রাগে অনুরাগে পর্ব ১৫
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি
“ভাবি, পুরো একটা সপ্তাহ হয়ে গেল ওনার কোন ফোনকাল এলো না। হঠাৎ এমন হওয়ার কারণ কী?”
মালিহার ব্যাকুল কন্ঠস্বর! জাওয়াদ আজ সপ্তাহ খানিক হয়ে গেল কোন ফোন ম্যাসেজ দেয় না মালিহার কাছে। আজ দিবে, কাল দিবে, হয়তো ব্যস্ত আছে এসব বলে বলে নিজেকে বুঝ দিয়েছে মালিহা। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর যেন শেষই হয় না। আর না আসে জাওয়াদের তরফ থেকে কোন ফোনকল বা ম্যাসেজ।
তাইতো আজ অস্বস্তি, লজ্জা ফেলে জায়ের কাছে কথাটি বলেই ফেললো। মালিহার চিন্তাগ্রস্থ মুখ দেখে রিপ্তি একটু হাসলো। পরক্ষণেই প্রতিত্তোরে বললো, “বোকা মেয়ে এত দুশ্চিন্তা করলে হবে? ভীন দেশে গিয়েছে দায়িত্ব পালন করতে। সেখানে সবসময় কি সুযোগ হয় ফোনে কথা বলার? হয়তো নেটওয়ার্কের সমস্যা কিংবা সময় সুযোগ করে উঠতে পারছে না বাড়িতে ফোন দিতে। একটু অপেক্ষা করো। সময় হলে ঠিক ফোন দিবে। তুমি এই শরীরে এত চিন্তা করিও না তো। সর্বদা হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করবে। তোমার মধ্যে একটি নতুন প্রাণ বেড়ে উঠছে। তোমার যাবতীয় কর্মকাণ্ড তার ওপর প্রভাব ফেলবে। যত হাসিখুশি থাকবে গর্ভের শিশুও তত ভালো থাকবে। চিন্তা করলে ওর ওপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। বুঝলে? প্রেম দেখি ঝরে ঝরে পড়ছে!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রিপ্তির বলা শেষ বাক্যে লজ্জা পায় মালিহা। গালদুটো লাল হয়ে ওঠে। প্রতিত্তোরে উপর নিচ মাথা নাড়ায়। অর্থাৎ সে সব বুঝেছে।
গর্ভকালীন সময়ের প্রথম ট্রাইমেস্টার শেষ হয়ে এখন সেকেন্ড ট্রাইমেস্টার চলছে মালিহার। ঝুকিপূর্ণ সময় পেরিয়ে এসেছে সে। গর্ভবস্থায় সেকেন্ড ট্রাইমেস্টারকে বলা হয় হানিমুন পিরিয়ড। এই সময়টা প্রথমদিকে হওয়া মর্নিং সিকনেস, তীব্র ঘ্রাণশক্তি সহ বিভিন্ন অস্বস্তিকর উপসর্গ কাটিয়ে উঠে গর্ভবতী অনেকটা ফ্রেশ ফিল করে। ডাক্তাররা সাজেস্ট করেন এই সময়টা কিছুটা ঘোরাঘুরি করে কাটানো যেতে পারে।
মালিহাকে নিতে আসবে তার বাবা। তার আগেই মালিহাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে চেকআপ করাতে নিয়ে গেলেন তার শাশুড়িমা। ডাক্তার চেকআপ শেষে একগাদা উপদেশ বাক্য শুনিয়ে গর্ভকালীন সময়ের উপযুক্ত একটি ডায়েট চার্ট ধরিয়ে দিলেন। হসপিটাল থেকে ফেরার পথে মালিহা আবদার করলো, “মা চলুন না চাইল্ড কেয়ার থেকে একটু ঘুরে আসি। আপনার ছেলে একদিন নিয়ে এসেছিলেন। এরপর আর যাওয়া হয়নি। বাচ্চাগুলোর মুখ কি মায়াবী!”
