রং পর্ব ৫৪
তন্নী তনু
জিসান সিনথিয়ার চাচাতো ভাই। ভুলে গিয়ে থাকলে মনে করিয়ে দিলাম।
ফ্ল্যাসব্যাক–
কানে হেডফোন গুজে রকিং চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে অন্য জগতে বিচরণ করছে জিসান। অনেকগুলো দিন কেটে গেলেও সিনথিয়ার বিষয়টি ক্রমেই ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছে। কিডন্যাপিং এর পরে অনেকগুলো দিন কেটে গেছে মেয়েটির কোনো খোঁজখবর নেই। চাচা চাচীও আজকাল বেশ উদাসীন বিষয়টা নিয়ে।মেয়ের বাঁচা মরাতে তাদের কিছু আসে যায় না নাকি!! মনে হচ্ছে মেয়ে অপহরণের শিকার নয়! যেনো শ্বশুরবাড়িতে আরাম আয়েশে রেখে এসেছেন।
ঐদিকে মোটা অংকের টাকার আশি শতাংশ এখনো হাতেই আসেনি। নতুন করে কোনো কল আসেনি। সবকিছু বিদঘুটে আর ঘোলাটে লাগছে। রকিং চেয়ারটা হালকা দুলিয়ে মনের সাথে তলিয়ে ভাবে জিসান– এসব মরিচিকার পেছনে না ছুটে নিজের বিয়ের উপর নজর দিলেও সুন্দরী বউ এর সাথে সময় কাটাতে পারতো। আজকাল সিনথিয়া মোটা অংকের টাকাও নাকি কামায়। জীবনটা আরাম আয়েশেই চলে যেতো। শুধু শুধু জীবনটা ঝামেলার মধ্যে ফেলে দিয়ে এখন অযথাই দুশ্চিন্তায় মাথা ক্ষয় হচ্ছে। সহসাই উচ্চ শব্দে চেচিয়ে ওঠে কলিং বেল। চোখ মুখ কুচকে ফেলে জিসান। অতঃপর গলা উচিয়ে ডাকে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
–মা…. কেউ এসেছে মনে হয়।
— আমি রান্না করছি বাবা। একটু তুমি ওঠো।
কান থেকে হেডফোনটা একটানে খুলে বিছানায় ছুড়ে মারে জিসান। চরম বিরক্তি নিয়ে উঠে আসে। দরজা খুলেই চোখ গোল গোল করে ফেলে জিসান।
— আপনারা!!
— আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে থানায় জেতে হবে।
অতঃপর……
দুটো চেয়ারের মাঝখানে কয়েক হাত দূরত্ব। একটা চেয়ারে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে জিসান। অপর পাশের লেদারের চেয়ারে শীরদাড়া টান করে বসে আছে ইরফাদ। জিসানের মিনমিনে গলা,
–বিশ্বাস করুন আমি এসবের কিছুই জানিনা।
মিথ্যার আভাসে ইরফাদের হীমশীতল মেজাজ আগুনের ন্যায় উত্তপ্ত হয় ক্রমেই। তার ক্রুব্ধ গলার আওয়াজে প্রলয়ের পূর্বাভাস,
— তাহলে মিস সিনথিয়া ইবনার রুমে ছাদ থেকে ফোন পাঠানো, তার উপর টোয়েন্টিফোর আউয়ারস নজরদারি,কালপ্রিটের কাছে তথ্য প্রেরণ কি আমি করেছি???
— এগুলো কে করেছে স্যার!! আমি তো ওকে ভালোবাসতাম। ট্রাস্ট মি। ও কিডন্যাপ হওয়ার আগে আমাদের বিয়ের কথাও চলছিলো। ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করুন।
ইরফাদের ঠান্ডা মস্তিষ্ক টগবগ করে ফুটতে থাকে। রক্তচক্ষুতে তাকায় জিসানের দিকে।
— ছয়টা কামড়ে কয়দিন হসপিটালে থাকতে হয়েছে মনে আছে??
