মোহশৃঙ্খল পর্ব ৪

মোহশৃঙ্খল পর্ব ৪
মাহা আয়মাত

সূর্যের নরম আলো জানালার ফাঁক গলে এসে পড়েছে বিছানার ধবধবে সাদা চাদরে। ঘড়ির কাঁটা নির্ভার ভঙ্গিতে নয়টা পেরিয়ে দশের দিকে এগোচ্ছে। ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে ধীরে ধীরে চোখ মেলে অর্তিহা। ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি এক ধূসর বোধ জমে আছে তার চোখের পাতায়। শরীর নড়তেই কাঁপুনির মতো ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে। সে ব্যথা চেনা, পুরনো। দাঁতে দাঁত চেপে গিলে নেয়—একটুও শব্দ করেনা।
চোখ পড়ে তার পরনে থাকা পুরুষদের একটি সাদা শার্টে—যেটা আদ্রিকের। বুকের কাছে খানিকটা খোলা, আর হাতাগুলো তার পাতলা হাতে ঝুলে আছে। যেন এই শার্টটুকুই একমাত্র ঢাকনা হয়ে জেগে আছে তার ভাঙা শরীরের ওপরে।

ধীরে ধীরে বিছানা থেকে পা নামায় অর্তিহা। মেঝের মার্বেলটা ঠান্ডা। নিচে ছড়িয়ে থাকা নিজের কাপড়গুলো কুড়িয়ে তোলে একে একে—নতুন কিছু না, বরং খুব চেনা দৃশ্য। প্রতিবারই এমন হয়। আদ্রিক আসে রাতের নিঃশব্দতার সঙ্গে, যেন কোনও গোপন অপরাধ নয়, বরং একধরনের অধিকার নিয়ে। নিজের চাওয়া মিটিয়ে, শব্দহীন ভাবে চলে যায় সূর্য ওঠার আগেই। কিন্তু কখনোই তাকে নগ্ন রেখে যায় না। যাবার আগে নিজের শার্টটা তার গায়ে পরিয়ে দেয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অর্তিহা নিঃশব্দে কাপড় তুলে কাভার্ডের দিকে এগোয়। বের করে কুর্তি আর জিন্স। তারপর দরজা আটকে ঢুকে পড়ে ওয়াশরুমে। শাওয়ারের নিচে প্রায় ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে দেয়। পানির ফোঁটাগুলো ঠিকই ঝরে পড়ছিল গায়ে, কিন্তু তার মন যেন স্থবির হয়ে গিয়েছে—একটা নিস্তরঙ্গ নদী, যেখানে না আছে ঢেউ, না আছে শব্দ।
শাওয়ার শেষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে তাকায় নিজ চোখে। সেখানেও যেন কোনো আলোর ঝলক নেই—চোখ দুটি নিস্পন্দ, পাথরের মতো। ঠোঁটে হাসি নেই। থাকার কথা না। আজ এইচএসসি রেজাল্ট দিবে—জানেও। তবু কোনো উত্তেজনা নেই। যে জীবনে প্রতিটি দিন একেকটা বোঝা, সেখানে একটা নম্বর দিয়ে আসলে কীই-বা বদলায়?

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে অর্তিহা। মেঝের ওপর তার পায়ের ছাপ পড়ে না, শব্দ হয় না। লিভিং রুমে ঢুকতেই চোখে পড়ে—সবাই সেখানে। শুধু একজন নেই—আদ্রিক। আরভিদ তাকে ডাক দেয়। পাশে বসায়। তার একপাশে মেহজা বসে আছে, রেশমি মেজেন্টা শাড়িতে আবৃত। ঘরজুড়ে এক ধরনের অপেক্ষার হাওয়া।
আরভিদ স্নেহভরে অর্তিহার মাথায় হাত রেখে বলে,
— চিন্তা করার কিছুই নেই রেজাল্ট অবশ্যই ভালো হবে।
আরভিদ আবার ফোনের সার্ভারে চেক করে। এবার রেজাল্ট শো করল। সে বলে,
— রেজাল্ট চলে এসেছে।
আভীর কারদার কিছুটা উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
— রেজাল্ট কী?
আরভিদ ঠান্ডা গলায় জানায়,
— ৪.১৭।

