আরভিদ নির্বাচনে দাঁড়িয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে এবং দেশের আইনমন্ত্রী হয়।

এরপর কেটে যায় আরও তিনটি বছর। এই সাত বছরের ব্যবধানে ধীরে ধীরে মাশরিফের মনও বদলে যায়। তিনি নিজ চোখে দেখেন আরভিদের ভালোবাসা, মেহজার প্রতি তার যত্ন, খেয়াল আর সীমাহীন অধিকারবোধ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরভিদের এই অশেষ চাওয়ার কাছে মাশরিফ নত হন। তিনি স্বীকার করে নেন, মেহজাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস তিনি আরভিদকেই করতে পারেন। অবশেষে, তিনি রাজি হয়ে যান মেহজা আর আরভিদের বিয়েতে।
মেহজা ঘুমের মধ্যে টের পায়, কেউ একজন তার ওপর ঝুঁকে আছে। ধীরে চোখ খুলতেই দেখে—আরভিদ তার মুখের একদম সামনে! হঠাৎ ভয় পেয়ে দুহাতে ঠেলে দেয় তাকে। আচমকা ধাক্কায় আরভিদ ছিটকে গিয়ে বিছানার একেবারে শেষ প্রান্তে পড়ে যায়, এবং বেড়িয়ে আসে ভাবনার জগৎ থেকে। মেহজা ধপ করে উঠে বসে।
আরভিদ বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে,

— মাথায় সমস্যা নাকি তোর? কেউ এভাবে ধাক্কা মারে?
মেহজা রেগে ও সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলে,
— আপনি আমার ওপর ঝুঁকে ছিলেন কেন? কী করার মতলব ছিল?
আরভিদ উঠে দাঁড়িয়ে বিরক্ত স্বরে বলে,
— ঘুম থেকে ওঠার অপেক্ষা করছিলাম, গর্দভ!
রাতেই না বলেছিলি, সকালে শপিংয়ে যাবি?
মেহজা ভ্রু কুঁচকে বলে,
— বলেছিলাম ঠিকই, কিন্তু বলেছিলাম না তো আপনাকে আমাকে জাগাতে!
— জাগাইনি আমি! আমি শুধু রেডি হয়ে অপেক্ষা করছিলাম।
মেহজা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
— ১০ মিনিট না, ৫ মিনিট অপেক্ষা করেছেন আর তাতেই দশবার শুনিয়ে দিলেন!
আরভিদ চোখ সরু করে বলে,
— ১০ মিনিট, ৫ মিনিট না! সকাল ৮টা থেকে রেডি হয়ে বসে আছি। এখন বাজে ১১টা! আর আমি মাত্র দুইবারই বলেছি!
মেহজা বিরক্ত মুখে বলে,

— হয়েছে, হয়েছে! পুরো দমে দেখছি ঝগড়া শুরু করে দিয়েছেন!
বলেই মেহজা কাভার্ড খুলে বের করে একখানা কালো সুতি শাড়ি। আরভিদ সেটা দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,
— তুই শাড়ি পরবি?
— হ্যাঁ! কেন, কোনো সমস্যা?
— না, সমস্যা নেই। কিন্তু তোর তো শাড়ি একদমই পছন্দ না, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
মেহজা একরু গম্ভীর হওয়ার ভান করে বলে,
— এখন তো আমি মন্ত্রীর বউ! আমার একটা আভিজাত্য থাকা দরকার, তাই না? আমি যদি কুর্তি পরে বের হই, লোকে ভাববে আমি হয়তো আপনার ছোট বোন! কিন্তু শাড়ি পরলে? সেই কনফিউশানের প্রশ্নই নেই!
আরভিদ হেসে ফেলে।
— হুম।
মেহজা হেসে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। প্রায় বিশ মিনিট পর সে বেরিয়ে আসে, পড়নে কালো শাড়ি। শাড়ির মোহে মোড়ানো সে যেন এক স্নিগ্ধপরী। আরভিদ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। বুকে তার ঢেউ বইছে প্রশান্তির হাওয়ায়।
আরভিদের মুখ থেকে আপনাআপনি বেড়িয়ে আসে,

— স্নিগ্ধপরী?
মেহজা চুল মুছতে মুছতে অবাক হয়ে বলে,
— হুম?
পরমুহূর্তেই হেসে ফেলে। তারপর তোয়ালে টা স্ট্যান্ডে রেখে পা ফেলে আয়নার সামনে গিয়ে চোখে কাজল দিতে দিতে হেসে বলে,
— একজনের থেকে শুনলাম, মন্ত্রী সাহেব নাকি এইসব শাড়ি নিজে পছন্দ করে কিনেছেন?
আরভিদ আয়নায় মেহজার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে নরম কণ্ঠে উত্তর দেয়,
— একদম ঠিক শুনেছেন। প্রতিটা শাড়ি আমি নিজে পছন্দ করে নিয়েছি, শুধু আমার স্নিগ্ধপরীকে কল্পনায় রেখে।
মেহজা ঠোঁট চেপে হাসি আটকে বলে,
— বাব্বাহ!
আরভিদ একটু হাসে, যার এক রত্তি শব্দ হয়।

— এই শাড়িগুলো আমি গত সাত বছর ধরে এক এক করে কিনেছি। যখনই কোথাও শাড়ি চোখে পড়ত, আমি তাতে তোকে কল্পনা করতাম। কি সেই স্নিগ্ধ রূপ তা বলে বুঝানো যাবে না। মনে হতো, তুই যদি ঠিক এই শাড়িটা পড়ে আমার সামনে দাঁড়াস! সেই কল্পনাগুলো আমার মনে হাজারটা আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলত তোকে এই রূপে, এই রঙে, বাস্তবে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। প্রতিটা শাড়ি তোকে ভেবেই কেনা। আমার স্নিগ্ধপরীকে ভেবে!
মেহজা আয়নায় আরভিদের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে এক অপার মুগ্ধতা। এই মানুষটার কথায় এমন কী আছে, যে মেহজা বারবার হারিয়ে যায়! মুগ্ধ হয়, ছুঁয়ে যায় তার মন! চোখে কাজল দেওয়া শেষ করে সে ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক দিয়ে, চোখে দেয় হালকা মাসকারা। তারপর কানে পড়ে ছোট ঝুমকা, চুলগুলো আঁচড়ে ঠিক করে ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ায় আরভিদের সামনে। কোমরে হাত রেখে একটুখানি হেসে বলে,