এহেম কথায় হৃদযন্ত্রটা আকষ্মিক দূর্বার গতিতে কাঁপতে থাকে জিসানের, পুরোনো ভয়াল দৃশ্য চোখে ভেসে উঠতেই চোখ তুলে তাকায় ইরফাদের দিকে।ইরফাদের নিগূঢ় চাহুনিতে ভেসে ওঠা ভয়াল আভাসে জিসানের ভেতরে ওঠে উত্তাল ঝড়। তাহলে সে রাতে কে ছিলো মুখোশের আড়ালে!!! সত্যিই কোনো জন্তু নাকি রিভেন্স!!! আর রিভেন্স ই যদি হয়। তাহলে……..?
ঠিক সে সময়ে নিগূঢ় কন্ঠস্বরে ইরফাদ বলে ওঠে,
–যাস্ট ওয়েট এন্ড সি। অনেক হিসেব বাকি।
বর্তমান–
এতোটুকু দৃশ্য স্মৃতিচারণ করে রাফসানের প্রতি আরো কঠিন হয় ইরফাদ। পা ধরে থাকা রাফসানকে কটাক্ষ করে বলে,
— নিজের স্বার্থের জন্য নিজের বোনকে ইউজ করেছেন মিস্টার রাফসান। আপনার বোন ছোট বেলায় ঐ জিসানের কাছে অ্যাবিউজ হয়েছে। আপনার বোন রাফির কাছে প্রতারিত হয়েছে। জিসানের বিষয়টা আপনার অজানা। কিন্তু রাফি? ওর বিষয়টা আপনি জানতেন। এরপরেও শুধু মাত্র প্রতিশোধের নেশায় আপনি নিজের বোনকে ইউজ করেছেন। সে রাতে যদি সঠিক সময়ে আমি না আসতাম আপনার বোনের কি হতো? আপনার কাছে আপনার মেয়ে কতোটুকু সেইফ মিস্টার রাফসান!!
— আমি ভালোবাসাহীন মানুষের পায়ের তলায় থেকে বড় হয়েছি। আমার হৃদয়ে যে কষ্ট আছে ঐটা আপনি বুঝবেন না স্যার। আমার ছোট্ট একটা সুখের নীড় ভেঙ্গে কতোগুলো টুকরো হয়েছে। ছিন্ন বিচ্ছিন্ন আমার জীবন। প্রতিশোধের নেশায় আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। সিনথিয়াকে আমি তো কাছে থেকে পাইনি। সামনাসামনি দেখাও হয়নি। প্রতিশোধের নেশায় আমি যাই করি আমি আমার বোনকে ফুল সেফটি দিয়েছি। চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে সারা রাস্তা জুড়ে ও সবাইকে মেরেছে। ওর উপর ফুলের টোকা আমি পড়তে দেইনি। ও যখন আমার কাছে ছিলো ওকে আমি আগলে রেখেছি। ও যতো কাছাকাছি থেকেছে আমি ততো ভালোবাসা অনুভব করেছি,টান অনুভব করেছি। কাছে না পেলে কি করে বুঝবো বোন, মেয়ে এদের ভালোবাসা কেমন হয়।
— পা ছাড়ুন। আই হ্যাভ টু গো।
ভাড়া বাসার একটি বড়সড় রুমে ফ্লোরিং বিছানায় বসে আছে তিথি। শিশির ওয়াশরুম থেকে উকি দিয়ে বলে,
— কল আসলে ধরবে না ওকে!!
তিথি আলগোছে মাথা নাড়ে। এরপরেই ফোনে টাইপ করে,
–এই রিমা কি অবস্থা রে…
— আলহামদুলিল্লাহ্!
–আন্টির কি অবস্থা। আগের থেকে নরমাল?
