রং পর্ব ২০
তন্নী তনু
ছাইরঙা আকাশের বুকে বিন্দু বিন্দু তারা জ্বোনাকির মতো জ্বলছে। রাস্তায় একটু পরপর গাড়ির দেখা মেলে। ইরফাদের গাড়ির পুরো সিটজুড়ে সিনথিয়ার ভাজ করা শরীর। এককোণে বসে শান্ত চোখে স্ট্রিয়ারিং ঘুরাচ্ছে ইরফাদ। সিনথিয়ার মাথাভর্তী ঘন লম্বা চুল সিটের নিচ পর্যন্ত ছুঁয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে আসা দমকা হাওয়া সিনথিয়ার চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে। চোখে মুখে ভিষণ জ্বালা ধরাচ্ছে। নাক মুখে কুট কুট করে কামড়াচ্ছে। তবে হাত তুললেই যে সে ধরা পড়ে যাবে। তাই সবটা সয়ে নিচ্ছে। রাফি”র কথা মনে পড়ে।
কিন্তু তার জন্যে আর হৃদয় পোড়ে না। আর দুঃখ হয়না! সে তো পর হয়েছে সেদিন-ই। তবে তার গুম হওয়া রহস্য ভেদ করতে ইচ্ছে করে। কোথায় গেলো সে? কেনো গেলো? অনিমার সাথে আর যোগাযোগ হয়নি।তৃতীয় পক্ষ বন্ধুত্বের মধ্যে কেমন চির ধরাতে পারে নিজের জীবন দিয়েই প্রমাণিত। বন্ধু বলতে কিচ্ছু হয়না। সে কেবল সময়ের অভ্যাস। যে বন্ধু বিপদে বিপক্ষে দাঁড়ায় সে আবার কিসের বন্ধু। তবুও মন কাঁদে ঐ সকল মানুষের জন্যেই। রাফির প্রতি সকল দূর্বলতা কেবল ঘৃণায় বদলে গেছে। মনের সবটুকু জায়গা দখলদার এখন ইরফাদ। কে বলে?ভালোবাসা রঙ বদলায় না। ভালোবাসার রঙ বদলায়। ভুল মানুষের প্রতি সৃষ্ট মায়া অবশ্যেই কেটে যায় যদি পরবর্তী মানুষটা মানুষ হয়। গাড়ির সিটে শুয়ে এসব ভেবে যাচ্ছে সিনথিয়া। পাশের মানুষটা নিস্তব্ধ, নিরব মনে গাড়ি চালাচ্ছে। মাঝে মাঝে গুনগুনিয়ে কিছু বলছে। অনেকটা পথ পেরিয়ে এক শুনশান নিরব রাস্তা। চাঁদের জ্যোস্নাই যে এ পথের একমাত্র আলো। ইরফাদ হঠাৎ-ই গলা ছেড়ে গায়,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— মে দুনিয়া ভুলা দুঙ্গা
তেরি চাহাত মে
মে দুনিয়া ভুলা দুঙ্গা
তেরি চাহাত মে
ও দুশমান জামানা
মুঝেনা ভুলানা
মে খুদকো মিটা দুঙ্গা– তেরি চাহাত মে….
গলার স্বরে যেনো মায়া ঢেলে দেওয়া। কচ্ছপের মতো শক্ত খোলসের আড়ালের নরম মনের মানুষটা যেনো এইবার বেড়িয়ে এসেছে। সিনথিয়া চোখ বন্ধ করে অনুভব করে। ইরফাদের এই ঘোর লাগানো গলা তার মন শান্ত করে দিচ্ছে। নদীর কলকল পানির শব্দ, ঘন অন্ধকার রাতের বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ ,ঝর্ণার পানির ঝমঝম করা শব্দ মন যেমন বরফ শীতল শান্ত করে দেয়। ইরফাদের গলা তার হৃদয় শীতল,শান্ত, নিরব করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে সে কল্পনার কোনো জগতে বিচরণ করছে। একটা ঝুম বৃষ্টির রাত। দু”হাত পাখির ডানার মতো ছড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে বৃষ্টিকে স্পর্শ করছে সে। পেছন থেকে সেই মোহনীয় গলা,
–মে দুনিয়া ভুলা দুঙ্গা
তেরি চাহাত মে
মে দুনিয়া ভুলা দুঙ্গা
তেরি চাহাত মে
ও দুশমান জামানা
মুঝেনা ভুলানা
মে খুদকো মিটা দুঙ্গা– তেরি চাহাত মে….
