মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৯
মাহা আয়মাত
বিয়ের হৈ-হুল্লোড় থেমে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই।হাসি, মজা সবই যেন এক নিমিষে নিঃশব্দ হয়ে গেছে। এখন কেবল চাপা উত্তেজনা আর ফিসফিসানি। সবার চোখে মুখে একটাই প্রশ্ন—সাইহান কোথায়? ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বলে গিয়েছিল, তারপর আর ফেরেনি। প্রায় ঘন্টা দেড়েক হয়ে গেছে! কাজি অনেক আগেই এসেছে, রাতও হয়ে যাচ্ছে। এদিকে প্রায় সব অতিথিই এখন সাইহানের নিখোঁজের খবর জেনে গেছে। আভীর কারদার, আফির কারদার, সারফারাজ—সবার মুখে চিন্তার ছাপ। কেবল আদ্রিক দাঁড়িয়ে আছে একদম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে, যেন কিছুই হয়নি।
শায়রা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে বলে,
— উপরে কোথাও ভাইয়া নেই!
সায়রও সেখানে এসে উপস্থিত হয়,
— আমি বাহিরের দিকটাও দেখে এসেছি, সেখানেও ভাইয়া নেই!
সাইহানের এক বন্ধু বলে ওঠে,
— সাইহানের ফোনও বন্ধ!
সারফারাজ চাপা রাগে গর্জে ওঠেন,
— এদিকে-সেদিকে কোথাও না থাকলে, সে আছে টা কোথায়? আহাম্মকটা ফোন বন্ধ করেছে কেন?
আভীর সঙ্গে সঙ্গে বলেন,
— আমাদের অপমান করানোর জন্য!
সারফারাজ বিস্মিত চোখে তাকান,
— মানে?
আভীর ঠান্ডা গলায় বলেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— মানেটা খুবই সিম্পল! তোর ছেলে পালিয়েছে। সে আসলে বিয়ে করতে আসেনি, বরং আমাদের সম্মান নষ্ট করতেই এসেছিলো। আমাদের বাড়ির মেয়ের হবু বর পালিয়েছে। এই খবরটা যদি বাইরে বের হয়, তাহলে তো আমাদের বদনাম হবেই!
সারফারাজ রেগে বলেন,
— পাগল নাকি তুই? এতে একার তোর সম্মান যাবে না, আমারও যাবে! এই খবর মিডিয়ায় গেলে আমারও বদনাম হবে!
আফির কারদার খোঁচা মেরে বলেন,
— সুনাম থাকলে তো বদনাম হবে!
সারফারাজ রাগে কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই আভীর কারদার তীব্র কণ্ঠে বলে ওঠেন,
— আজকে তুই আর তোর ছেলে যা করেছিস, তার শোধ আমি তুলবো!
তাহিয়া কারদার উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলেন,
— সাইহান কোথায় ভাইয়া? ওকে আসতে বলো না তুমি?
সারফারাজ গলা ভার করে বলেন,
— আমি জানি না, ঐ জানোয়ারটা কোথায়!
তাহিয়া কারদার কাঁপা গলায় বলেন,
— এখন কী হবে? সময় চলে যাচ্ছে! রাতও অনেক হয়েছে! আজ বিয়ে না হলে আমার মেয়েটার বদনাম হয়ে যাবে!
আভীর কারদার এবার রেগে ফেটে পড়েন,
— সময় গেলে যাক! এখন যদি ওর ওই কাপুরুষ ছেলে ফিরে আসে, তাও আমি এই বিয়ে হতে দেবো না! তোর ছেলে কি বিয়ে করবে না? আমিই আমার মেয়েকে ওর কাছে বিয়ে দেবো না!
সারফারাজ দাঁতে দাঁত চেপে অপমান গিলে নেন।
আভীরের এমন ব্যবহার স্বাভাবিক। তিনি ভাবছেন অর্তিহাকে বিয়ে করার জন্য সাইহান নিজেই কত কিছু করেছে, আর এখন বিয়ের দিন পালিয়ে গেছে?
