মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৯ (২)

মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৯ (২)
মাহা আয়মাত

অর্তিহা সারাদিনের কান্না আর না খাওয়ার ক্লান্তিতে নুইয়ে পড়েছে। এটা আদ্রিকের চোখে পড়ে। সবার হাসি মজার মাঝেই আদ্রিক হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। সবাই তাকায় ওর দিকে।
সামির জিজ্ঞেস করে,
— কি হলো, দাঁড়ালি কেন?
আদ্রিক বলে,
— রুমে যাচ্ছি। অর্তির রেস্টের প্রয়োজন।
এই বলে সে অর্তিহাকে কোলে তুলে নেয়। অর্তিহা ভয় পেয়ে আদ্রিকের ওয়েস্টকোট আঁকড়ে ধরে। সবাই একসাথে হেসে ওঠে,

— ওওহোহোহোহো!
সবার হাসিতে অর্তিহা লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলে আদ্রিকের বুকে। ত দেখে আদ্রিক হেসে অর্তিহার দিকে তাকায়। আদ্রিক অর্তিহাকে নিয়ে হাটা শুরু করে। অর্ধেক সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই দেখে সবাই পেছন পেছন আসছে।
— কি হলো? পেছনে আসছো কেন সবাই?
ফারিদ হেসে বলে,
— বাসর ঘরে ঢুকতে হলে টাকা দিতে হয়!
আদ্রিক বলে,
— আমি বাসর রুমে না, নিজের রুমে যাচ্ছি।
সামির মজা করে বলে,
— কিন্তু যাচ্ছিস তো বাসর করতেই, সালা!
সবাই হেসে ওঠে। অর্তিহা লজ্জায় আরও কুঁকড়ে যায়। ওদের এসব কথা শুনে অর্তিহার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।
আদ্রিক বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— আজ বাসর করছি না! যেদিন করবো, সেদিন টাকা দিবো!
ফারিদ হাসতে হাসতে বলে,
— আমাদের বোকা ভাবছিস? প্রথম রাতে কোপ দিবি না! এটা বিশ্বাস করবো নাকি?
আদ্রিক বাঁকা হেসে বলে,
— প্রথম রাতে কোপ তো দিয়েই দিয়েছি!
আদ্রিকের কথা সবার মাথার উপর দিয়ে যায়। কেউই কিছু বুঝতে পারে না। শুধু সামির হেসে ফেলে। কারণ সে আদ্রিক আর অর্তিহার বিয়ের ব্যাপারটা শুরু থেকেই জানে।
মিষ্টি বলে,

— কি বলছেন আদ্রিক ভাইয়া, কিছুই বুঝলাম না!
আদ্রিক হেসে বলে,
— বুঝতে হবে না, সালি সাহেবা! সময় হলে বুঝবে।
ফারিদ বলে,
— যা বুঝার সময় হলে বুঝবো, এখন দুই লাখ টাকা বের কর!
আদ্রিক ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
— দুই লাখ?
সামির বলে,
— হ্যা। তোর জন্য তো এটা কিছুই না! তুই অনেক টাকা ইনকাম করিস!
আদ্রিক স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,
— টাকা কষ্ট করে ইনকাম করেছি, মদ বেচে না! তাই এক টাকাও অনেক!
কৌশালী বলে,
— সে যাই হোক, দিতে হবে! নাহলে বাসর ঘরে যেতে দিবো না।
আদ্রিক হেসে বলে,

— রুম আমার, বউ আমার! তোমরা কিছুই করোনি, আবার দুই লাখ চাও? সবাই মিলে চকলেট খেও, ৫০০ টাকা দিচ্ছি!
সামির বলে,
— কি! বাসর গেটে ৫০০ টাকা? হোটেলে খেয়ে এর চেয়ে বেশি টিপস দিস তুই!
মিষ্টি বলে,
— ঠিক আছে, এক লাখ না দিন। নাহলে ঢুকতে দেবো না!
আদ্রিক শান্তভাবে বলে,
— পসিবল না!
ফারিদ আর সামির বলে,
— তাহলে তোর রুমে যাওয়ারও কোনো পসিবিলিটি নেই! ভেবে দেখ! বউ নিয়ে রুমে যেতে পারবি না!
কৌশলী বলে,
— অর্তি, আদ্রিক ব্রোকে বল টাকাটা দিয়ে দিতে। আমরা আমাদের পাওনাটা নিয়ে চলে যাই!
মিষ্টি বলে,

— হ্যাঁ হ্যাঁ! অর্তি বল না!
ফারিদ হেসে বলে,
— অর্তি বোন, তুমি বলে দাও তোমার সদ্য বিয়ে করা শয়তান বরকে আমাদের পাওনা টা দিয়ে দিতে। আমরা যাই রুমে ঘুমাতে, আর তোমরা তোমাদের কাজ করো গিয়ে রুমে!
অর্তিহা প্রচণ্ড লজ্জায় মুখ লাল হয়ে যায়। মুখে কথা আসে না, তবুও আস্তে করে বলে,
— দিয়ে দিন না! যা চাইছে!
আদ্রিক হেসে ফেলে। সবাই একসাথে বলে ওঠে,
— অর্তি বলেছে!
আদ্রিক মুচকি হেসে বলে,
— ওকে, লিটল হার্ট! তুই বলছিস দেখে দিচ্ছি।
কৌশলী অর্তিহাকে টিজ করে বলে,
— বিয়ের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই এতো প্রেম হয়ে গেছে? ডিরেক্ট লিটলহার্ট?
হানিন মুখে কিছুটা হাসি রেখে বলে,
— সত্যিই বিয়ের কয়েক ঘন্টার প্রেম এটা? নাকি আরো আগে থেকেই ছিলো?
আদ্রিক চোখ সরু করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় হানিনের দিকে। মুখে খুশির হাসিটা সরিয়ে ঠোঁটে টেনে আনে বিষমিশ্রিত এক হাসি। হানিনও উত্তরের আশায় তাকিয়ে থাকে। তখনি কৌশলী বলে,

