রং পর্ব ৩৪
তন্নী তনু
সূর্যের প্রখর তাপ আর ভ্যাপসা গরমে শরীর ঘেমে উঠছে। মাথার উপর ফ্যান অনবরত ঘুরছে। গায়ের ভারী লেহেঙ্গাটা এখনো সেভাবেই আছে। পা দুটো বাঁধা। শূন্য টাইলস করা শুভ্র মেঝেতে গুটিয়ে শুয়ে আছে সিনথিয়া। বেলা বাড়ছে। মাথায় কতশত কথা কতো প্রশ্ন। জীবন তাকে শূন্য ভেলায় তুলে কোথায় থেকে কোথায় নিচ্ছে নিজেও জানে না। রাফির কথাগুলো মাথায় ঘুরঘুর করছে। রাফি এখানে কি করে এলো। নিলয়কেই বা কিভাবে চিনলো। দুজনের যোগাযোগ হলো কি করে? সবচেয়ে বড় চিন্তা ইরফাদ কে নিয়ে। কোথায় আছে ইরফাদ? ইরফাদ কি জানে! সিনথিয়া বাসায় পৌঁছাতে পারেনি। ইরফাদ কি তাকে খুঁজছে? নাকি এখনো জানতেই পারেনি।
চিন্তা যেনো মাকড়শার জালের মতো জড়িয়ে ধরে। ঠিক ঐ সময়ে দরজা ক্যাচক্যাচ করে ওঠে। সামনে দাঁড়ানো রাফি। হাতে বড়সড় প্লেট। রুমে ঢুকে যায় রাফি। পা দিয়ে দরজা ভেজিয়ে দেয়। বড় থালাটা এনে মেঝেতে রাখে। খুলে দেয় সিনথিয়ার হাতের বাঁধন। মুখে গুজে রাখা কাপড় টেনে বের করে সিনথিয়া। ফোঁস ফোঁস করে কয়েকটা শ্বাস নেয়। যেনো অনেককটা সময় দম বন্ধ ছিলো। রাফি খাবারের উপর থেকে ঢাকনা সরায়। বাসমতি চালের সাদা ধবধবে ভাত। ছোট সাইজের একটা রূপচাঁদা মুচমুচে করে ভাজা। দুটো ছোট ছোট বাটি রাখা।একটাতে গরুর গোস আরেকটা বাটিতে কাকড়া স্পাইসি করে রান্নার কোনো আইটেম হবে। অনেকটা সময় পেটে দানা পড়েনি। ধোয়া ওঠা গরম ভাত আর লোভনীয় খাবার দেখেই জিভ ভিজে ওঠে সিনথিয়ার। মনের অজান্তেই ঢোক গিলে ফেলে সিনথিয়া। রাফি সিনথিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। তারপর বলে,” খিদে পেয়েছে? আমি জানি তুমি এসব পছন্দ করো।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রাফির বলা কথায় পেট থেকে সমস্ত খিদে যেনো উবে যায়। রাফি মিথ্যা বলে বিয়ে করেছিলো। সে সময় যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলো সে চট্টগ্রাম যাবে। এই নিয়ে কথাও হয়েছিলো। কথার পৃষ্টে সে বলেও ছিলো স্পাইসি কাকড়া তার খুব পছন্দের। মানুষটা তাকে ঠান্ডা মাথায় ঠকিয়েছে। এখন আবার পছন্দের তারিফ করতে এসেছে। যত্তসব নাটক। সিনথিয়া মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। মেঘের মতো চোখ দুটো দেখে রাফি মেঝেতে বসে। সিনথিয়ার মুখ পানে চেয়ে থাকে। ভেজা গম্ভীর গলায় বলে,
— বিশ্বাস করো আমি নিরুপায় ছিলাম। ঐ মূহুর্তে আমার দম নেওয়ার অবস্থা ছিলো না।
সিনথিয়া মুখ ফেরায় না। মুখে চরম বিরক্তি। দাঁতের উপর দাঁত ফেলে রাখে সে। রাফি হাত বাড়িয়ে একবার হাত ধরতে চায়। তারপর নিজেকে গুটিয়ে নেয়। তারপর বলে,