— কেমন লাগছে?
আরভিদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মেহজার দিকে। তারপর ধীরে এগিয়ে এসে একদম মেহজার মুখোমুখি দাড়ায় এবং তাদের মধ্যকার দূরত্ব খুবই কম। যাকে বলে একদম কাছাকাছি। আরভিদ মেহজার গালের দুই পাশে হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে নরম গলায় ফিসফিস করে বলে,
— এতক্ষণ ছিলি আমার স্নিগ্ধপরী। কিন্তু এখন? এই কাজল চোখ, আর ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক! যা তোকে আমার রেডলিপে রূপান্তর করেছে। তুই এখন একেবারে আমার রেডলিপ! যাকে দেখলেই মন উড়িয়ে নেয়! কাছে পেতে ইচ্ছে করে, ছুঁয়ে রাখতে ইচ্ছে করে।
মেহজার গাল লজ্জায় গরম হয়ে ওঠে। সাধারণত লজ্জায় মানুষের গাল লাল হয়ে তবে মেহজার বেলায় ব্যতিক্রম! ছোট থেকে সে লজ্জা পেলে তার গাল গরম হয়ে যায়। কিন্তু সে চায় না সেটা আরভিদের চোখে পড়ুক। মেহজা চোখ নামিয়ে নেয়।
আরভিদ মৃদু হেসে মাথা এগিয়ে মেহজার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। আলতো করে একটি চুমু দিয়ে বলে,

— এই আদরের কথা বলছিলাম!
মেহজা চোখ তুলে তাকায় তার দিকে। আরভিদ আবার দুষ্টুমি করে বলে,
— ঐ আদরটা রাতের জন্য! তবে তুই যদি চাস…
আরও কিছু বলার আগেই মেহজা আঙুল তুলে আরভিদের ঠোঁটে ছুঁইয়ে দেয়। থামিয়ে দেয় তার কথা। আস্তে করে বলে,
— দেরি হয়ে যাচ্ছে না?
— হুঁম।
বলেই আরভিদ হেসে মেহজার হাতটা মুঠোয় নিয়ে বলে,
— চলুন, সাহেবা!
মেহজা একটু অবাক হয়ে বলে,
— ব্রেকফাস্ট করবো না?
আরভিদ হেসে জবাব দেয়,
— করবো তো! কিন্তু বাইরে।
— ওহ!
— হুম। এখন চল।

তারা একসাথে রুম থেকে বের হলো। করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মেহজার চোখে পড়ে, কয়েকজন কালো টি-শার্ট পরা লোক করিডোরটা ফুল দিয়ে সাজাচ্ছে। তারা নিচে লিভিং রুমে নামতেই দেখে, সেখানেও সাজসজ্জার কাজ চলছে—সাদা কাপড়, তাজা ফুল, আর নানা রকমের সাজে জায়গাটা একেবারে বদলে গেছে। আদ্রিক ইভেন্ট ম্যানেজারকে হাত দিয়ে নির্দেশনা দিচ্ছে কিভাবে কি হবে।
তাহিয়া কারদার লিভিং রুম পার হয়ে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিলেন। মেহজা আর আরভিদকে রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন,

— কোথাও যাচ্ছো তোমরা?
আরভিদ উত্তর দেয়,
— হ্যাঁ, মেহুকে নিয়ে শপিংয়ে যাচ্ছি।
মেহজা সাথে সাথেই বলে উঠে,
— শাওড়ি আম্মা, আপনিও চলেন না আমাদের সঙ্গে?
তাহিয়া খানিকটা অবাক হয়ে বলেন,
— শাওড়ি আম্মা?
মেহজা হেসে উত্তর দেয়,
— আগে তো আপনাকে মামানি বলে ডাকতাম, কারণ তখন তো ছিলেন আমার মামার বউ। কিন্তু এখন তো আমি আপনার ছেলের বউ, তাই আমি ঠিক করেছি এখন থেকে আপনাকে শাওড়ি আম্মা বলেই ডাকবো! আপনার কি এতে কোনো আপত্তি আছে?
তাহিয়া হেসে ফেলেন,

— দুষ্টু মেয়ে! নাহ, আমার কোনো আপত্তি নেই!
মেহজা খুশি হয়ে বলে,
— তাহলে চলেন না আমাদের সঙ্গে শপিংয়ে? বিয়ের জন্য তো তেমন কেনাকাটাই করা হয়নি!
তাহিয়া মৃদু হেসে বলেন,
— না, তোমরাই যাও। পছন্দ করে নিয়ে এসো শপিংমল থেকে। আর একটু পরে আনজারা ফ্যাশন থেকে আমাদের জন্য ড্রেস পাঠানো হবে। তোমার মামা কথা বলেছে।
মেহজা ছোট করে বলে,
— ওহ।
তাহিয়া জিজ্ঞেস করেন,
— ব্রেকফাস্ট করবে না?
আরভিদ বলে,
— না মম, বাইরে গিয়েই করবো।
তাহিয়া মাথা নেড়ে বলেন,
— আচ্ছা, যাও তবে।

তারপর আরভিদ আর মেহজা দুজনে বেরিয়ে পড়ে। বাইরে এসে দেখে ড্রাইভার গাড়ি বের করে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনে গিয়ে গাড়িতে উঠে শপিং মলের উদ্দেশে রওনা হয়। শপিংমলে পৌঁছে আরভিদ প্রথমেই মেহজাকে নিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে ঢোকে। সেখানে মেহজার জন্য একটি স্যান্ডউইচ আর চকলেট শেক, আর নিজের জন্য নেয় একটি কফি। যাতে খেতে খেতে শপিং করা যায়। তারপর তার একটি বিলাসবহুল ফ্যাশন হাউসে ঢুকে পড়ে। মেহজা খেতে খেতে ঘুরে ঘুরে শাড়ি দেখছে, আর আরভিদ এক হাতে কফি, অন্য হাতে চকলেট শেক ও স্যান্ডউইচ নিয়ে মেহজার পেছন পেছন হাঁটছে।
হঠাৎ মেহজা থেমে দাঁড়ায় একটি পিচ রঙা শাড়ি পরা ডলের সামনে। পুরো শাড়িটাতে ঝলমলে স্টোনের কাজ করা — দেখে বোঝা যায় শাড়িটি বেশ ভারী হবে।
মেহজা হেসে নিজেই বলে,

