রং পর্ব ৮

রং পর্ব ৮
তন্নী তনু

কনফারেন্স রুমে টেবিল ঘিরে বসেছেন পুলিশ সদশ‍্য। প্রভাতরঞ্জন সরকার আহত গলায় বলছেন,
— প্রথমে এতো গুলো ছেলে গুম! এরপর মেয়েদের পরপর লাশ পাওয়া যাচ্ছে! এভাবে চলতে থাকলে তো সাধারণ মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়বে। এর আগের কেসটা ওভাবেই পড়ে আছে! না পাওয়া যাচ্ছে খোঁজ না পাওয়া যাচ্ছে ক্লু। এভাবে তো চললে হবে না। কি মনে হচ্ছে তোমাদের! এসব কোনো সিরিয়াল কিলারের কাজ!
সকলেই নিরব হয়ে বসে আছেন। তারমধ‍্যে থেকে জাবির শান্ত গলায় উত্তর দিলো,
— স‍্যার! পারসোনালি আমার যা মনে হচ্ছে! এইবারের কেসটার উদ্দেশ‍্য খু!ন!
রিজভী শিকদারের পাল্টা প্রশ্ন,

— তাহলে মু/ক্তি/পণ কেনো চেয়েছে?
জাবিরের প্রতিউত্তর,
— উদ্দেশ্য যদি খু!ন ই না হয়.. তাহলে মুক্তিপণ নেওয়ার পরও কেনো! কাউকেই জীবিত ফেরত দেয়া হলো না?
সবাই ভেবে দেখলেন, যুক্তি আছে কথার। প্রভাতরঞ্জন সরকার জাবিরকে বললেন,
— হ‍্যাঁ!
জাবিরের আত্ননির্ভরশীল শান্ত গলা,
— স‍্যার!আমার মনে হচ্ছে প্রেমঘটিত ব‍্যাপার।
–“একজনের পাঁচজন গার্লফ্রেন্ড থাকবে নাকি! একে একে সবাইকে উপরে পাঠাচ্ছে! পাঁচজনের মধ‍্যে একজনও মনের মতো ছিলো না?” রিজভির হাস‍্যকর গলা। জাবির দাঁত শক্ত করে বলে,
— হাসার মতো কি বললাম! হতেই তো পারে সবগুলো খু/ন একজন ই করেছে। মানে কিলার একজন ই! তবে খু/ন করাচ্ছে অন‍্যান‍্য মানুষ।কি/লারের পেমেন্ট হিসেবেও তো মুক্তিপণ নিতে পারে।
–“কি বলতে চাচ্ছেন! যে সকল ছেলেরা মেয়েদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছে। তারা রেগে গিয়ে কোনো সিরিয়াল কিলারকে দিয়ে খুন করাচ্ছে?” রিজভীর চাপা হাসির গলা শুনে দাঁত চেপে জাবির বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–হুম।
— “আপনিও কি এমন প্রতারণার স্বীকার হয়েছিলেন নাকি! কাউকে মে!রে টে!রে দিয়েছেন না!কি! না হলে এমন প্ল‍্যান মাথায় আসে কি করে?” দাঁত কেলিয়ে হাসে রিজভী শিকদার। জাবির রেগে উঠে,
— হতে পারে না? এই জেনারেশনে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায়-প্রকাশ‍্যে মেরে দিয়ে যায়! কু-প্রস্তাবে রাজি না হলে প্রকাশ‍্যে এ!সিড মারে!তাহলে এমন ঘটনায় হাসার কি আছে?
রিজভি শিকদার আবারো ঠোঁট টিপে হাসে। এমন ঘটনায় রেগে যায় জাবির। চোখ গরম করে বলে,
— এভাবে হাসার কি হলো!আর ইউ ম‍্যাড?
— মাইন্ড ইউর ল‍্যাংগুয়েজ! আপনি যে রকম বর্ণনা করছেন তাতে সবাই আপনাকেই….

–“সাইল‍্যান্ট!” প্রভাতরঞ্জন সরকারের গমগমে গলা। কনফারেন্স রুম পানির ন‍্যায় ঠান্ডা। তিনি আবার বললেন,
— “এখানে সবার মতামত নেয়া হচ্ছে। যে যেই এঙ্গেল থেকে কেস’টি দেখছেন। তার মত প্রকাশের পূর্ণ অধিকার আছে। আপনারা প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের মতো আচরণ করবেন না! ভুলে যাবেন না আপনাদের পরিচয়।” তিনি ইরফাদের দিকে দৃষ্টি ফেলেন। ইরফাদ হাতের ফোনটা মন দিয়ে দেখছেন। প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেন,
— ইরফাদ! তুমি কিছু বলছোনা না যে!
হাতের ফোনটা সাইডে রাখলো ইরফাদ। কিছুক্ষণ সময় নিলো। তারপর বললো,
— আমার মনে হচ্ছে!কিলার আমাদের ডায়ভার্ট করার চেষ্টা করছে।
–যেমন!

