রং পর্ব ৪৫ (২)

রং পর্ব ৪৫ (২)
তন্নী তনু

হৃদয়ের গহীনে নিভু নিভু জ্বলা ভয় ভয় অনুভূতিরা তীব্র হীমশীতল প্রবাহে শীরদাড়া দিয়ে বয়ে চলেছে অবিরামভাবে। সিনথিয়া বন্ধদরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ।পেছন থেকে দরজা টেনে নব মোরড়ানোর সময় সৃষ্ট মৃদু আওয়াজটা সিনথিয়ার বুকের খাঁচায় দিরিমদিরিম করে বাজছে অযথাই।তবুও তার চোখের কোটর থেকে চোখজোড়া তার বাঁধা না মেনেই রুমের এইপ্রান্ত থেকে ঐপ্রান্ত পর্যন্ত পরিচিত অবয়বকে ঘুড়ে ঘুড়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। বেশ ছিমছাম ঝকঝকে তকতকে কক্ষের পরিবেশ,কেউ যেনো অভিজ্ঞ হাতে সুক্ষ, সুনিপুণভাবে স্বপ্ন বুনন করেছে। আধুনিক ইন্টেরিয়র সিলিংটা নিয়নের প্রজ্জলয়মান সোনালী আভায় সুসজ্জিত, নিয়ন বাতির স্বর্ণালী আলো চুইয়ে চুইয়ে সোনারূপে পড়ছে যেনো সিনথিয়ার সর্বাঙ্গে। সোনারঙ চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে অফহোয়াইট রঙের দেয়ালগুলোতে।

কিন্তু কোথাও পরিচিত অবয়বটি নেই।সামনের দেয়ালে অর্ধখোলা থাইগ্লাস দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে আসা শীতল বাতাসে ঢেউ খেলে উড়ছে ফিনফিনে পর্দাগুলো। এক…দুই..তিন…চার. রুমের চারদেয়ালের কোথাও…..সেই মুখটি নেই। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, নতুন সম্পর্ক ধরে নিঃশ্চল,নিরব, নিস্তব্ধে দাঁড়িয়ে আছে সিনথিয়া। এই মূহুর্তে তার কি বলা উচিৎ, কি করা উচিত সম্পূর্ণই জ্ঞানশূন‍্য লাগছে তার। সবচেয়ে ভালো হতো তাকে তার বাসায় পাঠালে। কিন্তু পাঠানো হলো না। বাবা-মা তার চিন্তায় হয়তো অর্ধমৃত। অপেক্ষা, প্রতীক্ষার প্রহর গুনে চলেছে তারা। আইনের নিয়ম কি এতই কঠিন। কোমল হৃদয়ের করুণ পরিণতি কি তারা মানে না? একবার কি খবর দেয়া যেতো না তার পরিবারকে?ভাবনার জালে পেঁচানো অনেক প্রশ্ন, আর আত্মার হাহাকার। ক‍্যাচ ক‍্যাচ মৃদু শব্দে খুলে যায় সামনের থাই গ্লাস। উড়ন্ত পর্দা হাতে চাপিয়ে দিয়ে বেলকনি থেকে আধুনিক কার্পেটে পা রাখে কেউ। ভাবনার জাল ঝড়ের তান্ডবে ছিড়ে যায়। আপাদমস্তক বিশালদেহী বলিষ্ঠ গড়নের মানুষটির পরনে থ্রি কোয়ার্টার প‍্যান্ট। কটন প্লেইন স্লিভলেস ঢিলেঢালা টি-শার্টে ফুলে ওঠা হাতের পেশী স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চুল গুলো অযত্নে বেড়ে কপাল ভ্রু-ছুঁয়েছে।বিশালদেহী মানুষটার প্রত‍্যেক পায়ের গতিতে চারপাশ যেনো তোলপাড় যেনো সে মহাপ্রলয়, বিধ্বংসী!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সিনথিয়ার হঠাৎ করেই ভয় বাড়ছে…..
চারপাশের নিস্তব্ধ, নিরব পরিবেশ। সামনে থাই গ্লাস টেনে দিচ্ছে ইরফাদ।এই মানুষটার সাথে অনেকবার রাস্তা- ঘাটে ঘন্টার পর ঘন্টা থাকলেও আজ নিরালায়, নিরবে, একা এভাবে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেও পায়ের তলা থেকে কেঁপে উঠছে সিনথিয়া? কিন্তু কেনো? বুকের মধ‍্যে ধিরিম ধিরিম বাজা শব্দের তোড়ে দূর্বল লাগছে ভিষণ। দরজা পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায় সে।একপলক সামনে তাকায় ইরফাদ। সিনথিয়ার পরনে লাল টুকটুকে শাড়ি জড়ানো। ইভা খুশিতে অল্প সময়ে যতোটুকু পেরেছে তাই দিয়েছে। নিজের পছন্দের শাড়ি, নিজের পছন্দের বাচ্চাদের ডিজাইনে তৈরীকৃত বালা দুটো সিনথিয়াকে পড়িয়েছে। গলায় ঝুলছে পাতলা চেইনকে আকড়ে ধরা ইরফাদের হাতের রিং। সিনথিয়ার হাতের উপর দালানের মতো গহনার বক্স। এগুলো যে তার বাবার কাজ সে ভালো করেই জানে। ইরফাদ দৃষ্টি সরিয়ে বলে,