— তুমি তো জানতে আমি জবলেস ছিলাম। ঐ সময়ে কতো খারাপ সময় গিয়েছে আমার। আমি একটা বিজনেস করতে একজনের সাথে পার্টনারশিপ ছিলাম। চাচার মাধ্যেমে লোনের ব্যবস্থা করি।ঐখানে অনেক টাকা লস হয়ে যায়। অনেক অনেক ঋণের বোঝা আমার ঘাড়ে ছিলো। ট্রাস্ট মি সিনথি…..! ঐ সময়ে ব্যাংক লোন গুলো আমার ঘাড়ে পাহাড়ের মতো বোঝা হয়ে গিয়েছিলো। প্রতি মাসের ইনস্টলমেন্ট দিতে পারতাম না। বাবা জেনে যায়। তারা কোনো হেল্প করে না। ঐদিকে লোন টানতে না পারায় কেস হওয়ার মতো সিচুয়েশন তৈরী হয়। ঐ সময়ে বাবা শর্ত দেয় এক শর্তে তিনি আমার ঋণ পরিশোধের ভার নেবেন।আমাকে বিয়ে করতে হবে। তবেই আমি টাকা পাবো। অনিমার বাবা আর আমার গ্রামের বাসা একই জায়গায়। ওদের সাথে আমাদের জমি নিয়ে ঝামেলা আছে। বাবার শর্ত ছিলো অনিমাকে বিয়ে করতে হবে। তবে ই আমার বাবা আমার ঋণের ভার নিবেন।
জমিজমার যে ভেজাল ছিলো! একমাত্র আমি অনিমাকে বিয়ে করলেই সেগুলো অনিমার বাবা আমার নামে করে দিতেন। এটাই ছিলো অনিমার বাবার কন্ডিশন। আমার বাবাও এটাই চাইতেন। তবে আমি একটা অন্যায় করেছিলাম। আমার উচিত হয়নি। নিজের জন্যে অন্য একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করা আমার উচিত হয়নি। আমি তখন বাবাকে শর্ত দেই- “জমিজমার ঝামেলা মিটে গেলে আমি মেয়েটিকে ডিভোর্স দিবো।” বাবা শুধু বলেছিলেন,”পরের বিষয় পরে দেখা যাবে।”
যেহেতু বিয়েতে রাজি ছিলাম না। নরমালি আমার মুড খারাপ ছিলো। সে সময় বাবা বলেছিলো, আমাকে দেখে না বোঝা যায় আমি বিয়েতে রাজি নই। মেয়ের পরিবার যেনো কোনো ভাবেই এসব আঁচ না করতে পারে। বিয়েটা সেভাবেই করেছিলাম। সবার সামনে নিঁখুত অভিনয় আমি চালিয়ে গেছি। ট্রাস্ট মি আমি বুঝতেও পারিনি তুমি ছিলে। আমি জানলে এতো বড় কষ্ট আমি তোমাকে দিতাম না সিনথি।
সিনথিয়ার যেনো ভ্রুক্ষেপ নেই এসব কথার। কথার দিকে মন নেই। সে শূন্য দেয়ালে তাকিয়ে কিছু ভাবছে। রাফি আবার বলা শুরু করে,
— এর পরে বাসায় ফিরি। আমি অনেক দূরে দূরে ছিলাম। রুমে যাচ্ছিলাম না। ঐ সময়ে বাবা, পরিবারের মানুষ আমাকে খুব প্রেশার দেয়। আর কন্ডিশন তো আছেই। আমি বাসায় থেকে বের হতে পারি না। তাদের কথা ছিলো জমির ঝামেলা না মেটা অবধি আমাকে বিয়ে বিয়ে খেলা চালাতেই হবে।আমি ঐদিন রাগে ক্ষোভে ড্রিঙ্কস করি। অনেক রাত অবধি আমি অন্য রুমে ছিলাম। এরপর জোরপূর্বক ভাবে আমাকে রুমে দেয়া হয়। আমি ঐ রুমে ঢুকে বিছানায় যাইনি। ওয়াশরুমে আধঘন্টা বসে ছিলাম। এরপর দরজার বাইরে থেকে নক দেয় মেয়েটি। আমি সব সহ্য করে নিয়ে নিজেকে শক্ত করে বিছানায় আসি। ওই মেয়ের সাথে আমি তখনও একটা কথা বলিনি।বালিসে শুয়ে শুধু বলেছিলাম আমি খুব টায়ার্ড।তারপর ঘুমিয়ে গেছি। তখন মাঝরাত। কেউ আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে দুহাতের আলিঙ্গনে ঝাপটে ধরে আছে। আমার ড্রিঙ্কসের নেশায় চোখ ঝাপসা। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় আমি তো দেখলাম — একটা পিচ্চি মায়াবি মুখ। যার ভ্রু দুটো কালো মেঘের মতো। চোখ দুটো টানা টানা। বন্ধ চোখের পাপড়ি গুলো আরাম করে শুয়ে পড়েছে। শ্যামা মায়াবীনি। কি যে স্নিগ্ধ….
