যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ১৭

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ১৭
মম সাহা

ঝড়-বৃষ্টির রাত। চারপাশে ছুটে বেড়াচ্ছে বেনামি বাতাস। বহু পুরোনো বটগাছটার ডাল গুলোও কাঁপছে থেকে-থেকে। এমন ঝড় কবে এর আগে হয়েছিল ঠিক মনে করতে পারছে না চিত্রা। জন্মের পর এই বোধহয় প্রথম সে এতটা ঝড় দেখছে। লোহার জানালা গুলো ক্ষণে ক্ষণে এসে কী নিষ্ঠুর শব্দ করে আটকে যাচ্ছে আবার খুলে যাচ্ছে। জানালার বাহিরের অমানিশা মাখানো রাত্তিরের বুকে বৃষ্টি যেন ভয়ঙ্কর তালে ঘুঙুর পরে নাচছে। কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই বজ্রপাত হচ্ছে। মনে হয় যেন ধরণীর বুকটায় আজ বিশাল আকাশ ভেঙেচুরে লুটিয়ে পড়বে।
চিত্রার বাহিরে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই গা হিম হয়ে গেলো। কণ্ঠ বসে এসেছে অবেলার শীতে। ভাঙা ভাঙা স্বরে ভীত আকুতি তার বাহার ভাইয়ের কাছে,

“জানালাটা কি আটকাবেন একটু, বাহার ভাই?”
বাহার ভাই তখন চুলোয় বসানো হাঁড়িটাতে প্রায় হয়ে আসা খিচুড়ি গুলো আরেকবার নেড়েচেড়ে দেখছিলেন। চিত্রার আধ-ভাঙা কণ্ঠে গাঢ় ভাবে তাকালেন চিত্রার দিকে। টর্চের থিতিয়ে আসা আলোয় মেয়েটার ফ্যাকাসে মুখটি বর্ষার ভেজা কদমের মতনই লাগছে। বাহার ভাই হাঁড়িটা ঢেকে দিয়েই জানালা আটকে দিলেন। জানালার ছিটকিনিটায় জং ধরে গিয়েছে বলে ছিটকিনি টানা যাচ্ছিলো না শত চেষ্টাতেও। তার উপর দা ন বের মতন শক্তিশালী বাতাস এসে জানালাটাকে যেন টেনে খুলে ফেলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আটকাতে গিয়ে বেশ বেগ পেতেও হয়েছিলো তাকে। হাতটাও কিছুটা কেটে গেলো বোধহয়!
চিত্রার শঙ্কিত দৃষ্টি এক মুহূর্তেই বদলে গেলো মায়ায়, উৎকণ্ঠায়। আঁতকে উঠল তার গলার স্বর,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কেটে গেছে তো হাতটা!”
“কিছু হবে না। ওদিক বুক ফেটে ফালা-ফালা তুমি করো হাতের চিন্তা!”
কথাটা বলেই থেমে গেলেন লোকটা। তেমন পাত্তা দিলেন না সেই কেটে যাওয়াতে। বরং দ্বিতীয় চুলোয় বসানো চায়ের ছোট্টো পাতিলটা নামিয়ে চা ঢেলে এগিয়ে দিলো চিত্রার দিকে। চিত্রাকে রান্নাঘর থেকে টেনে নিয়ে বসালো তাদের ছোট্টো কাঠের ডাইনিং টেবিলটায়। একটি আধ-ভাঙা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলো চারপাশের অন্ধকার দূর করার জন্য।
চিত্রা মৃদু মৃদু শীতে একটু আরাম পাচ্ছে। যদিও কিছুটা ঠান্ডাও লাগছে তার। বাহার ভাইকে সামনের চেয়ারটায় বসে থাকতে দেখেই চিত্রার কিছুক্ষণ আগের কথোপকথনের কথা মনে পড়ে গেলো। আবার শুধালো,
“আপনি কেন বললেন আপনি জেল খেটেছেন? আর আমার বাড়ির লোকই বা কী করেছে, বাহার ভাই? আপনি কথা একটু খুলে বলতে পারেন না?”

