যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২৭

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২৭
মম সাহা

রাস্তায় ক্রিং ক্রিং শব্দ তুলে পায়ের রিকশাটি এগিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলো এসে আছড়ে পড়ছে চোখ-মুখে। রিকশায় বসে আছে দু’জন মানব-মানবী। নিশ্চুপ, নীরবতাতেও তাদের মাঝে যেন চলছে কত ধরনের কথা।
চিত্রার শরীরে নীল শাড়িটি অন্যরকম আভা তৈরি করছে। শ্যামলা, গোলগাল গড়নের মুখটি জ্বলজ্বল করছে পথের আলোয়। পাশেই বসা লোকটা সেই জ্বলজ্বল করা রূপটি নিয়ে মোটেও একটি কথা বলেননি। বরং মনের আনন্দে ফুঁকে যাচ্ছেন সিগারেটটি।
চিত্রাই প্রথম কথা বলল, “বাড়ি ফিরে গোসলটা করে নিবেন। আমি খাবার পাঠাবো।”

“পাঠাতে হবে কেন?” বাহার ভাইয়ের তৎক্ষণাৎ অদ্ভুত প্রশ্ন।
চিত্রা খানিক ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল, “রাতে না খেয়ে ঘুমাবেন? উপোস করবেন?”
“উপোস আমার পেট সয়ে গেছে। করতে কোনো আপত্তি নেই শরীরের।”
“আপনার শরীরের আপত্তি না থাকলেও আমার আছে।” কথাটি বলতে বলতে নাকের পাটা ফুলিয়ে আঁড়চোখে তাকাল মেয়েটা।
বাহার ভাই সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে হু হা করে হেসে উঠলেন। পুরুষালি স্বরে বললেন,
“কী ভেবেছ? তোমার চোখ রাঙানোকে আমি ভয় পাই?”
“পান না?”
“না।”
“তবে কী ভয় পান?” প্রশ্ন ছুঁড়েই উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইল চিত্রা। বাহার ভাইয়ের ঠোঁটের হাসির প্রশস্ততা কিছুটা কমলো। তিনি সরাসরি তাকালেন চিত্রার দিকে। দৃষ্টিতে রাখলেন দৃষ্টি। সিগারেটটায আরেকটি ফু দিয়ে ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তোমার নীরবতাকে ভয় পাই, মেয়ে। তোমার অ-ভালোবাসাকে আমার বড্ড ভয় হয়। মনে হয় যেন একটি নির্মম যন্ত্রণার দানব এসে আমার বুকের জমিন ছিঁড়ে নিচ্ছে। তুমি কি জানো রঙ্গনা? প্রেমিকের মৃত্যু হয় প্রেমিকার ঘোষিত বিচ্ছেদে, মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায়। আর যা-ই করো, মৃত্যু দিও না।”
লোকটার অকৃত্রিম আকুতি। তখনো চোখ দুটো ঘুরছে চিত্রার মুখমণ্ডলে। চিত্রার সেই আকুতি ভরা কথায় মায়া জন্মালো। সাথে জন্মালো অনুযোগ। বলল,
“আমি চিরজীবন তো আপনার বেঁচে থাকার কারণ হতেই চেয়ে ছিলাম। অথচ আপনিই একদিন আমার সমস্ত বেঁচে থাকা কেড়ে নিয়ে পালিয়ে ছিলেন।”

এবার বাহার ভাই চোখ নামিয়ে নেন আলগোছে। দৃষ্টি ফেলেন পিচ ঢালা রাস্তায়। আবারও নিরব হয়ে আসে চারপাশটা। চিত্রা তখনও মানুষটার মুখ পানে তাকিয়ে থাকে। একটি জবাব, একটি কেবল সঠিক বাক্যের আশায়। সে জানে বাহার ভাই একেবারেই অসহায় না হলে তাকে এমন ব্যথা দিতো না। কিন্তু তবুও একটিবার মানুষটার মুখ থেকে শুনতে চায়। জানতে চায় সঠিক কারণ। কিন্তু বরাবরের মতন মানুষটা চুপ করেই আছেন। যেন এই মুহূর্তে বলা চিত্রার কথাটি তার কর্ণগোচরই হয়নি।
চিত্রার ভঙ্গুর স্বর। আবারো জিজ্ঞেস করে, “উত্তর দিচ্ছেন না কেন?”
উন্মনা বাহার ভাই জবাবে কেবল তপ্ত শ্বাসটুকুই আলগোছে ফেলেন। উদাসীন বৈরী বাতাসে মিশে যায় যেন তার লাল রঙের অদেখা ক্ষত গুলো।