ঘরে এক মুহূর্তের নিঃশব্দতা। যেন সকলে অপেক্ষা করছিল অর্তিহার প্রতিক্রিয়ার জন্য। কেউ ভেবেছে হয়তো কাঁদবে, কেউ হয়তো আফসোস করবে। কিন্তু অর্তিহা স্থির। চোখে অনুতাপ নেই, নেই উত্তেজনার কোনো রেখাও।
আরভিদ আবার মাথায় হাত রেখে বলে,
— মন খারাপ করিস না। এই রেজাল্ট তোর জীবন ঠিক করে দেবে না।
আভীর কারদার হালকা গলায় বলেন,
— আরভিদ একদম ঠিক বলেছে। প্রিন্সেস, তুমি কষ্ট পাবে না, আমরা আছি তোমার পাশে।
সেই মুহূর্তে নাজনীন কারদার উঠে দাঁড়ান। তার গলায় দৃঢ়তা, আবার স্নেহে ভরা কোমলতা।
— কষ্ট পাবে কেন? এই রেজাল্ট কি কম কিছু? অসুস্থ অবস্থায় পরীক্ষায় বসে ৪.১৭ পাওয়া কোনো সাধারণ কথা নয়। বরং অনেক ভালো রেজাল্ট করেছে আমাদের অর্তি!
তিনি মেইডকে ডাকেন,

— যাও, মিষ্টি নিয়ে এসো। আজ আমাদের সেলিব্রেশন।
ঘরে হালকা হাসির রেশ পড়ে। পরিবেশটা বদলে যায় এক মুহূর্তেই। মেইড মিষ্টির বক্স নিয়ে আসে। নাজনীন সবাইকে মিষ্টি দিতে থাকেন। শেষে অর্তিহার সামনে এসে দাঁড়ান। অর্তিহা উঠে দাঁড়ায়। চোখে এক ঝলক অনুভূতির ঝিলিক। নাজনীন মিষ্টি বাড়িয়ে দেন। অর্তিহা হালকা কামড় দিয়ে সেটাকে হাতে নেয়।
তারপর হঠাৎ করেই নাজনীনকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— মিমি… থ্যাংকস, সবসময় আমার পাশে থাকার জন্য।
নাজনীন হেসে বলেন,
— আমার মেয়ের পাশে আমি থাকবো না? তুমি তো আমার সবচেয়ে আদরের।
ঠিক তখনই সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে আদ্রিক। ধীরে পা ফেলে লিভিং রুমে এসে দাঁড়ায় অর্তিহার পাশে। পকেটে হাত গুঁজে প্রশ্ন করে,

— কি হয়েছে?
নাজনীন মুখে হাসি নিয়ে বলেন,
— অর্তি ৪.১৭ পেয়েছে! এই নাও, মিষ্টি খাও।
মিষ্টির প্যাকেট আদ্রিকের দিকে বাড়িয়ে দেন। আদ্রিক হালকা গলায় বলে,
— উঁহু, আমার লাগবে না। আমি বরং অর্তির টার থেকেই একটু খেয়ে নিচ্ছি।
তারপর ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির রেখা টেনে অর্তিহাকে বলে,
— দে?
অর্তিহা একটু হকচকিয়ে যায়, কিন্তু কিছু না বলে নিজের কামড় দেওয়া মিষ্টিটা আদ্রিকের সামনে ধরে। আদ্রিক সেটায় কামড় দেয়। অর্তিহা তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয়—সামনের দিকে চেয়ে থাকে।
চারপাশে সবার কথাবার্তায় হালকা কোলাহল, সেই সুযোগেই আদ্রিক চুপিসারে একটু ঝুঁকে আসে তার কাছে। কানের পাশে ঠোঁট রেখে দুষ্টু এক হাসি মুখে ফিসফিসিয়ে গেয়ে ওঠে,

— “Jo mithai ek rupiyaa tumne munh laga ke,
Mujhko di to laakh rupiyaa…“
অর্তিহা চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়—কেউ দেখেছে কি? মুহূর্তেই দৃষ্টি আটকে যায় মেহজার চোখে। সে কৌতূহল ভরে তাকিয়ে আছে তাদের দিকেই। পরিস্থিতি সামাল দিতে অর্তিহা দ্রুত বলে ওঠে,
— আমি রুমে যাচ্ছি।
কোনো জবাবের অপেক্ষা না করে সে তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় উপরে। তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আদ্রিক ঠোঁটের কোণে লুকিয়ে রাখে এক মুচকি হাসি—সবার চোখের আড়ালে। এরপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সোফায় গিয়ে বসে, আলাপে যোগ দেয় বাকিদের সাথে। কিন্তু মেহজা চুপচাপ তাকিয়ে থাকে তার দিকেই, চোখে জমে ওঠে সন্দেহের এক গভীর রেখা।

কেবিনজুড়ে নেমে আছে নিস্তব্ধতা। এসির ঠান্ডা বাতাস দেয়াল বেয়ে ঘুরছে, আর তার শীতলতায় যেন সময়টাও থেমে আছে। রুমের মাঝখানে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন ড. সাইহান ইরতিশাম রেজা—বিশ্বের শীর্ষ নিউরোসার্জনদের একজন। দক্ষতার পাশাপাশি সে সুদর্শন ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের জন্যও পরিচিত। ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা, গালে চাপা দাড়ি, তামাটে শ্যামলা জিম করা গড়ন—যা ব্লু শার্টের খোলা তিনটি বোতামে স্পষ্ট। সাদা এপ্রনটি চেয়ারের হাতলে ঝুলছে। মুখে গভীর স্তব্ধতা।
হঠাৎ দরজা ঠেলে ঢোকে কেউ। সাইহান চোখ না খুলেই শান্ত অথচ গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,

