যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২৬
মম সাহা
স্মৃতির মানসপটে ভেসে উঠে কত দৃশ্য। সুখ জীবনের এক কালীন কত খুশির চিত্রই তুহিনের মনে পড়তে শুরু করল। নীরব বনফুল ছিলো সেই গল্পের নায়িকা। পুরো গল্প জুড়ে তার লাজুক বিচরণ। সর্বগুণ ছিলো মেয়েটার অঙ্গে। তুহিনের ঘরটি কী যত্ন করেই না গুছিয়ে রাখতো। এরপর আর এমন যত্ন করে কেউ কি তুহিনের ঘর গুছিয়ে রাখতে পেরেছিল? না, পারেনি। সে-সকলই আজ স্মৃতি ও দীর্ঘশ্বাস কেবল।
বনফুল আঁকড়ে ধরে আছে তুহিনের হাত। এতটাই শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে যে, যেকেউ বুঝতে পারবে মেয়েটা কত ভয় পাচ্ছে তুহিনকে হারিয়ে ফেলার। বার বার বিড়বিড় করে শুধাচ্ছে, “তুমি ভালো আছো তো? তুমি সত্যি সত্যি এসেছো তো? তুমি থাকবে তো?”
তুহিন বিনা ক্লান্তিতে প্রতিবার উত্তর দিচ্ছে। আশ্বস্ত করছে যে, সে থাকবে।
বাহার ভাই বোনের এই দৃশ্য দেখে ব্যথিত নয়নে তাকিয়ে আছেন নির্নিমেষ। চোখ গুলো লালচে হয়ে আছে। লোকটা বোধহয় ভেতর ভেতর ডুকরে উঠছেন কান্নায়। চিত্রা বুঝলো বাহার ভাইয়ের এই অনুভূতির কথা। তাই তো বাহার ভাইকে টেনে নিয়ে এলো রুমটার বাহিরে।
আকাশে তখন রূপোর থালার মতন চাঁদ উঠেছে। সুন্দর, হাসছে চাঁদটি। জোছনায় ভরে গিয়েছে পৃথিবীর বুকটি। মুগ্ধতায় হাসছে ফুলের আঙিনা। রুম থেকে বেরিয়ে বড়ো বারান্দাটায় দাঁড়াল ওরা দু’জন। বাহার ভাই তো চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলেন কতক্ষণ। কোনো কথা বললেন না। নিরবতাতেই যেন তার সকল অভিযোগ ভেসে গেলো।
মানুষটার খুব একা লাগছে কি? চিত্রার বেশ মায়া হলো। একলা লাগার সময় গুলোতে আমরা যে একটি ভরসার হাত, একটি বিশ্বাসের কাঁধ চাই সে কথা চিত্রার অজানা নয়। তাই তো সে মানুষটার ভরসার হাত হয়ে এগিয়ে গেলো। বাহার ভাইয়ের পুরুষালি হাতটি নিজের ছোটো দু’টি হাতের মুঠোয় চেপে ধরল। খুব নীরবেই এই আশ্রয়স্থলটি হলো।
চিত্রার হাতের মুঠোয় নিজের হাতটিকে অনুভব করতেই বাহার ভাই চোখ মেলে তাকালেন। গভীর তার চোখ জোড়া। ক্লান্তি নাকি বিষণ্ণতায় যেন নিভে আসতে চাচ্ছে।
তিনি চিত্রার দিকে গাঢ় ভাবে তাকিয়ে রইলেন কিছুটা ক্ষণ। এরপর আচমকাই বললেন,
“কত রাত ঘুম হয় না আমার, জানো? খুব ঘুমুতে ইচ্ছে করছে নির্ভাবনায়। একটু তোমার কোলে মাথা রেখে শান্তিতে ঘুমুতে চাই, রঙনা। আমার অনেক দিনের ক্লান্তি জমে আছে শরীরে।”
চিত্রা হাতের মুঠো শক্ত করল। নীরবে সম্মতি দিয়ে বলল,
“ঘুমাবেন। আমি আছি তো।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বাড়ি থেকে আজকাল কল এলে চাঁদনীর দমবন্ধ লাগে। বুকের ভেতর হঠাৎ করে কী যেন একটা হয়। সে বুঝতে পারে না নিজেকে। কী করা উচিত আর কী করবে না, সেই ভেবে ভেবে হয়রান হয়ে যায়। তার এই মন যে কেবল মুক্তি খুঁজে। এই পৃথিবীতে সকলের কি বাঁধন মানায়? সকলে কি আটকে থাকতে পারে?
