রং পর্ব ৫১ (৩)

রং পর্ব ৫১ (৩)
তন্নী তনু

আধুনিকতার ছোঁয়ায় তৈরী করা রান্নাঘরটিতে প্রবেশ করা মাত্র সিনথিয়ার প্রতিবার ই খুব শান্তি অনুভব হয়। ছিমছাম, পরিপাটি রান্নাঘর। যার হাতের ছোঁয়ায় ঘরটা এতো পরিপাটি মানুষটা সত‍্যিই বড্ড শৌখিন,মনের দিক দিয়ে কোমল। রান্না ঘরে পা রেখেই কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সিনথিয়া। এ বাড়ির বেশীরভাগ জিনিস সাদা রঙের। সাদা রঙ সত‍্যিই চোখের প্রশান্তি দেয়। রান্না ঘরটাও বেশীরভাগ অংশ ইন্টিরিয়র করা সাদা তেই। রান্নাঘরের কেবিনেট গুলোও সাদা রঙের। প্রত‍্যেকটা জিনিস সাজানো গোছানো। ডাবল পাল্লার ফ্রিজটার সামনে দাঁড়ায় ইভা। তারপর মিষ্টি গলায় বলে,
— আসো আসো! আজ সব কিছুতে তোমার ছোঁয়া দরকার।
সিনথিয়া ধীর পায়ে ফ্রিজের সামনে দাঁড়ায় সিনথিয়া।
— বাম সাইডটা খোলো।
সিনথিয়া ইভার কথামত কাজ করে। বাম সাইডের প্রতিটা তাক এতো সুন্দর করে সাজিয়ে, গুছিয়ে জিনিসপত্র রাখা। বোঝাই যাচ্ছে না এটা ফ্রিজ। ইভা ইশারা দেয়। নিচ তাক থেকে পলিতে আটসাট করে পেঁচানো কয়েকটা আস্ত মাছ।

— বড় টা বের করো।
সিনথিয়া ইভার কথা মত বড় মাছটা বের করে। ইভা বলে,
–ঐখানে নিয়ে রাখো। মাছ কাটতে পারো?
সিনথিয়া মাথা দু”পাশে নাড়ায়। ইভা বলে,
–কোনো ব‍্যাপার না। ধীরে ধীরে শিখো। তবে কষ্ট হলেও শিখো। আল্লাহ্ কতো দিন রাখবেন তোমাদর সাথে তিনিই জানেন। আমার ভাইটার তো তুমি ছাড়া কেউ নেই। ও খুব চাপা স্বভাবের। অর্ডার করার অভ‍্যাস নেই। সময় মতো সব না দিলে নিজে নিজেই সব করে। এই যে অফিসের এতো প্রেশার। এর পরে এসে আবার নিজের কাজ করে এটা আমার ভালো লাগে না। সব আমি টাইমলি করে দেই। তুমিও তো কাছে থাকবে, সব বুঝে কোরো। ওয়াইফ হলো হাজব‍্যান্ডের সবচেয়ে কাছের সঙ্গী। এর চেয়ে কাছের কেউ হয় না।
সিনথিয়া ধীর গলায় বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— সব শিখে নিবো আপু।
— এই তো গুড গার্ল। গরুর গোসটা বের করো তো। ওটা পানিতে ভেজাও।
সিনথিয়া লক্ষী মেয়ের মতো ইভার কথা মতো কাজ করে। এরপর সব মসলা, পেয়াজ, মরিচ বের করে ইভা। খোসা ছাড়িয়ে পেয়াজ ধুঁয়ে কাটিং বোর্ডের উপর রাখে ইভা।
— কাটতে পারবে?
সিনথিয়া মাথা নাড়ায়। ধারালো ছুরিটা ধরে পেয়াজ কুচি করে। ইভা পাশাপাশি মসলা ব্লেন্ড করে। সিনথিয়াকে হাতে ধরে মাছ কাটা শেখায় ইভা। একে একে সকল কাজ সিনথিয়াকে হাতে ধরে করায়। সব গোছানো শেষে চুলায় প‍্যান বসায় ইভা।
— গরুর গোস টা আগে রান্না করো। পরে গরম করে নেওয়া যাবে। খিচুড়ি আর ইলিশটা গরম না থাকলে ভালো লাগবে না।