বাহার ভাই সিগারেট ফুঁকতে শুরু করেছিলেন ততক্ষণে। চিত্রার প্রশ্নে চিত্রার দিকে ছোটো ছোটো চোখে তাকালেন। নাক দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন,
“খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজাতেই চলবে তো তোমার? ওহ্, আচারও আছে মনে হয়!”
বাহার ভাইয়ের স্পষ্ট কথা ঘুরানোর প্রয়াসে ক্লান্ত শ্বাস ফেলল চিত্রা। নাক-মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে ফিরে বলল,
“আমি কিছুই খাবো না। বৃষ্টিটা কমলেই বাড়ি ফিরবো।”
“বৃষ্টি কমার জন্য আর অপেক্ষা করছো কেন? এখুনি চলে যাও! তোমাকে তো নিমন্ত্রণ করে আনিনি!”
চিত্রা ভ্যাবাচেকা খেলো এই কণ্ঠে! সেই পুরোনো গলার স্বর! সেই পুরোনো বেপরোয়া টান টান বাচনভঙ্গি। কোনো অস্পষ্টতা নেই, কোনো ছল নেই। যেন রুষ্ট হয়ে আছে তার শব্দ কণিকারা।
চিত্রাও হেরে যাওয়ার পাত্রী নয়। সে-ও দ্বিগুণ শক্ত কণ্ঠে বলল,
“চলে যাবো। আমাদের বাড়িটা পুরো অন্ধকার হয়ে আছে সেজন্যই তো এখানে এসেছি। নয়তো আমার কোনো শখ নেই এখানে এসে বসে থাকার।”

বাহার ভাই অনবরত পা নাড়াচ্ছেন। সিগারেটের আগুনটা জ্বলছে জোনাকির ন্যায়। বললেন,
“আগে তো ঠিকই অনেক শখ ছিলো!”
চিত্রার শক্ত করে ধরে রাখা মুখের আদল ঝুকে যায় খানিক। লোকটা তাকে আবারও কড়া কথা বলছে? এত সাহস! এখানে এসব কথা শোনার চেয়ে নিজের বাড়ির অন্ধকারে থাকাটাই ভালো ছিলো। ভূত পেত্নী যা-ই আসুক অন্তত সম্মান নিয়ে তো মরতে পারতো?
রাগে-দুঃখে এবং লুকিয়ে থাকা গভীর অভিমানে চিত্রা উঠে দাঁড়ালো। চায়ের কাপটা শব্দ করেই রাখলো টেবিলটার উপরে। পা বাড়াতে নেয় চঞ্চল চড়ুইয়ের মতন। অথচ তার পা জোড় আটকে দেয় লম্বা পুরুষালী পা-টি। চিত্রা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। তেজ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“সমস্যা কী? যেতে দিচ্ছেন না কেন?”
বাহার ভাইয়ের সিগারেটটা শেষ ততক্ষণে। তিনি সেটা নিভিয়ে ছুঁড়ে মারলেন ময়লা ফেলার বিনটাতে। পার্ফেক্ট নিশানায় সেটা গিয়ে পড়লো বিনে।

“এসেছো নিজের ইচ্ছেতে আর যাবে আমার ইচ্ছেতে। তাই যেতে দিচ্ছি না।”
খ্যাপে গেলো চিত্রা, “মগের মুল্লুক নাকি! আপনি যা বলবেন তা-ই শুনতে হবে?”
“যদি না-ই শুনবে তো আগেই বলতে। এত কষ্ট করিয়ে রান্নাটা কেন করালে? প্রথমেই বলতে তুমি খাবে না। এখন যেহেতু রেঁধেই ফেলেছি, খেয়েই যেতে হবে।”
“আমি যেমন রাঁধতে না করিনি তেমন বলিনি যে আমি খাবো রান্না করুন। তাহলে আপনার রান্না করা কৃতিত্বের কোনো দায়ভার আমার নয়।”
“নীরবতাই সম্মতির লক্ষ্মণ, মেয়ে। তাই চুপচাপ বসে যাও। এত অবাধ্য হইও না। ফুলের দেহে অবাধ্যতা বড্ড বেমানান।”
চিত্রা নিশ্চুপে আবার বসে পড়লো চেয়ারটাতে। দৃষ্টি তার উদাস। কণ্ঠে শত সহস্র বছরের বৈরাগ্যতা। শুধালো,