— না আগের থেকে সব আরোও কমপ্লিকেটেড।
— খুবই প্যথেটিক! আন্টির একটু বোঝা উচিত।
–ওনার জায়গা থেকে উনি ঠিক আছে। এই যে একটা বড়সড় ব্লান্ডার করে বসে আছি। আমার জীবন তো এখন কমপ্লিকেডেট তাই না? এই জীবনের ফিউচার কি?আমার কি হবে? এই বাচ্চাটার কি হবে। সুখের একটা আস্ত জীবন খুব সহজেই পাড় হয়। কিন্তু আমার এই ভুলে পুরো জীবন কি মসৃণ হবে। আমার জন্য পুরো পরিবারকে সাফার করতে হচ্ছে। আমার জন্য আমার মা সবসময় সকলের কথা শোনে। বাজার, পাশের ফ্ল্যাট, আন্টিরা, সবাই কথা শোনায়। সবাই ছি ছি করে।
— ধৈর্য্য ধর। সব ঠিক হয়ে যাবে।
— কিছুই ঠিক হবে না আর। শুধু মানিয়ে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। অনেকদিন হলো তোদের দেখি না। কেউ খোঁজ নেয় না। জীবন কতো অদ্ভুত। একসময়ে একসাথে ছাড়া চলতেই পাড়তাম না। একদিন দেখা না হলে পাগল হয়ে যেতাম আর এখন কতো দূরত্ব। সিনথিয়াটাও কল ধরে না।
সিনথিয়ার বিষয়ে শেয়ার করার পুরো নিষেধাজ্ঞা থাকায় তিথি পুরো বিষয়টা লুকিয়ে যায়। তবে নিজের জীবনের সুখের খবরটুকু তো দিতেই চায় তিথি। কিন্তু যদি মন খারাপ হয়, যদি রিমা ভাবে, ” তার জীবনটাই শুধু এমন কষ্টের।” সে কথা ভেবেই আর কিছুই বলা হয়ে ওঠে না।
— তোকে একটা কথা বলবো রিমা।
— হ্যাঁ শিউর বল।
— অনেক কিছু তোকে বলা হয়নি। তোর মানষিক অবস্থা ছিলোনা তাই।
— কোনো প্রবলেমে পড়েছিস!!
— নাহ! আমার জীবনের অন্ধকার কেটে একটুখানি আলোর দেখা মিলেছে। আমি বিয়ে করেছি।
— সত্যি!! কখন!! কে সে!!
— শিশির ভাইয়া ছিলো না!
— ওহ মাই গড। তোর মামি!! ওনাকে কি করে ম্যানেজ করলি।
— মেনে নেয়নি রে।
— তাহলে?
–ভাড়া বাসায় থাকছি।
–ব্যাপার না। পার্টনার ভালো হলে একদিন সবাই মেনে নেয়। শুধু আমার মতো কপাল পোড়া আর কেউ না হোক।
— মানুষটা সত্যিই খুব ভালো। আমাকে খুব সাপোর্ট দিয়েছে।
— নজর না লাগুক। ভালো মূহুর্ত গুলো কারো সাথে শেয়ার করবি না। আমার সাথেও না।
— তোর খারাপ লাগছে?
–আমি অনেক খুশি হয়েছি। অনেক কষ্ট পেয়েছিস জীবনে। তোর মাথার উপর একটু ছায়ার প্রয়োজন ছিলো। আমার আত্মা থেকে বলছি আমার খুব শান্তি লাগছে। তবে কোনো ভালো মোমেন্ট কখনোই শেয়ার করিস না। যদি নজর লেগে যায়।
— একদিন দেখা করবি!!