— দাঁড়িয়ে কেনো? কখন এসেছো?আমাকে ডাকোনি কেনো?
সিনথিয়া চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে ইরফাদের দিকে।ইরফাদের হাঁটা চলায় পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। আর মনে মনে ভাবছে কি বলে ডাকবে সে? উহুম উহুম শব্দ করে! নাকি খ‍্যাক খ‍্যাক করে কাশি দিয়ে। নাকি স‍্যার বলে ডাকা উচিৎ ছিলো! “স‍্যার আপনি কই? এভাবে!”
–কি ভাবছো!
আসো….
ইরফাদ দাঁড়িয়ে থেমে থেমে জিজ্ঞাসা করছে। সিনথিয়া বুঝতে পারছে না কি করা উচিত? কোন দিকে যাবে! ইরফাদের দিকে? নাকি সোজা বিছানার দিকে!

প্রেমের বিয়ে হলে বিষয়টা ভিন্ন ছিলো–সোজা বিছানায় টুপ করে বসে পড়তো, পারিবারিক বিয়ের বিষয়টাও ভিন্ন–পরিবারের মানুষ বউ সাজিয়ে বিছানায় বসিয়ে রাখতো। কিন্তু এক্সিডেন্টলি বিয়েগুলোতে রুমে ঢুকে কোন দিকে যেতে হয়। এখন সে কোথায় যাবে। জীবনে কখনো কোনোদিন এতো সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেনি সে। কোনদিকে যাবে সে? ইরফাদের দিকে! নাকি বিছানার দিকে!
সে যে এতো উপস্থিত বুদ্ধিহীন মেয়ে এই সিচুয়েশন এ না পড়লে বুঝতে পারতো না। কোনদিকে না গিয়ে হ‍্যাবলার মতো দরজাতেই দাঁড়িয়ে থাকে সিনথিয়া। ইরফাদ বিছানার দিকে এগিয়ে একবার পিছু ফেরে। সিনথিয়াকে একটু আগে যেখানো দাঁড়ানো দেখেছিলো সেখানেই দাঁড়িয়ে মেয়েটি।একচুলও নড়েনি। সিনথিয়া মনে মনে ভাবছে কাঠের ভারী পাল্লা যদি ঠুনকো হতো। আর তার পিঠের বলের কাছে পরাজিত হত। এই মূহুর্তে দরজা ভেঙ্গে ওপাশে ছিটকে পড়তো সে।

— আর ইউ ওকে সিনথি!
সহসাই চোখ তুলে তাকায় সিনথিয়া। কাঁধের দিকে মাথা ঝাকিয়ে অস্পষ্ট করে বলে- হুম।
— এদিকে আসো…
সিনথিয়া পিপিলিকার গতিতে পা ফেলে। আধুনিক ডিজাইনের ওয়াল কেবিনেট এর উপর কুচি কুচি করে পর্দাগুলো সরিয়ে দেয় ইরফাদ। সিনথিয়া বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সিনথিয়া মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। কেবিনেটের পর্দা সরায় ইরফাদ। উপর নিচ জুড়ে আয়না। সেখানে নিজেকে দেখতে পায় সিনথিয়া। তার পাশের বলিষ্ট পুরুষের অবয়ব নিজের সাথে মিলিয়ে শক্ত ঢোক গেলে। এই মানুষটার সাথে পার্টনার হিসেবে তাকে আদও মানাবে! ইরফাদ পাল্লা টেনে দেয়। হারিয়ে যায় আয়নার প্রতিচ্ছবি। কেবিনেট থেকে একটা ব‍্যাগ বের করে ইরফাদ। পেছনে তাকিয়ে দেখে সিনথিয়া দাঁড়িয়ে আছে বিছানার দিকে।ইরফাদ আবাও ডাকে,

