রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ১৩
সিমরান মিমি
দিনের প্রথম অংশ মাত্র আলোড়ন সৃষ্টি করে ধরণীতে বিরাজ করছে।সূর্যের আলোক রশ্মি গুলো একে একে প্রখর হয়ে তীব্রভাবে বিধে যাচ্ছে চোখে।উফফফ!এমন কেন হচ্ছে।রুমের মধ্যে আলোর তীব্রতা এতটা প্রখর হলো কি করে?ফোলা ফোলা লাল চোখ দুটো বেশ বেগ পেতে হলো খুলতে।চোখের নিচে অশ্রুকণা গুলো শুকিয়ে দাগ হয়ে আছে।পুরোপুরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই চোখের সামনে সূর্য দৃশ্যমান হলো।তড়িৎ বেগে উঠে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকালো স্পর্শী।এটা ছাদ।তার মানে গতকালে এখানেই কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে।দ্রুতপায়ে নিচে নামতেই দেখলো সিঁড়ির গোড়ায় উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে পিপাসা।স্পর্শী ধীর পায়ে মায়ের কাছে গেল।তার পাশে বসে সান্ত্বনা সরুপ সাজালো মিথ্যে কথার ঝুড়ি।বললো,
“মা,আর্শির খোঁজ পেয়েছি।যে ছেলেটা মারা গেছে ওর বড় ভাই’ই নিয়ে গেছে রাগ করে।ওই ছেলেটা ভালো।ও আর্শির কোনো ক্ষতি করবে না।আমার সাথে কাল কথা হয়েছে।বলেছে,আমি যদি প্রমাণ করতে পারি আমি নির্দোষ, তাহলে ছেঁড়ে দেবে।”
শান্ত চোখে স্পর্শীর দিকে তাকালো পিপাসা।থুতনিতে আঙুল দিয়ে স্পর্শীর নিচু মুখটাকে আরেকটু উঁচু করলো। বললো,
“কিভাবে প্রমাণ করবি?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
ঢোঁক গিললো স্পর্শী।বললো,”আমি পিয়াশের বন্ধুদের কাছে প্রয়োজনে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইবো।”
মাথা নাড়িয়ে উঠলো পিপাশা।বললো,”হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাই যা।গিয়ে দেখ ওদের মনটা একটু গলে নাকি।ভালো করে একটু নরম মাফ চাইবি।যেন মায়া হয় ওদের।আচ্ছা,আমিও আসবো নাকি তোর সাথে?”
মাথা নাড়িয়ে স্পর্শী বললো,”দরকার পড়বে না।”
এরপর কোনোরুপ বাকবিতন্ডায় না জড়িয়েই রুমে প্রবেশ করলো স্পর্শী।গায়ের পোশাক চেঞ্জ করে টেবিল থেকে ঢকঢক করে পানি খেল।হাতের ফোন’টা টিপতে টিপতে গেটের বাইরে বের হলো।অনন্দার নামবারে কল করতেই ওপাশ থেকে রিসিভড হলো।মুহুর্তেই শান্ত গলায় স্পর্শী বললো,
“একটা হক স্টিক বের করে হলের সামনে দাঁড়া। পিয়াশের রুমমেট তিনটার কাছে হাত জোড় করে মাফ চাইবো।আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।
রিকশা থামতেই দ্রুতপায়ে নেমে পড়লো স্পর্শী।প্রীতিলতা হল থেকে পুনরায় নজরুল হলে যাওয়ার জন্য রিকশায় উঠলো।সঙ্গে অনন্দাও আছে। ইতোমধ্যে অনেকেই তাকে কনগ্রাচ করেছে মুক্তি পাওয়ার জন্য।কিন্তু স্পর্শী নির্জীব।বয়েস হলের সামনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে উঠতেই দাঁরোয়ান এগিয়ে এলো।আলতো হেসে বললো,
” আরে, তোমরা এইখানে আসছো কেন?এইডা তো ছেলেদের হল।মেয়েদের হল একদম মেইন গেট দিয়া ঢুইকা বাম সাইডের রাস্তার প্রথম বাম দিকের গলিটায়।”
স্পর্শী তাকে অবজ্ঞা করে এগিয়ে এলো সামনে।রিসিপশনের লোকটার কাছে আসতেই লোকটা চিনতে পারলো।সবিনয়ে বললো,”তুমি ছাড়া পেয়েছো খুশি হয়েছি।কিন্তু আপাতত কিছুদিন ভার্সিটিতে এসো না।ভালো হবে।কিন্ত তুমি তো সোজা সেই হলের সামনেই আসলা।এখানে আসলে তোমার উপর সন্দেহ বাড়বে স্পর্শী সরদার।”
‘পিয়াশের রুমমেট তিনজন’কে একটু বাইরে ডেকে দিন ভাইয়া। আমি একটু কথা বলবো।ভীষণ দরকার।প্লিজ!’
