যাতনা আমার পর্ব ৩৯

যাতনা আমার পর্ব ৩৯
সানজিদা ইসলাম সূচনা

নভেম্বরের শেষ দিকের সময়। হেমন্তকালকে বিদায় জানিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিকায় যুক্ত হয়েছে শীতকালের পৌষ মাস। কনকনে ঠান্ডা কুয়াশার চাদরে মুড়ানো আজকের সকাল পুরোটা শহর জুড়ে। অবশ্য তা ঠাওর করতে পারবে না মফস্বল শহরের বাসকৃত লোকজন। একতলা দুতালা এক সাথে হাড্ডাহাড্ডি ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বিল্ডিংয়ের মানুষ গুলো প্রকৃত শীতের আমেজ খুব কম পায়। বড়ো বড়ো দাড় করানো সেই অট্টালিকা গুলো শুষে নেয় যেন শীত শীত আমেজ। তার সাথে এই আলসে শহরে বাঙালি শীত মানে মাঘের শেষ পনের কে উপলব্ধি করে শুধু।

কারণ আজ তাদের জীবন চারদেয়ালের রুম আর ফোন, ইন্টারনেট এতেই বিশ্ব জয় করে নেয় তারা। সকাল আটটা, কম্ফোর্টের নিচে আরামদায়ক উষ্ণতা অনুভবের তীব্রতায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে দুজন দম্পতি। গভীর নিদ্রায় তারা। তাদের এই আরামদায়ক মোমেন্ট নষ্ট করে বেজে উঠলো এলার্ম ঘড়ি। তন্দ্রাছন্ন হলো কিছুটা দু’জনের। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত হয়। পিলপিল করে চোখ খোলে নিধি। ভালো করে ঘুমটা ভেঙে আসতেই চোখ রাখে পাশে শোয়া ফাহাদে পানে। চোখমুখ কুঁচকে রয়েছে তার। নিধি আড়মোড়া ভেঙে উঠতে গেলেই পারেনা সেটা। কারণ তাকে দৃঢ় কঠিন বাঁধনে রেখেছে ফাহাদ। নিধি কিছুটা উপুড় হয়ে ফাহাদ কে ডাকলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” ফাহাদ শুনছেন? ছাড়ুন আমাকে। বেলা দশটা গড়ালো বলে। নিচে গিয়ে ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে হবে তো না-কি? ”
কিন্তু না। এই কথা বলার পরে ফাহাদ তাকে আরো জড়িয়ে ধরে তার চওড়া বক্ষ পাঁজরে। নিধি বিরক্ত হলো খুব। এটা যেন নিত্যকার ঘটনা হয়ে উঠেছে। তীব্র রাগ নিয়ে মাথা উঠিয়ে ফাহাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিধি। নাহ, তার কোনো হেলদোল নেই। নিধি এবার রেগে গিয়ে ফাহাদের কোমড়ের কাছে সুড়সুড়ি দিতেই তড়াক করে নিধিকে ছেড়ে দিয়ে একহাত দূরে স্বরে যায় ফাহাদ। বিশ্ব জয় করার মতো হেসে উঠে নিধি। ফাহাদের তন্দ্রাঘোর কাটলো। ভালো করে বিষয় টা বুঝে উঠতে একটু সময় লাগলেও, পরে ফাহাদ খেপে ফুঁসে ওঠে। আচমকা নিধির হাত টেনে তার নিচে ফেলে গলায় মুখ গুঁজে শুয়ে পরে ফাহাদ। নিধি যেন এবার মহা বিপদে পড়েছে। ক্ষ্যাপা ষাঁড় খেপেছে। নিধি দুবার ফাহাদের কাধঁ ঝাঁকাতেই মুখ তুললো সে।