সিনথিয়া ফিরে তাকায়। যেমন বর্ণনা রাফি দিচ্ছে অনিমা মোটেও এমন নয়। অনিমা ফর্সা সুন্দরী। সিনথিয়া বলে,
— মাতাল নাকি?? অনিমা মোটেও শ্যামা না। আর ওর চোখ ও এমন বড় না।
— সেটাই তো বলছি পাখি। আমি তো পুরো ঘরে অনিমাকে দেখলাম না। আমি তো তোমাকেই দেখলাম….
সিনথিয়া বসা থেকে কেঁপে ওঠে। রাফির মুখটা ভার। সে ভেজা গলায় বলে,
–আমি সে রাতে শুধু তোমাকেই দেখেছি।যেহেতু আমি ড্রাঙ্ক অবস্থায় ছিলাম। আমি তোমাকে মনে করেই আমি অর্ধশত চুমু খেয়েছি ঐ মুখে। তারপর যা হয়েছে আমি নিজের মধ্যেই ছিলাম না। আমি বেসামাল হয়ে গ্রীবা থেকে উন্মুক্ত উদরের বিবর অবধি ছুঁয়ে ফেলেছি। তোমার খোঁপা করা চুলের নিচের অংশটুকু দুই বছরে বহুবার খেয়াল করেছি। কিন্তু কখনো আবদার করিনি।ঐসময়ে গভীর ভাবে ছুঁয়ে ফেলেছি। সকালে উঠে দেখি তুমি নেই কোথাও নেই। তুমি কোথাথাও নেই। চোখের সামনের মেয়েটা অনিমা। পরের সময়গুলো আমার শব্দহীন কান্নায় বালিশ ভিজে গেছে। বিশ্বাস করো আমি ঐ মেয়েকে আর একবারের জন্যেও স্পর্শ করিনি। আর কিচ্ছু হয়নি আমাদের মাঝে। যা হয়েছে সব ভুল করে…..