সায়র এগিয়ে এসে বলে,
— আচ্ছা আঙ্কেল, আমরা একটু ওয়েট করি ভাইয়ার জন্য? হয়তো ভাইয়া কোনো কাজে পড়েছে…
আভীর সায়রকে থামিয়ে দেন,
— কী অপেক্ষা করবো আর? দুই ঘন্টা হয়ে গেছে! তোমার ভাই দুই ঘন্টা উধাও। এতেই বোঝা যাচ্ছে সে পালিয়েছে!
সায়র চুপ করে যায়। আর বলার কিছু থাকে না।
আভীর যা বলছে, সত্যিই তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু তবুও মন মানতে চায় না। সাইহান যে অর্তিহাকে বিয়ে করার জন্য এতকিছু করেছিল, সে কি সত্যিই এমন করবে? শায়রার দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে আদ্রিকের দিকে। সে বুঝে গেছে, সাইহানের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে আদ্রিকের হাত আছে।
সারফারাজ ভাঙা কণ্ঠে নিচু স্বরে বলেন,
— আমি সত্যিই লজ্জিত আজকের জন্য…
তাহিয়া কারদার ভেজা কণ্ঠে বলেন,
— ভাইয়া, এসব বলো না! তুমি যেখান থেকেই পারো, সাইহানকে নিয়ে এসো! আমার মেয়েটা বউ সেজে বসে আছে!
সারফারাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
— তোর মেয়ের কাছে আমার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিস। ওই জানোয়ারটা ওর যোগ্য না! তোর মেয়ে আরও ভালো কাউকে পাবে!
তাহিয়া হতবাক হয়ে বলে,
— মানে কী বলছো তুমি? আমার মেয়ের আজ বিয়ে হবে না? আমি তো তোমাদের কথাতেই রাজি হয়েছিলাম এই কম বয়সে মেয়েটার বিয়ে দিতে!
কিন্তু এখন যদি এই বয়সেই আমার মেয়ের উপর বিয়ে ভাঙার ট্যাগ লাগে। তাহলে তোমরা কি বুঝতে পারছো, ওর জীবনে কী প্রভাব পড়বে? আমার মেয়ের সম্মানটা কী হবে তখন?
সারফারাজ চুপ করে থাকেন। কোনো উত্তর দেন না। অবশ্য উনার কাছে উত্তরও নেই। তখনি নাজনীন কারদার বলে ওঠেন,
— ভাইয়া, আমি একটা প্রস্তাব রাখতে চাচ্ছি! আপনি না করবেন না! সেই প্রস্তাবে বাড়ির এবং অর্তি দুটোরই সম্মান নষ্ট হওয়া থেকে বেঁচে যাবে।
সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকায় নাজনীন কারদারের দিকে। আভীর কারদার প্রশ্ন করেন,
— কি? বলো?
নাজনীন কারদার বলেন,
— আমি অর্তিকে আমার ছেলের বউ করতে চাই! ছোটবেলা থেকেই আমি অর্তিকে আমার আদ্রিকের জন্য পছন্দ করে রেখেছিলাম। কিন্তু আপনি যখন সাইহানের সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক করলেন, তখন কিছু বলতে পারিনি। এখন যখন সাইহান পালিয়ে গেছে, আমি চাই অর্তিকে আমার আদ্রিকের বউ বানাতে। তাতে বাড়ির সম্মানও বেঁচে যাবে।
নাজনীন কারদারের কথা শুনে উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে যায়। শায়রার এক মুহূর্তের জন্য তার চারপাশের সবকিছু থেমে যায়। বুকের ভেতর প্রচণ্ড কাঁপুনি শুরু হয়। সে চিন্তিত ও ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে আভীর কারদারের দিকে। তার মন বলছে, না বলে দিক।
আভীর কারদার কপালে ভাঁজ ফেলে কিছুক্ষণ ভাবেন। আদ্রিক এমন একজন ছেলে যাকে কোনো পাত্রীর বাবা মা না করতে পারবে না। তিনি চোখ ঘুরিয়ে তাকান আরভিদের দিকে। আরভিদ গম্ভীর মুখে বসে আছে। তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে বলেন,
— আমি রাজি!
