রং পর্ব ৩৯

রং পর্ব ৩৯
তন্নী তনু

গোধূলি বেলায় ছাদে দাঁড়িয়ে আছে তিথি। দুপুরের কড়া রোদে জামা কাপড় কেচে ছাদে দিয়েছিলো। এখন সেগুলো তুলতে আসা। নিজের জামা, কুটুসের জামা সবগুলো একহাতে তুলে নেয় তিথি। বাকি শুধু শিশিরের শার্ট-প‍্যান্ট, টি-শার্ট গুলো তোলা। আজকাল শিশিরের ছোঁয়া লাগা সব কিছুই অদ্ভুদ শান্তি এনে দেয়। তার জামা কাপড় কাচতেও অন‍্য রকম অনুভূতি কাজ করে। ভাজ করতেও ভালোলাগে।শিশিরের উপস্থিতি আজকাল সস্তি দেয়, শান্তি দেয়। টানানো দড়ি থেকে একহাতে কালো টি-শার্ট হাতে তুলে নেয় তিথি। আশে পাশে একপলক তাকায়। তারপর বুকের মধ‍্যে চেপে ধরে তিথি। চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেয় কিয়ৎক্ষণ। তখন ই পেছন থেকে কেউ যেনো ডেকে ওঠে,

— এই!! কি করছো?
কেঁপে ওঠে তিথি। টেনে নেওয়া শ্বাস যেনো বুকের গহীনে ঠেকে রয়।
— আস্ত মানুষটাই তো তোমার। তাকে ধরলেই তো পারো….
পেছন ঘুরে তাকায় তিথি। ছাদে ওঠার সিঁড়ির রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে শিশির। হাসছে রাতের আকাশের তারার মতো মিটি মিটি করে। তিথি শিশিরকে ফিরে দেখে। তারপর নিজের হৃদয়ের উপর হাত রেখে যেনো দম ফেলে। শিশির এগিয়ে আসে। তারপর বলে,
— ভয় পেলে?
তিথি পেছন ঘুরে কাজে মন দেয়। শার্ট গুলো তুলতে তুলতে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— যাও… মামি চলে আসবে….।
— আসুক….।
— ভয় পাওনা নাকি?
— বউ তুমি আমার। পবিত্র সম্পর্কে কিসের ভয়?
— মামি জানলে আমাকে বাসা থেকে বের করে দিবে।
— দিলে অনেক আগেই দিতো। কিছু মানুষ উপরে খুব কঠিন হয়। তবে ভেতর থেকে খুব কোমল হয়।
— যে যা ফেইস করেনি সেই যন্ত্রণাও ফিল করতে পারেনা।
— হয়তো…আবার হয়তো নয়।
— তুমি যাও তো….
— রাতে আসবো??
— কোথায়??
— সেদিনের মতো….
সেদিনের রাতের স্মৃতিচারণ করে তিথি। তারপর নিজের কাছে নিজেই যেনো ধরা পরে যায়। মুখ লুকাতে চায় তিথি। পেছন ফেরেনা। শিশির দুষ্টু হাসে। তারপর বলে,

— সুহাসিনী! তুমি কি লজ্জা পেলে।
তিথি পেছন ফেরে না। মুখ লুকিয়ে রাখে।পেছন থেকে শিশির বলে,
— আমি একটা ডিসিশন নিয়েছি।
মা” কে কাল সব জানিয়ে দিবো।
তিথি পেছন ফেরে। যেনো পরের দৃশ‍্যপট নিজের চোখে দেখছে। সে তড়িঘড়ি করে বারণ করে,
— নাহ! এমনটা কোরোনা প্লিজ। আমার ভয় করে। ছোট বেলা থেকে একটু শান্তি আমি পাই নি। সব সময় ভয়ে ভয়ে কেটেছে। কয়েকটা দিন অনেক ভালো আছি। তুমি ভালো থাকাটুকু কেড়ে নিও না। প্লিজ….
–আমি আছি তো সোনা।