ছন্দহীন স্বরে বলেন, “যেই উত্তর দিতে গিয়ে প্রেমিকের কণ্ঠ কেঁপে উঠে, যেই প্রশ্ন শুনে প্রেমিকের চোখ নামিয়ে ফেলতে হয়, এমন প্রশ্নরা কেন আমার রঙ্গনার মস্তিষ্ক ছাড়ে না? কেন রঙ্গনা বারে বারে পাষাণ হয়ে এতখানি আঘাত করে যতখানি আঘাত রুহ অব্দি পৌঁছায়?”
বাহার ভাইয়ের কণ্ঠটা বড়ো অসহায় শোনালো। চিত্রা থমকে গেলো এহেন কথায়। আর কোনো অভিযোগ মেলে ধরার সাহস পেলো না। মেয়েটা যে বড়োই ভালোবাসতে জানে। প্রেমিকের ভঙ্গুর স্বর কিংবা অসহায়ত্ব সে কীভাবে মেনে নিবে!
এই অযাচিত নিস্তব্ধতায় চিত্রা আলগোছে বাহার ভাইয়ের হাতের মুঠোয় নিজের ছোট্টো হাতটি দিয়ে শক্ত করে ধরল মুঠো। বাহার ভাইয়ের অসহায়ত্বে খুব করে যেন সে বলল, চিরজীবন সে মানুষটার পাশে আছে। যতই মানুষটার করা কাজে সে ভেঙে পড়ুক, ব্যথা মিলুক কিংবা যন্ত্রণায় মৃত্যু কামনা করুক নিজের… তবুও সে মানুষটার পাশে থাকবে। যেমন করে পাশে থাকে ছায়া।

অবনী বেগম নিজেদের বিছানার চাদরটা গুছিয়ে নিচ্ছেন। টান টান করে। রাতে মানুষটা টান টান বিছানার চাদর না হলে ঘুমুতে পারেন না। রেগে যান যে! স্বামীর কোনটায় সুবিধা, কোনটায় অসুবিধা তা ভীষণ যত্নের সহিত অবনী বেগমের মুখস্থ।
কেবল মুখস্থ বললে ভুল হবে। বলা যায় অভ্যাস। আমজাদ সওদাগরের জীবনে যতটুকুই পারফেকশন আছে সবটাই অবনী বেগমের হাতের। স্বামীর সবটুকু একদম সঠিক, সুন্দর রাখতেই তিনি পছন্দ বোধ করেন।
আমজাদ সওদাগর তখন হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করলেন। প্রবেশ করেই ব্যস্ত কণ্ঠে শুধালেন, “অহি কোথায়? ডেকে দাও তো।”