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই শায়রা চোখ বন্ধ করে ফেলে। সারফারাজ একবার মেয়ের দিকে তাকান। শায়রা চোখ খুলে তাকায় আদ্রিকের দিকে। আদ্টিক এখনো আগের মতোই স্বাভাবিক।
নাজনীন কারদার খুশি হয়ে যান। তিনি আদ্রিকের কাছে গিয়ে তার হাত ধরে বলেন,
— তোমাকে না জিজ্ঞেস করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি মম! কিন্তু আমি মনে করি এটা খুব ভালো সিদ্ধান্ত! তুমি জানো, আমি অর্তিকে কত ভালোবাসি। আমার অনেক ইচ্ছে ছিল ওই পুতুলটাকে আমার ছেলের বউ করার! তুমি আপত্তি করো না!
আভীর কারদার এবার আদ্রিককে প্রশ্ন করেন,
— আমার মেয়েকে বিয়ে করতে তোমার কোনো আপত্তি আছে?
আদ্রিক স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেয়,
— না।
আভীর কারদার এবার আফির কারদারকে জিজ্ঞেস করেন,
— তোর আছে?
আফির বলে,
— না ভাইয়া! আমি কেন আপত্তি করবো!
আভীর কারদার কাজিকে বলেন,
— আজই বিয়ে হবে! পাত্র আদ্রিক! কাজি সাহেব, সব রেডি করুন।
কাজি প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। সারফারাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই, লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যায় তাঁর। তিনি বলেন,
— আমরা যাচ্ছি।
আভীর কারদার সঙ্গে সঙ্গে বলেন,
— না! বিয়ে দেখে তবেই সব মেহমান যেতে পারবে।
সারফারাজ চুপ করে যান। সব প্রস্তুতি শেষে কাজি অর্তিহাকে নিয়ে আসতে বলেন। আভীর কারদার তাহিয়া কারদারকে ইশারা করেন অর্তিহাকে নিয়ে আসার জন্য। তাহিয়া কারদার হানিন ও মিষ্টিকে বলেন অর্তিহাকে নিয়ে আসতে। তারা দুজন মাথা নেড়ে চলে যায়।
অর্তিহা রুমে বসে আছে। চিন্তায় অস্থির, হাত-পা ঘামছে, শরীর কাঁপছে। এত চাপ সে নিতে পারছে না। পাশে মেহজা পায়চারি করছে চিন্তায়। সাইহান কোথায় গেছে, সে কিছুই বুঝতে পারছে না। বহুবার কল দিয়েছে, কিন্তু ফোন বারবার বন্ধ! নিচে কি হচ্ছে, সেটাও জানে না। এতক্ষণ ধরে সে অর্তিহার সঙ্গেই উপরে আছে। অর্তিহাকে একা রাখেনি, কারণ তার মনে হচ্ছে এটা হয়তো আদ্রিকের কোনো চাল সাইহানকে পাওয়া যাচ্ছে না এমন খবর ছড়িয়ে দিয়ে অর্তিহাকে একা করার চেষ্টা করছে, তারপর হয়তো কিডন্যাপ করবে! এসব ভাবতেই মেহজা অর্তিহার পাশে থেকে যায়।
এই সময় হানিন আর মিষ্টি রুমে ঢোকে। মেহজা তাদের দেখে অস্থির হয়ে বলে ওঠে,
— নিচে কি হয়েছে?
মিষ্টি শান্ত স্বরে বলে,
— অর্তিকে নিয়ে যেতে বলেছে! কাজি সাহেব অপেক্ষা করছেন!
মেহজা খুশি গলায় বলে,
— সাইহান ভাই এসে গেছেন?
হানিন মাথা নাড়ে,
— নাহ!
মেহজা কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
— তাহলে অর্তিকে নিয়ে যেতে বলেছে কেন? বিয়ে কিভাবে হবে?
— বর চেঞ্জ হয়েছে!
মেহজা হতবাক,
— মানে? কিসব বলছো!
মিষ্টি এবার অর্তিহার দিকে তাকিয়ে বলে,
— মানে, অর্তির বিয়ে সাইহান ভাইয়ার সাথে না বরং
অর্তিহা দ্রুত বসা থেকে উঠে এগিয়ে আসে, মুখে স্পষ্ট উৎকণ্ঠা,
— বরং কার সাথে?