-” নট ফেয়ার বউ, তোমার এই কাজটা যে আমার পছন্দ নয় জানোনা? ”
-” তো কি করবো বলেন? গত তিন বছরেও তো আপনি শুধরোচ্ছেন না। সকাল সকাল আমাকে যন্ত্রণা না দিলে হয় না? আমাকে ছাড়ুন, ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে হবে। ”
নিধি চিড়বিড় করে কথা গুলো খই ফোটানোর মতো বলে উঠে। ফাহাদ নাক ফোলায়। মুখটা গম্ভীর করে তৎক্ষনাৎ।
-” তাই? করিম ভিলায় স্টাফের অভাব নেই বউ। তারা নিশ্চয়ই বসে থাকবে না। আর রইলো যন্ত্রনার কথা? সারারাত তুমি আমাকে যে ধরনের প্যারা দাও, এটা ধরলে সকাল তো কিছুই না। ”
কথাটা বলে ওষ্ঠদ্বয় নির্বিঘ্নে এগিয়ে দেখালো ফাহাদ। সুক্ষ্ম খোঁচা টা কোন দিক দিয়ে দিয়েছে তা মস্তিষ্কে ফুটে উঠেলো তাড়াক করে। লজ্জায় মুখ লাল হলো নিধির। তবুও দমলো না সে।

-” সত্যিই? আপনি প্রতি দিন আমাকে নয়টা পর্যন্ত আপনার কাছে জোরজবরদস্তি করে ধরে রাখেন। আমি ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতে নামতে আপনি এসে হাজির হন। আর বাবার সাথে ঝগড়া করতে করতে না খেয়ে অফিসে যান। তার কারণ হলো আপনি আমার হাতের খাবার ছাড়া আজকাল সেফদের বানানো কিছুই খাননা। আমি যেহেতু লেট করে উঠি আপনি ব্রেকফাস্ট করেন না। আর আপনি যাবার পরে মায়ের মুখে আমার এইসব বাণী শুনতে শুনতে দুপুর গড়ায়। তিন বছর ধরে এটাই হয়ে আসছে। ”

এক দমে কথা গুলো বলে থামে নিধি। বড় নিঃশ্বাস ফেলে সে। ফাহাদ তার কথার বিপরীতে টানটান হয়ে বলে উঠে,
-” তা তো বলবেই। স্বামীর জন্য সামান্য নাস্তাটা সময় সাপেক্ষে রেডি করতে পারোনা তুমি। কথা তো শুনতেই হবে। ”
নিধি যেন কপাল চাপড়ায়। কই যাবে সে? এ লোক ধড়িবাজ একটা। নিজেই তো তাকে সে সুযোগ দেয়না। আবার নাস্তার টেবিলে ঠিক অভিযোগ তুলে দেয় নির্বিঘ্নে।
-” তাহলে এখন আমাকে ছাড়ুন। আপনার সেবা করতে হবে যে। অফিসে যেতে হবে আপনার। নাহলে ফের বাবার সাথে ঝগড়া করতে হবে। ”
-” মন চায়ছে না। আর একটু থাকো প্লিজ। ”

কথাটা বলে নিধির গলায় ফের মুখ গুঁজে শুয়ে রইলো ফাহাদ। নিধি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে কোনো কাজ হবে না আর। পেড়িয়েছে প্রায় তিন বছর। একই স্বভাব ফাহাদের। এই লোকটাকে কোনো কথাই শুনাতে পারেনা সে। নিধি ফাহাদের নিকট থেকে চোখ সরিয়ে স্থির করে। কুয়াশায় নিরবিচ্ছিন্ন সকালের একটু খানি একফালি রোদের দিকে। যা উইন্ডোর কাচ ভেদ করে আছরে পরেছে। ফাহাদ নিধির সুখের ঘরে। নিধি ফাহাদের মথায় হাত বোলায়। এই লোকটা তার অন্ধকার জীবনের একফালি চাঁদের আলো। সে জীবনে না আসলে হয়তো পুরো জীবন অন্ধকারেই নিমজ্জিত থাকতো। তার জীবনে সবচেয়ে বড়ো উপহার হলো ফাহাদ।