— আজ রাতেও সবাই এক সাথে খেলে হয় না আপু। টুম্পা, আমি, তুমি, বাবা আর উনি।
— আসছো থেকে তো একসাথেই খাচ্ছি বনু। বরের সাথে টাইম স্পেন্ড করার প্রয়োজন আছে। নতুন নতুন যে ফিল টা পাবে ঐটা ভালোভাবে অনুভব করো। পরে এমন সময় আসবে না আর।
সিনথিয়া হাতের খুন্তিটা সাইডে রেখে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ইভার মুখোমুখি দাঁড়ায়। হঠাৎ করেই জড়িরে ধরে ইভাকে। আকস্মিক এহেম কান্ডে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ইভা। ভেজা হাতটা মুঠি করে সিনথিয়ার পিঠে হাত বুলায়। সিনথিয়া চোখ বন্ধ করে ভাবে- এতো কোমল মনের নারীকে কি করে অবজ্ঞা করলো, কি করে দূরে ঠেলে দিলো রাফসান। যে মেয়েটা তার বড় ভাইয়ের বউকে এতো আপন করতে পারে সে তার বরকে কতোটা আগলে রাখতে চাইতো। এই মানুষটার থেকে সংসার ছিনিয়ে নিয়ে রাফসান মোটেও ঠিক করেনি।সিনথিয়ার মাঝে মাঝেই মন চায় সমস্ত সত‍্যিটা ইভাকে বলে সব বাঁধা ভেঙ্গেচুড়ে চারটা হাত আবার এক করতে।
— কি হলো পাখি? মন খারাপ লাগছে?
সিনথিয়া ধীর গলায় বলে,

— তুমি এতো ভালো কেনো? তুমি দূরে গেলে ভিষণ কষ্ট হবে আপাই।
— দূরে কোথায় যাচ্ছি। এতো সহজে আমার মুক্তি নেই।
— তুমি যদি বুঝতে আমার ভেতরের অনুভূতি!
মনের কথাটা মনেই থেকে যায়। আলিঙ্গন ছেড়ে ছলছল নয়নে তাকায় সিনথিয়া। ইভা বলে,
— এতো ইমোশোনাল হলে চলে!! বোকা মেয়ে। চলো রান্না করো।
প্রতিটা কাজ হাতে ধরে ধরে দেখিয়ে দেয় ইভা। সিনথিয়া ইভার কথা মতো রান্না করে। একটা চুলায় নিভু নিভু আঁচে মাংস বসিয়ে অন‍্যচুলায় খিচুড়ি বসিয়ে দেয় সিনথিয়া। রান্না শেষ হওয়ার আগেই ইভা বলে,
— তুমি এখন আমার রুমে যাও। ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে আসো। একটু সাজু করে এসো। এসে মাছটা ভাজবে। আমিই ভেজে দিতাম। তবে ভাইয়া তো তোমার হাতের রান্না খেতে চেয়েছে। আমি সব রেডি করে দিচ্ছি তুমি মাছটা শুধু ফ্রাই প‍্যানে দিবে, আর উল্টে পাল্টে দেবে।

— সাজবো?
— একটু সাজবে না? সাজবে মানে তো আর এটা নয় ভাড়ী মেকআপ, গাঢ় সেডের লিপস্টিক। তুমি এমনিই স্নিগ্ধ দেখতে। ড্রেসটা পড়বে, মুখে মস্চোরাইজার, অার হালকা করে একটু লিপগ্লোস দিও। আমার মনে হয় তোমার চোখ এমনিই কাজল কালো। ঐচোখে হোয়াইট কাজলটা খুব মানাবে। একটু দিও….
— এতো কিছু??
— ভাগ‍্যিস তোমার বর অতো রঙচঙ পছন্দ করে না। ন‍্যাচারাল লুক ই পছন্দ করে। ঐজন‍্য তোমার ওতো সাজগোজের প্রয়োজন নেই। যাইহোক,
অনেক কথা হয়েছে, সময় নষ্ট হচ্ছে। যাও সেজে আসো।
— আচ্ছা!

