রং পর্ব ২৪

রং পর্ব ২৪
তন্নী তনু

অপ্রত‍্যাশিত জিনিস গুলো হঠাৎ করে উড়ে এসে হাতের মুঠোয় ধরা দিলে অনুভূতি গুলো সমুদ্রের উচ্ছাসের মতো ঢেউ খেলে যায়।যে মানুষটাকে একপলক দেখার জন‍্যে সারাদিন ছটফট করে। সেই মানুষটি নিজে থেকে তাকে যেতে বলছে। সে কি না গিয়ে পারে? সিনথিয়া আলমারি থেকে ড্রেস বের করে। ঠিক ঐ সময়ে ফোনটা আরেকবার কেঁপে ওঠে,
— বোরকা পড়ে আসতে পারবে?
সিনথিয়া সাধারণত বোরকা ছাড়াই চলাফেরা করে। তাই তার বোরকা নেই। সিনথিয়া বসে কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর বলে,

— শুধু নিকাব পড়লে হবে না?
ইরফাদ লিখে,
–কাম সাচ আ লুক। অ‍্যট ফাস্ট সাইট, নো ওয়ান ক‍্যান আইডেন্টিফাই ইটস ইউ।
সিনথিয়া লিখে,
— হু উইল সি এন্ড নোউ আস
এট দ‍্যা মিডনাইট?
–টু বি ফরওয়ার্নড ইজ টু বি ফরআর্মড।
সিনথিয়া চিন্তায় পড়ে যায়। তার কাছে এই মূহুর্তে কোনো বোরকা নেই।এখন কি করা যায়?? এই টুকুর সমস‍্যার জন‍্যে কি তার দেখা করা হবে না? মন টা খারাপ হয়ে যায় তার। কি করবে ভেবে পায় না।ইরফাদ আরেকটা মেসেজ দেয়,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— এট দিজ টাইম, ইটস ভেরি রিস্কি টু গো আউট টুগেদার। দ‍্যাটস বি কেয়ারফুল।
সিনথিয়া আলমারি থেকে একটা কুর্তি বের করে নেয়। তার ওড়নাটা সুন্দর করে মাথায় পেঁচিয়ে নেয়। উপর দিয়ে পড়ে নেয় রেইনকোট।কিচ্ছু করার নেই। সব বাঁধা বিপত্তি পার করে সে আজ যাবেই। সিনথিয়া বের হওয়ার সময় মুগ্ধকে ডাকে। তার ফোনে একটা মেসেজ পাঠায়। তারপর দরজা লক করে বাইরে বেরিয়ে আসে। বাসার দিকটা মুগ্ধ এইবার ঠিক সামলে নিবে।ভোর হলে হোক। আজ কোনো অসুবিধা নেই। নেই ফেরার তারা। সিনথিয়া ধীর গতিতে পা চালিয়ে বাইরে যায়। রাস্তার মোরে আবছা আলোয় কাউকে দেখা যাচ্ছে। পাশে রাখা বাইকের সামনে পায়চারী করছে। মাথায় হেলমেট দেয়া।সিনথিয়া বাতাসের মতো দৌড়ে যায়। সামনের মানুষটি বলে,

— রিলাক্স….. রিলাক্স….
সিনথিয়া থামে। সিনথিয়া ড‍্যাপ ড‍্যাপ করে তাকায়। তারপর বলে,
— আমাকে চেনা যাচ্ছে?
–নাহ! কিন্তু রেইনকোট ক‍্যানো?
— সবাই যেনো না চিনতে পারে তাই।তাহলে আপনি কি করে চিনলেন?
— আমাকে চেনা যাচ্ছে?
— ওতোটাও না। তবে আপনি ছাড়া এই রাস্তার মোরে কেউ ওয়েট করার ছিলো না।
— আমিও ওভাবেই চিনলাম আপনাকে।
সিনথিয়া নিজের মাথায় চাপড় দিলো। “আস্ত গাধা”। ইরফাদ বাইকে উঠে বসে। সিনথিয়াকে হেলমেট এগিয়ে দিয়ে বলে,– রেইনকোট খোলো। এটা পড়। তারপর বাইক স্টার্ট দেয়। সিনথিয়া রেইনকোট খুলে হেলমেট পড়ে নেয়। ইরফাদ ইশারায় বলে,

