রাগে অনুরাগে পর্ব ৭

রাগে অনুরাগে পর্ব ৭
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি

মালিহাকে বিদায় দেওয়ার সময় মায়া বেগম অশ্রুসিক্ত নয়নে মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে গেলেন। নিজেকে সরিয়ে নিল মালিহা। মায়ের মুখপানে একটিবার তাকালোও না। গটগট করে হেঁটে গাড়িতে গিয়ে উঠলো। নিজ মা যখন খুব যত্ন নিয়ে দুঃখ কষ্ট উপহার দেয় তখন সেই দুঃখ কষ্টের যন্ত্রণা সহ‍্য করা যায় না। কথায় আছে না, ‘পর মানুষে দুঃখ দিলে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু আপন মানুষ দুঃখ দিলে মেনে নেওয়া যায় না।’

চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত মেয়ের দিকে মায়া বেগম হতভম্ব হয়ে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থাকলেন। এই মেয়েকে তিনি চিনেন না। মেয়ে তার রাগী, জেদি হলেও মনটা নরম। মা বলতে পাগলপ্রায়। সেই মেয়ের এমন রূপ মায়া বেগমের মেনে নিতে বড্ড কষ্টই হলো। পরক্ষণেই মনকে মিছে বুঝ দিলেন, “সুখি হলে তখন মাকে ঠিক মনে পড়বে। অভিমান ভেঙ্গে আবার মায়ের কাছে ছুটে আসবে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বিকেলের নুয়ে পরা রোদের ফালি জানালার কাচ ভেদ করে চোখেমুখে লাগছে। মালিহা সেই তেজহীন আলোর দিকেই তাকিয়ে আছে এক মনে। পাশে জাওয়াদ বসে আছে। মফস্বলের সরু পিচঢালা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে মাঝারী গতিতে। মালিহার জা ও মেয়ের মধ্যে টুকটাক কথোপকথনের আওয়াজ ভেসে আসছে। জাওয়াদের শরীর থেকে মিষ্টি কিন্তু ঝাঝালো একটা সুঘ্রাণ এসে নাকে লাগছে মালিহার। চোখমুখ কুচকে যায় বিরক্তিকর পারফিউমের গন্ধে। নিজেকে আরেকটু গুটিয়ে নেয় মেয়েটি। জাওয়াদ আড় চোখে একবার মালিহাকে দেখল। পরক্ষণেই ব‍্যাস্ত হয়ে গেল নিজ ফোনে।

মেহমান বিদায় নেওয়ার পরে মালিহার চাচা চাচিও বাসায় ফেরার জন্য তোড়জোড় শুরু করলেন। বড় এক ব‍্যাগ টানতে টানতে জামিলা বেগম খুটখুট করে হেঁটে আসতে লাগলেন। মায়ের হাত থেকে বড় ব‍্যাগটি নিজের হাতে নিলেন মালিহার ছোট চাচা। মৃদু ধমকে মাকে বললেন, “তুমি কোন বুদ্ধিতে এত বড় ভারি ব‍্যাগ টানতে গেলে? হাত থেকে পড়ে গিয়ে ব‍্যাথা পেলে কি হতো ভাবতে পারছো?”

জামিলা বেগম ছেলের কথার প্রতিত্তোর করলেন না। তিনি চারপাশটা একবার নজর ঘুরিয়ে দেখলেন। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। এ বাড়িটাতেই তিনি যৌবন কাল থেকে এ পর্যন্ত সময় কাটিয়ে এসেছেন। তার বুড়োর সাথে হাজারো স্মৃতি জড়িয়ে আছে বাড়ির আনাচকানাচে। অভিমানী কিশোরীর ন‍্যায় চোখ ভরে জল আসতে চায়। জামিলা বেগম নিজেকে সংযত করেন।
ছোট ভাই এবং ভাইয়ের বউয়ের সাথে মাকেও চলে যেতে দেখে অবাক হন মালিহার আব্বু। বিস্ময় নিয়ে শুধান,

“কোথায় যাচ্ছো মা?”
“ওদের সাথে।” জামিলা বেগমের এক কথায় জবাব দেন।
“কিন্তু কেন?”
বিস্ময়বোধ যেন কমছেই না বড় ছেলের। মেয়ের বিদায়ে পিতার মন বেদনায় মুষড়ে পড়েছে। এখন আবার মায়ের চলে যেতে চাওয়ায় কষ্টটা দ্বিগুণ হাড়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জামিলা বেগম বললেন, “ছেলে তো আমার একটা না বাবা। তোমার এখানে যেমন থাকতে হয় ওদেরও তো দেখতে হয়। যদিও এই বুড়ো বয়সে দেখব আর কি! বরং বোঝা হয়েই থাকতে হবে।”

“মা! কিসব বলছো? বোঝা কেন হতে যাবে তুমি?”
ছোট ছেলের রাগী কন্ঠের পিঠে ঠোঁট ভিজিয়ে হাসেন জামিলা বেগম। অবুঝ বালিকার ন‍্যায় বলেন, “কথার কথা আর কি।”

মায়া বেগম একটি কথাও বললেন না। কেবল বিস্ময় নিয়ে দেখলেন সবটা। সকলে চলে যেতেই রুমের দরজায় খিল আটলেন। আছড়ে পড়লেন বিছানায়। চল্লিশ পেরনো মধ‍্য বয়স্ক গৃহিনীর ধৈর্যের বাদ ভেঙ্গে গেল। ফুফিয়ে কেঁদে উঠলেন। মন কু ডাকছে। বারবার একটা কথায় মনে হতে লাগলো, “একদিন বাঁচাতে গিয়ে বাকি তিনদিক ভেঙ্গে গুড়িয়ে ফেললেন না তো!”