— শোন শোন! সাদা ধবধবে একটা ড্রেস অর্ডার করেছিলাম। মানে আমার পছন্দ ছিলো পরে ভাবলাম তোমার জন‍্যেও নেই। দুজন এক রকম ড্রেস পড়বো। ভাইয়ার রুম থেকে ড্রেস আনতে হবে না, সারপ্রাইজ নষ্ট হয়ে যাবে।ড্রেস আমার আলমারিতে আছে দেখো।
ড্রয়ারে চুড়িও আছে সবগুলোই ভাইয়ার আনা। যতো বিষণ্ন মন ই থাক বাবা আর ভাইয়ার জন‍্যে সব পড়তে হয়। এতো চুড়ি জমেছে,ঐখান থেকে যেগুলো ভাল্লাগে নিও।
— তুমি বের করে দাও আপু।
— এই বাসাটা তোমার। আর আমার কোনো প্রাইভেসি নেই। তুমি হাত দিয়ে নিলেই আমার ভালো লাগবে।
সিনথিয়া একপলক তাকায় ইভার দিকে, পৃথিবীতে হৃদয় উজার করে যারা ভালোবাসে তারাই ভালোবাসা পায় না। কোমল হৃদয়ের মানুষগুলো শুধু কষ্টই পায়।

মাঝারি আকৃতির একটা টেবিল। কাচের স্বচ্ছ ডিশ এ বাসমতি চালের খিচুড়ি, উপরে গাঢ় সবুজ রঙের দুটো মরিচ, গোল চাকা আকৃতির তিনখন্ড লেবু, ঝাল ঝাল গরুর মাংস ভুনা, গরম মচমচে ধোঁয়া ওঠা কয়েক পিছ ইলিশ ভাজা লম্বাকৃতির ক্রোকারিজে সুন্দর ভাবে সুসজ্জিত, সাথে গোল গোল করে কয়েক পিছ বেগুন ভাজা। বন প্লেটে মরিচ,লেবু আর কয়েকপিছ শসা দিয়ে সাজিয়ে টেবিলের উপরে মোমবাতির ঝাড়টা বসিয়ে দেয় ইভা। প্রতিটা মোমবাতির চারপাশ জুরে স্বচ্ছ কাচের দেয়াল। টেবিলের চাকা ধীর গতিতে চালনা করে ইভা বলে,
— এভাবে টেনে নিয়ে যেতে পারবে? সাবধানে নিও।
সিনথিয়া মাথা নাড়ায়। ইভা বলে,
— সাদা রঙ টা মনে হয় তোমার জন‍্যেই স্পেশালি বানানো হয়েছে। আর ঐজন‍্যেই আমার ভাইয়া সাদা রঙ টা এতো পছন্দ করে। খুব মিষ্টি লাগছে আজ।
যাও এবার। প্ল‍্যান মনে আছে তো?
সিনথিয়া ধীর গতিয়ে মাথা নাড়ায়।

ঝুম বৃষ্টি, অর্ধখোলা জানালার ফাঁক গলিয়ে বাতাসের আনাগোনা। কুচি কুরি সাদা পর্দা গুলোর উড়াউড়ি। বেলকনির চাপানো থাই গ্লাস ঘেসে বৃষ্টির ধারা। বিছানায় কোলের উপর ল‍্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ ডুবিয়ে আছে ইরফাদ। ঘরের সাদা ধবধবে আলো হঠাৎ করে অন্ধকারে তলিয়ে যায়। চোখ তুলে তাকায় ইরফাদ। কক্ষের সমস্ত আলো অন্ধকারে ডুবে গেলো? লোডশেডিং তো হওয়ার কথা না। একসাথে সবগুলো লাইট নষ্ট হওয়াও সম্ভব না। ল‍্যাপটপ ফোল্ড করে গলা উচিয়ে ডাকে,
— ইভা!

