রং পর্ব ২৩ (২)
তন্নী তনু
একটা ফুরফুরে স্নিগ্ধ আবহাওয়া নিয়ে সকালের শুরু। ইভা সকাল থেকে যন্ত্রমানবের মতো কাজ করে যাচ্ছে। ইরফাদের খাবার তার রুমে দিয়ে এসেছে। বাবার জন্যে রুটি সবজি বানানো শেষ। বাবার খাবার টেবিলে দিয়ে টুম্পার জন্যে খাবার নিয়ে যায় ইভা।গতদিনের ঘটনার রেশ তার হৃদয়ে এখনো আছে। জীবন নিয়ে তার আরেকটা বার ভাবা দরকার।নিজের ভুলে মেয়েটার জীবন সে নষ্ট করতে পারে না। মেয়ের মাথার উপর একটা ছায়া দরকার। হৃদয় ভেঙেছে বলে পুরো পৃথিবী থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বাকি পথটা কঠিন করার কোনো প্রয়োজন নেই। জীবনকে আরেকটা বার সুযোগ দেয়া উচিত। একজনের বিশ্বাসঘাতকতা পুরো জীবন নষ্ট করার অধিকার রাখে না। একটা ভুলের জন্যে নিজের আত্মা, নিজের হৃদয়কে প্রতিনিয়ত পোড়ানোর কোনো মানেই হয় না। সাজিদ যখন এতো করে চাইছে তাকে একটা সুযোগ দেয়া যেতেই পারে। ইভা সাজিদের নম্বরে একটা মেসেজ দেয়।
–“বিকেলে একবার বাসায় আসবেন। আমার কিছু কথা ছিলো।”
প্রয়োজনের চেয়ে সিনথিয়া আজ একটু বেশী-ই ঘুমিয়েছে। চোখ খুলেই বালিসের তলা থেকে ফোন দুটো বের করে নেয়। একটা ইরফাদের দেয়া অপরটি অচেনা মানুষের। প্রথমে ইরফাদের দেয়া ফোনটি চেক করে। কোনো কল, মেসেজ আসেনি। এরপর দ্বিতীয় ফোনটি অন করে।একই নম্বর থেকে দুটো মিসড কল। সিনথিয়া কল ব্যাক করে। কিন্তু কল যায় না। সিনথিয়া অপর ফোন থেকে ইরফাদকে কল দেয়।এই তো সুযোগ।এর ফাঁকে মানুষটার গলার বরফ শিক্ত, হিমায়িত স্বরটা অনেকটা সময় ধরে শোনা যাবে। সিনথিয়া কল দিয়েই সালাম দেয়। এরপরের কথোপকথন,
— স্যার!একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
— ইয়াহ সিউর।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এতো কঠিন মানুষটার হৃদয় আসলে কি দিয়ে গলানো যাবে সে তা জানে না। তবে যদি বুঝতে পারতো সেই অসাধ্য সে সাধন করতো। গত দিনগুলোতে ইরফাদ শক্ত গলায় কথা বলেছে। একটা সেকেন্ডও মন নরম করেনি। সিনথিয়া তাকে বুঝতে পারে না। সেদিন রাতের পর থেকে একটা কথা শোনার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। তবে তার যে কাঠকাঠ গলার উত্তর। সে আদও কি উত্তর দিবে। মনেমনে সিনথিয়া সিদ্ধান্ত নেয় উত্তর যেমন-ই হোক সে কথোপকথন চালিয়ে যাবে। মানুষটা যদি সঠিক হয় তাকে ভালোবেসে একটু নির্লজ্জ হওয়ায় যায়। সিনথিয়া ধীর গলায় চোখ বন্ধ করে বলে,
— আপনার ব্যাথা কমেছে?
–কিসের ব্যাথা?
— ঐ তো সেদিন রাতে কপালে কাটা ছিলো!
–হুম।
–আচ্ছা আপনার শার্ট পেছনে ভেজা কেনো ছিলো?