গাড়ি থেমে যায়। সিনথিয়ার স্বপ্নের ঘরে দরজা বন্ধ হয়। চোখ বন্ধ করে বোঝার চেষ্টা করে, “হলো টা কি?” কিন্তু খোলা নয়নে পিটপিট করে তাকানো তার বারণ। সিনথিয়া চোখ টিপে দু”চোখের পাতা খোলে সামান্য। আধখোলা চোখে দেখতে পায়। স্ট্রিয়ারিং আকরে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে আছে লৌহকঠিন সেই মানব। কিন্তু হঠাৎ কি হলো তার? এই মূহুর্তে প্রশ্ন করা তার বারণ! তাই চুপচাপ দেখা আর অনুভব করা ছাড়া তার কি করার আছে। সিনথিয়া হালকা করে চোখ খুলে রাখে। ইরফাদ মাথা তুলে বসে। সিটে এলিয়ে দেয় নিজেকে। বলিষ্ট হাতের আঙ্গুলি চালিয়ে নিজের চুলগুলো মুঠি করে টানে। ওষ্ঠধর গোল করে শ্বাস ছাড়ে বার বার। চোখে না দেখতে পেলেও সিনথিয়া বেশ অনুভব করে। শক্ত নারকেলের খোসার মতো শক্ত মনের আড়ালে যে শুভ্র কোমল মনটা আছে- তা বড় অশান্ত। ইরফাদ দীর্ঘশ্বাস টানে। তারপর হঠাৎ করেই বের হয়ে যায়। হাতের ধাক্কায় গাড়ির দরজা ঠাস করে বাড়ি খায়। সিনথিয়া হালকা কেঁপে ওঠে।
অন্ধকার চারদেয়ালের মাঝে ভুতুড়ে আধার। নিজের শ্বাসের শব্দ নিজেই কানপেতে শুনছে তিথি। আর অপেক্ষা করছে মোবাইলে আসা মেসেজের। আর তার মন গরম বালির মতো ঝুরঝুর হয়ে পড়ছে। চাইলেও নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারছে না। “ভালোবাস” এক দূর্বলতার নাম। পৃথিবীর সব মানুষ মনে হয় এই একটা জায়গায় ভিষণ দূর্বল। ভালোবাসা হীন জীবনে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে যে তাকে টানছে তাকে সে উপেক্ষা করতে পারছে না। কথায় মজে গেছে সে। না দেখা মানুষটি আকারে কেমন? দেখতে কেমন? কিছুই মাথায় আসছে না। একেই বলে- “কথা” এমন এক ভয়ংকর হাতিয়ার। যার মাধ্যেমে যুদ্ধ বাধানো যায়। সে তো কথাতে ডুবে যাচ্ছে। চোরাবালি নাকি মরিচীকা কোনো চিন্তাই তাকে স্থির করতে পারছে না। “শুধু মনে হচ্ছে মরিচীকা হলেও ছুটবো। চোরাবালি হলে ডুববো।” তখন-ই ফোনের মৃদু কাপন।
–“ভালোবাসি।”
তিথির ভেতরে গড়ে তোলা জেদ শুকনো পাতার মতো মরমর করে ভাঙ্গে। মিশে যায় ধুলাবালির সাথে। তিথির পাতলা ঠোঁটে ফোটে এক চিলতে হাসি। এর পর অজানা ভয় নিজের বুকের মধ্যে তীর বসায়। তিথি বলে,
— ভালোবাসা এভাবে হয়?
