রাগে অনুরাগে পর্ব ১২

রাগে অনুরাগে পর্ব ১২
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি

মালিহা শুনেছে তার শাশুড়ি মা টেংরা মাছ দিয়ে ঝাল ঝাল আলু বেগুনের চচ্চড়ি খেতে খুব পছন্দ করেন। তাই আগ্রহ নিয়ে রান্নার দায়িত্বটা সেই নিয়েছে। মালিহার একটি স্বভাব হচ্ছে, সে যখন কাজ করবে তখন কিচেনে অন‍্যের উপস্থিতি পছন্দ করে না। এতে নাকি তার মনোযোগ নষ্ট হয়। রান্নার স্বাদের গুণাগুন ক্ষুণ্ন হয়।
জাওয়াদ গিয়েছে সপ্তাহ খানিক হবে। বাড়ির সকলে একটু একটু করে স্বাভাবিক হচ্ছে। এমনই হয়। দূরে থাকা বাড়ির সদস‍্যগুলো বাড়িতে এলে যেমন আনন্দের ঢল নামে চলে গেলে দুঃখও লাগে তেমন।

মাছগুলো কাজের মহিলাটি কেঁটে ধুয়ে দিয়ে গিয়েছেন। মালিহা রাইস কুকারে ভাত চড়িয়ে দিয়েছে। মাছগুলো আবারও ধোয়ার জন্য সিংকের কাছে নিলো। অন‍্যের মাছ ধোয়া তার পছন্দ হয় না। খেতে পারে না সে। দাদু বলতেন, “মাছ যত ধোয়া যায় তত তার স্বাদ বাড়ে।” মাছে পানি দিতেই কেমন যেন লাগলো। হাতে প্লাস্টিকের গ্লাবস পড়া। যেন কাঁটায় হাত না কেঁটে বা ফেরে যায়। হাত দিয়ে ভালো করে ধুতে গিয়ে মাছের গন্ধটা একটু বেশিই লাগলো। আগেও এমন লেগেছিল। কিন্তু পাত্তা দেয়নি মেয়েটি। কিন্তু এখন যেন বেশিই অসহ‍্য লাগছে। গা গুলিয়ে আসছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মালিহা তাড়াতাড়ি করে বাম হাত দিয়ে নাকে ওড়না চেপে ধরে দ্রুত মাছগুলো ধুয়ে নিলো। নাক থেকে ওড়না সরাতে না সরাতেই হুড়মুড় করে বমি করে মেঝে ভাসিয়ে দিলো। কিচেন থেকে সরে বেসিং পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ পেল না। হঠাৎ এহেন শারীরিক পরিবর্তনের কারন বুঝতে পারলো না। বুক ধরফর করতে লাগলো। ভালো করে হ‍্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুয়ে ডাইনিংয়ের চেয়ারে গিয়ে বসলো। ভনভন করে মাথা ঘুরাচ্ছে।

নিচে পানি নিতে নেমেছিল রিপ্তি। মালিহাকে এলোমেলো অবস্থায় দেখে দৌড়ে কাছে গেল। মালিহা তখন টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে হাপাচ্ছিলো। রিপ্তি কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কি হয়েছে মালিহা? শরীর খারাপ লাগছে?”
রিপ্তির উপস্থিতিতে মালিহা মাথা উঠিয়ে তাকালো। বললো, “কেমন যেন লাগছে। মাছ ধুতে গিয়ে বাজে গন্ধ এলো নাকে। তারপর কিচেনের মেঝেতেই বমি করে দিয়েছি। শরীর অদ্ভূত রকম খারাপ লাগছে। আগে কখনও এমন হয়নি। আমার কথা বলততেও কষ্ট হচ্ছে ভাবি।”

রিপ্তি দেখলো মেয়েটি ঘনঘন শ্বাস ফেলছে। মালিহাকে কিছু বললো না। চলে গেল শাশুড়ি মায়ের রুমে। ডেকে নিয়ে এলো তাকে। কিছুটা অসুস্থ তিনি। হালকা জ্বর, ঠান্ডা। দুদিন হয় ঠিক করে খেতে পারেন না। তাইতো মালিহা গিয়েছিল তার পছন্দের খাবার রাধতে।

শাশুড়ি মা এসেই মালিহার কপালে হাত রাখলেন। চিন্তিত মনে হলো তাকে। তারপর বাড়ির ল‍্যান্ডফোন থেকে কল করলেন পারিবারিক চিকিৎসকে। এ বাড়িতে এখনো একটি ল‍্যান্ডফোন সচল আছে। সেই নব্বই দশক থেকে সার্বিস দিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমাঝে সমস্যা দেখা দেয়। মায়া করে একসময়ের কেনা ফোনটি আর ফেলানো হয় না। তাছাড়া বাড়ির বড়রা এখনো এটিই ব‍্যবহার করে। মালিহা অবাক হয়ে কয়েকবার নেড়েচেড়ে দেখেছে।