কথাটুকু যেনো সস্তির আভাস হয়ে হৃদয় জুরে ছড়িয়ে যায়।তিথি শিশিরের চোখে চোখ রাখে। এতো ভালো তাকে কেউ বাসেনি। এই ছোট্ট জীবনে এতটুকু ভরসা দেয়ার মতো কেউ ছিলো না। যা কখনো পায়নি তা পেয়েও যদি হারাতে হয়। ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা সে কি সত‍্যি সহ‍্য করতে পারবে। পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা যে অসহনীয়। এর পর কি হবে তার সাথে? চোখ দুটো জলে ভর্তী হয়ে যায়। শিশির লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসে। তিথি পিছিয়ে যায়। আর বলে,
— প্লিজ যাও… মামি আসবে।
শিশির থামে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
— বোকা মেয়ে…..বিয়ে কি লুকিয়ে রাখার জিনিস? আমি কি সারাজীবন তিথির বর হয়ে থাকবো? আমাদের টুনটুনি হবে না? বাবা হতে হবে না আমাকে??
তিথি চোখ তুলে তাকায়। মনে মনে ভাবে,” আয়হায়! এসবও ভেবে ফেলছে শিশির!” শিশির আবার এগিয়ে আসে। তারপর বলে,
— বিয়েটা চুপিচুপি করেছিলাম।মা খুব জেদি। বললে মানতো না। আরও অশান্তি করতো। দিব‍্যি দিতো অথবা অসুস্থ হওয়ার নাটক শুরু দিতো। আর তখন তুই আমাকে কোনো ভাবেই বিয়ে করতিস না। তাই বিষয়টা কমপ্লিকেটেড করার চেয়ে ইজি করেছি। কিন্তু এভাবে কয়দিন। সত‍্য লুকিয়ে রেখে কি লাভ….

— মামি কখনোই মানবে না….. আমাকে মামি পছন্দ করে না। সহ‍্য করতে পারে না। আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলবো….
— আমি আছি তো ….. কথা দিচ্ছি কখনো হাত ছাড়বো না। রাতে আমার রুমে আসবি। তোকে একটা গিফ্ট দেয়ার আছে….
— না না! গিফট লাগবে না। মামি দেখে ফেলবে।
–দেখলে দেখবে…
— তুমি বুঝতে চাইছো না কেনো? মামি আমাকে সহ‍্য করতেই পারে না।
— তার ধারণা পাল্টে দিস…. পৃথিবীর সব মেয়ে এক নয়। সবাই ছেড়ে যায় না।
— মানে??
— মানে মেয়েদের তোমার মামি বিশ্বাস করে না। তাই মামির ধারণা পাল্টে দিও চাঁদ।
–ক্লিয়ারলি বলো….
–রাতে ঘরে আসিস… বলবো…

খেলা জমজমাট-আনন্দ মুখর পরিবেশ। নিজের দেশের প্রতি দূর্বলতা কার নেই। নিজের দেশ সব জায়গায় এগিয়ে যাবে কে না চায়। নিজের দেশের খেলা বিশ্বব‍্যাপি নাম ছড়াবে এটা সবাই চায়।নিজের দেশ নিজের দেশের প্লেয়ার জিতলে খেলা দেখে যে আত্মতৃপ্তি হয়। তা কি টাকায় কিনে পাওয়া যায়। কিছু অনুভূতি অপর কেন্দ্রীক হয়। যেনো দেশ জিতলেই জিতে যাই নিজেই। এই দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে পরিকল্পনা সাজিয়েছে একদল টাকালোভী লোক। যাদের স্বার্থের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে দেশের সম্মান। দেশের জয়। দেশের তরুণ সমাজ। দেশকে রসাতলে দিতে আর কি লাগে। যেখানে তরুণ সমাজ হলো শক্তি। তাই তাদের অধপতন, তাদের ধ্বংস করেই দেশের করুণ পরিণতি সহজেই করা যায়।