সিনথিয়া রাফির চোখের দিকে তাকায়। চোখ দুটো ছলছল করছে। রাফি চোখ তুলে তাকায়। সিনথিয়া চোখ সরায়। রাফি বলে,
— আমি শুধু বিয়ের নিয়ম টুকু পার করেই ঢাকা চলে এসেছি। এতো গিল্টি ফিল হয়েছে। মনে হয়েছে সব খুলে বলবো। তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবো। আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু বলার আগেই ঐ ঘটনা ঘটলো। কিডন্যাপ করেছিলো তোমার ভাই। যার উদ্দেশ্যে ছিলো আমি কিডন্যাপ হবো। তুমি ফেঁসে যাবে। আর এইখানের কেস এসপি ই দেখে। কোনো না কোনো ভাবে এসপির সাথে কানেক্টেড হতে পারলেই হলো। পরে তোমাকে দিয়ে এসপিকে ট্র্যাপে ফেলবে। আমি এরপর তার কথা মতো চলেছি। যা বলেছেন করেছি। বিনিময়ে তোমাকে চেয়েছি। আর কিচ্ছু না।
সিনথিয়ার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সেদিনের দৃশ্যপট। যেদিন রাফি কল দিয়েছিলো। এই বিষয়টা সিনথিয়া একমাত্র নিলয়ের সাথে শেয়ার করেছিলো। আর নিলয় বলেছিলো,” যেনো সিনথিয়া দেখা করে। এবং সেজেগুজে গিয়ে একটা সুক্ষ জ্বালা ধরায়। সেদিন নিলয়ই সমস্ত প্ল্যান শিখিয়ে দিয়েছিলো। খেলা শুরু তো অনেক আগেই। শুধু সে বুঝতে পারেনি। রাফি দম নেয়। তারপর বলে,
— তোমাকে জেলে পাঠানো। সব প্ল্যান তোমার ভাইয়ের ই করা। আমার মনে হয় পুলিশদের কোনো বড় অফিসার তোমার ভাইকে সহযোগিতা করেছে। তাছাড়া যতোটুকু জানি এসপি তোমার পক্ষে ছিলো। উপরের হাত ব্যাতিত এবাবে তোমাকে ধরা, এসপির চোখে ধূলো দেয়া এতো সহজ ছিলো না। তোমার ভাই চাইতো তুমি এসপির কাছাকাছি থাকো।
সিনথিয়ার ঘেমে ওঠা শরীর আরেকবার ঘেমে ওঠে। তার চোখের অন্তরালে এতো বড় জাল পাতা হলো। অথচ সে জানতেও পারলো না। বুঝতেও পারলো না। এতো বড় সত্যি কি করে ইরফাদের কাছে পৌঁছে দিবে সে। এখানে কতো বড় জাল পাতা হচ্ছে তা কি করে জানাবে সে। রাফির গলা ধরে আসে। সে সিনথিয়ার হাত নিজের হাতে মুষ্টিমেয় করে। সিনথিয়া হেঁচকা টানে ছাড়িয়ে নেয়। তার চোখ বলে,” ডোন্ট টাচ।”
রাফি পাঁচ আঙ্গুলে নিজের মাথার চুল খামছে ধরে। উপরের দাঁত দিয়ে চেপে ধরে অধর। তারপর ভাঙা গলায় বলে,
— পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ ই কোথাও না কোথাও ভুল করে। ভুল ছাড়া মানুষ নেই। আমি একটা সময় হয়তো অনেক খারাপ ছিলাম। অনেক মেয়েদের সাথেও মিশতাম। কিন্তু আমি কারো সাথে ইন্টিমেট হইনি।
— তাহলে বৃষ্টি নামের যে মেয়েটি! ওনাকে কিন্তু থানায় ডাকা হয়েছিলো।
