যাতনা আমার পর্ব ৩৬

যাতনা আমার পর্ব ৩৬
সানজিদা ইসলাম সূচনা

তিথির আজ মেহেদী ও সংগীত। দুটো একসাথেই হবে। অপরদিকে ইশানেরও। সংগীত, মেহেদী যার যার বাড়িতে হবে। গায়ে হলুদ আর বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য আলাদা ভেন্যু নির্ধারণ করা হয়েছে। কিছু প্রতিবেশী আর আত্মীয় স্বজনরা মিলে মেহেদীর অনুষ্ঠানটা আয়োজন করা। পুরো করিম ভিলা অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। জমকালো আয়োজনে চারপাশে মুখরিত হয়ে আছে। রাজকীয় বাড়ির রুপ যেন, আর্টিফিশিয়াল চেরি ব্লসম ফুলের স্তুপে পরে গেছে। তিথির পছন্দ অনুযায়ী সম্পূর্ণ ডেকোরেশন করেছে জায়ান।

ইনায়া হাতে মেহেদী ডালা নিয়ে মেহেদীর স্টেজে যাচ্ছে। একটু পরেই সমস্ত নিয়ম কানুন অনুযায়ী অনুষ্ঠান শুরু করা হবে। সাথে জায়ানের এক খালাতো বোন পিহু। মিনারা বেগমের আপন বলতে, এক ভাই আর বোন আছে। তাদের সামনে ইনায়া কে জায়ানের ফুপাতো বোন হিসেবে পরিচয় করে দেওয়া হয়েছে। সবাই নিধিকে নিয়ে কোনো কিছুই বলেনি। সবটা তাদের জানা। ইনায়া স্টেজে ডালাটা রেখে পিছনে ফিরতেই, জায়ানের দিকে চোখ গেলো। যে ম্যানেজমেন্টের লোকেদের সাথে কথা বলছে। ইনায়া অবাক হলো জায়ান কে দেখে। আজকের দিনেও এই লোক কালো পাঞ্জাবি পরে ঘুরছে? আজকের ড্রেস কোড সবুজের মধ্যে রাখা হয়েছে। সবাই কালার মিল রেখে ড্রেস পরেছে। কিন্তু এই লোক? ইনায়া পিহুকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে জায়ানের দিকে যায়। জায়ান লোকটা কে বিদায় দিয়ে পিছনে ফিরতেই, ইনায়া কে দেখলো। ইনায়ার পড়নে সবুজ সেলোয়ার কোড। জায়ান হাসলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” কি অপরুপ সাজে সেজেছ তুমি অপরুপা।
-” ফ্লার্ট করা বাদ দেন।
জায়ানের হাসি আরো চওড়া হলো। ইনায়ার মুখে হালকা রাগের আভাস। ঝলমলে আলোর উজ্জ্বল পরিবেশে জায়ানের হাসি তার কাছে বিরক্ত ঠেকলো। সে গম্ভীর গলায় শুধালো,
-” আপনি কি শোক পালন করছেন? আজকের দিনেও কালো পড়তে হবে? ”
-” কেনো? কোথাও লেখা আছে, বোনের বিয়েতে কালো পড়তে নেই? ইনফেক্ট, সবার উচিত বিয়েতে আমার মত কালো পড়ে শোক পালন করা। ”
জায়ানের কথায় ইনায়া রাগলো বেশ। এটা কোনো কথা? ইনায়া শান্ত অথচ গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,

-” বিয়ের দিনও যেন এইসব না দেখি। অসহ্য সন্ত্রাসী একটা। ”
জায়ান কোনো উত্তর দিলো না। যার মানে সে কালোই পড়বে। ইনায়া আর কিছু বললো না। এই লোকের সাথে কথা বলা পুরোটাই বেকার। সে পিছু ফিরে যেতে নিলো। জায়ান মুচকি হাসি দিয়ে বলে উঠলো,
-” তুমি আমি একই সুতোই বাঁধা। ডুর টানলে এক তো হবোই হরিণী। তোমার জীবন টা এই সন্ত্রাসীতেই বাঁধা। সহ্য না করে যাবে কোথায়?
ইনায়া জবাব না দিয়ে চলে গেলো। হন্তদন্ত পায়ে ছুটে বাড়িতে ঢুকে তিথির কাছে গেলো। জায়ান ইনায়ার যাওয়ায় দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে। সামনে তাদের দিন গুলো হয়তো ভালো যাবে। আচমকা জায়ানের ফোন বেজে উঠায়, জায়ান সোরগোল থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। ফোন বের করলেই দেখতে পায় জ্বলজ্বল করছে ফাহাদের নাম। জায়ান রিসিভ করে জিজ্ঞেস করে,