যেখানে দশ টাকা উপার্জন করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। “সেখানে ফ্রি তে টাকা পাওয়া যায়।” এই টোপকে গিলে রাতের আধারে স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে একদল তরুণ–কাল সকালেই হয়তো হাতের মুঠোয় আসবে স্বপ্নের বাইক। স্বপ্নের মোবাইল ফোন, স্বপ্নের ল‍্যাপটপ। যে ছেলেটি টাকার কাছে হেরে গিয়ে হারাতে বসেছে গার্লফ্রেন্ড। টাকার অভাবে যে প্রেমিক প্রিয়াকে ঘরে তুলতে পারছে না সেও দিবালোকে স্বপ্ন দেখে বেড়ায়। এই টাকা একবার তুলতে পারলেই “প্রিয়া তুমি আমার।” কেউ বা ভাবছে টাকা পেলেই করাবে মায়ের চিকিৎসা। কেউ বা ভাবছে টাকা পেলেই গার্লফ্রেন্ডকে দিবে ডায়মন্ডের নেকলেস।স্বপ্ন পূরণ যেনো একবার জিতলেই। গত কয়েকদিনে কেউ কেউ এই এ‍্যপস কে কাজে লাগিয়ে করেছেও তাই। সাথে করেছে বিনা পয়সায় এ‍্যপস প্রমোশন। বন্ধুর উপকার করতে গিয়ে বন্ধুকেও ডাকছে ধ্বংসের দিকে। রাতের আধারে মেসেজে মেসেজে বন্ধু বন্ধুকে প্রচার করছে। “এই শোন!

এমন এক এ‍্যপস পেয়েছি নিজে থেকে একটাকাও খরচ হয়নি। এপস খোলা মাত্র একাউন্টে যোগ হয়েছে টাকা। সেই টাকা “ক্রিকেট বেটিং” ধরে আমি পেয়েছি লক্ষ লক্ষ টাকা। “কথায় বলে প্রচারেই প্রসার।” বিনা কষ্টে রাতের আধারে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে গেছে ডিভাইস থেকে ডিভাইসে। তরুণ সমাজের মাথায় যে পোকা ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে “খেললেই টাকা”। সেই সূত্রে একটানা জিতছে কয়েকবার। সাহস বাড়ছে। বাড়ছে নেশা। বাড়ছে টাকার অংক। জিতছে শত টাকা। হারাচ্ছে হাজার টাকা। প্রথমে জেতার নেশায় আসক্ত মাথা বার বার টোকায় “লাগা বা/জি” প্রথমে তো উইন আবার জিততে হবে। দশ বার হাজার টাকা জিতিয়ে দিয়ে একবার লক্ষ টাকার গুটি কিভাবে টেনে নিতে হয় তা এ‍্যপসের পেছনের মাথা ঠিকই জানে। তিনদিন পর ফাইনাল খেলা।

সকলের অন্তরের অন্তরস্থল বলছে দেশ জিতবে। সেই সাথে জু/য়া/রিয়া বাড়াচ্ছে টাকার অংক। পরপর তিনটা খেলায় বাংলাদেশকে ভরসা করে পেয়েছে লাখ টাকা। আর ফাইনালে একবার ভরসা করলে হতে পারে কোটিপতি। এই নেশায় হাতে থাকা সকল টাকায় প্রাণপণে খেলবে তরুণ। আর এটাই তো চাল। যা পেয়েছে তার শতগুণে আদায় করে নিবে এ‍্যপসের আসল খিলারি। আর এমন নেশা ধরাবে তা চলবে ধ্বংস হওয়া অবধি। এই নেশায় মেতে তরুণসমাজ জায়গা-জমি,ভিটে-মাটি, মায়ের চিকিৎসার টাকা, বউ এর শেষ সম্বল স্বর্ণালঙ্কার সব দিয়ে তুলতে চাইবে হারানো টাকা। এই এমন এক শেকল। সব হারিয়ে নিঃস হয়ে করবে ক্রাইম থেকে ক্রাইম। এর ফাঁকে বড় বড় রাজনৈতিক মুখোশধারী বিদেশে জমাবে ড্রলার। নিজের রাজনৈতিক দল ক্ষমতা হারালেই নিশ্চিন্তে পারি দিবে ওপারে। দেশকে রসাতলে দিয়ে নিজেরা অমরত্ব পান করবে। ভেবে নিবে এই পাপের মৃত‍্যু নেই। দেশ জ্বলবে জ্বলবে দেশের সাধারণ মানুষ। উপরমহল শুধু মজা নিবে।

