মোহশৃঙ্খল পর্ব ৫
মাহা আয়মাত
অর্তিহা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্লাসরুমের সামনের বেঞ্চটার দিকে। সেখানে আসলে কিছুই নেই—শুধু শূন্যতা। ক্লাসে তখন স্যার পড়া বোঝাচ্ছে, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর যেন অর্তিহার কানে পৌঁছাচ্ছেই না। আজকেই অর্তিহার কোচিংয়ে প্রথম দিন। ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য আরভিদ তাকে এই কোচিংয়ে ভর্তি করিয়েছে। স্যার পড়া বোঝাতে বোঝাতে হঠাৎ চোখ চলে যায় অর্তিহার দিকে। মুহূর্তেই পড়া থামিয়ে এগিয়ে আসে অর্তিহার দিকে।
তা দেখে অর্তিহার ফ্রেন্ড হানিন অর্তিহার কনুইতে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে,
— অর্তি! তাহমিদ ভাইয়া তোর দিকে আসছে!
হানিনের কথা শুনে অর্তিহা নিজের ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে সামনে তাকায়। সত্যিই তো—তাহমিদ ভাইয়া তার দিকেই আসছে।
তাহমিদ অর্তিহার সামনে এসে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলে,
— কী হলো, মিস অপরূপা? মনোযোগটা কোথায়?
অর্তিহা তড়িঘড়ি করে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বলে,
— সরি ভাইয়া।
তাহমিদ আবার হাসে,
— ইশশ! সুন্দরী মেয়েদের মুখে ‘সরি’ কথাটাও অপরূপ লাগে!
অর্তিহা একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায়। ধীরে স্বরে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— ভাইয়া, বসতে পারি?
— অন্য কেউ হলে পড়ায় মন না দেওয়ার জন্য দাড় করিয়ে রাখতাম, কিন্তু আপনি তো অপরূপা। আর অপরূপা দাঁড়িয়ে থাকলে ভালো লাগে না। তাই বসে যান, মিস অপরূপা।
এইবার অর্তিহা মাথা তোলে। নরম স্বভাবের মাঝেও হালকা একটা দৃঢ়তা মিশিয়ে সে বলে,
— ভাইয়া, আমার নাম অর্তিহা। তাই আপনি যদি আমাকে ‘অপরূপা’ বলে অস্বস্তিতে না ফেলেন, তাহলে ভাল লাগবে।
অর্তিহার কথা শুনে হানিন হঠাৎ ফুস করে হেসে ফেলে। কিন্তু সাথে সাথে মুখ চেপে ধরে নিজেকে শান্ত করতে লাগল। তাহমিদের ইগো তে লাগে অর্তিহার কথাটা। তাহমিদ একবার কড়া চোখে হানিনের দিকে তাকাল, তারপর অর্তিহার দিকে চোখ রেখে মুখ থমথমে করে সামনে চলে গেল। অর্তিহা নীরব হয়ে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর, তাহমিদ পড়ানো করে সবাইকে ছুটি দিলো।
ক্লাস শেষে অর্তিহা আর হানিন একসাথে কোচিং সেন্টার থেকে বের হয়। কোচিংটা একটা সরু গলির ভেতরে, মাত্র এক মিনিট হাঁটলেই মেইন রোডে পৌঁছানো যায়। দুজন হাঁটতে হাঁটতে গলি পেরিয়ে একটু সামনে এগিয়ে যায়। তখন হঠাৎ অর্তিহার সামনে এসে দাঁড়ায় একজন পরিচিত সুদর্শন পুরুষ। গায়ে সাদা শার্ট, চেহারায় এক ধরনের গাম্ভীর্য, চোখে স্থিরতা। তাকে দেখে অর্তিহা অবাক হয়ে দু’কদম পেছিয়ে যায়।
— অর্তিহা, তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
সামনে দাঁড়ানো পুরুষটির কণ্ঠে অনুরোধের সুর।অর্তিহা ভয়ে আশপাশে তাকায়। নাহ, আশেপাশে কেউ নেই। তারপর সে ধীরে, কাঁপা কণ্ঠে বলে,
— আপ… আপনি এখানে? কেন এসেছেন? আর এভাবে পথ আটকেছেন কেন?