“আমায় ছেড়ে কেন গিয়েছিলেন, বাহার ভাই?”
এতক্ষণের চতুরতা, নিবিড় হাসি ছুটে বেড়ানো মানুষটার চোখ-মুখ কেমন কালো মেঘে নিভে এলো। সে উঠে গেলো চেয়ারটি ছেড়ে। চিত্রা হাসল,
“আমার ভাই বনফুলের সাথে যা করেছিলো তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য?”
বাহার ভাই জবাব দিলেন না। নিঃশব্দে মিলিয়ে গেলেন সামনের অন্ধকার রুমটিতে। চিত্রার বহুদিন পর ষোড়শীর মতন বুকে অভিমান জমতে শুরু করলো। চোখে চিকচিক করলো বাঁধনহারা অশ্রু। বেশ জোরেই বলল,
“তাহলে কি আপনার এই নীরবতাকেই সম্মতির লক্ষ্মণ ধরে নিবো এবার?”
অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়া বাহার ভাইয়ের কণ্ঠ রইলো গম্ভীর, নিশ্চুপ। চিত্রার সে কি কান্না এলো চারপাশ ভেঙে! টেবিলের উপর মুখ ঢেকে চিত্রার সমস্ত অভিযোগ ঝড়ের মতন তাণ্ডব হয়ে নেমে এলো কণ্ঠে,

“আপনি আমার সাথে এমন কেন করেছেন বাহার ভাই? আপনি জানেন না আমার কত নরক গিয়েছে এ জীবন। আপনি কেন এমন ভাবে ভেঙে ছিলেন আমাকে? আমার কী দোষ ছিলো? আপনি জানেন না আমি কতবার মরতে চেয়েছিলাম আপনার বিরহে! আপনি তো জানতেন রঙ্গনা আপনাকে ছাড়া কেমন ভেঙে যেতে পারে তবুও কেন রঙ্গনাকে এমন শাস্তি দিলেন? এমন যন্ত্রণাই বুঝি প্রাপ্য ছিলো আমার? হসপিটালে হিসাব করে আমার কত আয়ু ফুরিয়েছি আপনি কখনো বুঝবেনও না সেটা।”
চিত্রার আকুতি ঝড়ের দাপটে পাল্লা দিয়ে বাড়লো। কাঁপছে মেয়েটার শরীর। কীভাবে কাঁদছে মেয়েটা!
হুট করেই ও অনুভব করলো ওর কোলে একটি মাথা গুটিশুটি মেরে শুয়েছে। চিত্রা থমকে গেলো। এই ছোঁয়া, এই পরিচিত গায়ের সুবাস ওর বড়োই আপন, বড়োই জানা। চিত্রা ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকালো। তার অর্ধ ভেজা জামাটার কোলের কাছটায় হাঁটু গেড়ে মাথা এলিয়ে রেখেছে বাহার ভাই। যা কল্পনাতেও আসে না সেই দৃশ্য এখন চিত্রার চোখের সামনে ঘটছে। চিত্রা থমকে গেলো ঠিক। লোকটার কোঁকড়া চুল গুলো চুইয়ে জল পড়ছে। মুখটা ঠিক বুঝা যাচ্ছে না! এ কোন বাহার ভাই! হঠাৎ করে মানুষটার হলোই বা কী?
চিত্রার কোলেই মাথাটা রেখে বাহার ভাই চিত্রার হাতটা টেনে নিলেন। ছোটো হাতটা চেপে ধরলেন নিজের মুখে। পৃথিবী সমান আকুতি নিয়ে বললেন,

“আমায় ক্ষমা করে দিও, রঙ্গনা। আমি তোমার দুঃখ হতে চাইনি। এই তামাম দুনিয়া আমি তোমার জন্য ভেঙে দিতে প্রস্তুত ছিলাম তবুও তোমার দুঃখ হতে প্রস্তুত ছিলাম না। আমারে যে অসময় শেকলে বেঁধে দিয়ে ছিলো। আমি কী করতাম বলো? তোমার এই হাতের রগটার জায়গায় যতবার কাটা দাগটা দেখি ততবার নিজেকে ভেঙেচুরে দিতে ইচ্ছে করে। তুমি এমন অবুঝ কেন, রঙ্গনা? তুমি তো জানতে আমি যেভাবেই হোক ফিরে আসবো তবে কেন নিজেকে এমন যন্ত্রণা দিলে? এই বুঝি তোমার বিশ্বাস ছিলো? এই ছিলো তোমার ভালোবাসা? যাকে ভালোবাসলে তাকে তো তুমি চিনলেই না, রঙ্গনা! তার কাছে যে তুমি পুরো পৃথিবী এই কথা তুমি একটি বার বুঝলে না? এই মরণ যন্ত্রণা আমি কীভাবে বুকে পুষে রাখি? আমারও তো ক্লান্ত লাগে! আমারও যে মন ভাঙে তোমরা কেন সেটা বুঝো না? কেন বুঝো না, প্রতিশোধের ধর্ম প্রেমিকের নেই? আমায় তুমি কেন বুঝলে না, রঙ্গনা? কেন তুমি আমার রঙ্গনাকে এমন কাতরে কাতরে মারতে চেয়েছিলে? এই দুনিয়ায় সবার সাথে আমি যু দ্ধ করেছি তোমায় পাওয়ার লোভে অথচ দেখো….. তুমিই কি-না শেষমেশ আমাকে চিনলে না! এই ব্যথা আমি কই লুকাবো? কারে দেখাবো বলো?”
লোকটার কণ্ঠ কাঁপছে। চিত্রা অনুভব করলো বাহার ভাইয়ের মুখে ধরে রাখা তার হাতটি ভিজে যাচ্ছে। বাহার ভাই কাঁদছেন? বেপরোয়া বাহার কাঁদছেন! কতটা দুঃখ পেলে পাথরের মতন মানুষও এমন অভিযোগ করে? কতটা দুঃখ পাওয়ার পর মানুষ এমন অসহায়ের মতন মূর্ছে পড়ে? এতটা দুঃখ নিয়ে মানুষটা এতদিন কোনো অভিযোগ ছাড়াই দিব্বি ভালো থাকার অভিনয় করে গেছেন। কেন?