— আমাদের উদ্দেশ‍‍্য কিলার’কে ধরা। আর কিলারে’র উদ্দেশ‍্য আমাদের চোখ ফাঁকি দেয়া। এই সকল চিত্র,শব্দ, ক্লু কিলার নিজেই রেখে গেছে। যাতে অন‍্য একটি গল্প তৈরী হয়। আর আমরা কেস ঐ দিকে ডায়ভার্ট করি।
— তোমার কি মনে হচ্ছে? খু!ন! নাকি মুক্তিপণের উদ্দ‍্যেশ‍্যে কি!ড!ন‍্যাপিং!
— উদ্দ‍্যেশ‍্য যাই হোক গন্তব‍্য হলো কিলারকে ধরা। আমাদের “কেনো!”র দিকে না গিয়ে “কে” করলো! তার দিকে ফোকাস করা উচিত। কারণ কিলার আটক হলে গল্প এমনিই বেরিয়ে আসবে।
— উদ্দ‍্যেশ‍্য না জানলে গন্তব‍্যে পৌছাবে কি করে?
–উদ্দেশ‍্যে জানার চেয়ে গন্তব‍্যে পৌঁছনোর রাস্তা বেশী সহজ। এই সব ক্লু’র দিকে ফোকাস না করে আমাদের কিলার’কে খুঁজে বের করতে হবে।

ইরফাদ সাইডে থাকা ফোনটি তুলে নেয়। তারপর উল্টো করে ধরে। লাশের গায়ের চিত্র গুলো দেখায়।
–চিত্রগুলো ভালোভাবে দেখুন। চিত্রগুলোই রহস‍্যে। চিত্রগুলো এতো ছোট আর নিখুঁত করে আঁকা যে কেউ এই ধরনের চিত্র আঁকতে পারবে না। অবশ‍্যেই কিলার প্রফেশনাল আর্টিস্ট। জাবির!
–ইয়েস স‍্যার!
–ঐ সকল এলাকার আশেপাশের প্রফেশনাল আর্টিস্ট দের একটা লিস্ট করবেন। আর পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট চেক করে জানাবেন মৃত্যু ঠিক কি কারণে হয়েছে!
— জ্বি স‍্যার

গোধূলি বেলায় ধূসর রঙের প্রাইভেট কার’টি আপন গতিতে রাস্তার গরম ধূলো উড়িয়ে ছুটে চলেছে। কখনো ধীর গতীতে কখনো দ্রুত গতিতে ছুটছে। পাশাপাশি বসেছে ইরফাদ ও সিনথিয়া। ইরফাদ চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে। আর বাইরের লুকিং গ্লাসে চোখ রাখছে। সিনথিয়া নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ ভাবে বসে আছে। ইরফাদ ধীর গলায় বলে,
–” সেদিন যে লোকগুলো তোমার উপর এ‍ট‍্যাক করেছিলো! ঐ লোকেশন মনে আছে?” সিনথিয়া মাথা নাড়ে।তারপর নীরব গলায় বলে,
–আমার ফ্রেন্ডের বাসার আশেপাশেই রাস্তাটা…
–চিনবে?

–আশা করি চিনবো।কিন্তু মেইন রোডের পরে ওই গলি গুলোতে গাড়ি ঢুকবেনা।
–নো প্রবলেম!হেঁটে যাব। যেখানে তোমার উপর অ্যাটাক হয়েছিল!ওই স্পট চিনলেই হবে।
ইরফাদ সিন্থিয়ার দেখানো লোকেশনের দিকে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সিনথিয়া গাড়ির স্বচ্ছ গ্লাস ভেদ করে একদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে।সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যাতে জায়গাটি চিনতে ভুল না হয়। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ইরফাদ গাড়িটি ধীর গতিতে চালায়। ধীরগতিতে রাস্তার মোড় নিতেই সিনথিয়া তড়িঘড়ি করে বলে ওঠে,
— রাখুন!রাখুন!
ইরফাদ সাথে সাথে ব্রেক করে।তারপর বলে,
— “এখানে?” সিনথিয়া মাথা নাড়ে।ঐতো সামনের গলি।ইরফাদ পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
–সিউর?
–“হুম। এই রাস্তার শেষের গলি দিয়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিলাম। ”
ইরফাদ গাড়িটি গলির সামনে দ্বার করায়। পকেট থেকে ফোন বের করে ডায়াল করে,
–জাবির! একটা এড়িয়ার ফুটেজ চেক করতে হবে। রোহানকে ইনফর্ম করুন। আমি লোকেশন পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওই পুরো এলাকার সমস্ত ফুটেজ দ্রুত চেক করে আমাকে জানাবেন।
–ওকে স্যার!

ফোন কেটেই চওড়া রাস্তায় এক পাশে গাড়ি পার্ক করে ইরফাদ।গাড়ি থেকে নেমে গলির দিকে এগিয়ে যায় ইরফাদ। একবার ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে নেয় পুরো জায়গাটা। তারপর পুনরায় গাড়িতে বসে। সিনথিয়া তখন এক মনে এক দৃষ্টিতে সাইড গ্লাসে তাকিয়ে আছে। ইরফাদ সিনথিয়ার দৃষ্টির দিকে লক্ষ্য করে। একটা মিডিয়াম সাইজের দোকান। দোকানে মালপত্র। একপাশে চা’এর জন‍্যে ছোট্ট ব‍্যবস্থা। দোকানের সামনে বেঞ্চ পাতা। কেউ দাঁড়িয়ে কেউ বসে আসে। তাদের চোখ দেয়ালে টানানো বিশাল আকৃতি টিভিতে আটকে আছে। টিভির দেখার ফাঁকে কেউ চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন কেউ বা উচ্চ স্বরে কথা বলছেন।তাদের কথোপকথনের মূল বিষয় টিভিতে দেখানো খেলা।সিনথিয়া লোকজনের ফাঁকফোকর দিয়ে দেয়ালে টানানো টিভিতে চোখ ডুবিয়ে দিয়ে আছে। চোখ সরালেই যেন বিশেষ কিছু মিস হয়ে যাবে। সিনথিয়া বার বার গাড়ির সাইড গ্লাস হাত দিয়ে নিচের দিকে টানছে। গ্লাসটি যেনো বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার চোখের। ইরফাদ সাইড ক্লাস নামিয়ে দেয়।সিনথিয়ার অন‍্যদিকে কোনো মনোযোগ নেই তার দৃষ্টি সেই বিশাল আকৃতি টিভির দিকেই নিবন্ধ। মহা আগ্রহ নিয়ে সে ক্রিকেট খেলা দেখছে। সিনথিয়ার সমস্ত মনোযোগ টিভির স্ক্রিনে। শক্ত হাতে ব্যাট ধরে আছে ক্রিকেট ক্যাপ্টেন তীর্থ (ছদ্মনাম)।বোলার বল নিয়ে এগিয়ে আসছে। সিনথিয়া যেন সমগ্র কিছু ভুলে বসেছে। ফুল টাচ বল’এ তীর্থ ব্যাট দিয়ে সজোরে আঘাত করে। তাতেই বল বাউন্ডারি পার। সিনথিয়া চরম উচ্ছ্বাসে গাড়ির সিট থেকে একবার লাফিয়ে ওঠে। সমগ্র ভালোলাগা,উচ্ছ্বাস,আনন্দ যেন তারা হাতের মুষ্টিতে ধরা দেয়। সবকিছু ভুলে আনন্দটুকু প্রকাশ করতে মুষ্টিমেয় হাতটি উপরে উঠিয়ে ঝাঁকিয়ে বলে