গর্ভবতী পুত্রবউয়ের আবদার ফেলতে পারলেন না ভদ্রমহিলা। বললেন, “বেশ চলো তাহলে। আমারও ওদিকটায় যাওয়া হয় না অনেকদিন।”
বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন প্রকার খাবার উপহারসামগ্রী নিয়ে মালিহাকে নিয়ে চাইল্ড কেয়ারে ঢুকলেন একদম বিনা নোটিশে। বাচ্চারা তখন মাঠে খেলাধুলা করতে ব্যস্ত। তাদের দেখে খেলা রেখে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বাচ্চারা। অফিস কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন পরিচিত মুখ। কুশল বিনিময় করলেন তিনি। আশ্রমের অন্যান্য কর্মচারীরাও এগিয়ে এলো। উপহারসামগ্রী বিলিয়ে দেওেয়া হলো বাচ্চাদের মধ্যে। আনন্দে চোখমুখ ঝলমল করে উঠলো বাচ্চাগুলোর। সকলের খুশি দেখে মালিহারও মনটা ভালো হয়ে গেল।
আশ্রমে বেশি সময় কাঁটালেন না। দুপুরের মধ্যেই বাড়ি ফিরে এলেন। পথিমধ্যে মালিহা জিজ্ঞাসা করলো, “মা, এই আশ্রমের সাথে আপনারা কতদিন ধরে যুক্ত? আপনাকে, আপনার ছেলেকেও দেখলাম বেশ সমীহ করে চলেন সকলে।”
“আমার শশুরের আমল থেকে। তিনিই এই এতিমখানা প্রতিষ্টা করার জন্য জমি দান করেছিলেন। এরপর আরও কিছু মানবিক সহায়তায় আশ্রম নির্মিত হয়। তারপর থেকেই বংশানুক্রমে তোমার শশুর এবং ছেলেরাও এখানকার দাতা সদস্য। সামর্থ্য অনুযায়ী মাসিক একটা অ্যামাউন্ট দেওেয়া হয় এখানে।”
“মাশাআল্লাহ।”
দিন দুয়েক পরে মালিহার বাবা মেয়েকে নিতে আসলেন। শাশুড়ি মা বারবার করে বলে দিলেন, “এক সপ্তাহের বেশি থাকবে না। ছেলেরা বাড়ি থাকে না। চাকরিসূত্রে একেকজন একেকদিকে। তোমাদের নিয়ে আমার যত শখ আহ্লাদ। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো মা।”
প্রতিত্তোরে মালিহা হ্যাঁ, না কিছু না বললেও মালিহার বাবা হাসিমুখেই বললেন, “তাহলে বোঝেন আমাদের কেমন লাগে? আদর ভালোবাসা দিয়ে বড় করা মেয়েটি যখন দিনের পর দিন চোখের আড়ালে থাকে আমাদের কেমন লাগে? কতদিন পরে যাচ্ছে। কদিন থাকুক তারপর আপনারা গিয়ে বেড়িয়ে আসবেন আর আপনাদের বউমাকে নিয়ে আসবেন।”
“বুঝি তো ভাই। আপনার মেয়েটা তবুও কাছাকাছি আছে। অন্তত এক দেশে। চাইলেই যখন তখন দেখা করতে পারেন। কিন্তু আমার মেয়েটা থাকে সেই বিদেশ বিভূইয়ে। কত সীমাবদ্ধতা। চাইলেও যখন তখন দেখতে পারি না। ছেলেমেয়ে কেউই আমার কাছে নেই। দুই বউমা নিয়েই আমার দিনকাল কাঁটে। এটাইতো জগতের নিয়ম ভাই। এক ঘরে জন্ম নিয়ে অন্য ঘরে জীবন কাঁটাতে হবে। এভাবেই তো নারীলোক জীবন কাঁটিয়ে দেয় বছরের পর বছর।”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ভদ্রমহিলা। একমাত্র মায়েরাই জানেন আদরের সন্তানের দূরত্ব ঠিক কতখানি পোড়ায়। নাড়ীর টান যে এজন্যই একটু বেশি জ্বলে।