অহির গালের সাথে গাল মিশিয়ে বসে আছে হুমু। মেয়েটা বড়ো হয়েছে। আধো আধো কথা এখন স্পষ্ট হয়েছে। কী সুন্দর দেখতে হয়েছে! চেহারাতে এখন মায়ের একটা ছাপ পাওয়া যায়। মেয়েটা মায়ের মতনই দেখতে হয়েছে। অহিকে পেয়ে এতটুকু মেয়েটারও যেন আনন্দ ধরে না। অত ছোটো বয়সে কয়েকদিন দেখা একটি নারীকে এতদিন যাবত বাচ্চাটা মনে রেখেছে। আত্মার টান না হলে কি আর সম্ভব হতো এটা?
নওশাদের মা রান্নাঘরে ছিলেন। তাকে সাহায্য করছে কাজের খালা। নওশাদদের ছোটো পরিবার। নওশাদের মা অহির জন্য রান্না করছেন। অহি নিষেধ করেছে, বাড়ি ফেরার তাড়ার কথাও জানিয়েছে কিন্তু লাভ আর হলো কই? এই ঝড়ে ঘরের বাহিরে যাওয়া অসম্ভব প্রায়!

তার মাঝেই ভদ্রমহিলা উপস্থিত হলেন ড্রয়িং রুমে। অহির সাথে বসে আছে হুমু। নওশাদ বিপরীত সোফাটায়। এতদিন পর দেখা হয়েছে ছেলেমেয়ে গুলোর নিশ্চয় তাদের মান-অভিমান মেটানোর জন্য একটা সুযোগ দরকার। আপন মনে কথাটি ভেবেই নাতনিকে ডাকলেন তিনি। চোখের ইশারায় ছেলেকে বুঝালেন ভুল বুঝাবুঝি মিটিয়ে নিতে।
নওশাদদের ফ্লাটেও বিদ্যুৎ নেই। জেনারেটরও দিচ্ছে না। এত বৃষ্টি দেখে হয়তো কোনো সমস্যা হয়েছে! হুমু যেতেই অহি গুটিশুটি মেরে বসে রইল। অপরাধবোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে ভেতরটা। যদিও এ অব্দি নওশাদ কিংবা কেউই জিজ্ঞেস করেনি তার এই দীর্ঘতম দূরত্বের কী কারণ। তবে জিজ্ঞেস তো নিশ্চয় করবেই। তখন অহি কী জবাব দিবে? একটা মিথ্যেকে বিশ্বাস করে সে এতটা দূর গিয়েছে এটা আদৌ বলা শোভনীয়? আর তাছাড়া নওশাদের মনটাও নিশ্চয় বাজে ভাবে আঘাত প্রাপ্ত হবে! তাকে এক ফোঁটা বিশ্বাস না করার জন্য সে নিশ্চয় অহিকে ক্ষমা করবে না কখনো।