অটোয়া শহরে শীতের আবির্ভাব হয়েছে কয়েকদিন যাবত। গা হিম করা ঠান্ডা বাতাস এতোদিন থাকলেও, আজ যুক্ত হয়েছে তুষারপাত। সাদা সাদা পেজো তুলোর মতো কুঁচি কুঁচি বরফ গুলো আঁচড়ে পরছে ঘরবাড়ি বিস্তর পান্তর জুড়ে। মুক্তঝড়ার মতো শুভ্র সাদা তুষার কনা গুলো ঠাই নিচ্ছে ঘড় জমিনে। সকাল থেকেই নিজেদের অপরুপ চিত্র দেখিয়ে চলছে শহর জুড়ে। বছরের প্রথম স্নো ফল সবাই উৎসাহের সহিত উপভোগ করছে যেন। হাইওয়ে রাস্তা, দু’একটা গাড়ি এখনো চলমান। এরমধ্যে একটা কালো বিএমডব্লিউ। এই নিষিদ্ধ তুষারপাত কম হওয়ায় এখনো এগিয়ে যাচ্ছে নিজের গতিপথ অনুসার করে। রাস্তায় তুষারের মিছিল বাড়ছে তড়িৎ গতিতে। এরইমধ্যেই নিজের কাঙ্ক্ষিত জায়গায় এসে থামে থামে বিএমডব্লিউটি। এরই মাঝে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সেখানে থামে আরও একটি গাড়ি। এরথেকে বেড়িয়ে আসে অভার লং কোর্ট ও গলায় মাফলার এবং মাথায় টুপি পরহিত লিও। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সে গাড়িটির দিকে। গাড়ির কাচ ভেদ করে সামনের মালিককে দেখে হেসে উঠেলো লিও।

-” বছরের প্রথম স্নো ফলের উৎসবে তোমাকে স্বাগতম এনএসএম। বাট, তুমি গাড়ি থেকে নামছো না কেন? বাই দ্য ওয়ে, তুমি কি চাইছো আমি তোমাকে ফুল দিয়ে বরণ করে ভিতরে নিয়ে যাবো? তাহলে স্যরি, আমি তা অ্যারেঞ্জম্যান্ট করতে পারিনি। আমার কাছে এখন এসবের সময় নেই। ”
ভেতরের মানুষটা ক্রূর হাসলো। সাইড থেকে কোর্ট টা গায়ে জড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে আসে সে। অতঃপর গম্ভীর দৃষ্টিপাত করে সামনে দাঁড়ানো লিওর দিকে। অতঃপর মুখ বাকিয়ে গমগমে আওয়াজে বলে,
-” এসব নমনীয়তা সঞ্চালিত শুধু তোমার ওয়াইফ জিসা পর্যন্ত রাখো লিও। আমাকে এসব দেখিয়ো না। ফের, লোকে আমাদের গে উপাধি দিয়ে দিবে নির্ঘাত। ”
লিও হাসলো চোখ বন্ধ করে। মজা নিয়ে বলে উঠলো,

-” সো হোয়াট? লোকে করুক এসব মজা। আমরা কেন কান দিবো এইসবে? একটু তো নমনীয়তা ভাব দেখাতেই পারি। বিকজ, আই এম ইয়োর বিজনেস পার্টনার। ”
কথাটা বলে কিছুক্ষণ পরে চোখ মেলে সামনে কাউকে পায়না লিও। ফুস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেতে-যেতে বলে ওঠে,
-” ওহ্, কাম অন নাভান। রাগ করলে নাকি? আমি তো মজা করছিলাম। ”

অটোয়া শহরের বেশ নামীদামি বিজনেস ক্লাসিক ব্লু ফেইরি হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টে এটা। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে এই রেস্তোরাঁটির কারুকাজ। এখানে বেশির ভাগ বিজনেসম্যানদের মিটিং করার ফেবারিট জোন। নাভান আর লিও ভিতরে গিয়ে তাদের বাকি ক্লাইন্টদের সাথে মিটিংয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরে। একটা জরুরি তলবে সবাই একত্রে হাজির হয়েছে আজকের এই তুষার ভরা দিনেও। লিও দুবছর ধরে নাভানের কোম্পানীর সাথে কাজ করছে। অতি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং সেটা৷ সময় গড়ায় মধ্যাহ্ন দুপুরে। মিটিং শেষে গম্ভীর মুখে বসে আছে নাভান, সাফরান আর লিও। অত্যাধিক গম্ভীর হয়ে আছে তিনজনেরই মুখ। ক্ষানিকটা সময় পার হইতে নাভান চিড়বিড় করে রেগে বলে ওঠে,

-” কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ডিল ছিলো সেটা। ডিল সাকসেসফুলি পার করার পরেও ক্যান্সেল করতে পারে কি করে? ”
লিও আর সাফরান একে অপরের দিকে তাকালো। তপ্ত মুখের নাভান কে নেভানোর ব্যবস্থা তাদের নেই। সাফরান বিরস গলায় বলে উঠলো,
-” অদিতি, ও আমাদের থেকে ভালো এমাউন্টও অফার করেছে তাদের। ”
নাভানের চোখ সচল হলো। লস, সব জায়গায় লস দিয়ে রেখেছে এই মেয়ে। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ গুলো জ্বলজ্বল করে উঠে গেলো তৎক্ষনাৎ। নাভানের ভয়ংকর ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে চাইলো না সাফরান। কফির কথা বলে তড়িঘড়ি করে উঠে চলে যায় সে। নাভান গম্ভীর মুখে বলে,

-” আর কতো ওকে চান্স দেবো লিও? সেই থেকে আমাদের পেছনে পরে আছে ওই বিচ টা। ”
-” তু্মি জানো না নাভান, ওর হাত কতোবড়? বড় বড় আন্ডারগ্রাউন্ড মাফিয়াদের হাতে নিয়ে চলে। বিকজ, তাদের বেবিগার্ল বলে কথা। ”
-” ও আর কতো নিচে নামতে পারবে লিও? আর কতো?
লিও কতোক্ষণব্যাপী হতে নিশ্চুপ থেকে আচমকা বলে উঠলো,
-” লাস্ট মান্থ ওর সাথে হঠাৎ করেই দেখা হয়েছিলো। তোমার কথা জিজ্ঞেস করেও বলে উঠেছিলো, বাংলাদেশের সাথে তার ঢের হিসেবনিকেশ বাকি আছে। সে সব কমপ্লিট না করে তোমাকে মুখ দেখাবেনা। ”
নাভান দাঁতের ফাকে গর্জন তুলে ফিসফিস করে বলে ওঠে,

-” রিডিকিউলাস, ওর মতো মেয়েকে আমি মৃত্যুর আগে দেখতে চাইনা। ”
নাভান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। চোখ রাখলো বাইরে কাচ ভেদ করে শুভ্র নির্মল সাদা তুষার কুচির দিকে। হতাশায় ভেতরটা হাহাকার দিয়ে উঠলো তার। অদিতির সাথে বাংলাদেশেই তার শেষ দেখা হয়েছিল। গত তিন বছরে আর তাদের দেখা হয়নি। অদিতি আড়ালে থেকেই তার উপর নজর রাখছে যেন প্রতিনিয়ত। কারণ এখন তার শত্রু নজর অন্য দিকে। আচমকা ইনায়ার চেহারাটা চোখের দৃশ্যপটে ভেসে উঠলো যেন। হ্রদ গহীনের কোণে আলোড়ন তৈরি করে মুহূর্তে। সদা বিরাজমান প্রশ্ন মনের কোনে ঘন্টা বাজিয়ে তুলে নির্বিঘ্নে। ইনায়া ভালো আছে তো? অপরপক্ষের সত্তা কুটিল হেসে বলে উঠে,

-” সে তো আছেই বেশ। কারণ তাকে ভালো রাখার মানুষটাই এমন। ”
নাভানের হতাশা ব্যক্ত করা মুখটা দেখে লিও ভাবলো। কিছু কিছু মানুষের জীবনে সুযোগ একবারই আসে। তা হাত ছাড়া করলে আর পাওয়া যায় না সেই সুযোগ। লিও দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাভানের দৃষ্টিতে চোখ রাখে। অনেক অস্থিরতা মনস্তাপ জুড়িয়ে আছে সেটাতে। হয়তো ইনায়ার কথা মনে পরেছে। এমনটা প্রায় হয়ে আসছে। আচমকা নাভান জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-” জিসা কেমন আছে? চেক-আপ করা হচ্ছে তো ঠিক মতো? ”
-” এইতো ভালোই আছে। শুধু নতুন জনের আগমনের অপেক্ষায়। ”

