মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৫

মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৫
মাহা আয়মাত

মেহজা বিছানায় বসে বিরক্ত হয়ে নখ কামড়াচ্ছে। আরভিদ অনেকক্ষণ আগে বেরিয়েছে কিন্তুএখনো ফিরছে না। হঠাৎ পাশে রাখা ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠে। মেহজা ফোন হাতে তুলে দেখে, আননোন নাম্বার থেকে কল আসছে। সে কল রিসিভ করে কানে দেয়।
— হ্যালো, কে বলছেন?
বিপরীত পাশ থেকে ভেসে আসে এক পুরুষ কণ্ঠ।
— ভাবি আমি।
মেহজা বিরক্ত কন্ঠে বলে,

— সবাই ই তো আমি হয়! আপনি কোন আমিটা বলছেন?
— ভাবি আমি সাইহান!
— আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?
— করেছি ম্যানেজ! ভাবি, আপনার সাথে একটা জরুরি কথা ছিলো।
— কি? বলেন।
বিপরীত পাশ থেকে সাইহান শ্বাস ফেলে বলে,
— ভাবি, আপনি একটু অর্তিহাকে নজরে রাখতে পারবেন?
মেহজা ভ্রু কুচকে বলে,
— কেন? কি হয়েছে? ওকে নজরে রাখতে হবে কেন?
— আসলে ভাবি, আমি বিয়েটা নিয়ে অনেক চিন্তিত!
মেহজা ধৈর্য্য ছাড়া হয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— কেন ভাই? কি হয়েছে? আমাকে একটু ২x স্পিডে বলবেন?
— আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আদ্রিক এই বিয়েটা হতে দিবে না। ও অর্তিহাকে এত সহজে আমার হতে দিবে না। তার উপর কালকে তো আমাকে ডিরেক্ট বলেই দিয়েছে সেটা!
— উনি কেন বিয়েটা হতে দিবে না?
— জানি না, কিন্তু ও অর্তিহা কখনো ভাইয়ের নজরে দেখে না! ও একটা সাইকো!
মেহজারও মনে হয় আদ্রিক অর্তিহাকে বোনের মতো দেখে না। আদ্রিককে সন্দেহজনক মনে হয়, কারণ ওর আশেপাশে থাকলে অর্তিহা খুব ভয় পায়, গুটিয়ে থাকে। অস্বাভাবিক আচরণ করলে দেখা যায়, সময়ের ব্যবধানে আদ্রিকই আশেপাশে থাকে। যেটা সবার চোখ এড়ালেও মেহজার চোখ এড়াতে পারেনি।
এখন সাইহানের কথায় মেহজার সন্দেহ আরও বেড়ে গেছে।
মেহজা চুপ থাকায় সাইহান ডাকে,

— ভাবি?
মেহজা ভাবনা থেকে বেরিয়ে বলে,
— হ্যাঁ, আমারও সন্দেহ হয়েছিল। এখন আপনার কি মনে হয়, উনি বিয়েটা কিভাবে আটকাবে?
সাইহান এবার গলা নিচু করে বলে, যেন চারপাশ শুনে ফেলবে এমন ভয়,
— ও নির্ঘাত বিয়ের আগের অর্তিহাকে কিডন্যাপ করে ফেলবে! অর্তিহাকে সরিয়ে ফেলবে এখান থেকে যাতে বিয়েটা না হয়। তাই ভাবি, আপনি প্লিজ অর্তিহার সাথে থাকবেন। ওকে কবুল বলানোর জন্য আমার সামনে আনার আগ পর্যন্ত!
— আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, আমি অর্তির আশেপাশে আঠার মতো লেগে থাকবো!
সাইহান যেন একটু স্বস্তি পায়। কিন্তু পুরোপুরি না।
— আর হ্যাঁ ভাবি, এটা আরভিদকে বলবেন না! তাহলে আরভিদ আদ্রিককে বলে দিবে যে আমরা ওর প্ল্যান ধরে ফেলেছি!
মেহজা একটু থেমে, মাথা নেড়ে বলে,