—ইয়েস! ইয়েস!
কয়েকটা দিনের পরিচয়ে মেয়েটিকে এতো উচ্ছাসিত হতে দেখা যায়নি একবারের জন‍্যেও। সব সময় গম্ভীর, নিস্তব্ধতা-ই বিরাজ করে তার মাঝে। যাক বাইরে নিয়ে আসাটা এই দিক দিয়ে স্বার্থক। সিনথিয়া পাশ ফিরতেই চোখে চোখ পড়ে ইরফাদের।সে তো দিন দুনিয়া ভুলে গেছিল কিছুক্ষণের জন্য। ইরফাদের চাহনি দেখে সিন্থিয়ার নিজেকে পাগলা গারদের পাগল মনে হয় । “আচ্ছা! কোন আক্কেলে সে এরকম লাফালাফি করলো?” নিজের কাজে লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নেয় সিনথিয়া।ইরফাদ স্টিয়ারিং ঘুরায়। একদিকে লজ্জা অন্যদিকে খেলা দেখতে না পাওয়ার জন্য মনটা খারাপ হয় সিনথিয়ার। বদ্ধ কুঠির থেকে বের হয়ে এই আলো-বাতাস আর স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পেরে সে তো ভুলেই বসে ছিল তার ঠিকানা কোথায়! মুখটা মেঘের মতো কালো হয়ে আসে তার। পাঁচ আঙ্গুলে ভর দিয়ে কপাল ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে থাকে সিনথিয়া। এদিকে নিজের পার্সোনাল ফোনটা সিনথিয়ার দিকে এক হাতে এগিয়ে দেয় ইরফাদ। শান্ত গলায় বলে,

–ধরো!
সিন্থিয়া চোখ তুলে তাকায়। ইরফাদের হাতে থাকা ফোনটির স্ক্রিন জুড়ে ক্রিকেট খেলা চলছে। আর ফোনটি তার দিকেই বাড়িয়ে দিচ্ছে ইরফাদ। অবাকের উচ্চসীমায় পৌঁছে চোখ দুটো পেঁচার মতো গোল গোল আকৃতি হয় তার। আপনা-আপনি খুলে যায় ওষ্ঠ যুগল। একজন “এসপি” তার দিকে নিজের পারসোনাল ফোন এগিয়ে দিচ্ছে?

ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে ইরফাদের বাবা সাথে তার বন্ধুর ছেলে সাজিদ । কথার ফাঁকে তার বাবা উঠে গিয়ে ইভার ঘরে যায়,
— ইভা!
— হ‍্যাঁ বাবা,বলো!
— কফি করে দিতে পারবে?সাজিদ এসেছে তো।
নামটা শুনেই ইভা’র মুখটা কালো হয়ে যায়। এই লোকটা’কে তার অসহ‍্য লাগে। তবুও ইভা বাবার সামনে মিষ্টি মুখে মাথা নাড়ায়,
— হ‍্যাঁ বাবা! আমি আসছি…
বাবার সামনে সাজিদের সাথে খারাপ ব‍্যবহার করার সাধ‍্য নেই তার। অন‍্যদিকে অতিথি’কে খাবার দিতে কার্পণ্য করতে পারে না সে।শুধু কফি দিতে বললেই কি শুধু কফি দেয়া যায়!

কিচেনে ঢুকেই বেশী করে চিজ দিয়ে পাস্তা রেডি ফয়েল পেপারে ঢেকে একহাতে ওভেনে বেকড করতে দেয় ইভা। আরেক দিকে ফ্রোজেন করা মোমোগুলো রেডি করে পিরিচে গোল করে সাজিয়ে নেয়। মাঝখানের ছোট্ট ফাঁকা জায়গায় বসিয়ে দেয় স্পেশাল সসে্র গোল ছোট্ট পেয়ালা। ওভেন থেকে পাস্তা বের ট্রে তে তুলে নেয় সাথে দু’টো স্পুন। দু’টো মগে কফি ঢেলে নিয়ে সোজা চলে যায় ড্রয়িং রুমে।গিয়ে দেখে তার বাবা ড্রয়িংরুমে নেই।টুম্পা বসে আছে সাজিদে’র কোলে। চোখাচোখি হয় দু’জনের। ইভা চোখের ইশারায় টুম্পাকে বলে,-“নামো।” টুম্পা দেখেও যেনো দেখেনা। সাজিদ’কে টুম্পা খুব বেশীই পছন্দ করে। এটাই তার সবচেয়ে অপছন্দ। কিন্তু মেয়ে তো এই বিষয়ে পুরোই একরোখা। সাজিদ আসলেই তার কোলে চড়ে বসে। ইভা না পারে মেয়েকে দমিয়ে রাখতে। আর না পারে সাজিদের আসা বন্ধ করতে। ওপাশ থেকে সাজিদের শান্ত ক্ষীণ গলা ভেসে আসে,

— কেমন আছো?
ইভার কথা বলার প্রবল অনিচ্ছা থাকা সত্বেও সে মাথা নাড়ে।
সাজিদ আবার বলে,
–আমাকে জিঙ্গেস করলেনা?
ইভা মুখে তালা মেরে থাকে। যাই বলুক! “সে আর কথা বলবে না।” সাজিদ বাঁকা হেসে বলে,
— উত্তর’টা পেলাম না কিন্তু?
–কিসের উত্তর?
— ঐ যে তিন বছর আগে থেকে যা জানতে চাচ্ছি!
ইভা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— এক কথা কত বার বলবো?আপনি কবে বুঝবেন বলেন তো সাজিদ ভাই? আর কতবার আপনাকে বারণ করার পরও আপনি আসবেন। এসব বলবেন!

