যাতনা আমার পর্ব ৩১

যাতনা আমার পর্ব ৩১
সানজিদা ইসলাম সূচনা

শপিং শেষে একটা পার্কে এসেছে ইশান, তিথি, ইনায়া আর নিধি। খুব শান্ত পরিবেশ, নিরিবিলি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এই জায়গাটি। দুপুর হওয়ার দারুণ এখানে প্রায় জনমানসের দেখা নেই আপাতত। তিথি কিছু ছবি ক্লিক করে ইনায়ার দিকে ক্যামেরা ধরে। যে এখন ফুচকা স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে। তিথি এবার তার ডানপাশে বসে থাকা নিধির দিকে তাকালো। মলিন মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে সে। তিথি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিধিকে অনেক কষ্টে ইশান মানিয়ে নিয়ে এসেছে। শপিং করার পুরোটা সময় নিধি চুপচাপ ছিলো। কোনো কথাই তেমন ভাবে বলেনি। ইশান আর তিথি মিলেই নিধির শপিং কমপ্লিট করেছিলো। এক পর্যায়ে নিধির কিছু অস্বাভাবিক দিক লক্ষ্য করে ইনায়া। পুরুষ মানুষ দেখলেই তিথি কেমন ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিলো। তাই তারা সবাই শপিং বাদ দিয়ে এখানে এসেছে। বাকিটা পড়ে করে নেবে। তিথি নিধির শুষ্ক মুখটার দিকে তাকিয়ে হাসলো কিছুটা। মেয়েটা চমৎকার, ভাইয়ের বউ হলে মন্দ হবে না। তিথির ভাবনার মাঝেই ইনায়া এসে পাশে বসে। সাথে একটা লোক তিন প্লেট ফুচকা আর সমুচা সিংগারা নিয়ে এসেছে। লোকটা খাবার গুলো রেখে চলে যেই ইনায়া শান্ত গলায় নিধি কে বলে,

-” তোমার প্রিয় ফুচকা নিধি, খেয়ে নাও ঝটপট। ”
-” আমি খাবোনা ভাবি। ”
ইনায়ার কথার জবাবে এতটুকু বলে নিধি আবার সামনে দৃষ্টি দেয়। ইনায়া কিছুটা শাসনের স্বরে বলে উঠে,
-” কোনো কথা শুনছি না। ”
নিধি ঠোঁট উলটে তিথি আর ইনায়ার দিকে তাকায়। তারপর ফুচকার প্লেট তুলে নেয়। ইনায়া তিথি খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে কথা শুরু করে দেয়। কিছুসময় পর ইশান এসে তাদের জলদি তাড়া দেয়,
-” এখনো তোমাদের এই স্পেশাল ডিস খাওয়া শেষ হয়নি? জলদি করো। ”
বলেই তিথির পাশে বসে পরে ইশান। পাশ থেকে পানি বোতল তুলে মুখ লাগিয়ে অর্ধেক টা শেষ করে দেয়। তিথি তা দেখে অনেকটা তেতে উঠে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” ইয়াক, কি করলে এটা তুমি? মুখ লাগিয়ে খাওয়ার কি দরকার ছিলো? ”
ইশান একটু অদ্ভুত ভাবে তিথির দিকে তাকিয়ে আচমকা হেসে বলে ওঠে,
-” লোকজনের পা দিয়ে গোলানো ময়দার ফুচকা খেতে পারো। আবার অন্য লোকের অদ্ভুত ভাবে মাখিয়ে পরিবেশন ও পছন্দ করো। বাড়িতে কি করে বানিয়ে নিয়ে আসে তা আর নাই বলি। আর আমি সামান্য বোতলে মুখ লাগিয়েছি বলে ইয়াক্ হয়ে গেলো? আশ্চর্য! ”
-” কে বলেছে এই মিথ্যা কথা? ”
-” ইউটিউব ঘেঁটে দেখো গিয়ে। ”