রাত বাড়ছে।ধীর পায়ে সাবধানে তিথি ড্রয়িং রুম পেড়িয়ে যায় তিথি। শিশিরের রুমে আধখোলা দরজা দিয়ে নিরবে ঢুকে তিথি। ঘরে জ্বলছে ড্রিম লাইট। তিথি রুমে প্রবেশ করে মূর্তির মতো দাঁড়ায়। শিশির ফোন স্ক্রল করছে। চোখের কোণে প্রিয়তমার প্রতিচ্ছবি ধরা দিলে পাশে তাকায় শিশির। আপনা আপনি প্রশস্ত হয় ওষ্ঠজোড়া। গলার স্বর নামিয়ে বলে — আকাশের চাঁদ কি আমার ঘরে নেমে এলো?
তিথি নিরব থাকে। সারা দুনিয়ায় চঞ্চল ভাবে ছুটে বেড়ালেও আজকাল শিশিরের সামনে কথাই বলতে পারে না। শিশির হাতের ইশারায় ডাকে। আর ফিসফিসিয়ে বলে,– আয়।
তিথি তবুও দাঁড়িয়ে থাকে। শিশির আবার ডাকে,

–আয় না!
ধীর পায়ে এগিয়ে যায় তিথি। বিছানার পাশে গিয়ে বসে। শিশির তিথির দিকে ঝুকে আসে। কানের কাছাকাছি এসে বলে,
— মিস করছিলে বুঝি।
তিথি গম্ভীর গলায় বলে,
— আমি শুধু জানতে এসেছি।
–কি?
— বিকেলে যে বললে,” রাতে বলবো।”
— ওসব কিছু না। শোন তোকে একটা জিনিস দিবো।চোখ বন্ধ কর।
— আমার কিছু লাগবে না। তুমি কি বলবে বলো।
— আরে চোখ বন্ধ কর তো।
একহাত তিথির চোখে চেপে ধরে শিশির। তারপর বালিশের তলা থেকে একটা বক্স বের করে শিশির। তারপর তিথির হাতে দেয়। তিথি চোখ খোলে। চারকোণা লাল রঙের বক্স। তিথি একবার শিশিরের দিকে তাকায়। তারপর বলে,
— কি এটা?
— খুলে দেখ।
তিথি বক্স খোলে। মৃদু আলোতেও চিকচিক করছে সোনালী রঙের কিছু একটা। আঙ্গুলের ডগায় তুলে ধরে তিথি। একটা চেইন। মাঝখানে একটা স্বর্ণের বল। শিশিরের দিকে বিস্মিত চোখে তাকায় তিথি। শিশিরের মুখে হাসি ঝিলিক দিচ্ছে। শিশির বলে,

— পছন্দ হয়নি? দে পড়িয়ে দেই….
–কোথায় পেলে এসব?
— কোথায় পেলাম মানে? টাকা জমিয়ে কিনেছি।
–ভারী মনে হচ্ছে। অনেক দামী মনে হচ্ছে।টাকা কোথায় পেলে….?
— আরে… বাবা টাকা দেয় না আমাকে?
— কিন্তু এটা অনেক ভারী…..
— থামতো। দে পড়িয়ে দেই।
বলেই হাত থেকে নেয় চেইন। তারপর হাত বাড়িয়ে গলায় পড়িয়ে দেয়। তিথি বারণ করে।
— মামি দেখবে। অনেক কথা শোনাবে।মারবে… প্লিজ….
— যদি বলে কিছু। বলবি শিশির দিয়েছে। বাকিটা আমি সামলাবো…..
–তুমি খুব বাড়াবাড়ি করছো….
–তুই কি চাস সারাজীবন এভাবে থাকি। আর আমার বউকে অন‍্যের সাথে বিয়ে দিয়ে দিক?
তিথি চুপ করে থাকে। আনমনা হয়ে ভাবে। আচ্ছা! তাদের এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি? এরপর কি হবে? শিশির তিথির মুখের দিকে তাকায়। তারপর বলে,
— এতো চিন্তার কিছু নেই। আমি আছিতো।