— এই শাড়িটা তো সুন্দর! বিয়ের দিন এইটাই পরবো!
ঠিক তখনই একজন স্টাইল এডভাইজার এগিয়ে এসে বলে,
— ম্যাম, আমি কি কোনোভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
মেহজা বড় করে একটা হাসি দিয়ে বলে,
— হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনি এটা একটু ধরেন, আমি একটা শাড়ি ট্রায়াল দেব।
বলেই হাতে থাকা স্যান্ডউইচটা স্টাইল এডভাইজার
হাতে ধরিয়ে দেয়। স্টাইল এডভাইজার কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে একবার মেহজার দিকে তাকাচ্ছে, আবার আরভিদের দিকে। তার মুখে একরকম বিভ্রান্তির ছাপ স্পষ্ট।
সেটা দেখে মেহজা হেসে বলে,

— আরে, উনার তো হাত খালি নেই, নাহলে ওনার হাতেই দিতাম! আর আপনি তো নিজেই এসে বললেন সাহায্য করতে চান। আমি আবার কাউকে না বলতে পারি না।
এরপর মেহজা ডল থেকে শাড়িটা বের করে নিজের গায়ে রেখে একটু সামনে গিয়ে বাম পাশে যায়। তারপর সেখান থাকা আয়নায় নিজেকে দেখে। তারপর আরভিদের দিকে ফিরে প্রশ্ন করে,
— কেমন লাগছে?
আরভিদ মুচকি হেসে আস্তে করে বলে,
— বুকে জ্বালা ধরানোর মতো সুন্দর, জালেমা!
মেহজা হেসে আবার আগের জায়গায় এসে স্যান্ডউইচটা স্টাইল এডভাইজার হাত থেকে নিয়ে শাড়িটা তার হাতে দিয়ে বলে,

— এই শাড়িটা নিচ্ছি, আলাদা করে রাখবেন ।
— ওকে ম্যাম।
বলেই স্টাইল এডভাইজার শাড়িটা নিয়ে ভিতরের দিকে চলে গেল। মেহজা আরও বিভিন্ন শাড়ি দেখতে ব্যস্ত, সঙ্গে সমান তালে খাচ্ছে। আরভিদ অবশেষে একটু শান্তিতে নিজের কফিটা খাওয়ার সুযোগ পায়। কারণ মেহজা ইতিমধ্যেই সেন্ডউইচগুলো সাবাড় করে এখন চকলেট শেকে মন দিয়েছে, আর চোখে চোখে শাড়ির ডিজাইন ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ততক্ষণে আরভিদের কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে।
প্রায় এক ঘণ্টা লেগে যায় মেহজার নিজের জন্য হলুদের শাড়ি বেছে নিতে সাথে অর্তিহা, তাহিয়া, নাজনীন, আর আস্মিতার জন্যও শাড়ি নিতে। এমনকি মিশান ও কৌশালীর জন্যও গাউন পছন্দ করে। সবগুলো পছন্দ করার পর একজন স্টাফকে ডেকে বলে সেগুলো সাইডে রাখতে।
তারপর ধীর পায়ে আরভিদের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে,

— এখন চলেন আপনার জন্য কাপড় নেই। আমার আব্বু, শ্বশুর আব্বা, চাচা শ্বশুর আব্বা… আর হ্যাঁ, আপনার সেই জিগরী দোস্তের জন্যও কিনতে হবে।
আরভিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে মেহজার পেছনে পেছনে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত সে। কেবল ঘোরা না, তার ওপর কাপড়ও ক্যারি করেছে। কিন্তু সে জানে, এই ক্লান্তির লেশমাত্রও যদি মেহজা টের পায়, তাহলে তার মুড চেঞ্জ হতে সময় লাগবে না। রাগ করে চলে যাবে। তাই সে মুখে হাসি টেনে বলে,
— চল ঐদিকে, জেন্টস কালেকশনে ঐদিকে।

তারপর দুজনে সেদিকে চলে যায়। প্রথমেই আরভিদের জন্য মেহজা একটা হলুদের জন্য পাঞ্জাবি পছন্দ করে নেয়। তারপর বিয়ের এবং রিসেপশনের জন্য দুটি ফর্মাল স্যুট, যার রঙ মেহজা নিজের ড্রেসের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়। এরপর পরিবারের অন্যদের জন্যও কাপড় পছন্দ করে নেয় দুজনে। সবকিছু নিয়ে এসে দাঁড়ায় ক্যাশ কাউন্টারে।
তাদের দেখে ক্যাশ কাউন্টারের লোকটা সঙ্গে সঙ্গে একজন স্টাফকে ডেকে ফিসফিস করে বলে,
— মন্ত্রী সাহেব আর ম্যাডামকে তাড়াতাড়ি বসার জন্য চেয়ার দাও।
লোকটা এবার হাসিমুখে আরভিদকে সালাম দেয়,

— আসসালামু আলাইকুম, স্যার।
আরভিদ শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,
— ওয়ালাইকুম আসসালাম। এগুলোর বিলটা রেডি করো তাড়াতাড়ি।
একজন স্টাফ তড়িঘড়ি করে চেয়ার এনে দেয় তাদের বসার জন্য। ক্যাশ কাউন্টারের লোকটি আবারও সম্মান দেখিয়ে বলে,
— স্যার, ম্যাম, আপনারা বসুন। বিলটা এখনই করছি।
আরভিদ ও মেহজা দুজনে চেয়ারে বসে। তখন ক্যাশ কাউন্টারের লোকটা শাড়িগুলোর দিকে এক নজর দেখে হেসে বলে ওঠে,