— ভেরি সুন ইনশাআল্লাহ। সিনথিয়াকে বলে রাখিস।
–ওকে।
ফোন রাখতেই শিশিরের ফোন বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে,– কলিং মা।
তিথি ঠোঁটে হাসির রেখা ফোঁটে। ভুলে বসে শিশিরের করা নিষেধ।ফোন ধরেই সালম দেয়। তারপর বলে,
–কেমন আছো।
মার্জিয়া বেগমের মাথায় যেনো আকাশ ফেঁটে বাজ পড়ে। চেঁচিয়ে ওঠে মার্জিয়া বেগম,
— জীবনটা তছনছ করে দিয়েও তোর শান্তি নেই। তোর মা আমার ভাই আর আমার জীবন খেলো। তোকে রেখে গেলো আমার ছেলের মাথা খেতে। সব শেষ করে দিলি।
— একটু সহজ হওয়া যায় না আমার প্রতি।
— ফোন রাখ। তোর গলা শুনলেও আমার দিন খারাপ যায়।
ফোন কেটে দেন মার্জিয়া বেগম। শিশির রুমে প্রবেশ করে। তিথির থমথমে মুখ দেখেই বলে,
— বারণ করেছিলাম তবুও শুনিস না। এখন সারাদিন মন খারাপ করে থাক। একটা দিন তো অপেক্ষা কর, একটা দিন।মা নিজেই নিতে আসবে দেখিস।
পশ্চিম আকাশে তেজহীন সূর্যটা ডুবে গেছে ঢুলতে ঢুলতে, সুবিশাল আকাশ ধূসর মেঘে উদ্ভাসিত। ইরফাদ বাসায় ফিরেছে মিনিট পাঁচেক।গুরুগম্ভীর থমথমে পরিবেশে তেজস্বী মুখটার স্বকিয়তা নেই, চুপচাপ বসে আছে বিছানায়, ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপটার দিকে তার নজর নেই,অতল ভাবনায় তলিয়ে যাচ্ছে বারংবার। কক্ষে এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করছে সিনথিয়া। নাহ! কেমন যেনো ঘোলাটে লাগছে! সব ঠিক আছে তো। ধীর পায়ে এগিয়ে ইরফাদের পাশে দাঁড়ায় সিনথিয়া। নরম হাতটা ইরফাদের অবাধ্য গমরঙা কপাল ছোঁয়া চুল গুলোকে সরিয়ে দিয়ে ধীর গলায় বলে,
— কিছু হয়েছে?
চোখ ফিরিয়ে কোমল নারীর কোমল চাহুনির দিকে তাকায় ইরফাদ। সে চোখে শুধু জানার ইচ্ছে। চোখ ফিরিয়ে নেয় ইরফাদ। সাইড টেবিলের উপর ছোট ট্রে থেকে কফি মগটা তুলে নেয়। কফি মগে প্রগাঢ় চুমুক দিয়ে ধীর গলায় বলে,
— টুম্পা কোথায়!!
— আপুর কাছে।
— ওকে একটু আমার কাছে দাও।
ফের প্রশ্ন করার সাহস সিনথিয়ার শরীরে নেই। এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে তার মনে হচ্ছে– আসলেই ভালোবেসে আগলে রাখার যোগ্যতাটুকুই তার নেই। মানুষের ভেতরে কি চলছে, কিভাবে কথা বলতে হবে, কি করে কথা জিজ্ঞেস করতে হয়,কি করে জোর করতে হয় সেই শক্তিটুকুই তো তার নেই। সে একটা পাথুরে মূর্তি যখন যতোটুকু দিচ্ছে ততোটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট। সিনথিয়া এক পা ফেলে আবারও পেছন ঘুরে দাড়ায়। ইরফাদের চোখে চোখ রেখে পাথুরে মূর্তির মতো দাঁড়ায়। মনের সাথে দিধা দন্দের দেয়াল চুকে ধীর গলায় বলে,
— আপনার কি মন খারাপ! কিছু হয়েছে। আমাকে বলা যাবে না?
— নাথিং সিরিয়াস!
— আজকে অন্যরকম লাগছে।
ইরফাদ চোখ ফিরিয়ে বলে,
–টায়ার্ড লাগছে।
— আমি তো আপনাকে কতো খারাপ সিচুয়েশন ফেস করতে দেখেছি। তখন তো এমন লাগেনি। আজ একটু বেশীই অন্যরকম লাগছে। আমাকে বলা যায় না প্লিজ।
— কিছু হয়নি।
— পাঁচটা মিনিট আমি একটু বসি আপনার পাশে?
— হুম সিওর।
বিছানার পাশে অল্প একটু ফাঁকা জায়গায় বসে সিনথিয়া। ইরফাদের নিগূর চোখদুটোকে পড়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালায় সিনথিয়া। মুখে যতোই বলুক, তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সুকন্ঠী রিনরিনে স্বরে সিনথিয়া বলে,
— প্রত্যেকদিন ফিরে আপনি আগে ফ্রেশ হন আজ গোসল করলেন না। আবার কফির মগের দিকে ফিরেও দেখলেননা !