ব্যস্ত রাস্তা, ব্যস্ত মানুষ জন আর ব্যস্ত শহর। জীবিকা নির্বাহের আপ্রাণ চেষ্টায় ব্যস্ত জনগণ। নিজেদের মতো চলে ফিরছে তারা। এ শহরের প্রতিটি সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে প্রতিটি দিন নিজেদের একই পদ্ধতিতে জীবনকে নিয়ে চলছেন। যার যার মতোই ছুটছেন দুরন্তপনার সহিত। দুপুরের সময়, কোচিং সেন্টারের বাইরে কারো জন্য অপেক্ষাকৃত ইনায়া। শরীরে সি গ্রীন কালারের একটা সেলোয়ার স্যুট। দুধে আলতা গায়ে রঙটা যেন বেশ মানিয়েছে। ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সামনে। পাশেই বিশাল বড়ো সাইনবোর্ড ‘ প্রজ্ঞা কোচিং সেন্টার ‘। পাশ কেটে কতো স্টুডেন্ট সালাম জানিয়ে বিদায় নিচ্ছে। ইনায়ার সেদিকে খেয়াল নেই। বিরক্ত হয়ে কিছুক্ষণ ওয়েট করলো রিকশার জন্য। কিন্তু আশ্চর্য, এতোক্ষন সে রিকশা ফিরিয়ে দিলেও এখন আর কোনো রিকশাই পাচ্ছে না। আজ প্রচুর রাগ হলো ইনায়ার। পাশেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো রায়া। তারপর ইনায়ার গম্ভীর মুখের দিকে চেয়ে বলে উঠে,

-” ফাইনালি কোচিং থেকে এক সপ্তাহের ব্রেক নিতে পারবো। আমি খুব এক্সাইটেড, আর তুই মুখ টাকে এমন ভোতা করে কেন রেখেছিস? ”
ইনায়া উওর দিলো না। মনটা খারাপ করে সামনে তাকিয়ে। রায়া হয়তো বুঝলো। মুখ বাকিয়ে ফোন বের করে ইনায়ার দিকে এগিয়ে দেয়,
-” তোমার নেতা সম্মেলনে। এখানে মুখভার করে রাখলে কি হবে? ”
ইনায়া এবার কথা ঘুরালো,
-” সানিয়ার বেবি কে দেখতে যাবি? ”
-” আজ না, কালকে চল। ”

ইনায়া সম্মতি জানালো। তারপর দুজনেই একটা রিকশায় করে চলে যায়। যাত্রা পথে ইনায়া একটা জায়গায় নেমে পরে। রায়া হাসলো, কিছু কথা বলে সে একাই ফ্লাটের দিকে গেলো। সানিয়ার বিয়ে হয়েছে দুই বছর। সে এখন এক বাচ্চার মা। ইনায়া আর রায়া এখন অন্য জায়গায় এক সাথে থাকে। দেখতে দেখতে তাদের কোচিং সেন্টারটা অনেক বড়ো করেছে তারা। ইনায়া অনার্স শেষ করেছে। ছোট বড়ো বাচ্চাদের সাথে তাদের সময়,ভালোই কাটে। রায়া ও সে মোটামুটি খুব ভালো বন্ধু হয়েগেছে এতোদিনে। এই শহরে মাথা উচু করে দাঁড়াবার শক্তি এখন ইনায়ার বেশ আছে।