— সিনথি এই খানে এসো। এদিকে….
সিনথিয়া এইবার ইরফাদের পাশাপাশি দাঁড়ায়। একবাদ ইরফাদের দিকে আর একবার কেবিনেটের দিকে তাকায় সিনথিয়া। ক‍্যাবিনেটের লকার চাবি দিয়ে খোলে ইরফাদ। তারপর ক‍্যাচ করে লকারের ছোট্ট পাল্লাটা খোলে। সেখানে আছে কয়েকটা পার্ট। ভারী পিস্তল, রিভলবার রাখা। তার উপরের তাক” দেখিয়ে ইরফাদ বলে,
— রাখো ওগুলো…বাবা ইভার জন‍্য যা যা দিয়েছে তোমার জন‍্যেও দিয়েছে। যত্ন করে রেখো।
সিনথিয়া মাথা নেড়ে হাতের বক্সগুলো রাখে। ইরফাদ একটা শক্ত ভারী বক্স বের করে। তারপর সিনথিয়ার হাতে দেয়। এরপর বলে,
— খোল!
ইরফাদের কথামতো সিনথিয়া বক্স খোলে। পেঁচিয়ে গোল করা একটা কাগজ। সিনথিয়া একবার ইরফাদের দিকে তাকায়। ইরফাদ চোখের ইশারায় বলে.– ওপেন ইট!
সিনথিয়া ছোট্ট সুতোর গিট ধরে টানে। চোখের সামনে মেলে ধরে কাগজটা। ইরফাদের দিকে তাকিয়ে বলে,

— কি এটা!
— একজন নারী– বাবার রাজকন‍্যা, স্বামীর হৃদয়েশ্বরী, আর সন্তানের জান্নাত। তবে এই নারী কখনো কখনো অনুভব করে তার পৃথিবীতে কিচ্ছু নেই। থাকার জন‍্য একটু নিজস্ব জায়গা নেই,মাথার উপরে একটুকরো ছাদ নেই। রাগ- অভিমান করে একরাত কোথাও মাথা গোজার অবস্থা নেই। দীর্ঘশ্বাস টা চেপে রেখে অনেক নারী সংসার করে শুধু মাথা গোজার ঠাঁই নেই বলে। তারা তো আঠারো অবধিই বাঁচে,তবে তাদের দেহের খাঁচাটা কবর দেয় ষাটের পরে। আমি চাই আমার ওয়াইফ জীবনের অন্তিম সময় অবধি বাঁচার মতো বাঁচুক।
আমার জীবনের উপার্জনে গড়া একটুকরো ছাদের ব‍্যবস্থা তোমার জন‍্য। রাগ, অভিমান হলে তোমার যেনো কখনো মনে না হয় তোমার যাওয়ার জায়গা নেই। তোমার নিজের একটা বাড়ি আছে।

এটা বাড়ির পেপার্স। তোমার নামে ট্রান্সফার করতে একটু টাইম লাগবে।তবে আমার ড্রিম ছিলো — বিয়ের দিন রাতে আমি আমার ওয়াইফকে গিফট করবো। এক্সেস তোমার নেই তবে খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।
কথার পৃষ্ঠে হঠাৎ করেই নোনতা গরম জল চোখের পল্লব ছুঁয়ে টুপ করে পড়ে সিনথিয়ার। এভাবেও কেউ ভাবতে পারে। লকারের চাবি, কার্ড সমস্ত কিছু সিনথিয়ার হাতে ধরিয়ে দেয় ইরফাদ। তারপর বলে,
–মানি ইজ নিডেড টু সারভাইব ইন লাইফ। বাট দেয়ার ইজ নো নিড ফর বিওন্ড নেসেসিটি।খুব ক্ষুদ্র এমাউন্ট আছে….লাগলে ইউজ করো। চাবি গুলো কাছে রাখবে। যা যা নেই কালকের মধ‍্যে চলে আসবে ওকে?সব সময় পাশে স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে পারবো না। তবে আই”ল ট্রাই– এই নষ্ট সমাজের সকল অশুভ ছোঁয়া থেকে তোমাকে দূরে রাখতে।