— আদ্রিক ব্রো দ্রুত টাকাটা দাও না!
আদ্রিক হানিনের থেকে চোখ সরিয়ে বলে,
— টাকা রুমে!
ফারিদ বলে,
— ঠিক আছে, আমরা সবাই যাচ্ছি তোর পিছু পিছু!
সবাই আদ্রিকের পিছু পিছু রুমের কাছে আসে।আদ্রিক অর্তিহাকে নিয়ে নিজের রুমে ঢোকে এবং তাকে বিছানায় বসায়। তারপর সাইড টেবিল খুলে এক লাখ টাকার একটা বান্ডিল বের করে তাদের হাতে দেয়।
টাকাটা হাতে নিয়ে ফারিদ বলে,

— আমরা দেখে ১ লাখে সেরে ফেলতে পেরেছিস ব্রো। আদনান থাকলে কম হলেও ৩ লাখ নিতো।
আদনানের কথা শুনে সামিরের মুখ মলিন হয়ে যায়। আদনান সত্যিই খারাপ ছিল, আর তার নজর আগে থেকেই অর্তিহারের দিকে ছিল। সামির এটা জানার পর তাকে বহুবার ওয়ার্নও করেছিল, কিন্তু আদনান বদলায়নি। কিন্তু আদ্রিক শেষপর্যন্ত আদনানের সাথে যা করেছে, তাতে সামিরের অনেক খারাপ লেগেছে। যতই হোক না কেন, বন্ধু ছিলো। তাই খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক কিন্তু তাই বলে যে আদ্রিক পুরোপুরি অন্যায় করেছে তাও না। আর সামির আগে থেকে জানতো না। আদ্রিক তাকে আজ সকালেই জানিয়েছে।
আদ্রিক ফারিদের সে কথায় উত্তর না দিয়ে বলে,

— ১০ সেকেন্ডের মধ্যে রুম খালি কর!
ফারিদ হেসে বলে,
— ওকে ব্রো, অল দা বেস্ট!
বলেই সবাই সেকেন্ডের মধ্যে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।সবাই চলে যেতেই আদ্রিক দরজাটা বন্ধ করে কাভার্ডের দিকে যায়। অর্তিহা একবার তাকায়, তারপর চোখ ফিরিয়ে নেয়। আদ্রিক কাভার্ড খুলে নিচ থেকে তিনটা লাগেজ বের করে এনে বিছানার পাশে রাখে। তারপর একটি লাগেজ অর্তিহার সামনে রেখে চেইন খুলে দেয়।
অর্তিহা চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে। আদ্রিক ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বলে,

— এই তিনটা লাগেজে আছে আমি এখন পর্যন্ত ভ্রমণ করা ৮৪টা দেশ থেকে তোর জন্য আনা ৮৪টা গিফট। প্রতিটা দেশ থেকেই তোর জন্য কিছু না কিছু কিনেছি। এই গিফটগুলো প্রমাণ যে আমার এগারো বছরের পাইলট জীবনে আমি যত দূরেই থাকি না কেন, তোকে কখনো ভুলিনি! তুই ছিলি আমার মনে প্রতিক্ষণ!
অর্তিহা বিস্ময়ে চুপ করে থাকে। আদ্রিক লাগেজ থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট বের করে খুলে ফেলে। ভেতরে সাদা আর লাল পাথরের মিশ্রণে বানানো একটা সুন্দর পায়েল।
আদ্রিক বেডে অর্তিহার সামনে বসে বলে,
— বাম পা টা দে।
অর্তিহা আস্তে করে নিজের বাম পা এগিয়ে দেয়। আদ্রিক ঝুঁকে পায়েলটা অর্তিহার পায়ে পরিয়ে দিয়ে আলতো চুমু খায়। তারপর চোখে চোখ রেখে বলে,

— এখন তুই যখন হাঁটবি, তখন প্রতিটি ধ্বনিতে বাজবে আমার প্রেমের সুর।
অর্তিহা কিছু বলে না। আদ্রিক লাগেজ খুলে একে একে ব্রেসলেট, কানের দুল, ঘড়ি, চুড়ি, কোমরের বিছা, ড্রেস, মেকআপের বিভিন্ন জিনিস বের করে দেখায়। আবার সবকিছু ঠিক করে রেখে দেয়। এভাবে বাকি দুটো লাগেজও খুলে দেখিয়ে আবার গুছিয়ে রাখে।
আদ্রিক বলে,
— কালকে এই লাগেজগুলোর জিনিস ভালো করে দেখে নিস। আজকে অনেক ক্লান্ত তুই।
তারপর উঠে গিয়ে কাভার্ড থেকে ১২–১৩টা শপিং ব্যাগ এনে বিছানায় রাখে। অর্তিহা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। আদ্রিক মুখোমুখি বসে বাঁকা হেসে বলে,
— এতক্ষণ তো ১১ বছরের জমানো গিফট দিলাম, এখন দিচ্ছি আমাদের বিয়ের প্রথম রাতের গিফট। যেটা শুধু রাতেই কাজে লাগবে!
অর্তিহা কৌতুহলী হয়ে বলে,

— কী?
— এখানে আছে ২৩টা নাইটি! এগুলো তোর বাসর রাতের গিফট!
অর্তিহা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। আদ্রিক আবার বলে,
— লজ্জা পেয়ে নে, সমস্যা নেই। কিন্তু পড়তে হবে এগুলো! এগুলো আমি সাজিয়ে রাখার জন্য আনিনি, অর্তিজান। প্রতিদিন একেকটা পরে আমাকে দেখাতে হবে!
অর্তিহা এখনো মাথা নিচু করে থাকে। আদ্রিক তার থুতনির নিচে আঙুল দিয়ে মুখটা উপরে তুলে চোখে চোখ রেখে বলে,
— শুনেছিস আমার কথা? পড়ে দেখাতে হবে!
অর্তিহা চোখ নামিয়ে নেয়। আদ্রিক হেসে ওঠে জোরে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ওয়েস্টকোটের বোতাম খুলতে খুলতে বলে,