— যতোদিন না তুমি সম্মতি দিবে!
— এতো নির্লজ্জ মানুষ হয়?
— ভালোবাসলে মানুষ উম্মাদ হয়ে যায় ইভা!
— একটা বিবাহিত মেয়ে’কে কিভাবে ভালোবাসা যায়?
— তুমি কি বিবাহিত?
— আমি কি অবিবাহিত?
— আমার কাছে তুমি শুধুই “ইভা”। বিবাহিত, অবিবাহিত, ডিভোর্সী এগুলো ডাজেন্ট ম‍্যাটার।
–মুখে অনেক কিছুই বলা যায়।
— মুখের কথা বাস্তবে রূপ দিতে হলে তোমার সম্মতি দরকার। একবার হাত’টা ধরেই দেখোনা।
— চুপ করুন! সাজিদ ভাই! আমার মেয়েটা বড় হচ্ছে ও বুঝতে পাররে। ওর সামনে এসব বলবেন না প্লিজ!
সাজিদ টুম্পা’কে বুকের মধ‍্যে চেপে ধরে। ক্ষীণ শ্বাস ভিতরে টেনে নেয়। তারপর বলে,
— সম্মতি দিলে- মেয়েটা খুশিই হবে ইভা! তুমি একবার সুযোগ তো দাও..
ইভা টুম্পাকে জোর করে টেনেটুনে কোলে নেয়। তারপর বিরক্ত গলায় বলে,
— পাগল নাকি!

ছাই রঙা মেঘ ক্রমেই রূপান্তরিত হচ্ছে ঘন কালো মেঘে। পরিষ্কার আকাশ তলিয়ে যাচ্ছে ঘন কালো মেঘের আড়ালে । কিছুক্ষণ আগেও আকাশের বুকে এক ফালি চাঁদ মাথা চারা দিয়ে উঠেছিলো তাও এখন মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেছে। বৃষ্টির ফোঁটা গুলো বিন্দু আকার থেকে ভারী বর্ষণে রূপ নিয়েছে। রাস্তার মানুষগুলো দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। রাস্তা জুড়ে এখন শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। বাঘের গর্জনের মতো বজ্র ধ্বনি আর বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে ধরণী।

এর মধ‍্যে দিয়ে চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে ইরফাদ। সিনথিয়াও বসে আছে আগের মতো চুপচাপ ভাবেই। গাড়ি কোন দিকে চলছে তা তার জানা নেই! ইরফাদ ঠিক কি কারণে তাকে বাইরে নিয়ে এসেছে- তার জানা নেই! এখন তারা কোথায় যাচ্ছে তাও সে জানে না। জিঙ্গাসা করার প্রয়োজনও মনে হচ্ছে না। তার শুধু অনুভব হচ্ছে- স্বস্তিই পাচ্ছে, মন ভরে শ্বাস নিতে পারছে। এই কয়দিনে দমবন্ধকর পরিবেশে থাকতে থাকতে সে যে পাগলপ্রায় হয়ে গেছে। তাই আজ গন্তব্য জানার প্রয়োজন নেই তার। সময় জানার ইচ্ছে নেই। কখন ফিরবে তাও জানার ইচ্ছে নেই। কিছুই জানতে চায়না সে। আবহাওয়ার পরিবর্তন ও গাড়িতে চলা এসির জন‍্য হঠাৎই একরাশ ঠান্ডা ঝেঁকে ধরে সিনথিয়াকে। শীত লাগা শুরু হয় সিনথিয়ার। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে সে। ইরফাদের পুর্ণ দৃষ্টি সামনের দিকে। ফাঁকা রাস্তা! বৃষ্টির ভারী ফোটা গুলো গাড়ির কাচের উপর খেলা করছে। একফোটা পানি টুপ করে পড়ে আবার উপরে ছিটকে উঠছে। এভাবেই বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা গাড়ির কাচে পড়ে আবছা হয়ে আসছে গ্লাস। গাড়ির ওয়াইপার ভারী বর্ষণের ছাপ মুছতে বৃত্তাকার গতিতে উঠানামা করছে। সিনথিয়ার আরও জড়োসড়ো হয়ে বসে। গাড়ির ভেতর কোনো আলো জ্বালানো নেই। আকাশ ফেঁড়ে বের হওয়া আলোর ঝলকানিতে কিছুক্ষণের জন‍্যে আলোকিত হয় গাড়ি ভেতরে। সিনথিয়া অনেকটাই কাচুমাচু হয়ে বসে আছে- আড় চোখে দেখে ইরফাদ। তারপর শীতল গলায় বলে,