শশুরালয়ে মালিহার পদধূলি পড়লো মাগরিবের পরে। চারপাশে তখন আবছায়া আধার নেমেছে। জাওয়াদের হাতের মুটো বন্দিতে তার নরম কোমল হাতজোড়া আটকানো। পিছন পিছন এগিয়ে চলছে নিঃশব্দে। যতই এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক ততই ভয় ভীতি দানা বাধছে মনে। এ বাড়িতে কাটানো প্রথম রাতের অভিজ্ঞতা তার মন থেকে এতটুকুও মুছেনি। বরং প্রতিদিনই সেখানে ঘৃণার পারদ পুরু হতে থাকে।
শাশুড়ি মা সদর দরজা থেকে এগিয়ে নিয়ে যান ছোট বউমাকে। আহ্লাদি অভিযোগ করেন, “মায়ের বাড়িতে গিয়ে এই মাকে একেবারে ভুলেই গিয়েছ দেখছি! তা কেমন আছো মা?”

মালিহা রিনরিনে কন্ঠে জবাব দিল, “আলহামদুল্লিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?”
“আল্লাহ রেখেছেন ভালো। বাতের ব‍্যাথাটা একটু বেড়েছে শুধু। আচ্ছা তুমি যাও। ফ্রেশ হয়ে এসো।”
বাড়ির পরিবেশ প্রথম দিনের তুলনায় বেশ শান্ত, নিরব। বাড়তি মানুষের আনাগোনা নেই। মালিহাকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে গেল জাওয়াদ। বললো, “চলো। ফ্রেশ হয়ে তারপর এসো। এভাবে বসে থাকলে অস্বস্তি আরও বাড়বে।”

চমকে ওঠে মালিহা। জাওয়াদের মুখ থেকে এমন মিষ্টি কথা হজম করতে কষ্ট হয় তার। মালিহা চমকায়িত দৃষ্টি নজর এড়ায় না জাওয়াদ। ঠোঁট এলিয়ে হাসে ছেলেটি। তা দেখে বড়সর ধাক্কা খায় মালিহা। এই ছেলেকে এর আগে এভাবে হাসতে দেখেনি সে। অবশ‍্য দেখেছেই বা কতক্ষণ। বিস্ময় নিয়েই জাওয়াদের পিছু পিছু হেঁটে আসে। রুমে ঢুকে আলমারির এক পাল্লা খুলে মালিহার উদ্দেশ্যে বলে, “এপাশটাই তোমার প্রয়োজনীয় সবকিছু পেয়ে যাবে। পাশের দিকটাই আমার। তোমার পছন্দ মত পোশাক পড়তে পারো। এ বাড়িতে এ নিয়ে কেউ কিছু বলবে না। চেঞ্জ করো। আমি বাইরে আছি। প্রয়োজন পড়লে ডেকো।”

মালিহা জাওয়াদ বেরিয়ে যেতেই গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় আলমারির খোলা পাল্লার দিকে। কখনও কি ভেবেছিল এ বাড়িতে তাকে আবার ফিরতে হবে? অথচ এ বাড়ির আলমারির একটা কর্ণার তার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। ঠোঁট কোনে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে।

কয়েকটি কামিজ সেট আর লং কুর্তি চোখে পড়ল মালিহার। সবুজ রঙের একটা সালোয়ার সেট বের করে ওয়াশরুমে ঢুকলো। মুখ ধুতে গিয়ে বেসিনের আয়নায় নিজেকে দেখে মালিহা। শুভ্র বর্ণের গোলাকার এক নারী মুখ। ঠোঁটের নিচের তিলটা চকচক করে জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্ব। নিজের দিকে তাকিয়ে ভিষন কান্না পায় মেয়েটির। চরম অপমানিত স্থানে তাকে ফিরে আসতে হয়েছে। আপজনেরা তাকে একটু ঠাঁই পর্যন্ত দিল না।