ইরফাদের দরজার সামনে দাঁড়ানো সিনথিয়া। এক দুই তিন এভাবেই এক থেকে দশ পর্যন্ত গুণে গুণে অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমে খাবার টেবিল সহ প্রবেশ করে সিনথিয়া। মূহুর্তেই উপর তলার প্রতিটি কক্ষের আলো নিভে যায়। দিয়াশলাইয়ের কাঠির ঘর্ষণে প্রজ্জলিত সোণালী আভায় উজ্জল দ‍্যুতি ছড়িয়ে পড়ে কক্ষে। নিচু হয়ে কাচের দেয়াল ভেদ করে মোমের সুতো জ্বালিয়ে দেয় সিনথিয়া। সাদা ধবধবে কটনের গাউন, দুহাতের চুড়ি রিনিঝিনি বাজছে। সাদা হেয়ার বেন্ড ছাপিয়ে চুল গুলো পড়েছে পিঠ জুড়ে। অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া কক্ষ আলোয় হাসছে, আলোয় ভাসছে। টেবিলের একপ্রান্ত নিচু হয়ে ঠেলে আসা মেয়েটির গলার ওড়না হাতের উপর গড়িয়ে পড়লো। ইরফাদ নিরব, নিস্তব্ধ, নিশ্চল নয়নে তাকিয়ে। টেবিল ঠেলে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় রেখে শীড়দাড়া টান করে দাঁড়ায় সিনথিয়া। অতঃপর তার দিকে স্থির রাখা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে চোখজোড়া নিবদ্ধ করে। টানটান শিড়দাড়া শিরশিরিয়ে দূর্বল করে দেয় তাকে। ধীরপায়ে উঠে আসা ইরফাদ সিনথিয়ার মুখোমুখি হয়ে শীতল গলায় বলে,

— সর্বনাশ করেই ছাড়বেন মনে হচ্ছে।
কোমল দৃষ্টিতে ইরফাদের দিকে চোখ তুলে তাকায় সিনথিয়া। ধীর গলায় বলে,
— সব ঠিক ঠাক ভাবেই তো করলাম।
— ইমম‍্যাচিউর বউ তোমাকে কি করে বুঝাই আমি!!!
–বসুন আমি খাবার সার্ভ করে দিচ্ছি। ইভা আপু হেল্প করেছে। খারাপ হয়নি সত‍্যি বলছি।
— ফ্রেশ হয়ে আসি!!
–হুম অবশ‍্যেই..
দুটো প্লেট থেকে একটা প্লেটে খিঁচুড়ি, লেবু, আর এক পিছ ইলিশ দেয় সিনথিয়া।চেয়ার টেনে দেয়, গ্লাসে পানি ঢালে। মৃদু বাতাসে মোমের আলো দোল খায়। সিনথিয়া জানালার গ্লাস টেনে দেয়। পর্দা চাপিয়ে পেছন ফেরে। ইরফাদকে দেখেই চেয়ার টেনে দেয় সিনথিয়া। তারপর বলে,