— ম্যামের চয়েস আছে বলতে হবে! আমাদের শপের সবচেয়ে বেস্ট কালেকশনগুলোই উনি পছন্দ করেছেন।
কথাটা শুনে মেহজার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। চেহারায় ভেসে ওঠে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস আর গর্ব। ক্যাশ কাউন্টারে থাকা লোকটা দ্রুত হাতে বিল হিসেব করে হাসিমুখে বলে,
— স্যার, আপনাদের বিল এসেছে মাত্র ২৩ লাখ টাকা।
এক মুহূর্তেই হাসি মিলিয়ে যায় মেহজার মুখ থেকে। সে তড়িত্‍ গতিতে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। তার আচরণে হতচকিয়ে যায় ক্যাশ কাউন্টারের লোকটা আর পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা স্টাফ মেয়েটি। মেহজার হঠাৎ এমন কাজে আরভিদও থমকে যায় বিস্ময়ে।
মেহজা বিস্ময়ভরা চোখে বলে,

— গাঁজাখোরের মতো কথা বলবেন না!
আরভিদ অবাক বলে,
— মেহু!
মেহজা এবার একটু হেসে আরভিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
— না মানে, আন্দাজে কথা বলবেন না! মাত্র ২৩ লাখ টাকা মানে? ভালো করে দেখুন একবার!
লোকটা মৃদু কণ্ঠে বলে,
— ম্যাম, ভালো করেই হিসেব করেছি! সব ড্রেসের দাম খুবই বেশি।
মেহজা চোখ রাঙিয়ে পিচ কালারের শাড়ি তুলে ধরে বলে,
— আচ্ছা বলেন, এটার দাম কত?
— ম্যাম, ২ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।
মেহজা চোখ কুঁচকে বলে,
— এত দাম কেন? স্বর্ণ লাগানো আছে নাকি এতে?
ক্যাশ কাউন্টারের লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কারণ সে কী বলবে খুঁজে পাচ্ছে না।
মেহজা এবার আরেকটা ড্রেস দেখিয়ে বলে,

— এটা কত?
এভাবেই সে একে একে সব ড্রেসের দাম জানতে থাকে। প্রতিটা দাম শুনে মেহজা হাত দিয়ে থামিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে,
— সব মিলিয়ে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা দেব, সবগুলো দ্রুত প্যাক করে দিন।
আরভিদ যেন আকাশ থেকে পড়ে মেহজার কথা শুনে। সে তৎক্ষনাৎ উঠে দাড়িয়ে অবাক হয়ে বলে,
— কী করছিস মেহু!
মেহজা চোখে মুখে বিরক্ত দেখিয়ে বলে,
— আপনি চুপ থাকেন! আমি দেখছি সব কিছু!
ক্যাশ কাউন্টারের লোকটা একটু গম্ভীর মুখে বলে,
— সরি ম্যাম, সম্ভব না!
মেহজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধৈর্য ধরার চেষ্টা করে বলে,

— ভাই, ২৩ লাখ টাকা তো আপনি কথার কথা বলেছেন! ঠিক আছে, আপনার কথাও থাক, আমার কথাও থাক! ৩ লাখ টাকা দিচ্ছি, ফাইনাল অফার! এর এক কানাকড়িও বাড়াবো না! এখন তাড়াতাড়ি সব ড্রেস প্যাক করেন!
লোকটা এবার চোখ ঘুরিয়ে তাকায় আরভিদের দিকে। আরভিদ গলা খাঁকারি দিয়ে অসহায় গলায় বলে,
— আমাকে দেখছো কেন? ও আমার সাথে আসেনি! ও আমার…দূর সম্পর্কের বউ হয়!
মেহজা প্রথমে থমকে গেল। পরমুহূর্তেই রাগে বোম হয়ে যায়। ক্যাশ কাউন্টারের লোক আর পাশে দাঁড়িয়ে থাকক মেয়ে স্টাফ এতক্ষণ মেহজার কথা শুনে অবাক ছিল, এবার আরভিদের কথা শুনে রীতিমতো বাকরুদ্ধ।
মেয়ে স্টাফ চমকে উঠে বলে,

— দূর সম্পর্কের বউ? এই প্রথম শুনলাম! দূর সম্পর্কে তো ভাই হয়, বোন হয়, চাচা-মামা হয়… কিন্তু বউও হয় সেটা জানতাম না!
মেহজা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— আপনাকে আমি বাসায় গিয়ে দেখে নেবো!
তারপর সে আবার ক্যাশ কাউন্টারের লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে,
— আপনি তিন লাখ টাকায় দেবেন?
লোকটা এবার গম্ভীর মুখে আরভিদের দিকে তাকায়। আরভিদ মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ বলতে বলে। ক্যাশ কাউন্টারের লোকটা তৎক্ষণাৎ মাথা নেড়ে বলে,
— ঠিক আছে ম্যাম!
মেহজা রেগে মুখ বেঁকিয়ে বলে,
— তো হাত গুটিয়ে বসে আছেন কেন? প্যাক করেন!

বলেই মেহজা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আরভিদের দিকে তাকায়, আর সাথে সাথে আরভিদ ভয় ঘাড় ঘুরিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। লোকটা আর দেরি করে না। দ্রুত সবগুলো ড্রেস প্যাক করে মেহজার সামনে এগিয়ে দিল। মেহজার চোখের ইশারায় আরভিদ তাড়াতাড়ি সব ব্যাগ হাতে তুলে নেয়, পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে কার্ডটা বের করে সুইপ করে।ক্যাশিয়ার বিল করে তিন লাখ টাকার রিসিটটা মেহজার দিকে বাড়িয়ে দেয়। মেহজা সেটা দেখে সিউর হয়ে আরভিদকে উদ্দেশ্য করে বলে,