–তুমি কি জানো? মামি কেনো আমাকে পছন্দ করে না? তোমার নানু বাসার কেউ আমাকে কেউ পছন্দ করে না। আমার জন‍্য কেউ এ বাসায় আসে না। কেনো?? এই প্রশ্নগুলো খুব ভাবায়। এই উত্তর খুঁজে পাই না…..
— আমিও তেমন কিছু জানি না। তবে একটু একটু জানি। আমার একটা ফুপ্পি ছিলো।আমার ফুপ্পিকে আমার মা বোনের মতো ভালোবাসতো। যেখানে যেতো নিয়ে যেতো। যা চাইতো দিত। বাবা ফুপ্পিকে কোথাও যেতে দিতে না চাইলে মা ব‍্যবস্থা করে দিতো। একটা সময়ে নাকি ফুপ্পি অসুস্থ হয়ে যায়। ডক্টর টেস্ট করে জানান ফুপ্পি প্রেগন‍্যান্ট। বাবা মাকে দোষারোপ করেন। কারণ মা বেশী ফ্রিডম দিয়েছেন বলে এই অবস্থা। পরবর্তীতে শুনতে শুনতে জানা যায় আমার মামা মানে আমার মায়ের ভাই এর সাথে ফুপ্পির রিলেশন ছিলো।

বাসার সবাই তখন মা”কেই দোষারোপ করেন। মামার অল্প বয়স আবার ফুপ্পিরও খুব অল্প বয়স। তাই নানু বাসায় থেকে মানতে চান না। পরবর্তীকালে মা খুব কষ্টে ম‍্যানেজ করেন।নানু শর্ত দেয় ইসলামিক ভাবে দুই পরিবার মিলে বিয়ে দেয়ার পর মামা তাদের বাসায় থাকবে। ফুপ্পি আমাদের বাসায়। দ‍্যান মামা স্ট‍্যাবল হয়ে ফুপ্পিকে নিয়ে যাবেন। যেমন কথা তেমন। বাচ্চাটা হয়। বছর তিনেক পর মামার জব হয়। তিনি জানান ফুপ্পিকে নিয়ে যাবেন।ডেইট ফিক্সড হয়। দুই পক্ষের রিলেটিভস দের জানানো হয়। ইনভিটেশন করাও হয়। যেহেতু জীবনের ভুলের কারণে বিয়েটা সেভাবে হয়নি। তিনি চান আনন্দ অনুষ্ঠান করে বউ বাচ্চা নিয়ে যেতে। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়। কিন্তু অঘটন ঘটে সেদিন রাতে। ঐদিন রাতে ফুপ্পিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। পুরো শহর আত্মীয়-স্বজনের বাসায় খোঁজখবর নিয়েও পাওয়া যায় না। একে একে সবাই জানে বিষয়টা। থানায় জানানো হয়। একপর্যায়ে জানা যায় ফুপ্পি তার কলেজের একটা ছেলের সাথে পালিয়েছে। মামার বউ পালিয়ে গেছে….ছি ছি রটে যায়। মামা মুখ দেখাতে না পেরে গাঁ ঢাকা দেয়। সেই যে বেড়িয়েছিলো। এরপর আর ফেরেনি।

— কিন্তু তোমার ফুপ্পি কেনো এমন করলো?
— জানিনা।
— বাচ্চাও তো হয়েছিলো তাহলে?
— পৃথিবীতে কিছু প্রশ্নের উত্তর হয় না। ছেড়ে যাওয়ার জন‍্য কারণ লাগে না তিথি।
— তারপর কি হলো?
–তারপর মামা আর ফেরেনি। একবছরের মাথায় বিদেশ চলে গেছে।
— তোমার ফুপ্পি….আচ্ছা ঐ বাচ্চাটা??
বলেই শিশিরের দিকে তাকায় তিথি। তারপর বলে,
— বাচ্চাটাই আমি??

এইটুকু বলেই থ হয়ে যায় তিথি। শিশিরের চোখের ভাষা পড়ে নিয়েই স্তব্ধ হয়ে যায়। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উথালপাতাল শুরু হয়। শক্ত তিথি নিজেকে আর সামলাতে পারে না। চোখে জল উপছে ওঠে। অদূর থেকে ছোড়া ঢিল যেনো মাথায় এসে লাগে। বুকের মধ‍্যে শুরু হয় তান্ডব। ভারী হতে থাকে বুক। এসব সে জানতো না। তার মায়ের জন‍্য মামীর ভাইয়ের জীবন নষ্ট। নষ্ট মামীর বিশ্বাস।তার উপর সে নিজে বোঝা। তার উপর লুকিয়ে মামীর ছেলেকেই বিয়ে করে বসে আছে। ভাবতেই কলিজা শুকিয়ে আসে তিথির। ভবিষ্যৎ যেনো কালো মেঘের চেয়েও আধার হয়ে ঘনিয়ে আসছে তার দিকে। দুচোখের জল টুপটুপ করে পড়ে। শিশির হাত বাড়ায় চোখের জল মুছতে। তিথি হাত সরিয়ে দেয়। বাঁধ ভাঙা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে তিথি,