— হুম, ঠিক বলেছেন।
— আচ্ছা আমি রাখছি। আপনি অর্তিহার সাথে থাকবেন।
— ঠিক আছে।
মেহজা ফোন রাখতেই রুমে ঢুকলেন আস্মিতা তালুকদার আর মাশরিফ তালুকদার। মেহজা উনাদের দেখে বুঝে গেল কেন এসেছেন। দুজনের মুখেই গম্ভীর ভাব। মাশরিফ এসে মেহজার পাশে বিছানায় বসলেন। আর আস্মিতা মেহজার সামনে বসে কিছুটা রেগে বলেন,
— তুমি কবে বড় হবে? কবে একটু বুঝদার হবে? তোমার এই অবুঝ কাজগুলো আমাদের মাথা নিচু করে দেয়। আমাদের শিক্ষায় প্রশ্ন উঠে।
মেহজা বিরক্ত হয়ে তাকায় আব্বুর দিকে। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, সে যেন কিছুই করেনি। ছোটবেলা থেকে মেহজার এই স্বভাব। দোষ করবে কিন্তু স্বীকার করবে না, উল্টো অন্যের ওপর চাপাবে।
মাশরিফ সেটা দেখে আস্মিতাকে চোখের ইশারা করে বলেন,

— আস্মি, আমি বলছি।
আস্মিতা আরও রেগে গিয়ে বলেন,
— আপনি বললেও হবে না। সবসময় তো আপনি আপনার আদরের মেয়েকে নরম ভাষায় বোঝান! কিন্তু তারপরও সে একই কাজ করে। আর এখন? শ্বশুরবাড়িতে এমন একটা কাজ করেছে!
মেহজা ঠোঁট বাকালো। মাশরিফ শান্ত গলায় বলে,
— সত্যিই আম্মু, কালকে তুমি যেটা করেছো সেটা একদম ঠিক করোনি! তোমার কাজটা আমাদের লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। মাথা নত হয়ে গেছে।
হঠাৎ আরভিদের কন্ঠস্বর ভেসে আসে,

— লজ্জা পাওয়ার দরকার নেই আঙ্কেল, ফুজি। মেহু আর এমন করবে না।
দুজনেই দরজার দিকে তাকান। আরভিদ রুমে ঢুকছে, হাতে ট্রে আর তাতে নাস্তার প্লেট। আরভিদকে দেখে মেহজা খুশি হয়ে গেল। প্লেটটা সাইড টেবিলে রাখতে রাখতে আরভিদ বলে,
— আর তোমরাও কালকের কিছু মনে রেখো না।
আস্মিতা উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,
— কীভাবে ভুলে যাবো? কালকের ঘটনার পর ভাইয়া কি মেহুকে মানবে?
আরভিদ শান্ত গলায় বলে,
— ড্যাড মানা আর না মানার কেউ না। আমি মানছি, আমি মেহুর পাশে আছি, এটাই যথেষ্ট। আর কেউ না থাকলেও চলবে।
আস্মিতা বলেন,

— কিন্তু বউদের শ্বশুর বাড়ির মানুষদের মন বুঝে চলতে হয়। যেটা আমার মেয়ে করছে না।
আরভিদ দৃঢ় গলায় বলে,
— ও আমার স্ত্রী, আইনমন্ত্রী আরভিদ কারদারের স্ত্রী। ওকে আমি যেমন আছে, তেমনভাবেই মেনে নিয়েছি। তাহলে ও কেন বাড়ির মানুষের মন বুঝে চলবে? ওর কাউকে খুশি করার দরকার নেই। শুধু কারো অসম্মান না করলেই হয়। ও নিজের মতো করেই চলবে।
আস্মিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

— আমার মেহুকে নিয়ে অনেক চিন্তা ছিল। ওর স্বামী কেমন হবে, বুঝবে কিনা ওকে তা নিয়ে কম টেনশন করিনি। কিন্তু আমার মেয়ের ভাগ্য এতো ভালো জানতাম না! সত্যিই সাত জন্মের ভাগ্য ওর। কিন্তু দেখো, অসভ্য মেয়ের কাণ্ড তোমার কদরই করতে চায় না। আল্লাহই জানেন কবে এ মেয়েটাকে বুঝ দিবেন তিনি!
মাশরিফ উঠে দাঁড়িয়ে আরভিদের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
— বলাটা ঠিক কিনা জানি না, তবে গতকাল মেহুর জন্য আভীর বিপক্ষে তোমার দাঁড়িয়ে যাওয়া আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করেছে। তখন মনে হয়েছিল,
মেহুর জন্য তোমার থেকে ভালো কাউকে আমি পেতাম না। আমার মেয়ের জন্য তুমি বেস্ট। আমার মেয়ে তোমাকে পেয়ে জিতেছে, আর তোমাকে জামাই হিসেবে পেয়ে আমিও জিতেছি। এটা দেখে খুব গর্ব হয় যে, আমার মেয়েকে তুমি এতোটা ভালোবাসো।
তারপর মেহজার দিকে তাকিয়ে বলেন,