— বসুন।
–তুমিও বসো!
সিনথিয়া চেয়ার টেনে বসে। ইরফাদ ধীর গলায় বলে,
— তোমার প্লেট নাও।
সিনথিয়া নিজের প্লেটে খাবার নেয়। আর তলিয়ে তাকায় ইরফাদের দিকে। ঝুড়ঝুড়ে দানার খিঁচুড়িতে লেবু চিপড়ে মুচমুচে ভাজা ইলিশ মাছের অংশ হালকা করে মেখে নিয়ে কোমল করে তুলে মুখে দেয় ইরফাদ, সেকেন্ড খানি সময় চোখ বুজে নিয়ে যে অভিব‍্যক্তি ইরফাদের মুখে ফুটে ওঠে তাতেই নিজের মুখের রস শক্ত ঢোক গিলে নেয় সিনথিয়া। বেশীই কি মজা নাকি লোকটা খায় ই এমন করে? ঠিক তখনই চোখ মেলে তাকায় ইরফাদ। সিনথিয়ার ঘন আখি পল্লবে দৃষ্টি ফেলে বলে,
— প্রথমবার হিসেবে ভালো হয়েছে।
সিনথিয়া অল্প একটু খাবার নিজের মুখে তুলে নেয়। কপাল কুচকে তলিয়ে ভাবে,”মুখের এক্সপ্রেশন দেখে মনে হলো না জানি কতো মজা।”
ইরফাদ এক ভ্রু উচিয়ে বলে,

— কি মজা হয় নি?
— ভালোই হয়েছে!
— আমার পাশে এসে বসো। আমি খাইয়ে দেই। মজা লাগবে।
সিনথিয়া ইরফাদের পাশে বসে। প্লেট হাতের উপর নেয় ইরফাদ। নিজের হাতে মেখে একে একে তিনপিছ মাছ খাওয়ায় ইরফাদ। অনেকটা সময় পরে সিনথিয়া মাছের শূন‍্য ক্রোকারিজ দেখে বলে,
–মাছ কোথায় গেলো!!
— হুম তাইতো! কোথায় গেলো!
— আমি খেয়ে নিয়েছি?
— বরের হাতে খাবার একটু বেশীই মজা মনে হচ্ছে??
— আপনি কি করে জানলেন?
— ভালোবাসার ছোঁয়ায় যে কোনো জিনিস ই সুন্দর, মিষ্টি।
–ভালোবাসেন বুঝি?
— একটা মাত্র বউ! ভালোবাসবো না?
–এতো সহজ স্বীকারোক্তি?
— ভালোবাসা প্রকাশে লজ্জা পেতে হবে নাকি?
— তাহলে আগে কেনো মুখ ফিরিয়ে থাকতেন?
— কখন? কোন সময়ে।

— যেদিন আমাকে ছেড়ে দেওয়া হলো জেল থেকে ঐদিন রাস্তায় আমি আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আপনি একবার ফিরেও দেখলেন না।
— আমি কি তোমাকে তখন ভালোবাসতাম?
— জানিনা!
–তাহলে?
— একটুও বাসতেন না?
— নাহ!
— একটুও না!
— না সিনথি।
— তাহলে প‍্যাম্পার কেনো করতেন।
— একটা মেয়ে বিনা কারণে সাফার করছে। সে নির্দোষ আমি জানি। তাই একটু আশ্বাস দিয়েছি যাতে মেয়েটা ভেঙ্গে না পড়ে।

— সবার ক্ষেত্রেই দিতেন?
— আমি কি খুব বেশী কিছু দিয়েছিলাম সিনথি?
— ঐটাই যে আমাকে শক্ত রেখেছে, আমার সাহস যুগিয়েছে।
— সাহস তো দিতে চেয়েছি। এছাড়া কিছুই না।
— আমি ভালো না বাসলে আপনি ঐ সিনথি নামটুকু ভুলে যেতেন তাইনা।
— অবশ‍্যেই!
নিরব হয়ে যায় সিনথিয়া। মুখটা ভার হয়ে যায়। ইরফাদ শীতল গলায় বলে,
–প্রথমে ভালোবাসিনি তাতে কি,ভালোবাসি তো এখন।
সিনথিয়া তলিয়ে তাকায়, ঠোঁটের কোণে ফোটে একচিলতে হাসি।