— এতো বড় সত‍্য তুমি কেনো আগে বললে না।
বলেই উঠে দাঁড়াতে চায় তিথি। শিশির হাত টেনে ধরে বিছানায় বসায়। তারপর বলে,
–আগে বললে কি আর এখন বললেই কি? কাঁদছিস কেনো এভাবে?
— সব জেনেও এমন অপরাধ করালে আমাকে??
— মা তোকে ভালোবাসে না তা নয়। ঐ সময়ের পর থেকে তোকে শাসন করে। এমনকি আমাদেরও। মা কঠিন হয়ে গেছে। তোর মা”কে অনেক ভালোবেসে অনেক স্বাধিনতা দিয়ে কি পেয়েছে? দুঃখ আর কষ্ট। তাই একটু চেঞ্জ হয়ে গেছে।মানুষ এমন-ই কষ্ট পেলে নিজেকে পরিবর্তন করে।

তিথি কাঁদে। এই প্রথমবার তিথি কান্নার আওয়াজ হয়। তার কান্নার ভাষা ছিলো নিরব শান্ত। কিন্তু আজ সত‍্যিই সে সহ‍্য করতে পারছে না। পৃথিবীতে এমনও মা হয়? যে নিজের সন্তানকে ফেলে রেখে যেতে পারে।
সেই সাথে আরেকটা চিন্তা তিথির শরীরের শক্তি শুষে নিচ্ছে। মামি তাকে যে বিশ্বাসে খাওয়ালো, পড়ালো, বড় করলো। এখন যদি জানে এতো বড় সত‍্যি! সে বাঁচবে তো। একদিকে ভালোবাসা অন‍্য দিকে বিশ্বাস লঙ্ঘন। কি আছে কপালে তার? তিথি বুক কাঁপে। শরীর অসাড় হয়ে আসে। শিশির চিন্তায় পড়ে যায়। এইটুকু শুনে তিথি এমন ভেঙ্গে পড়বে সে জানতো না। শিশির এগিয়ে বসে। তিথির হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। তিথি ছাড়িয়ে দেয়। কিছুই সহ‍্য হচ্ছে না তার। কান্না করতে করতে বলে,

— কেনো করলে এমন সব জেনেও। সারাজীবনের জন‍্য মামীর কাছে অপরাধী করে দিলে আমাকে… কেনো?? মামির মন ভেঙ্গে যাবে। উফফ… আমি সহ‍্য করতে পারছি না।
শিশির জোর করে হাতের মুঠোয় তিথির হাত নেয়।তারপর আশ্বাস দিয়ে বলে,
— আরে পাগলি! সবাই এক নাকি। তুই দেখিয়ে দিবি পৃথিবীর সব মেয়ে বিশ্বাসঘাতক নয়।
— না তা হয় না। কেনো করলে তুমি। আমি এতো বড় অপরাধ করলাম।
–কোনো অপরাধ করিসনি। আমি ভালোবেসেছি। আমি চেয়েছি তোকে। সবার সামনে বলার সাহস আমার আছে।
— না তা হয় না…. তোমরা বলে ছিলে আমার মা মরে গেছে। কিন্তু এখন তো দেখছি আমি অ/বৈধ বাচ্চা।
বলেই কান্না শুরু করে তিথি। চোখের জলে ভিজছে গলা, ভিজছে বুক। আর ভেতরটা জ্বলছে তপ্ত আগুনে। শিশির খুব স্বাভাবিক ভাবে কথাটা বলেছিলো। কিন্তু তিথির রিয়েকশন এমন হবে কল্পনাও করেনি। শিশির তিথির হাত টেনে আবারো নিজের বুকের উপর রাখে। তারপর বলে,