মনের ভেতর চলা ঝড়কে অহি থামাতে পারছে না। এই অব্দি চলে তো এসেছে কিন্তু এখন? কীভাবে নিজের এমন দোষের কথা বলবে?
নিজেকে মনে মনে বোঝালো অহি। যেই দোষের জন্য অপরপক্ষকে সে এতবছর বিরহ বেদনায় রেখেছিল সেই দোষ অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। নওশাদ যে শাস্তি দিবে তা না-হয় মাথা পেতেই নিবে সে! যে-ই না নিজেকে ধাতস্থ করে কথা বলতে নিবে ঠিক সেই মুহূর্তেই নওশাদ কথা বলল। কথা নয় বলা যায় প্রস্তাব দিলো,
“আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।”
আচমকা এমন প্রস্তাব মরুর বুকে বৃষ্টির মতনই অপ্রত্যাশিত ছিলো। অহি থতমত খেয়ে গেলো যেন। শুনতে ভুল করেছে ভেবে অস্ফুটে বলল, “কী?”
“আমি বিয়ে করতে চাই আপনাকে। আপনি কি রাজি?”
অহি উত্তর দেওয়ার ভাষা পেলো না। এতদিন পর অহিকে পেয়ে নওশাদের নিশ্চয় প্রশ্ন করা উচিত ছিলো কেন অহি এমনটা করলো। হম্বিতম্বি করাও উচিত ছিলো। অভিযোগ করা উচিত ছিলো। অভিমান করার উচিত ছিলো। তা-না করে লোকটা বিয়ের কথা বলছেন?

অহি থমকে যাওয়া স্বরে বলল, “আমি কেন দূরে গিয়েছি সেটা শুনবেন না? জানতে চান না?”
“সেটা জানার হলে দরজার বাহিরে দাঁড়ানো আপনাকে প্রথমেই আমার মা জড়িয়ে ধরতো না! আগে জিজ্ঞেস করতো কেনো এই দূরত্ব তৈরি করা হয়েছিলো।”
“তাহলে কি জানতে চান না কেন আমি চলে গিয়েছিলাম?”
“না, চাই না। আমি কেবল জানতে চাই আপনি আমাকে বিয়ে করবেন কিনা?”
অহি এই মুহূর্তে কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। রান্নাঘর থেকে নওশাদের মায়ের কণ্ঠ ভেসে এলো,
“শাশুড়ি হিসেবে আমি মন্দ নই। হ্যাঁ বলে দাও।”
অহি নওশাদের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো। নওশাদ এবার উঠে এলো, বসলো অহির পাশটায়। অহির হাতটা দৃঢ় ভাবে টেনে নিয়ে কিছুটা ধীর, শান্ত স্বরে বলল, “আমি আর আপনাকে চলে যেতে দিবো না। এই যে ধরলাম, আর ছাড়ছি না।”
এমন একটা উষ্ণ অধিকার বোধ, পোক্ত হাতের অভাবেই তো অহি ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছিলো এত বছর! আজ সেই হাতটা পেয়েও কীভাবে ছেড়ে দিবে সে? এমন ভালোবাসা পাওয়ার লোভ কি ছাড়া যায় আদৌ?

জীবনের দোলাচালে চলে যাওয়া অতীত দোলনচাঁপার মতন সুন্দর, চাপা সুঘ্রাণ ছড়ায়। কখনো বা বেদনার ঝরা বকুল হয়ে করুণ আকুতি ছড়িয়ে দেয় জীবনের চারপাশটায়। চাঁদনীর অতীত এতদিন ঝরে যাওয়া বুকলের মতনই আর্তনাদ ছড়ালেও আজকাল আর তা মেয়েটার আত্মা অব্দি আসতে পারে না। আষ্টেপৃষ্টে শেষ করে দিতে পারে না মেয়েটাকে। হুট করেই যেন ও ভীষণ শক্ত হয়ে গেলো। যতটা শক্ত হলে কোনো আর্তনাদ জানালার কাছটায় এসে বিষাদ ছড়াতে পারে না ততটা।
কলিংবেল বেজে উঠল ফ্ল্যাটের। চাঁদনী সদ্য স্নান সেরে বেরিয়েছে। চুল গুলো ভেজা। গিয়েই দরজা খুলল। পার্সেল এসেছে। একটি ফুলের তোড়া। চাঁদনী পার্সেলটি সংগ্রহ করলো। ফুলের উপর থাকা সাদা রঙের কার্ডটি নিয়ে খুলতেই ইংরেজিতে লিখা ‘সরি’ শব্দটি জ্বলজ্বল করল চোখের সামনে।