— বলবো না।
— আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। বলুননা প্লিজ প্লিজ…কি এমন হয়েছিলো সেদিন। মাথার মধ্যে প্রশ্ন গুলো শুধু ঘুরপাক খায়।
— পৃথিবীতে অনেক কিছুই ঘটে। তার সব জানতে হবে এমন নয়।
— পৃথিবীর কোনো কিছু আমার সামনে ঘটেনি। যেটা সামনে ঘটেছে ঐটার প্রতি জানার আগ্রহ আসতেই পারে। আপনার উপর কি এট্যাক হয়েছিলো?
–ধরে নাও যা খুশি।
— তাহলে আমার কিছু হলো না কেনো??
— আমি প্রোটেক্ট করতে জানি। ইউ মে হ্যাভ ফরগটেন ” হু আই আ্যম।”
সিনথিয়ার পাগল মনটা বন্য হরিণের মতো লাফিয়ে ওঠে।তাহলে কি সে রাতে তাকে বাঁচাতেই ইরফাদ নিজের জীবন বাজি রেখেছে। একটু আঁচ লাগতে দেয়নি। ইসস! এতো ভাললাগছে কেন!তার সব স্বপ্ন কি পূরণ হতে চলেছে। ইরফাদ তার জন্য এতো ভাবে? ছোট্ট খরগোশের মতো ফুরফুরে মনটা কেঁপে কেঁপে ওঠে। কল্পনার রাজ্যে দুটো দড়ির অবলম্বনে পাতা তক্তায় বসে শূন্যে দোল খায় সিনথিয়া। নিজের মধ্যেই নিজেকে হারিয়ে শূন্যে তাকিয়ে থাকে। ঠিক ঐ সময়ে ইরফাদের গলা,
–ডোন্ট থিংক এনিথিং সিনেমাটিক এন্ড ডোন্ট থিংক ইট ওয়াজ বিটেন টু সেভ ইউ। ইউ আর থিংকিং আপসাইড ডাউন অলওয়েজ।
সিনথিয়া একলাফে আকাশে যেমন উড়ছিলো ইরফাদের কথায় আবার ধপাস করে পড়ে। পাগল মনটার চিন্তাভাবনা অপর প্রান্তের মানুষটা বুঝে ফেলায় লজ্জায় পড়ে যায়। শরীর হীম হয়ে আসে।তবে লজ্জা এড়ানোর একমাত্র মাধ্যম তাকে বুঝানো ” আপনি যা বলেছেন তা আমি বুঝিনি।” সিনথিয়া বুদ্ধি খাটিয়ে সাথে সাথে বললো,
— বুঝলাম না।
ওপাশ থেকে ইরফাদ ওপাশ থেকে বলে,
— ট্রান্সলেট করবো??
সিনথিয়া সাথে সাথে বলে,
— “না না। কোনো প্রয়োজন নেই।” সিনথিয়া কথা ঘুড়িয়ে ফেলে। সে তাড়াহুড়ো করে বলে,
— ফোনে কল এসেছিলো।
— স্ক্রিনশট পাঠাও।
পয়েন্ট টু বি নোটেড ” এই ক্রাইমের আড়ালে যেই থাকুক সে তোমাকে ভালোভাবেই চেনে। টোয়েন্টি ফোর আউয়ার্স তুমি তার নজরে আছো। সো, বি কেয়ার ফুল। আমাকে হেল্প করার বিষয়টা তাকে আঁচও করতে দেয়া যাবে না।”
— ওকে!
— তোমার ভাইয়ার করা প্ল্যান অনুযায়ী কোন রাস্তাটুকু তোমাকে দৌঁড়াতে বলেছিলো মার্ক করে দাও।
সিনথিয়ার দুষ্টু মন শুধু সুযোগ খোঁজে। এতো সহজে লোকেশন দিলে ইরফাদের সাথে তো আর দেখা করতে পারবে না। তাই সে বলে,
— এভাবে কি করে বলবো?
— যেভাবে তোমার ভাই তোমাকে বলেছিলো।
— ঐ লোকেশন তো বলতেই পারি।কিন্তু কোথায় থেকে কোথায় গিয়েছিলাম কি করে বোঝাবো?
— ইটস ভেরি নেসেসারি টু নো। দ্যান আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড দেয়ার প্ল্যান।
— আই নোউ। কিন্তু না গিয়ে কি করে দেখাবো?