— মনে রেখো আম্মু, তুমি জিতেছো আরভিদকে পেয়ে।
মেহজা মুখ বাঁকিয়ে বলে,
— তোমরা এমনভাবে বলছো যেন উনি আমাকে পেয়ে হেরেছে! কেউ উনাকেও বলো, উনিও আমাকে পেয়ে জিতেছে।
আস্মিতা ফট করে বলেন,
— আমার আরভিদ হেরেছে তোমার মতো বেয়াদবকে পেয়ে!
মেহজা ভেংচি কাটে। আরভিদ হেসে বলে,
— হুম। এখন তোমরা বরং ব্রেকফাস্ট করতে যাও। আর হ্যাঁ, একদম আপসেট হবে না। তোমাদের মেয়ে যেমন ভুল করেছে তেমনি আমার বউও করেছে। কই, আমি তো মাথা নিচু করছি না, তোমরাও করবে না।
আস্মিতা জিজ্ঞেস করেন,

— তোমরা যাবে না?
আরভিদ বলে,
— না, আমি আমার আর মেহুর জন্য এখানেই এনেছি।
মাশরিফ মাথা নেড়ে বলেন,
— আচ্ছা, আমরা যাই।
ওনারা চলে যেতেই আরভিদ এসে মেহজার পাশে বসে বলে,
— মন খারাপ করেছিস ফুজি বকা দিয়েছে বলে?
মেহজা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,
— কচু পাতার গায়ে যেমন পানি লাগে না, তেমনি আম্মু বকা আমার গায়ে লাগে না!
বলেই জোরে হাসতে থাকে। তার হাসি দেখে আরভিদও হেসে ফেলে। সে মেহজাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

— সত্যিই আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তুই কোনো সাধারণ বউ নয় লা… তুই হচ্ছিস আমার পাজি বউ!
দুজনেই হেসে উঠে। হঠাৎ মেহজা আরভিদ থেকে নিজেকে সরিয়ে মুখ বাকিয়ে বলে,
— একটু ফ্রি হলাম দেইখা কি তুই বেডা অভার হয়ে যাবি?
আরভিদ ভ্রু কুঁচকে সরু চোখে তাকিয়ে বলে,
— তুই পাঁজি পাঁজিই থাকবি!
মেহজা হাসতে হাসতে বলে,
— একদম!
হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে সে জিজ্ঞেস করে,

— আচ্ছা সত্যি বলেন তো, কেউ কি আমাকে খাবার টেবিলে খেতে মানা করেছে?
— না।
— মিথ্যে বলছেন। নিশ্চয়ই কেউ না করেছে, তাই আপনি খাবার রুমে নিয়ে এসেছেন।
আরভিদ মেহজাকে বাম হাত দিয়ে টেনে বুকে জড়িয়ে বলে,
— না আমার চঞ্চলারানি, এমন কিছুই না। আমার ছোট্ট বউটা কষ্ট করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে বলে আমি নিজেই রুমে এনে দিয়েছি।
মেহজা ঠোঁট বাকালো,
— হুহ্! এত্তোহহ ভালোপাসা?
— হুঁউউউউমম।