নরম চোখে তাকায় ইরফাদ। নিগূর কন্ঠস্বরে তখনো একই বুলি,
— একটু টায়ার্ড!
— আমি আপনার বুকে হাত রেখে দেখতে পারি?
— কম্পমান হৃদয়ের কম্পন অদৃশ্য হয়ে গেছে আজ। কি দেখবে তুমি?
তড়িৎ গতিয়ে উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করে সিনথিয়া,
–কি হয়েছে!! বলুন না। খুব অশান্তি লাগছে।
— কিছু হয়নি।
— বলবেন না তাই তো। আপনার নিগূর গলার স্বর, চোখের ভাষা বুঝতে পারিনা বলে কি এতোই অন্ধ আমি?? আমার হৃদয়, আমার চোখ কি এতোই ক্ষমতাহীন?
বলেই দ্রুত পায়ে বাইরে বেরিয়ে যায় সিনথিয়া। ইরফাদ ইন্টেরিয়র সিলিং এর দিকে চোখ মেলে শরীর এলিয়ে দেয় বিছানায়। যে দাবানলে তার হৃদয় পুড়ে অঙ্গার, প্রতি মূহুর্তে যন্ত্রণা তাকে যাতাকলে পিষে চলেছে সে যন্ত্রণার মুক্তি কোথায়। এই যন্ত্রণা কতকাল বয়ে বেড়াতে হবে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যে খেলা শুরু হয়েছিলো, সেই অশুভ পাতার বিনাশ করতে ভালোবাসার, মায়ার যে বাঁধন সে নিজ হাতে নিজের অজান্তেই শেষ করেছে সে সত্যটুকু তার সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। অপরাধিকে শাস্তি কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে তার হৃদয়ে কিঞ্চিত ব্যাথাও হয় না এমনকি নিজের রক্তের মানুষের ক্ষেত্রেও না। বিশ্বাসঘাতক, অপরাধীর ক্ষেত্র সে পাথর, ইস্পাত কঠিন। কিন্তু মায়ের মৃত্যু সন্তানের হাতে এই কঠিন সত্য বয়েবেড়াতে ঐ ইস্পাত কঠিন, পাথুরে হৃদয়টাও কেঁপে উঠছে বারংবার।
–মামাই! আসবো?
কি আছে ঐ কথাটায়? পৃথিবীর সমস্ত মিষ্টি একসাথে জড়ো করলেও মনে হয় না এতো মিষ্টি লাগবে যতোটা মিষ্টি ঐ ছোট্ট বাচ্চাটার ডাকে। ইরফাদ সকল যন্ত্রণাকে দূরে ঠেলে দুহাত বাড়িয়ে হৃদয়ের গহীন থেকে লম্বা করে ডাকে,
— মা…
ছোট্ট, মিষ্টি পরীটা একছুটে বন্য হরিণির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে ইরফাদের হাত দুটোর উপর ভর করে কোলে উঠে বসে। দরজায় মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে দুটো প্রাণের আদর ভালোবাসার সাক্ষী হয়। ছোট্ট মিষ্টি পরীটাকে বুকের উপর নিয়ে প্রগাঢ় বাঁধনে আগলে নেয়। ছোট্ট দেহটার পিঠে আদুরে চাপড় দিয়ে ইরফাদ ক্ষণে ক্ষণে ডেকে ওঠে,
— মা
ছোট্ট প্রাণটা ভালোবাসার ছোট্ট নীড় জড়িয়ে ইরফাদের ডাকে সাড়া দেয়,
–হুম
ইরফাদ আবার ডাকে,
— ও মা।
— হুমম
–মা
–হুউউউমমম
–মা,ও মা, মা।
— তোমাল কি হয়েছে মামাই!!
— কিছু না মা!
— তোমাল কি মন খালাপ!! ব্যতা পেয়চো?