–এভাবে কাঁদিস না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আর তুই কি বলছিস উল্টাপাল্টা তুই অ\বৈ\ধ কেনো হবি।
তিথি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ঘটনার পূনরাবৃত্তি ঘটছে তাও তাকে দিয়েই। কিছুতেই মানতে পারছে না সে। তিথি নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। তারপর উঠে দাঁড়ায়। শিশির আবার পেছন থেকে টেনে ধরে। তিথি ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে। তারপর বলে,
— একটা অপবিত্র, অ/বৈ/ধ মানুষকে কে কেনো বিয়ে করলে??
বলেই আবার কান্না শুরু করে তিথি। চোখের লাল শিরা ফুলে ফুলে ওঠে। এমনটা হবে জানলে শিশির কিছুতেই এসব বলতো না। হাত দিয়ে চোখ মুছে দেয় শিশির। তিথি ঢুকরে কেঁদে ওঠে আবার। ভেজা গলায় অস্পষ্ট স্বরে আবার বলে,

— আমি অপ!বিত্র, অ!বৈধ….
বলেই কেঁদে ফেলে। শিশির তিথিকে দুহাতের বাঁধনে শক্ত আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেয় নিজের বুকের সাথে। পৃথিবীর সমস্ত বাতাস টেনে নেয় শিশির। সর্বশক্তি দিয়ে মিশিয়ে নেয় তিথিকে নিজের সাথে। কিছুক্ষণ দম বন্ধ করে থাকে দুজন। তারপর হালকা করে হাতে বাঁধন।তারপর ফোস করে শ্বাস শিশির। তিথির পিঠে হাত বুলায়। তারপর ঘন চুলের উপর চুমু খেয়ে বলে,
— বাচ্চা কখনো অ\বৈ\ধ হয় পাগলি? বাচ্চা তো নিষ্পাপ হয়। আর মামা আর ফুপ্পি বিয়ে করেছিলো প্রথমেই।যদিও প্রুফ ছিলো না। তাই হয়তো প্রুফ করতে পারেনি। পরেও সবাইকে জানিয়ে বিয়ে দিয়েছিলো।
তিথি দম নেয়। আদুরে বুকে মুখ লুকিয়ে বলে,
–তুমি কেনো জড়ালে আমাকে নিজের সাথে? সেই একই ঘটনা কেনো ঘটালে।মামি কখনো মেনে নিবেনা।
— তোর মামি-ই স্কুল কলেজে সব জায়গায় বলে আসতো তোর মা মৃত। বাবা বিদেশে। তোর দিকে আঙুল তুলবে বলে আমাদের নিয়ে অন‍্য শহরে চলে এসেছে। তোকে ভালোবাসেনি ঠিক আছে…. কিন্তু কাউকে আঙুলও তুলতে দেয়নি।

— ঐটাই তো কষ্ট আমার। ঐ মহিলার মতো আমিও বিশ্বাসঘাতকতা করলাম মামির সাথে….।
— একটুও না। আমাকে আগলে রেখে তুই প্রুফ করবি সবাই এক না। আমি কালকেই বাবাকে বলবো তোর কথা। ভয় পাস না। কথা দিচ্ছি মেনে নেওয়া না অবধি “তোকে প্রকাশ‍্যে আমার করে নেয়ার” যুদ্ধ চালিয়ে যাবো।
— মামি মানবে না। সব হারিয়ে আমি নিঃস্ব। তোমাকে ভালোবেসে আমিও তোমিকেও হারিয়ে ফেলবো। আমি শেষ হয়ে যাবো… আমার খুব ভয় করছে….
— এই তো আমি সোনা….তোমাকে আমি সারাজীবন এভাবেই আগলে রাখবো।

নতুন জায়গায় নিজেকে আবিস্কার করে জাবির, ইরফাদ।মাঝখানের সময় গুলো ঘুমের মধ‍্যেই চলে গেছে। তবে যেই রুম ছিলো এখন সে রুমে নেই। এতো নিখুঁত পরিকল্পনায় তাদের নিয়ে আসা হয়েছে। কোথায় আছে তারা। আর সিনথিয়া? সব ঠিক আছে তো? জাহাজে হাত পা খোলা অবস্থায় থাকলেও হাত পা বাঁধা অবস্থায় আছে এখন। তার মানে এটা অন‍্য জায়গা। যেখান থেকে পালানো যেতেই পারে। আর এই ভয়েই তাদের বেঁধে রাখা হয়েছে। তবে মুখ বাঁধা নেই। জাবিরের দিকে তাকায় ইরফাদ। রুমের দু”দিকে দুটো চেয়ারে বাঁধা দুজন।জাবিরের চোখ বন্ধ। ইরফাদ গলা উঁচিয়ে ডাকে,