স্বামীর ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে কিছুটা কৌতূহলী হয়েই অবনী বেগম জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে? কোনো সমস্যা?”
“যা বলছি তা করো তো।” বেশ বিরক্তি নিয়েই যেন বললেন লোকটা। অবনী বেগম আর কথা বাড়ালেন না। এই নিমতেতো আচরণের সাথে তার নতুন পরিচয় নয়৷ বহু বহু যুগ যাবত পরিচয়।
মিনিট খানেকের ভেতরই অহি প্রবেশ করল রুমে। উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল, “ডাকছিলেন, আব্বু?”
ভদ্রলোক নিজের হাতের মুঠোয় থাকা ফোনটি এগিয়ে দিলেন। প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন, “নাও ধরো। তোমার মা কল করেছেন। তাকে তো বিয়েতে আসতে বলোনি আপাতত দোয়া চেয়ে নাও।”
অহি আশ্চর্য হলো বাবার কথায়। ঘাড় ঘুরিয়ে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো অবনী বেগমের দিকেও তাকালো।
মেয়েকে তাকাতে দেখে অবনী বেগম দরজা থেকে সরে বাহিরে চলে গেলেন। থাকবেই বা কেন? তার কি এখানটাই থাকার আদৌ কোনো অধিকার অবশিষ্ট আছে? যেখানে সে কেবল চিরজীবন বাহিরের মানুষটি হয়েই ছিলো।
অহি ফোনটি ধরল। এবং তার বাবাকে বিস্মিত করে দিয়ে কলটি বিচ্ছিন্ন করল। কিংকর্তব্যবিমুঢ় আমজাদ সওদাগর হতভম্ব কণ্ঠে বললেন,

“কাটলে কেন? এ কি অভদ্রতা!”
অহির চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আসে। সে কঠিন থেকে কঠিনতম স্বরে বলল, “কাউকে দুঃখ দেওয়ার চেয়ে অভদ্রতাই কি ভালো না?”
“দুঃখ! কাকে দুঃখ দিলাম?” আমজাদ সওদাগর যেন বুঝতে পারলেন না মেয়ে কী বলছে।
অহি তপ্ত শ্বাস ফেলল। তার বাবা নামক মানুষটা কি দিন দিন বোকা হয়ে যাচ্ছেন? না হলে অনায়াসে এমন মানুষকে কীভাবে দুঃখ দিতে পারেন? আর দুঃখ দিয়ে নির্দ্বিধায় ভুলেও যাচ্ছেন!
“আব্বু, আপনি ঐ ভদ্রমহিলার সাথে কেন যোগাযোগ রেখেছেন? আপনার মান-অপমান বোধ কি নেই? একটা মানুষ যে আপনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে, আপনাকে বুঝিয়েছে আপনি তার যোগ্য নন, তারপরেও কোন কারণে আপনি তার সাথে যোগাযোগ করেন? আত্ম-সম্মান বলতেও তো একটা বস্তু আছে!”
আমজাদ সওদাগর খ্যাপে উঠলেন, “খবরদার! আমাদের ব্যাপারে এমন কথা তুমি উচ্চারণ করবে না। আমরা তোমার বাবা-মা।”

“বাবা-মা! শব্দ গুলোর মর্মার্থ অনেক। না ঐ মহিলা মা হতে পেরেছেন না আপনি বাবা হতে পেরেছেন। সবসময় কেবল আপনারা নিজেদের নিয়ে থাকলেন। ঐ মহিলা নতুন সংসার করলেন আর আপনি সারাজীবন তার আশায় বসেই রইলেন। কবে আপনি আম্মুর ভালোবাসা বুঝবেন? অবনী নামক নারীটির এত মায়া কবে আপনাকে ছুঁবে? আপনি ঝাল খাবার খান বলে মানুষটা দু’বেলা রান্না করেন। আপনি গোসল করতে যাওয়ার আগে সে সবটা গুছিয়ে দেয়। রাত করে বাড়ি ফিরলে মানুষটা সজাগ থাকে। আপনার যেন কোনো কিছুতে সমস্যা না হয় তার দিকে সবসময় নজর তার। অথচ তার জীবনের বড়ো সমস্যাটি যেন আপনি হয়ে আছেন। এ কেমন আচরণ আপনার? এ কেমন অবুঝ আপনি! সময় এখনো আছে, আব্বু। পরে কপাল চাপড়ালেও আরেকটু অবনী আপনি পাবেন না।”
কথা শেষ করেই অহি চলে গেলো। আমজাদ সওদাগর দাঁড়িয়ে রইলেন চোখ দু’টো বন্ধ করে। মেয়েটার হলুদের অনুষ্ঠান এখন শুরু হবে। কাল বাদে পরশু মেয়েটা চলে যাবে পরের ঘরে। অথচ আজও মেয়েটা তাকে ক্ষমা করতে পারেনি। পারবেই বা কীভাবে? ক্ষমার কাজ সে কি করতে পেরেছে? পারেনি।