— বললাম না প্রতিটা মানুষের জীবনেই ভুল আছে। একটা সময় ছিলো বাবার টাকা উড়াতাম। ঘুরতাম ফিরতাম। অনেক মেয়ের সাথেই আমার প্রেম ছিলো। ওরাও ঘুরতো, ফিরতো, মজা নিতো। জীবন মানে আমি এটাই জানতাম।ওরাও এটাই জানতো। টাকা যতোক্ষণ ছিলো অনেক মেয়েই ছিলো।একটা সময় বাসা থেকে টাকা দেয়া অফ করে। ঐসময়ে কেউ পাশে ছিলো না।এই সব প্রেম তখন আপনা- আপনি নাই হয়ে গেছে। তাদের মধ্যের একজন ছিলো বৃষ্টি। গল্পের এক পৃষ্ঠ পড়ে কি উপসংহার বোঝা যায়?তার সাথে আমার প্রেম ছিলো।
বাবার টাকা আসা শেষ তাকেও আর খুঁজে পাইনি। একটা সময় সে আমার-ই ফ্রেন্ডের সাথে বিয়ের পিড়িতে বসলো। ফ্রেন্ড দেশের বাইরে সেটেলড।এইনগেইজমেন্টের পর কোনো না কোনো ভাবে আমার ফ্রেন্ড এসব জেনে যায়। পরবর্তীতে ও নিজেই বিয়ে ভেঙ্গে দেয়। বৃষ্টি আবারও আমার দিকে ঝুকে। কারণ রাফির তখন আবার জব হয়েছে। আমি তখন একবার ডেটে ডাকি। সেও আসে। আমি তখন ডেসপারেট ছিলাম। প্রতিশোধের নেশা ছিলো। সে সময়ে ও বাসা থেকে পালিয়ে আসে। আমি তাকে হোটেলে রেখে পালিয়ে যাই। এই হলো ঘটনা। আজ অবধি কোনো মেয়েকে অবৈধ ভাবে কিচ্ছু করিনি আমি। শুধু জীবন চলার পথে কিছু ভুল ডিসিশন নিয়েছি এইতো। তাই সঠিক মানুষ জীবনে আসার পরও নিজের করে পাইনি। আমি সত্যিই নিরুপায় ছিলাম সিনথিয়া। জীবনে ভুল করতে করতে যখন সত্যিই ভালোবেসেছি। তখন তোমাকে হারিয়ে ফেললাম। কিন্তু পৃথিবীর যতো ভুল অন্যায় থাকুক। আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি। সকল ভুল শুধ্রে হলেও আমি তোমাকে চাই…
একই পৃথিবীতে মানুষের জীবনে কতো গল্প কতো দীর্ঘশ্বাস। সে তো প্রতারক ভেবে কতো কি-ই ভেবে বসে আছে। আবার মন থেকে মুছে না ফেলতে পারলেও পথটা বন্ধ করে ফেলেছে। জীবন এতো গোলক ধাধার মতো কেনো? এই একটা মানুষ তাকে পেতে সব ফেলে এখানে পড়ে আছে। এই মানুষটাকে ভুলতে সে নিজে অন্যকাউকে মায়া দেখাচ্ছে। জীবন শুধু এক দীর্ঘশ্বাস।
একটা রুম ভর্তী মাফিয়ারা দল বেঁধে আছে। তাদের মধ্যে ইজি চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে নিলয়। হাতের আঙুলে চেপে আছে সিগারেট। একটু পর পর ধোয়া ছাড়ছে শূন্যে। পেছন থেকে মাফিয়া গুলো বলছে।
— আপনার বোন সারারাস্তা সবাইকে মারতে মারতে আসছে। মাফিয়া পুরাই!
নিলয় গমগমে গলায় উত্তর দেয়,
— মার খাওয়ার জন্যে তো টাকাও পেয়েছিস। অভিযোগ কিসের?
— আপনার নিষেধ থাকার কারণে তো হাত তুলতে পারিনাই। না হইলে….
নিলয় ধমকে ওঠে,
— না হইলে কি…আমার বোন ও…
— আরে বস! না হইলে কি আর মাইয়া মানুষের মাইর খাই??
— খাবি! যতো খাবি ততো টাকা পাবি। যা বাইরে খোঁজ খবর লাগা। যতো যাই হোক। আমার বোন তোদের হাজার বার মারবে। তোরা মার খাবি।কিন্তু ফুলের টোকাও দিতে পারবি না। যা সব….