— আমি যাচ্ছি!
বলেই মেহজা বেড়িয়ে গেল। মেহজা চলে যেতেই আরভিদ ফিসফিস করে ক্যাশিয়ারকে বলে,
— বাকি টাকা আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট দিয়ে যাবে!
ক্যাশিয়ার মাথা নেড়ে বলে,
— ঠিক আছে স্যার, শুধু খেয়াল রাখবেন ম্যাম যেন টের না পান!
আরভিদ কোনো উত্তর না দিয়েই সোজা বেরিয়ে গেল। আরভিদ চলে যাওয়া মাত্রই ক্যাশিয়ার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

— বাবারে! আইনমন্ত্রী হয়েও বউয়ের সামনে মুখ খুলতে পারে না, আর আমি তো সাধারণ মানুষ! না বাবা, আমি বিয়ে করবো না!
ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। পেছনে বসে আছে মেহজা আর আরভিদ। দুজন দুই পাশে, মাঝখানে ফাঁকা জায়গা। আরভিদ ফোন হাতে নিয়ে বসে, কিন্তু মনোযোগ ফোনে নেই। সব মন মেহজার দিকে। তবু সেটা বুঝতে না দিয়ে ফোনে ব্যস্ত থাকার ভান করছে। আড়চোখে মাঝে মাঝে মেহজাকে দেখছে। এখনো কেউ কোনো কথা বলেনি। মেহজা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে, মুখে হালকা রাগ। গাড়ি থামে কারদার ম্যানরের সামনে। ড্রাইভার আরভিদের দরজা খুলে দেয়। মেহজা নিজে দরজা খুলে নেমে যায়।

ঠিক তখনই একটা ২৭-২৮ বছর বয়সী ছেলে দৌড়ে এসে আরভিদের সামনে দাঁড়িয়ে হাফাতে হাফাতে বলে,
— স্যার, আপনি এসেছেন? আমি অনেকক্ষণ ধরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম!
তার পেছন পেছন আরেকটি ছেলে এসে দাঁড়ায়। মেহজা প্রথম ছেলেটাকে চিনতে পারে—সে হচ্ছে নাসিদ, আরভিদের এসিস্ট্যান্ট। কিন্তু দ্বিতীয় ছেলেটাকে সে চিনে না!
আরভিদ ঠাণ্ডা মুখে নাসিদের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
— তো? তাহলে কি আমার তোমার জন্য অপেক্ষা করা উচিত ছিলো?
নাসিদ হালকা অপ্রস্তুত হেসে বলে,

— না না স্যার, কী যে বলেন!
তখনি তার চোখ পড়ে মেহজার উপর। সে মেহজাকে হেসে বলে,
— ম্যাম, কেমন আছেন?
মেহজা ভ্রু কুঁচকে, রাগে ঠোঁট বাঁকিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকে যায়। মেহজার এই কাজে নাসিদ ও তার পেছনে দাঁড়ানো ছেলেটা হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে মেহজার যাওয়ার দিকে। আরভিদ সেই দৃশ্য দেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, তারপর নাসিদের দিকে তাকিয়ে রাগচাপা কণ্ঠে বলে,
— গাড়িতে শপিং ব্যাগগুলো আছে!
বলেই সেও ভেতরে ঢুকে পড়ে। নাসিদ মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর পাশে থাকা ছেলেটাকে দেখে মাথা নাড়িয়ে বলে,

— একজন রাগে ফুসে, আরেকজন ভেংচি মারে! এদের আবার বিয়ে হয়েছে! সারাদিন তো মনে হয় ঘরে কোপাকুপি চলে!
তার কথা শুনে পেছনের ছেলেটা হেসে ফেলে।
নাসিদ বিরক্ত হয়ে বলে,
— এই তাফসির! হাসছো কেন? এখন ব্যাগগুলো তুলে আমার সাথে নিয়ে চলো!
— স্যার, আমি?
— স্যার আমি আবার কী! আমি আরভিদ স্যারের এসিস্ট্যান্ট, আর তুমি আমার এসিস্ট্যান্ট! দেখছো না আমি কেমন করে সব শুনি স্যারের?
— না শুনে উপায় আছে? না শুনলে স্যার তো আপনাকে উপরে পাঠিয়ে দিতেন!
— তুমি তো দেখি চাকরির প্রথম সপ্তাহেই চাকরি হারানোর ব্যবস্থায় নেমে পড়েছো! একদম বের করে দেবো কিন্তু!
তাফসির মাথা নত করে বলে,

— সরি স্যার!
দুজনে ব্যাগ হাতে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে। মেহজা ঘরে ঢুকেই এক মিষ্টি, শান্ত গন্ধে থমকে যায়। চারপাশটা স্নিগ্ধতায় ভরে আছে। সেই গন্ধ এসেছে সাদা ফুল থেকে—সবখানে ফুল আর সবুজ পাতার সাজ। পুরো বাড়িটা যেন একটুকরো স্বপ্নের মতো লাগছে। কিন্তু এখন মেহজার সেদিকে মুগ্ধ হয়ে থাকার ইচ্ছে নেই। রাগে তার মুখ মথা গরম হয়ে আছে। মেজাজ বিগড়ে আছে। সে সোজা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। আরভিদ পেছন পেছন আসে, ডাকতেও থাকে মেহজাকে। কিন্তু মেহজা কোনো উত্তর দেয় না। মেহজা রুমে ঢুকে পেছন পেছন আরভিদও ঢুকে পড়ে।

— মেহু?
মেহজা রাগে গর্জে উঠে,
— কী চাই?
আরভিদ শান্ত গলায় বলে,
— যৌতুক!
মেহজা বিস্ময়ে তাকায়,
— কী বললেন? কী চাই আপনার?
আরভিদ হেসে বলে,
— যৌতুক, জান! বিয়ের সময় তো পাইনি!
মেহজার রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে,
— খাচ্চর! লজ্জা করে না যৌতুক চাইতে!
আরভিদ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,
— লজ্জা কেন করবে? যৌতুক তো সব ছেলেদের ড্রিম! শ্বশুরবাড়ি থেকে বেড-ফার্নিচার আর কতকিছু দেবে! অনেকে তো গাড়িও নেয়!
মেহজা দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