— আপনি কি কাল থাকবেন না??
— কাজের প্রয়োজনে যে কোনো সময় বাইরে যাবো। তার আগে তোমাকে সব বুঝিয়ে দিতে হবে না?
–হুম!
— আমার এবসেন্সে-যেকোনো প্রয়োজন ইভাকে বলবে। ইমারজেন্সি থাকলেও একা বাড়ির বাইরে পা দিবে না।বাইরে যেতে ইচ্ছে করলে আমাকে কল দিবে,আমি নিয়ে যাবো।
— আমি বাড়ি যাবো না?
— না সিনথি! অফিসিয়াল রুলস অনুযায়ী তুমি পুলিশের আন্ডারে থাকবে। মেইন কালপ্রিট এর মুখোশ খোলা না অবধি তোমার লাইফ রিস্ক। তোমার রিস্ক মানে আমি রিস্কে। এই মূহুর্তে আমার দূর্বল জায়গায় ফাস্ট সিকিউরিটি দেয়া উচিত। সো কোথাও যাবে না তুমি…
এমন সিদ্ধান্তে সিনথিয়া হতভম্ব হয়ে যায়। তার মানে তার বাড়ি ফেরা হবে না। বাবা,মা, মুগ্ধ…… কাউকে দেখা হবে না।সে কি বন্দি হয়ে গেছে! মুখটা থমথমে হয়ে আসে। ইরফাদ শীতল গলায় বলে,
— বাবা মা কে মনে পড়ছে!

সিনথিয়া ছোট্ট মাথায় বিষয়টা নিতেই পারছে না। সে তো বাড়ি ফিরতে চায়। সে তো ভেবেছিলো আজ রাত টাই শুধু থাকতে হবে। ইরফাদ সিনথিয়ার চোখে তাকিয়েই বুঝতে পারে। কেবিনেটের পাল্লা চাপিয়ে দূরত্ব কমিয়ে কাছে দাঁড়ায় ইরফাদ,
— আরে পাগলি মেয়ে! বাবা–মা কে কাল কেই ডেকে নিবো,মুগ্ধও আসবে। শুধু তুমি যেতে পারবে না কিছুদিন। মন খারাপের কিচ্ছু নেই…. কিচ্ছু না…..
সিনথিয়ার মুখের উপর থেকে কালো মেঘের অস্তিত্ব ধীরে ধীরে সরে যায়। ইরফাদ ব‍্যাগ বাড়িয়ে দেয়।
–চেঞ্জ করে আসো যাও…..
সিনথিয়ার ছোট্ট মাথাটা বুঝে নিতেও সময় নেয়। সে তো মাত্র চেঞ্জ করে এলো। তাকে কি শাড়িতে ভাললাগছে না? ইরফাদ রুমের লাইট অফ করে ড্রিম লাইট দেয়। তারপর ওয়াশরুম দেখিয়ে বলে–যাও….

একটা ঢিলেঢালা টি-শার্ট, হাফ স্লিভ দুটোতে শূন‍্যের মতো গোল করে ফাঁকা অংশ সাথে গিট দেয়া দুটো ফিতা।কটনের স্কার্টটা মাটি ছুঁয়ে যাচ্ছে। কোমরের কাছে ভাজ করে নিয়ে বের হয় সিনথিয়া। ইন্টেরিয়র সিলিং এর সাথে ভাসমান দোলনা ঝুলিয়ে দেয় ইরফাদ। পেছন ফিরে একবার তাকায় ইরফাদ। এরপর কাজে লেগে যায়। প্রায় চারশো কেজি লোড নিতে পারে এমন বিশাল গোল আকৃতি দোলনা। তিনজন মানুষ অনায়াসে একসাথে শুয়ে থাকতে পারবে। কিন্তু হঠাৎ দোলনার আয়োজন কেনো?? বিছানা থেকে বালিস নিয়ে দোলনায় রাখে ইরফাদ। এরপর সিনথিয়াকে ডাকে। সিনথিয়া ধীর পায়ে দোলনার সামনে দাঁড়ায়। ইরফাদ দোলনার সুতো ধরে সিনথিয়া বলে,
–ওঠো!
সিনথিয়া পুতুলের মতো উঠে বসে। আর চোখ গোল গোল করে ইরফাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি চাচ্ছে ইরফাদ?