সাইহান নিচু কণ্ঠে, চোখ নামিয়ে বলে,
— সরি অর্তিহা। এভাবে তোমার পথ আটকানোর জন্য। তবে বিশ্বাস করো, না এসে থাকতে পারিনি। একটু কথা বলতে চাই তোমার সঙ্গে।
অর্তিহা হালকা রাগ মিশ্রিত শান্তস্বরে বলে,
— কি বলতে চান? আপনি আমাকে ভালোবাসেন? এই কথাটা অনেকবার বলেছেন আপনি। আর আমি… আমি উত্তরও দিয়েছি, বারবার।
সাইহান দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
— দিয়েছো, কিন্তু সেটা তো পারিবারিক শত্রুতার কথা ভেবে।
অর্তিহা চোখ নামিয়ে শান্ত স্বরে জবাব দেয়,
— না, এমন কিছু না।
সাইহান গভীর ও অসহায় চোখে অর্তিহার দিকে তাকিয়ে বলে,
— তবে কেন? কেন বারবার আমাকে অকারণে ফিরিয়ে দিচ্ছো? জানো, তোমার প্রত্যাখ্যানগুলো আমার ভিতরটা চুরমার করে দেয়। খুব কষ্ট পাই আমি…
— কষ্ট হলে আমার থেকে দূরে থাকেন।
সাইহান ধরা গলায় বলে,
— ভালো সবাইকে বাসা যায় না, আর যাকে ভালোবাসা যায়, তার থেকে দূরে থাকাও যায় না।
তার কণ্ঠে ছিল চাপা কষ্ট।
অর্তিহা ধীর কন্ঠে বলে,
— ভুলে যান আমাকে। মনে করুন, আমি অন্য কারোর হয়ে গেছি…
— আমি কখনো তোমাকে ভুলতে পারবো না, আর না তোমাকে অন্য কারোর হতে দিবো!
অর্তিহা হঠাৎ মাথা তুলে তাকায়,
— আপনি কি আমাকে জোর করবেন?
সাইহান চটজলদি বলে উঠে,
— কখনো না। আমি কখনোই তোমার ওপর জোর করতে পারি না, করবও না।
— তাহলে কেন বারবার আমার অনিচ্ছার পরও আমার পিছু নিচ্ছেন?এটা তো একপ্রকার জোরই!
সাইহানের কণ্ঠে এক অবিচলিত আশা ঝলমল করে,
— না। আমি জানি তুমি তোমার পরিবারের কারণে আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছো, তাই প্রত্যেকবার তোমার ফিরিয়ে দেওয়ার পরও আমি আবার তোমার কাছেই আসি।
— প্লিজ, এটাই শেষবার এসেছেন। আর কোনোদিন আমার পিছু করবেন না।
এই কথাগুলো বলেই অর্তিহা সঙ্গে থাকা হানিনের হাত ধরে চলে যায়। সাইহান অর্তিহার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে, হৃদয়টা ব্যথায় জর্জরিত।
হানিন অর্তিহার দিকে তাকিয়ে যেতে যেতে বলে,
— অর্তি, সত্যিই কি তুই তোদের পারিবারিক দন্ডের কারণে এই হ্যান্ডসামকে ফিরিয়ে দিচ্ছিস?