— আর ইউ ওকে!
সিনথিয়া তৎক্ষণাৎ ইরফাদের দিকে তাকায়। ক্ষীণ স্বরে বলে,
–হুম…
–আনইজি লাগছে?
সিনথিয়া মাথাটা মৃদু ঝাঁকিয়ে বলে “না।”
— ভয় পাচ্ছো?
শব্দটি শুনে প্রথমবারের মতো সিনথিয়ার মাথায় আসে! এই এই শুনশান নিরব রাস্তা! কয়টা বাজে তাও জানা নেই!তার উপর ঝুম বৃষ্টি! রাস্তা ঘাট প্রায় ফাঁকা! কি কারণে! আর কোথায় যাচ্ছে তাও জানা নেই। গাড়িতেও আলো নেই। এই আবছা আলোয় পাশে বসে আছে স্বল্প দিনের পরিচিত একজন বলিষ্ঠ পুরুষ! ভাগ‍্যের নির্মম পরিহাসে অন‍্য পুরুষের প্রতারণার জালে বিশ্বাস,ভরসা, ভালোবাসা,মানসম্মান সব হারিয়ে বসে আছে সে। এক নম্র ভদ্র মুখোশধারী পুরুষের মায়াজালে ফেঁসে যাওয়া মানবীর এই আধারে অন‍্য পুরুষের পাশে বসে ভয় পাওয়াটাই তো স্বাভাবিক! কিন্তু তার ভয় তো দূর!ভয়ের কথাটাও একবার মনে হলো না। তার কি ভয় পাওয়া উচিত ছিল না!” এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার পরও কেন এই কথাটি তার মাথায় আসলো না?”

— “কি! ভয় লাগছে!” সিনথিয়া মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে বলে,–না..
আবছা আলোয় আবারো ভেসে আসে হীমশীতল পুরুষালী গলা,
— লাইট অন করবো?
সিনথিয়া এইবার দোটানায় পড়ে। তার এই মূহুর্তে কি বলা উচিত? হ‍্যাঁ বললে ইরফাদ কি ভাববে? আর না বললেই বা কি ভাববে। কিছুক্ষণ মনের সাথে বোঝে সিনথিয়া। তার আলো না থাকাতেই ভালো লাগছে। সবকিছু ভালোভাবে অনুভব করতে পারছে। আলো জ্বালালেই বরং তার সংকোচ হতো। সে প্রথমবার নিজের ভালোলাগার দিকটাকে গুরত্ব দিলো। তারপর মাথা ঝাকিয়ে মুখে বললো,

— এরকম ই ভালো লাগছে!
বলেই আবার নিস্তব্ধতায় ডুবে যায় সিনথিয়া।ইরফাদ এসি অফ করে। তার আবার হিম শীতল গলা,
— তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি! কি কারণে নিয়ে যাচ্ছি একবারও ত জিজ্ঞেস করলে না!
সিনথিয়া উত্তর দিতে পারে না। এর কোনো উত্তর তার কাছে নেই। সে শুধু জানে তার সস্তি লাগছে! বুক ভোরে নিশ্বাস নিতে পারছে! এর বাইরে তার কিছু জানার নেই আজ। আজ তার কোনো ভয় কাজ করছে না! সংকোচ ও হচ্ছে না! কিন্তু কেনো? সে উত্তর তার কাছে নেই। রাফির সাথে কখনো রাতে কোথাও যাওয়া হয়নি। খুব বেশী সময় কাটানোও হয়নি। প্রেমিক হওয়া সত্বেও বুকের মধ‍্যে একটা ভয় কাজ করতো। যদি কোনো অঘটন ঘটে! কিন্তু সেই ভয়টাও অল্প দিনের পরিচিত পুরুষের পাশে বসে হচ্ছে না। কেনো! সে উত্তর তার কাছে নেই। সে ধীর গলায় উত্তর দেয়,

— প্রয়োজন ছাড়া! একজন “এসপি” জেলখানার আসামী কে নিয়ে কোথাও যায়?
–বাহ!ভালোই তো লজিক দিলে। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি কথা বলতে জানো না! পিচ্চি মেয়ে…
সিনথিয়া আবছা আলোতে নিজের দিকে তাকায়। কোন এঙ্গেলে তাকে পিচ্চি মনে হয়?বাইশ চলে তার বয়স। পাঁচ ফিট তিন ইঞ্চি মেয়েকে কি-করে পিচ্চি লাগে!

অনেকটা পথ যাওয়ার পর গাড়ি থামায় ইরফাদ। পকেট থেকে ফোন বের করে। তারপর একটি নম্বরে ডায়েল করে ধীর গলায় বলে,
— চেক ইনবক্স!
তারপর আবার গাড়ি স্টার্ট দেয় ইরফাদ। ত্রিশ মিনিট পর গাড়ি রাস্তার সাইডে পার্ক করে। আগের নম্বরে কল দিয়ে বলে,
— রেডি!
– জ্বি স‍্যার!দুই মিনিটের মধ্যে আসছি..

দু মিনিটের মাথায় একজন ওয়েটার আসেন।ইরফাদের গাড়িটি একদম রেস্টুরেন্টের কাছাকাছি দাঁড় করানো। গাড়ির সাইড ডোর’টি খুলে দেয় ইরফাদ। একজন ওয়েটার ইরফাদের সাথে কুশল বিনিময় করেন। পূর্ব পরিচিত তা বোঝাই যাচ্ছে। ওয়েটারের হাতে একটি ট্রে। হাতে থাকা ট্রে ইরফাদের দিকে এগিয়ে দেয়। ইরফাদ ট্রে কোলের উপরে তুলে নেয়। তারপর একহাতে গাড়ির দরজা টেনে বন্ধ করে দেয়।ওয়েটার বলেন, –স্যার! ম্যাডামকে নিয়ে ভিতরে বসতেন!
— নো!থ্যাংকস!
ওয়েটার চলে যায়। ট্রেতে থাকা স্যুপ এর পেয়ালার চারপাশে রুমালে পেচিয়ে নেয় ইরফাদ। তারপর সিনথিয়ার দুহাতের মাঝখানে দেয়।
–ধরো,,,সাবধানে!
সিনথিয়া দশ আঙ্গুলের আলিঙ্গনে ধরে উষ্ণ রুমালে পেঁচানো পেয়ালা। গরম হয়ে ওঠা শুভ্র রুমালের উষ্ণ স্পর্শে সিনথিয়ার হীমশীতল হাত দু’টো যেনো প্রাণ ফিরে পায়। গরম ধোঁয়া ওঠা থাই স্যুপের লোভনীয় দৃশ‍্য-সাথে মাশরুম স্পাইসি চিকেন আর অনথন। তবে খাওয়ার চেয়ে এই ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূতির মধ্যে সুপের উষ্ণ পেয়ালা ধরে সিনথিয়ার বেশ আরাম লাগছে। এই ভেজা ভেজা আবহাওয়া একটু উষ্ণ আচের যে ভীষণ প্রয়োজন ছিল তার-ইরফাদ বুঝলো কি করে! সে কি সব বুঝতে পারে!