— শুয়ে পরো। পিলো দিয়ে দিচ্ছি দুটো। গুড নাইট। হ‍্যাভ আ নাইস ড্রিম।
আবছা আলোয় ধেঁয়ে আসা প্রশ্নের ঝড়ে সিনথিয়ার কোমল মনে প্রলয় শুরু হয়েছে। “তাহলে কি ইরফাদ আলাদা থাকতে চাচ্ছে? তাহলে এতোকিছু শুধুই দায়িত্ব থেকে? তাকে রক্ষা করতেই বিয়ে করেছে? এর মানে মন থেকে তাকে মানতে পারছে না?” সে তো এমন টা চায় নি। ভালো না বেসে তাকে কেউ গ্রহণ করুক এটা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি সে। একটা মানুষের পুরো জীবনের বোঝা সে কখনো হতে চায়নি। অজান্তেই তার চোখের জল ধেয়ে আসে। এতো বড় ভুল করে ফেললো সে?
— শুয়ে পরো..

ইরফাদের কথায় সিনথিয়া অনুভূতিশূন‍্য হয়ে শুয়ে পড়ে। ইরফাদ নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ে।সিনথিয়ার পৃথিবীর সমস্ত কিছুকে অসহ‍্য, অসহনীয় লাগছে। পৃথিবীর কতো অন‍্যায় তার সাথে হয়েছে, কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু একটা মানুষ তাকে ভেতর থেকে অনুভব না করে শুধু মাত্র দায়বদ্ধতা থেকে তাকে জীবনে রেখে দিবে এই শোক জীবনেও সামাল দিতে পারবে না সে। দোলনা বেডের পাশাপাশি দুলছে। ইরফাদ একহাতে হালকা করে দোল দিচ্ছে। ঠান্ডা আবহে দোলনা দুলছে। আর হৃদয়ের উত্তাপে জ্বলছে সিনথিয়া। অশান্ত সিনথিয়ার বুকের হাড় ভেঙ্গে যাচ্ছে। ভালোবাসা দিতে চেয়েছিলো সে। কিন্তু অজান্তেই হয়ে গেছে বোঝা। বুকের গহীনের তান্ডবে ঢুকরে ওঠে সিনথিয়া। হৃদয়ের রক্তক্ষরণে চোখ ফেটে উপছে পড়ে উষ্ণ নোনতা জল। বাইরে হঠাৎ শুরু ভারী বর্ষণ। বৃষ্টির তালে চাপা কান্নার সুর হারিয়ে যাচ্ছে। ইরফাদ বালিস পেতে শুয়ে আছে। আর একহাতে সময় নিয়ে নিয়ে দুলিয়ে যাচ্ছে দোলনা। বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দের আবহে মাতোয়ারা শীতল পরিবেশ। থাই গ্লাস লেপ্টে পড়ছে বৃষ্টির ধারা, যেনো অঝোরে কাঁদছে কেউ। ইরফাদ ঘুমানোর চেষ্টা করছে। হৃদয়ে দহনে নিঃশব্দে তোলপাড় সিনথিয়া, এই হৃদয়বিদারক ব‍্যাথা সে কাকে দেখাবে। একজনের ফাঁদে পা দিয়ে ভুলের জগতে হৃদয় দিয়ে অন্তর ছিড়ে একাকার। ভুলের জগত থেকে পিছু ফিরে অবশিষ্ট ভালোবাসার বন্ধনে যাকে বাঁধতে চাইলো সে তাকে দায়বদ্ধতা থেকে বিয়ে করলো। অন‍্যের জীবন তো নষ্ট করতে চায়নি সে। অজান্তেই ফুঁপিয়ে ওঠে সিনথিয়া। হালকা ফিসফিস শব্দটুকু শুনে চোখ খোলে ইরফাদ। সহসাই স্বাভাবিক গলায় বলে,