রাত তখন দু’টো। চিত্রাদের ছাদে সাউন্ড সিস্টেমে বাজছে মিউজিক। আত্মীয় স্বজনদের হৈ-হুল্লোড়ে মুখরিত ছাদটি। কেউ নাচছে তো কেউ গাইছে। চিত্রা এক সুযোগে নিচে নেমে এলো। প্লেট ভর্তি পোলাও, রোস্ট নিয়ে নিলো। এরপর আরেকটি প্লেট দিয়ে ঢাকা দিয়ে বের হলো বাহার ভাইদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
আকাশে জ্বলজ্বলে চাঁদ। চিত্রা রাস্তায় দাঁড়িয়েই দেখলো বাহার ভাইদের ছাদে একটি অবয়ব। মানুষটা তাহলে অপেক্ষা করছে ওর জন্য! ইশ্ বড্ড দেরি হয়ে গেলো!
ভাবতে ভাবতেই বাড়িতে ঢুকল চিত্রা। ধীর পায়ে উঠল ছাদে। সাদা টি-শার্ট পরনে লোকটার। চুল গড়িয়ে পড়ছে জল। কোঁকড়া চুল গুলো কেমন চকচক করছে! খায় না বলে মুখ চোখ কেমন শুকিয়ে গিয়েছে।
চিত্রা বাহার ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বরাবরের মতন চঞ্চল কণ্ঠে বলল, “নিন খাবারটা খান। কত রাত হলো!”

বাহার ভাই হাতের সিগারেটটা নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষলেন। এরপর গিয়ে বসলেন মোটা রেলিঙের উপর। হাতের গিটারটা টুং টাং শব্দ করতে করতে বললেন,
“তুমি খেয়েছো?”
চিত্রাও সেখানটায় গিয়ে দাঁড়াল। ধীর কণ্ঠে জবাব দিলো, “গিয়ে খাবো।”
“এখানেই খাও। বসো। তুমি খাও, আমি মন ভরে দেখি। আমার মনের খিদে মিটুক।”
চিত্রা ভারি অবাক হলো।
“কী বলছেন!”
“আহা মেয়ে, যা বলছি তা করো।”
“আপনি খান তো। রাত হয়েছে অনেক।”

বাহার ভাই বাধ্য ছেলের মতন গিটার রেখে থালাটা নিলেন। বা’হাতে চিত্রাকে টেনে বসালেন কাছটায়। প্রথম লোকমাটা নিয়ে এগিয়ে ধরলেন চিত্রার মুখের সামনে। বিবশ কণ্ঠে বললেন,
“বহু দিন আগে একবার আমার হাতে খেতে চেয়েছিলে মনে আছে? আমাদের বাড়িতেই? আমি দিইনি বলে অভিমান করেছিলে? আজ তোমার সকল অভিমানদের নির্বাসনে পাঠিয়ে এই এক লোকমা প্রেম নিবেদন করলাম তোমায়। গ্রহণ করবে কি?”

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২৬

চিত্রা হত-বিহবল হয়ে গেলো। চোখে তার জমলো জল। বাহার ভাই এক হাতে ভাতের প্লেটটা ধরে আরেক হাতে চিত্রার হাতটা টেনে নিলেন। কব্জির কাছের ডেবে যাওয়া কাটা দাগটায় ঠোঁট ছোঁয়ালেন। খুব নরম গলায় বললেন,
“এরপর আমি কোনো দুঃখ দিলে ব্লেড দিয়ে আমার বুকটা এফোঁড়ওফোঁড় করে দিও। তবুও নিজেকে আঘাত করো না, রঙ্গনা। আমি যে ভেঙে যাই। গুরিয়ে যাই তোমার দুঃখ দেখলে। এমন পরোক্ষভাবে আমায় মেরো না। আমায় কেটো না। আমায় ভেঙো না। তুমি আমায় ভাঙলে আমি কারে এই যন্ত্রণা দেখাবো? বলো?”

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২৮