ফোনটি যখন তৃতীয়বারের মতন বেজে উঠল, চাঁদনী তখন রিসিভ করল। বুক ভরে টেনে নিল নিঃশ্বাস। ভিডিও কল। ক্যামেরার ওপাশে রঙিন আলো। মায়ের শরীরে জড়ানো সুন্দর শাড়ি। সাউন্ড সিস্টেমে হয়তো গান বাজছে। সেই গান অব্দি ভেসে আসছে। আনন্দমুখর মুখ রোজা সওদাগরের। চনমনে কণ্ঠে বললেন,
“কিরে চাঁদ, রুম এমন অন্ধকার কেন? আর তুই রওনা হবি কখন? ফ্লাইট ক’টায়?”
চাঁদনী এই অন্ধকারে হাপুস নয়নে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। কণ্ঠে জোর নেই তেমন। অবসন্ন ভাবে বলল,
“কাল সকালে।”
রোজা সওদাগর যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। মেয়েটা তার বুকে ফিরে আসবে অবশেষে! কত কথা কাটাকাটি, তর্ক বিতর্ক, রাগ অভিমানের পর অবশেষে মেয়েটাকে ফেরানো যাচ্ছে। নয়তো মেয়েটা যেমন করে বেঁকে বসেছিল! আর যদি না ফিরতো? তখন কী হতো!
রোজা সওদাগরের ঠোঁটেে কোণে ঝলমলে হাসি। তিনি আনন্দিত চিত্তে বললেন,
“অবশেষে তুই আসছিস। কত চিন্তা দিলি মা’কে। অবশেষে মায়ের বুকে ফিরে আসছিস।”
চাঁদনী মায়ের ঝলমলে হাসি দেখে নীরবে তাকিয়ে রইল। বুকটার ভেতর তার তখন দেদারসে চলছে যুদ্ধ। নিজেরই দেশের আবহাওয়া, বাতাস কিংবা মাটির প্রতি তার টান অনুভব হয় না আজকাল। বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে। কেবল উড়ে ছুটে বেড়াতে ইচ্ছে হয়। মনে হয় যেন গন্তব্যহীন ভাবে ছুটে বেড়ালে জীবনে একমাত্র সে ভালো থাকবে। কিন্তু বাবা-মা বুঝলে তো! উনারা ভাবেন, সন্তান বোধহয় একটা সংসার পেলেই খুশি থাকবে। কিন্তু আদৌ সংসার করার মতন ধৈর্য, ইচ্ছে সন্তানের মনে বেঁচে আছে কি-না তা একটিবার বুঝার চেষ্টা করেন না।
চাঁদনীর এই গম্ভীর ধ্যানের মাঝেই কখনো ভিডিও কলে মুখ বদল হয়ে মায়ের জায়গায় বাবা এসে দাঁড়িয়েছেন সে টের পেলো না। আনমনে তাই বলে উঠল,
“আম্মু, তোমার বুকে তো ফিরে আসছি অথচ আমার বুকে কেমন ভাঙন তা বুঝলে না। এতদিন তা-ও আব্বু বুঝতো আমি কতটা ভালো নেই, আজকাল সেই বোঝাবুঝির অধ্যায়ও আব্বু ছেড়ে দিয়েছে। এই দুনিয়ায় আমাকে একটু কেউ বোঝার রইল না।”
কথা শেষ করেই হতাশ শ্বাস ফেলে চাঁদনী ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই বাবার মুখমন্ডল ভেসে উঠল। থমকে গেলো সে। দ্রুত কথা কাটিয়ে নেওয়ার পায়তারা করল। বলল,
“আব্বু, ভালো আছো তো? হলুদ পাঞ্জাবিতে তোমায় আজও ইয়াং লাগে। যুবক বয়সী লাগছে, আব্বু।”
আফজাল সওদাগর মেয়ের কথা ঘুরানোর আপ্রাণ চেষ্টাকে সফল করলেন। জবাব তিনিও হেসে বললেন,
“তাই বুঝি? যুবক লাগছে?”