এই বৃষ্টি ভেজা দিনে কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে আছে রিমা।ফিসফিশিয়ে প্রিয় মানুষের সাথে কথা চালিয়ে যাচ্ছে।
–শুভ্র! কাল একটি রিকোয়েস্ট রাখবে আমার!
–বলো..
— অনেকদিন হলো তোমার সাথে মিট করি না! কাল একবার আসবে?
–ভেবে দেখবো!
–তোমার কি আমার জন্য মায়া লাগে না?
–কি মনে হয় তোমার?
–তুমি অনেক নিষ্ঠুর!পাষাণ! না হলে কি আর, দেখা না করে থাকতে পারো?
— তাই!
–হুম
— দেখা করলে মায়া বাড়ে! তখন দূরে থাকতে কষ্ট হয়।
— দূরে থাকতে বলে কে?
— আর একটা মাস! তারপরেই অপেক্ষার দিন শেষ। আর একটু ধৈর্য্য ধরো।

ঝুম বৃষ্টি, ঘন অন্ধকার রাস্তা। রাস্তার দু’ধারে লম্বা লম্বা গাছ। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় দেখা যাচ্ছে, দমকা হাওয়ায় গাছের ডগা এপাশ-ওপাশে হেলে পড়ছে। আর মধ্য দিয়ে গাড়িটি যেন আপন গতিতে ছুটে চলেছে। তারা কোথায় যাচ্ছে কেন যাচ্ছে সিনথিয়া জানে না।সে শুধু নিষ্কপলক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। রাস্তাটি মনে হচ্ছে কোন গ্রামের।শহর থেকে গ্রামের রাস্তায় চলে এসেছে গাড়ি অথচ সিনথিয়ার কোন হেলদোল নেই।সে যেন নিশ্চিন্ত! শতভাগ নিরাপদ!কোথায় থেকে আসছে এত বিশ্বাস এত ভরসা!তা তার জানা নেই। তার শুধু মনে হচ্ছে গাড়ি না থামুক। গাড়ি চলুক অনন্তকাল। সাথে সাথেই ইরফাদ গাড়ি থামায়। সিনথিয়া ইচ্ছেতে ভাটা পড়ে।ইরফাদ একটা ছাতা হাতে গাড়ির দরজা ঠেলে বাইরে বের হয়। সিনথিয়া সে-দিকেই তাকায়। ইরফাদ সিনথিয়াকে বলে,

— খুব ইমপর্ট‍্যান্ট কাজ- পাঁচ মিনিট বসো হ‍্যাঁ!
সিনথিয়া মাথা নাড়ায়।ছাতা হাতে দূরে দাঁড়ায় ইরফাদ। তারপর প্রভাতরঞ্জন সরকারের নাম্বারে ডায়েল করে,
–আসসালামু আলাইকুম।
–ওয়ালাইকুম আসসালাম। ইরফাদ! সব ঠিক আছে?
— জ্বি স‍্যার!
— কিন্তু তোমার প্ল্যান “A” তে কোনো কিছু পাওয়া যায়নি। প্ল‍্যান “বি” ট্রাই করো।
–জ্বি স‍্যার!
— আর কোনো তথ‍্য পেয়েছো?
— স‍্যার! যা গেস করেছিলাম তাই হয়েছে।থানার বাইরে থেকেই একটা গাড়ি পিছু নিয়েছিলো! পুরো জার্নিতে গাড়িটি আশে পাশেই ছিলো!সিনথিয়ার সাইড গ্লাস ওপেন থাকায় তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সিনথিয়ার উপর ছিলো। বিষয়টি পুরোপুরি নজরে আসায় আমি গাড়ি স্লো মশানে রাখি।এতে পেছনের গাড়ি সামনে চলে যায়,তারপর আমি তাদের পিছু নেই। খানিকক্ষণ যাওয়ার পর বৃষ্টি শুরু হয়। তারা গাড়ি ফেলে পালিয়ে যায়। গাড়ির নম্বর রেখেছি। তবে প্রশ্ন হলো!আজ যে সিনথিয়া লকাপের বাইরে তা-তারা জানলো কি করে? এমন তো নয় যে, সারাদিন মেয়েটির খোঁজেই তারা বসে থাকে! তার মানে দাড়াচ্ছে! লকাপের দায়িত্বরত কেউ সিনথিয়ার সব নিউজ বাইরে পাঠায়।আমাদের তাকে খুঁজে বের করতে হবে।

— ওকে! এদিকটা আমি দেখছি! তুমি প্ল‍্যান “বি” ট্রাই করো। অল দ‍্যা বেষ্ট!
–ওকে স‍্যার!
ইরফাদ পুনরায় গাড়িতে বসে। একটানে পার হয়ে যায় অনেকটা পথ। তারপর আবার গাড়ি দাঁড় করায়। বৃষ্টি থামার কোনো নাম নেই। যেনো এই বৃষ্টির পথ শেষ হবার নয়। ইরফাদ একটা ব‍্যাগ থেকে ছোট ফ্লাস্ক বের করে। পাশাপাশি সিনথিয়াকে বলে,
— কফি খাবে!
সিনথিয়া পাশ ফিরে তাকায়। তার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ইরফাদ গাড়ি থেকে নামে। ইরফাদ সিনথিয়ার পাশের দরজা খুলে দেয়। মাথার ইশারায় বাইরে বেরিয়ে আসতে বলে ইরফাদ।
— কাম!

