রং পর্ব ৬৫
তন্নী তনু
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, অন্ধকারে তলিয়ে গেছে সমুদ্রতীরবর্তী রাত, আকাশ ধূসর মেঘে ঢাকা। দূরে কোথাও থেকে সমুদ্রের স্বচ্ছ মুক্তঝড়া একগুচ্ছ ঢেউয়ের আছড়ে পড়া শব্দ হৃদয় অবধি ছুঁয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের দিকে ছুটছে শিশির, সঙ্গে জাবির। ফোন কলে যুক্ত আছেন রুস্থান কবির। হাঁটার গতিতে শ্বাসের ওঠানামা বেগতিক, জাবিরের হাঁপিয়ে ওঠা কন্ঠস্বর,
— স্যার! সমুদ্রতীরবর্তী এই জায়গা’র আশে পাশেই রাফি সহ বাকিদের সঙ্গে কোনো একটা বড়সড় ঝামেলা লেগে গেছে। আমরা অলমোস্ট সেখানে পৌঁছে গেছি। বাকিরা খুব শিঘ্রই পৌঁছে যাবে। ইরফাদ স্যার থাকলে আমরা আরোও স্মুথলি বিষয়’টা হ্যান্ডেল করতে পারতাম।
— ইরফাদ খুব শিঘ্রই সেখানে পৌঁছাবে। ডোন্ট ওয়ারি। ততোক্ষণ পর্যন্ত আপনারা সামলে নিবেন।
–ওকে, ওকে স্যার।
রাত পৌঁছে গেছে মাঝামাঝিতে। লোকশূন্য সমুদ্র সৈকত,তেড়ে এসে ভাসিয়ে নেওয়া ঢেউয়ের শব্দ, আর সৈকতে স্থাপিত দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসা নরম আলো। সমুদ্রে’র শুকনো বালুর উপর দু’টো মানব অবয়ব ভেঙেচুড়ে,এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। পরনের ধুলো মাখা, ছিড়েছুড়ে যাওয়া পোশাক।চলে এসেছে পুলিশ টিম। একসাথে এগিয়ে যায় সবাই। শনাক্ত করা হয় দু’টো লাশ। যাদের মুখে ভয়ংকর মাস্ক লাগানো। হ্যান্ডগ্লাভস পড়ে নেয় শিশির, জাবির। জ্বালানো হয় আলো, অতঃপর কয়েক দফায় তোলা হয় পারিপ্বার্শির অংশের ছবি, দু’টো লাশের ছবি। পেছন থেকে একজন পুলিশ ভিডিও ধারণ করেন। জাবির হাঁটুভেঙে বসে যায় লাশের পাশে। একহাতে খুলেছে প্রথম লাশটি’র মাস্ক। কয়েক দফায় আবারো ক্যাপচার। প্রথম লাশের বুকের উপর ছোট্ট ছিদ্র, হৃদপিন্ড ভেদ করে চলে গেছে বুলেট। চলে গেছে প্রাণ। প্রথম লাশ’টা তাদের চেনা। এইবার দ্বিতীয় লাশের মুখোশে হাত দিতেই অকস্মাৎ চোখ যায় লাশের পাশে একটা বক্সের উপর যা রুমালে ঢাকা। একবার শিশিরের দিকে তাকায় জাবির। শিশিরের চোখের ভাষা,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— সাবধানে…!
জাবির একটানে সরিয়ে দেয় রুমালটা।এরপরে চোখদুটো থেমে যায় অকস্মাৎ–” মাই গড! বো!ম! টাইম অনলি এইটিন সেকেন্ডস! মুভ মুভ!