— বলেছিলাম না, এখন পেশেন্ট দেখবো না।
— কেন? ভাবি কি ফেল করেছে?
চেয়ার টেনে বসতে বসতে কথাটি বলে। সাইহান নিঃসাড়ে জবাব দেয়,
— ফালতু কথা বলবি না, রাফিন।
রাফিন হেসে ফেলে, সেই চিরচেনা বেয়াড়া ভঙ্গিতে,
— আচ্ছা বলছি না। এখন বল তো, এমন করে বসে আছিস কেন? আর আজ তো এইচএসসি রেজাল্ট বেরিয়েছে। ভাবির কী হলো?
সাইহান গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চোখ মেলে সোজা হয়ে বসে। কণ্ঠটা এবার একটু বেশি ভারী,
— সেটা নিয়েই চিন্তা।
রাফিন কপাল কুঁচকে তাকায়,
— কেন? কী হয়েছে?
— ওর রেজাল্ট যেটা এসেছে… আমি কল্পনাও করিনি। ও বরাবরই ভালো ছাত্রী ছিল। কিন্তু এই এক বছরে সবকিছু বদলে গেছে। আমার মনে হচ্ছে, ও কোনো কিছু নিয়ে গভীরভাবে ডিপ্রেসড।

— তুই বেশি বেশি ভাবছিস। পরিক্ষার সময় তো ভাবি অসুস্থ ছিল। হয়তো তাই রেজাল্ট খারাপ করেছে।”
সাইহান মাথা নাড়ে ধীরে,
— “ব্যাপারটা শুধু রেজাল্ট না, রাফিন। ওর চোখে এখন কেমন যেন শূন্যতা। হাসিটা তো দূরের কথা—চেহারায় কোনো অনুভূতিই নেই। সবসময় কেমন চুপচাপ থাকে।”
রাফিন গম্ভীর হলেও হাসতে চায়,
— “তাহলে এক কাজ কর—সব ঝামেলা সরিয়ে এবার অফিসিয়ালি ওয়াইফ বানিয়ে ফেল। ভালোবাসা দিয়ে ভাবির সব ডিপ্রেশন উড়িয়ে দে।”
সাইহান এবার একটু বিরক্ত হয়ে বলে,
— আমি সিরিয়াস।
— জানি ভাই, তোকে আমি চিনি। তুই যদি কোনো কিছু নিয়ে সবচেয়ে বেশি সিরিয়াস হোস, সেটা একমাত্র ভাবি-রিলেটেড।
সাইহান এবার আর কিছু বলে না। নীরব থাকে। কেবিনের নিঃশব্দতা আর এসির মৃদু গুঞ্জন যেন সাইহানের চিন্তার ভার বাড়িয়ে তোলে।
একটু বাদেই রাফিন আবার বলে,

— চল বাহিরে যাই। শুধু শুধু এখানে বসে থাকছিস, পেশেন্টও দেখছিস না। বরং ভাবি পাশ করেছে, এটা সেলিব্রেট করি। একটা ট্রিট দে।
প্রায় দুই মিনিট কোন সাড়া নেই। সাইহান চুপ করে থাকে, আর রাফিন তার মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর খোঁজে। অবশেষে সাইহান ধীরে উঠে দাঁড়ায়। রাফিন হেসে উঠে দাঁড়ায়। তারপর দুজনেই বেরিয়ে পড়ে হাসপাতাল থেকে।

রাত ঠিক ৯টা। মেহজা একা বসে আছে নিজের রুমে। আরভিদ বাইরে গেছে। তার মনে বারবার ঘুরে ফিরে আসছে একটাই প্রশ্ন— আদ্রিক ঐসময় ঠিক কী বলেছিল অর্তিহাকে, যে অর্তিহার মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট ছিল? আর ইদানীং অর্তিহা কেমন যেন পাল্টে গেছে। আগের মতো প্রাণবন্ত নেই। হাসে, কথা বলে ঠিকই, কিন্তু সবকিছু যেন মিথ্যে মনে হয় মেহজার কাছে।
হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় মেহজা। সোজা চলে যায় অর্তিহার রুমের দিকে, যা ঠিক আরভিদের পাশের রুম। দরজায় নক করে। মিনিটখানেক পর অর্তিহা দরজা খুলে।চোখেমুখে চিন্তার ছাপ।