সবাই বাইরে চলে যায়। নিলয় রাফি কে ডাকে। তারপর সিনথিয়াকে নিয়ে আসতে বলে। রাফি সিনথিয়াকে নিয়ে আসে। একটা চেয়ারে হাত পা বাঁধা অবস্থায় বসায়। নিলয় পেছন ঘুরে সিগারেট ফুকছে। সিনথিয়া সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। লম্বা চওড়া মানুষটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। হাতের ইশারা দেয় নিলয়। রাফি দরজা বন্ধ করে বাইরে চলে যায়। সামনের মানুষের গলাটা মেঘের গর্জনের মতো গমগমে।
— তেইশ বছর পর তুই আমার কাছে এলি।কতো স্বপ্ন ছিলো তোকে ঘিরে তুই জানিস ও না।
সিনথিয়ার কোমল মনটা ভাই নামক অস্তিত্বটার গলা শুনে দুলে ওঠে। তার ভাই। তার রক্তের মানুষ। আত্মা কেঁপে ওঠে সিনথিয়ার। নিলয়ের কঠিন গলাও যেনো কেঁপে ওঠে,
— ছোট পাখি! আমাদের একটা স্বপ্নের মতো সুখের পরিবার ছিলো। রাজার গল্প শুনেছিস কখনো। ঐ রাজার মতো জীবন ছিলো তোর বাবার। আমি ছিলাম একমাত্র রাজপুত্র। আমাদের আলিশান বাড়ি ছিলো। আমার জন্মের পর বাংলাদেশে থাকা হলেও পরবর্তীতে আমরা দেশের বাহিরে থাকতাম।বাবা দেশের বাহিরে বিজনেস করতেন। আমাদের ছোট চাচা দেশের বাহিরেই সেটেলড। মা ফরেনার। সেই সূত্রে এই ইউরোপ কান্ট্রিতেই আমার বড় হওয়া। বাবা বাংলাদেশ থেকে আসা যাওয়া করতেন। আমরাও আসা যাওয়া করতাম।একটা সময় বাবার দেশে বাবার কাজের চাপ বাড়ে। মা বাংলাদেশে চলে আসেন। আমি তখনও দেশের বাইরে।তখন একটা খুশির সংবাদে আমরা সবাই ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আমি যখন জানতে পারি আমাদের ছোট্ট পরিবারে ছোট পাখি আসবে আমি তো মহাখুশি। দেশে আসার জন্যে মন ছুটে থাকতো। কবে ছোট পাখি জন্ম নিবে আর আমি কোলে নিবো।
আমার খেলার সাথি হবে। কি যে খুশি, কি যে আনন্দ। দিন রাত কল্পনা করতাম একটা ছোট্ট বোন হলে কেমন লাগবে। ঐ ছোট্ট ছোট্ট হাতে আমাকে স্পর্শ করবে। দাঁত ছাড়া হাসলে কেমন লাগবে?? কতো মিষ্টি স্বপ্ন! কিন্তু সে স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো। হঠাৎ করেই বাবা জেলে। আমি তখন খুব একটা বড় নই। চাচা চাচি আমাকে কিছু জানতে দিতে চাইতো না। কিন্তু আচ করতে পারতাম। কিচ্ছু ঠিক নেই। মা”কে ফোনে পেতাম না। একদম বিচ্ছিন্ন পরিবার। একটা সময় জানলাম — বাবা জেলে। মা”য়ের কোনো খোজ নেই। এরপর জানলাম মা ভারসাম্য হারিয়েছে। আমার তখন কিচ্ছু করার ছিলো না। ভেতরে ভেতরে খাঁচা বন্দি পাখির মতো ছটফট করতাম। ঐ সময়ে চাচা চাচির তিন মেয়ে থাকার কারণে তোর দায়িত্ব কেউ নেয় নি।