খাওয়া শেষে মোবাইলের টর্চ জ্বেলে সব কিছু রান্না ঘরে পরিষ্কার করে রাখে সিনথিয়া। রুমে প্রবেশ করে একজনের রুপে বিমোহিত হয়ে নিরব, নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সিনথিয়া। অতঃপর এক সুদর্শন, বলিষ্ঠ পুরুষের দিকে চোখ স্থির হয়ে যায় সিনথিয়ার, হৃদয় পরিণত হতে থাকে ধীরে ধীরে বরফখন্ডে। এক মিনিটেই পুরো লুক চেঞ্জ , পরণে কালো রঙের হাফ স্লিভ টি-শার্ট,কালো প‍্যান্ট, উন্মুক্ত বুক চাপা দেয়া টি- শার্টের বোতাম গুলো খোলা। মুখে পানির ঝাপটা দেয়া অবশিষ্ট পানি চুইয়ে পড়ছে টি-শার্ট জড়ানো বুকে। আলতো করে ভেজানো চুলে আঙ্গুলি চালাতেই সিনথিয়ার বুকে এক প্রকার ঝড় বয়ে যায়, শিরদাড়া জুড়ে অনুভূতিরা আন্দোলিত হয়, শিরশিরিয়ে ওঠে পায়ের তলা। এই সুদর্শন, বলিষ্ঠ পুরুষের বুকে একবার আছড়ে না পড়লে যে হৃদয়ের ঝড় থামবে না? এই অনুভূতি কি সে বুঝতে পারে? কি দরকার ছিলো এই নিঝুম, ঝড়-বৃষ্টির রাতে নিজেকে এভাবে প্রেজেন্ট করার। এমনিতে সে কি কম সুন্দর?? সব পাগল করার ধান্দা। চোখ ফিরিয়ে নেয় সিনথিয়া। ফিরিয়ে নেয়া চোখপানে তাকিয়ে ইরফাদ বলে,

— টাওয়েল কোথায় রাখলে?
— আমার টা?
— ঐটাই আমার টাওয়েল।
— বৃষ্টি তো তাই বাইরে ছড়িয়ে দিয়েছি। এনে দিবো?
— না থাক।
কক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সিনথিয়া। ইরফাদ নিজের পুরোনো গিটারটা বের করে। সিনথিয়া চোখ বসিয়ে ইরফাদের কার্যকলাপ দেখতে থাকে। অতঃপর কক্ষের মধ‍্যে থেকে ছো মেরে সিনথিয়াকে তুলে নেয় ইরফাদ। জানালার থাই গ্লাস লাগানো অংশটার সামনে লম্বা করে বসার জায়গা। সেখানে তুলে বসায় সিনথিয়াকে। পা ভাজ করে দেয়ালে শরীর এলিয়ে বসে সিনথিয়া। হাতের সাইডের থাইগ্লাস চুইয়ে অঝোর ধারায় ঝড়ছে ঠান্ডা জল। রকিং চেয়ারের বসে ইরফাদ। আঙ্গুলের ছোঁয়া সুর তোলে গিটারে। এক সুখকর অনুভূতিতে ভেসে যায় সিনথিয়া। নিশ্চুপ, নিরবে কান পেতে শোনে সেই হৃদয়স্পর্শী সুর। পজ দেয় ইরফাদ। অতপর বলে,

— গান গাইতে পারো?
সিনথিয়া মাথা দু”দিকে নাড়ায়। তারপর বলে,
— আপনার গলায় গান ভালো ওঠে। একদম ডুবে যাওয়ার মতো।
— তাহলে ঐ রাতে তুমি ঘুমাওনি তাইতো?
নিজের কথার জালে ফেঁসে গিয়ে চোখের পলক ফেলা ভুলে যায় সিনথিয়া। কথা ঘুড়িয়ে বলে,
–আজকে গান শোনাবেন?
— আমার কথার আন্সার পাইনি ড্রামা কুইন।
— আমি কখন ড্রামা করলাম।
— তুমি গাড়িতে থাকাকালীন একবার-ই গান গেয়েছি। তখন তোমার ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা।
— আমার আপনার সাথে ঘুরতে ভালো লাগতো। বললে কি আমাকে নিয়ে ঘুরতেন!!
— ঠান্ডা মাথার খিলারি। না হলে কি আর ঘুমের ভান ধরে আমার বুকের মধ‍্যে জায়গা নাও..
–আমি ইচ্ছে করে করেছি নাকি।
–হুম তাইতো।