চাঁদনী বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলো এই কাজটি কে করেছে! এই দেশে এসে নানান উপায়ে, নানান ভাবে সরি তো একজনই বলেছে! আজকেরটাও হয়তো সে-ই করেছে!
চাঁদনী ফুলের তোড়াটা রেখে দিলো নিজ স্থানে। যেই সরি ব্যথার দাগ, কলঙ্কের কালি মুছতে পারে না সেই সরি দিয়ে কী করবে সে? তার দিনগুলো কি আদৌ ফেরাতে পারবে? পারবে শত রাত জেগে থাকার বেদনা গুলো ভুলে যেতে?
চাঁদনী ফোন তুলে নিলো। মৃন্ময়কে ছোটো করে মেসেজ দিলো। নিজের মনে মনে ভেবে রাখা পরিকল্পনাটি নিয়ে সে আরও ভাবতে শুরু করলো। দ্বিতীয়বার সে কাকে সুযোগ দিবে তা নিয়ে ভেতর ভেতর কত তর্ক-বিতর্ক চললো! কথায় আছে না, কাঁটার আঘাত পাওয়ার পর মানুষ ফুল দেখলেও মূর্ছা যায়! চাঁদনীরও অবস্থা হয়েছে তা।

নিরুর বৃষ্টি পছন্দ ছিলো। বৃষ্টি দেখলেই ছুটে যেতো ভিজতে। মেয়েটার যেন কী এক আলাদা টান ছিলো এই বৃষ্টির সাথে। আজও কি ভিজছে ও? এতদিন তো সে তুহিনকে বৃষ্টির সঙ্গী হিসেবে পেতে মরিয়া হয়ে থাকতো এখন কাকে সঙ্গী হিসেবে নিয়েছে? নিশ্চয় নিজের স্বামীকে! ওর স্বামী কি বৃষ্টিতে ভিজে? নাকি তুহিনের মতনই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, বৃষ্টির পানিতে ঠান্ডা লেগে যায়! বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে আজ তুহিনের।
এতদিন পর তুহিন একটু ছেলেমানুষি করলো। সাত-পাঁচ না ভেবেই কল দিয়ে বসলো নিরুর ফোনে। রিং হতেই বুকের ভেতর উত্তেজনা হামাগুড়ি দিতে লাগলো। সেই প্রথম প্রেমে পড়ার মতন উত্তেজনা। মনে মনে একটি নিষ্ঠুর ভাবনা ভেবে খুশি হতে লাগলো। তার প্রেমিক অহংকারী স্বত্বাটা আনন্দিত হলো এ-ই ভেবে যে নিরুর স্বামী নিরুকে তুহিনের মতন ভালোবাসতে পারেনি।
তুহিনের কলটি রিসিভ হলো। অপরপাশ থেকে একটি অপরিচিত কণ্ঠ ভেসে এলো,

“কে?”
তুহিনের উত্তেজিত স্বত্বা তখন কিছুটা থামলো। চাপা স্বরে বলল,
“নিরু কোথায়?”
“ভাবি! ভাবি তো ছাঁদে গিয়েছে ভাইয়ার সাথে। আপনি একটু পরে কল দিয়েন।”
ব্যস্ত ভাবে কথাটি বলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো অপরিচিত কণ্ঠটি। তুহিনের উত্তেজনায় হঠাৎ ভাঁটা পড়ে গেলো! মনে মনে সে যেই পৈচাশিক আনন্দ পাচ্ছিলো এতক্ষণ সেটা যেন নিমিষেই মিইয়ে গেলো। নিরুর স্বামী নিরুর এই অতি আকাঙ্খিত আবদারটিও পূরণ করে ফেলেছে ভেবেই তার দর্পচূর্ণ হয়ে গেলো। তার মানতে যদিও কষ্ট হচ্ছিলো তবে এই দুনিয়া তাকে বুঝিয়ে দিলো যে কারো শূণ্যতা দুনিয়া রাখে না।

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ১৬

তুহিন দূরে ছুঁড়ে মারলো ফোনটি। নিজের ভাবনায় নিজেই ঘৃণা ছুঁড়ল! নিরুকে সুখী হতে দেখে তার ভিতরে যেই হিংস্র ভাবনার জন্ম হয়েছে সেই ভাবনার প্রতি নিজেই ক্ষুব্ধ হলো তুহিন।
ভালোবাসা যে এক অসংজ্ঞায়িত অনুভূতি তা ও ক্ষণে ক্ষণে টের পাচ্ছে! এজন্যই বনফুল এমন ছন্নছাড়া হয়েছিলো আর চিত্রা গিয়েছিলো মরতে। ভালোবাসা যে কী ভয়ংকর বিষ তা বিচ্ছেদ না হলে আদৌ বুঝতো!

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ১৮