রিপ্তি একগ্লাস লেবু চিনির শরবত করে এনে দিলো মালিহাকে। ফ্রিজে রাখা তেতুল মাখিয়ে দিলো একটু শুকনো মরিচের গুড় দিয়ে। মালিহা ঢকঢক করে শরবত টুক খেল। একটু তেতুলও মুখে দিলো। এখন কিছুটা ভালো লাগছে তার। রিপ্তি কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলেই ফেললো, “মালিহা তোমার পিরিয়ড কি নিয়মিত? এ মাসে হয়েছে?”
“নিয়মিত। কিন্তু এ মাসে……” কথা থেমে গেল মালিহার। হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো রিপ্তির দিকে।
রিপ্তি বললো, “বুঝেছি আমি।”

ভদ্রমহিলা দু বউমার কথোপকথন শুনছিলেন নিরবে। এবার মুখ খুললেন, “বড় বউমা কি হয়েছে বলো তো?”
“বুঝছেন না মা? এ বাড়িতে বাবুর খেলার সঙ্গী আসছে যে!”
“আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ্।”

জা এবং শাশুড়ি মায়ের মুখ হাসিহাসি। খুশি যেন ধরছেই না তাদের। ঘন্টা খানিকের মধ্যে ডাক্তার এলেন। পরিক্ষা নিরিক্ষা শেষ নিশ্চিত করলেন এ বাড়ির ছোট বউমা সন্তান সম্ভাবা। ডাক্তারকে ডাবল ফিস দেওেয়া হলো। শশুর বাবা শুনে নানান পদের মিষ্টান্ন নিয়ে এলেন। খুশি ভাগ করে নিতে ফোন দেওেয়া হলো মালিহার বাবার বাড়িতেও। সকলেই খুশি। সকলের মধ‍্যমনি হয়ে বসে থাকা মালিহা যেন কিছুই বুঝতে পারছেনা। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সকলের মাঝ থেকে উঠে এলো। ধীরে ধীরে নিজ রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো। মুখে বালিশ চেপে বোবা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো মেয়েটি। তার গর্ভে সন্তান আসছে। একটি ছোট্টমনির আম্মু হবে সে। ভাবতেই অন‍্যরকম শিহরণ বয়ে গেল শরীর জুড়ে। সে কি আদৌ এই সন্তান চেয়েছিল? আর জাওয়াদ? তার কি অভিব‍্যাক্তি হবে? যে সম্পর্ক এখনো মন থেকে মানতেই পারেনি, ঠাঁই দিতে পারেনি জাওয়াদ নামক মানুষটিকে। অথচ তার সন্তান গর্ভে ধারন করে বসে আছে। এ কেমন ভাগ‍্যের পরিহাস!

এখন পর্যন্ত জাওয়াদের দেওেয়া ফোনটা খুলে দেখেনি। আংটিটাও জাওয়াদ চলে যাওয়ার পরে খুলে রেখেছিল। একা থাকলেই মনে পড়ে সেই বিভীষিকাময় রাতের কথা। কতটা আশা নিয়ে পা ফেলেছিল এ বাড়িতে। অথচ সামান্য একটি ব‍্যপারে পেতে হয়েছিল অসহ‍্য যন্ত্রণা। যেখানে সুখের সাগরে ভেসে কথা ছিল। মালিহা ওয়াশরুম গিয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে এলো। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাড়ালো। ঘুরেফিরে দেখতে লাগলো নিজেকে। একটি ছোট্ট ভ্রুণ বেড়ে উঠছে তার ছোট পেটে!

আনমনে হাত রাখে পেটে। খুব করে অনুভব করতে চায় তাকে। কিন্তু এখন তা সম্ভব নয় একদমই। বিষাদের মাঝেও ছোট্টমনি এক টুকরো সুখ হয়ে এলো যেন। মালিহার ফ‍্যাকাশে বিষণ্ণ বদনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। বহুদিন পরে মেঘলা আকাশে রোদ উঠলে যেমন চারদিক বেশি আলোকিত ও উজ্জল মনে হয়। ঠিক তেমনই মালিহার মুখের হাসিতে ঝলমল করে উঠলো চারিপাশ।