— যা, চেঞ্জ করে নে। তারপর ঘুমা। অনেক ধকল গেছে তোর ওপর।
অর্তিহা অবাক হয়। আদ্রিক এমন কথা বলেছে। সেটা তার বিশ্বাস হয় না! বাঘের সামনে মাংস রেখে সে না খাওয়ার কথা বলছে যেন! এতক্ষণ যার ভয় করছিল, সে ই এখন চেঞ্জ করে ঘুমাতে বলছে!
আদ্রিক অর্তিহার মনের কথা বুঝে ফেলে। সে অর্তিহার অবাক মুখ দেখে হেসে বলে,
— যেই সাজ আমার জন্য সাজা হয়নি, সেই সাজ আমি নষ্ট করব না! আজকে তুই ছাড় পাচ্ছিস এই কারণেই। কিন্তু কালকে তুই আবার সাজবি আমার জন্য, আমার বউ হয়ে! লাগেজে একটা ব্রাইডাল গাউন আছে, সেটাই কালকে পরবি। আর আমি তখন নষ্ট করব সেই সাজ!
অর্তিহা আদ্রিকের কথার বিপরীতে কিছু বলে না। অবশ্য বলারই বা কি আছে? আদ্রিক তাকে আদেশ দিয়েছে। আর আদ্রিকের আদেশ অমান্য করার সাহস তাকে দেওয়া হয়নি। আর না আদ্রিকের আদেশে সে খুশি তাই চুপচাপ বসে থাকে। তাকে এভাবে চুপ দেখে আদ্রিক আবার বলে,

— অন্য কারোর জন্য তোর এই সাজ আমার সহ্য হচ্ছে না, বেবিডল। তাই দ্রুত চেঞ্জ করে এই সাজটা মিটিয়ে দে!
অর্তিহা ধীর কন্ঠে বলে,
— এই রুমে তো আমার কোনো কাপড় নেই!
— কাপড় আছে তো লাগেজে, কিন্তু ওগুলো রাতে ঘুমানোর জন্য কমফোর্টেবল না। তাই তুই আমার একটা টি-শার্ট পড়ে নে। আর এমনিতেও তুই তো আগেও আমার শার্ট অনেকবার পরেছিস!
অর্তিহা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আদ্রিক নিজের একটা টি-শার্ট এনে দেয়। অর্তিহা সেটা হাতে নিয়ে বলে,
— এই ভারী গাউন পরে ওয়াশরুমে চেঞ্জ করা সম্ভব না, তাই রুমেই চেঞ্জ করতে হবে।
আদ্রিক বলে,

— ওকে, কর।
অর্তিহা বলে,
— তাহলে আপনি বাইরে যান।
আদ্রিক এগিয়ে এসে অর্তিহার একদম কাছে গিয়ে ঝুঁকে ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে বলে,
— তুই প্রেগন্যান্ট অর্তি। আর সেটা আমিই বানিয়েছি!
অর্তিহা চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
— আমার অস্বস্তি হবে।
আদ্রিক ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি টেনে বলে,
— ঠিক আছে, অফিসিয়াল বাসর করে তোর অস্বস্তি দূর করে দেই?
অর্তিহা দ্রুত বলে উঠে,
— না না!
আদ্রিক ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
— না?
অর্তিহা নরম কিন্তু জোর গলায় বলে,
— না।
আদ্রিক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
— তাহলে আমার সামনেই চেঞ্জ কর!
অর্তিহা একটু থেমে বলে,

— আপনি তো এখনই বললেন যে, আমার সাজ অন্য কারোর জন্য, তাই আপনি সেটা সহ্য করতে পারছেন না! আপনি সেই সাজ নষ্ট করবেন না, তাহলে দেখবেনই বা কেন?
আদ্রিক অর্তিহার কথায় হেসে ফেলে।
— তুই দেখি অর্তি, চালাক হয়ে যাচ্ছিস! আমার কথায় আমাকে আটকে ফেলতে চাস!
অর্তিহা আদ্রিকের থেকে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,
— আপনি কিন্তু আপনার কথা থেকে নড়ছেন!
আদ্রিক হেসে বলে,
— আজকে সুযোগ পেয়েছিস তাই এনজয় নে! কালকে আমি এমনভাবে ধরবো তখন কোনো যুক্তিতেই আমাকে দূরে সরাতে পারবি না!
এই বলে আদ্রিক উল্টো ঘুরে দাঁড়ায়। অর্তিহা তখন উঠে দাঁড়িয়ে পেছনে হাত দিয়ে গাউনের চেইন খুলতে চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবে আদ্রিকের থেকে সাহায্য নিবে কিনা। অনেক ভেবে উপায় না পেয়ে ডাক দেয়,

— আদ্রিক ভাইয়া?
আদ্রিক ঘুরে তাকিয়ে বলে,
— সিরিয়াসলি অর্তি? আদ্রিক ভাইয়া?
অর্তিহা বলে,
— হ্যাঁ, আমার গাউনের চেইনটা খুলে দিন।
আদ্রিক অর্তিহার কাছে গিয়ে চেইনটা খুলে দেয়। তারপর অর্তিহার কাঁধে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে বলে,
— আজকের পর যেন ভাইয়া ডাকটা না শুনি!
আদ্রিকের চুমুতে অর্তিহা কেঁপে ওঠে। আদ্রিক নরম স্বরে আবার প্রশ্ন করে,
— বুঝছিস?
অর্তিহা আস্তে বলে,

— তাহলে কী ডাকবো?
আদ্রিক অর্তিহাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে, অর্তিহার নাকে নিজের নাক ছুঁইয়ে বলে,
— আদ্রিক।
— কিন্তু আপনি তো আমার বয়সে বড়!
— বয়সে বড় হলেও নাম ধরে ডাকলে বিশ্রী লাগবে না। বরং যখন দুই দিন পর আমার সন্তানের সামনে তার বাবাকে ভাইয়া ডাকবি, তখন ও কনফিউজড হয়ে যাবে আমাকে পাপা ডাকবে নাকি মামা। বুঝেছিস, বেবিডল?
অর্তিহা নিচু স্বরে বলে,
— হুম।
— তাহলে এখন থেকে কী ডাকবি?
— আপনার নাম ধরে।
— তো ডাক দে।
অর্তিহা কিছুক্ষণ চুপ থেকে অস্বস্তি নিয়ে আস্তে করে বলে,

— আদ্রিক।
আদ্রিক মৃদু হেসে বলে,
— পার্ফেক্ট, লিটলহার্ট।
— এখন আপনি ঘুরে দাঁড়ান, আমি চেঞ্জ করবো।
আদ্রিক ঘুরে দাঁড়ায়। অর্তিহা দ্রুত কাপড় পাল্টে টি-শার্ট পরে নেয়। এরপর ওয়াশরুমে চলে যায় মেকআপ তুলতে। আদ্রিক পাঞ্জাবি বদলে খালি গায়ে বিছানায় শুয়ে অর্তিহার জন্য অপেক্ষা করে। অর্তিহা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বেডের কাছে আসে, ঠিক তখনি আদ্রিক বলে ওঠে,
— তুই আমার পাশে ঘুমাতে পারবি না!

