রাগে অনুরাগে পর্ব ৯
সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি
জাওয়াদ মালিহার কাছাকাছি থাকতে চায়। কিন্তু মালিহা কৌশলে এড়িয়ে চলে তাকে। জাওয়াদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু সে নির্বিকারভাবে তার চেষ্টা চালিয়ে যায়। শশুর বাড়িতে মালিহার নতুন করে ফিরে আসার একটি সপ্তাহ শেষ হয়েছে। তিনদিন আগে জাওয়াদ দুটো শপিং ব্যাগ এনে মালিহার হাতে দিলো। মালিহা নিয়েছিল ঠিকই কিন্তু একটিবার ব্যাগ দুটো খুলে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি। তার জন্য আলমারির বরাদ্দ অংশে টুক করে রেখে দিয়েছিল। জাওয়াদ দেখেও চুপ ছিল। সে প্রতিজ্ঞা করেছে, এই মেয়েটির ওপর সে কোনভাবেই রাগ করবে না। আর না উচু স্বরে কথা বলবে। তা সে যতই অপছন্দের কাজ করুক।
মালিহা এবং জাওয়াদ দুজনই বুদ্ধিমান নর-নারী। তাদের মধ্যকার ঝামেলা বনিবনা না হওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ গোপন করে যাচ্ছে পরিবারের সকলের থেকে। জাওয়াদের ছুটি প্রায় শেষের দিকে। আর মাত্র দুটো দিন থাকতে পারবে বাড়িতে। এরপরই আবার ফিরে যেতে হবে কর্মস্থলে। নারীদের যেমন নিজ জন্মস্থান, চেনা রুম ব্যালকনি ফেলে অচেনা অজানা স্থানে এসে মানিয়ে নিতে হয়। ঠিক তেমনই পুরুষ মানুষের জীবনেও কর্মস্থল নামক নিয়মতান্ত্রিক স্থানে মানিয়ে চলতে হয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নারীরা খুব সহজেই অভিমান উগরে বলে দিতে পারে, ‘নারীর কখনও আপন নিবাস হয় না। নিজ বাড়ি বলে কিছু হয় না।’ অনুরূপভাবে পুরুষের নিজ বাড়ি থাকা সত্বেও সেখানে আয়েশ করে থাকার সুযোগ হয় না। থাকতে হয় দুদিনের অথিতির মতো। দুঃখ কষ্ট নারী পুরুষ উভয়ের জীবনেই আছে। পুরুষ মাত্রই সে সুখী একথা যেমন চির সত্য হিসাবে বিবেচনা করা যাবে না। তেমনি প্রত্যেকটি নারী মানেই অবলা, অসহায় এমনটাও ভাবা ঠিক নয়। বাস্তবতা, পরিবেশ প্রকৃতি বিবেচনা করে জীবন যাপন সহজ কঠিন হয়ে থাকে। কোথাও নারী নির্যাতিত আবার কোথাও পুরুষ। এই নশ্বর পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে নারী পুরুষ উভয়েরই লড়াই করে যেতে হয় প্রতিনিয়ত। এটাই যেন এ পৃথিবীর অঘোষিত নিয়ম!
সময়টা শেষ বিকেল। আরেকটু পরেই আবির রঙা সূর্য অস্ত যাবে। গোধূলির রঙে রঙিন হবে প্রকৃতি। মালিহা এবাড়িতে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। ব্যালকনিতে শুকাতে দেওেয়া কাপড়গুলো গুছিয়ে রাখছে ওয়ারড্রোবে। রিপ্তি টবসহ দুটো গোলাপের চারা দিয়েছিল। মালিহা ব্যালকনির এক কোণায় রেখে দিয়েছে। মাঝেমধ্যে পানি দেয়। শুকনো কাপড় আনার সময় গোলাপ গাছগুলোয় চোখ যায় মালিহার। কাপড় গুছিয়ে পানি নিয়ে আসে গাছে দেওয়ার জন্য। পানির অভাবে মাটির শুকনো খড়খড়ে হয়ে গিয়েছে।
নেতিয়ে পড়েছে গাছের পাতাগুলো। মালিহা আনমনে ভাবে, তার আর জাওয়াদের সম্পর্কটাও ঠিক পানি বিহীন গাছের নুয়ে পড়া পাতার মতো। গাছে যেমন দীর্ঘদিন পানি না দিলে একসময় জীবিত থেকে মৃত হতে সময় লাগবে না। তেমনিই তাদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটাও কেমন ক্ষয় হতে হতে একসময় নিঃশেষ হয়ে যাবে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মালিহার। সে তো এমন বিষাদ বিষণ্ণ সম্পর্ক চায়নি। স্বামীকে ভালোবাসবে, তার ভালোবাসার রঙে নিজেকে রাঙাবে বলেই তো কত প্রেম প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। অশ্রুরা বাধ ভেঙে গড়িয়ে পড়তে চায়। সন্তপর্ণে ওড়নার কোনা দিয়ে মুছে নেয় মেয়েটি। সে নিজের আবেগ অনুভূতি এ পৃথিবীবাসিকে জানাতে চায় না।