— আর ইউ ওকে সিনথি!
এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় সিনথিয়া। আপ্রাণ চেষ্টা করে গলার স্বর পরিবর্তনের। স্বাভাবিক ভাবে বলার চেষ্টা করে,
— হুম!
এতটুকুতেই তীক্ষ্ম মস্তিষ্কধারী ইরফাদ উঠে বসে। এই মাথার খেলায় দুনিয়ার সকল অপরাধ ধরতে পারে তাহলে মিথ‍্যা বুঝতে পারবে না? সহসাই উঠে দাঁড়ায় ইরফাদ। দোল খাওয়া দোলনার প্রান্ত ধরে বসে ইরফাদ। ততোক্ষণে চোখ মুখ মুছে শ্বাসসহ বন্ধ করে আছে সিনথিয়া। যেনো শ্বাস ফেললে সে শব্দেও সবটা বুঝে নিবে ইরফাদ। ঝুলন্ত দোলনার উঠে সিনথিয়ার মুখের দিকে ঝুকে আসে ইরফাদ। তারপর বলে,
— হোয়াট হ‍্যাপেন্ড সিনথি!
সিনথিয়া নিস্তব্ধ,নিরব।
সহসাই ইরফাদ সংকোচহীন ভাবে হঠাৎ করেই কান পেতে দেয় সিনথিয়ার বুকে,ঘন চুলভর্তী ইরফাদের মাথা তার গলার খুব নিকটে, এহেম কান্ডে আতকে ওঠে সিনথিয়া। হৃদপিণ্ড যে সাইরেন বাজিয়ে ওঠে!! হৃদয় যেনো বুকের খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসবে এখন। ইরফাদের স্পষ্ট গলা,

— কাঁদছিলে কেনো?
বুকের কাঁপনে কি অতীতের কিছু জানা যায়? বুকে মাথা রেখে কি জানলো ইরফাদ। কান্না তো বোঝা যায় চোখের জলে। তাহলে সে বুকে মাথা দিয়ে কিসের খবর নিচ্ছে। উঠে বসে ইরফাদ। সিনথিয়াকে টেনে তোলে। মাথার এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দেয় কপাল থেকে। তারপর ধীর গলায় বলে,
— কাঁদছিলে কেনো?
সিনথিয়া অপ্রস্তুত হয়ে যায়।এই মূহুর্তে কি বলবে সে? সত‍্যিটা তো সে বলতে পারবে না।
— বলছোনা কেনো?
সিনথিয়া ইরফাদের ভারী গলার স্বর শুনে কেঁপে ওঠে। তারপর বলে,
— কাঁদিনি তো!
— সিনথি! আমি সিউর না হয়ে কথা বলিনা।
ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় সিনথিয়া ইরফাদের তীক্ষ্ম চোখের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়। এই মূহুর্তে কি বলবে সে। তবে আজ তার নিস্তার নেই। সিনথিয়া শক্ত ঢোক গিলে বলে,
–বাবা-মার কথা মনে পড়ছে। মন খারাপ হচ্ছিলো।
— তোমার হৃদয় পড়তে আমি ভুল করবো! তুমি এটা ভাবো?তুমি আমাকে মিথ‍্যা বলছো সিনথি?
কি আছে ঐ হীমশীতল গলায়? এতো শক্তি কিসের? সিনথিয়া চোখ বন্ধ করে বলে,

–আপনি দায়িত্ব থেকে আমাকে বিয়ে করেছেন? বিয়ে না করলে আমার জীবন নষ্ট হতো তাই?
— আমার কোন কাজে এটা মনে হলো জানতে পারি?
–জানিনা!
— বলো! কি কারণে মনে হলো?
— আপনি কিছু বোঝেন না?
— না বুঝিনা বলো।
–আমাকে ভালো লাগেনি বলেই আপনি এতো ডিসট‍্যান্স মেইনটেইন করছেন। আমি আপনার সাথে যাই না…. ঐ জন‍্য আলাদা রেখেছেন…..
— আর ইউ সিউর?
–হুম….
–ডিসট‍্যান্স কমাতে হবে তাইতো?