তোকে দত্তক দেয়া হয়েছে। সে সময় কেস চলে। মা কোনো মানষিক হাসপাতালে। আর বাবা ছন্নছাড়া এদিক সেদিক ঘুরে বেয়ায়। এতো অর্থ-যস-খ্যাতি সব ধূলোয় মিশে যায়। বাবার পয়সায় চলা আমার চাচার যসও তখন ফুরিয়ে আসে। তিনিও সে সময় নিজের আসল রূপ দেখান। তিনি আমাকে নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাক করেন। ততোদিনে বাবা প্রায় নিজেকে সকল কেস থেকে মুক্ত করেছেন। সব গুছিয়ে নিচ্ছেন। আমি তখন রাতে ঘুমাতে পারতাম না। কল্পনা করতাম ঘুম ভেঙ্গে দেখবো সব ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখতাম সব আগের চেয়েও এলোমেলো। পুরুষ মানুষতো চোখের জল ফেলতে পারতাম না। তবে অন্তরটা ঠিকই কাঁদতো। বোনকে নিয়ে দশটা মাস যে স্বপ্ন আমি দেখতাম তাকে একবার কোলেও নিতে পারলাম না। আর একবার দেখতেও পারলাম না। আফসোস! নিয়ে জীবন টা পার হলো।
বাবা সব কিছু থেকে মুক্ত প্রায়।ঠিক তখনই বাবা হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেলেন। আমি মা-বাবাহীন এক অনাথ!চাচা-চাচীর সংসারে গাধার মতো খেটে বড় হতে থাকলাম। সব ভুলে থেকে শুধু টিকে রইলাম। এর মধ্যে একটা চিঠি এসেছিলো। একটা পুরানো কাগজ মেলে ধরে নিলয়। তারপর বলে,” বাবাকে তো পাসনি। এটা ধর এটাতে বাবার গন্ধ লেগে আছে।”
সিনথিয়া হাত বাড়িয়ে চিঠিটা ধরে। চারপাশ ছিড়ে ছিড়ে গেছে। মাঝখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
— আমার কলিজার টুকরা বাবা! জানিনা এই চিঠি পৌঁছাবে কি না। আমি কোথায় আছি জানিনা। শুধু জানি এখান থেকে আলো দেখা যায় না। বাতাস স্পর্শ করা যায় না। মুক্তি হয়তো অসম্ভব। তুমি জানো না তোমার ছোট্ট একটা বোন আছে। তোমার মায়ের কথা জানিনা, কোথায় আছে তাও জানিনা। আমি হয়তো এখান থেকে বের হতে পারবো না। অনেক কষ্টে এইটুকু তোমার কাছে পৌছে দেওয়ার চেষ্টা। তুমি তোমার বোন আর মা কে খুঁজে বের করো। ওদের দেখে রেখো। আমার জন্য চিন্তা করো না। জীবন মানে স্ট্রাগল। স্ট্রাগল করেই বেঁচে থাকতে হবে।
আমি এক অন্ধকার দমবন্ধকর জায়গায় বন্দি। ওদের মধ্যে কেউ একজন আমাকে খেতে দিতে আসে। আরেকজন পাহারা দেয়।
আর শোনো! এইখানে একটা অদ্ভুত পোশাক পড়া একটা লম্বা চওড়া জন্তুর পোশাক পড়া কেউ আসে। আমাকে খাবার দিতে, খোঁজ খবর নিতে। ছলা কলা করে একবার দেখতে পেয়েছি। একজন লোক তাকে একবার ডেকেছিলো। নামটা ইরফা…. ইরফাদ হবে।কর্নেল রিদওয়ানুর রহমানের সাথে আমার প্রথম সমস্যার শুরু। শুনেছি তার একটা ধূর্ত ছেলে আছে। তুই একটু খোঁজ নিস তো। কর্ণেলের ছেলের নাম কি?
নিচের লাইন টুকু পড়ে সিনথিয়া চোখ ছেপে আসে। মনের গহীনের ছোট্ট একটা জায়গায় পাহাড় ধসে পড়ে।মৃদু ব্যাথা করে। এসব কেনো হচ্ছে। সে তো নিজেও দেখে এসেছে ঐ অদ্ভুত পোশাকে ইরফাদকে। দুনিয়াটা তার জন্যেই কেনো এতো এতো এতো জটিল। ওপাশের মানুষটা থমথমে ভারি গলায় বলে,
— এই চিঠি নিয়ে কতো পুলিশ স্টেশনে ঘুরেছি। কেউ মাথা ঘামায়নি। কেউ বাবাকে খুঁজে দেয়নি।
এই চিঠি”টা যে লোকটা আমাকে দিয়েছিলেন। তাকেও খুঁজে পাইনি। বাবার দেয়া লোকেশনে তোকে বহুবার খুঁজেছি। পাইনি! তোর পালিত বাবা তখন অন্য জেলায় সিফট করেছিলেন। তাই কিছুদিন এর জন্য আমি সব বাদ রাখি।নিজের ক্যারিয়ারের দিকে ফোকাস দেই। আমি এভাবেই বড় হয়েছি। একা! ভিষন একা।