দীর্ঘ গভীর তপ্ত শ্বাস টানে ইরফাদ। সে শ্বাসে মিশে আছে কতো যন্ত্রণা, ব্যাথা আর হাহাকার। সেসব লুকিয়ে ছোট্ট উত্তর দেয় ইরফাদ,
— না মা।
ছোট্ট টুম্পা বুক থেকে মাথা তুলে ইরফাদের চোখ পানে তাকায়। ছোট্ট ছানাটা কিছু বুঝে উঠতে না পেরে তার মামনিকে যেভাবে আদর করে সেভাবেই টুপ টুপ করে হামি দেয় অসংখ্য অসংখ্য বার।
রাতের রূপালী চাঁদ ঢাকা পড়ে গেছে ধূসর মেঘের আড়ালে। ইরফাদ ধীর পায়ে কখনো বেলকনি কখনো জানালায় আর কখনো রকিং চেয়ারে। তবে হৃদয়ের গহীনের ঝড়ের তান্ডব তাকে ভেঙেচুড়ে বিলীন করে দেয়। হাঁসফাঁস করা হৃদয়টার চাপা দেয়া সত্যেটা দীর্ঘশ্বাসে মিশিয়ে আকাশে উড়িয়ে দেয়। তবে হৃদয়ে চলা ঝড় থামে না। সিনথিয়া শতবার জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পায় না। অবশেষে ইরফাদ উঠে দ্রুত পা চালিয়ে বেড়িয়ে যায় কক্ষ থেকে। সিনথিয়া বের হয় পিছু পিছু। ইরফাদের বলিষ্ঠ শরীর টা মিলিয়ে যায় রিদুয়ানুর রহমানের দরজায়। সিনথিয়া মনে মনে ভাবে,” মানুষটার কি হলো?”
নামাজ শেষে বাসায় ফিরেছেন রিদুয়ানুর রহমান। এক কাপ চা” এর জন্য মনটা আনচান করায় ইভাকে চা বানিয়ে দিতে বলে এসেছেন তিনি। পরিবারের ব্যস্ত সময়ে তিনি নিরালায়,নিভৃতে উপন্যাস পড়েন। বলতে গেলে কড়া লিকারের চা আর বই তার এখন নিত্যদিনের সঙ্গী। বইয়ের পয়ষট্টিতম পৃষ্ঠায় চোখ ডুবিয়ে দিতেই ইরফাদের গলা,
— বাবা!!
–জয়, আয় আব্বা।
তেজস্বী মুখখানার সব সময় প্রজ্বলিত তেজ, শক্তিটা আজ মিইয়ে গেছে। সর্বক্ষেত্রে বলবান, তেজস্বী, ইস্পাতকঠিন, পাথুরে ছেলেটাকে আজ ভঙ্গুর লাগছে। তিনি বই রেখে তড়িঘড়ি করে উতলা স্বরে বলেন,
— কি হয়েছে আব্বা!
ইরফাদের নিশ্চুপ অভিব্যক্তি, সোজা বসে রিদুয়ানুর রহমানের পায়ের তলায়।
সিনথিয়া থমথমে মুখ নিয়ে যায় রান্না ঘরে। ইভা চায়ের কাপে চা ঢালছে। ট্রে এর উপর কাপ উঠিয়ে নেয় ইভা। তারপর সিনথিয়াকে বলে,
— বাবাকে দিয়ে আসতে পারবে পাখি!! মোমো বানাচ্ছি। দুটো একসাথে দিতে গেলে ঠান্ডা হয়ে যাবে।
— ঐ রুমে তো টুম্পার মামাই গেলো এই মাত্র। দুজন কথা বলছে মনে হয়। যাওয়া যাবে এখন?