বলতে বলতে আরভিদ প্লেটটা সাইড টেবিল থেকে তুলে নেয়। মেহজা পরোটা দেখে খুশি হয়ে গেল।
— ইয়ে! পরোটা এনেছেন। তাও গরুর মাংস দিয়ে। কতদিন ধরে পরোটা খাই না! ঐ ব্রেড বাটার খেতে খেতে জিহ্বার ছাল উঠে গেছে।
আরভিদ হেসে মেহজাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে।খাওয়ার মাঝেই মেহজা বলে,
— কি ছোট ছোট করে দিচ্ছেন? এইটুকু তো আমার দাঁতের ফাঁকে আটকে যাবে।
আরভিদ ভ্রু কুঁচকে এবার বড় টুকরো করে খাইয়ে দিতে থাকে। খাওয়ার মাঝেই মেহজা আবার বলে,
— আপনি খান।
আরভিদ হেসে আবদার করে বলে,
— তুই খাইয়ে দে?
মেহজা পরোটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলে,
— এই যে, এমন বউ পাবেন কোথায় যে খাবার মুখে তুলে দেয়! এই বুড়া বয়সে আমার মতো একটা যোয়ান মাইয়া পাইয়া জিতছেন!
আরভিদও হেসে বলে,
— জ্বি জোয়ান যুবতী বউ, আপনাকে পেয়ে আমি বিশাল জিতা জিতেছি! আমি মানছি!

অর্তিহা ব্রেকফাস্ট সেরে রুমে ঢুকেই দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। কারণ, আদ্রিকের কাছে রুমের চাবি আছে। সে যেকোনো সময় ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে। কিন্তু এখন অর্তিহা একা থাকতে চায়, একান্ত নিজের সঙ্গে। বুকের জমে থাকা পুরনো কষ্টগুলো আজ সে হালকা করতে চায়। কারণ আজকের পরে হয়ত সেই সুযোগ টা আর পাবে না।
নীরবে কাভার্ডের দিকে এগিয়ে গেল সে। কাভার্ড থেকে বের করলো একটা ছোট্ট চাবি।
তারপর বেডের কাছে এসে মেঝেতে বসে পড়ে। বেডের একদম শেষ প্রান্তে এক গোপন ড্রয়ার যেটা এমনভাবে বানানো হয়েছে যেন দিনের আলোয়েও চোখে না পড়ে। সেখানেই চাবিটা ঢুকাতেই খুলে গেল গোপন পাটাতন। ভেতর থেকে বের করে এক ছোট বাক্স। কাঠের তৈরি, বাদামি রঙা। খুব যত্নে এখানে রেখে দিয়েছিলো এক বছর আগে যেন আদ্রিকের চোখে না পড়ে। আদ্রিকের চোখে পড়লে এগুলো সে জ্বালিয়ে দেবে। কাঁপা হাতে বাক্সটা খোলে সে।

বুক ধুকধুক করছে। করাটাই স্বাভাবিক, কারণ বাক্সে আছে এমন একজনের স্মৃতি, যে আজ পৃথিবীতে নেই। যাকে আদ্রিক মিটিয়ে দিয়েছে পৃথিবী থেকে। তবে মনের গভীরে সযত্নে জেগে আছে নামটা—মাওলিদ। যেন মনে আঁকা অমলিন রেখা, মুছে যাওয়ার নয়, চিরকাল বেঁচে থাকা। সেখান থেকে মুছার সাধ্যি আদ্রিকের নেই। হাত কাঁপছে অর্তিহার। বুকের ভেতর যেন একটা ঢেউ উঠছে। থেমে থেমে ধাক্কা দিচ্ছে হৃদয়ের গভীরে।
বাক্স খুলতেই তার চোখে পড়ে শুকনো হয়ে যাওয়া একটুকরো কালো গোলাপ, মুক্তার একটি ব্রেসলেট আর একটি ছবি। ছবিটা হাতে নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সে। কালো কলেজ শার্ট পরা একটি ছেলে হাসছে। নির্মল, সহজ, নিঃস্বার্থ এক হাসি। এই হাসিটাই সে শেষ দেখেছিল ২৬ জুলাই, এক বছর আগে। তারপর? না হাসি, না সেই মানুষ। চোখ থেকে নীরব অশ্রু ঝরে পড়ে। তারপর হঠাৎ ভেতরে চেপে রাখা কান্না আর চেপে রাখতে না পেরে ডুকরে ওঠে।