তিথি আর ইশানের কথা লেগে যায় এখোনি। ইনায়া আর নিধি অবাক হয়ে এদের ঝগড়া দেখছে। এরা নাকি বিয়ে করবে? সমান্য বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি। শেষ মুহূর্তে ইশানের সাথে কথায় না পেরে তিথি ফুচকার প্লেট ইশানের গায়ের উপর ঢেলে গাড়ির দিকে চলে যায়। ইশান হা হয়ে যায় তিথির এহেন কান্ডে। ইনায়া আর আর নিধি একটু পরেই একযোগে হেসে উঠে। ইশান পানি দিয়ে শার্ট ক্লিন করতে করতে বলে ওঠে,
-” জানো ইনায়া, কিছু মেয়েদের এটা জন্মগত স্বভাব যুক্তিতে না পারলে জিনিসপত্র গায়ে ফেলা। ”
ইনায়া আর নিধি হাসি থামিয়ে তিথির কাছে যায়। ইশান বিল দিয়ে একটু পরেই চলে আসে। তিথি এখনও ভিষণ রাগ নিয়ে দাড়িয়ে আছে। ইনায়া হালকা স্বরে জিজ্ঞেস করে,
-” সামন্য কথা নিয়ে এতো ঝগড়া? তোমারা সংসার কি করে করবে? হুম? ”
তিথি নাকমুখ ফুলিয়ে বলে ওঠে,
-” সেটাইতো, ওকে বলে দাও শুধরে যেতে। না হলে তার রুমের একটা জিনিসও আমি আস্ত রাখবো না বলে দিলাম। ”

ইশান তিথির কথাকে অতোটা গুরুত্ব না দিয়ে গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,
-” আমি নিধিকে নিয়ে যাচ্ছি। তোমরাও যাও। ”
তিথি মুখ বাকিয়ে নিজের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে পরে। ইনায়া ও তিথির পাশে বসতে যাবে তখনই সেখানে আরো একটা গাড়ি এসে ব্রেক কষে। তারা সবাই সেদিকে লক্ষ্য করে দেখতে পায় সেটা ফাহাদের গাড়ি। গাড়ি থেকে তখন নেমে আসে ফাহাদ। আজকে তার বেস ভুস একটু অন্যরকম। হোয়াইট ডেমিন প্যান্ট আর স্কাই ব্লু শার্ট ফাহাদের। খুব কম সময় ফাহাদ পাঞ্জাবি বাদে অন্য কিছু গায়ে জড়ায়। তিথি ভাইকে হাসলো একটু। ঝটপট গাড়ি থেকে নেমে ভাইয়ের কাছে এগিয়ে যায় সে।
-” সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো ভাইয়া। ”
ফাহাদ সামনে এগোতে এগোতে শান্ত স্বরে বলে উঠে,
-” আপাতত সব ঠিকই আছে। ”

ইশান ফাহাদ কে দেখে দৌড়ে তার কাছে আসে অতঃপর মিনমিন করে বলে ওঠে,
-” আমার কিন্তু ভয় লাগছে ভাইয়া। কালকের ঘটনা বড়মা সবাইকে জানিয়েছে। ইনফেক্ট নিধিও জানে। প্লিজ ভেবে দেখো আরো একবার। ”
ফাহাদ ইশানের কথায় কোনো উত্তর দিলো না। ইনায়া আর নিধি অবাক হয়ে দেখছে এদের কান্ড। ফাহাদ কে দেখে নিধির মুখ টোটালি অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। কালকের সব কথা মায়ের মুখে শুনে তার ভিষণ রাগ হয়েছিলো। এই মেয়র কি টাইমপাস করার জন্য আর কোনো মেয়ে খুঁজে পাচ্ছে না নাকি? ফাহাদ নিধির তাকিয়ে হালকা হেসে ইশানকে বলে উঠে,
-” চলো এবার যাওয়া যাক। ”