— ভেতরে আসতে দিবি না?
— হ্যাঁ, আয় ভেতরে।
সোফায় বসে মেহজা। অর্তিহাও পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,
— হঠাৎ আমার রুমে? কোনো দরকার?
মেহজা সরাসরি বলে,
— তোকে কেমন যেন লাগছে। তুই কি কিছু নিয়ে চিন্তা করছিস?
অর্তিহা হালকা হেসে বলে,
— কই না তো।
মেহজা এবার ওর হাত ধরে বলে,
— মিথ্যে বলিস না অর্তি। তোর চোখ বলছে তুই কিছু লুকাচ্ছিস। তুই তো আগের মতো নেই। এক বছরেই কেমন চুপচাপ হয়ে গেছিস।
অর্তিহা শান্ত ও নরম স্বরে বলে,

— আমি সবসময় চুপচাপই ছিলাম।
— হ্যাঁ, চুপচাপ থাকতি, কিন্তু মন খারাপ করে না। তোর সব কিছু এখন লোক দেখানো মনে হয়। বল না, কি হয়েছে?
— সত্যি বলছি মেহু, আমি ঠিক আছি।
— ঠিক থাকলে আজ রেজাল্ট দেখে কোনো রিয়েকশন দিলি না কেন? তুই তো এক-দু’নম্বর কম পেলেও কান্না করতিস!
— সবাই পাশে ছিল, স্বান্তনা দিচ্ছিল তাই।
মেহজা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। অর্তিহা হঠাৎ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— তুই তোর আর ভাইয়ার বিয়ের দিন কিছু বলছিলি ভাইয়াকে নিয়ে… সেটা কি?
মেহজা মুখ ফিরিয়ে নেয়।
— বলেও কী লাভ? কেউ বিশ্বাস করেনি। আমি আর কাউকে বোঝাতেও চাই না।
— কিন্তু আমি তো বিশ্বাস করি তোর সব কথা, মেহু।
মেহজা অবাক হয়। নিজের মা যখন বিশ্বাস করেনি, তখন অর্তিহার মুখে এই কথা শুনে একটু থমকে যায়।
— বললে তুই সহ্য করতে পারবি না।
অর্তিহা মনে মনে বলে,

— তুই ভাবিস আমি এখনো কোমল, অথচ আমি অনেক আগেই ভেঙে গেছি। আমার যন্ত্রণাগুলো কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।
তারপর সরাসরি প্রশ্ন করে,
— বিয়ের দিন ভাইয়া তোর রুমে গিয়েছিল কেন?
মেহজা চুপচাপ কিছুক্ষণ অর্তিহার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর নিচু গলায় বলে,
— “আমাকে ভয় দেখাতে এসেছিল। নিজের এক অদ্ভুত রূপ নিয়ে, যেটা একেবারে হিংস্র, উন্মাদ আর ভয়ংকর— যেন কোনো পশু। যাতে আমি রাজি হই, বিয়েটা করি।“
এক মুহূর্ত চুপ থেকে সে আবার বলে,

— জানিস অর্তি, সেদিন তোর ভাইয়ের চোখে এমন এক রাগ দেখেছিলাম… মনে হচ্ছিল, আমাকে যদি না পায়, তবে হয়তো মেরে ফেলতেও দু’বার ভাববে না।
মেহজা থেমে যায়। অর্তিহা চুপচাপ তার দিকে তাকায়। তারপর আস্তে করে বলে,
— কিন্তু ভাইয়া তো তোকে ভালোবাসে। তাহলে এমন ব্যবহার করলো কেন?
মেহজা হালকা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
— পুরুষ মানুষ ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু তা শুধু নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।
অর্তিহা মাথা নিচু করে ফেলে। মেহজা সেটা দেখে মৃদু হাসে, অর্তিহাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— জামাই যদিও জিরো, ননদ কিন্তু আমার একশো।
অর্তিহা হালকা হাসে। মেহজা তখন অর্তিহাকে ছেড়ে বলে,
— অর্তি, একটা ড্রেস দিবি আমাকে? তুই জানিসই তো, আমি শাড়ি একদম পছন্দ করি না। আর কাভার্ডে যা আছে সব শাড়ি!
অর্তিহা মেহজার হাত ধরে বলে,

— আয়, দেখ তো কোনটা ভালো লাগে।
দুজনে মিলে কাভার্ডের সামনে দাঁড়ায়। অর্তিহা মেহজাকে একটা নতুন টি-শার্ট আর প্যান্ট সাথে ওড়না দেয়।
— থ্যাংকস।
বলে মেহজা হালকা হেসে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।মেহজা ঘরে ঢুকেই সরাসরি ওয়াশরুমে চলে যায় চেঞ্জ করতে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে বেরিয়ে আসে, তারপর ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
— আহ! কি শান্তি!
রুমে ঢোকার শব্দে মেহজার দৃষ্টি ঘুরে গেল দরজার দিকে। আরভিদ ঢুকছে—সাদা পাঞ্জাবির ওপর হালকা শাল জড়ানো। সাধারণ এক সাজ, কিন্তু এই পুরুষটিকে সেটা ভীষণ রকম মানায়। পাঞ্জাবির নিচে তার প্রশস্ত বুকটা যেন আরও বেশি দৃঢ়, আরও বেশি মোহনীয় মনে হয়। চোখ সরিয়ে নেওয়া দায়। নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে মনে মনে বলে,