— আমাকে মাফ করে দাও মাওলিদ! আমার মতো অভিশপ্ত মেয়ে তোমার জীবনে এসে তোমার জীবনটাই কেড়ে নিয়েছে। আমাকে ভালোবাসার বদলে প্রাণটাই নিয়ে নিয়েছে ঐ জঘন্য লোকটা! অথচ আমি কবুল বলেছিলাম তোমাকে বাঁচাতে। কিন্তু আমি পারিনি তোমাকে বাঁচাতে ঐ রাক্ষসটার থেকে। আমি জানতাম না আমার তোমার জীবনে আসাটা তোমার মৃত্যুর কারণ হবে! এমন জানলে আমি কোনো দিনও তোমার দিকে বন্ধুত্বরের হাত বারাতাম না। আর না সেই সম্পর্কের পরিণতি এমন হতো!

অর্তিহার চোখের সামনে ভেসে উঠে দুই বছর আগের সেই সময়টা। এসএসসি চলছিল তখন। সেদিন ছিল অর্তিহার ম্যাথ পরীক্ষা। যে বিষয়ে তার ভয় বরাবরের। মাত্র ১৩-১৪টা এমসিকিউ পারছিল। রেজাল্ট খারাপ হবে এই আতঙ্কে হাত-পা কাঁপছিল তার। ঠিক তখনি পাশে নজর পড়ে এক ছেলের দিকে। গায়ের রঙ কালো, তবে মায়াবী চেহারা। চেহারায় একটা শান্ত-ভদ্র ভাব। আশপাশের সবাই যেখানে অর্তিহাকে আড়চোখে দেখছিল, সে ছেলেটি একবারও তাকায়নি তার দিকে। নিজের মতো করে খাতায় রাফ করছে। অর্তিহা দ্বিধায় পড়ে গেল ডাকবে কি না। শেষে সাহস করে ডাক দিলো।
ছেলেটি খাতা থেকে চোখ সরিয়ে এক ঝলক অর্তিহার দিকে তাকিয়ে স্যারের উপস্থিতি বুঝে মাথা নামিয়ে নেয়। দৃষ্টি খাতায় রেখে হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করে,

— কি?
অর্তিহা তাকে MCQ গুলো জিজ্ঞেস করলে, ছেলেটা একে একে হাতের ইশারায় সব বলে দেয়। অর্তিহা পরীক্ষা শেষে ছেলেটাকে থ্যাংকস বলার জন্য অপেক্ষা করলেও ছেলেটা একবার তাকিয়েও দেখলো না। চুপচাপ চলে গেল। এরপর প্রতিটি পরীক্ষায় সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বাড়তি কোনো কথা না শুধু উত্তরের অদলবদল। এসএসসি শেষ হয়, ছেলেটাকেও আর দেখা যায় না। তবুও অর্তিহার মনে ছেলেটা গেঁথে গেল। তার মন থেকে যায় না। সে ভুলতে পারে না তাকে। মনে মনে তার প্রতি একটা আলাদা অনুভব তৈরি হয়ে যায়। অদ্ভুত এক শান্ত ভালো লাগা, অথচ ছেলেটার নাম পর্যন্ত জানে না সে।

কেটে যায় চার মাস। কলেজে ভর্তি হয় অর্তিহা ও তার বেস্টফ্রেন্ড মিষ্টি। প্রথম দিন ক্লাসে বসেই হঠাৎ অর্তিহার কানে পরিচিত এক কণ্ঠস্বর। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে। হ্যাঁ, সেই ছেলেটাই! সাথে সাথেই অর্তিহার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। আশা ছেড়ে দিয়েছিল সে। ভেবেছিলো হয়ত তাদের আর দেখা না। কিন্তু আল্লাহ কাছে প্রতিটা দিন প্রতিটা সময় দোয়া করে গেছে আরেকটার এই ছেলেটার সাথে দেখা হওয়ার। অবশেষে আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেছেন। ছেলেটার দেখা সে আবার পেয়েছে। ক্লাস শেষে অর্তিহা ইচ্ছে করে ছেলেটার কাছে যেতে, কথা বলতে। কিন্তু সাহস পায় না। সে তো ইন্ট্রোভার্ট মেয়ে।
তখন মিষ্টি বলে,