সিনথিয়া কিছুক্ষণ প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এই ঝুম বৃষ্টিতে বাইরে কেন যেতে হবে? তারপর বেশি কিছু কিছু না ভেবেই বাইরে বের হয়। আরেকটি ছাতা সিনথিয়ার দিকে বাড়িয়ে দেয় ইরফাদ। সিনথিয়া ছাতা হাতে সাবধানে পা ফেলে ইরফাদের দেখানো পথ অনুসরণ করে। পিচঢালা ভেজা রাস্তার কোণা ঘেসে দাঁড়ায় সে। রাস্তার ধার ঘেঁষে অসংখ‍্য সারি সারি গাছ। বাতাসে দুলছে ডালপালা। রাস্তার পাশেই খাল। বৃষ্টির ফোটা গুলো খালের পানিতে লাফালাফি করছে। আকাশ থেকে ক্ষণে ক্ষণে আসা আলোতে এইটুকুই দেখতে পেয়েছে সিনথিয়া। ইরফাদের চোখের ইশারায় আরেকটু কোণা ঘেঁষে দাড়ায় সিনথিয়া। ইরফাদ শান্ত গলায় বলে,

— ছাতাটা ক্লোজ করে আমাকে দাও।
সিনথিয়া ইরফাদের কথা মতো কাজ করে। ইরফাদ ছাতাটা রাস্তার উপর রাখে। তারপর আবার শীতল গলায় বলে,
— জুতো খুলে সাইডে রাখো। আর কফি মাগ’টা নাও।
সিনথিয়া জুতা খুলে সাইডে রাখে। কফির শূন‍্য মগটা হাতে নেয়। মাথার উপর ছাতা ধরে আছে ইরফাদ।বৃষ্টির ছাট তীর্যক ভাবে পড়ায় ভিজছে দু-পায়ের পাতা। বরফ সিক্ত পানির স্পর্শে কেঁপে ওঠে সিনথিয়া। ইরফাদ ফ্ল‍াস্ক থেকে গরম কফি ঢালে সিনথিয়ার হাতে থাকা কফি মগে। ধীর গলায় বলে ওঠে,
–চোখ বন্ধ কর!
সিনথিয়া কোনো কিছু না ভেবেই চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয়। কারণ জানা নেই। সে শুধু জানে – ভালো লাগছে ভিষণ! পেছন থেকে ইরফাদের বরফ শীতল গলা,

–মনে কর! নিস্তব্ধ নির্জন ঝুম বৃষ্টির রাতে তুমি একা এখানে দাঁড়িয়ে আছো।
সিনথিয়া অনুভব করে! মাথার উপর কান্নারত খোলা আকাশ, নির্জন-নিস্তব্ধ রাস্তায় কোণ,ছাতার ওপরে অনবরত পড়তে থাকা ঝুম বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ। পায়ের উপরে পড়তে থাকা বৃষ্টির শীতল স্পর্শ। হাতের মধ‍্যে ক্রমেই বেড়ে যাওয়া উষ্ণ অনুভূতি। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া স্নিগ্ধ বাতাস। সিনথিয়ার শ্বাস ঘন হয়ে আসে। এতো সুন্দর অনুভূতির সাথে এই প্রথম সাক্ষাৎ তার। পেছন থেকে ভেসে আসা ইরফাদের গলা আবারো হিম শীতল,,
— লম্বা শ্বাস নাও তো।

ইরফাদের কথা মত সিনথিয়া লম্বা করে শ্বাস টেনে নেয়। সিনথিয়ার ভিতরের আনাচে কানাচে একটা শীতল অনুভূতিতে ভরে ওঠে। শরীর হয়ে ওঠে হিম শীতল। পা থেকে মাথা অবধি শিরশিরিয়ে ওঠে। এতো সুন্দর স্নিগ্ধ পরিবেশে এমন অনুভূতি তার জীবণে এই প্রথম। অজানা কারণে শরীর হীম হয়ে আসে।সিনথিয়া ওধরের স্পর্শে শুষে নেয় ধোঁয়া ওঠা উষ্ণ তেতো স্বাদের কফি। ভেতর থেকে একটা চাঙা অনুভূতি ধরা দেয়। এতো ভালো কোনোদিন তার লাগে নি।তারপর মনোমুগ্ধকর শান্ত নিরব পরিবেশে চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির শব্দ শোনে!
ফ্ল‍্যাশব‍্যাক

সেদিন রাতে হঠাৎ ইরফাদের ফোনে ফোন আসে। ফোন করেন গারদের দায়িত্বরত বিশ্বস্ত একজন মহিলা পুলিশ,
–স‍্যার!
— বলুন..
— মিস সিনথিয়ার হাতে একটি চিঠি দেখা গেছে। তিনি খুব চুপিচুপি সেই চিঠি পড়তে চেয়ে আমার চোখাচোখি হয়েছেন। আমার চোখের আড়ালে এই চিঠি মিস সিনথিয়ার হাতে পৌঁছে দিয়েছে কেউ। কে বা কারা সাহায‍্য করছে জানিনা। তবে চিঠিটা পড়ার পর মেয়েটি দীর্ঘসময় চুপচাপ বসে ছিলো। আমার মনে হলো বিষয়টি আপনা’কে জানানো উচিৎ।