স্পর্শী অনুরোধ করে বললো।
আলতো হেসে দাঁড়িয়ে পড়লো লোকটা।সবিনয়ে বললো,’সেকি। ওরা তো হলে থাকে না। খুন হওয়ার পরের দিন’ই হল ছেড়েছে।’
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো স্পর্শী।বললো,”তিনজন’ই একি দিনে?অদ্ভুত!
কিছুক্ষণ চিন্তা করে হুট করে বললো,”ভাইয়া,গ্রাউন্ড ফ্লোরের এপাশে -ওপাশে তো দুটো সিসি ক্যামেরা আছে।প্লিজ আমাকে ওইদিনের রাতের ফুটেজ টা একটু দেখান।খুব প্রয়োজন।
লোকটি কিছুটা আফসোসের স্বরে বললো,’দেখো স্পর্শী । তুমি একটু শান্ত হও।ফুটেজ অলরেডি দেখেছে পুলিশ।সেখানে স্পষ্ট’ই দেখা গেছে ওরা তিনজন রাত দশটা ছেচল্লিশ এ হলের বাইরে গেছে আর তিনটা পঞ্চাশ এ ফিরে এসেছে।এরপর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কর্তৃপক্ষ কে বিষয় টা জ্ঞাত করেছে। ওরা কোনোভাবে দোষী নয় ;কারন খুন করার সময়টাই ছিলো না।’
স্পর্শী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হেটে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। অনন্দা পাশেই তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।কিন্তু সেটা বেশ বিরক্তিকর ঠেকছে স্পর্শীর কাছে।তার বোন মিসিং।এই সান্ত্বনা দিয়ে সে কি করবে?আকাশের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ভেঙে কান্না করে উঠলো।দুহাত দিয়ে মুখ চেপে বসে রইলো কিছুক্ষণ।হুট করেই মনে কিছু আসতেই উঠে দাঁড়ালো।দুহাত দিয়ে চোখ মুছে পুনরায় ছুটলো হলের দিকে।রিসিপশনের লোকটিকে আবারো ঘিরে ধরলো তার একের পর এক প্রশ্নের ভীড়ে।বললো,
“আমাদের হলে তো লিফটের সামনে সিসি ক্যামেরা আছে। এমনকি প্রতিটা ফ্লোরের একদম প্রবেশ পথে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে।তাহলে ছেলেদের কেন এই ব্যাবস্থা নেই?’
লোকটি শান্তভাবে বললো,’ছেলেদের ও আছে।সবার ক্ষেত্রেই সেম সিকিউরিটি। শুধুমাত্র নতুন নির্মিত কয়েকটা ভবনে নেই।কিন্ত তা দিয়ে তুমি কি করবে?’
স্পর্শী ঠাণ্ডা মেজাজে গম্ভীর কন্ঠে বললো,’পিয়াশের ফ্লোরের এবং লিফটের ফুটেজ দেখবো আমি।আচ্ছা ওগুলো কি পুলিশ দেখেছে?’