-” ওদিকের কি খবর? ”
-” খুবই ইন্টারেস্টিং ভাই। তুই ভাবতেও পারবি না এই মেয়ে কতো বড়ো ড্রামাবাজ। ”
-” মানে? জায়ান ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করলো। ফাহাদ অপর পাশ থেকে হেসে বলে উঠলো,
-” তার মায়ের কাছ থেকে আমাদের কথা শুনে, খুঁজে খুঁজে আমাদের শত্রুর সাথে ভাব মিলিয়েছে। তুই তো জানিস খলিল কেমন? এই মেয়ের ফাঁদে পড়ে সব দিয়ে বসে আছে। খলিলের জোরেই বাংলাদেশে এসে এমন দাপট দেখিয়ে ছিলো। গতকাল জামিনে ছাড়া পেয়েছে অদিতি। এই থানা পাল্টিয়েও কোনো লাভ হলো না। তোর প্রতি অনেক ক্ষোভ মেয়েটার। এখন তার একটাই লক্ষ্য। সেটা হয়তো তুই। এখন কোথায় পালিয়েছে জানা নেই। ফোর্স দিয়ে খোঁজার চেষ্টায় আছি। তোকে সামনে পেলে জানে না মেরে দেয়। ”

জায়ান গা দুলিয়ে হেসে উঠে। কানে ফোন রেখেই, সিগারেটে ধরায় সে। দু এক টান দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
-” আমি মানুষটা এমনিতেই ভালো। কেউ যদি দুষ্টু বুদ্ধি দিয়ে আমাকে কাবু করতে আসে, তাহলে তার বুদ্ধি দিয়েই তাকে কাবু করবো আমি। হোক খারাপ বা ভালো৷ প্রথম এই রাস্তা তার দেখানোই। অদিতির বেলায়ও তাই ঘটেছে। আমার প্রাণভোমরায় হাত দিতে চেয়েছিলো সে।
জায়ানের হুংকার মেশানো কথায় ফাহাদ আর কিছু বলেনা। সে নিশ্চুপ রয়। খলিলের লোকদের সাথে বেশ ভালো ঝামেলায় পরেছে ফাহাদরা। সামনে বুঝেশুনে স্টেপ নিতে হবে তাদের। রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে আসন্ন নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে এগুতে হবে। মাত্র আর তিন মাস। জায়ান আচমকা জিজ্ঞেস করে,
-” কিন্তু অদিতি খলিলের সন্ধান কি করে পেলো? ”
ফাহাদ চুপ রয়। উত্তর মিলে না কারো কাছে। এই মেয়েকে হালকা ভাবে ছাড়লে হবে না।

নিধি তিথির রুমে বসে আছে। তিথির সাজ প্রায় শেষ। নিধি মুখটা অত্যন্ত গোমড়া হয়ে আছে। সে আজকে বাড়ি যেতে চেয়েছিল। তাদের বাড়িতেও সে একটাই মেয়ে। কিন্তু মেয়র সাহেবের নিষেধ, কেউ অবজ্ঞা করতে পারছে না। ফাহাদ আজ চারদিন হলো, দুইদিনের নাম করে শহরের বাইরে আছে। ওখানে থেকেই নিধির উপর খবরদারী করে যাচ্ছে। তিথি সাজ শেষ করে নিধির পানে তাকালো। যে বিষন্ন মনে বসে আছে। তিথি শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-” ভাইয়া কখন আসবে নিধি ভাবি? ”
নিধির ধ্যান ভেঙে তিথির দিকে ফিরলো। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তিথিকে। নিধি মলিন কন্ঠে জবাব দেয়,
-” আমি কি করে জানবো? তাকে আমি কল দেইনি। আর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। ”
তিথি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিধির কাছে গিয়ে বোঝানোর স্বরে বলে উঠলো,
-” সব মেনে নাও। দেখবে তুমি অনেক খুশি থাকবে সবসময়। আর তোমার বাড়ি যাওয়া নিয়ে মন খারাপ তো? আমি কালকে বাবাকে বলবো, তোমায় বাড়িতে দিয়ে আসতে। ”
নিধি চমকালো। হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-” সত্যিই? ”
-” হুম, তোমাকেও কথা দিতে হবে। বিয়ের দিন ভেন্যু থেকে সোজা বাড়িতে চলে আসবে। ”
-” ভেবে দেখবো। ”
নিধি চওড়া একটা হাসি দিয়ে বলে কথাটা। হঠাৎ ইনায়ার আগমনে, নিধি আর তিথি কথা বন্ধ করে। ইনায়া তিথি কে ধরে মিষ্টি স্বরে বলে ওঠে,
-” তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে তিথি। ”
তিথি খুশি হলো বেশ। ইনায়ার হাত ধরে উঠে দাঁড়ায় সে। তিনজনই অগ্রসর হয় মেহেদীর অনুষ্ঠানে।