— বসো।
সিনথিয়া নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। সে কি স্বপ্ন দেখছে? মেঘ না চাইতেই জল। বিস্ময়ে চোখ গোল গোল হয়ে যায়। বাইকে তার পেছনে বসার সৌভাগ্য তার হলো। ঐদিকে ইরফাদ আরেকবার তাড়া দেয়,
— এনি প্রবলেম??
সিনথিয়া মাথা নাড়ে-“নাহ।” তার পর তাড়াতাড়ি করে বাইকে বসে। ইরফাদ আর তার মধ‍্যে অল্প একটুখানি দূরুত্ব। সংকোচে জড়সড় হয়ে বসা ছাড়া উপায় নেই। ইরফাদ বলে,
— আর ইউ ওকে??
–হুম।
— ” এভাবে ব‍্যালেন্সড রাখতে পারবে না।”
সিনথিয়ার পাতলা ওষ্ঠধরে খুশি ঝিলিক দিয়ে ওঠে।ইরফাদ তাকে ধরতে বলছে? ঘুমের ঘোরে দেখা স্বপ্ন মনে হচ্ছে সবকিছু।
ইরফাদ তার প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের ব‍্যাগ সামনে থেকে নিয়ে স্কুল ব‍্যাগের মতো ঝুলিয়ে নেয়। তারপর বলে,

— অনেক দূর যেতে হবে। আমাকে ধরে বস। না হলে পড়ে যাবে।
আকাশের চাঁদ মাটিতে যেনো নেমে এসেছে।
চারপাশ শুনশান নিরবতা। মধ‍্যে রাত। পথঘাট জনমানব শূন‍্য। বাতাসে নাচানাচি করছে গাছের পাতা।সোজা পিচ ডালাই করা রাস্তা।ছুটে চলছে বাইক।একঝাপটা বাতাসে সিনথিয়ার ওড়না উড়ছে।ইরফাদের পেছনে ব‍্যাগ ঘেঁষে বসে সিনথিয়া। হাত দুটো দিয়ে আলতো স্পর্শ করে আছে ইরফাদের কাঁধ। সব যেনো ঘোর লাগানো অনুভূতি। রাস্তায় বাইক ছুটে চলছে। সিনথিয়া সামনের মানুষটির সাথে সমানতালে দুলছে। আর মানুষটির আলতো ছোঁয়া পেয়ে ভেতর থেকে হাওয়াই মিঠায়ের মতো গলে যাচ্ছে সিনথিয়া।

ঘন আধার নামানো রুমের চারদেয়াল। বিছানায় বসে আছে শিশির। কোলের উপর মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে আছে তিথি। পাঁচ আঙ্গুল হাত বুলিয়ে দিচ্ছে শিশির। তিথির ধীর গলা অস্পষ্ট কথাগুলো শিশির শোনার চেষ্টা করছে,
— মামি খুব কষ্ট পাবে। আমি খুব ভয় পাচ্ছি।
— কোনো ভয় নেই। আমি আছি না?
— যদি মেনে না নেয়?
–মেনে না নিয়ে কি করবে? ছেলেকে কে তো আর ফেলে দিতে পারবে না।
— আমাকে মামি সহ‍্য করতে পারে না।
— না পারুক! আমি তো ভালোবাসি।
— খুব ভয় করছে।
–“এসব বাদ দে তো” শিশির আলতো হাতে স্পর্শ করে তিথির হাত। পুরো মানুষটাকে তুলে নেয় নিজের কোলের উপর। তিথির শ্বাস ভারী হয়। শিশির ফিসফিসিয়ে বলে,
— ভালোবাসি বলতো…..

তিথি মজা করে অনেক মানুষকেই ভালোবাসি বলেছে। অনেক দুষ্টুমি সে করেছে। অনেক দূরন্তপনা, পাগলামী করে থাকলেও আজ নিজেকে খুব অপ্রস্তুত লাগছে। আড়ষ্টতায় অন্ধকারেও চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। জীবনের প্রথম কোনো পুরুষের সংস্পর্শে এসে শরীর বরফের মতো হীম হয়ে আসছে। চাইলেও শিশিরের শক্ত বলিষ্ঠ হাতের প‍্যাঁচ থেকে সে বের হতে পারছে না। বুকের মধ‍্যে শব্দের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। শিশির আবার তাড়া দেয়,
— বলনা।
তিথি বরফের মতো জমে যায়। শিশির কানের উপর কোমল বরফশিক্ত ওষ্ঠধর রেখে ফিসফিসিয়ে বলে,–“ভালোবাসি।”
তিথি কেপে ওঠে। ছাড়িয়ে নিতে চায় শিশিরের বাঁধন। তবে বলিষ্ঠ হাতের বেড়াজালে সে আরও গভীরভাবে আটকে যায়। শিশির আবারও ফিসফিসিয়ে বলে,” তোমার সমস্ত ব‍্যাথা এই ঠোঁটের স্পর্শে শুষে নিবো। এর আগে তোমার মুক্তি নেই।”