–কান্ট মিট নাউ সিনথি…আই উইল কল ইউ ইফ নেসেসারি।
সিনথিয়ার মনের মধ্যে টুক করে একটা ঘন্টি বাজলো। ইরফাদ কি বুঝতে পারলো – সে যে তার সাথে দেখা করার সুযোগ খোঁজে।
পৃথিবীর সব রঙ এখন বেরঙিন।দুচোখ ভরা শুধুই শূন্যতা আর অফুরন্ত জল। রিমা শুধু অন্ধকার খোঁজে। পৃথিবীর এমন কোনো জায়গা কি নেই যেখানে একটু লুকিয়ে থাকা যায়। একটু সস্তি পাওয়া যায়। কাল কি হবে? জীবনের কী হবে? শুভ্র কখনো কি ছাড়া পাবে? তাকে ঢেকিছাটা চালের মতো গুড়ো করে যে চলে গেলো তার সাথে কি আর সংসার হবে? এই বাচ্চাটার ভবিষ্যৎ কি? যে টিকে থাকার লড়াই তার জীবনে শুরু হয়েছে সেই যুদ্ধে কি সে টিকে থাকতে পারবে। বাচ্চা পৃথিবীর আলো দেখবে তো? এই সব প্রশ্ন তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়। আর কতো যন্ত্রণা তাকে সইতে হবে। আর কত? সেই সময়ে তার মায়ের আগমন। আগে তার মা ঘরে ঢুকলে ভালো লাগতো। এখন তার আত্মা কেঁপে ওঠে। সে জানে তার মা সেই একই কথা নিয়ে আসবে। রিমা চোখের জল মোছে। তারপর উঠে বসে। তার মা”য়ের গলা আজ ধীর শান্ত। মেয়ের পাশে বসেন,
— তোর বাবা ফোন দিয়েছিলো।
রিমা চুপচাপ শোনে। সে জানে তার বাবাও একই কথা বলে। এসবের উত্তর নেই তার কাছে। এক কান দিয়ে শুনে অন্যকান দিয়ে বের করা ছাড়া তার উপায় নেই। তার মায়ের আদুরে গলা,
— আমার মা! একটু বোঝ…. পিতৃ পরিচয়হীন সন্তান পৃথিবীতে অনেক কষ্ট পেয়ে বেঁচে থাকে। ছেলেটা ভালো হলে সব না হয় মেনে নিতাম। কিন্তু ঐ ছেলের সাথে তো আর সংসার করা সম্ভব না। বাচ্চা টা তুমি…
বাকি কথা শোনে না রিমা। তার আগেই কান্না এসে যায়। এই কথাগুলো শুনতে শুনতে সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। সে চেচিয়ে ওঠে,
— বাচ্চা টা কি ক্ষতি করেছে তোমার মা?? ভাত মাছ চেয়েছে? পিতৃ পরিচয়ের জন্যে খোঁচাচ্ছে?? ওর কি দোষ?
— ভালোভাবে বুঝাতে এসেছিলাম।বুঝলি না তো?
–আমাকে বোঝাতে হবে না। ভুল আমি করেছি সেই ফল আমার নিষ্পাপ বাচ্চাটা পেতে পারে না।
রিমার মা কথা চলাকালীন শক্তপোক্ত হাতে মেয়ের গালে পাঁচ আঙুল বসিয়ে দেয়। রিমা শক্ত হয়ে বসে। নাহ! কাঁদলে চলবে না।
বিকেল হতেই সাজিদ চলে আসে। টুম্পা দৌড়ে গিয়ে কোলে চড়ে। ইভা রান্নাঘরে নাস্তা রেডি করে। আজকে মন খারাপ করে নয় স্বেচ্ছায় খুশি মনে সাজিদের সামনে যায়। সাজিদকে খুব হাসি-খুশি প্রাণবন্ত লাগছে। ইভা আজ নিজেই জিজ্ঞেস করে,
— কেমন আছেন?
সাজিদের চোখ মুখে উপচে পড়া খুশি। কতো দিনের চেষ্টার পর ইভা তার সাথে কথা বলছে। সে উত্তর দেয়,
— আলহামদুলিল্লাহ্। তুমি?