— আবার বেড লাগবে কেন? এই বেডটা কি করবি?
— ফেলে দেবো!
— কেন? এটা তো একদম নতুন বেড!
আরভিদ বাঁকা হেসে বলে,
— শ্বশুরের দেওয়া বেডেই তার মেয়েকে কাঁদানোর মজাই আলাদা! যে মজাটা এখনো নিতে পারিনি তো!
মেহজা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,
— জালেম একটা!
আরভিদ হেসে বলে,
— আমার জালেমা!
মেহজা চোখ বড় করে আঙুল উঁচিয়ে বলে,
— এই ফালতু মন্ত্রী!
আরভিদ হেসে মাথা ঝুঁকিয়ে বলে,
— জ্বী, ঘরমন্ত্রীণি!
মেহজা এবার আর রাগ ধরে রাখতে পারে না। জোরে বলে,
— দুই নাম্বার বেডা!
— ভেজাল বেডি!
মেহজা চিৎকার করে ওঠে,
— গন্ডার!
আরভিদ হেসে এগিয়ে মেহজার একদম কাছে এসে গালে হাত রেখে বলে,
— তোতাপাখি!

ঠিক তখনই দরজা খুলে নাসিদ আর তাফসির রুমে ঢোকে, দুজনের হাতেই শপিং ব্যাগ। তারা আরভিদ আর মেহজাকে একে অপরের এতো কাছে দেখে দুইজনই দাঁড়িয়ে যায় থতমত খেয়ে। আরভিদ বিরক্ত হয়ে ওদের দিকে তাকায়। শুধু বিরক্ত না, রাগও উঠে ওদের উপর। বেচারা একটু সুযোগ পেয়েছিলো বউয়ের রাগ ভাঙানোর কিন্তু এইজন এসে সব ভেস্তে দিলো।
মেহজা সুযোগ বুঝে আরভিদকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়, গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়ায়। তারপর নাসিদকে বলে
— সরে দাঁড়ান!
নাসিদ তাড়াতাড়ি সরে যায়। তাফসিরকে কিছু বলার দরকার পড়ে না, সে নিজেই সরে যায়। মেহজা রাগে রুম থেকে বের হয়ে যায়।
আরভিদ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— তোমার মতো বোকাচিকাকে অ্যাসিস্ট্যান্ট বানানো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল!
নাসিদ মাথা নিচু করে কাঁপা গলায় বলে,
— সরি স্যার!
আরভিদ আরও রেগে বলে,

— সরি তোমার পেছনে ঢুকিয়ে দেবো! যাও এখান থেকে!
নাসিদ আর তাফসির সোফায় শপিং ব্যাগগুলো রেখে ভয়ে দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে যায়। দুজনেই করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিচে নামছে।
নাসিদ কিছুটা ভাবান্তর হয়ে প্রশ্ন করে,
— আচ্ছা তাফসির? বোকাচিকা মানে কী?
তাফসির মাথা নাড়িয়ে বলে,
— আরে স্যার, বুঝতেছেন না! “চি” এর জায়গায় “চু”, আর “কা” এর জায়গায় “দা” বসায় দেন। ব্যাস, বুঝে যাবে!
নাসিদ হিসাব মেলাতে মেলাতে বলে,
— চি এর জায়গায় চু… কা এর জায়গায় দা… মানে… বোকাচু…
বলেই থেমে যায়, মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তারপর তাফসিরের দিকে তাকিয়ে বলে,
— স্যার আমাকে এইটা বলেছে?
তাফসির মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে দেয়। নাসিদ হতবাক হয়ে যায়, কিছু বলতেও পারে না। তাফসিরের খুব হাসি পাচ্ছে, কিন্তু সে হাসছে না। কারণ চাকরির মাত্র এক সপ্তাহ হয়েছে, এতো দ্রুত নতুন চাকরি পাবেও না। দুজনেই চুপচাপ নিচে নামতে থাকে।

অর্তিহা শাওয়ার নিয়ে লাল রঙের চুড়িদার পরে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। চুড়িদারটা কিছুক্ষণ আগেই তাহিয়া কারদার তাঁর কাভার্ড থেকে বের করে দিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ উনার মতে, অর্তিহা ইদানীং কেমন ফ্যাকাশে, নির্জীব রঙের পোশাক পরে, যা তাকে নিস্প্রাণ আর ক্লান্ত দেখায়। তার উপর আবার আজকে অর্তিহার গায়ে হলুদ। যদিও সেটা ছোটখাটো ঘরোয়া ভাবে। তারপর অনেক পরিচিত মানুষই আছে। সেখানে যদি বউ ফ্যাকাশে হয়ে থাকে সেটা ভালো লাগবে না। এটাই কথা তাহিয়া কারদারের। কিন্তু তিনি তো আর জানেন না উনার মেয়েটা এমন দেখায় কাপড়ের জন্য না বরং মানুষিক অশান্তির জন্য।

আজ সে ঘুম থেকে উঠেছে অনেক দেরিতে, দুপুর বারোটা নাগাদ। কারণ, সে রাত একটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল আদ্রিকের জন্য। আদ্রিক তখনও বাড়ি ফেরেনি। পরে আর না পেরে ঘুমিয়ে পড়ে। তাই কথা হয়নি তাদের। ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে অর্তিহা কথা বলতে চাচ্ছে, কিন্তু আদ্রিক তো রুমেই ঢুকছে না। লিভিং রুমে দাঁড়িয়ে ইভেন্ট ম্যানেজারকে নানা নির্দেশনা দিচ্ছে। সব কিছু ও-ই সামলাচ্ছে।
অর্তিহা ঘড়ির দিকে তাকায়—এখন বাজে তিনটা। এখন নিশ্চয়ই আদ্রিক রুমে গেছে। আজ যে করেই হোক, তার সঙ্গে কথা বলতেই হবে। নিজের ভেতরের অশান্তি আর চেপে রাখতে পারছে না অর্তিহা। তাই হঠাৎ করেই যেন সাহস খুঁজে পায়। বেড থেকে লাল ওরনাটা নিয়ে গলায় জরিয়ে বেরিয়ে পড়ে রুম থেকে।
আদ্রিকের রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় সে। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিশ্চিত হয়, কেউ নেই। তারপর আস্তে করে দুবার নক করে। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে যায়।