— কেনো হবে না?
— কেনো হবে?
— হয় কি না জানিনা তিথি! আমি শুধু জানি “আমি ভালোবাসি।”
— আপনি আমার নাম কি করে জানলেন?
–আমি সব জেনেই তো তোমার দুঃখ ভোলাতে চাইলাম।
— আপনি আমাকে কি করে চেনেন?আমি তো ঐ মেসেজ এসপি”র নম্বরে দিয়েছিলাম।
–ঐটাই তো! একে বলে কপাল। তিনি তোমাকে নম্বর দিলো তাও রং নাম্বার। আবার ভাগ্যের কি লিখন সেই নাম্বার টা আমার। এজন্যেই বলে, যদি থাকে নছিবে ঘুরে ফিরে আসিবে।
— আপনি আমাকে চেনেন?
— বলবো কেনো?
— বলুননা? আমি আপনাকে চিনি?
–কাল আসো দেখেই বুঝবে….
–কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা।
রাস্তার পাড় ঘেসে নিজে থেকে বেড়ে ওঠা ঘাস পাতা। জ্যোস্নার আলোতে দিনের আলোর মতো খা খা করছে বালিময় রাস্তা। ইরফাদ সামনের দিকে হেঁটে চলেছে। কোথায় যাচ্ছে সে? সিনথিয়া তার পাশে ছিলো তা কি পুরোপুরি ভুলে গেছে? এভাবে এমন একটা রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে কেউ যায়। সিনথিয়া চুপিচুপি গাড়ি থেকে নামে। ইরফাদ”কে অনুসরণ করে সাবধানে। ইরফাদ লম্বা পায়ে সামনে এগিয়ে চলে। সিনথিয়া পিছু পিছু যায়। সামনেই নদী। জ্যোস্নার আলোয় নদীর পানি আয়নাসম। যেনো মুখ রাখলেই ভেসে উঠবে নিজের প্রতিচ্ছবি । শো শো করা বাতাসে কান বন্ধ হয়ে আসে। সিনথিয়ার জামা উড়ছে আকাশে উড়ন্ত পতাকার মত। টেনে ধরে রেখেও লাভ হচ্ছে না। চুলগুলো এলোমেলো। সে চুলগুলো হাতখোপা করে। ততোক্ষণে ইরফাদ নদীর পাড় ঘেসে বসা। হাতের আঙ্গুলের ভাজে চেপে রাখা সি!গা!রেট। কখনো ওষ্ঠের ভাজে ফেলে ধোয়ায় ঢেকে নিচ্ছে অন্তর। আবার মাঝে মাঝে দুঃখ গুলোকে ধোয়ার কুন্ডলী পাকিয়ে আকাশের দিকে ছেড়ে দিচ্ছে। একটা মানুষের উপরপিঠ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই স্বচ্ছ,পরিপাটি,গোছালো, সুন্দর। অন্দরমহল কেমন আসলে তা জানাও যায় না। একটা মানুষ সব দিকেই ভালো হয় না। দোষ-গুণ নিয়েই মানুষ। সিনথিয়ার ছোট্ট মনে প্রশ্ন- “কি কারণে এই মূহুর্তে ধূমপানের প্রয়োজন হলো? কোন যন্ত্রণা তাকে পোড়ায়। নারীর দোষেই কি পুরুষ খারাপ হয়?”