অর্তিহা মাথা নেড়ে নরম স্বরে উত্তর দেয়,
— না।
হানিন আর প্রশ্ন করেনি। অর্তিহা বাড়ি থেকে পাঠানো গাড়িতে উঠে বসল, ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলো। সাইহানও ধীরে ধীরে সেখানে থেকে সরে দাঁড়ালো।
মেহজা রুমে একা বসে আছে। আরভিদ সকালবেলায় উঠে পার্লামেন্টে চলে গিয়েছিল। সেই যে গেছে, আর ফেরেনি—এখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। মেহজার কিছুই ভালো লাগছে না। কাছে মোবাইলও নেই, যা টিপে সময় কাটাতে পারে। একঘেয়েমি আর বিরক্তি চূড়ায় পৌঁছে গেলে হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়।
ধীরে ধীরে রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ির কাছে এসে থমকে যায়। চোখ পড়ে লিভিং রুমের সোফার দিকে। সোফায় বসে আছে একটা মেয়ে, শর্ট ড্রেস পরে। সে তাহিয়া কারদারকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে বলে মনে হলেও, আসলে চোখে এক বিন্দু জলও নেই—শুধু কান্নার ভান।
মেহজা নিচে নেমে একটু কাছে গিয়ে ভালো করে দেখে মেয়েটাকে। আর সাথে সাথে নাক ছিটকে, বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
— এই দেশি সান্ডা আবার কখন এল?
তখনই কিচেন থেকে নাজনীন বেরিয়ে আসে। তিনি দেখতে পায়, তাহিয়া কারদারকে একটি মেয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। তবে মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছে না। বিস্মিত হয়ে নাজনীন মেহজার কাছে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেন,
— কে এই মেয়েটা?
মেহজা নাজনীনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
— দেশি সান্ডা!
নাজনীন ভ্রু কুঁচকে বলেন,
— দেশি সান্ডা?
এই মুহূর্তে, মেয়েটি মুখ তোলে। নাজনীন অবাক হয়ে বলেন,
— কৌশালী এসেছে?
তারপর মেহজার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেন,
— দেশি সান্ডা মানে কী?
মেহজা চোখ-মুখ কুঁচকে, যেন প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে বলে,
— উফ, ছোট মামানী! দেশি সান্ডা মানে হচ্ছে বাজেটের সান্ডা! এই তো কিছুদিন আগে গোপালগঞ্জে এক ছেলে সান্ডা ভেবে গুইসাপ খেয়ে ফেলেছিলো!
একটু থেমে মেহজা তাকায় কৌশালীর দিকে, ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। তারপর বলে,
— কৌশালীও একরকমের দেশি সান্ডা। মানে…
সে এবার মুখ ঘুরিয়ে নাজনীন কারদারের দিকে তাকায়। চোখাচোখি হতেই দুজনের মুখে একসাথে চক্রান্তময় হাসি। দুজনে হাই ফাইভ করে বলে ওঠে,
— গুইসাপ!
তবে আনন্দ বেশি সময় স্থায়ী হয় না। পরক্ষণেই দুজনের মনে পড়ে, তারা একে অপরের চিরশত্রু। মুহূর্তেই হাসি মিলিয়ে যায়, মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। একে অপরের দিক থেকে সরে গিয়ে আবার আগের দূরত্বটুকু বজায় রাখে।
তাহিয়া কারদার মমতাভরা কণ্ঠে বলেন,
— আর কেঁদো না, আম্মু। চোখ-মুখের কী হাল বানিয়ে ফেলেছো নিজের!
কৌশলী নাক টানতে টানতে বলে,
— কাঁদবো না, আন্টি? তুমি কীভাবে পারলে? আমার ভালোবাসা, আমার আরভু বেবিকে অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে?
বলেই আবার তাহিয়াকে জড়িয়ে ধরে কান্নার ভান ধরে ফুপাতে লাগল।
এই কথা শুনে মেহজা দৃঢ় কন্ঠে বলে,
— ‘অন্য একটা মেয়ে’ আবার কী? সম্মান দিয়ে কথা বলো। আমি তোমার আরভু বেবিরই পছন্দ করা মেয়ে, বুঝেছো?
এবার কৌশলী ধীরে ধীরে তাহিয়াকে ছেড়ে মেহজার সামনে দাঁড়াল। চোখে আগুন, মুখে রাগ,
— তুমি কে? আমাদের মাঝখানে কথা বলার সাহস হয় কীভাবে?