বিষিয়ে ওঠে মন মস্তিষ্ক। এ কেমন জীবন তার? নিজ মা বোঝা মনে করে তাড়িয়ে দিল। স্বামী নামক মানুষটা প্রথম রাতেই নিজের হিংস্র রূপ দেখাতে কাপর্ণ‍্য করলো না। কি ক্ষতির বাকি আছে তার জীবনে? মুখে হাত চেপে ঢুকরে কেঁদে ওঠে মেয়েটি। বহু কষ্টে এতক্ষণ কান্না চেপে রেখেছিল। ওয়াশরুমের জনশূন‍্য একাকি স্থানে সব আবেগ উগরে আসছে। নিজেকে আটকানোর চেষ্টাটুকুও করলো না। অস্পষ্ট স্বরে বারবার শুধু একটি বাক‍্যই আওড়ালো, “আমাকে কষ্ট দেওয়া মানুষগুলো যেন ছাড় না পায়।”

বেশ সময় নিয়ে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেড়লো মালিহা। ভিজে টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে পুরো রুম পায়চারি করলো একবার। দরজায় ঠকঠক শব্দে পায়চারি থামিয়ে দরজা খুলে দিলো। ওপাশে হাসি হাসি মুখ করে রিপ্তি দারিয়ে আছে। মালিহাকে দেখে বিস্তৃত হলো মুখের হাসি। দরকার ওপাশে দাড়িয়েই বললো, “তোমার মা কথা বলবেন। নাও কথা বলো।”

মায়ের সাথে কথা বলতে একটুও মন চায় না মালিহার। তবুও হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিল। স্বভাবসুলভ রিপ্তি ফোন দিয়েই চলে গেল। ফোন কানে নিয়েও চুপ রইল মালিহা। মায়া বেগম ওপাশ থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ঠিকমতো পৌছেছিস তো? সবাই ভালো আছে? সব ঠিকঠাক আছে তো?”

মায়ের প্রত‍্যেকটা কথা ন‍্যাকামি মনে হলো মালিহার। একটা মানুষ ঠিক কতটা অবুঝ হওয়ার ভান করলে অত‍্যাচারিত স্থানে মেয়েকে পাঠিয়ে এমন অবুঝ প্রশ্ন করতে পারে। মালিহার মন আবারও বিতৃষ্ণায় ছেয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে কোনরকম বলে, “নেক্সট টাইম আমার সাথে যোগাযোগ করার কোন চেষ্টা করবে না। রাখছি।” ওপাশ থেকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন রেখে দেয় মালিহা।

ধপ করে বসে পড়ে বিছানায়। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়। কি আছে জীবনে তার? একটা শক্ত খুটি নেই তার। শান্তির শ্বাস ফেলার মতো স্থান টুকুও তার জীবন থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
মিনিট দশেক বাদে জাওয়াদ ফিরে আসে। মালিহাকে কাঁদতে দেখে থমথমে হয়ে আসে তার মুখশ্রী। এগিয়ে যায় মালিহার দিকে। জাওয়াদকে দেখে নিজেকে সামলায় মালিহা। টাওয়েলে চোখমুখ মুছে নেয় দ্রুত। সটান দাড়িয়ে পড়ে বিছানা থেকে। কান্নাকাটির জন্য লোকটা আবার কিছু বলবে নাকি? চোখেমুখে আতঙ্ক বিরাজমান!

মালিহার একবারে কাছাকাছি গিয়ে দাড়ায় জাওয়াদ। ঠিক যতটা কাছে গেলে একে অন‍্যের শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ শোনা যায়। জাওয়াদকে নিজের এতটা কাছে আসতে দেখে মালিহার নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার জোগাড়! নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে গেলে জাওয়াদের পুরুষালি পোক্ত হাতের বন্ধনে আটকা পড়ে তার হাত। মুখ নামিয়ে নেয় মেয়েটি। জাওয়াদকে সে মারাত্মক ভয় পায়। একথা সে কিছুতেই অস্বীকার করতে পারে না।

মালিহার হাত ছেড়ে জাওয়াদের হাত গিয়ে ঠেকে মালিহার থুতনিতে। থুতনি উচিয়ে মালিহার চোখের দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে জাওয়াদ বলে ওঠে, “আমি খুব দুঃখিত মালিহা।নতুন জীবনের সূচনা লগ্নে যেখানে আদর, ভালোবাসা আর যত্নে মুড়িয়ে দেওয়ার কথা ছিল সেখানে আমি তোমাকে দিয়েছি এক টুকরো বিষাদ, অযত্ন। সেদিনের ব‍্যবহারে আমি লজ্জিত, দুঃখিত! রাগের মাথায় যে ভুল আমি করেছিলাম সেই লজ্জায়, ঘৃণায় আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারছিলাম না। এরপরও তোমার সামনে আমি কোনমুখে দাড়াতাম বলো?”

রাগে অনুরাগে পর্ব ৬

জাওয়াদের একের পর এক ভালো মানুষি সহ‍্য হয় না মালিহার। ভয়, ঘৃণা, লজ্জায় মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে যায় মুহূর্তেই। হাত পা অসাড় হয়ে আসে। মাথা ঝিনঝিন করতে থাকে। ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টিশক্তি। নিজেকে আর দাড় করিয়ে রাখতে পারে না। মুহূর্তেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মেয়েটি।

রাগে অনুরাগে পর্ব ৮