ইরফাদের কথায় চোখ কুচকে তাকায় সিনথিয়া।চোখের দৃষ্টি দেখে ইরফাদকে বোঝা তার কাজ নয়।তাই দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। ইরফাদ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইরফাদ। সিনথিয়ার নিজেকে চিড়িয়াখানার প্রাণী মনে হয়।চোখ ট‍্যারা করে তাকায় সিনথিয়া। ইরফাদ সহজ গলায় বলে,
— ট্রাস্ট মি এই কারণে ইমম‍্যাচিউর বউ আমি চাই নি।
এমন কথায় সিনথিয়ার মুখটা অন্ধকারে ছেয়ে যায়। তার মানে সত‍্যিই ইরফাদ তাকে কখনো চায়নি। দায়বদ্ধতা থেকে বিয়ে করেছে। মুখেও স্বীকার করছে। ইরফাদ সিনথিয়ার মুখটা দেখে। তারপর বলে,
— দেখো বিয়েটা খুব খারাপ একটা সিচুয়েশনে হয়েছে। তোমার বাবা মা এই বিষয়টা জানেও না। সিচুয়েশন নরমাল হলে আমি তোমাকে বাসায় রেখে আসতাম। দ‍্যান সবাইকে জানিয়ে তোমাকে এই বাসায় আনতাম। কিন্তু তোমাকে এখানে না আনলে, অফিসিয়াল রুলস অনুযায়ী সিকিউরিটি দিয়ে তোমাকে রাখা হতো। আমি কেনো তোমাকে রেখে আসবো?

আর এখানে যেহেতু আনা হয়েছে। বাসার সবাই জানে পছন্দ করেই এনেছি তাই না? তাহলে তোমাকে অন‍্যরুমে রাখা উচিত হবে? তাই নিজের রুমেই রেখেছি। তবে বিয়ে হলো নতুন এক জীবনের শুরু। সেখানে বাবা-মায়ের দোয়ার প্রয়োজন আছে। অনেক নিয়মকানুন আছে। ঐগুলো থেকে তোমাকে কেনো বঞ্চিত করবো বলো? তোমার জীবনের শখগুলো আমার সামর্থ থাকার পরেও কেনো অপূর্ণ থাকবে সিনথি। আমি তো ঐজন‍্য একটু সময় নিচ্ছিলাম।
সিনথিয়া ঠান্ডা গলায় বলে,

— ভালোবেসে তো বিয়ে করেননি। আমি তো এমনটা চাইনি?
— অজস্রবার ” ভালোবাসি” বলা প্রেমের বিয়েতেগুলোতেও বিচ্ছেদ হয়। ভালোবেসেই বিয়ে করতে হবে এমন রুলস আছে?
— তাহলে কেনো বিয়ে করলেন আমাকে?
— কোনো কারণ নেই।
— তাহলে তো আমার মন মানবে না।আমি কারো জীবনের বোঝা হবো না।
ইরফাদ বলিষ্ঠ হাতে চেপে ধরে সিনথিয়ার হাত। তারপর নামিয়ে নেয় মেঝেতে। তারপর টেনে বিছানায় বসায়। দোলনা থেকে বালিস এনে আগের মতো রাখে।তারপর বলে,
— ওঠো বিছানায়।

সিনথিয়া মূর্তির মতো বসে থাকে। ইরফাদ তাড়া দেয়। সিনথিয়া বেঁকে বসে। মিনমিনে গলায় বলে,
— জোর করে কিচ্ছু চাইনা আমি।
ইরফাদ বিছানায় বসে। সিনথিয়াকে বলিষ্ঠ হাতের উপর তুলে বিছানায় মধ‍্যে তুলে দেয়। সিনথিয়া জেদ করে বসে থাকে। ধীর গলায় বলে,
–আমি সব যন্ত্রণা সহ‍্য করতে পারবো। কিন্তু কেউ ভালো না বেসে দায়িত্ববোধ থেকে সংসার করবে এটা মানতে পারবো না স‍্যার।

রং পর্ব ৪৫

ইরফাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সিনথিয়ার দিকে। ঝুম বৃষ্টিতে আবছা আলোয় উদ্ভাসিত মুখটির পানে চেয়ে বলিষ্ঠ হাত বাড়িয়ে বুকের খাঁচায় এলোকেশী মাথাটা চৌম্বকের মতো টেনে নেয় ইরফাদ, হৃদয়ের সাইরেন বাজা অংশে সিনথিয়ার মাথা চেপে ধরে হীমশীতল গলায় বলে,
— হৃদয়টা কাঁপছে দেখো………

রং পর্ব ৪৫ (৩)