মেহজা এক ভ্রু উঁচু করে ঠোঁটে হালকা হাসি টেনে বলে,
— যাকে পাওনি বলে এভাবে ন্যাকা কান্না করছো, আমি তার আদরের, ভালোবাসার বউ। বুঝেছো? নাকি আরেকটা স্টাইলে বোঝাতে হবে, কৌশালী ডার্লিং?
কৌশালী রেগে গিয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর মুখ ঘুরিয়ে তাহিয়া কারদারের দিকে তাকিয়ে বলে,
— দেখছো আন্টি, কেমন মেয়ে পছন্দ করেছো নিজের ছেলের জন্য? গুরুজনদের সামনে কেমন নির্লজ্জের মতো কথা বলছে!
মেহজা ভ্রু কুঁচকে বলে,
— আমি যদি আমার স্বামীর ভালোবাসার কথা বলি, তাহলে সেটা নির্লজ্জতা হয়? আর তুমি কেমন বেহায়া? অন্যের স্বামীকে ভালোবেসে কাঁদছো, তাও আবার তার শ্বাশুড়ির গলা জড়িয়ে ধরে?
কৌশালী কান্না মেশানো গলায় বলে,
— দেখেছো, আন্টি? ও আমাকে বেহায়া বলেছে!
তাহিয়া কারদার এবার কৌশালীর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,
— কিন্তু কৌশালী, তুমিও তো মেহুকে উল্টো-পাল্টা কথা বলছো।
কৌশালী এবার নাটক করে চোখ মুছতে মুছতে বলে,
— আন্টি, তুমি আমাকে এভাবে বলতে পারলে?
— কীভাবে বলেছে?
ঘরের সবাই একসঙ্গে মেইন ডোরের দিকে তাকায়। আরভিদ দাঁড়িয়ে আর তার পাশে আছেন আভীর কারদার। কৌশালী দৌড়ে এগিয়ে গেল আরভিদের কাছে। হাত বাড়িয়ে তাকে আঁকড়ে ধরতে চাইলে আরভিদ কয়েক ধাপ পিছিয়ে গেল।
— আরভু বেবি! তুমি এসেছো?
মেহজা ব্যঙ্গ করে বলে,
— না উনার ভূত এসেছে!
কৌশলী রেগে মেহজার দিকে তাকায়, তারপর আবার আরভিদের দিকে মুখ ফেরায়। আরভিদ বিরক্ত হয়েও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে,
— কি হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেন?
কৌশলী অভিমানের মতো ঢং করে বলে,
— তুমি বিয়ে করে ফেলেছো, তাই!
মেহজা হেসে বলে,
— একে তো তোমার আরভু বেবি আঙ্কেল বয়সে বিয়ে করেছে। এখন কি চাইছিলে? আরও দেরি করে দাদার বয়সে বিয়ে করতো?
কৌশলী ক্ষোভ নিয়ে বলে,
— দেখেছো, তোমাকে ইনডিরেক্টলি “আঙ্কেল” বলছে!
মেহজা ভেংচি কেটে বলে,
— ছিহ, বয়স যতই হোক, জামাই তো জামাইই! আঙ্কেল কেন বলবো?
আরভিদ এবার কড়া চোখে মেহজার দিকে তাকিয়ে বলে,
— রুমে আয়।
বলেই সবাইকে রেখে সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে গেল।
কৌশালী ডাকলেও আরভিদ ফিরেও না।
মেহজা লজ্জার ভান করে কৌশলীকে বলে,
— সোয়ামি রুমে ডাকছে, যায় আমি।
বলেই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে যা। পেছনে কৌশালী
তাকিয়ে থাকে মেহজার যাওয়ার দিকে, চোখে তীব্র রাগ। মেহজা ধীরে ধীরে রুমে ঢোকে। দেখে, আরভিদ বিছানায় বসে আছে—চেহারায় থমথমে রাগের ছাপ।
মেহজার পা থমকে যায়।
সে ঢোক গিলে বলে,
— ডেকেছেন কেন?