অর্তিহা থেমে আদ্রিকের দিকে তাকায়। পরমুহূর্তেই ভেতরে ভেতরে ভাবে, ভালোই হলো! কারণ তারও আসলে আদ্রিকের পাশে ঘুমানোর ইচ্ছে নেই। শুধু ভয়ে মানা করতে পারে না। অর্তিহা ভাবে, সে সোফায় ঘুমাবে। তাই হাত বাড়িয়ে বালিশ নিতে যায়, কিন্তু আদ্রিক তার হাত ধরে বলে,
— হয় আমার উপরে ঘুমাবি, নয়তো আমি তোর উপরে। এখন যেহেতু তুই প্রেগন্যান্ট, দ্বিতীয়টা সম্ভব না। কিন্তু প্রথমটা সম্ভব, আর সেটাই হবে।
অর্তিহা চট করে বলে,

— আমি পাশে ঘুমাতে পারবো, আমার অসুবিধা হবে না!
— কিন্তু আমার অসুবিধা হবে! তাই কোনো কথা না বলে চুপচাপ আমার বুকে আয়।
অর্তিহা বাধ্য হয়ে কিছুটা দ্বিধা নিয়ে আদ্রিকের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। আদ্রিক ওকে নিজের সাথে টেনে নেয়। অর্তিহার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে, কারণ আদ্রিক খালি গায়ে। আদ্রিকের শরীরের নেশাময় ঘ্রাণ অর্তিহার নিঃশ্বাসে মিশে যায়, চোখ বন্ধ করতেই সে হারিয়ে যায় আদ্রিকের উষ্ণতায়। আদ্রিক অর্তিহার মাথায় আলতো হাতে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। সারাদিনের ক্লান্তি এবং মাথায় আদ্রিকের আদুরে হাত বুলানোর ফলে অর্তিহা ঘুমিয়ে যায়।
অর্তিহাকে ঘুমিয়ে যেতে দেখে আদ্রিক ওর মাথাটা নিজের হাতে রেখে পাশে হয়ে শুইয়, তারপর অর্তিহার গালে হাত রেখে গভীর চোখে তাকিয়ে ধীর গলায় বলে,

— আজ আমাদের অফিসিয়াল ফার্স্ট নাইট। আমার খুব ইচ্ছে ছিল, বিয়ের পর তুই যখন প্রথমবার আমার রুমে আসবি, তখন তোকে রানির মতো করে স্বাগত জানাবো। সবাই দেখবে, আমার অর্তিজান আমার কত প্রিয়! কত আদরের, যত্নের। চেয়েছিলাম আমাদের প্রথম রাতটা হবে অনেক স্পেশাল ভাবে। তুই লজ্জা পেয়ে অপেক্ষা করবি আমার আর আমি তোর লজ্জা ভাঙাবো। কিন্তু কিছুই হলো না! আমার সেই স্বপ্ন, সেই ইচ্ছে সব ভেঙে গেল।
তখনি আদ্রিকের ফোনে কল আসে। সে তাড়াতাড়ি ফোনটা সাইলেন্ট করে ফেলে, যাতে অর্তিহার ঘুম না ভাঙে। সাইলেন্ট করার পর স্ক্রিনে চোখ পড়তেই দেখে, আনসেভ করা একটা নাম্বার। কিন্তু নাম্বারটা চেনা। বহুবারই কল এসেছে এই নাম্বার টা থেকে তার ফোনে। ফোনটা হাতে নিয়ে রিং বাজতে থাকা দেখতে থাকে আদ্রিক। কিছুক্ষণ পর রিং থেমে যায়, আবারও কল আসে। কয়েক সেকেন্ড পর সে কলটা রিসিভ করে কানে লাগাতেই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে কান্নায় ভেজা শায়রার কণ্ঠ,

— আদ্রিক, আমার কষ্ট হচ্ছে! অনেক কষ্ট হচ্ছে! তুমি কোথায় আদ্রিক?
আদ্রিক নিচু গলায় স্বাভাবিক কন্ঠে প্রশ্ন করে,
— সদ্য বিয়ে হওয়া স্বামী কোথায় থাকবে?
শায়রা আবার কেঁদে বলে,
— কোথায় তুমি আদ্রিক? তোমার রুমে?
আদ্রিক আগের মতোই স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
— অর্তির বুকে।
শায়রা কান্নায় ভেঙে পড়ে,
— আদ্রিক, কেন আমাকে কষ্ট দিচ্ছো? এসব কথা কেন বলছো? তুমি জানো না, তোমাকে অন্য কারও সাথে আমি সহ্য করতে পারি না! তবে কেন এসব বলে আমাকে কষ্ট দিচ্ছো?
আদ্রিক ঠান্ডা গলায় বলে,

— তুই ই তো জানতে চেয়েছিস!
শায়রা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
— আমি তোমাকে ভালোবাসি! আর ভালোবাসা তো দোষের না! তাহলে সেই ভালোবাসার শাস্তি কেন দিচ্ছো আমাকে? তুমি অর্তিহাকে ছেড়ে আমার কাছে এসে পড়ো না আদ্রিক! প্লিজ, এসে পড়ো!
আদ্রিক ঠোঁটে হালকা হাসি নিয়ে বলে,
— আমি অর্তিকে স্পর্শ করলে তোর কষ্ট হবে?
শায়রা হুহু করে কেঁদে বলে,
— ভীষণ!
শায়রার কথায় আদ্রিক অভ্যাসগত হাসিটা ঠোঁটের কোনে টেনে,

