যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২৮

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২৮
মম সাহা

চিত্রা এসেছে শাহবাগের মোড়ে ফুল নিতে। বিয়ের গেইটের ফুল গুলো তেমন তরতাজা নেই। আজকেই প্রায় নেতিয়ে এসেছে। আগামীকাল বিয়ে। ততক্ষণে এই ফুল আর পরিস্ফুটিত থাকবে না। তাই সে আর অহি এসেছে ফুল দেখতে। সাথে সওদাগর ভিলার গাড়ি ও ড্রাইভারও আছেন। চিত্রাদের কাজ কেবল ফুল পছন্দ করা।
ফুল কেনা প্রায় শেষ। এর মাঝেই হুট করে এসে একটি বাচ্চা হাত জড়িয়ে ধরল অহিকে। অহি কিঞ্চিৎ ভড়কে গেলো। এই মানুষের গমগমে স্থানে তাকে কেউ জড়িয়ে ধরছে সেটা যে অপ্রত্যাশিত ছিলো। অহি বাচ্চা হাত গুলোর দিকে তাকিয়েই আঁচ করে ফেলেছে হাত দু’টো কার। পেছনে ফিরতেই দেখে হুমু তাকে জড়িয়ে ধরে ফোকলা দাঁতে হাসছে।
চিত্রাও হুমুকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। বাচ্চাটার গাল ধরে টেনে দিল। উৎসাহিত কণ্ঠে বলল,

“আরে আমাদের রাজকন্যা যে! এখানে কেনো শুনি? কার সাথে এসেছো?”
হুমুর ফোকলা দাঁতের হাসি বিস্তৃত হলো। আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখালো সোজা। বরাবর দাঁড়িয়ে হাসছে সুপুরুষ নওশাদ। সুন্দর মুখটা একটু হলদেটে লাগছে। গতকালকের হলুদের আভাস এখনো তার দেহ জুড়ে বিচরণ করছে।
অহি চশমা ঠেলে চোখ ঘুরিয়ে নিলো। বিয়ের জল গায়ে পড়তেই কি লোকটা এত বেশি সুন্দর হয়ে গেছে কিনা কে জানে? আগের চেয়েও যেন লাবণ্য বেড়েছে চেহারার।
চিত্রা গলা খাঁকারি দিয়ে উঠল। আগ বাড়িয়ে নওশাদকে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার দুলাভাই, এখানে যে? ছোটো আপা আসতে বলেছে নাকি?”
নওশাদের উত্তরের আগেই অহি চোখ গোল গোল করে তাকালো। নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে নির্দোষ প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“না তো, আমি ডাকবো কেন!”
“নিজের মানুষকে দেখতে চাইতেই পারো, আপা। অস্বীকার করার কী আছে?” চোখ টিপে হাসল চিত্রা।
অহির অবস্থা তখন নাজুক। মেয়েটা লজ্জা লজ্জা মুখটি নামিয়ে ফেলল। গালে লালচে আভা ফুটে উঠল ঈষৎ লজ্জার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে।
নওশাদ সবসময় প্রেমিকার ছায়া হতে পছন্দ করে। প্রেমিকার সমস্ত লজ্জা ঢেকে দিতে চায় নিজের সবটুকু দিয়ে। আজও বা বাদ যাবে কেন? তাই তো পরবর্তী কথাটি সে বলল। জবাব দিলো,
“চিত্রা আপু, তোমার আপু তো জানায়নি আমাকে সে যে এখানে আসবে। আমি হুমুকে একটু ঘুরাতে নিয়ে এসেছিলাম। বাচ্চাটা বায়না করছিল। তোমার আপা আমাকে দূরে সরিয়েই তো কূল পায় না। কাছে আর কী ডাকবে!”
অহি ভেংচি কাটলো। চিত্রার বড়ো আনন্দ হলো দু’জনের এমন প্রেম দেখে। সে দু’জনকে আলাদা সময় দেওয়ার জন্য তড়িঘড়ি করে বলল,

“আচ্ছা আচ্ছা তোমরা কথা বলো, আমি আসছি। ওখানে সামনে আমার একটা কাজ আছে।”
কথাটি বলেই খুব দ্রুত হেঁটে সেখান থেকে সরে গেলো সে।
চিত্রা যেতেই অহি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। সন্দিহান কণ্ঠে বলল, “আমি শাহবাগ আসছি সেটা আপনাকে বলে ছিলাম না? আপনি জেনে-বুঝেই এসেছেন তাই না?”
নওশাদের ফরসা মুখের চোখের উপরে থাকা ঘন, কালো, মোটা ভ্রু খানিক কুঞ্চিত করে বলল, “হ্যাঁ, জেনে-বুঝেই এসেছি। নিজের বউকে দেখতে এসেছি। কোনো পাপ করিনি, হুহ্!”
কথাটি বলল কত গর্বের সাথে। যেন সে এখানে এসে রাজ্য জয়লাভ করে ফেলেছে। পৃথিবীর সমস্ত গৌরবের কাজ করা তার শেষ।
এদিকে অহি লজ্জায় প্রায় জুবুথুবু। হুমু মেয়েটা কী বুঝলো কে জানে? হেসে প্রায় কুটিকুটি। মুখে হাত চেপে হাসছে রীতিমতো। অহি দাঁত কিড়মিড় করল, হুঁশিয়ারি স্বরে বলল,