মাথা নাড়িয়ে না সূচক উত্তর দিলো লোকটি।বললো,” না, দেখেনি।কিন্তু তুমিও দেখতে পারবে না।হলের ভেতরের ফুটেজ গুলো পার্সোনাল।বিনা অনুমতিতে ওগুলো তোমায় দেখিয়ে আমার চাকরি ক্ষুয়াবো নাকি?তুমি এখন আসতে পারো।”
হুট করে এই ব্যাবহার টা ভালো ঠেকলো না স্পর্শীর।যদিও লোকটি কিছু ভুল বলে নি ;কিন্তু তাও স্পর্শীর ভালো লাগলো না।মৃদু হেসে ভ্রুঁ উঁচিয়ে বললো,’অনুমতি লাগবে?ওকে আনছি।ওয়েট করুন।
পুনরায় হলে পুলিশ হাজির করলো স্পর্শী।কর্তৃপক্ষের বিষয়টা ভালো ঠেকলো না।এই নিয়ে অগণিত বার পুলিশ আসছে তাদের’ই ক্যাম্পাসে ;এটা যে তাদের রেপুটেশন নষ্ট করছে।ইনস্পেকটর স্পর্শীকে নিচু গলায় বললো,
“দেখো,ছেলেটা রুমে বসে গলায় ফাঁস দিয়েছে।আর আমাদের কাছে সেই ফ্লোরের বারান্দার ফুটেজ আছে।এই ফুটেজ দেখে খুব কি সুবিধা হবে?শুধু শুধু আমাকে আনলে।’
স্পর্শী ভাঙা গলায় বললো,” আমি জানি স্যার।কিন্তু আমার যে সন্দেহ হচ্ছে ভীষণ;নইলে আত্মহত্যার পরের দিনই তিনজন রুমমেট ‘ই কেন হল ছাড়বে।একবার দেখি।যদি কিছু পাই।
হার মানলো ইনস্পেকটর।একে একে দুটো লিফটের ভেতর বাহির দেখানো হলো। কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না।পরক্ষণেই ফ্লোরের বারান্দার ফুটেজ বের করলো।সন্ধ্যা থেকে টেনে টেনে দেখতে দেখতে হঠাৎ ই চমকে উঠলো সবাই।জুম করে আরেকবার রিপিট করতেই ধুম করে দাঁড়িয়ে পড়লো স্পর্শী।পিয়াশদের রুম থেকে কাঁপা হাতে দরজা ধরতে ধরতে বাইরে বের হলো রতন।অস্থির হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছিলো সে।উত্তেজনায় হাত থেকে পড়ে গেল একটা পানির বোতল।এরপর আচমকাই কয়েকপা ছুটে চলে গেল ফ্লোরের মাঝখানে উঠোনের ন্যায় জামাকাপড় শুকানোর জায়গায়।দুহাত দিয়ে দ্রুত স্টুডেন্টের মেলে রাখা জামাকাপড় ফেলে দিলো ফ্লোরে।রশি খুলে দৌড় দিলো আবারো রুমের মধ্যে।সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে গেল সে রুমের দরজা।আর এই পুরো ঘটনাটাই ঘটেছে ঠিক দশটা পঁয়ত্রিশ এ।স্পর্শী পুনরায় জুম করতে বললো।স্ক্রিন বড় হতেই বললো,
“ওটা পানির বোতল থাকলেও ভেতরে কিন্তু পানি নয়।কালো রঙের ঘোলা একটা তরল পদার্থ। সম্ভবত নেশাজাতীয় কিছু খাচ্ছিলো।’
ইনস্পেকটর বললেন,
” এই রশি’ই তো পিয়াশের গলায় পাওয়া গেছে।কিন্তু এটা দিয়ে ওই ছেলেটা কি করছিলো?’