— নির্ঘাত এই লুচ্চা বেডার অর্ধেক ভোটারই মেয়েমানুষ।
আরভিদ এক ঝলক তাকিয়ে দেখে মেহজার শোয়ার ভঙ্গি। গম্ভীর স্বরে বলে,
— সারাদিন শুধু শুয়েই থাকিস। তার ওপর শোয়ারও কোনো স্টাইল নেই!
মেহজা ভেঙিয়ে বলে,
— কেন? এখন কি মডেলিং করে ঘুমাতে হবে?
আরভিদ আলমারি থেকে কাপড় বের করতে করতে বলে,
— মডেলিং না করলেও চলবে, অন্তত মাথা-পা সোজা করে ঘুমা। রাতে তোর মাথা থাকে এক কোণে, পা আরেক কোণে!
মেহজা বিরক্ত হয়ে মুখটা বাঁকিয়ে বলে,

— এতোই যদি সমস্যা, তাহলে আপনি সোফায় গিয়ে ঘুমান। আমি তো ছোটবেলা থেকেই এভাবেই ঘুমাই।
আরভিদ গম্ভীর গলায় বলে,
— বেশি কথা বললে রুম থেকে বের করে দিব।
কথাটা শুনে মেহজা রাগে ফুসে ওঠে। উঠে দাঁড়িয়ে গলা চড়িয়ে বলে,
— “দুই নাম্বার বেডা একটা! রাতে এক রূপ, দিনে আরেক রূপ! এইজন্যই আপনি এত বড় রাজনীতিবিদ হতে পেরেছেন—রূপ বদলাতে এক সেকেন্ডও লাগে না আপনার।”
আরভিদ ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসে। ঠান্ডা গলায় বলে,
— এখন কি তুই রাতের রূপটা দেখতে চাস?
মেহজা চোখ কুঁচকে উত্তর দেয়,
— না, আমার চাইতে হবে না। একটু পরেই ঘুমাতে গেলে সে রূপ নিজেই অ্যাক্টিভ হয়ে যাবে।
আরভিদ হেসে ফেলে, চোখে দুষ্টুমি ঝিলমিল করে ওঠে,

— অলরেডি এক্টিভ হয়ে গেছে, রেডলিপ!
এই কথাটুকু শোনার পরেই মেহজা হকচকিয়ে যায়। ভয়ে দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে পড়ে। আরভিদ মুচকি হেসে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে চেঞ্জ করার জন্য। মেহজা নিচে নেমে আসে। সিঁড়ির কাছে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় নাজনীন কারদারের।
তিনি মেহজাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে বলেন,

— এটা তো অর্তির ড্রেস? কিছুদিন আগেই নিয়েছিলো।
মেহজা মাথা মাথা নেড়ে জবাব দেয়,
— হ্যা, আমি অর্তির থেকে এনেছি। শাড়ি পরে ঘুমাতে কষ্ট হয়, তাই…
বলেই মেহজা হেঁটে চলে যেতে চায়। কিন্তু কয়েক কদম যাওয়ার পর থেমে যায় নাজনীন কারদারের কথা শুনে।
— বাহ, ধারের কাপড়েও দেখছি তোমায় বেশ মানিয়েছে, মেহজা!
মেহজা ঘুরে তাকাল নাজনীনের দিকে। ঠোঁটে এক তীক্ষ্ণ হাসি ছুঁয়ে বলে,
— ব্যাপারটা আসলে পার্সোনালিটির, ছোট মামানি। এই দেখুন, আমি ধারের কাপড়েও ভালো লাগছি। আর আপনি তো মাশাআল্লাহ নিজের ব্র্যান্ডেড পোশাকেও ভালো লাগেন না।
নাজনীন কারদারের মুখ রাগে লাল হয়ে ওঠে।

— এমন বেয়াদব মেয়ে জীবনে দেখিনি!
মেহজা মুচকি হেসে বলে,
— কিন্তু আমি একজনকে ঠিক আপনার মতো দেখেছি।
নাজনীন কারদার ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে,
— কাকে?
মেহজা মেকি হেসে বলে,
— ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। ঝগড়া ছাড়া থাকতে পারেন না। এই তো এখন বাংলাদেশ, তো একটু পরেই পাকিস্তানের সাথে ঝামেলা বাধাবে।
নাজনীন এত অপমান সহ্য করতে না পেরে রাগে মুখ থমথমে করে চলে গেল ডাইনিং টেবিলের দিকে। মেহজাও পিছু পিছু গেল। নাজনীন গিয়ে বসে তার স্বামী আফির কারদারের পাশে। মুখে রাগ ফুটে উঠেছে। আফির সেটা দেখে জিজ্ঞেস করে,
— কী হয়েছে, নাজনীন?
নাজনীন নিজের রাগ চেপে রেখে বলে,