— আচ্ছা আপনাদের পুলিশ টিম কি এখনো ধরতে পারেনি জিসান ভাইয়ার পিঠে ছয়টা কামড় কিসে দিলো। আমার কেনো যেনো মনে হয় কেউ রিভেঞ্জ নিতে চেয়েছে। না হলে আমার পিঠে ছয়টা কামড়ের পরিবর্তে তার পিঠে কেনো ছয়টা আচড় লাগলো?
–কষ্ট লাগে নাকি?
–মোটেও না! আমি জানলে আরোও কয়েকটা দিতে বলতাম।
— দিয়ে আসবো আজ?
— আপনিইইইই…..
–শশশ গান শোনো।
চোখ বন্ধ করে গিটারে সুর তোলে ইরফাদ। তারপর চোখ বন্ধ করে রেখেই গায়,

আমার পরানো যাহা চায়,তুমি তাই তুমি তাই গো
আমার পরান যাহা চায়
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো
আমার পরান যাহা চায়
তুমি সুখ যদি নাহি পাও যাও, সুখের সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে
আর কিছু নাহি চাই গো
আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই,তুমি তাই গো…
আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন
তোমাতে করিব বাস
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ মাস
আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন
তোমাতে করিব বাস
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ মাস
যদি আর-কারে ভালোবাসো
যদি আর ফিরে নাহি আসো
তবে তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও
আমি যত দুঃখ পাই গো….

শেষের লাইন টুকু শুনে পা নামিয়ে দেয় সিনথিয়া। ধীর পায়ে এসে বসে ইরফাদের কোলের উপর। গিটার টা সরিয়ে নিজে জায়গা করে নেয় বলিষ্ঠ বুকে। অতঃপর ধীর শীতল গলায় বলে,
— আপনার সকল দুঃখ আমার। আপনারের সুখেই আমার সুখ….
বলিষ্ঠ হাতের টানে বুকের তপ্ত ওমে সিনথিয়াকে টেনে নেয় ইরফাদ। অতঃপর শীতল গলায় বলে,
–কোনো মিন করে গান গাইনি। ভালো লেগেছে তাই গেয়েছি।
— অন‍্য গান শোনান…
রকিং চেয়ারে শরীর এলিয়ে দেয় ইরফাদ, বুকের মধ‍্যে একটুকরো ভালোবাসাকে বুকের ওমের চাদরে ঢেকে দোল দেয় ইরফাদ। বন্ধ চোখে আবারো গায়,

যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…………….(।।)
এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে
জল ভরা দৃষ্টিতে
এসো কোমল শ্যামল ছায় ।
যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরি
কদম গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি ।।
উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো
ছলকে ছলকে নাচিবে বিজলী আরো
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…………….(।।)
নামিবে আঁধার বেলা ফুরাবার ক্ষণে
মেঘ মাল্লা বৃষ্টিরও মনে মনে ।।
কদম গুচ্ছ খোঁপায়ে জড়ায়ে দিয়ে
জল ভরা মাঠে নাচিব তোমায় নিয়ে
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…………….(।
যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…………….