এখন সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। চারদিকে ভেসে আসছে আযানের সুর। পাখিরা ফিরে যাচ্ছে নিজেদের নীড়ে। একটু গুমোট পরিবেশ। রাজকীয় করিম ভিলাও সন্ধায় কৃত্রিম লাল আলোতে জ্বলজ্বল করছে। বাড়িটির বাহিক অপার সৌন্দর্য তুলে না ধরলেই হয়। কারণ, এর ভিতরে বাসকৃত মানুষগুলো এখন হাজার চিন্তায় আর কান্নায় ভেঙ্গে গেছে। বাড়ির বিশাল বড়ো হলরুমে মাথায় আইস ব্যাগ ধরে পায়চারি করছেন মিজানুল করিম। কিছুটা দুরে বসে কান্না করছেন মিনারা বেগম। কান্না টা মূলত ভিষণ রাগে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কতো করে বোঝানোর পরও ছেলে এই কাজ করতে পারলো? মিজানুল করিম আইস ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে চলতে থাকা টিভির সামনে এসে আবার বসলেন। যেখানে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ পাঠিকা সুন্দর করে বলেছেন, ব্রেকিং নিউজ: বিয়ে করেছেন মেয়র ফাহাদ করিম।

বিশিষ্ট শিল্পপতি নাহিদ মির্জার মেয়ে নিধি তাসনীম কে নিজের সহধর্মিণী হিসেবে কবুল করেছেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, নিজের ফেসবুক পেজে একটা পোস্টের মাধ্যমে এই কথা জানান মেয়র ফাহাদ করিম। শোনা যাচ্ছে কিছুদিন আগে গনধর্ষন করা হয়েছিলো নিধি তাসনীম কে। মিজানুল করিম আর কিছু দেখলেন না। টিভি অফ করে দিয়ে মিনারা বেগমের পাশে বসলেন। এরমধ্যেই সোহানা আর নাহিদ মির্জা বার কয়েকবার ফোন দিয়ে বলছেন, ফাহাদ নিধি কে জোর করে বিয়ে করেছে। মিনারা বেগম এবার রেগে সামনে থাকা ফ্লাওয়ারভাস ছুড়ে মারেন। মিজানুল করিম খেঁকিয়ে উঠলেন প্রায়।

-” এই খবরদার, বাড়ির জিনিসপত্র ভাঙচুর করবেনা একদম। যাও মাথায় পানি ঢেলে ঠান্ডা হও। ছেলের বউ আসবে বরন করতে হবে। ”
-” এমন পরিস্থিতিতে আপনি আমার সাথে মজা করছেন? বাড়ি থেকেই বেড়িয়ে যাবো আমি। ”
তাদের কথার মধ্যেই জায়ান উপর থেকে নিচে নেমে আসে। দুপুরে অফিস থেকে এসে এতোক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো জায়ান। ঘুম ঘুম চোখে মিনারা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
-” কি হলো তোমাদের? ঝগড়া করছো কেনো। ”
মিজানুল করিম টিভি অন করে দেয় জায়ানের উদ্দেশ্য। একই নিউজ বারবার দেখানো হচ্ছে। জায়ান কোনো রিয়াকশন না দিয়ে সোফার উপর আরাম করে বসে। মিনারা বেগম হতবাক হয়ে বললেন,

-” কিছুই বলবি না? ”
জায়ান ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,
-” কি বলবো মা? ভালোবাসে, জোর করে বিয়ে করেছে। এতে আর কি বলার থাকে। তোমরা পারিবারিক ভাবে মেনে নিলেই পারতে। ”
মিজানুল করিম ভ্র কুঁচকালেন। তিনি গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,