— কিছু না।
অন্যদিকে, মেহজা গিয়ে চুপচাপ বসে পড়ল অর্তিহার পাশে। অর্তিহাও চুপ করে আছে। এমন সময় ডাইনিং স্পেসে প্রবেশ করে আরভিদ আর আদ্রিক। আরভিদ সোজা গিয়ে বসল মেহজার পাশের চেয়ারে। আদ্রিক বসে পড়ল অর্তিহার ঠিক সামনে। মেহজা আরভিদকে নিজের পাশে বসতে দেখে নাকমুখ কোঁচকাতে লাগল। কানে ফিসফিস করে বলে,

— সারা দিন এমন চিপকে থাকেন কেন?
আরভিদ একটু ঝুঁকে আস্তে স্বরে বলে,
— আমাদের বন্ড ফেবিকলের তাই তো!
মেহজা দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলে,
— লুচ্চা একটা!
সবাই খেতে শুরু করে। তাদের খাবারের মাঝখানে আফির কারদার হঠাৎ বললেন,
— আজ রাতেই তো চলে যাচ্ছো, আদ্রিক?
আদ্রিক প্লেটে স্পোন চালাতে চালাতে বলে,
— হ্যাঁ, রাত তিনটার ফ্লাইট।
নাজনীন অবাক হয়ে বলল,

— আজ রাতেই? আমি তো ভেবেছিলাম পুরো সপ্তাহ থাকছো। মাসের বেশিটা সময় তো তুমি দুবাই থাকো!
আফির গম্ভীর স্বরে বললেন,
— নাজনীন, আদ্রিক Emirates-এর ক্যাপ্টেন পাইলট। ওর তো ওখানেই বেশি থাকা স্বাভাবিক। বরং, প্রতি মাসে ও যে সময় বের করে এখানে আসে, সেটাই অনেক!
নাজনীন চুপ করে গেল। তখন তাহিয়া কারদার হেসে বলে,
— আমাদের টানেই তো আসে! না হলে আজকালকার ছেলেরা তো বাড়ির খবরও রাখে না।
তাহিয়ার কথা শুনে অর্তিহা একবার আদ্রিকের দিকে তাকাল। দেখল, আদ্রিক আগেই তার দিকে তাকিয়ে আছে, ঠোঁটে চিরচেনা রহস্যময় হাসি।
আদ্রিক এবার নাজনীনকে বলে,
— মম, কাল একটা ফ্লাইট আছে। তারপর দুইদিন পর আবার আসবো।
বলেই সে অর্তিহার দিকে তাকিয়ে বলে,
— তারপর পুরো এক সপ্তাহ এখানেই থাকবো।
নাজনীন খুশিতে চোখ বড় করে বলেন,
— সত্যি বলছো?
আদ্রিক মাথা নেড়ে হেসে বলে,

— হ্যাঁ। আগামী সপ্তাহে আমার রুটেশনে আর কোনো ফ্লাইট নেই।
মেহজা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে,
— আদ্রিক ভাই, এতদিনে আপনি কয়টা দেশে গেছেন?
আদ্রিক হেসে বলে,
— মোট ৮৩টা দেশে ফ্লাই করেছি।
— এতোগুলো! কাল কোন দেশে যাচ্ছেন?
— তুর্কীতে।
— ইশশ! আমিও পাইলট হতে চাই! ভ্রমণ করতে আমার খুব ভালো লাগে।
তাহিয়া কারদার হেসে বলেন,
— তাহলে পড়ালেখা কন্টিনিউ করো। অর্তিহার সঙ্গে ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেবে আরভিদ।
আভীর কারদার মাথা নেড়ে বললেন,
— তাহিয়া একদম ঠিক বলেছে। মাসরিফ থেকে তোমার নেওয়া এক বছরও শেষ। এখন পড়ালেখায় ফিরো।
মেহজা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে,

— পাইলট হওয়ার ইচ্ছে হয়েছে ঠিক, কিন্তু পড়াশোনার ইচ্ছে হয়নি মামা!
নাজনীন এবার ঠোঁট বাঁকিয়ে টিটকারি মেরে বলে,
— পড়াশোনা না করাই ভালো। তোমার রেজাল্টে এমনিতেই আমাদের ‘কারদার’ বংশের নাম ডুববে।
মেহজা ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গ হাসি টেনে শান্ত কণ্ঠে উত্তর দেয়,
— কারদার বংশ এতই দুর্বল? একটা রেজাল্টেই যদি ডুবে যায়, তা হলে তো টাইটানিকের চেয়েও দুর্ভাগা!
নাজনীন রাগে ফেটে পড়লেন। কণ্ঠে ক্ষোভ নিয়ে বললেন,
— দেখেছো, কী বেয়াদব মেয়ে! নিজের মামা ও শ্বশুরবাড়ির বংশকে অপমান করছে!
মেহজা কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই, টেবিলে হালকা ধাক্কার শব্দ তুলে আরভিদ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে,
— মেহু, চুপচাপ খা।
তারপর নাজনীনের দিকে তাকিয়ে বলে,