অতঃপর মোমবাতির চুইয়ে পড়া স্বর্ণালী আলোয় রকিং চেয়ারে দুলতে থাকা দুজন মানুষের মধ‍্যে বিরাজ করে প্রগাঢ় নৈঃশব্দতা………
শুধু দুটো হৃদযন্ত্রের দূর্বার প্রেমালাপ দুটো দেহ ছাড়িয়ে এক হতে চায়।
অনেকটা সময় নৈঃশব্দে তলিয়ে থাকে দুজন। সিনথিয়া নিরবতা ভেঙ্গে বলে,
— বেলকনিতে যাওয়া যাবে না?
— ভিজে যাবে!
–আপনার বৃষ্টিতে ভিজতে ভাললাগে না।
— নাহ!
— আমার জানালায় হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁতে ভালো লাগে।
— চলো…
সিনথিয়া উঠে বসে। ইরফাদ খুলে দেয় থাই গ্লাস। বৃষ্টির ঝাপ্টায় সরে আসে সিনথিয়া। ইরফাদ ডাকে,
–আসো

বৃষ্টির স্বচ্ছ ঠান্ডা পানি হাত বাড়িয়ে দেয় সিনথিয়া। পেছনে দাঁড়ায় ইরফাদ। সিনথিয়ার কোমল হাতের নিচে হাত বাড়িয়ে একসাথে বৃষ্টির জল স্পর্শ করে। সিনথিয়া উচ্ছাসে বৃষ্টির পানি নিয়ে খেলা করে। চুইয়ে পড়া স্বর্ণালী আলোয় স্নানরত সিনথিয়ার গ্রীবা জ্বলজ্বল করছে, শীতল চোখে তাকিয়ে থাকা ইরফাদ সেখানে প্রগাঢ় ভাবে ডুবিয়ে দেয় ভেজা, কোমল, ঠান্ডা ওষ্ঠাধর। অতঃপর উচ্ছাসে খেলতে থাকা সিনথিয়ার রক্ত জমে যায় প্রগাঢ় স্পর্শের দমনে, উষ্ণ হৃদপিণ্ড জমে যায় বরফখন্ডে।

ধীর গতিতে পেছন ফেরে সিনথিয়া। গলায় রাখা পাতলা ফিনফিনে সাদা ওড়না হাতে পেঁচিয়ে সরিয়ে নেয় বলিষ্ঠ হাতের মানুষ। কম্পমান হৃদযন্ত্রের অস্বাভাবিক কাঁপনে চোখ সরিয়ে নেয় সিনথিয়া। সিনথিয়ার অস্বাভাবিক কাঁপতে থাকা হাতটা পেঁচিয়ে সিনথিয়ার কোমরের পেছনে শক্ত হাতে ধরে ইরফাদ। সিনথিয়া শরীর এলিয়ে থাই গ্লাসের দিকে। বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু ফোটায় ভিজে ওঠে পিঠ। বলিষ্ঠ,সুদর্শন পুরুষের চোখদুটোতে একবার চায় সিনথিয়া। বেগতিক চোখের ভাষা পড়ে অন‍্য হাত বলিষ্ঠ বুকে ঠেকিয়ে বাঁধা দেয় ইরফাদকে। সে হাতের বাঁধন উপেক্ষা করে একজোড়া শীতল,কোমল, ভেজা ওষ্ঠ আলতো করে ছোঁয় গলার প্রতিটা ভাজ। বৃষ্টির ফোটায় ফোটায় ভিজে যায় সিনথিয়ার মুখ, ইরফাদের মাথা। শরীর এলিয়ে দেয়া সিনথিয়াকে বলিষ্ঠ হাতে টেনে নিজের দিকে নিয়ে প্রগাঢ় হীম শীতল গলায় ইরফাদ বলে,

রং পর্ব ৫১ (২)

— চোখ বন্ধ করে রেখেছো?একটা চুমুতেই সকাল হয়ে যাবে।
অতঃপর বাক‍্যটা সত‍্যায়িত করার লক্ষে বলিষ্ঠ, সুদর্শন পুরুষের একজোড়া ওষ্ঠ ডুবে যায় কোমল নারীর কম্পমান হৃদপিণ্ডের উন্মুক্ত অংশ জুড়ে।

রং পর্ব ৫২