মালিহার বাবা আর কথা বাড়ালেন না। একে একে সকলের থেকে বিদায় নিলেন। আসার সময় রিপ্তির মেয়েটির হাতে পাঁচশো টাকার একটি নোট গুজে দিলেন। গেটের এক কোনে দাড়িয়ে মালিহার কাছাকাছি এসে রিপ্তি ছোট্ট করে বললো, “তাড়তাড়ি ফিরে এসো। আমাদের আবার ভুলে যেও না। আর সাবধানে থেকো।”
একে একে সকলের থেকে বিদায় নিয়ে মালিহা বাবার সাথে বাড়ির পথ ধরলো। মনটা তার বিশেষ ভালো নেই। খচখচ করছে। জাওয়াদ হঠাৎ কেন ফোন করছে না এ নিয়ে চলছে মনে শত প্রশ্নের আন্দোলন। শাশুড়ি মাকে বলতে চেয়েও বললো না মালিহা। এমনিতেই ছেলেদের দূরত্ব তাকে কষ্ট দেয়। আবার এমন কথা বললে দেখা যাবে চিন্তায় নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছেন।
বাসে উঠেও নিজের মধ্যে কোন উৎফুল্লতা টের পেল না মালিহা। কতদিন পরে মা, ভাইবোনদের সাথে দেখা হবে। কথা হবে। অথচ মনে কোন আনন্দ নেই। সব চিন্তা শুধু একজনকে ঘিরেই। দৃষ্টি জানালার বাহিরে। রাস্তার পাশের গাছগুলো পিছন ফেলে বাস এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। বাতাসের ঝাপটা হিজাব দুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মালিহা এক ধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। মানুষের জীবনও ঠিক এমন। জীবনে বর্তমান হয়ে আসা কতশত মুহূর্ত ঠিক এভাবেই ফেলে রেখে আসতে হয়। আজকের বর্তমান আগামী দিনের অতীত।
মালিহাকে দেখামাত্র মায়া বেগম জড়িয়ে ধরলেন। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি। মূলত মেয়ের প্রতি করা কঠিন আচরণ, তীব্র ভালোবাসায় তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছেন। কতদিন স্বপ্ন দেখেছেন মেয়ে তার বাড়িতে ফিরে এসেছে। স্বপ্নভঙ্গ হলেই চোখের কোনে অশ্রু এসে ভীর করতো। মালিহাও একটু কাঁদলো। মায়ের থেকে দূরত্বে কোন ছেলেমেয়েই ভালো থাকতে পারে না। বড্ড কষ্ট দেয়। মালিহারও কষ্ট হয়েছে খুব।
মা মেয়ের কান্নাকাটি শেষ হলে মায়া বেগম মেয়েকে নিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসালেন। ফুল ভলিউমে ফ্যান ছেড়ে দিলেন। দ্রুতগতিতে কিচেনে ঢুকলেন। ফ্রিজে আগে করে রাখা ডিম দুধের পুডিং বের করলেন। শরবত করলেন গাছের সতেজ লেবুর। কিছুক্ষণ আগে রান্না করে রাখা পাস্তাটা গরম করে নিলেন। তারপর সবকিছু সুন্দর করে প্লেটে গুছিয়ে মেয়ের সামনে হাজির করলেন। মালিহা বিনাবাক্যে খাবারগুলো খেতে লাগলো। আজকাল খুব খিদে পায়। পর্যাপ্ত খাওয়ার পরেও আরেকটু খেতে মন চায়।
শাড়ির আচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে মায়া বেগম মেয়েকে শুধালেন, “রাতে কি খাবি মা?”