— আর মিমি, তুমিও। কথা বাড়ানোর দরকার নেই।
চারপাশে নীরবতা নেমে এলো। দুজনেই চুপচাপ খেতে থাকে। খাওয়া শেষ হলে সবাই ধীরে ধীরে যার যার রুমে চলে যায়। মেহজা নিজের রুমে ঢুকতেই পেছন পেছন আরভিদও আসে। সে চুপচাপ দরজা বন্ধ করে মেহজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ করে ওর গলায় মুখ ঘষে দিয়ে ফিসফিস করে বলে,
— আজকে আমায় পাগল করে দে, রেডলিপ।
মেহজা রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,
— যে আগে থেকেই পাগল, তাকে আর পাগল করার কী দরকার? সরেন আমার কাছ থেকে।
সে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চায়, কিন্তু আরভিদ আরও জোরে ওকে জড়িয়ে ধরে।

— কাল রাতের কথা ভুলে গেছিস?
— ভুলিনি। কিন্তু আপনি যতই জোরজবরদস্তি করুন , আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে কখনোই গ্রহণ করবো না।
আরভিদ এবার ওর গলা থেকে মুখ তুলে তাকায়,
— কেন? কী কমতি আছে তোর মধ্যে? যে তুই আমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারবি না?
মেহজা রেগে ফেটে পড়ে,
— অসভ্য বুইড়া! শয়তান! দুই নাম্বার বেডা!
আরভিদ হেসে ওঠে, যেন ওর কথায় কিছুই যায় আসে না।
— তুই যাই বলিস, আজ তোকে ছাড়ছি না।
এই কথা শুনেই মেহজার মাথায় আসে একটা বুদ্ধি। হঠাৎ করে বমি আসার অভিনয় করতে শুরু করে,
— ইউক! ইউক!
করে মুখ চেপে ধরে ছুটে যায় ওয়াশরুমে। অভিনয়টা এত নিখুঁত ছিলো যে আরভিদ কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সে দরজা বন্ধ করে আরও জোরে বমির শব্দ করতে থাকে। ওদিকে আরভিদ ভেতরে ঘাবড়ে যায়। দরজায় ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে ওঠে,
— মেহু! দরজা খোল! কী হয়েছে তোর?
মেহজা কোনো উত্তর না দিয়ে কেবল বমির আওয়াজ করে যায়। এবার আরভিদের রাগ চড়ে যায়,
— বললাম দরজা খোল, না হলে ভেঙে ফেলবো!
অবশেষে দরজা খুলে যায়। মেহজার চোখ-মুখ ভেজা, চেহারায় অসুস্থতা স্পষ্ট। দেখে মনে হয়, শরীরটা ভীষণ খারাপ। আরভিদ এগিয়ে এসে চিন্তিত কণ্ঠে বলে,

— তুই ঠিক আছিস?
মেহজা ধীরে বলে,
— শরীরটা খুব খারাপ লাগছে।
আরভিদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
— হঠাৎ এমন বমি কেন?
মেহজা রেগে ভ্রু কুঁচকে উত্তর দেয়,
— তো বমির কি উচিত ছিলো আগে থেকে ব্যান্ড বাজিয়ে আসা?
আরভিদ নিজেকে সামলে নেয়।
— আচ্ছা, বোস। একটু বিশ্রাম নে।
সে মেহজাকে বেডে বসিয়ে দেয়। মেহজা বলে,
— আমি ঘুমাতে চাই, শরীরটা একদম দুর্বল লাগছে।
— ঠিক আছে, ঘুমা।
মেহজা শুয়ে পড়ে। আরভিদ ওর পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে থাকে। মেহজার মনে মনে হাসি আসে। একেবারে ভিতরে ভেতরে। মনে মনে বলে,
— মেহজা যদি নিজের ফর্মে থাকে, তাহলে আপনার মতো দশজন রাজনীতিবিদকেও টপকাতে পারে।