-” তাই? তা দু’জন দু’জনকে পছন্দ করলে মেনে নিতাম। তোমার ভাইয়ের ভালোবাসা তো এক পাক্ষিক। সবুর করো এই ভেবে,যে এখনো যেনো মির্জা বাড়ির লোকেরা কেস ঠুকে দেয়নি। ”
জায়ান বাবার সাথে আর তর্কে জড়ায় না। মিনারা বেগম রাগে গজগজ করতে করতে বলে,
-” আমি নিধিকে কোনোদিন মেনে নেবো না। কিছুতেই না। ”
-” কেনো মানবে না মা? সমস্যা টা কই। ”
জায়ানের কথায় মিনারা বেগম দ্বিগুণ রাগান্বিত হয়ে উত্তর দেয়,
-” তুমি জানো না জায়ান সমস্যা টা কোথায়? ওই ধর্ষিতা মেয়ে কি করে করিম ভিলার বউ হতে পারে? কিছুতেই না। ”
জায়ান মায়ের প্রতি রুষ্ট হয়ে যায় অনেক। সে বোঝানো সুরে বলে,
-” তোমার কি হলো মা? তুমি তো এমন ছিলেনা। এতো গুড মম তুমি বউ আসার আগেই টিপিক্যাল শাশুড়ী হয়ে গেলে? একবার ভাবো তো নিধির জায়গায় তিথি থাকলে কি হতো? ”
-” বাস্তবতায় মায়া দেখানো যায় না জায়ান। সবশেষে আমারা সামাজিক মানুষ। সমাজে বাস করি আমরা। ”
মিজানুল করিম এবার শান্ত ভাবে বসে মিনারা বেগম কে বোঝাতে শুরু করলেন,

-” মেনে নাওতো মিনা। ছেলেটা চৌত্রিশ বছরে একটা মাত্র বিয়ে করলো। তাও আবার জোর করে। মেয়ে যে সহজে তোমার ছেলের সাথে সংসার করবেনা তা নব্বই ভাগ সত্যি। আমাদের এখন ফাহাদে পক্ষে থাকা দরকার। আর জায়ান তো আছেই তাকে তাকে তুমি নিজের মনের মতো বউ এনে দিয়ো। আর মেয়ের তো সামনেই বিয়ে। ”
এসব ভুলানো কথায় দমলেন না মিনারা বেগম। তার উপর আরো ক্ষেপে গিয়ে বললেন, তিথির বিয়েও তিনি আটকে দিবেন। মিজানুল করিম পড়লেন মহা বিপদে। জায়ান কে মিনমিনিয়ে বললেন,
-” নিজের বিয়ের কথা বলে আপাতত সান্তনা দে বাপ। নাহলে আজ ভাই ভাবিকে বাড়িতে ঢুকাতে পারবিনা। ”
জায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে উপরে চলে যায়। ডার্ক নেভি ভ্লু কালারের একটা শার্ট জড়িয়ে নিচে নেমে আসে সে। অতঃপর মায়ের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলে উঠে,

-” তোমার ছেলে আর ছেলের বউকে আনতে যাচ্ছি মা। বরন করে নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নাও। আর নিজের মনে কে শক্ত করে গড়ে নাও কারণ, আমি কিছুদিন পরে ইনায়া কে বিয়ে করছি। ”
কথাটা বলে জায়ান গাড়ির চাবিটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। বিস্ফোরন ঘটিয়ে যায় করিম ভিলায়। মিনারা বেগম স্তম্ভিত হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। জায়ান আবার এটা কি শুনালো? মিনারা বেগমের মাথা প্রায় ঘুরছে। তিনি পিছন ফিরে মিজানুল করিমের দিকে তাকালেন।

যাতনা আমার পর্ব ৩০

মিজানুল করিম ইতিমধ্যে আবার আইস ব্যাগ মাথায় চেপে ধরেছেন। ছেলের প্রথম কথায় খুশি হতে গিয়েও যে এতো বড়ো ধাক্কা খাবেন সেটা তার জানা ছিলো। তিনি ভয়ার্ত চোখে মিনারা বেগমের দিকে তাকান। ছেলে তো আগুন নেভানোর বদলে তার উপর এক বস্তা তুস ফেলে গেছে। এবার জাপানের সুনামি চলে এলেও এই আগুন থামবে বলে মনে হচ্ছে না।

যাতনা আমার পর্ব ৩১ (২)