শীতের দিন হলেও দুপুরের খুব প্রখর রোদে হেটে ইনায়ার অবস্থা নাজেহাল। ইনায়া সাইড ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুখটা মুছে নেয়। রাস্তার পাশেই বিশাল বড়ো মাঠ। প্রচুরসংখ্যক লোকজনের ভিড় সেখানে। মাইকে তীব্র কন্ঠের ভাষণ। রাস্তায় পার্ক করা অনেক গুলো গাড়ি। মাঝখানের কালো গাড়িটা দেখে তৎক্ষনাৎ মুখ বাকালো সে। মাঠের চারদিকে বড়ো দেওয়াল টানা। অপর পাশে বসার জায়গা আছে সেখানে। ইনায়া দোকান থেকে কোমল পানীয় কিনে খেতে শুরু করলো। দোকানী হয়তো এমন দিনে এইসব কেনায় তাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করেছে মনে মনে। তাতে ইনায়ার কি? সাময়িক কোলাহলের পরে কানে বেজে উঠে সেই চিরাচরিত কন্ঠস্বর। ইনায়া থমকালো কিছুক্ষণ। মুগ্ধ হয়ে শুনলো তার পৌরসভার বর্তমান মেয়রের বলা কথা গুলো। মাদকাসক্ত হয়ে তার কথা গুলো যেন সর্বদাই ইনায়ার নিকট ঠেকে। এ এক কঠিন রোগের রোগীতে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। যা থেকে সে চাইলেও বের হতে পারবে না। কই? আগে তো এমন লাগতো না। ভালো লাগাটা প্রখর বিদ্রূপাত্মক হয়ে আছে আজকাল। ইনায়া মৃদু হেসে উঠে আনমনে। অতঃপর বিরবির করে বলে ওঠে,

-” সে কি জানে? হয়েছি দগ্ধ, তার প্রেম দহনে? ”
ইনায়া হাসি আরো প্রসারিত হয়েছে। আজকাল জীবন টা বড্ড ভালো লাগে তার কাছে। আগে তো এমন ছিলো না। আচানক ইনায়ার মুখে আধার নেমে আসে। এই ভালো লাগা গুলো যে তার ভাবতেও মানা। মনের ভেতর বড্ড ভয় জেঁকে বসে। কারণ প্রথমই হারিয়ে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়েছিল সে। এখন হারাবার ভয়ে তটস্থ ভঙ্গিতে ৪ বছর পূর্বের স্মৃতি হানা দেয় তার মস্তিষ্কে। গাড়ির সাইরেন বেজে উঠায় ধ্যান ভেঙে যায় ইনায়ার। শাঁইশাঁই করে চলে যাচ্ছে পার্কিং করা একের পর এক গাড়ি গুলো। ইনায়ার চোখ থাকে নতুন মার্সিডিজ গাড়িটির দিকে। তার কালো কাচ ভেদ করে কাউকে খোঁজার প্রয়াস চালায়। কিন্তু হয়ে উঠেনা আর। লোকটা কি চলে গেলো? সময় গড়ালো আছরের দিকে। আস্তে আস্তে ভরাট সমাগম শূন্য হয়ে যায়। ইনায়া মলিন মুখে অন্য দিকে তাকিয়ে উঠে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিতেই পাশ থেকে একটা কর্কশ গলার ধমক শুনতে পায় সে।

-” যাচ্ছো কেনো? আরো কিছুক্ষণ থাকো। সন্ধ্যা হবার পরেই একেবারে চলে যেও। ”
ইনায়া এবার ভীতু চোখে পাশে তাকায়। কালো পাঞ্জাবি পরা মুখে মাক্স লাগানো জায়ান কে দেখে চমকালো না একটুও। চোখ দুটি সচল হলো তার। রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো মুখমন্ডলে। জায়ান ধীর গতিতে ইনায়ার সামনে দাড়িয়ে লো ভয়েজে বলে ওঠে,

-” আমার বোকা হরিণী। এ-তো কেন যাতনা দাও আমাকে? ”
-” আর আপনি যে আমাকে জালিয়ে দিচ্ছেন। তার বেলায় কি? ”
জায়ান হাসলো, বুঝলো ইনায়ার রাগ হয়েছে বেশ। এদিকটায় আপাতত শুনশান হয়ে আছে। জায়ান আচমকা জরিয়ে ধরে ইনায়া কে। ইনায়া কিছুটা চমকে উঠে। সে স্থির হয়ে দাড়িয়ে থেকে অভিযোগের স্বরে বলে উঠে,
-” গত এক সপ্তাহে ফোন ব্যতীত সামনাসামনি আমাদের কোনো কথা হয়েছে জায়ান? গতকালকেই তো বললেন আজকে পুরো বিকেলটা আমার জন্য বুকিং করেছেন। আর রাত পেরোতেই ভুলে গেলেন? ”
জায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলো,