আরভিদ ধীরে মাথা তোলে, সরাসরি মেহজার চোখে চোখ রেখে বলে,
— নিচে কীসব বলছিলি?
মেহজা কাঁধ সোজা করে দাঁড়ায়, স্বর কঠিন করে বলে,
— আমি কোথায় বললাম? আপনার আদরের, ভালোবাসার ‘কৌশলী’ই তো আমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার মুখ থেকে আপনাকে ‘বুড়ো’ বলানো চেষ্টা করেছে!
আরভিদ চোখে বিস্ময় নিয়ে উঠে দাড়ায়,
— আমার আদরের ভালোবাসার কৌশালী মানে?
মেহজা হালকা কণ্ঠে বলে উঠে,
— এমা কি আপনার আদরের না? ও এখানে বসে কাঁদছিল, আর আপনি পার্লামেন্টে বসে বুঝেই দৌড়ে চলে এলেন! আহা, কী গভীর হৃদয়ের টান!
আরভিদ এক ভ্রু উঁচিয়ে চেয়ে থাকে মেহজার দিকে, পরক্ষনেই ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে বলে,
— তুই কি জেলাস?
মেহজা কথাটা শুনে একটু ভাব নিয়ে হালকা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,
— আমি, জেলাস? তাও আবার ঐ দেশি সান্ডার উপর?
আরভিদ বিরক্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,
— এমন উইয়ার্ড উইয়ার্ড নাম তোর মাথায় আসে কিভাবে?
মেহজা হেসে বলে,
— বাবাহ! শরীরে বুঝি ফোসকা পড়ে গেছে আপনার ‘কৌশলী’কে নিয়ে বলায়?
— কেন শুধু শুধু ঝগড়া করছিস? সারাদিন বাসায় ছিলাম না, এখন এসেছি। কই একটু সেবা-যত্ন করবি, তা না করে উল্টে ঝগড়া করছিস!
মেহজা আরভিদের কথা শুনে আচমকাই নরম হয়ে যায়। চুপচাপ কাছে এসে বুকে হাত রেখে আদুরে কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
— অনেক ক্লান্ত লাগছে?
হঠাৎ মেহজার এমন আচরণে আরভিদ কিছুটা অবাক হলেও শান্ত গলায় উত্তর দেয়,
— হ্যাঁ, খুব ক্লান্ত।
মেহজা ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে নরম গলায় বলে,
— তাহলে একটু লেবুর শরবত করে দেই? ইঁদুর মারার বিষ দিয়ে? একবার খেলে সারাজীবন আর ক্লান্তি লাগবে না!
আরভিদ হেসে ফেলে, ঠোঁটে মুচকি হাসি রেখে বলে,
— তোর মুখেই তো অনেক বিষ আছে, তুই শুধু একটা কিস দে… তাহলেই সব ক্লান্তি চলে যাবে, জালেমা!
মেহজা মুচকি হেসে গালে গুতা দিয়ে বলে,
— মরতে মরতেও লুচ্চামি করতে হবে, তাই না?
আরভিদ দুষ্টু হেসে বলে,
— বউ যদি এতো হট হয়, তাহলে মরতে মরতেও বাসর করতে ইচ্ছে হয়!
মেহজা দাঁতে দাঁত পিষে হেসে বলে,
— সারাটা শরীরে শুধু কুড়কুড়ানি! আপনার সঙ্গে আইনমন্ত্রীর থেকে ‘কুড়কুড়ানি মন্ত্রী’ নামটাই বেশি যায়!
আরভিদ হেসে বলে,
— সমস্যা নেই। সবার জন্য আমি আইনমন্ত্রী, কিন্তু তোর জন্য আমি শুধুই কুড়কুড়ানি মন্ত্রী। ঠিক আছে, জালেমা?