রাত অনেকটা গড়িয়ে গেছে। চারপাশ নিঃস্তব্ধ। আদ্রিক অর্তিহার বুক থেকে মাথা উঠিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসে বিছানায়। পাশ থেকে হাতঘড়িটা নিয়ে দেখল—সময় রাত ১টা ৪৭। সে একবার অর্তিহার দিকে তাকায়। মেয়েটা নিঃশব্দে শুয়ে আছে, যেন কোনো অনুভূতিহীন শরীর। চোখে-মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। দেখতে মানুষ, কিন্তু মনে হয় যেন যন্ত্র।
আদ্রিক নিচু হয়ে ওর কপালে একটা চুমু দিল। তারপর শান্ত গলায় বলে,
— দুদিন পর আবার আসব, লিটলহার্ট। অপেক্ষা করবি আমার।
অর্তিহা ধীরে চোখ সরিয়ে তাকায় আদ্রিকের দিকে। গলায় কাঁপুনির মতো কিছু থাকে,
— ভাইয়াও কি আপনার মতো?
আদ্রিক খানিক থেমে ওর কথা বুঝে ফেলে। তবু গালে হাত রাখে অর্তিহার, আদর মিশ্রিত কন্ঠে বলে,

— আমার মতো বলতে কেমন?
অর্তিহা তাকিয়ে থাকে তার চোখে, গলা কেঁপে ওঠে,
— আপনার মতো হিংস্র… দানব… ভয়ংকর… আর…
আদ্রিক চোখ টেনে রাখে, ঠোঁট কোণে হালকা হাসি,
— আর…?
— আর মনুষ্যত্বহীন।
অর্তিহার কণ্ঠ শান্ত, কিন্তু যেন কোনো এক জমে থাকা কষ্ট আজ বেরিয়ে এলো। আদ্রিক হেসে ওঠে। তবে সে হাসি আনন্দের নয়, একটা ধূসর অভ্যাসের। তারপর একটু নরম গলায় বলে,

— মেহু তোকে এসব বলেছে?
অর্তিহার চোখে রাগ আর অভিমান একসাথে জ্বলজ্বল করছিল,
— কেন জানতে চাইছেন? যাতে গিয়ে নিজের বেস্টফ্রেন্ডকে বলতে পারেন? তারপর আপনার বেস্টফ্রেন্ড আবার ওর ওপর রাগ ঝাড়বে, তাই তো?
আদ্রিক ঠাণ্ডা স্বরে, গলার কাছে হাতটা নামিয়ে স্লাইড করে বলে,
— আরভিদ আর মেহজা স্বামী-স্ত্রী। আর একটা স্বামী তার বউকে কীভাবে হ্যান্ডেল করবে, সেটা তার ব্যাপার। তোকে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না। তুই শুধু আমাকে নিয়ে ভাব।
অর্তিহা মুখ ফিরিয়ে বলে,

— আপনাকে নিয়ে আলাদা করে ভাবতে হয় না। আপনি তো আমার মস্তিষ্কে গেঁথে আছেন। আপনার তৈরি করা এই অসুস্থ সম্পর্ক এক মুহূর্তের জন্যও আপনাকে ভুলতে দেয় না।
একটু চুপ করে থেকে, ফিরে আদ্রিকের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
— আমার ভাবনার মাঝে শুধু ঘৃণা আছে আপনার জন্য, আদ্রিক ভাইয়া।
আদ্রিক হালকা করে হাসল। অর্তিহার চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা স্বরে বলে,
— ভালোবাসা ক্ষণিকের…
কিন্তু ঘৃণা? আজীবনের বিনাশ।
তাই তোর ভালোবাসা না, ঘৃণাটাই চাই, লিটলহার্ট।
তারপর সে ওর ঠোঁটে একটা চুমু দিয়ে বলে,

— একটা গুডবাই কিস দে?
অর্তিহা কিছু না বলে কপালে একটা চুমু দিল—তাতে কোনো অনুভব ছিল না, কেবল বাধ্য হয়ে দেওয়া।
আদ্রিক উঠে দাঁড়াল।
— ঘুমিয়ে থাক, আমি চলে যাচ্ছি।
অর্তিহা চুপ করে রইল। আদ্রিক খালি গায়ে দরজা খুলে বের হয়ে গেল। ওর চলে যাওয়া পর্যন্ত অর্তিহা তাকিয়ে রইল দরজার দিকে। তারপর ধীরে গিয়ে দরজাটা লক করে ফিরে এসে শুয়ে পড়ে।
অন্যদিকে, আদ্রিক নিজের রুমে ফিরে শাওয়ার নেয়।

মোহশৃঙ্খল পর্ব ৩

বাড়ির সবাই তখনো ঘুমিয়ে। এমনিতেই সে চায় না, কেউ তাকে বিদায় জানাক। তার সব যাওয়া-আসা এমন নিঃশব্দেই হয়। বাড়ির বাইরে এসে দেখে, ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রিক কিছু না বলে গিয়ে গাড়িতে বসে পড়ে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ছুটে চলল গাড়ি এয়ারপোর্টের পথে। তবে গন্তব্য শুধুই এয়ারপোর্ট নয়—আসলে গন্তব্য ঠিক কোথায়, তা জানে শুধু একজনই… আদ্রিক।

মোহশৃঙ্খল পর্ব ৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here