স্পর্শী গম্ভীর কন্ঠে বললো, ‘জিজ্ঞেস করুন ওদের’কে।মৃত্যুর আগে বন্ধুকে গলায় ফাঁস দিতে হেল্প করছিলো কি ওরা;তাই জন্য কি নিজে থেকে রশি এনেছে।নাকি ফাঁস দিয়ে হত্যাটা ওরাই করেছে।
অপরাহ্ণের প্রথম প্রহর।ঘড়ির কাটায় মাত্র আড়াই টা।রতন বসে আছে লকাপের মধ্যে।অন্ধকার সেই কুঠুরি।আশপাশ থেকে একটুকু আলো র ও ছিটেফোঁটা নেই।শুধুমাত্র মাথার উপরে একটা ছোট্ট লাইট জ্বলছে। ছোট্ট একটা টেবিল।তার ওপাশে চেয়ারে বাধা আছে রতন।বামপাশে স্পর্শী নিস্পলক ভাবে তাকিয়ে আছে।ডান পাশে লাঠি হাতে এক পুলিশ এবং সামনেই ইনস্পেকটর। এ যাবৎ অগণিত মারলেও স্বীকার পায় নি সে।কিন্তু যখন ভিডিও ফুটেজ দেখানো হলো।ঠিক তখন’ই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।এবার আর বাঁচার উপায় নাই।কেন দড়িটা সেই আনতে গেল।উফফফস!ভুল।
পুনরায় মারতে উদ্যত হতেই রতন বললো,
“পিয়াশের সাথে কোনো শত্রুতা তাদের ছিলো না।কোনোকালেই না।বরং খুব ভালো বন্ধু তারা।যত খরচ লাগতো সব পিয়াশ দিতো।ওর বড়লোক ভাই হিসাব ছাড়াই টাকা দিতো।আর আমাদের পেছনেও ও হিসাব ছাড়া খরচ করতো।মদ,গাঁজা,ইয়াবা,ফেন্সিডিল, থেকে শুরু করে বিভিন্ন হাই কোয়ালিটি এবং এক্সপেন্সিভ মাদক দিয়ে নেশা করতাম আমরা।পিয়াশ ও আমাদের সাথে থাকতে থাকতে শিখে গেছিলো।এমনকি একটা পর্যায়ে ও আমাদের থেকেও বেশি নেশাগ্রস্ত হয়ে উঠলো।
প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে আমরা রুমের মধ্যে বসে নেশা করতাম।আবার দশটার পর বের হয়ে দিঘির পাড়ের জঙ্গল টাতে গিয়েও করতাম।ওইদিন ও সব ঠিক’ই ছিলো।ওই ভিডিও নিয়ে পিয়াশের কোনো মাথা ব্যাথা ছিলো না।আরে ওর লজ্জার ল ও নেই।ও তো দিব্যি আমাদের সাথে বসে নেশা করছিলো।চারজন’ই প্রায় ন’টা পর্যন্ত একটানা আমোদ-ফুর্তি করতে থাকি।হুট করেই সামনে থাকা সকল বোতল, ইয়াবা গুলো ও টেনে নিলো।নিজের বিছানার তলায় রেখে চেঁচিয়ে বললো,” আজ যখন স্পর্শী আমায় মারছিলো, তখন তোরা গিয়েছিলি আমায় বাঁচাতে।সামনেও তো যাস নি।আরো পালিয়ে গেছিলি।তোদের দেবো আমার টাকার কেনা মদ।জীবনেও না।নিজের টাকা দিয়ে কিনতে পারলে তারপর খাস।এখন আমি ওগুলো একা খাবো।
স্যার বিশ্বাস করেন,আমাদের কোনো হুশ জ্ঞান ছিলো না।অনেকটা নেশা হয়ে গেছিলো।ওই মাদক গুলো তখন পাওয়ার জন্য যা খুশি তাই করতাম।আর সেজন্যই আমরা ওরে ধরে বিছানার এপাশে এনে চেপে ধরি। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় যে যেভাবে পারছি ওকে বাধা দিয়ে মদ গুলো নিতে।ওইসময় বালিশ চাপা পরে ও মারা যায়।কিন্তু স্যার,আমরা নেশায় ছিলাম।মাফ করে দেন। হুশ ছিলো না।এরপর অনেক্ষণ পর বুঝলাম ও মারা গেছে।তখন কি করতাম বলেন।তাড়াতাড়ি কোনোভাবে রশি এনে গলায় পেঁচাইয়া ফ্যানের সাথে ঝুলাইয়া দিলাম।যাতে সবাই বোঝে, ওই ভিডিও র জন্য আত্মহত্যা করছে।কিন্তু শালার গায়ে এত্তো ওজন যে দুই মিনিটের মধ্যে ফ্যান ভাইঙ্গা নিচে পইরা গেছে। তারপর সব গুছাইয়া আমরা নরমাল হইয়া কোনোমতে হল দিয়া বের হইয়া গেছি।কিন্তু বিশ্বাস করেন,এটা ইচ্ছাকৃত ছিলো না।
রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ১২
ইনস্পেকটর ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারলেন। এরপর কনস্টেবলের উদ্দেশ্যে বললেন,
“বাকি দুটোকেও ধরে আনো।আমি এমপিসাহেব কে ফোন করছি। ‘