হানিন শান্ত গলায় উত্তর দেয়,
— আদ্রিক ভাইয়ার সাথে! আভীর আঙ্কেল অর্তিকে নিয়ে যেতে বলেছেন!
এই কথা শুনে অর্তিহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যেন বুকের অস্থিরতা একটু থেমে যায়, শরীরের ভারটা হালকা লাগে।
মেহজা বিস্ময় আর রাগ মিশ্রিত কণ্ঠে বলেন,
— এটা কিভাবে সম্ভব? আদ্রিক ভাই কিভাবে? আর একটু অপেক্ষা করতে পারি না? হয়তো সাইহান ভাই কোনো বিপদে পড়েছেন!
মিষ্টি বলে,
— ভাবি, এখন কাছের মানুষ রেখে অন্যের বিপদের কথা ভাবলে চলবে না! অর্তির বিয়ে না হলে ওরই বদনাম হবে, আপনাদের পরিবারেরও! সাইহান ভাইয়ের এমন নিখোঁজ হওয়াটা দেখে বোঝাই যাচ্ছে উনি পালিয়েছেন!
মেহজা অসহায় গলায় বলে,
— তোমরা বুঝতে পারছো না…
মিষ্টি দৃঢ়ভাবে বলে,
— আমাদের বুঝিয়ে কী হবে ভাবি? সিদ্ধান্ত তো নিচে নেওয়া হয়ে গেছে। এখন শুধু ওকে নিতে যেতে বলেছে। দেরি হলে আভীর আঙ্কেল রেগে যাবেন!
হানিন বলে,
— মিষ্টি ঠিক বলেছে! চল অর্তি!
হানিন আর মিষ্টি মিলে অর্তিহাকে নিচে নিয়ে আসে। মেহজাও পিছু নেয়। লিভিং রুমে ঢুকতেই আভীর কারদার এগিয়ে এসে অর্তিহাকে ধরে সোফায় নিজের পাশে বসান। অর্তিহার পাশে এসে দাড়ান তাহিয়া কারদার। এসে অর্তিহার হাতটা ধরেন। অর্তিহা মাথা তুলে তাকায় তাহিয়া কারদারের দিকে ভেজা চোখে। তাহিয়া কারদার আশ্বাস দেন চোখের ইশারায়। অর্তিহার সামনের সোফায় বসে আছে আদ্রিক। অর্তিহা মাথা নিচু করে, নিঃশব্দে বসে থাকে। আদ্রিক তার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে, মুখে কোনো হাসি নেই, চেহারা একেবারে স্থির।
হঠাৎ সে অর্তিহার চোখ সরিয়ে দূরে দাঁড়ানো মেহজার দিকে তাকিয়ে হালকা মুচকি হাসে।
মেহজার চোখে সেই হাসি রাগের আগুন ধরায়। সে ভালো করেই জানে সাইহানের নিখোঁজের পেছনে আদ্রিকের হাত আছে। আর এই হাসিটা তাকে ইচ্ছে করেই দিয়েছে রাগানোর জন্য। মেহজা রাগে চোখ ঘুরিয়ে তাকায় আরভিদের দিকে, অভিমানী দৃষ্টিতে। আদ্রিকের পাশেই বসা সে। আরভিদও বুঝে নেয় মেহজার চোখের অভিমান, দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে।
তখনি শোনা যায় কাজি সাহেবের কন্ঠস্বর,
— আপনি যদি আভীর কারদারের একমাত্র মেয়ে অর্তিহা কারদারের সাথে বিবাহের জন্য রাজি থাকেন, তাহলে বলুন কবুল।
আদ্রিক তখন চোখ ঘুরিয়ে তাকায় শায়রার দিকে।
শায়রা দাঁড়িয়ে আছে ভীড়ের পেছনে, চোখে জল, মুখে তীব্র কষ্ট। তার দৃষ্টি আহত—যেন এক শিকারি তাকিয়ে আছে তার শিকারের দিকে, আর শিকারের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইছে! শায়রার চোখ টলমল করছে জলে, ঠোঁট কাঁপছে। তার দৃষ্টি যেন বলছে,
— আদ্রিক, এমনটা করো না! আমি মরে যাবো!