— “আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো।” তারপর ছোট্ট একটা খাম হাত বাড়িয়ে দেয়। তারপর ধীর গলায় বলে, “পড়ে নিবেন।” তারপর বেড়িয়ে যায়। সাজিদ খাম খোলে। প্রথমেই সেখান থেকে ঝড়ে পড়ে গোলাপের পাপড়ি। এর মধ্যে একটা ছোট্ট সাদা কাগজ। সাজিদ কাগজ মেলে ধরে।
” জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত আমি ভুল নিয়েছিলাম। আমার হাতে নষ্ট করা সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস আমার জীবন। তবে অনেক ভেবে দেখলাম জীবনকে একবার ভালো থাকার সুযোগ দেয়া উচিত। আমি একটু সস্তি চাই। একটু শান্তি চাই। একটা পুরো রাত ঘুমাতে চাই। এর বাইরে চাওয়ার কিছু নাই। পারবেন? এইটুকু দিতে?”
সাজিদের চোখ মুখে রাজ্যজয়ী হাসি। টুম্পা এখনো সাজিদের কোলে। ফুলের পাপড়ি গুলো দেখে টুম্পা বলে,
— ফুল ছিড়ে ফেলেছো কেনো আংকেল? মামনি বকবে তো…
সাজিদ মেয়ের কপালে ছোট্ট হামি দেয়। তারপর বলে,
— আংকেল না মামনি! পাপা বলো পাপা।
সাজিদ চিরকুটের নিচে লেখে–” ভালোবাসা ছাড়া কিছুই দিতে পারবো না। চলবে?”
শিশির বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসে। রাতে সকলে একসাথে খেয়ে নেয়। তারপর যে যার রুমে চলে যায়। বারোটার দিকে শিশির তিথির রুমে যায়। শিশিরকে দেখে কুটুস আর তিথি উঠে বসে। কুটুস শিশিরকে দেখেই বলে,
— আজকেও ওয়াসরুমে বসে থাকবো???
— প্রয়োজনে থাকবি।
–কাল আমার ক্লাস টেষ্ট আছে ভাইয়া।
— তো ঘুমা। আমার বউরে আমার সাথে দিয়ে দে…
— মা যদি জানে মেরেই ফেলবে।
–কেউ জানবে না। ঘুম পারিয়ে এসেছি।
–মানে??
— মা ঘুমের ঔষধ খেয়েছেন। আর বাবা বাসায় নেই।
— কি বলছো?? তাই বলে ঘুমের ঔষধ?
— “কি করবো বউ ছাড়া ঘুম ধরে না।” বলেই তিথির কাছে যায় শিশির। তারপর বলে,
–তিথি চলে আয়! না হলে সকাল হয়ে যাবে।
তিথি এইটার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। সবটা শুনে তার পেটের তলায় শুড়শুড়ি লাগে। সে জড়সড় হয়ে বসে। হাত পা ঘামতে থাকে। শিশির এগিয়ে যায়। হাত ধরতেই সরিয়ে দেয় তিথি। আচমকাই পা দু”টো কাঁপতে থাকে। শিশির বিষয়টা খেয়াল করে। তিথিকে টেনে বাইরে নিয়ে যায়। কুটুস দরজা ভেজিয়ে দেয়। দরজার বাইরে গিয়ে তিথি দাঁড়িয়ে থাকে। টানা হ্যাচরা করে তিথিকে যখন সরানো যায় না। তখন পাঁজাকোলে তুলে নেয়। ঘন অন্ধকারে শিশির তিথির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,– “কাঁপাকাঁপি, কান্নাকাটি গ্রহণযোগ্য নয়। শুধুই প্রেম।”
রং পর্ব ২৩
সিনথিয়া এপাশ ওপাশ করছে। ঘুম আসছেনা। ফোনটা মৃদু কেঁপে ওঠে। সিনথিয়া ফোন ওপেন করে দেখে,
— তোমাকে ট্রিট দেয়ার ছিলো। লং ড্রাইভে যাবে???
সিনথিয়া আকাশ থেকে পড়ে। সব স্বপ্ন নাকি??
সিনথিয়া সাথে সাথে বলে,–অবশ্যেই।