অর্তিহার চোখে পড়ে, আদ্রিক পরনে স্কাই ব্লু শার্ট আর সাদা প্যান্ট। শার্টের বোতামগুলো খোলা তাই লোমহীন ফর্সা বুকটা দেখা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে, বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে সে। আদ্রিক দরজার পাশ থেকে সরে দাঁড়ায়। অর্তিহা পা ফেলে ভেতরে ঢুকতেই সে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। তারপর চুপচাপ চোখ বুলিয়া অর্তিহার মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত। আদ্রিকের এমন সারা শরীরে চোখ বুলিয়ে দেখাতে অর্তিহার একটু অস্বস্তি লাগে, কিন্তু সে নিজেকে সামলে নেয়।
মাথা নিচু রেখে একটু কড়া গলায় বলে,

— কালকে আমার বিয়ে!
আদ্রিক হেসে প্রশ্ন করে,
— কিসের বিয়ে?
অর্তিহা এবার চোখে চোখ রেখে, ক্ষোভ মেশানো কণ্ঠে বলে,
— এমন ভাব করছেন যেন কিছুই জানেন না!
আদ্রিক কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,
— জানি তো! কিন্তু এখন আমি জানতে চাই, তুই কি চাস?
অর্তিহা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,
— বারেহ! আজ সূর্য নীল রঙ দিচ্ছে না তো? আপনি জানতে চাচ্ছেন আমি কি চাই?
আদ্রিক হেসে কাছে আসে, তবে দুজনের মাঝে এখনো একহাত দূরত্ব। সে হাত বাড়িয়ে অর্তিহার থুতনি টা এক আঙুল দিয়ে উচিয়ে চোখে চোখ রেখে বলে,
— সূর্য নীল রঙ দিচ্ছে কিনা জানি না, তবে আজ দুপুরে আমার রুমে চাঁদ উঠেছে। তাও লাল আভা ছড়ানো চাঁদ।
অর্তিহা কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে কড়া গলায় বলল,

— আমার প্রশ্নের উত্তর দিন!
— কি?
অর্তিহা আদ্রিকের চোখের দিকে তাকিয়ে, একরাশ অসহায়তা আর রাগ মেশানো কণ্ঠে বলে,
— আপনি কি বুঝতে পারছেন না? মানুষ যখন জানবে আমি প্রেগন্যান্ট, তখন সবাই আমাকে খারাপ বলবে… নষ্টা বলবে!
আদ্রিক চোখগুলো তীক্ষ্ণ ও কঠোর করে কন্ঠস্বর হিমশীতল করে বলে,
— জীব টেনে ছিড়ে ফেলবো তাদের!
অর্তিহা বিস্ময় নিয়ে বলে,
— হু?
আদ্রিক মাথা নেড়ে বলে,

— হুম তাদের জিব টেনে ছিড়ে ফেলবে তোর সম্পর্কে বাজে কথা বলা তো দূর, তোর নামটা নিলেই!
— আপনি আমাকে এমন এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছেন, যেখানে মানুষের এইসব কথা না শুনে উপায় নেই! আর আপনি কতজনের মুখ বন্ধ করবেন? আর বাড়ির লোকজন? তারা?
— যেই হোক যতজনই হোক সবার মুখ বন্ধ করে ফেলবো! আর এটা করা আদ্রিক কারদারের জন্য কোনো ব্যাপার না!
— আপনার এসব ব্যাপার সেপারের ভীরে আমি পিষে যাচ্ছি! হিংস্র মনুষ্যত্বহীন খারাপ মানুষ!
আদ্রিক ঝুকে অর্তিহার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
— এখন আমি যেমনই হই না কেন, তোর পার্মানেন্ট বুকিং, লিটলহার্ট!
তারপর গলার স্বর একটু নামিয়ে, ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি টেনে নেশাভরা কণ্ঠে বলে,
— আর তুই আমার পার্মানেন্ট বুকিং!
অর্তিহা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় কিন্তু যেতে পারে না তার আগেই আদ্রিক অর্তিহাকে হেঁচকা টানে নিজের একদম কাছে শরীরের সাথে মিশিয়ে বলে,

— কোথায় যাচ্ছিস? রুমে এসেছিস কিছু দিয়ে যা আমাকে?
— কি…কি দিবো?
আদ্রিক অর্তিহার ঠোঁটে আঙুল স্লাইড করে বলে,
— কিস!
অর্তিহা ভয় আর বিস্মিত হয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
— কিস… কিস মানে?
আদ্রিক বাজখাঁই কন্ঠে বলে,
— বাংলায় বলে কড়া চুম্বন!

আদ্রিক তার হাতটা অর্তিহার ভেজা চুলে ডুবিয়ে, আর বাম হাতটা রাখে তার গালে। কিসটা ধীরে শুরু হয়, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে গভীর, আগ্রাসী আর জোরালো হয়ে ওঠে। আদ্রিক গভীর আবেশে অর্তিহার ঠোঁট খেতে থাকে যেন সে ক্ষুধার্থ বহু দিনের। অর্তিহা ভয়ে, মোহে আদ্রিকের বুকের অংশের শার্টটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখে। প্রায় পাঁচ মিনিট পর আদ্রিক অর্তিহাকে ছেড়ে দেয়। অর্তিহা তখন নিঃশ্বাস নিতে থাকে হাঁপাতে হাঁপাতে।
আদ্রিক নেশাভেজা চোখে ধীরে ধীরে মেপে নেয় অর্তিহার শরীরটা। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে একরাশ তৃষ্ণা, যেন সে এক শিল্পকর্ম দেখছে—নির্বাক, মোহাবিষ্ট। তারপর অর্তিহার চোখে তাকিয়ে নরম ও ঘোলাটে কণ্ঠে বলে,
— ফর্সা গায়ে লাল রঙের ড্রেসটা একদম মানাচ্ছে না! খুলে ফেলি, বেবিডল?
শব্দগুলো ফিসফিসে, কিন্তু তাতে ছিল এক ধরনের সঙ্কল্প। অর্তিহার উত্তর শোনার অপেক্ষা না করেই আদ্রিক তার মুখটা ডুবিয়ে দেয় অর্তিহার গলায়।
অর্তিহা চোখ বন্ধ করে নেয়। বুকের গভীরে জমে থাকা আতঙ্ক এক ঢোক গিলে ফেলতে চায়। ঠোঁট কাঁপে, গলায় আটকে যায় বাক্য। তবুও বহু কষ্টে বলে ওঠে,