“একদম। বয়স পঁচিশ লাগছে।”
“তোমার মায়ের পাশে মানাচ্ছে না দেখছি। তোমার মা কেমন মুটিয়ে গিয়েছে দেখছো? একটা নতুন মা আনতে চাচ্ছি তোমার জন্য।”
স্বামীর ঠাট্টায় খ্যাপে গেলেন রোজা সওদাগর। চ্যাঁচামেচি করে উঠলেন, “আমি মুটিয়ে গিয়েছি? আমি? নতুন করে বিয়ে করার শখ জেগেছে না?”
“হয়েছেই তো! দেখো তো একটা সতীন পছন্দ করো, বিয়েটা করেই নিই।”
স্বামীর ঠাট্টায় তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন রোজা সওদাগর। তা দেখে হো হো করে উচ্চ শব্দে হেসে উঠলেন আফজাল সওদাগর। সেই হাসিতে তাল মেলালো চাঁদনীও। কিন্তু চোখ থেকে তার অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। এমন সুখী, সুন্দর পরিবারটি ছেড়ে বছরের পর বছর কতটা দূরে কাটিয়ে দিতে হয়েছে জীবনটা। যার জন্য তার এই নির্বাসন তাকে আদৌ ক্ষমা করা যায়? আবারও সুযোগ দেওয়া যায়? পারবে আড়াইটা বছর ছেলেটা ফিরিয়ে দিতে? যেই সম্মানহানি হয়েছে তা ফিরিয়ে দিতে?
চাঁদনী ফোন কাটার পূর্ব মুহূর্তে আফজাল সওদাগর বাঁধ সাধলেন। হাসি মুখেই বললেন,
“মা, তোমার সাথে আমার কথা আছে। দাঁড়াও।”
চাঁদনী অপেক্ষা করল। আফজাল সওদাগর খাটে গিয়ে বসলেন। স্ত্রীকে ইশারা দিলেন খাটে বসার। ঘরের দরজা আটকে দিলে আঁটসাঁট করে। প্রশ্ন করলেন,
“কাল সকালে ফিরছো তো, মা?”
এই সামান্য প্রশ্নটির জন্য যে বাবা এতটা আয়োজন করেননি তা চাঁদনী বুঝতে পারল ঠিক। তবুও কোনো কৌতূহল প্রকাশ না করে কেবল জবাবে বলল, “হ্যাঁ।”
“তোমার পাহাড় দেখার ইচ্ছে তবে মাটিচাপা দিলে?”
চাঁদনী এই প্রশ্নের জবাবটা তৎক্ষণাৎ দিতে পারল না। কিছুটা সময় রয়েসয়ে এরপর বলল, “হ্যাঁ।”
“আব্বুর প্রতি তোমার অভিযোগ নেই তো?”