সহসাই সেখানে অবস্থানরত পুলিশ টিম দৌঁড়ে পিছিয়ে যায়। এক দীর্ঘ লাফে জাবির পার হয়ে যায় অনেকখানি পথ,শিশিরও দৌড়ে বেড়িয়ে যায়। অনেকখানি দূরে দাঁড়িয়ে, পাশের জনের কাছ থেকে একটানে ক্যামেরা নিজের হাতে নেয় শিশির। অতঃপর নরম আলো, স্নিগ্ধ হৃদয় গলানো জায়গাটার বুম’ শব্দে কম্পিত হয়ে ওঠে মাটি, বালু’র উড়াউড়ি, বিষ্ফোরিত আগুনে আলোকিত চারপাশ, কালো ধোয়ার কুন্ডলী, চোখ ছেপে আসে, কানের মধ্যে শব্দের তোরে তালা লেগে যায়। পুরো বিষয়টি ক্যামেরাবন্দি হয়ে যায়। অতঃপর সমুদ্রতীরবর্তী মনমুগ্ধকর রাতের কোলে নেমে আসে ধ্বংসলীলা। আগুন জ্বলতে থাকে।
দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসে স্পিডবোটের শব্দ।আকাশের নিচে প্রসারিত সমুদ্রজলের বিস্তারে লম্বা ঢেউ ছিড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে স্পিডবোট, তার মাঝখানে গথিক ভ্যাম্পায়ারের মতো কালো পোশাক জড়ানো আপাদমস্তক ঢাকা শরীর, শিরদাড়া টান করে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে এক বলিষ্ঠ অবয়ব। বাতাসের ধাক্কায় উড়ছে লম্বা কোর্টের নিচ প্রান্ত। দূরে থেকে ঘুড়ে দাঁড়ায় কালো পোশাকধারী অবয়ব। ভয়ংকর মুখোশে তার মুখটা ঢাকা। স্পিডবোট জলরাশি ফেড়ে হিমশিতল বাতাসের গতিতে এগিয়ে আসছে। জাবির সহ টিম এলার্ট। রিভ!লভা!র তাক করে প্রস্তুত সবাই। স্পিডবোট কাছে এসে খানিকটা মন্থর হয়ে আসে, অতঃপর দূর থেকে আকাশ পানে কয়েকরাউন্ড বুলেট ছোড়ে মুখোশধারী অবয়ব।
নিস্তব্ধতায় তলানো রাতের বুকে গর্জে ওঠে বিষ্ফোরণ, আকাশ হয়ে ওঠে ক্যানভাজ, সেখানে ভেসে ওঠে লাল, নীল আলোতে। Rafi-‘The Silent Killer.’
আকাশ পানে লাল, নীল আলোতে চোখ আটকে যায় সবার। মূহুর্ত্তেই সমুদ্রে’র জলরাশির ফেড়ে ঝড়ের গতিতে স্পিডবোটটি ছুটে চলে। এরপর….! এরপর উধাও হয়ে যায়।
হেডকোয়ার্টারের কেবিনরুমে বসে আছে রুস্তান কবির, ইরফাদ সহ বাকিরা। জাবির এক এক করে সমস্ত প্রুফ দেখায়। এবং নিজের মতামত জানায়।
— স্যার! আমরা নিউজ পেয়েছিলাম সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় রাফি সহ তাদের টিম’কে দেখা গিয়েছে। আমরা যখন পৌঁছাই তখন দুটো মানুষ পড়ে ছিলো। যারা মৃত। মুখ’টা মাস্কে ঢাকা। ভিডিও আছে স্যার। এখানে ক্লিয়ার উনি তপন চৌধুরী, বাকি জনের মাস্ক সরানোর আগেই আমি টাইম বোম দেখি। ঐটা এইটিন সেকেন্ডের মধ্যে ব্লাস্ট। আমার মনে হয় উনি প্রভাত রঞ্জন। একই সাথে কাজ করেছি তার সব-ই আমার পরিচিত।
এরপরের ঘটনা হলো– একটা স্পিডবোর্ডের শব্দ। এরপরের টুকু একটু দেখে নিন!
রুস্তান কবীর প্রতিটা দৃশ্য চোখ বসিয়ে দেখেন, তারপর বলেন,
— কি মনে হচ্ছে?
কি হতে পারে?
–ইন্টারন্যাশনাল গ্যাং এর সাথে যুক্ত বড় বড় ক্রিমিনাল জেল থেকে পালিয়েছে, এর অবশ্যেই কোনো কারণ ছিলো। আই গেস! বাইরের দেশে যারা যুক্ত তারা এদেরকে মেরে দিয়েছে।
— এটা কেনো মনে হলো?
— গেস করে বলেছি স্যার। আমার মনে হচ্ছে এরা অনেক কিছুই জানতো যা এখন পর্যন্ত বলেনি। তাই প্ল্যান করে এদের জেল থেকে বের করে মারা হয়েছে।
— তাহলে রাফি কে কেনো ছাড়লো?
— স্যার! রাফি’কে ওরা কাজে লাগাবে হয়তোবা। তাই প্রয়োজনে বাঁচিয়ে রেখেছে।
— তাহলে আপনি যা বলতে চাচ্ছেন…..!
–ইয়েস স্যার!প্রভাত রঞ্জন ছিলো এই দেশের তরুন সমাজ ধ্বংসের অধিপতি। তার সাথে দেশের বাইরে সরাসরি লিংক ছিলো। আইনের চোখে তারা অপরাধী।জেল থাকলেও তাদের কথা বেড়িয়ে আসার চাঞ্চ ছিলো, দেশের বাইরে থাকলেও তারা আইনের নজরদাড়িতে থাকতো। তাই তাদের শেষ করে রাস্তা ক্লিয়ার করেছে। রাফি’কে কাজে লাগানো যাবে তাই হয়তো রাফিকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
— সব টাই গেস এর উপর ভিত্তি করে। আইন চায় প্রুফ।
— স্যার! দেশ থেকে দু’জন পয়সন শেষ হয়েছে, আপাদত দেশ’টা ঠান্ডা, এটাই অনেক। এটার প্রুফ তো আছে। এইটুকু পাবলিক করা হোক। বাকিটা পরে দেখা যাবে।
সকল তথ্যের ভিত্তিতে আইনি প্রক্রিয়ায় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সকল বিষয় খতিয়ে দেখে অবশেষে–
” ব্রেকিং নিউজ”
দেশের যুবসমাজ ধ্বংসের চাবিকাঠি নাড়ানো, কালোজগতের অধিপতি’র প্রভাতরঞ্জনের লাশ মিলেছে সমুদ্রতীরবর্তীতে।
অতঃপর বিস্তারিত…..