মেহজা হেসে বলে,
— আমার জন্য পরে কুড়কুড়ানি মন্ত্রী হবেন, জালেম জামাই। আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন। নিচে নিশ্চয়ই আপনার আম্মা অপেক্ষা করছে!
আরভিদ ভ্রু কুচকে বলে,
— মম?
— আরেহ নাহ! আপনার লন্ডনী আম্মা, কৌশালী!
আরভিদ নাক ছিটকে বিরক্ত কন্ঠে বলে,
— ছিহ! তোর এসব কথা বলতে লজ্জা করে না?
— সত্য কথা বলতে আমি মেহজা, লজ্জা পাই না।
আরভিদ কাভার্ড থেকে কাপড় বের করে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে গম্ভীর স্বরে বলে,
— ভালো হয়ে যা, মেহু। নইলে মেরে তোকে ভালো করবো!
— এই সাহস ভুলেও করবেন না। পরে আপনার জনগণের হাতছাড়া মন্ত্রীকে মেনে নিতে কষ্ট হবে।
— দেখা যাবে।
বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। মেহজা গিয়ে সোফায় বসে আরভিদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে।
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের নীরব আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অর্তিহা। চারপাশের নিস্তব্ধতা যেন তার অন্তর্গত অনুভূতিগুলোকে আরও বেশি স্পষ্ট করে তোলে। আজকের রাতটা যেন একটু বেশিই চুপচাপ—আর সেই নিরবতায় অর্তিহার বুকের ভেতরের কষ্টগুলো যেন হঠাৎ করেই বাচাল হয়ে উঠেছে।
তার মনে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে বিকেলের সেই কথাগুলো—সাইহানের বলা প্রতিটি শব্দ। কতবারই তো সে ছেলেটাকে না বলেছে! তবুও সাইহান বারবার ফিরে আসে, নিজের কষ্টকে নিয়ে। অর্তিহার কিছুই করার থাকে না। তার মনে একটা প্রশ্ন ওঠে—সাইহান কি পারে না তাকে ভুলে যেতে? কেন সে বারবার কষ্ট পেতে আসে?
চার পাঁচ বার নক করার পর কোনো সাড়া না পেয়ে মেইড অর্তিহার রুমের দরজার হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দেখে, দরজা খোলা। সে ভেতরে ঢুকে দেখে অর্তিহা রুমে নেই, বুঝতে পারে সে বেলকনিতে। বেলকনির দিকে এগিয়ে গিয়ে অর্তিহাকে দেখে। মাথা নিচু করে মৃদু স্বরে বলে,
— ম্যাম, আভীর স্যার আপনার জন্য নিচে অপেক্ষা করছেন।
অর্তিহা ধীরে বলে,
— আচ্ছা, আপনি যান, আমি আসছি।
মেইড মাথা নেড়ে বেরিয়ে যায়। অর্তিহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে ঢুকে দেয়ালে টাঙানো ঘড়িটার দিকে তাকায়—এখনই তো আদ্রিকের আসার সময়! তার ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে ওঠে। যাবে? নাকি অপেক্ষা করবে? যদি এখন নামে, যদি হঠাৎ করেই আদ্রিকের মুখোমুখি হয়ে পড়ে?
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ে—আদ্রিকের চোখ ফাঁকি দেওয়া যায় না। মোহশৃঙ্খলে সে তাকে বেঁধে রেখেছে— সে তার বন্দিনী, তার লিখে দেওয়া ভাগ্যের পাতায়।
অন্য কারও কাছে হয়তো নিজেকে লুকানো যায়, কিন্তু যার হাতে নিজের নিয়তির রাশ, তার দৃষ্টি এড়িয়ে কোথায় যাবে সে? অর্তিহা ধীরে উঠে দাঁড়ায়। এক নিঃশ্বাসে সব দ্বিধা মুছে দিয়ে লিভিং রুমের দিকে পা বাড়ায়। সে লিভিং রুমে আসতেই দেখে, আভীরর কারদার আর আফির কারদার বসে কথা বলছেন।
সে এগিয়ে গিয়ে আভীর কারদারের পাশে বসে বলে,
— ড্যাড, ডাকছিলে?