“তোমার যা মন চায় তাই করো। আমি রুমে যাচ্ছি আম্মু।”
মালিহা দ্রুত মায়ের কাছ থেকে সরে নিজের চেনা পরিচিত রুমটাতে ঢুকলো। মনের মধ্যে সারাক্ষণ খচখচ করছে। বুকে চিনচিন করে ব্যাথা হচ্ছে। মন শুধু বলছে, “শুধু একটিবার ফোন দিন জাওয়াদ। আমার অস্থিরতা কিছুতেই কমছে না যে!” কিন্তু না জাওয়াদ ফোন দেয়, আর না মালিহার অস্থিরতা কমে। রুমে এসেই পরনের জামা বদলে কটনের কামিজসেট পড়লো। শাশুড়িমা, শশুর বাবা, রিপ্তি সকলের সাথে কথা বলে নিলো একবার। এরপর কিছুক্ষণ চুপচাপ জানালার ধারে বসে রইলো। জানালার ওপাশে শান বাধানো পুকুর ঘাট। তার ওপর কৃষ্ণচূড়া গাছ। পুকুরে গাছের ছায়া এসে মিশে গিয়েছে পানিতে। সেদিকেই এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে এসেছে। মালিহা রুম থেকে ভাইবোনদের হইচই এর আওয়াজ শুনতে পারছে। কোচিং থেকে ফিরেছে দুটো। বোন আসার সংবাদে তারা খুবই খুশি এবং উত্তেজিত! ব্যাগ কাধে নিয়েই মালিহার সাথে দেখা করে গেল।
সন্ধার পরে মালিহার বাবা পাড়ার মোড়ের নতুন রেস্টুরেন্ট থেকে গরম গরম বার্গার নিয়ে এলেন। বহুদিন পরে ভাইবোনেরা মজা করে টেলিভিশন দেখতে দেখতে সন্ধার নাস্তা সারলো। মায়া বেগমের চোখমুখ চকচক করছে মেয়েকে কাছে পেয়ে। ছেলেমেয়েদের একসাথে দেখে মায়ের মন খুশিতে ভরে উঠেছে যেন। কিচেনে দাড়িয়ে কড়াইয়ে খুন্তি নাড়ছেন আর আচলে চোখ মুচছেন। এ অশ্রু বড়ই আনন্দের।
রাতে বেলে মাছ দিয়ে আলু বেগুনের চচ্চড়ি করলেন মায়া বেগম। সাথে ডিম ভাজা মরিচ পেয়াজ দিয়ে। এসব সাধারণ খাবার মালিহার খুব পছন্দের। কিন্তু আয়েশ করে খেতে পারলো না মেয়েটি। সন্ধার নাস্তার পরে পেটে তেমন ক্ষুদা নেই। আর যতবার জাওয়াদের কথা মনে পড়ছে ততবারই মনটা পুড়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় খাওয়া গলা দিয়ে নামলো না। ভাত নড়াচড়া করে উঠে পড়লো। মায়া বেগম সবটা চুপচাপ দেখলেন শুধু।
রাতে মালিহার রুমে এক গ্লাস দুধ গরম করে নিয়ে এলেন মায়া বেগম। মালিহা তখন বুক সেলফ থেকে বই নামিয়ে ধুলো ঝারছিল। মায়া বেগম রুমে প্রবেশ করে টেবিলে পিরিচে দুধ ঢেকে রাখলেন। তারপর খুব শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি হয়েছে রে মা? আসার পর থেকে কেমন মনমরা লাগছে তোকে। মায়ের ওপর থেকে রাগ এখনো কমেনি মা?”
মালিহা মায়ের কথায় মৃদু হাসে। হাত থেকে বই সরিয়ে রেখে মাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলে, “মায়ের ওপর সন্তানেরা কখনও রেগে থাকতে পারে না আম্মু। অভিমান হলেও রাগ করা যায় না। মায়েরা হচ্ছেন সুপার ওয়েম্যান। সৌন্দর্য খুইয়ে মৃত্যুর দলিলে নাম লিখিয়ে মেয়রা মা হন। জন্ম দেন সন্তানকে। সেই নাড়ী ছেড়া ধন কখনও রাগ করতে পারে? মা হচ্ছি বুঝতে শিখছি আম্মু।”
মায়া বেগম আদর করে দেন মেয়েকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “মাশাআল্লাহ মেয়ে আমার বড় হয়ে গিয়েছে যে!”
রাগে অনুরাগে পর্ব ১৪
পরদিন সকালবেলায় একেবারে বিনা নোটিশে ছোট দেবরের বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে হাজির হলেন মায়া বেগম। উদ্দেশ্য শাশুড়ি মাকে ফিরিয়ে আনার। এতদিন মন চাইলেও সাহস করে উঠতে পারেননি। যে দুঃখ তিনি দিয়েছেন মায়ের মতো শাশুড়িকে তা কিছু কম নয়। তাইতো আজ মালিহাকে নিয়ে হাজির হয়েছেন।