— আমি অর্তিকে আদর করছি! শুনবি আমার আদরে অর্তির পাগলামো?
বলেই সে ফোনটা অর্তিহার মুখের কাছে নেয় এবং মুখে আস্তে করে ফুঁ দেয়। অর্তিহা ঘুমের মধ্যে চোখ-মুখ কুঁচকে বলে,
— উমমমম! কি করছেন!
আদ্রিক ফোনটা আবার কানে নিয়ে বলে,
— শুনেছিস? অনেক আদর করছি অর্তিকে। তাই আমাদের ডিস্টার্ব করিস না!
শায়রা অসহায়ের মতো করে বলে,

— না আদ্রিক! প্লিজ শুনো? প্লিজ আদ্রিক….
আর বলতে দেয় না আদ্রিক। কলটা কেটে দেয়। কল কাটা শেষে হেসে ফেলে। তারপর মিরাজকে মেসেজ পাঠায়,
— লেট হিম গো!
মেসেজ পাঠানো শেষ করে ফোনটা রেখে অর্তিহার মাথাটা আস্তে করে বালিশে রাখে, তাকে ভালোভাবে শুইয়ে দেয়। তারপর অর্তিহার হাতটা নিয়ে নিজের বুকেী কাছে এনে, আর অর্তিহার নখ দিয়ে নিজের বুকে গভীরভাবে আঁচড় কাটে কয়েকটা। তারপর গায়ে একটা শার্ট জড়িয়ে নেয়, কিন্তু বোতাম লাগায় না, বুকটা খোলা রাখে।
রুম থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে আসে। নিচে এসে চারপাশে তাকায়, কেউ জেগে আছে কিনা। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ, সবাই ঘুমিয়ে আছে। সে এগিয়ে গিয়ে মেইন ডোর খুলতেই দেখতে পায় সাইহানকে। সাইহান দরজায় ধাক্কা দেওয়ার জন্য হাত উঠিয়ে ছিলো, কিন্তু তার আগেই আদ্রিক দরজা খুলে দেয়। সাইহানের গায়ে এখনো সেই বরের পোশাক, কিন্তু তাকে ভীষণ বিধ্বস্ত লাগছে। চোখে জল, চুল এলোমেলো, মুখে ক্লান্তির ছাপ। আদ্রিকের ঠোঁটে অভ্যাসগত এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।
সাইহান আদ্রিককে দেখে রাগে ফেটে পড়ে,

— অর্তিহা কোথায়?
আদ্রিক ঠাট্টার সুরে বলে,
— তোদের ভাইবোন দুজনেরই কমনসেন্সের অভাব! একজন ফোন করে কান্না করে, আরেকজন বাড়িতে এসে চিৎকার করে, অর্তিহা কোথায়! অর্তি কোথায় থাকবে? অফকোর্স বাসর ঘরে!
সাইহান গর্জে ওঠে,
— ডেকে দে! আমার কথা আছে ওর সাথে!
আদ্রিক শান্তভাবে বলে,
— ও অনেক ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে! বেশ ক্লান্ত! ফার্স্ট নাইট বলে কথা!
শেষের কথাটা আদ্রিক বাঁকা হেসে বলে। সাইহান রেগে বলে,
— ওকে ডেকে দে! আমি ওর সাথে কথা বলবো! অর্তিহা? অর্তিহা?
আদ্রিক বিরক্ত সুরে বলে,

— ইশশ! আস্তে! বলেছি না, অর্তি ঘুমাচ্ছে!
সাইহান এবার আঙুল তুলে বলে,
— তুই করেছিস না আমায় কিডন্যাপ? বল!
আদ্রিক ঠোঁটে হাসি টেনে বলে,
— কেমন লাগলো আমার তরফ থেকে দেওয়া আদরটা?
সাইহান দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— তোর মতো খারাপ, জঘন্য মানুষ আমি জীবনে দেখিনি!
আদ্রিক ঠান্ডা স্বরে বলে,

— সালার দুঃখ! আমার উপকার, যত্ন, আদর কেউ দেখে না! যতই করি না কেন মানুষের জন্য, কেউ স্বীকার করে না! কেউ মনে রাখে না! ভাবলে খুব কষ্ট লাগে!
সাইহান রেগে বলে,
— নাটক বন্ধ কর!
আদ্রিক শান্তভাবে বলে,
— কাউকে কষ্টের কথা বললেও ভাবে নাটক করছি! এই দেখ, এখনোও নিজের কথা ভাবিনি! তোর যাতে অপেক্ষা না করতে হয়, তাই বাসর রাতে বউয়ের কাছ থেকে উঠে এসেছি। শুধু তোর কষ্ট হালকা করার জন্য! তাও তুই বুঝলি না!
সাইহান রাগে ফেটে পড়ে, এগিয়ে এসে আদ্রিকের শার্টের কলার চেপে ধরে বলে,
— তোকে আমি মেরে ফেলবো!
আদ্রিক ধীরে কলার ছাড়িয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,
— আগে তুই নিজে বাঁচ!
আদ্রিক থেমে আবার বলে,

— তোর এখনো আমার কলার ধরার যোগ্যতা হয়নি! টাকা হলেই যে আদ্রিক কারদারের বরাবর দাঁড়াতে পারবি এমন না বিষয় টা! পার্সোনালিটির ব্যাপার আছে!
সাইহান চোখে জল নিয়ে বলে,
— আজকে আমি যে কষ্টটা পেয়েছি…
আদ্রিক দুঃখ পাওয়ার ভান করে বলে,
— ইশশ! দুঃখের সাগরের একমাত্র মাঝি সাইহান ইরতিশাম রেজা! ভাবতেই কান্না পাচ্ছে!
এবার আদ্রিক বাঁকা হেসে বলে,
— কিন্তু একটু আগের পাওয়া সুখের কারণে কান্না আসছে না আমার!
বলেই আদ্রিক ইচ্ছে করে নিজের শার্টের দুইটা বোতাম লাগায়। যাতে বুকের আঁচড়গুলো সাইহানের চোখে পড়ে। আদ্রিকের পরিকল্পনা সফল হয়। সাইহান সেই আঁচড়গুলো দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না আঁচড় গুলো কিসের! সাইহান কষ্টে চোখ ফিরিয়ে নেয়।
আদ্রিক হেসে বলে,