তার চোখে ছিল হাজারো অনুনয়, আকুতি, ভাঙা ভালোবাসার চিৎকার। আর আদ্রিক সেই চোখের যন্ত্রণার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে উঠে,
— কবুল, কবুল, কবুল!
সবাই একসাথে বলে,
— আলহামদুলিল্লাহ!
শব্দটা ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। শায়রার পা যেন হঠাৎ ভারী হয়ে যায়, তবু সে দু’কদম পিছিয়ে আসে। তার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। চোখ থেকে টুপ করে গরিয়ে পড়ে পানি। তার ভালোবাসার মানুষ আজ অন্যের হয়ে গেল। এই যন্ত্রণা সে কিভাবে সহ্য করবে? করতে পারবে না তো! শায়রা হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ায়, কিছু না বলে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। সবাই তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
সারফারাজ ধীরে বলে ওঠেন,
— আমরা এবার যাই। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
বলেই বেরিয়ে যান। উনারর পিছু পিছু বাকিরা বরযাত্রী রাও চলে যায়। ওরা চলে যেতেই সবাই আবার বিয়েতে মনোযোগ দেয়।
গ্যারেজটা অন্ধকার। একটা কোণায় চেয়ারে হাত-পা শিকলে বাঁধা অবস্থায় বসে আছে সাইহান। তার চারপাশে গোল করে রাখা হয়েছে ২৪টা বড় সাউন্ড বক্স, যেন এক ভয়ংকর বেড়ি তার চারদিক ঘিরে রেখেছে। মুখও শক্ত করে বেঁধে রাখা, ফলে কথা বলা বা চিৎকার করার কোনো উপায় নেই। প্রায় দশ-বারো মিনিট আগে কেউ তার মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কে ছিল, সেটা দেখতে পারেনি, কারণ তখন পুরো রুম অন্ধকার ছিল। জ্ঞান ফেরার পরই লোকটা চলে যায়। তার পর রুমের আলো জ্বলে ওঠে।
আলো জ্বলার পর সাইহান চারপাশে তাকিয়ে দেখে অনেকগুলো গাড়ি। এর মধ্যে দুটি গাড়ি তার চেনা। একটা অর্তিহার, যেটা দিয়ে সে কলেজে যাওয়া আসা করে। আরেকটা আদ্রিকের। গাড়িগুলো দেখেই সে বুঝে যায়, সে এখন কারদার ম্যানরের গ্যারেজে আছে। সে হাত-পা নড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুতেই পারে না। লোহার শিকল এত শক্ত করে বাঁধা যে ত্বক পর্যন্ত ঘষে গেছে। বুকের ভেতর আতঙ্ক বাড়তে থাকে। মাথায় আসে নানা চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। অর্তিহা এখন কোথায়, সে কি জানে সাইহান নেই? হয়তো এতোক্ষণে সবাই জেনে গেছে সে নিখোঁজ।
ঠিক তখনই চারপাশের ২৪টা সাউন্ড বক্স থেকে খুব আস্তে একটা কণ্ঠ ভেসে আসে,
— আপনি যদি আভীর কারদারের একমাত্র মেয়ে অর্তিহা কারদারের সাথে বিবাহের জন্য রাজি থাকেন, তাহলে বলুন কবুল।
এটা কাজির কণ্ঠ। সাইহানের শরীর কেঁপে ওঠে। সে মরিয়া হয়ে দুলতে থাকে, ছটফট করতে থাকে। মন থেকে একটাই কথা বেরোয়—না!