আভীর কারদার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে বললেন,
— হ্যাঁ, আজ তো আমার প্রিন্সেসের কোচিং-এর প্রথম দিন ছিল! কেমন গেল?
অর্তিহার মনে পড়ে যায় সাইহানের কথা। এক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি নেমে যায়। তারপর ধীরে বলে,
— ভালো।
ঠিক তখনই ডোরবেল বেজে ওঠে। মেইড দরজা খুলে দেয়। ভিতরে প্রবেশ করে আদ্রিক, পেছনে ড্রাইভার, হাতে আদ্রিকের লাগেজ। আদ্রিকের পরনে হোয়াইট টি-শার্ট, তার উপর কালো লেদারের জ্যাকেট, ব্ল্যাক প্যান্ট আর চোখে গাঢ় সানগ্লাস। যেন কোনও বিলাসবহুল ম্যাগাজিনের কাভার থেকে সদ্য বেরিয়ে আসা এক সুদর্শন চরিত্র।
আভীর কারদার হেসে বলে ওঠেন,
— এই তো, আদ্রিক এসে পড়েছে!
ড্রাইভার লাগেজটা নিয়ে চলে যায় ওপরে, আদ্রিকের রুমে। আদ্রিক এসে সোফায় বসে, হেলান দিয়ে তাকায় অর্তিহার দিকে। তার চোখে একটা ঠান্ডা, গভীর দৃষ্টি—নিঃশব্দে শিউরে ওঠার মতো। আজ ঠোঁটের কোণে নেই সেই চেনা রহস্যময় হাসিটা। অর্তিহার গা কেমন করে ওঠে, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। সে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আদ্রিক ঠান্ডা স্বরে প্রশ্ন করে,
— কোচিং-এ কেমন লাগল?
অর্তিহা নিজেকে সামলে নিয়ে একটা গভীর শ্বাস নিয়ে বলে,
— ভালো।
আদ্রিক আবার প্রশ্ন করে, স্বর ঠিক আগের মতোই,
— কোচিং-এর গেটের সামনের রাস্তা টা পছন্দ হয়েছে তো?
অর্তিহার এবার সত্যিই গায়ে কাঁটা দেয়। সে কি তবে জেনে গেছে? সাইহানের কথা? এবার আর কিছু বলতে পারে না। আফির কারদার আর আভীর কারদার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন আদ্রিকের দিকে। তাঁরা বুঝতে পারছেন না, এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন কেন করছে আদ্রিক। অর্তিহা চুপচাপ তাকায় আদ্রিকের দিকে। আদ্রিক ঠোঁটের কোণে টেনে আনে হালকা অভ্যাসগত হাসি—যা স্পষ্টতই প্রশ্নের চেয়েও বেশি কিছু বলে দেয়।
— যদি পছন্দ না হয়ে থাকে, তাহলে সবকিছু পরিষ্কার করে দিবো?
আফির কারদার ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললেন,
— কি পরিষ্কার করে দিবে?
আদ্রিক অর্তিহার দিকে রাখা অবস্থায় উত্তর দেয়,
— আবর্জনা।
অর্তিহা আচমকা উঠে দাঁড়ায়। তার আচরণে আফির কারদার এবং আভীর কারদার—দুজনেই অনিচ্ছাকৃতভাবে ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে।
আফির কারদার বিস্ময়ের সুরে প্রশ্ন করে,
— কী হয়েছে, প্রিন্সেস? হঠাৎ করে এভাবে উঠে দাঁড়িয়ে গেলে কেন?
অর্তিহা সংযত কণ্ঠে উত্তর দেয়,
— কই, কিছু না তো! আমি একটু রুমে থেকে আসছি।
বলেই দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। আভীর কারদার অর্তিহার চলে যাওয়ার দিকে খানিকক্ষণ সন্দেহভরা চোখে তাকিয়ে দেখে। এরপর সে ধীরে চোখ ফেরায় আদ্রিকের দিকে।
— কিছু হয়েছে?