“কী বলছেন! হুমু আছে তো।”
“থাকুক হুমু। সত্যি বলতে ভয় কীসের? আমি এখানে চ্যাঁচিয়ে বলতে পারবো যে আপনি আমার বউ। বলবো? বলি?”
অহি এই পাগলাটে লোকটাকে নিয়ে কোথায় যাবে? অবশেষে না পেরে সে মানুষটার মুখ চেপে ধরল।
রাস্তার একদিকে, একদম কোণায় দাঁড়িয়ে আছে চিত্রা। বড়ো আপাকে ভিডিও কল দেওয়ার জন্য ফোনটা অন করেছে। এত মিষ্টি প্রেমের কথা বড়ো আপাকে না বললে তার আবার পেটের ভাত হজম হবে না।
হোয়াটসঅ্যাপে আপার আইডিটাতে ঢুকে কল দেওয়ার পূর্ব মুহূর্তেই একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর চিত্রাকে ডেকে উঠল,
“চিত্রা আপি না?”
ডাক শুনে কিছুটা কৌতূহল নিয়ে চিত্রা পেছনে ফিরতেই দেখল সেই পরিচিত অল্পবয়সী মুখটি। সদা হাসিতে জ্বলজ্বল করা মুখটি। ফুরফুরে চঞ্চলতা যার অঙ্গ জুড়ে কেবল মি সা ই লের বেগে ছুটে বেড়ায়।
চিত্রাও মেয়েটার হাসির সাথে তাল মেলায়। উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে,

“তমসা না?”
“তমু। আপন মানুষদের জন্য আমি তমু। তমসা তো পর মানুষের জন্য। ” কথাটি বলতে বলতে মেয়েটি এগিয়ে এলো। একদম চিত্রার সামনে। কাছাকাছি।
চিত্রা তমসার গালে আলতো হাত বুলিয়ে দেয়। স্নেহ ভরা কণ্ঠে বলে, “কতদিন পর তোমার সাথে দেখা হলো! তোমার ফোন নাম্বারটা নেই যে যোগাযোগ করবো। কেমন আছো? কোথায় হারিয়ে গিয়েছো? আজকাল দেখাই করতে আসছো না যে!”
তমসার হাসি দৃঢ় হয়। সে চিত্রার দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে চঞ্চল কণ্ঠে শুধায়, “আমায় মিস করেছিলে বুঝি?”
“হ্যাঁ, করেছিলাম। এত সুন্দর মেয়েকে মিস না করলে হয়?”
“যাক, আমাকেও তাহলে মিস করার কেউ আছে! তুমি ভীষণ ভালো আপু।”
চিত্রা তমসার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মায়াময় স্বরে বলে, “বাড়ি আসো না কেন?”
“কীভাবে আসবো শুনি? পরীক্ষা দিতে দিতে তে হয়রান হয়ে যাচ্ছি। সামনে ফাইনাল এক্সাম। প্রিপারেশনে ভীষণ ব্যস্ত তো!”

“ভালো করে প্রিপারেশন নিও। আর মাঝে মাঝে দেখা দিও।”
“দেখা তো দিতে পারব না আর। দেখা দিতে গেলে যে আমার বুকটা ব্যথায় কেমন করে!”
তমসার কথার আগাগোড়া না বুঝে চিত্রা কপাল কুঁচকে ফেলল। প্রশ্ন করল,
“বুক ব্যথা? হয়েছে কী?”
“ঐ যে, তোমার বাড়ির বরাবর যে স্যারের বাড়ি! তোমায় দেখতে গেলেই তো স্যারের বাড়ির দিকে আমার তাকাতে ইচ্ছে করে। চোখ গুলো কেবল এদিক-সেদিক ঘুরে স্যারকে দেখার জন্য। জেনেশুনে এমন পাপ কি করতে পারি বলো?”
তমসার কথার সারমর্ম কিছুটা বোধহয় চিত্রা আঁচ করে ফেলল। তবুও ভালো করে বুঝার জন্য বলল,
“পাপ? কীসের পাপ?”
“এই যে চিত্রা আপুর পুরুষমানুষকে দেখতে চাওয়ার পাপ। বয়স আমার অল্প হতে পারে কিন্তু আমি বো কা না আপু।”
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল চিত্রা। স্তব্ধ হয়ে আমতা-আমতা করে বলল, “কী বলছো?”