কিছু সেকেন্ড পর হঠাৎ সাউন্ড বেড়ে যায়। ২৪টা সাউন্ড বক্সে একসাথে খুবই জোরে শোনা যায় গভীর পুরুষালি কন্ঠ,
— কবুল, কবুল, কবুল।
এটা আদ্রিকের কন্ঠ। শব্দটা এত জোরে বাজে যে কানে যেন ঝনঝন করে। সাইহানের মাথা ঘুরে ওঠে কিন্তু শব্দের জন্য নয় বরং ভয় আর কষ্টে। মনে হয় মাথায় হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ। বুকের ভেতর ভারী হয়ে আসে, মনে হয় কেউ যেন চেপে ধরছে।
এরপর চারপাশে ধীরে ধীরে প্রতিধ্বনি হয়,
— আলহামদুলিল্লাহ।
এই শব্দটাও এখন তার কাছে তীরের মতো লাগে।আবার কাজির কণ্ঠ শোনা যায়, আগের মতোই আস্তে,
— মা, আপনি যদি আফির কারদারের একমাত্র ছেলে আদ্রিক কারদারের সাথে বিবাহে সম্মতি থাকেন, তাহলে বলুন কবুল।
এইবার কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে সব। সাইহানের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে, বুক ধড়ফড় করছে আগের চেয়ে আরও জোরে। মনে হয় এখন কিছু একটা শেষ হয়ে যাবে।
তারপর হঠাৎ অর্তিহার কণ্ঠ শোনা যায়, পূর্বের তুলনায় খুবই জোরে,
— কবুল, কবুল, কবুল।
শব্দটা যেন সাইহানের বুকের ভেতর গেঁথে যায়। সাইহানের শরীর স্থির হয়ে যায়। শরীর নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কোনো নড়াচড়া থাকে না। শুধু কানে বাজতে থাকে অর্তিহার বলা কবুল শব্দটা প্রতিধ্বনি হয়ে।
চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। মনে মনে সে বলে ওঠ,
— না… এটা হতে পারে না! অর্তিহা অন্য কারোর নামে কবুল পড়তে পারে না! সে তো আমার মায়াপরী, আমার নামের সাজে ছিলো! তাহলে কেন আজ অন্য কারোর হলো? না, এটা ভুল! সব কিছুই ভুল! অর্তিহা অন্য কারোর হতে পারে না!
হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ে নিঃশব্দ, বুকফাটা এক কান্না, যার শব্দ হয়তো কেউ শোনে না, কিন্তু সেই কান্নার ভারে গ্যারেজের বাতাসও যেন ভারী হয়ে যায়।
বিয়ের এক ঘণ্টা পেরিয়েছে। লিভিং রুমে আদ্রিক আর অর্তিহাকে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। আর তাদের ঘিরে হানিন, মিষ্টি, মিশান, কৌশালী, সামির আর ফারিদ রা সবাই মিলে হাসি-ঠাট্টা, আনন্দ-মজা করছে। অন্য মেহমানরা চলে গেছে, বড়রাও নেই। তাদের এখানে থাকা মানায় না বলে। এখন শুধু ছোটরা আড্ডায় মেতে আছে। তাদের মধ্যেই মেহজা আর আরভিদও বসে আছে। মেহজা রাগভরা চোখে আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে আছে। আদ্রিকের মুখের হাসিটা তার কাছে বিষের মতো লাগে। আদ্রিক বুঝতে পারে মেহজা রেগে আছে, কিন্তু তাতে তার আরো মজা লাগছে।
কারণ, অন্যকে কষ্ট দিতে বা রাগাতে সে বরাবরই ভালোবাসে। মেহজা মুখ ফিরিয়ে সামনে বসা আরভিদের দিকে তাকায়। আরভিদ মেহজার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। তাদের চোখাচোখি হতেই মেহজা উঠে দাঁড়ায়। মেহজার পাশে বসে থাকা মিষ্টি মেহজাকে জিজ্ঞেস করে,
— কোথায় যাচ্ছেন ভাবি?
মেহজা নিজের রাগ বিরক্ত চেপে রেখে শান্ত গলায় বলে,
— শরীরটা খারাপ লাগছে, তাই রুমে যাচ্ছি।
আদ্রিক ঠোঁটের কোনে হাসি রেখেই ব্যঙ্গ করে বলে,
— মন খারাপ থাকলে শরীর খারাপ লাগা ইটস নরমেল!
মেহজা দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সামলায়। কিছু না বলে সোজা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। আরভিদ উঠে মেহজার পিছু পিছু চলে যায় সেখান থেকে। রুমে ঢুকে মেহজা দরজাটা জোরে বন্ধ করার জন্য ধাক্কা দেয়, কিন্তু আরভিদ এসে হাত দিয়ে ধরে ফেলে। নরম স্বরে ডাকে,
— মেহু?