তিথির মাথায় চিন্তা ঘুরপাক খায়। কোথায় থেকে কোথায় গেলো সব। “এটা কোনো মিরাকল নাকি লাক?” কোন দিকে যাচ্ছে সে? কাল দেখা করতে গিয়ে কার সম্মুখীন হবে সে? তাকে কি সেও চেনে? নাকি অজানা অচেনা লোক? এর পরেই বা কি হবে? চিন্তায় দু”চোখের পাতা এক হয় না তার।অনেকটা সময় পর রিমার কথা তার মাথায় আসে। আচ্ছা রিমা কি করছে? আজ কি সে ঘুমিয়েছে? তাকে একটা মেসেজ দিয়ে কি জানা উচিৎ। ফোনের কি-বোর্ডে চাপে,
— ঘুমিয়ে গেছিস?
ওপাশ থেকে কোনো উত্তর আসে না। তিথি উত্তরের অপেক্ষায় থাকে। মেয়েটির জীবনের করুণ দশা তাকেও ভাবায়। সে নিজেও কি ভুল পথ ধরবে? কিন্তু ভালোবাসা দেখে যে ভিষণ লোভ হয়। এইতো সিনথিয়া কি রকম ভুগছে। রিমা কষ্ট করছে। সব-ই তো তার নিজের চোখে দেখা। তারপরও মন মানছে না। ভালোবাসা খুব ভয়নক জিনিস। আগুন দেখেও সেচ্ছায় ঝাপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। সে কি আগুনের দিকেই ছুটছে! ভাবতেই শ্বাসরোধ হয়ে আসে তিথির।
প্রায় আধঘন্টা পর ইরফাদ উঠে দাঁড়ায়। কালো প্যান্টে থেকে ধুলোবালি একহাত চাপড়ে ঝেড়ে নেয়। জুতোজোড়া পায়ে দিয়ে পেছন ঘোরে। এর আগেই সিনথিয়া সুযোগ বুঝে গাড়ির দিকে চলে আসে। শুয়ে থাকে আগের ভঙ্গিতে। ইরফাদ গাড়িতে ওঠে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আবার এক মনে গাড়ি চালায়। সিনথিয়ার চোখ দুটো হঠাৎ করেই বুজে আসে। চোখে নামে রাজ্যের ঘুম। যেনো কতকাল ঘুম হয়নি। তারপর চলে যায় স্বপ্নের রাজ্যে। ঝুম বৃষ্টি ঘন আধার নেমেছে ধরনীতে। আকাশ চিড়ে মেঘের গর্জন। দূরে কোথাও চির চির করে কিছু একটা পড়লো। সিনথিয়া এক গহীন জঙ্গলে হারিয়ে গেছে।ফেরার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। ভয়ে সে আত্মচিৎকারে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে।বৃষ্টিতে ভিজে সে একাকার। ভেজা কুর্তি গায়ে লেপ্টে গেছে।চুল গুলো ভিজে দড়ি পাকিয়ে যাচ্ছে। রাস্তা হারিয়ে সে দিশাহারা হয়ে ছুটছে।সরু জঙ্গলের রাস্তা, ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকানোর খেলা। আলোটুকু যেনো হৃদয় পর্যন্ত গিয়ে কড়া নাড়ছে। পেছনে বিপদ, সামনে বিপদ। আশেপাশে সবখানেই বিপদ। অনেকটা পথ পেরিয়ে খড়কুটোর একটা ছোট্ট ঘর। উপরে টিনের চালা।অনেকটা ছবি আঁকা ঘরগুলোর মতো। ঘরের কোনো দরজা নেই। আছে এক পাতলা ফিনফিনে পর্দা। সেটিও দমকা হাওয়ায় উড়ছে।সিনথিয়া দৌড়ে চলে যায় সে ঘরের বারান্দায়। তারপর ঘরে উকি দিয়ে বলে,
— কেউ আছেন?
ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পায় না সিনথিয়া। তাহলে কি কেউ থাকে না? আচ্ছা! পথ হারিয়ে ফেলেছে যখন। কিছুক্ষণ এখানে থাকাই যায়। বৃষ্টি কমলে না হয় পথ খোঁজা যাবে। ঠিক তখন ই কারো কাতর গলা শোনা যায়। গলা স্বর যেনো কাঁপছে। স্বরটা ভিষণ চেনা। সিনথিয়া তড়িঘড়ি করে ঘরে যায়। টিনের চালায় ঝুমঝুম করা মোহনীয় শব্দ। ঘরের এককোনে জ্বলছে হারিকেনের মৃদু আলো। ঘরের চৌকি জুড়ে একটা মানুষ। মানুষটির তুলনায় চৌকি ছোট হওয়ায় পা দুটো গুটিয়ে রেখেছে। ক্ষণে ক্ষণে কাঁপছে তার গলা। সিনথিয়া দৌড়ে কাছে যায়। এতো তার চেনা পুরুষ। সে এখানে কেনো? কি হয়েছে তার। সিনথিয়া আহত গলায় বলে,
— আপনি! আপনি এখানে কেনো?
বলিষ্ট লৌহশক্ত শরীর যেনো নেতিয়ে পড়েছে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে স্বচ্ছ গরম নোনা জল। সিনথিয়া বৃষ্টিতে ভেজা নিজের বরফশিক্ত হাত ইরফাদের উত্তপ্ত কপালে ছোঁয়ায়।আগুনের মতো উত্তপ্ত শরীর বরফ শিক্ত হাতের ছোঁয়ায় আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে। সিনথিয়া আহত গলায় বলে,
–“এতো ভিষণ জ্বর।”
জ্বরের উত্তাপে ফেঁটে যাচ্ছে চওড়া কপাল। চোখের কোণ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ছে গরম নোনতা জল। অজানা মায়ায় সিনথিয়ার গলা বুজে আসে। এমন জ্বরের কথার উল্লেখ ছিলো সেই ডায়েরিতে। সেদিন পাশে কেউ ছিলো না।তবে ডায়েরি পড়ে তো আফসোস ছাড়া কিছুই করতে পারেনি সিনথিয়া। তবে এই যদি হয় সুযোগ। সব ব্যাথা শিক্ত ওষ্ঠে একবার শুষে নিবে সে। সিনথিয়ার নিজের কোমল হাত দিয়ে চোখের উষ্ণ জল মুছে নেয়। তারপর উঠে দাঁড়ায়। জ্বর কমাতে প্রথমে ইরফাদের মাথায় পানি দেয়া উচিৎ। সে আশেপাশে বালতি খোঁজে। কোনো কিছু না পেয়ে মুখে বার বার “চ্চ” উচ্চারণ করে। ছটফট করতে করতে নিজের ওড়নার ভেজানো অংশ ভাজ করে ইরফাদের কপালে দেয়। বরফ শিক্ত হাত দিয়ে বারবার মুছে দেয় অশ্রুসিক্ত রক্তবর্ণের চোখ। জ্বরের ঘোরে বের হওয়া মুমূর্ষু স্বর সিনথিয়াকে আহত করে বারং বার। সিনথিয়া কানের কাছে বলে,
— কোথায় কষ্ট হচ্ছে…..
সাথে সাথেই বলিষ্ঠ হাতের মুঠিতে বন্ধ হয় সিনথিয়ার বরফসিক্ত হাত। ভূমিধসের মতো ভেতরটা কেঁপে ওঠে সিনথিয়ার। সিনথিয়ার হাত টেনে উষ্ণ, আগুনের মতো তপ্ত বুকের বা পাশে রাখে ইরফাদ। যেনো বলছে,” এখানেই ব্যাথা! ভিষণ ব্যাথা!”