–জাবির…. জাবির….
জাবির চোখ খোলে। মিটিমিটি চোখ নাড়ায়। ইরফাদ বলে,
—আর ইউ ওকে?
জাবির চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে। চোখ এদিক সেদিক ঘুড়িয়ে বলে,
–অন‍্য জায়গা!!
ইরফাদ মাথা নাড়ায়। তারপর ফলে,
— কাল রাতে ক্লোরোফর্ম দেয়া ছিলো রুম স্প্রে-র সাথে। আমাদের অন‍্য প্লেসে ট্রান্সফার করা হয়েছে।
জাবির বলে,
— বাকিরা কোথায়? সিনথিয়া ইবনা ঠিক আছে তো?
–জানিনা….

জাবির সাথে সাথে গলা ছেড়ে ডাকে।এই মূহুর্তে কাউকে দরকার অন্তত সিনথিয়ার খোঁজ নেওয়ার জন‍্য । ইরফাদের চোখ মুখ বলছে সে চিন্তিত। একসাথে কাজ করছে তারা অনেক কাল। তাই জাবির ভালো করেই জানে ইরফাদের প্রকাশ করতে পারে না। অনেক কিছুই শেয়ার করতে পারে না। অনেকটা সময় ধরে ডাকে জাবির। অনেকটা সময় পর দরজা খোলার আওয়াজ আসে। দরজা খোলে রাফি। দরজায় দাঁড়িয়ে উঁচু স্বরে বলে,
— কি দরকার?
— রাফসানরে ডাক!
— ভাই ঘুমায়…
— এসপির অর্ডার।যা বলছি কর…
— এক কথা বার বার বলবো নাকি।
জাবির দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

— হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে কথাটা রিপিট কর। দেখ একটা দাঁত থাকে নাকি। আর না হলে যা বলছি কর….
একটু পর রাফসান ও আসে। দরজার বাইরে চোখ বুলায় ইরফাদ। জাহাজে নেই তারা। এটা অন‍্য জায়গা।জাবির জিজ্ঞেস করে,– সিনথিয়া ইবনা কোথায়?
রাফসান বলে,
— আছে জায়গা মতোই। সেইফ…
–মুখের কথায় বিশ্বাস করিনা। নিয়ে আসুন…..
— বললেই হলো! ঠিক আছে বলেছি….ব‍্যাস।
— বনের বাঘকে হিংস্র করে তুলছেন! এই মেয়ের জন‍্য এসপিকে তুলে এনেছেন। সে সেইফ আছে কি না জানা দরকার।

— বললাম তো সেইফ আছে।
জাবির চেয়ারে বসে ছোটাছুটি করে। তারপর বলে,
— একবার যদি ছুটতে পারি তাইলে মরণ আছে বলে দিলাম । সবহগুলোকে এনকাউন্টার করবো।
ইরফাদ নিরব। ভেতরে কি চলছে কেউ জানে না। সেই প্রথম রাত থেকে এখন অবধি নিরব। গুমট ধরা মেঘের মতো কখন যে গর্জন দিয়ে উঠবে সেই জানে। জাবির বলে,
— ভালো চাস। সিনথিয়া ইবনা কে নিয়ে আয়। ব‍্যাস…. না হলে টিকতে পারবি না। বাঘ যদি খাঁচার বাইরে যায় ছিন্নভিন্ন করে দিবে। মনে রাখিস….
দুজন যেনো কথা শুনেও শুনতে পায় না।

রং পর্ব ৩৮

সময় পেরিয়ে যায়। কেউ আসে না। জাবির বলে,
–স‍্যার কিছু একটা করতেই হবে।
— আমি তো ঐইদিনের অপেক্ষা করছিলাম…
— মানে??
–মানে প্রতিপক্ষকে নিঃশেষ করতে তার দোড়গোড়ায় পৌছে গোড়া সহ উপড়ে ফেলতে হয়।
— স‍্যার একটা প্ল‍্যান আসছে মাথায়…

রং পর্ব ৪০