আদ্রিক স্থিরভাবে আভীর কারদারের চোখে চোখ রেখে বলে,
— হয়নি কিছু। আর হলেও… আমি সামলে নেবো।
বলেই সে উঠে দাঁড়ায়। আর কোনো কথা না বলে সোজা উপরের দিকে পা বাড়ায়। নিজের ঘরে ঢুকতেই আদ্রিক দেখে, অর্তিহা তার বেডে বসে আছে। মুখে কোনও কথা নেই, কিন্তু দৃষ্টি—স্পষ্ট উদ্বেগে ভরা।
আদ্রিক মুচকি হেসে ধীর পায়ে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দেয়। অর্তিহা ধীরে উঠে দাঁড়ায়। আদ্রিক পেছন থেকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। একহাতে কোমলভাবে তাকে আগলে নেয়, অন্য হাতে চুলে আলতো ছোঁয়া দিয়ে ঘ্রাণ নিতে শুরু করে—এমনভাবে যেন সেই চুলের গন্ধই তার একমাত্র আসক্তি।
আয়নায় আদ্রিকের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে অর্তিহা জিজ্ঞেস করে,
— আপনি এত শান্ত কেন?
যদিও সে জানে, আদ্রিক সবসময়ই এমন ঠাণ্ডা স্বভাবের।
আদ্রিক চুলে মুখ গুঁজেই শান্ত গলায় বলে,
— সবকিছু ভাঙার আগে আমি শান্ত থাকি। আবার সব সামলে নেওয়ার পরেও।
অর্তিহা হঠাৎই কেঁপে ওঠে,
— কী… কী সামলাবেন?
এবার আদ্রিক চোখ মেলে সামনে আয়নায় তাকায়। চোখে গভীরতা,
— সব।
অর্তিহা তার চোখে চোখ রাখে। ধীরে বলে,
— এমন হেঁয়ালি করে কথা বলছেন কেন?
আদ্রিক নিঃশব্দে হাসে, সেই চেনা রহস্যময় হাসি,
— আদ্রিক কারদার নামটাই তো হেঁয়ালির আরেক নাম।
অর্তিহা চোখ নামিয়ে নেয়। নিচু স্বরে বলে,
— ভুলে গিয়েছিলাম…
আদ্রিক এবার তাকে নিজের শরীরের সঙ্গে আরও একটু চেপে ধরে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
— আজ আমার বেবিডল নিজে থেকে ধরা দিলো কেন?
অর্তিহা কেঁপে উঠে,
— এমন…এমনি।
নিজেকে আদ্রিকের হাত থেকে আলতো করে ছাড়াতে চাইলো, কিন্তু আদ্রিক ছাড়ল না। বরং তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে চেপে ধরে নিজের সাথে এবং গভীরভাবে চোখে চোখ রেখে বলে,
— প্রতিটা এমনির পেছনে একটা কারণ লুকানো থাকে। এখন বল, তুই কি লুকাচ্ছিস?
অর্তিহা আদ্রিকের চোখে তাকিয়ে কিছুটা ভয় মিশ্রিত কণ্ঠে বলে,
— আপনার থেকে কিছু লুকানোর দুঃসাহস আমি আদৌ দেখাবো?
আদ্রিক হেসে ওঠে,
মোহশৃঙ্খল পর্ব ৪
— তুই তো এর থেকেও বড় দুঃসাহস এর আগে দেখিয়েছিস!
অর্তিহা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
— আর তার ফলস্বরূপ, আপনি আমাকে বন্দীত্বের জীবন উপহার দিয়েছেন!
আদ্রিক গভীর, দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
— “বিশ্বাস কর, তোর দুঃসাহসের পরিণাম এতটাই ভয়ংকর ছিল যে, তার বদলে এই বন্দীত্ব জীবন—এটা খুবই নগণ্য… লিটলহার্ট।”