“আমার আজ বড্ড তাড়া, আপু। আরেকদিন বলবো দেখা হলে। শুধু বলি, তোমার মতন অমন করে কি স্যারকে কেউ ভালোবাসতে পারবে বলো? কারো সাহসই হবে না। যেখানে তোমর মতন একজন ভীষণ ভালোবাসতে পারা মানুষ আছে সেখানে বাকি সবার ভালোবাসা ফিকে। সবাই কি আর চিত্রার মতন উদার হতে পারে নাকি! তবে যাই হোক, স্যারকে একটু আগলে রেখো, আপু। মানুষটার বোধহয় তোমার উপর ভীষণ মায়া। আমাকে পড়ানো অব্দি ছেড়ে দিলো! যদি তার চিত্রার মনে দুঃখ হয় তাই। অর্থ অভাবে থাকবে সে তবুও প্রেমিকার সুখের অভাব হতে দিবে না। আজ যাই, আপু। ভালো থেকো।”
কথা শেষ করেই বিদায় না নিয়েই মেয়েটা চলে গেলো। যেন রাজ্যের তাড়া আছে ওর৷ এখনই না গেলে কোন রাজকার্য শিকেয় উঠবে।
চিত্রা কেবল সেই প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে রইল। এই ছোটো জীবনে এমন সুখ-দুঃখ মেশানো ঘটনা গুলো কী ভীষণ বুক ভার ভার করে দেয়!
একদিকে তমসা মেয়েটির জন্য মায়া লাগলেও, অন্যদিকে সুখ অনুভব হচ্ছে। এ কেমন অনুভূতির দোলাচল!

গায়ের হলুদ অনেক রাত অব্দি উদযাপিত হওয়ায় আজ বেশিরভাগ মানুষই ঘুমাচ্ছে। সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছে। তবে বাড়ি কর্তীরা কাজ করছেন। একটি বিয়ে বাড়িতে কি আর কম কাজ আছে?
রোজা সওদাগরের মুখটি ভীষণ বেজার। মন খারাপ ছোঁয়াচে রোগ। তাই তার সন খারাপ ছুঁয়ে দিয়েছে বাকিদেরও। অবনী বেগম আর মুনিয়া বেগম তো কিছুক্ষণ পরপরই থেকে-থেকে জিজ্ঞেস করছেন, কী হয়েছে। কিন্তু রোজা সওদাগরের তেমন উত্তর নেই। বারংবার কথা ঘুরিয়ে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা তার ভেতর।
অবশেষে মুনিয়া বেগমই মুখ ফুটে বললেন,

“চাঁদনীটার কথা মনে পড়ছে, তাই না বড়ো আপা?”
মায়ের নরম মন সন্তানের কথা শুনতেই টলে উঠল। চোখে অশ্রু দেখা দিলো স্বচ্ছ।
তিনি তবুও কম্পনরত কণ্ঠটি চেপে চেপে জবাব দিলেন, “তা তো একটু পড়বেই।”
“চিন্তা করবেন না, বড়ো আপা। মেয়েটা ভালোই আছে হয়তো।”
মায়ের প্রাণ শঙ্কায় শুকিয়ে আসে। সত্যিই কি তার মেয়ে ভালো আছে? ভালো থাকলে কেউ যাযাবর হতে চায়? জীবন কাটাতে চায় একাকী? নিঃসঙ্গতা কি ভালো থাকা মানুষ চায়? চায় না। ভেতর ভেতর প্রচণ্ড ভেঙে না পড়লে কে একা বাঁচতে চায়? ঘরে ফিরলে একটা হাসি মুখ দেখতে পাবে না, জ্বর হলে কেউ মাথার কাছটায় বসে থাকবে না, একটু কথা শোনার কেউ থাকবে না… এমন জীবন সুখী মানুষ আদৌ চায়? এমন নরক কেউ স্বেচ্ছায় বেছে নেয়? নেয় না। অথচ তার মেয়েটা তো নিয়েছে। স্বেচ্ছায় একা থাকার মতন বিবাগী জীবন বেছে নিয়েছে। কতটা ভাঙার পর মানুষ আর জোরা লাগতে চায় না?

ততটাই বোধহয় ভেঙেছে মেয়েটা।
মায়ের মনের ভেতর থেকে নীরবেই বেরিয়ে আসে একটি দীর্ঘশ্বাস। বেনামি এই শ্বাসটি উড়ে যায়। সন্তানের শরীরের পাশ দিয়েই হয়তো সে যাবে। তবে সন্তানকি ধরতে পারবে তার আশেপাশের বাতাসটাও মিশে আছে মায়ের আহাজারি?

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২৭

বিয়ের তোরজোর সকাল হতেই শুরু হয়ে গিয়েছে। সকলে ব্যস্ত ছোটাছুটিতে। কেউ এটা আনছে, তো কেউ সেটা। দুপুরেই বরপক্ষ আসবে।
এই ছোটাছুটি, এই ব্যস্ততা, এই হৈচৈ থেমে গেলো। একটি কলিংবেলের শব্দেই।
দরজা খুলতেই বিপরীত পাশের মানুষটিকে দেখে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো।

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২৯