সুবিশাল আকাশের নিচে দুজন মানুষ ছুটে চলছে অজানা গন্তব্যের দিকে।সিনথিয়া ক্ষণে ক্ষণে লম্বা শ্বাস টেনে নিচ্ছে ভেতরে। আজ হৃদয়ের গহীনে ফুরফুরে অনুভূতি। ভালোলাগায় বরফশীক্ত হয়ে আসছে হাত পা। পিঠের মেরুদন্ড বরাবর বয়ে যাচ্ছে ঠান্ডা ঠান্ডা শিহরণ। পাখির মতো ডানা মেলে দিতে ইচ্ছে করছে। ইরফাদের হাত কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নেয় সিনথিয়া। মেলে দেয় দুদিকে। দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে নেয়। নির্মল স্নিগ্ধ বাতাস হৃদয় স্পর্শ করে। সেই সাথে শুনতে পায় একটা শক্ত গলা,

— এই!হাত নামাও- মরার শখ হয়েছে নাকি?
সিনথিয়া পুরো স্বপ্নের পৃথিবী থেকে বাস্তবে ফেরে। ধমকের সুর আত্মা কাঁপিয়ে দেয়। সে চুপচাপ আগের মতো বসে। অনেকটা পথ এগিয়ে যায়। দুজনের মধ‍্যে পিনপতন নিরবতা। ইরফাদ নিরবতা ভাঙ্গে।
— তুমি কি জানো অন‍্যের পারসোনাল জিনিসে হাত দেয়া অন‍্যায়?
সিনথিয়া বুঝে উঠতে পারে না। হঠাৎ এই কথা কেনো বলছে! সে স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দেয়,
— হুম জানি।
— তাহলে আমার ডায়েরি খুলেছিলে কেনো?
সিনথিয়ার ভেতরের সত্তা একবার পৃথিবী কাঁপিয়ে চিৎকার দেয়। হাত দুটো কাঁধ থেকে সরে যায় আপনাআপনি। একজন এসপির ডায়েরি পড়ার অপরাধে কোন শাস্তি যে পেতে হবে। ইরফাদ ধীর গলায় বলে,
— পড়ে যাবে কিন্তু…..
সিনথিয়া আবার ধরে বসে। ইরফাদ গাড়ির স্পিড কমায়। তারপর সাইডে দাঁড় করায়।দুজন-ই নামে। সিনথিয়া মাথা নিচু করে আছে। ইরফাদ আরেকবার বলে,

— ডায়েরি কেনো ধরেছিলে?
— আপনি কি করে জানলেন?
ইরফাদ চোখ বড় বড় করে তাকায় তারপর বলে,
— বলতেই হবে??
সিনথিয়া ভয় পায়। বলে,
— নাহ নাহ ঠিক আছে…. আসলে ঐদিন যখন আমাকে একা গাড়িতে রেখে গেলেন। আমার সময় যাচ্ছিলো না। এমনি এদিক সেদিক করতে করতে ব‍্যাগ খুলেছিলাম। কৌতুহলবশত পড়ে ফেলেছি। এখন আপনি যা শাস্তি দেবেন মাথা পেতে নিবো।
— অন‍্যের পারসোনাল বিষয় ঘাটাঘাটি মোটেও পছন্দ করিনা। এটা অন‍্যায়…
সিনথিয়া মাথা নিচু করে থাকে। মনে মনে বলে,” এই হলো ট্রিট। আহা! অন্তর জুড়িয়ে যাচ্ছে! তাইতো বলি এসপি দিবে ট্রিট” লং ড্রাইভ”! হাউ ফানি।”
ওপাশের মানুষটার গলা একটু গম্ভীর।