— তোকে একটা এডভাইস দেই! যদি জীবনে দ্বিতীয়বার কাউকে ভালোবাসিস, তাহলে তাকে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিস না! জোর করে ছিনিয়ে নিবি, তবেই পাবি! আর হ্যাঁ, দ্রুত করিস কাজটা, কারণ তোর হাতে সময় কম!
সাইহান দাঁত চেপে বলে,
— দেখা যাবে সময় কার কাছে থাকে না!
আদ্রিক স্বভাবগত হাসিটা ঠোঁটের কোনে টেনে বলে,
— ওকে! আমি দেখিয়ে দেবো! অনেক বকবক করেছিস, এখন যা! সারারাত এখানে কাটাতে পারবো না। বউ আমার রুমে অপেক্ষা করছে!
সাইহান আঙুল উঁচিয়ে বলে,
— ভাবিস না ভুলে যাবো, তোকে ছেড়ে দেবো!
বলেই ঘুরে চলে যেতে নিলে পিছন থেকে আদ্রিক বলে ওঠে,
— কালকে আরেকটা গিফট দিবো! রেডি থাকিস, কারদার বাড়ির জামাই হতে না পারা এক হতভাগা কাপুরুষ!
সাইহান দাঁতে দাঁত চেপে আদ্রিকের কথা গিলে নেয়। ছন্নছাড়া পায়ে, ভেঙে পড়া মন নিয়ে চলে যায়। আদ্রিক নিঃশব্দে দরজাটা বন্ধ করে, পা বাড়ায় নিজের রুমের দিকে।

অন্ধকার রুমে ড্রিম লাইট জ্বলছে। হালকা নীল আলো চারপাশে ছড়িয়ে দিয়েছে। রুমের সবকিছু এলোমেলো। জিনিসপত্র মাটিতে পড়ে আছে। কাচের জিনিস ভেঙে ছড়িয়ে, টুকরো টুকরো। বিয়েতে পড়া সাদা সাড়াড়া পড়ে শায়রা মাটিতে শুয়ে আছে। গায়ের দোপাট্টা টা দূর পড়ে আছে। ডান হাতে মাথা রেখে, বাম হাতে ছবির ফ্রেম ধরে তাকিয়ে আছে শায়রা। ডান হাত থেকে রক্ত পড়ছে, কিন্তু সে তাতে কোনো ভাবান্তর দেখাচ্ছে না। চোখে জল, কিন্তু দৃষ্টি পুরো ফ্রেমে। ফ্রেমে দেখা যাচ্ছে আদ্রিকের তুর্কির ক্লাবের সোফায় বসা ছবি, যেটা শায়রা নিজে তুলেছিল।
শায়রা ডান হাতে ছবির ওপরে হালকা ছুঁইয়ে বলে,

— কেন আদ্রিক? কেন এমন করলে? আমাকে তোমার বানালে না কেন? কি আছে অর্তিহার মাঝে, যা আমার মধ্যে দেখলে না? এতো ভালোবাসার পরেও আমার হলে না কেন? আমি তো তোমার কাছে পানি হয়ে থাকতে চেয়েছিলাম, যেমন আকৃতি দিতে, তেমনই হতাম! তবু তুমি কাছে এলে না, কষ্ট দিলে।
আর আমি, পাষাণ তোমায় ভালোবেসেই গেলাম।
তিন বছর আগে আমায় তোমার মাঝে বন্দি করেছিলে, কিন্তু মুক্তিও দিলে না, ভালোবাসাও না।
বলো আদ্রিক, আমার অপরাধটা কি ছিল?

শায়রার চোখে ভেসে ওঠে সেই তিন বছর আগের দিন। যেদিন শায়রা আর আদ্রিকের প্রথম দেখা হয়েছিল। সেদিন ছিল ১৮ই মার্চ। শায়রা পড়াশোনার জন্য লন্ডনে থাকতো, মামার বাসায়। রোজ ক্লাবে যাতায়াত থাকতো, পড়াশোনা কম, পার্টি বেশি।সেদিনও সে লন্ডনের এক আভিজাত্য ক্লাবে গিয়েছিল। ক্লাবটি ছিলো বিশাল বড়। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ রঙের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। চারদিকে ডিজে বাজাচ্ছিলো জোরে জোরে ইলেকট্রনিক বিট। ছেলেমেয়েরা একসাথে নাচছে। বার কাউন্টারে ককটেল সাজানো, ওয়াইন ও স্পার্কলিং ড্রিঙ্কস ঝলমল করছে।
শায়রাও তার ফ্রেন্ডদের সাথে ডান্স করছে। তখনি লাম্মি কানে ফিসফিস করে,

— শায়রা, পার্টিতে একটা হ্যান্ডসাম ছেলে আছে। অনেক হট। আর এটিটিউটের কথা কী বলবো? কোনো মেয়েকে পাত্তা দিচ্ছে না।
শায়রা তেমন গুরুত্ব দেয় না লাম্মির কথায়। সে হেসে বলে,
— আমার মতো সুন্দরী কেউ তার কাছে এখনো যায়নি দেখে ইগনোর করছে! আমাকে দেখে লাট্টু হয়ে যাবে!
রুশা বলে,
— না রে, দোস্ত! এই ছেলে এমন না! এর আলাদা ধাঁচ। কোনো মেয়ের দিকে তাকাচ্ছে না। ছেলেটা দেখতে কি যে সুন্দর! আমি আর রুশা তো ক্রাস খেয়েছি!
শায়রা হেসে বলে,
— চল!
লাম্মি প্রশ্ন করে,

— কোথায়?
— তোদের ঐ হ্যান্ডসাম যে কোনো মেয়ের দিকে তাকায় না, তাকে আমার প্রেমে ফেলতে! দেখি আমাকে দেখেও কিভাবে ইগনোর করে!
বলেই তারা ডান্স ফ্লোর থেকে চলে লাম্মির সাথে যেতে থাকে। লাম্মি কাঙ্খিত জায়গায় এসে থামে, সাথে শায়রা আর রুশাও।
লাম্মি আঙুল তুলে ছেলেটাকে দেখিয়ে বলে,
— ঐ হোয়াইট শার্টের উপর ব্ল্যাক জেকেট পড়া, হাতে ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে সোফায় বসা ছেলেটার কথাই বলছি।
শায়রা তাকায়, ছেলেটার চেহারা দেখা যাচ্ছে না, পাশ থেকে কথা বলছে। শায়রা হেসে লাম্মিকে চোখ মেরে বলে,
— চল, কাছে গিয়ে ছেলেটাকে একটু বেসামাল করি!
রুশা ব্যাঙ্গ করে বলে,
— দোস্ত, তুই নিজেই না আবার বেসামাল হয়ে যাস ছেলেটাকে দেখার পর!
শায়রা কোনো উত্তর দেয় না। এগিয়ে গিয়ে ছেলেটাকে ডাক দেয়,
— এক্সকিউজ মি?
ছেলেটা ঘুরে তাকায়,
— ইয়েস?