বাবা বেঁচে আছেন কি না আমি এখনো জানিনা। সব ধোঁয়াসা। আমি আমার জীবনের সর্বোচ্চ দিয়ে বাবাকে খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি। আমি যখন পরিপূর্ণ হই। তখন সিনহা পুলিশে জয়েন করেছে। এরপরে তো এসপি। ভাঙা গড়ার এই ছোট্ট জীবনে নিজেকে দাঁড় করাতে যতো সময় লেগেছে ততোদিনে ইরফাদ সিনহা একজন এসপি। তাকে তুলে এনে বন্দি করা এতো সহজ না। তাই এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। তোকে আঘাত করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই বোন। কিন্তু প্ল্যানটা তোকে জানিয়ে করলে তুই বিলিভ করতিস না। হেল্প ও করতিস না। এই জন্যে এতো কষ্ট হলো। তুই শুধু শুধু জীবনটা ক্রিটিক্যাল করছিস পাখি। শুধু শুধু জেদ করছিস। ইরফাদকে তুই চিনিস না। ও একজন এসপি। এতো অল্প বয়সে ও এসপি। ওর মাথায় কি আছে বুঝিস? কি পরিমাণ ধূর্ত চালাক তুই কল্পনাও করতে পারবি না।
ওর কেস সলভের জন্যে যা খুশি করতে পারে। যে কোনো মানুষকে কাজে লাগাতে পারে। তুই কি বুঝতে পারছিস! তুই একজন কে ভালোবেসে ঠকে জেলে ছিলি। এই কয়টা দিনে ও তোর মনে দূর্বলতা সৃষ্টি করেছে। তুই নিজেই ওর পক্ষ নিচ্ছিস। খেলা তো ও আগেই খেলে রেখেছে। ইরফাদ ধূর্ত, চালাক। ও কি খেলা খেলতে পারে তুই জানিস না। ও তো নিজের স্বার্থের জন্যে নিজের বোনের সংসার ভেঙ্গে দিয়েছে। নিজের ক্যারিয়ার ব্রাইট করার জন্যে বোন জামাইয়ের ছোট্ট ভুলকে কেন্দ্র করে ঐ ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দিয়েছে। একথা অল বাংলাদেশ জানে। সে চাইলেই পারতো তার বোন জামাইকে এলার্ট করে দিতে। যে নিজের বোনের কথাই চিন্তা করেনি সে তোর মতো মানুষকে ভালোবাসবে? কোনো দিন না। এসপি ঔটাই করেছে যাতে তোর ভেতরে দূর্বলতা সৃষ্টি হয়। তোকে কাজে লাগাতে পারে। হয়েছেও তাই। আমার বোন হয়ে তুই ওর হয়ে কাজ করছিলি। ভাব এসপি কি জিনিস? তোকে কাজে লাগানোর জন্যেই এতো ভালোমানুষি। তুই নিজে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা কর! এসপি দূর্বলতা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তোকে ধরা কি দিয়েছে?? সে কি তোকে ভালোবাসে?
রং পর্ব ৩৩
সিনথিয়া মাথা নিচু করে। ইরফাদ তাকে কখনো ভালোবাসেনি। আর ভালোবাসবেও না। এটা সে জানে। সিনথিয়া মাথা নেড়ে বলে,” নাহ।”
নিলয় তেরছা হাসে। তারপর চেয়ার ঘুড়িয়ে সিনথিয়ার মুখোমুখি হয়। তারপর বলে,
— এটাই ওর খেলা।
সিনথিয়ার মনটা মেঘের মতো অন্ধকার হয়ে আসে।বুকের মধ্যে শূন্য হয়ে আসে। চোখে চোখ রাখে নিলয়ের। নিলয় মুখের মাস্ক খুলে মৃদু হেসে বলে,
— আমার বোন হয়েও এতো বোকা!
চোখের সামনে পূর্ব সময়ে দেখা মানুষটাকে দেখে বুকের ভেতর ঝনঝন করে বেজে ওঠে।সিনথিয়া নিলয়ের চোখে চোখে রেখে বিস্ময়ে হা হয়ে থাকে কিছুক্ষণ। চেনা মানুষকে চোখের সামনে নিজের ভাইরূপে দেখে নিজেই থ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বলে,
–তুমি!! তুমিইইই….!!!