নিঃশব্দে মালিহার পাশে গিয়ে দাড়ায় জাওয়াদ। শেষ বিকেলের একফালি তেজ হীন রোদ মালিহার চোখেমুখে আছড়ে পড়ে। স্বর্ণের মতো জ্বলজ্বল করে ওঠে মুখশ্রী। জাওয়াদ সে শুভ্র বর্ণের একুশ বর্ষীয়া মানবীটির দিকে তাকিয়ে থাকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে। মেয়েটি দারুণ সুন্দর। একথা অমান্য করতে পারে না জাওয়াদ।
নিজের পাশে জাওয়াদের উপস্থিতিতেও নিরব নির্লিপ্ত থাকে মালিহা। স্থান ত্যাগ করার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই জাওয়াদ পিছন থেকে মালিহার হাত টেনে ধরে। সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে মালিহার। এতদিন এক রুমে অবস্থান করলেও দূরত্ব ছিল আকাশসম। জাওয়াদ তার কখনও স্পর্শ করেনি। আজ হঠাৎ জাওয়াদের স্পর্শে শিহরণ জাগে শরীরে। মালিহা চলন থামিয়ে স্থির হয়ে দাড়িয়ে পড়ে। জাওয়াদ ইতস্তত করে বলে ওঠে, “আমার একটি কথা রাখবে মালিহা?”
জাওয়াদের কন্ঠে আকুলতা। মালিহা শক্ত হতে গিয়েও পারে না। কিন্তু নিজ থেকে একটি শব্দও উচ্চারণ করে না।
মালিহার নিরবতায় হতাশ হয় জাওয়াদ। কিন্তু হাল ছাড়ে না। পুনরায় বলে, “আর দুটো দিন তোমাকে জ্বালাবো। এরপর তো চলেই যাচ্ছি। এছাড়াও আমার মিশনে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। কবে ফিরব সঠিক বলতে পারি না। আজকের সন্ধাটা যদি আমার সাথে কাটাতে বলি খুব কি অন্যায় করে ফেলব?”
মালিহা সাথে সাথে উত্তর দেয় না। সময় নিয়ে ভাবে। এ বাড়িতে তাকে আজীবন থাকার জন্যই পাঠানো হয়েছে। বিসর্জন দিতে হয়েছে ছোট থেকে বড় হওয়া আত্মসম্মান। আজ হোক, কাল হোক এই জাওয়াদকে নিয়েই তাকে থাকতে হবে। যতই সে ঘৃণার পাত্র হোক। তাদেরও সংসার হবে। হয়তো অন্যদের মতো ভালোবাসায় মোড়ানো নয়। নিজেকে ধাতস্থ করে মালিহা জবাব দেয়, “আচ্ছা।”
জাওয়াদের সুশ্রী মুখশ্রীতে হাসি ফুটে ওঠে। বিস্তৃত হয় সে হাসি। ফলে সুন্দর মুখখানার ডান গালে খানিকটা ডেবে যায়। মালিহার চোখ যায় সেদিকে। ছেলেটির বাহ্যিক সৌন্দর্য যেকোন নারীকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। কিন্তু মনটা যে কলুষতায় ভরা। চোখ সরিয়ে নেয় মালিহা। ততক্ষণে হাতের বাধন শীথিল হয়। মালিহা ছাড়া পেয়ে ব্যালকনিতে ছাড়ে।
মাগরিবের পরে মালিহাকে নিয়ে বেড়য় জাওয়াদ। মালিহা ভয়ে জবুথবু হয়ে থাকে। জাওয়াদকে তার কেমন যেন লাগে। ঠিক ভরসা করে উঠতে পারে না। বাতাসের তীব্র ঝাপটা এসে মালিহাকে ছুয়ে যায়। স্প্রীডে বাইক চলতে থাকে। রাস্তায় মোড় বাধলেই ঢুলতে থাকে মালিহা। বাইকে চড়ার অভ্যাস তার একদমই নেই। ফলে পড়ে যাওয়ার ভয় তো রয়েছেই। রাস্তার এক কোণায় বাইক দাড় করায় জাওয়াদ। হেলমেট খুলে পিছন ঘুরে বলে, “আমার কাধটা ধরে বসো প্লিজ! নাহলে যেকোনো সময় দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।”