— দোস্ত! এটাই সুযোগ! এখন না গেলে আবার হারাবি কালা মানিককে!
অর্তিহা রাগ করে বলে,
— তোকে বলেছি না, ওকে কালো মানিক বলবি না?
মিষ্টি হেসে বলে,
— তাহলে কি বলবো? আমাদের অর্তির শান্তি নষ্ট করা মানিক?
অর্তিহা লজ্জা পায়। মিষ্টি আবার বলে,
— চল দোস্ত।
অর্তিহা দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করে,
— আমি গেলে ও আবার হ্যাংলা ভাববে না তো?
— তোর মতো সুন্দরী মেয়ে গেলে এতোকিছু ভাবার সময় পাবে না! শুধু তোকে নিয়েই ভাববে!
মিষ্টি তাকে টেনে নিয়ে যায় ছেলেটার কাছে। অর্তিহার বুক ধুকপুক করতে থাকে। ছেলেটা প্রথমে দেখেনি সে বন্ধুদের সাথে কথায় ব্যস্ত। তারপর এক বন্ধু ইশারা করলে অবশেষে তাকায় এবং চমকে যায়। অর্তিহা লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে।
মিষ্টি হেসে বলে,

— হাই?
ছেলেটা নিজের বিস্ময় সামলে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,
— হ্যালো?
বলেই আবার অর্তিহার দিকে তাকায়। অর্তিহা মাথা নিচু করে রেখেছে। দুই হাত দিয়ে আঙুল চেপে ধরেও হাতের কাঁপুনি থামাতে পারছে না। ছেলেটা অর্তিহার মুখে স্পষ্ট লজ্জা দেখতে পায়। অর্তিহার এই অবস্থা দেখে ছেলেটার বন্ধুরা হেসে ইশারা করে তাকে কথা চালিয়ে যেতে বলে চলে যায়।
ওরা চলে গেলে মিষ্টি আবার জিজ্ঞেস করে,
— তোমার নাম কী?
অর্তিহা এবার মাথা তুলে আগ্রহভরা চোখে তাকায়। সেটা দেখে ছেলেটা বলে,
— মাওলিদ।
নামটা শুনে অর্তিহা লজ্জা মাখা হেসে মাথা নিচু করে কয়েকবার নামটা আওড়ে নেয়।
মিষ্টি অর্তিহাকে দেখিয়ে বলে,

— ওকে তো চিনোই? এসএসসিতে তোমার পাশে বসেছিলো!
মাওলিদ অর্তিহার দিকে তাকিয়ে বলে,
— হুম! নামটা কি যেন…
অর্তিহা চট করে মাথা তুলে বলে,
— অর্তিহা!
দুজনের চোখে চোখ পড়ে যায়। অর্তিহা লজ্জা পেয়ে আবার মাথা নিচু করে। মাওলিদও মুচকি হাসে। অর্তিহার এই আচরণে মিষ্টিও হেসে ওঠে। সেদিনের পর অর্তিহা আর মাওলিদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। মাওলিদ হয় অর্তিহার একমাত্র ছেলে বন্ধু। মাওলিদ ছাড়া অর্তিহা আর কোনো ছেলের সঙ্গে কথা বলত না। কলেজের অনেক ছেলে এতে হিংসাও করত।
দেখতে দেখতে অর্তিহা আর মাওলিদের বন্ধুত্বের তিন মাস কেটে যায়। প্রতিদিনের মতোই অর্তিহা কলেজে আসে। এবং তার চোখ চারপাশে মাওলিদকে খুঁজতে থাকে। কোথাও মাওলিদের দেখা না পেয়ে তার মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে যায়। মিষ্টি সেটা বুঝে ফেলে।
অর্তিহা মিষ্টিকে মন খারাপ করে বলে,

— ও আসেনি আজকে?
মিষ্টি মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
— এসেছে এসেছে। মেহগনি গাছের নিচে তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
অর্তিহা অবাক আর খুশির মিশ্রিত কণ্ঠে বলে,
— আমার জন্য?
মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ে,
— হুম। এখন দ্রুত যা।
অর্তিহা আর দেরি না করে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে ক্যাম্পাসের দিকে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে সে মেহগনি গাছের নিচে এসে দাঁড়ায়। সেখানে এসে দেখে মাওলিদ দাঁড়িয়ে আছে।
অর্তিহা হেসে বলে,
— এখানে কি করছো? ক্লাস করবে না?
মাওলিদ তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শান্ত গলায় বলে,
— অর্তিহা, এখন তোমাকে একটা কথা বলবো।
অর্তিহা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে,
— কী?
মাওলিদ হঠাৎ হাঁটু গেড়ে অর্তিহার সামনে বসে পড়ে। ধীরে ধীরে পেছনের হাতটা সামনে বাড়িয়ে দেয়। তার হাতে একটা লাল গোলাপ।
মাওলিদ গভীর অনুভূতির কণ্ঠে বলে,