বিয়ের আমেজ পূর্ণ বাড়ি করিম ভিলা হলেও, তার দারপ্রান্তে নেই বিশাল বড়ো মির্জা বাড়ি। আয়োজনে কেনো ত্রুটি নেই বাড়িতে। সবকিছু মনের মতো করেছে নাহিদ মির্জা। আত্নীয় স্বজনরা নিজ নিজ আনন্দে মেতে থাকলেও কোনো আমেজ নেই তাতে। তারপরও বাড়ির সবাই যথেষ্ট চেষ্টা করছে অনুষ্ঠান টা কমপ্লিট করতে। নিপা ও নওয়াজ মির্জা মেহমান আপ্যায়নে ব্যস্ত। নাহিদ মির্জাও তাই। আয়েশা মির্জা ব্যস্ত আছেন ইশানের সাথে খুনসুটি তে। বাড়ির বিশাল বড়ো জমকালো লাউঞ্জ এরিয়ার পাশে ছোট দুইটি টেবিল রাখা। একটাতে কিছু ফুলের স্তুপ। আর অন্যটি তে ভদকার গ্লাস। তার পাশের চেয়ারে নাভান বসে আছে।

মেরুন রঙের পাঞ্জাবি তে দারুণ সুদর্শন পুরুষ ঠেকলো সে। হাতের গ্লাস থেকে মাঝেমধ্যে অল্প করে স্লিপ নিয়ে সামনে উদীয়মান থালার মতো চাঁদের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে। আজ আকাশে চাঁদের পাশে জ্বলজ্বল করছে অগুনিত তাঁরা। যাদের দৃষ্টি যেন নাভানের পানেই। নাভান হাসলো, চমৎকার দেখালো সেটা। কিন্তু ভিতরের দহন বাইরে বের হলো না। ভেতরের সাথে নাটকীয় খেলায় যেন জিতে রইলো নাভান। এ দহন দেখাবার মতো নয়। তাকে জিততে দেওয়া বড়ই মানা। নিশুতি এই রাতটা কষ্টের সমাহার যেন। পেছনে কারো আভাস পেয়ে নাভান নড়ে উঠলো। হাতের গ্লাসটা টেবিলে রেখে পিছন ফিরে তাকায়। সোহানা মির্জা দাড়িয়ে আছেন। মলিন মুখ কিছুটা। নাভান হাসলো। ইশারা করলো পাশের চেয়ারটাতে বসতে। সোহানা বসলো ছেলের পাশে। কিছুক্ষণ কাটলো এমনিতেই।
-” ইনায়ার কাছে গিয়েছিলে? ”

নাভানের আচমকা প্রশ্নে তার দিকে লক্ষ্য করে সোহানা। নাভানের দৃষ্টি তার দিকেই। সোহানা ঘাবড়ে গিয়েও নিজেকে সামলালেন। হ্যাঁ বোধক মাথা ঝাকায় ছেলের দিকে। নাভান গম্ভীর কন্ঠ স্থাপন করে,
– ” কেনো গিয়েছিলে? ”
সোহানা মির্জা থমকালেন। নাভানের মুখে চাপা রাগ। তিনি বোঝানোর জন্য বললেন,
-” আমি তোমার কথা চিন্তা ক… ”
সোহানা মির্জার কন্ঠ রুখে গেলো নাভানের হঠাৎ হাসিতে। মায়ের পানে তাকিয়ে জোরে হেসে বলে ওঠে,
-” কেনো মা? তুমি জানো তো, তাকে পাওয়ায় যোগ্যতা আমি হারিয়েছি। ”
-” কিন্তু নাভান? ”

-” তাকে পাওয়ার আর চাওয়ার অধিকার আমার নেই। আমি সেটা দেখাতে পারি না। কারণ আমি পাপী। ”
সোহানা মির্জা কিছু বলার মতো খুঁজে পেলেেন না। মায়ের মন, নিজের ছেলের জন্য তিনি বিষয় টা নিচে রাখতে চেয়েছিলেন কি? কিন্তু ইনায়ার সাথে কথা বলে তিনি যেন ধ্যান ফিরে পেয়েছেন আবার।
তাই ভুলটা বুঝতে পেরেছেন। আবারো নিস্তব্ধতায় মোড়া হয়ে যায় সময় টা। কেউ কোনো কথা বললেন না। নাভানের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে সোহানার একটাই মিনতি। ছেলে যেন ঠিক থাকে। মানসিক ভাবে যেন ভেঙে না যায়। নাভান চাঁদটার দিকে তাকিয়ে হাসলো। ম্লান হাসি সেটা। ভাঙা গলায় বলে উঠলো,

যাতনা আমার পর্ব ৩৫

-” কোর্টের দ্বিতীয় নোটিশ এসেছে সেই কবে। আর মাত্র কিছু দিন। তার আর আমার গল্পের শেষ সমাপ্তি। ”
সোহানা মির্জা অবাক হলেন। গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
-” তুমি সিগনেচার করেছিলে? কাগজ জমা দিলে কখন।?
চাঁদ থেকে চোখ সড়ালো না নাভান। মুচকি হেসে বিরবির করে বলে উঠলো,
-” যখন বুঝলাম সে আর আমার হবে না। ”

যাতনা আমার পর্ব ৩৬(২)