-” আচমকা হয়ে গেছে আজকের সম্মেলন। তোমাকে অনেক ফোন দিয়েছি। কিন্তু সেটা বোধহয় তোমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। এখানে তোমাকে দেখে জাস্ট ডিসট্রাক্টেড হয়ে গেছি। হ্যাই? ”
ইনায়া মুখ তুলে জায়ানের দিকে তাকালো। জায়ান অতি আদুরে ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
-” আমার লাইফটা অনেক রিস্কি। এরজন্যই বলেছি, আমার কাজের আশে পাশেও থেকো না। কারো নজর হয়ে গেলে কিন্তু পিঞ্জিরার বন্দী পাখি হয়ে থাকতে হবে। তখন কিন্তু এখনকার মতো মুক্ত পাখি হয়ে ঘুরতে পারবেনা। ”
-” তাহলে ছেড়ে দিন না এই রাজনীতি জনসংযোগ। আমরা আমাদের মতো বেচে থাকবো। ”
ইনায়ার কথায় জায়ান ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে তাকালো তার দিকে। অতঃপর শান্ত গলায় বলে ওঠে,

-” রাজনীতি তো আমার রক্তে মেশানো। তা কি করে ছাড়বো? ”
-” কেনো ফাহাদ ভাইতো নিধির এক কথায় রাজনীতি থেকে সরে এসেছেন। আপনি কেনো পারবেন না? এই আপনার আমার প্রতি ভালোবাসা? সব ঢংয়ের কথা। ”
আচমকা জায়ান কে সড়িয়ে দিয়ে ইনায়া উলটো হাটা দেয়। জায়ান হতভম্ব হলো কিছুক্ষণের জন্য। বিষয় টা বুঝে আসতেই ইনায়ার দিকে এগিয়ে যায়। গোধূলির শেষ বিকেল। গোধূলির আলোমাখা আকাশপটের উপরে-সেইটুকুই রঙিন আলো জানান দিচ্ছে। সামনে ঘনিয়ে আসছে শীতের কুয়াশাময় সন্ধ্যা। ঠান্ডাও লাগছে ঢের। সময় মাত্র কিছুক্ষণ। এই লালচে আলোমাখা শেষ গোধূলির রাস্তা ধরে ইনায়া মুখ ফুলিয়ে হেঁটে চলছে। পিছনে জায়ান আসছে। ইনায়া পিছু ফিরে শাসানো ভঙ্গিতে বলে ওঠে,

-” খবরদার নেতা সাহেব। পিছু আসলে কিন্তু জনগণের মার খাওয়াবো। ”
জায়ান চমৎকার হাসলো। বুক ফুলিয়ে বলতে শুরু করে,
-” পাবলিক তার নেতাকে মারার সাহস সহজে রাখে না হরিণী। ”
ইনায়া কিছু বললো না। জায়ান ইনায়ার হাত এবার জোর করে ধরে নিয়ে যেতে লাগলো। ইনায়া আর রাগ দেখালো না। গাড়ির কাছে আসতেই ইনায়াকে খুব জোরে জড়িয়ে ধরে জায়ান। নিজের বক্ষপিঞ্জরে ইনায়াকে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলে ওঠে,

যাতনা আমার পর্ব ৩৮

-” আমার ভালোবাসার পরিমাণ যে কতোটুকু, তা তুমি মাপকাঠি দিয়ে পরিমাপ করতে পারবেনা হরিণী?
ইনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যা জায়ানের হ্রদ গহীনে ঝড়োমেঘ ডেকে তুলে তৎক্ষনাৎ। জায়ানের কন্ঠ গম্ভীর হয়। গরম অস্থির তোলপাড় গলায় বলে ওঠে,
-” দ্বিতীয় বার আমার ভালোবাসাকে আঙুল তুলে কথা বললে সেটা আমি মেনে নেবো না। ”

যাতনা আমার পর্ব ৪০