— জানি না তোমার মনে আমার জন্য কেমন ফিলিংস আছে, তবে আমার মনে এই কদিনে তোমার জন্য বন্ধুত্বেরও বেশি ফিলিংস এসেছে। যেগুলোকে নিঃসন্দেহে ভালোবাসা বলা যায়। তোমার উপস্থিতি আমার ভীষণ ভালো লাগে। তুমি থাকলে আমি কত স্বপ্ন দেখি! অর্তিহা, আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। তুমি কি আমাকে গ্রহণ করবে? জানি আমি দেখতে সুন্দর না, না তোমার যোগ্য। কিন্তু এই অযোগ্য মানুষটা চায় তুমি তাকে কবুল করে ফেলো। প্লিজ, আমাকে ফিরিয়ে দিয়ো না।
অর্তিহা খুশিতে যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। সে কি বলবে বুঝতেই পারে না। মাওলিদ তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে। অর্তিহা হেসে বলে,

— কে বলেছে আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেবো? আমিও তোমাকে ভালোবাসি আর সেটা প্রথম থেকেই। আর তুমি নিজেকে ছোট করা বন্ধ করো। আর একটা যদি নিজেকে সুন্দর না আর অযোগ্য বলেছো, তাহলে আমি রেগে যাবো। আমার চোখে সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটা তুমি। তোমার চরিত্র সুন্দর। আর তোমার মতো মায়াবী চেহারা কজনেরই বা আছে? তোমার মায়ায় পড়ে গেছি মাওলিদ আমি!
বলেই অর্তিহা মাওলিদের হাত থেকে ফুলটা নিয়ে নেয়। মাওলিদ তখন দাঁড়িয়ে পকেট থেকে একটা ছোট প্যাকেট বের করে। সেটা খুলে বের করে আনে একটি ব্রেসলেট।
তারপর সেটি অর্তিহার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
— এটা তোমার জন্য। পছন্দ করে এনেছি। জানি, এর দাম খুব কম। এর থেকে অনেক দামি জিনিস তুমি ব্যবহার করো। কিন্তু এখন আমার সামর্থ্য অনুযায়ী এতটুকুই পারলাম। একদিন অনেক টাকা কামিয়ে তোমাকে তোমার প্রাপ্য ব্রেসলেট দেবো।
অর্তিহা খুশিতে চোখ বড় করে বলে,

— ওয়াও! এটা অনেক সুন্দর। আর আমার কাছে টাকা কোনো ব্যাপার না। মানুষটার ভালোবাসাই মেটার করে। এখন আমার হাতে এটা পরিয়ে দাও।
বলেই অর্তিহা তার হাতটা বাড়িয়ে দেয়। মাওলিদ হেসে শান্ত স্বরে বলে,
— আমি তোমাকে এটা পরিয়ে দিতে পারবো না। আমি সেদিনই তোমাকে স্পর্শ করবো যেদিন তোমাকে কবুল বলে নিজের করবো। তার আগে আমি তোমাকে স্পর্শ করবো না, হাতটাও ধরবো না।
অর্তিহা মিষ্টি হেসে বলে,

মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৪

— ঠিক আছে। তাহলে এই ব্রেসলেটটা সেদিনই পরবো, যেদিন তুমি আমাকে পরিয়ে দেবে। দরকার পড়লে আমাদের বিয়ের দিনই পরিয়ে দেবে।
মাওলিদ হেসে ওঠে। তার দেখাদেখি অর্তিহাও হেসে ওঠে। সেদিনের পর থেকে তাদের শুরু হয় এক নতুন সম্পর্ক। বন্ধুত্ব পেরিয়ে প্রেমের সম্পর্ক।

মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here