মালিহা ইতস্তত করে জাওয়াদের কাধে নিজের হাত রাখে। জাওয়াদ পুনরায় বাইক স্টার্ট দেয়। সাঁই সাঁই করে বাইক চলতে থাকে। মালিহা চেপে ধরে থাকে জাওয়াদের কাধ। জাওয়ার মুচকি হাসে। মেয়েটি বড়ই ভীতু। সুন্দর মেয়েরা কেন যেন একটু বেশিই ভীতু হয়।
আজকাল রেস্টুরেন্ট মালিকেরা বেশ ব্যবসা খুলে নিয়েছে। নদী কিংবা হাওরের পাশ ঘেঁষে রেস্টুরেন্ট দেখা যায় অহরহ। নদীর নির্মল বিশুদ্ধ বাতাসের লোভে সেসব রেস্টুরেন্টে ভীরও হয় বেশি। জমজমাট পরিবেশ। কিন্তু একটু লাভ করতে গিয়ে আদতে ক্ষতিটা হয় নদীরই। যার ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হয় নদী তীরে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর। রেস্টুরেন্টের নোংরা গুলো তো সব নদীতেই যায়। এতে নদীর পানি হয় নোংরা। মাছও থাকে না। একসময় খড়স্রোতা নদী রুপান্তিত হয় ম”রা নদীতে। সেরকমই একটা রেস্টুরেন্টে আসে জাওয়াদ মালিহাকে নিয়ে।
রুফটপের কর্ণারে একটি বেতের ডেকোরেশন করা চেয়ারে জাওয়াদ বসে। এগিয়ে দেয় আরেকটি চেয়ার মালিহার দিকে। ফুরফুরে বাতাস বইতে থাকে। জুনের প্রচণ্ড গরমে এ বাতাস বড়ই স্বস্তির। মেনুকার্ড নিয়ে ওয়েটার আসে। জাওয়াদ মালিহার দিকে বাড়িয়ে দেয় মেনু কার্ড। মালিহা কিছুই খেতে চায় না। জাওয়াদ নিজের পছন্দমতো কিছু খাবার অর্ডার করে। খাবার আসতে সময় লাগবে। মালিহা আশপাশ দেখতে থাকে। আর জাওয়াদ মিষ্টি রঙা হিজাবে আবৃত মালিহা দেখতে থাকে। জাওয়াদ কালো প্যান্টের সাথে সাদা শার্ট পড়ে এসেছে। শুভ্র লোমশ হাতে কালো রঙের ঘড়ি। শার্টের কলারে রোদ চশমা গুজে রাখা। অদূরে বসা দুটো মেয়ের নজর তার দিকেই।
“মালিহা?” হঠাৎ আদুরে স্বরে ডেকে ওঠে জাওয়াদ।
মালিহা তাকায় সেদিকে। পকেট থেকে একটা নীল রঙের ছোট্ট বক্স বের করে জাওয়াদ। ফের বলে, “হাতটা দেখি!”
বিনাবাক্যে হাত বাড়িয়ে দেয় মালিহা। জনসম্মুখে কোনরকম ঝামেলা চায় না সে। দেখা যাবে হাত দিতে না চাইলেই জোরাজুরি শুরু করে দিবে লোকটা।
জাওয়াদ সিম্পল ডিজাইনের চকচকে সাদা পাথরের একটি আংটি পড়িয়ে দেয় মালিহার হাতে। পরক্ষণে বলে, “পছন্দ না হলেও খুলো না প্লিজ!”
দফায় দফায় লোকটা শুধু রিকুয়েস্ট করে যাচ্ছে মালিহাকে। বিস্মিত হয় মেয়েটি। লোকটা তাকে হীরের আংটি দিয়ে ভোলাতে চাইছে নাকি? মেজাজ গরঞ হতে চেয়েও হয় না। নিজেকে শান্ত রাখে মালিহা।
খাবার শেষ করে মালিহাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে জাওয়াদ। বাইকে উঠে বসে মালিহা। এবার আর ভুল হয় না মালিহার। বাইক স্টার্ট দেওয়ার আগেই জাওয়াদের কাধ আকড়ে ধরে।
রাগে অনুরাগে পর্ব ৮
এখানকার কিছুই চেনা নেই মালিহার। বাইক থামে অচেনা এক জায়গায়। বেশ বড় এড়িয়ে নিয়ে দালানকোঠা নির্মিত। চারপাশে ইটের দেওয়ালে ঘেরা। বড় বড় আমগাছে ঘিরে রেখেছে রাস্তাটা। মালিহার ভয় হয়। একেতো রাত তার ওপর অচেনা অজানা স্থান। কপাল বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে মেয়েটির। আকড়ে ধরে জাওয়াদের হাত। ঢোক গিলে শুধায়, “কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
জাওয়াদ হাসে। অন্ধকারে সে হাসি মালিহার চোখে ধরা দেয় না। জাওয়াদ বলে, “সারপ্রাইজ!”