— ঐটা কি অফিস!! ফ্যামিলির মানুষই তো। নক করে রুমে ঢুকবে নো প্রবলেম।
ট্রে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ায় সিনথিয়া। ভিড়ানো দরজায় দাঁড়িয়ে পায়ের সাথে আটকে যায় হৃদয়ের স্পন্দন।
ইরফাদের গলায় শোনা যায়,
— খুব অশান্তি লাগছে বাবা। সম্রাট শাহজাহান সব শেষ করে দিয়ে গেলো। সব শেষ।
রিদুয়ানুর রহমান ছেলের মুখপানে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন। এতো সহজে তো ভেঙ্গে পড়ার ছেলে ইরফাদ নয়। তাহলে কিসের এতো অশান্তি তাকে ঝেকে ধরলো। রিদুয়ানুর রহমান ছেলের হাতের উপর হাত চাপড়ে বলেন,
— কি হয়েছে আব্বা। বাবাকে বলো।
এমন সত্যটুকু বলার আগে ইরফাদ আরেকবার ভাবে। তার মা নেই এটা জেনেও সবার জীবন চলছে তবে তার হাতে তার মায়ের মৃত্যু এই সত্যটুকু বলে জটিলতা বাড়ানো উচিত হবে কি না মনের সাথে তলিয়ে ভাবে ইরফাদ।
এদিকে সিনথিয়া সরে আসতে চাইলেও মন সায় দেয় না। অদৃশ্য শেকলে আটকা পড়ে পা জোড়া। কি এমন সত্যি, কি এমন ঘটনা যার কারণে ইরফাদ এতো গম্ভীর হয়ে আছে। ঐ সময়ে ধীর পায়ে পেছন থেকে আসে ইভা। ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় বলে,
–দাঁড়িয়ে কেনো।
ঠিক সে সময়েই পুরোনো নামটা তার কানে ভেসে আসে,
— রাফসান, সম্রাট শাহজাহানের ছেলে বাবা। কতো কি হয়ে গেছে বাবা আমাদের চোখের আড়ালে।
— কি বলিস!
— প্রভাত রঞ্জন আর সম্রাট শাহজাহান দুজন মিলে পুরো দেশটা প্রায় শেষ করে ফেলেছে। সম্রাট শাহজাহান মুখোশের আড়ালে অন্ধকার জগতে সাম্রাজ্য গড়েছিলো। এতোগুলো বছর জেলে ছিলো। তাকে সাহায্য করে গেছে প্রভাতরঞ্জন। শুধু তাই নয় এই লোকটা রাফসানকে ভুলিয়ে ভালিয়ে উস্কে দিয়ে নষ্ট করে ফেলেছে। এতোটাই ভুল পথে তাকে চালনা করা হয়েছে যে প্রতিশোধের নেশায় পাগল হয়ে ধ্যান জ্ঞান ভুলে গিয়েছিলো। ক্রিকেট খেলাকালীন ম্যাচ ফিক্সিং এ খেললে বাবার তথ্য পাবে, বাবাকে পাবে এমন অফার করা হয়েছে তাকে। ক্রিকেট বোর্ড থেকে এই কথা বলা হলেও এর পেছনে ছিলো ঐ প্রভাতঞ্জন।এই প্রভাতরঞ্জন নিজ হাতে ওর বাবার হাত দিয়ে চিঠি লিখিয়ে রাফসানের কাছে মিথ্যা তথ্য পাঠিয়েছে। রাফসান এতোকাল ধরে জানতো ওর বাবার জীবন নষ্ট প্লাস গুম হওয়ার জন্য তুমি আর আমি দায়ী। ওর পরিবার ধ্বংস করার জন্য আমরাই দায়ী। ঐজন্য আমার বোনটার উপর এমন অবিচার করেছে। ওখানেই শেষ নয়।
প্রভাতরঞ্জন মিথ্যা কেসে সিনথিয়া ইবনাকে ফাঁসিয়েছে, আমার উপর কেসের দায়িত্ব দিয়ে আমাকে অলওয়েজ বিজি রেখেছে। এরপর কিডন্যাপিং এর নাটক সাজিয়ে আমাকে কিডন্যাপ করিয়েছে। যাতে পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এইদিকে ডায়ভার্ট থাকে। অন্যদিকে নিজের এ্যপ প্রমোশন করে গেছে। পুরো জার্নিটাতে রাফসান হেল্প করে গেছে। শুধু মাত্র আমার থেকে প্রতিশোধ নিবে এই আশায়। এই প্রভাতরঞ্জন ওকে ম্যানুপুলেট করে গেছে। প্রতিশোধের নেশায় রাফসান পাগল হয়ে গিয়েছিলো বাবা। কিন্তু ফুকেট থাকাকালীন ও কোনোভাবে টুম্পার ছবি দেখে ডাউট করেছে ঐটা ওর মেয়ে। এখন খুব পাগলামি করছে বাবা। আজ আমার পায়েও পড়েছিলো।