— দয়া করে ছেড়ে দিন, কেউ দেখে ফেলবে!
আদ্রিক গলায় নাক ঘষতে ঘষতে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে,
— কে দেখবে? রুমের দরজা বন্ধ! এখন কেউ কি দরজা ভেঙে ঢুকবে, শুধু আমাদের রোমান্স দেখার জন্য? নাকি রুমে কেউ গোপনে ক্যামেরা লাগিয়েছে যে দেখবে?
— প্লিজ, ছেড়ে দিন! আমার ভালো লাগ…
আদ্রিক এবার মাথা তুলে অর্তিহার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে আঙুল রেখে তাকে চুপ করিয়ে দেয়।
— ইশশ! চেহারাটা শুকিয়ে গেছে কিছুদিন ধরে আমার আদর না পেয়ে! একদম পুষ্টিহীনতায় ভুগছিস! এক্ষুনি তোর মধ্যে পুষ্টি ইমপোর্ট করছি। দেখবি, পুষ্টি লেভেল একদম হাই হয়ে গেছে।
অর্তিহা করুণ চোখে তাকিয়ে বলে,

— আমি একদম ঠিক আছি! আমাকে সবাই খুঁজবে! তখন এখানে পেলে সন্দেহ করবে!
আদ্রিক হেসে বলে,
— এখানে পেলে তো ভালো! তোর আর আমার মধ্যে ইটিস পিটিশ চলছে ভেবে সন্দেহ করে তোকে আমাকে জুরে দেবে!
অর্তিহা নাক সিটকে বলে,
— ছিঃ! আপনার মুখের ভাষা এত বাজে হলো কীভাবে?
আদ্রিক অর্তিহার গালে নাক ঘষে আদর মাখা কণ্ঠে বলে,
— মুখের ভাষা দেখলি! এতো আদর করি দেখলি না, লিটলহার্ট!
— কিছু দেখতে চাই না! আপনি শুধু বিয়েটা বন্ধ করুন!
আদ্রিক গাল থেকে নাক সরিয়ে মুখ টা তুলে অর্তিহার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলে,
— একটা কাজ করি?
— কি?
আদ্রিক মুচকি হেসে বলে,

— তোর বাপকে সিঁড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেই? হাত-পা ভেঙে কম হলেও এক মাস বেডে পড়ে থাকবে। আর বিয়েটাও পজ হয়ে যাবে। কি বলিস?
অর্তিহা কিছু টা রাগমিশ্রিত কন্ঠে বলে,
— তার থেকে বরং আপনিই ছাদ থেকে পড়ে যান! আর ছাদ থেকে পড়লে যেভাবে হাত-পা ভাঙবে, তাতে কম হলেও দুই মাস বেডে পড়ে থাকবেন! তখন বিয়েটা দীর্ঘদিনের জন্য পজ হয়ে যাবে!
আদ্রিক জোরে হেসে ফেলে,

— নিজের বাচ্চার বাপকে ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার জন্য উসকে দিচ্ছিস, লজ্জা করছে না?
অর্তিহা অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে হালকা কন্ঠে বলে,
— আপনারও লজ্জা করছে না আমার ড্যাডকে সিঁড়ি থেকে ফেলে দেওয়ার কথা বলতে?
— তোর ড্যাড যে আমার বউয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে, সেটার বেলা? নিজের ড্যাডের বেলা ১৬ আনা, আমার বেলাই ৪ আনা, তাই না?
অর্তিহা এবার অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে,
— তো আপনি আমাকে সবার সামনে গ্রহণ করে নিন!
— ঐদিনের কথাটা এত সহজে মাথায় ঢুকে গেছে? এতো তাড়াতাড়ি মেনে নিলি?
— হুম! আপনি যে জিনিসটা দিয়েছেন, এখন না মেনে উপায় আছে আমার কাছে!
আদ্রিক হেসে ফেলে। এক টুকরো কোমলতা ছুঁয়ে থাকে তার মুখে। নিজের হাতটা ধীরে অর্তিহার পেটে রাখে, কণ্ঠে স্নিগ্ধতা মেশানো গভীর গলায় বলে,

— আমি তোকে আমার সবচেয়ে পবিত্র, সবচেয়ে সুন্দর উপহারটা দিয়েছি। যে উপহার আমাদের দুজনের মিশ্রণে তৈরি। আমাদের জীবনের প্রথম আর সবচেয়ে গভীর অনুভূতি।
অর্তিহা চুপচাপ তাকিয়ে থাকে আদ্রিকের চোখে। সেই চোখদুটো ঝলমলে খুশিতে, উচ্ছ্বাসে ভরা। ঠোঁটে একরাশ শান্ত, আশ্বাসময় হাসি— যেন সে নিজেই অনুভব করছে সেই অনুভবের অলিখিত স্বপ্ন। আদ্রিক এবার তাকায় অর্তিহার মুখের দিকে। সাথে সাথে অর্তিহা দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
আদ্রিক আস্তে করে বলে,

মোহশৃঙ্খল পর্ব ১১

— আমাদের সন্তান!
কথাটা শুনে অর্তিহার বুকের ভেতর কেমন এক অদ্ভুত আলোড়ন। না, এটা কষ্ট নয়। আবার পুরোপুরি সুখও নয়। একেবারে নতুন, আগে কখনও না-জানা এক অনুভব, প্রথমবারের মতো। কিন্তু এমনটা হওয়ার কারণ? সন্তানের কথা শুনে? নাকি আদ্রিকের ঠোঁটে আমাদের সন্তান এই কথাটা শুনে?

মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here