— সব যখন পড়েই নিয়েছো। কি আর করার। শাস্তিস্বরূপ একটা ট্রিট তোমাকেই দিলাম।আজকে সেই স্পেশাল দিন। “20-04-2014 ” এই দিনেই আমাদের বিচ্ছেদ হয়েছিলো।
সিনথিয়া চোখ তুলে তাকায়। বুকের মধ‍্যে হঠাৎ করেই শূন‍্য হয়ে যায়। ডায়েরিতে অনেক কিছু ছিলো। তবে অনেক প্রশ্নও ছিলো। ইরফাদ যে নিজে থেকে বলবে তা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি সে। ইরফাদ যখন বলবে এর পেছনে কারণ থাকবে না তা তো হতেই পারে না।
ইরফাদের গলাটা আবারো গম্ভীর। আকাশের চাঁদের দিকে মুখ করে তাকায়। সাদা পাঞ্জাবী জড়ানো লম্বা চওড়া মানুষটিকে আজ একটু বেশীই স্নিগ্ধ লাগছে।তবে তার গমগমে গলাটা নেই।
ছোট বেলা থেকে গানের প্রতি একটা আলাদা ভালোবাসা ছিলো। গান শিখতাম। কলেজের একটা প্রোগ্রামে গান গেয়েছিলাম। তবে ঐ স্টেজে রিকুয়েস্টেড একটা গান গাইতে বলা হয়। আমার সাথে ডুয়েট করার জন‍্যে যে মেয়েটা স্টেজে আসে মেয়েটার নাম নিধি। এখানে থেকেই শুরু। মেয়েটা এতো এতো এতো এতো পাগলামী করতো। একপর্যায়ে আমি দূর্বল হয়ে যাই।

একটা সময়ে নিধির বাসা থেকে বিয়ের জন‍্যে প্রেশার দেয়া হয়। ঐ সময়ে আমার পরিচয় আমি একজন স্টুডেন্ট। আর বেকার ছেলের সাথে কেউ মেয়ে বিয়ে দিবে না।এদিকে আমাকে নিয়ে বাবার আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন। তিনিও বিষয়টা জানলে মানতে পারেন না। তখন আমি টিনএজার- দুজন দুজনের হাত ধরে অজানা, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াই। বন্ধুদর সহযোগিতায় আমাদের বিয়ে হয় ১০-০৪-২০১১ তারিখে।
এক আকাশ পরিমাণ চিন্তা আমার মাথার উপর।পকেটে অনলি সিক্সটি হান্ড্রেট এইটি টাকা। পৃথিবীর সব কিছু উপেক্ষা করে আমার কাছে ছুটে আসা এক স্বপ্নচারিনীর হাত তখনও আমার হাতের মুঠোয়। ঐ কোমল হাতে কি আমি দুঃখের স্পর্শ লাগাতে পারি।ঐ কোমল হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুড়ে আমি হাসি মুখের আড়ালে ঠেকিয়েছি পাহাড় সমান দুঃশ্চিন্তা। কোথোয় যাবো! কি করবো!কি খাওয়াবো?

সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো ছেলেটা একদিনেই দায়িত্ব নিতে শিখে গেলো। একটা ছোট্ট বাসা নিলাম।একহাজার টাকা এডভান্স বাকিটা পরে পরিশোধ করার প্রয়াস দিয়ে মাথা গোজার জায়গা পেলাম। বালিশহীন মাথা আমার। তবে তার জায়গা কিন্তু আমার বুকেই ছিলো। তাকে হাতের উপর বুকের উপর রেখেই শান্তির ঘুম।
খাওয়া, ঘুম, পড়াশুনা আর গানের বাইরে আমি তখন কিচ্ছু জানি না। তবে ঘরে যে আমার স্বপ্নচারিনী আমার হৃদয়ের রাণী। তাকে তো কষ্ট দিতে পারিনা। আমার তখন অনেক দায়িত্ব। বন্ধুদের থেকে ধার দেনা করে দশ দিন ওভাবেই যায়। তবে এভাবে আর কতো দিন।

বাসায় পারসোনাল “কার” থাকার কারণে ড্রাইভিং টাই জানতাম। তবে রেফারেন্স ছাড়া কেউ ড্রাইভিং এর জন‍্যেও নেয়নি। কি করবো? না খেয়ে থাকবো? আমি না হয় থাকলাম কিন্তু আমার ভালোবাসা, আমার ভালোবার মানুষটাকে তো কষ্ট দিতে পারি না। আমি সে সময় সাত মাস ভাড়ায় অটো চালিয়েছি।অল্প আয়ে আমার ছোট্ট চড়ুই সংসার। এর মধ‍্যেও ওর ছোট ছোট ইচ্ছে গুলো পূরণ করার চেষ্টা করেছি। নিধি আইসক্রিম খুব পছন্দ করতো। আশে পাশে ঐ আইসক্রিম পাওয়া যেতো না। অনেক রাতে আমি অনেক দূর থেকে আইসক্রিম এনে দিতাম। শূন‍্য পকেটে কখনো ফুচকা কখনো পনেরো টাকার আইসক্রিম ভাগ করে খেয়েও সুখী ছিলাম। একটা সময় দুজনের পড়াশোনা চালাতে আমি হিমশিম খেয়ে যাই। মনে হতো আমি পৃথিবীর কাছে হার মেনে যাবো। নিধির কলেজ এর ফিলআপ ডেট যতো এগিয়ে আসে আমার হৃদয় নাড়া দেয়। আমার রাতের ঘুম চলে যায়।