মেহজা ঘুরে তাকায়। চোখে জল, মুখে রাগ।
— কথা বলবেন না আমার সঙ্গে!
আরভিদ একটু থেমে বলে,
— একটা বার আমার কথা শুনবি না?
মেহজা রাগে চিৎকার করে বলে,
— কি শুনব? আপনি এখন বলবেন আপনি নির্দোষ, তাই না? বলবেন যে সাইহান ভাইয়ের নিখোঁজে আপনি কিছু জানেন না? কিন্তু আমি জানি, আপনি আর আপনার বন্ধু জড়িত। আপনারাই সাইহান ভাইকে গায়েব করেছেন।
আরভিদ শান্তভাবে বলে,
— আমি অস্বীকার করছি না। হ্যাঁ, আমি জড়িত ছিলাম।
মেহজা হতভম্ব হয়ে যায়, তারপর রাগে কাঁপা গলায় বলে,
— বাহ! নিজের বোনের জীবন শেষ করে আপনি এখন সেটা স্বীকার করছেন? আপনিই বোধ হয় প্রথম ভাই, যে নিজের বন্ধুর জন্য নিজের বোনের জীবনটা শেষ করেছে!
আরভিদ মাথা নিচু করে বলে,
— আমি অর্তির জীবন শেষ করিনি, মেহু।
— শেষ করেননি? আপনি দেখেননি অর্তি কেমন ভয় পায় আদ্রিক ভাইকে? আপনার বন্ধু যখন আশেপাশে থাকে, মেয়েটা ভয়ে একদম কুঁকড়ে যায়। এখন সারাজীবন সেই আতঙ্কের সঙ্গে থাকতে হবে ওকে। আপনি বলেন, এভাবে কেউ সুখে থাকতে পারে?
আরভিদ ধীরে বলে,
— অর্তি আদ্রিকের কাছেই ভালো থাকবে। অন্য কারোর সাথে অর্তিকে সুখে থাকতে দিবে না আদ্রিক।
— আপনি যদি আদ্রিক ভাইয়ের সঙ্গ না দিতেন, তাহলে আজকে অর্তি সাইহান ভাইয়ের হতো, সুখেও থাকতো।
— অর্তি তো আগেই আদ্রিকের হয়ে গেছে।
মেহজা চমকে ওঠে,
— মানে কি?
— মানে, আজকের বিয়েটা শুধু লোক দেখানো। অর্তি আর আদ্রিকের বিয়ে আগেই হয়ে গেছে।
বিস্মিত হয়ে মেহজা চুপ হয়ে যায়। মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না।
আরভিদ আবার বলে,
— এখন বলো, সাইহান আর অর্তির বিয়ে কিভাবে হতো? ও তো আগে থেকেই বিবাহিত, আর এখন তো আদ্রিকের সন্তানের মা হতে চলেছে।
অর্তিহা মা হতে চলেছে শুনে মেহজা আরেকদফা অবাক হয়। সে এখনো বিয়ের ব্যাপারাটাই হজম করতে পারছে না।
মেহজা শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করে,
— কবে বিয়ে হয়েছে?
— গত বছরের ২৯ জুলাই।
মেহজা অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে,
— অর্তি কি আদ্রিক ভাইকে ভালোবাসে?
— না, অর্তি ওকে ভালোবাসে না।
মেহজা চোখ ছোট করে প্রশ্ন করে,
— তাহলে জোর করে বিয়ে করেছে?
— হ্যাঁ। অর্তি অন্য কাউকে ভালোবাসতো। আদ্রিক তাদের একসাথে দেখে জোর করে বিয়ে করে ফেলে।
মেহজার চোখে জল চলে আসে।
— আপনি কিছুই বলেননি? নিজের বোনের জন্য একটা কথাও বলেননি? অবশ্য বলবেনই বা কি, আপনিও তো আমাকে জোর করে বিয়ে করেছিলেন।
আরভিদ আহত গলায় বলে,
— হ্যাঁ, করেছি। কিন্তু তোকে হারানোর ভয়েই। মানছি আমার ভুল হয়েছে। কিন্তু জান তুই এইভাবে বলে আমাকে কষ্ট দিস না!