ছেলেটার কথা শুনেও উত্তর দিতে পারে না শায়রা। তার দৃষ্টি আটকে যায় ছেলেটির নীল চোখে। সমুদ্রের মতো গভীর ও মায়াময় সেই চোখে হারিয়ে যায় শায়রা মুহুর্তেই।
আদ্রিক ওর ফ্রেন্ডদের সাথে বসে ওয়াইন খাচ্ছে। দুবাই থেকে লন্ডনের ফ্লাইট ছিল। গতকালই লন্ডনে এসেছে, লং রুটের জন্য আজ একদিনের রেস্ট। কাল আবার ওর ফ্লাইট আছে। ফারিদ আর সামিরও লন্ডনে থাকায় আজ হোটেলে না থেকে ওদের সাথে ক্লাবে বেরিয়েছে একটু রিল্যাক্স করতে।
হঠাৎ একটা মেয়ের ডাক শুনে তাকায়। কিন্তু মেয়েটাকে তার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করে,
— ইউ ওকে?

শায়রা আদ্রিকের কথায় নিজেকে সামলে হেসে বলে,
— ইয়াহ, আই’ম ওকে!
থেমে চোখে প্রশ্ন নিয়ে আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে বলে,
— বাট আর ইউ ওকে?
আদ্রিক হেসে বলে,
— আই’ম টোটালি ফাইন মিস!
শায়রা মুচকি হেসে বলে,
— রিয়ালি? ইভেন আফটার সিয়িং মি?
আদ্রিক এক ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
— হোয়াই? ডিড ইউ এক্সপেক্ট মি নট টু বি?
শায়রা হেসে আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলে,
— ইয়াহ। বিকজ নো গাই হ্যাজ এভার বিন ওকে আফটার সিয়িং মি!
আদ্রিক চুপ করে তাকিয়ে থাকে শায়রার দিকে।
শায়রা হেসে আবার বলে,

— বাই দা ওয়ে! আই’ম শায়রা! ইউর নেম?
আদ্রিক উত্তর দেয়,
— আদ্রিক।
— হোয়্যার আর ইউ ফ্রম?
— বাংলাদেশ।
রুশা হেসে বলে উঠে,
— দেটস সো নাইস! উই আর অলসো বাংলাদেশী!
শায়রা মুচকি হেসে আদ্রিকের কাছে গিয়ে আদ্রিকের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে,
— সিরিয়াসলি আমাকে দেখার পরও আমার প্রেমে পড়োনি?
আদ্রিক ঠোঁটের কোনে হালকা হাসি টেনে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,

— না।
— আমার প্রেমে না পড়ার কারণ?
আদ্রিক ওয়াইনের গ্লাসটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে, পকেটে দুই হাত গুঁজে শায়রার চোখে চোখ রেখে অভ্যাসগত হাসিটা ঠোঁটের কোনে রেখে বলে,
— আমি যারতার প্রেমে পড়ি না! আমি যার ‘তার’ প্রেমেই পড়ি!
বলেই ঘুরে ফারিদ ও সামিরকে বলে,
— বাই!
বলেই ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। শায়রা আদ্রিকের চলে যাওয়া দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,
— ইয়াহ! তুমি আমার প্রেমে পড়বে! বিকজ আজকে থেকে তুমি আমার! আর এই শায়রা ইশরার রেজা শুধুই তোমার, আদ্রিক! শুধুই তোমার বেবি!
সেদিনের পর থেকেই শায়রা আদ্রিকের পিছু নেয়। তার সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়। জানতে পারে আদ্রিক তার ফুপির দেবরের ছেলে, অর্থাৎ তাদের শত্রু। তাতেও শায়রা থামেনি। কারণ তার পাগলামি শত্রুতার চেয়েও বড়। শায়রার দিন দুনিয়া শুধুই আদ্রিক।
দরজা থাক্কায় শায়রার হুস আসে। সে মাথা তুলে দরজার দিকে তাকায়। আবার দরজায় ধক ধক শব্দ হয়, ভেসে আসে অঞ্জনা রহমানের কণ্ঠ,

— শায়রা মা, আমার দরজা খোল! প্লিজ মা! আমাদের খুব চিন্তা হচ্ছে তোমাদের জন্য! তুমি এভাবে দরজা লাগিয়ে রেখেছো! ঐদিকে তোমার ভাইয়েরও সেই একই অবস্থা!
শায়রা উঠে বসে, হাতে থাকা ছবির ফ্রেমটা বেডে রেখে দাঁড়ায়। তারপর এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে। অঞ্জনা রহমান শায়রাকে দেখে খুশি হয়ে গালে হাত রেখে বলেন,
— দরজা খুলেছো মা? তোমার জন্য কত চিন্তা হচ্ছ…
শায়রা অগ্নি চোখে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে প্রশ্ন করে,
— তোমার ছেলে এসেছে?
অঞ্জনা রহমান হতবাক হয়ে বলেন,