স্বপ্নের ঘোরে আমি দেখি- আমাকে আমার প্রতিচ্ছবি বলে। পারলি না তো। স্বপ্ন দেখিয়ে যে মেয়ের হাত ধরে অন‍্যে পৃথিবীতে এলি। তাকে তুই ভালো রাখতে পারলি না তো? আমি ভাঙবো, নিঃশেষ হবো তবুও হার মেনে নিতে পারবো না। আমার ব্লাড গ্রুপ ছিলো “ও”

নেগেটিভ।ঐদিন বাইশশত টাকার বিনিময়ে আমার ব্লাড সেল করি। আমার রক্তের বিনিময়ে চলে নিধির স্টাডি।
একসময় যা উপার্জন করি তাতেও আর হয়ে ওঠে না। পরবর্তীতে বন্ধুর সহযোগিতায় গার্মেন্টস সেক্টরে জব হয়। যা স‍্যালারি পেতাম দুজনের টেনেটুনে হয়ে যেতো। এভাবেই চলছিলো। আমি সব কিছুর ফাঁকে টুকটাক জিনিসপত্র কিনি। তখন বলা চলে আমার কষ্টের দিন প্রায় শেষ।একদিন নিধি রান্না করছিলো। আমি বিছানায় বসে আছি। ওর ফোনটা আমার পাশেই ছিলো। ঐসময়ে একটা কল আসলো। স্বাভাবিক ভাবেই কলটা রিসিভ করলাম। কিন্তু আমার স্বর শুনে কলটা কেটে দিলো। কেনো যেনো ডাউট হলো।তখন নাম্বারটা আমার ফোনে সেভ করে নিলাম।
অফিসে কাজ চলাকালীন মাঝে মধ‍্যে নিধিকে কল দিতাম। কিন্তু বেশীর ভাগ সময়-ই ওয়েটিং। বুকের মধ‍্যে অশনী সংকেত দিতো। আমি আগের টুকে রাখা নাম্বারটায় অন‍্য সীম দিয়ে কল দিয়ে দেখতাম ওয়েটিং। দুটো নম্বর একসাথে ওয়েটিং পেয়ে যন্ত্রণায় আমার ভেতরটা ছিড়ে যেতো। তবুও সব চুপচাপ সয়ে নিতাম। অপেক্ষা থাকতাম নিধি নিজে থেকে কিছু বলে কি না?

সেদিন রাতে অফিস থেকে ফিরে আমি অসম্ভব টায়ার্ড। তাকে বললাম,” একটু পানি দাও তো।” তার সোজাসাপ্টা গলা,” নিয়ে খাও।” এখানেই শুরু কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে আমি ছেলেটার কথা বলে ফেলি।সে ভুত দেখার মতো চমকায়। রাগারাগি হয়। এক পর্যায়ে আমি নিজের উপর ব‍্যালেন্সড হারিয়ে ফেলি। এক পর্যায়ে ওকে একটা থাপ্পর দেই। সাথে সাথে নিধি বলে,”আমি তোমার সাথে আর থাকবো না আমি ডিভোর্স চাই।” এই কথাটা শুনে পুরো দুনিয়া আমার সামনে অদৃশ‍্যমান হয়ে যায়।

রং পর্ব ২৩ (২)

নিধি সকালে সকালে বাসায় চলে যায়। আমি তখনো বুঝতে পারছিলাম না। যা হচ্ছে সত‍্যি নাকি স্বপ্ন।সেদিন থেকে নিধি আমার সাথে আর যোগাযোগ করে না। আমি নিজের মধ‍্যেই ছিলাম না। দুজন মিলে যে স্বপ্নের ঘর গড়ে তুললাম তা চোখের সামনে ঝুরঝুরে বালির মতো ভেঙ্গে পড়ছিলো। কষ্ট, যন্ত্রণায় আমার ভেতরে এতোটাই তিক্ত যে গলা দিয়ে পানি নামতো না। নিধিহীন ঐ শূন‍্যঘরে আমি টানা সতেরো দিন ভাত স্পর্শ করতে পারিনি।

রং পর্ব ২৫