সিনথিয়া অন্তরাত্মা মেঘের মতো গর্জন দিয়ে অশান্ত হয়ে ওঠে। ঘুম ছুটে যায় তার। লাফিয়ে উঠে বসে সে। মাথার উপর ছাদ যেনো নেমে এসেছে তার উপর। নিজের চারপাশ খেয়াল করে বুঝে উঠতে কষ্ট হয় সে কোথায়? সেই বৃষ্টি ভেজা জঙ্গল নাকি তার বাসা! নাকি গারদের সেই অন্ধকার কক্ষ। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে।পাশে থেকে ভেসে আসা গোঙ্গানির শব্দে আরেকবার কাপুনি দেয় শরীর। মনে পড়ে ঘুমানোর আগের মূহুর্তের কথা। সে তো ইরফাদের সাথে ছিলো। গাড়ির লাইট অন করে সিনথিয়া। শরীর একবার কেঁপে উঠে তার। গলার স্বর মনের অজান্তেই যেনো আকাশ বাতাস কাপিয়ে তোলে। শুধু বের হয় না গলার স্বর। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে সে। পাশের সিটে শরীর এলিয়ে বসে আছে সেই লৌহশক্ত মনবল আর বলিষ্ঠ শরীরের ছয় ফুটের মানুষ। চোখের পাপড়ির ভাজে যেনো উত্তপ্ত নোনা জল। বন্ধ চোখে যেনো ঝড়ছে আগুনের লেলিহান শিখা। কপালের বা পাশ ফেটে ঝড়ছে টকটকে র*ক্ত। ফোটায় ফোটায় ভিজে যাচ্ছে পড়নের সাদা শার্ট। ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছে অবাধ্য হওয়া গলার গোঙানির শব্দ। মানুষটার কি জ্ঞান নেই? এই মানুষটা তো একটু আগেও সুস্থ ছিলো। গাড়ি কি তাহলে এক্সিডেন্ট হয়েছে? কিন্তু এক্সিডেন্ট হলে তারও তো ক্ষতি হতো। সিনথিয়া ভেবে উঠতে পারে না এইটুকু সময়ের মধ্যে হলোটা কি? ঠিক তখন দূরে কোথাও থেকে সুমধুর কন্ঠে ফজরের আযান। সিনথিয়া হা হয়ে বসে থাকে। সে তো মাত্র ঘুমিয়েছিলো। এখনি ফজরের আযান? এতো সময় কি করে চলে গেলো? সর্বদিক থেকে আতঙ্ক তাকে গ্রাস করে ফেলে। এই মূহুর্তে সে কি করবে? ইরফাদের এই অবস্থা হলো কি করে! এতো রক্ত কোথা থেকে আসলো? তাকে কোথায় নিজে যাবে সে। কাকে বলবে?
আযান শুনে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, কিছুক্ষণের মধ্যে বাসায় না ফিরলে বাসায় হুলস্থুল কান্ড বেজে যাবে। এদিকে ইরফাদের নাজেহাল অবস্থা দেখে সিনথিয়ার মাথা কাজ করছে না। কি করবে এখন? সিনথিয়া ভাঙা গলায় বলে,
— এসব কখন হলো? কিভাবে হলো….
ইরফাদ শত চেষ্টায় চোখ খুলতে পারছে না। চোখ থেকে যেনো শিরা ফেটে রক্ত বের হবে। চোখ টেনে টেনে তাকানোর চেষ্টা করে। রক্তশিক্ত চোখে সিনথিয়ার পানে তাকায়। চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ে। ব্যাথাটুকু ওষ্ঠে শুষতে থাকে বারবার। তারপর অস্পষ্ট স্বরে বলে,
— তুমি বাসায় যেতে পারবে? ঐতো বাসা দেখা যাচ্ছে…..
বলেই স্ট্রিয়ারিং এর উপর মাথা ঝুকিয়ে রাখে ইরফাদ। চোখের সামনে শক্তপোক্ত মানুষটির বেহাল দশা দেখে নিজের চোখ থেকেও টুপটুপ করে পানি পড়ে।শার্টের পেছনে রক্তে ভেজা। সিনথিয়া বুকটা ধুক করে ওঠে। ভেতরটা মূহুর্তেই শূন্য হয়ে যায়। সে ফুপিয়ে উঠে বলে,
— এতো রক্ত কেনো? কিভাবে হলো? এখন কি হবে?