জাওয়াদকে ফোনে পাওয়া গেল বিকেল বেলায়। শাশুড়ি মা খুশিতে ডগমগ হয়ে ছেলের কানে সুখের খবরটি পৌছালেন। জাওয়াদ খবরটি শুনে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে ছিল। সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না। পরক্ষণেই সুখ হাসি তার ঠোঁটেও ফুটে উঠেছিল। মালিহাকে ফোনে চাইলো। কথা বলতে চায় সে। মালিহা তখন আশেপাশেই ছিল। ইতস্তত করে ফোন নিলো। একটু দূরে গিয়ে বসলো। ফোনের ওপাশ থেকে শুধু ফুপিয়ে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিছু বলছে না ছেলেটি। মালিহা ফোন কানের সাথে চেপে রাখে। মিনিট খানিক পরে জাওয়াদ বললো, “প্লিজ!

মালিহাকে বাচ্চাটাকে নষ্ট করো না। আমার ভুলের শাস্তি ওকে দিও না। তুমি তো নারী জাতি। মায়ের জাত। তোমার টান থাকার কথা আমার থেকে শতগুণ বেশি। যেভাবেই হোক পৃথিবীতে আসছে সে। তাকে বাধা দিও না। আমার অন‍্যায়ের শাস্তি আমাকে দিও। কিন্তু ওকে না। সব শাস্তি আমি মাথা পেতে নিব।”
মালিহা বললো, ”কে বললো আমি বাচ্চা নষ্ট করবো?”
“সত‍্যিই করবেনা? আমি তো ভেবেছিলাম….”
“কী?”

“যেখানে আমাকে এখনো ক্ষমা করতে পারোনি, মানতে পারোনি মন থেকে। সেখানে আমার সন্তানকে পারবে মেনে নিতে! সেই শঙ্কায় একথা বলেছিলাম আমি।”
“সবকিছু নিজের মতো ভাবলে চলে না জাওয়াদ। যেভাবেই হোক সে আসছে। হয়তো অপরিকল্পিত। কিন্তু আসছে তো। সৃষ্টিকর্তা দিচ্ছেন তাকে। আমি কি করে তাকে ফেলে দিই? যেখানে স্টিল আপনার বাড়িতে থাকছি, খাচ্ছি। এতটা হৃদয়হীনা ভাববেন না আমাকে।”

“সরি মালিহা। আমি আবারও ভুল করে ফেললাম।”
আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ে জাওয়াদ। ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে ছেলেটি। প্রথম বাবা হওয়ার সংবাদ যে কতটা সুখ এবং খুশি বয়ে আনে তা একজন বাবাই ভালো বলতে পারবে। এ সুখ দুনিয়ার কোন কিছুর সাথে তুলনা করা যায় না। কল্পনায় ভাসতে থাকে ছোট্ট দুটো নরম তুলতুলে হাত। কমলার কোয়ার মত নরম কোমল ঠোঁট। জীভ নাড়িয়ে ডাকতে থাকবে “বাবা” বলে।

জাওয়াদের মতো শক্ত পুরুষের কান্নায় ভিতরটা নড়ে ওঠে মালিহার। চোখে জমা হয় অশ্রু। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়। নাক টেনে বলে, “লেফটেন্যান্ট সাহেব এটুকুতে এত কাঁদলে চলবে? আশেপাশের সকলে দেখলে কি ভাববে? ছেলে মানুষের চোখে কান্না মানায় না।”
জাওয়াদের কান্না থামে। তাবু থেকে দূরে গিয়ে কথা বলছিল সে। অনেকটা সময় পরে কথা বলার সুযোগ পায়। ফোন ছাড়তে মন চায় না জাওয়াদের। দূরে থাকাটাও নিরাপদ নয় তার জন্য। শেষবারের মতো বলে, “জীবনে এত খুশি কখনও হয়নি তো তাই আর কি। আচ্ছা ভালো থেকো। নিজের এবং আমাদের বেবির যত্ন নিও। রাখছি।”
“আল্লাহ হাফেজ।”

রাগে অনুরাগে পর্ব ১১

ফোন কেঁটে গেল। তবুও দু পাশের মানব মানবি কানে জড়িয়ে রাখলো ফোন। যেন একে অন‍্যকে অনুভব করতে পারছে।
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আলমারি খুলে জাওয়াদের দেওেয়া শপিং ব‍্যাগ দুটো খুললো। একটাতে স‍্যামসাং ব্রান্ডের একটি ফোন। আরেকটি বড় ব‍্যাগে মসলিন শাড়ি। শাড়িটা হাতে নিয়ে মালিহা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দেখলো। এ বিলুপ্তপ্রায় দূর্লভ বস্তু জাওয়াদ হাজির করেছে কিভাবে?

রাগে অনুরাগে পর্ব ১৩