মেহজা রেগে বলে,
— অর্তি অন্যজনকে ভালোবাসতো জেনেও আপনি ওকে ওর ভালোবাসার মানুষটার কাছে ফিরিয়ে দিলেন না কেন?
আরভিদ চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর নিচু স্বরে বলে,
— কারণ, সে মানুষটা আর বেঁচে নেই।
— মানে? সে আত্মহত্যা করেছে?
— না, আদ্রিক মেরে ফেলেছে।
এই কথাটা শুনে মেহজা কেঁপে ওঠে। কয়েক কদম পিছিয়ে যায়।
— তাই অর্তি এমন চুপচাপ? মুখটা সবসময় ফ্যাকাশে হয়ে থাকতো? তাই ওর চোখে সবসময় কষ্ট দেখি? ওর ভালোবাসার মানুষকে মেরে ফেলেছে আপনার বন্ধু!
আরভিদ এগিয়ে মেহজার কাছে এসে মেহজার গালে হাত রেখে বলে,
— মেহু…
মেহজা চোখে জল নিয়ে অবুঝ কন্ঠে বলে,
— ওর বয়স কত? ১৮? এই বয়সেই এমন কষ্ট পেতে হলো ওর? এখন সেই খুনির সাথেই থাকতে হবে সারাজীবন? সুখী হতে পারবে ও?
আরভিদ কিছু না বলে মেহজাকে জড়িয়ে ধরে। মেহজা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
— নিজের উপর রাগ হচ্ছে। ওর পাশে থেকেও বুঝতে পারিনি ওর ব্যথাটা।
আরভিদ ওর চোখের জল মুছে কপালে চুমু খায়,
— আর কাদিস না, মেহু। আমারও কষ্ট হচ্ছে।
— থামাতে পারছি না। অর্তির জন্য খুব খারাপ লাগছে।
— আমি আছি, মেহু। যদি আদ্রিক কখনও ওকে কষ্ট দেয়, আমি ছাড়বো না।
— কষ্ট তো ইতিমধ্যে দিয়েছে। তখন কিছু করলেন না কেন?
— কারণ অর্তি প্রেগন্যান্ট। এখন যদি বিয়ে না হতো, বদনাম হতো ওরই। আর আদ্রিক যেমনই হোক, অর্তির জন্য ওর পাগলামি যত্ন সত্যি।
মেহজা চুপ করে যায়। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে থাকে। আরভিদ ধীরে বলে,
— সরি।
মেহজা আরভিদের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে বলে,
— আমাকে সরি বলছেন কেন? অন্যায় তো অর্তির সঙ্গে করেছেন!
— না, সরি বলছি তোকে না জানিয়ে একটা কাজ করেছিলাম বলে।
— কি কাজ?
— তোর মোবাইল দিয়ে তুই সেজে সাইহানকে মেসেজ দিয়েছিলাম।
মেহজা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
— কি মেসেজ? কেন?
— উপরে অর্তিহার রুমে আসার জন্য। যাতে ওকে নিচে সবার মাঝখান থেকে আলাদা করা যায়, কিডন্যাপের জন্য।
— কিন্তু আপনি জানলেন কিভাবে সাইহান ভাইয়ের সাথে আমার যোগাযোগ আছে?
— আদ্রিক বলেছিল, তোর সাথে সাইহানের যোগাযোগ আছে। আর তোর মোবাইল থেকে মেসেজ দিতে বলেছিল।
মেহজা রেগে বলে,
মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৮
— শয়তান একটা!
আরভিদ চোখে আকুতি নিয়ে বলে,
— সরি জান, রাগ করিস না। আমি চেয়েছিলাম সাইহান আর অর্তির বিয়ে না হয়।
মেহজা চোখের জল হাত দিশে মুছে বলে,
— আপনাকে বলিনি! আপনার শয়তান বন্ধুটাকে বলেছি!
আরভিদ হেসে বলে,
— ঠিক আছে, তুই বললে, আমিও তোর সাথে বসে ওকে গালি দেব!