সমুদ্রতীরে পুলিশ টিম উপস্থিত হওয়ার পরে দুটো লোক’কে অস্বাভাবিক,এলোমেলোভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায়। ঘটনা স্থলে- পুলিশ টিম নিশ্চিত হন লোক দুটি মৃত। তবে তাদের মুখে লাগানো ছিলো অদ্ভুত দু’টি মাস্ক। একজনের মুখ হতে মাস্ক সরানো হলে নিশ্চিত করা যায় তিনি জেল থেকে পলাতক অপরাধী তপন চৌধুরী। তিনি জু!য়া প্রমোশন, ও যুবসমাজ ধ্বংস, সাথে হিসাববিহীন মানব পাঁচার ও মার্ডারের সাথে সরাসরি যুক্ত। বাকি একজনের মাস্ক খোলার আগেই ঘটে ভয়ানয় দূর্ঘটনা। সেখানে রাখা টাইম বোম ব্লাস্টে সেই লাশ আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
পুলিশ টিম এর কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে চাঞ্চল্যকর ঘটনা হলো সেই অপরাধী দের মধ্যের একজন পলাতক– রায়হান রাফি নিজের দুঃসাহস আর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে আকাশের বুকে আতশবাজির লাল,নীল আলোতে নিজেকে নিরব ঘাতক হিসেবে দাবী করে পালিয়ে গেছেন। অতি শিঘ্রই তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।
পরিশেষে, এই অনলাইন জু!য়া বন্ধের সাথে সরাসরি যুক্ত এসপি’র এই সম্পর্কে ছোট্ট মেসেজ পড়ে জানাচ্ছি –” রঙ আর (রং)ভুলের মধ্যে যে খেলা খেলে আপনি রঙিন দুনিয়া’য় পৌঁছাতে চান সে কেবল মায়াজাল। এ মায়াজালে জীবন জ ড়িয়ে জীবনের রং হারিয়ে পৌঁছে যাবেন অন্ধকারে। অন্ধকারাচ্ছন্ন কালো জগত থেকে আপনি আর ফিরতে পারবেননা। তাই জীবন আপনার ডিসিশন ও আপনার! রং(ভুল) আর রঙ এর পার্থক্য বুঝুন। ফিরে আসুন নিজের রঙিন জীবনের দিকে।”
ইরফাদের বাসায় জাবির,শিশির একসাথে বসে হাসি, গল্পে বিভোর– গল্পের একপর্যায়ে জাবির বলে,
— স্যার!! বিশ্বাস করেন স্যার।টাইম তো ঠিকঠাক ই দিয়েছিলাম। কিভাবে এতো দেরী হলো। এইটিন সেকেন্ডস দেখে আমার মিনি হার্ট এট্যাক হয়ে যাচ্ছিলো। এইজন্যেই বলি- আপনি সাথে না থাকলে সব এলোমেলো হয়ে যায়। ওদের উপরে পাঠাতে গিয়ে আমাদের চলে যাওয়ার উপক্রম।
— এইজন্যেই বলেছিলাম! সাবধান! সাবধান!
— প্ল্যান তো সাকসেস হয়েছে, এই অনেক। মনের তৃষ্ণা মিটে গেছে। নিজের হাতে প্রতিশোধের মতো শান্তি অন্যকিছুতে নেই।
একবছর পর…..
রং পর্ব ৬৪
সমুদ্রের তীরে ঢেউয়ের তালে তালে ভেসে আসে ভারী কিছু। সমুদ্রতীরবমর্তী কিছু লোক এগিয়ে যায় সেদিকে। উবু হয়ে থাকা জিনিসটাকে মানুষের মতো লাগলে তারা টেনে টেনে শুকনো জায়গায় নিয়ে আসে। এরপর উল্টো ঘুরায়। পরণের কালো পোশাকে শ্যাওলা ধরে গেছে, মুখমন্ডল অদ্ভুত মুখোশে ঢাকা। লোকজনের ভীর। হৈচৈ, চেচামেচি আর অনেক অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা। ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনা। পুলিশ’কে কল দেয়া হয়। এরপর……