ইরফাদ ক্ষাণিকটা দম নেয়। গলা রুদ্ধ হয়ে আসছে তার। তবুও আশ্বস্ত গলায় বলে,
— ডোন্ট প্যানিক!
আপনা-আপনি গলার স্বর বদলে যায় সিনথিয়ার। কখন যে গলার স্বর উঁচু হয়ে যায় নিজেই বুঝতে পারেনা। সিনথিয়া হাঁসফাস করতে করতে বলে,
— আরে এই মূহুর্তে কেউ স্বাভাবিক থাকবে নাকি? আমি এখন কি করবো?
ইরফাদ অনামিকা আঙ্গুলের ডগা ছোঁয়ায় নিজের ওষ্ঠে। যেনো ইশারায় বলছে,” চুপ করো।” সিনথিয়া থামে না। সে পাগলের মতো ছটফট করে। চোখের সামনে মানুষ মরে যাচ্ছে সে কি না চুপ করে থাকবে। সিনথিয়া চেঁচামেচি শুরু করে।
— আরে আপনাকে হাসপাতালে নিতে হবে।
— তুমি বাসায় যাও… প্লিজ।
–আমি যাবো না।
— প্লিজ সিনথি যাও! রাফি”কে খুজে পেতে তোমাকে প্রয়োজন। তাই এই মূহুর্তে কোনো প্রবলেম করা যাবে না। প্লিজ আজকের মতো বাসায় যাও…
সিনথিয়া অবাক হয়। একটা মানুষ এমন মুমূর্ষু অবস্থায় ও প্রোফেশন নিয়েই ভেবে যাচ্ছে। কি অদ্ভুত মানুষ। ইরফাদ কথা বলতে খেই হারাচ্ছে বারবার। যন্ত্রণায় ব্যকুল হয়ে যাচ্ছে। তবুও নিজের চোখ মুখ খিচে সব সহ্য করছে। সময় নিয়ে বার বার সিনথিয়াকে বলছে,
— প্লিজ যাও।
সিনথিয়া স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। এই মূহুর্তে তাকে ফেলে কি করে ঘরে ফিরবে সে। আর তিনিই বা কি করে বাসায় ফিরবে। তার যে অবস্থা তাতে ডক্টর না দেখালে অনেক বড় কিছু হয়ে যাবে। এই মূহুর্তে এই ভাবে মানুষটিকে ফেলে সে কি করে যায়! তার মন তো মানছে না। ইরফাদের গলার স্বর আরোও অস্পষ্ট হয়ে আসে। সে একবার চোখখুলে তাকায়। তারপর সিনথিয়ার পাশের দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে দেয়।নেতিয়ে যাওয়া শরীরে সর্বশক্তি সঞ্চয় করে ইরফাদ। গাড়ি থেকে নেমে সিনথিয়াকে টেনে নামায়। তারপর নিজের সিটে বসে নিস্তেজ হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ।
রং পর্ব ১৯
পাশের দরজা টেনে নেয়। তারপর গাড়ি স্টার্ট দেয় আবার। সিনথিয়ার চোখ থেকে টুপটুপ করে জল পড়ে।এতো কঠিন মানুষ হয়। এতো পাষাণ,কঠিন মন কারো হয়। সিনথিয়া সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে।ইরফাদ গাড়ি ঘুড়িয়ে নিতেই ভেতরটা হুহু করে ওঠে সিনথিয়ার।মানুষটার ক্ষত স্থান আর যন্ত্রণায় ভারী হয়ে আসা মুখ তার ভেতর ভেঙ্গেচুড়ে দিচ্ছে। ভেতরের তোলপাড় আর মনের মধ্যে সমুদ্রের মতো ওঠা উত্তাল ডেউ কি আদও থামবে সিনথিয়ার!!