— পড়ুক
বাইরে মূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকা কোমলমতী ইভার পাথরে পরিণত হৃদযন্ত্রটা কেঁপে ওঠে। নির্মম, নিষ্ঠুর সত্য তার হৃদয় নিংড়ে টেনে হিচড়ে বের করে যন্ত্রণার নোনাজল। হৃদয়ের ক্ষরণকৃত রক্তকণা উষ্ণ নোনাজলে পরিণত হয়। টুপটুপ করে পড়ে দুচোখ বেয়ে। ঐদিয়ে ইস্পাত কঠিন হৃদয়ের অধিকারী ইরফাদ বাবার পায়ের উপর ঠেকায় তার মাথা। দাবানলে পুড়তে থাকা হৃদয়ের পরতে পরতে যে সত্য লুকিয়ে আছে তা বুকে চাপা দিতে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। এতো নির্মম, কঠিন সত্য চেপে রাখা তার ইস্পাতকঠিন হৃদয়ও পারছে না। রিদুয়ানুর রহমান ছেলের হাত টেনে ধরে বিস্মিত হয়ে বলে,
–কি করছিস!!
— বাবা আমি তোমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস শেষ করে ফেলছি বাবা।
–কি হয়েছে আমাকে বল।
— সব চেয়ে প্রিয় জিনিস আমি কেড়ে নিয়েছি বাবা।
— সব কিছুর উর্ধ্বে আমার সন্তান। আমি তোমার অপরাধ ব্যতিত সকল ভুল ই ক্ষমা করবো। বলো কি করেছো?
— বাবা! ঐ সম্রাট শাহজাহান আমাদের সমস্ত আলো অন্ধকারে পরিণত করেছে বাবা। মা কে বাসা থেকে ওনার লোকজন ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। এতো অপমান, এতো অসম্মান শুধু তার জন্য বাবা। মা আমাদের ছেড়ে যায়নি। তোমার মানসম্মান নষ্ট করতে এতো কিছু করা হয়েছে।
প্রকাশিত এতোটুকু সত্য শুনে সিনথিয়ার হৃদয়ে গহীনে বিভিষিকাময় আবহ বিরাজ করে। হৃদয়ের গহীনের ঝড়ে টালমাটাল হয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকায় সিনথিয়া। ইভার চোখে শিক্ত জলে তাকিয়ে হাত পায়ের বল ফুরিয়ে আসে সিনথিয়ার।
রং পর্ব ৫৩
কক্ষের ভেতর থেকে ভেসে আসা কন্ঠস্বরে ফুটে ওঠা দৃশ্যপট অনুভব করে উষ্ণ শরীর তাপ ক্রমেই রূপ নেয় হিমবাহে। ঐ স্বরের শেষ কথায় শৈত্যপ্রবাহ নামে সিনথিয়ার শরীর জুরে।
— বাবা! সেদিন রাতে সম্রাট শাহজাহান পালিয়ে যাওয়ার সময় মাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। যে গাড়িটা খাদে ফেলা হয়েছিলো সেই অপরাধীদের সাথে মা ছিলো। আমি আমার নিজ হাতে মাকে শেষ করে ফেলেছি বাবা। এই কষ্ট আমি কি করে সারাজীবন বয়ে বেড়াবো?
এহেম কথায় শরীর নিস্তেজ হয়ে দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ে সিনথিয়া। ইভা পাথুরে মূর্তির ন্যায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হৃদয়ের রক্তগুলো অশ্রুবিন্দু রুপে টুপ টুপ করে ঝড়ে পড়ে। সিনথিয়ার শরীর ক্রমেই রূপান্তরিত হয় হীমবাহে।