— কি?
শায়রা অগ্নি চোখে তাকিয়ে কঠিন স্বরে জোরে বলে,
— বলেছি তোমার ঐ কাপুরুষ ছেলে এসেছে?
অঞ্জনা রহমান শক্ত কন্ঠে বলেন,
— শায়রা! তোমার বড় ভাই হয়!
— বড় ভাই মাই ফুট! যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটার উত্তর দাও!
— হ্যা, এসেছে, একটু আগেই!
— সরো!
শায়রা তার অঞ্জনা রহমানকে হাত দিয়ে সরিয়ে, দ্রুত গতিতে করিডোর দিয়ে হেঁটে এসে সাইহানের দরজার সামনে গিয়ে জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিতে থাকে। রাগে ক্ষোভে সে এতোটাই জোরে ধাক্কা দিচ্ছে যেন মনে হচ্ছে দরজাটাই ভেঙে ফেলতে চায়। এরমধ্যে শায়রার জোরে ধাক্কা দেওয়ার কারণে সারফারাজ আর সায়রও এসে উপস্থিত হয় সেখানে।
সারফারাজ উদ্বীগ্ন হয়ে বলেন,

— কি করছো? এভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছো কেন?
শায়রা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,
— তোমার কাপুরুষ ছেলেটাকে বলো দরজা খুলতে, নয়ত আমি দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকব!
সারফারাজ বিস্মিত হয়ে বলেন,
— পাগল হয়ে গেলে নাকি?
শায়রা সারফারাজের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে,
— হ্যা, পাগল হয়েই গেছি আমি! আমার ভালোবাসা, আমার আদ্রিক, ঐ অর্তিহার হয়ে গেছে! সে অর্তিহার নামে কবুল পড়েছে! তাকে অর্তিহা কেড়ে নিয়েছে! আর আমি সুস্থ থাকবো? হ্যা, আমি পাগল হয়ে গেছি!
ঠিক তখনি দরজা খুলে সাইহান। শায়রা তাকে দেখেই জোরে ধাক্কা মারে, সাইহান পিছিয়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে। শায়রা রুমের ভেতরে ঢুকে রেগে জোরে বলে,

— কোথায় ছিলে? উত্তর দাও?
সাইহান উত্তর দেয় না, মাটিতে বসে থাকে। শায়রা চেঁচিয়ে বলে,
— কি হলো? কথা কানে যাচ্ছে না? কোথায় ছিলে? কোন গর্তে লুকিয়ে ছিলে?
সাইহান ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে ধীরে এলোমেলো ভাবে বলে,
— গ্যারেজে!
শায়রা থেমে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলে,
— কোথায়?
— আদ্রিক আমাকে কিডন্যাপ করে কারদারের গ্যারেজে আটকে রেখেছিলো!
শায়রা তালি দিয়ে বলে,
— ওয়াও! তা তুমি না বলেছিলে আদ্রিক অর্তিহাকে কিডন্যাপ করে ফেলবে? সিকিউরিটিও রেখেছিলে! তাহলে এখন উল্টো হলো কেন?
সাইহান আগের মতোই এলোমেলো ভাবে উত্তর দেয়,

— হ্যা, আমি তো মনে করেছিলাম আদ্রিক অর্তিহাকে কিডন্যাপ করে ফেলবে! কিন্তু আমার মাথায় একবারও আসেনি যে আদ্রিক আমাকেই কিডন্যাপ করে ফেলবে!
শায়রা জোরে, পাগলের মতো হাসতে থাকে। কিছুক্ষণ হাসার পর বলে,
— এটাই আদ্রিক! ওর মতো ব্রেইন তোমার হয়নি! ও তোমার মতো হাজারটাকে একসাথে ঘোল খাইয়ে দেবে! ওর চাল সম্পর্কে কেউ কোনো ধারণা করতে পারে না! যা মানুষের চিন্তা কল্পনার বাইরে সেটাই আদ্রিকের কাজ! এই জন্যই তো ও আদ্রিক কারদার!
শায়রা থামে। হঠাৎ একটা সো পিচ তুলে ফ্লোরে জোরে ছুঁড়ে মেরে হুংকার করে বলে,
— আর আমি সেই আদ্রিক কারদারকেই তোমার জন্য হারিয়ে ফেললাম! আজকে তাকে অন্য একটা মেয়ের সাথে দেখতে হয়েছে! শুধুমাত্র তোমার জন্য!
সায়র আর সারফারাজ দ্রুত এসে শায়রাকে ধরে আটকাতে চায়। শায়রা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে,

— ছাড়ো আমাকে! আজকে ওকে আমি মেরেই ফেলবো! ওর জন্য! শুধুমাত্র ওর জন্য আজকে আমি আমার আদ্রিককে হারিয়ে ফেললাম!
সায়র শায়রাকে ধরে বলে,
— শায়রা, প্লিজ শান্ত হো!
শায়রা চেঁচিয়ে বলে,
— শান্ত হবো না আমি! আগে তোর ভাইকে বিষ এনে দে! এ বেঁচে থেকে কি করবে? ভালো হয়েছে, এর সাথে অর্তিহার বিয়ে হয়নি! মেয়েরা এমন কাপুরুষদের লাইফ পার্টনার হিসেবে চায় না!
সারফারাজ দৃঢ় গলায় চোখ রাঙিয়ে বলেন,
— শায়রা, শান্ত হও! বেয়াদবি করছো কিন্তু!
সবাই মিলে শায়রাকে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করে। আর সাইহান এখনো মাটিতে পড়ে আছে। সাইহান চোখ বন্ধ করে চোখের জল ফেলে। শায়রার কথায় তার একটুও রাগ হচ্ছে না। সত্যিই আজকের সব হয়েছে তার বোকামির কারণে। আজকের কারণে চিরতরে সে অর্তিহাকে হারিয়েছে, আর শায়রা আদ্রিককে। যদি আজ সে একটু সাবধান থাকতো, তাহলে এমন হতো না।

মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৯

সায়র আর সারফারাজ শায়রাকে ধরে সাইহানের রুম থেকে নিয়ে চলে যায়। অঞ্জনা এসে মাটিতে বসে সাইহানের মাথায় হাত রাখে। সাইহান তাকায় অঞ্জনার দিকে, তারপর জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে,
— মা, আজকে আমার সব শেষ হয়ে গেছে! সব শেষ হয়ে গেছে! আমার ভালোবাসা অন্যকারোর হয়ে গেছে! শায়রা ঠিকই বলেছে, আমি কাপুরুষ! আমি পারিনি আমার ভালোবাসাকে নিজের করতে!

মোহশৃঙ্খল পর্ব ২০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here