“না, নেই। জীবনের সব ইচ্ছে তো তুমি পূরণ করেছো, আব্বু। এই একটা ইচ্ছের জন্য অভিযোগ করলে আল্লাহও আমাকে ক্ষমা করবেন না। আম্মু কখনো আমার মন বুঝেনি। আম্মুর কাছে সবসময় লোক, সমাজ বড়ো ছিলো। আম্মু সবসময় ভেবেছেন কীভাবে সমাজে সম্মান নিয়ে থাকা যায়। এতে মেয়ের কিছু ইচ্ছে জলাঞ্জলি গেলে, যাক। কিন্তু তুমি তা ভাবোনি আব্বু। তুমি সবার আগে ভেবেছো, আমি কী চাই। ভেবেছো, আমার কী দরকার। তাহলে তোমার উপর কীসের অভিযোগ রাখবো আমি?”
মেয়ের কণ্ঠ কাঁপছে তা বুঝতে পারছেন মা-বাবা দু’জনই।
রোজা সওদাগর কাঁদছেন নিঃশব্দে। আফজাল সওদাগরের মুখে তখনও কোনো পরিবর্তন নেই। তিনি হাসি মুখটি বজায় রেখেই বললেন,
“টুইংকেলের বাবার কাছে তোমার সব কাগজপত্র তৈরি। তোমার পাহাড় ছোঁয়ার ইচ্ছেও পূরণ হবে, মা। তোমার এক জীবনে কেবল ভালোবাসার মানুষটিকে পাওয়ার ইচ্ছেটা বাদ বাকি সব ইচ্ছে পূরণ করে দিবো আমি। তোমার এই জীবনে আমি কোনো আফসোস রাখবো না, মা। তুমি আমার মুক্ত শালিক। তোমার জন্য খাঁচা নয়, মা। তোমার জন্য আব্বু পুরো আকাশটা রেখেছি। তুমি উড়ে বেড়াও। কেবল উড়ো।”
কথা বলতে বলতে মানুষটার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রস্তাবে চমকে গেল চাঁদনী। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বলল,
“আম্মু? আম্মু মানবে তো?”
পাশ থেকে রোজা সওদাগর তখন সশব্দে কেঁদে উঠলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড অভিমানীনি স্বরে বললেন,
“তোর জীবনে তো তোর আব্বুই বেস্ট, তা আমি জানি। কিন্তু আমার জীবন জুড়ে তুই ছাড়া আর বেস্ট কে হতে পেরেছে বল? তোর সবসময় অভিযোগ ছিলো আম্মু তোকে বুঝেনি। অথচ আম্মু যে কত আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক ত্যাগ করেছে তা তো দেখলি না। আম্মু যে কত রাত মেয়ের জন্য ঘুমোয়নি সেটাও দেখলি না। মা রে, আমি যে তোর মা। মা সন্তানের মন না বুঝলে বুঝবে কে? আমার সন্তান আমার বুকে আজীবন থাকবে, কাছে নাহয় না থাকলো। তবুও আমার সন্তানের বুকে যেন অশান্তি না থাকে। আমিই তো চাইলাম আমার চাঁদ পাহাড় ছুঁতে যাক। আমার চাঁদের সব ইচ্ছে পূরণ হোক। মেয়েটা নাহয় এক জীবনে সুখী হলো। আমরা দু’জন দূর থেকেই সেই সুখ দেখবো, মা। আমরা কেবল অপেক্ষা করবো। তুই উড়তে থাক, মা। আমি আর তোর বাবা তোকে সুতোয় বাঁধা ঘুড়ি বানাইনি, তোকে পাখি বানিয়েছি। তোর জন্য পিছুটান নয়। যা সোনা মা। তোর স্বপ্ন পূরণ কর।”
যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২৫
এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রস্তাবে চাঁদনী ডুকরে কেঁদে উঠল। চার দিনের এই জীবনে হতাশায় কাটবে কীভাবে যদি এমন সুন্দর মা-বাবা থাকে? কে বলে ভালোবাসা পাওয়ার পরও মানুষ মরে যায়? এমন ভালোবাসা পেলে আদৌ কেউ মরতে পারে?