— চিঠি’টা কোনো ভাবে নিতে পারবেন? তবে মেয়েটিকে জানতে দেয়া যাবে না!
— জানিয়ে নেয়াটা সহজ। তবে না জানিয়ে নেওয়াটা তো টাফ স‍্যার!
–“ওকে! আপনার কিছু করতে হবে না। যা করার আমি-ই করবো। আপনি শুধু হেল্প করবেন।”
সেদিন চুপিচুপি কারাগারে ঢুকেছিলো ইরফাদ। দায়িত্বরত পুলিশের সহযোগিতা নিয়েও চিঠি হাতে পায়নি সে।আজ সিনথিয়া’কে কারাগারের বাইরে নিয়ে আসার প্রথম উদ্দেশ্য -ঐ চিঠি। প্ল‍্যান “এ”-
সিনথিয়াকে বাইরে বের করে আবনেন ইরফাদ। দায়িত্বরত মহীলা সিনথিয়ার সব তন্নতন্ন করে খুঁজবেন। চিঠি পাওয়া গেলে তার একটা কপি করে নিবেন। আসল’টা আগের জায়গায় রাখবেন। তবে প্ল‍্যান “এ” কাজ করেনি। চিঠিটা সেখানে রেখে আসেনি সিনথিয়া। প্ল‍্যান “বি”– “প্ল‍্যান-“এ” কাজ না করা মানে হলো চিঠি”টা মেয়েটির কাছেই আছে।এক্ষেত্রে ইরফাদ চায় চিঠি’টা এমন কৌশলে দেখবে যাতে মেয়েটি না জানে। কারণ যদি জানানোর মতো কিছু হতো তাহলে সিনথিয়া নিজে থেকেই জানাতো। তার জন‍্যেই এসব প্ল‍্যান- এতে যে কোনো সত‍্য সহজে বেরিয়ে আসবে। প্ল‍্যান- “বি” এর কাজ শুরু হয়েছে। কফি”তে মেশানো ট‍্যাবলেটের কাজ শুরু হয়েছে।

বর্তমান…
সিনথিয়ার মাথা ঘুড়ছে। সে তড়িঘড়ি করে এসে গাড়িতে বসে। ইরফাদ বসে পাশে। দু’মিনিটের মাথায় সিনথিয়া জ্ঞান হারায়। ইরফাদ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে। সত‍্যিই জ্ঞান নেই। ইরফাদ একজন নার্সের নম্বরে ফোন দেয়,
— রেডি!
–হুম..
–আমি পাঁচ মিনিটের মধ‍্যে আসছি!
ইরফাদ এক সরকারি কোয়ার্টারের সামনে গাড়ি থামায়। ছাতা হাতে এগিয়ে আসছে সুভা। সুভা ইরফাদ এর সহপাঠী ছিলো একসময়।সে একজন সিনিয়র নার্স। ইরফাদের খুব বিশ্বস্ত ফ্রেন্ড। ইরফাদ ছাতা হাতে বাইরে দাঁড়ায়। সুভা দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে ইরফাদের সামনে দাঁড়ায়। ইরফাদ’কে দেখে বলে,
— কেমন আছো?
ইরফাদ চোখ নামিয়ে উত্তর দেয়,
–ভালো। তুমি..?
–এইতো….

— মেয়েটি গাড়িতে আছে। তোমার কথা মতো একটা ট‍্যাবলেট দিয়েছি! কিছুক্ষণের মধ‍্যে জ্ঞান ফিরতে পারে। যাও…
— কাজের বাইরে কথাই বলতে চাচ্ছো না! কাজ ছাড়া কি তুমি কিছুই বোঝ না! আগের মতোই রয়ে গেছো তুমি!
ইরফাদ কোনো উত্তর দেয় না। চুপচাপ ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। উত্তর না পেয়ে সুভা গাড়ির দিকে যায়। গাড়ির দরজা খোলে। মেয়েটির সিট পেছনের দিকে হেলানো। বিছানা না হলেও আরামেই যেনো শুয়ে আছে। সুভা গাড়ি’তে ওঠে। গাড়িতে থাকা মৃদ‍ু আলো পড়েছে সিনথিয়ার উপর। গায়ের রঙ আহামরি ফর্সা না,উজ্জল শ‍্যামলা। কালো মেঘের মতো দু’টো টানা টানা ভ্রু।

রং পর্ব ৭

চোখের ঘন পাপড়ি গুলো উপরের দিকে কোকরানো।বন্ধ করা দু’চোখেও যেনো উপচে পড়া মায়া। সৃষ্টিকর্তাপ্রদত্ত ভাবে সুনিপুন ভাবে আঁকা ওষ্ঠযুগলের চারপাশ। সদ‍্য বের হওয়া কচি পাতার মতো পাতলা ওষ্টযুগল। কপালে আর কপোলের পাশে কান ঘেঁষে কচি ঘাসের মতো গজানো পাতলা পাতলা লোম গুলো যেনো এক বিশেষ চিত্রকর্ম,বেশী নজরকারা। শ‍্যামলা রঙের মানুষ এতো সুন্দর হয়।সুভা নিজেই চোখ সরাতে পারছে না। তবে হাতে সময় কম। সে কাজে মন দেয়। আগাগোড়া চেক করে সুভা। শুধু একটা জায়গা বাদ। সুভা সিনথিয়ার ওড়না সরায়। গলার কাছে থাকা জিপার নিচে টেনে নেয়। অন্তরবাসে হাত ঢুকিয়ে পেয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি।
তারপর সোজা বাইরে চলে আসে। তারপর ইরফাদে’র হাতে তুলে দেয়।ইরফাদ চিঠির ভাজ খোলে। সূচনায় চোখ না থেমে চোখ আটকে যায় চিঠির নিচে। সেখানে লেখা,
~~রাফি
তারপর………

রং পর্ব ৯