রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২২

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২২
সিমরান মিমি

কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে শামসুল সরদার। এই মেয়ের কাছে কোন কুক্ষণে সে পরিচয় জিজ্ঞেস করলো?ওর একবার ও ভয় লাগলো না এভাবে মুখের উপর কথা বলতে।ছোট ভাইয়ের বউয়ের সামনে যেন ভীষণ অপমানিত হলেন।আমতা-আমতা করে স্পর্শীকে ধমক দিয়ে বললেন,
“ষ্টুপিড মেয়ে।আমার তো তোমার বাবা কাছে নেই শুনে মায়া লাগলো,তাই জানতে এসেছিলাম।আর তুমিতো উলটো আমার সাথে ঝগড়া করছো।

স্পর্শী ভ্রুঁ কুঁচকে চাইলো।এরপর ঝগরুটে ভাব ধরে ইনিয়ে-বিনিয়ে বললো,
” আমার ও তো মায়া হয়েছিলো,”যখন দেখলাম আপনি আপনার স্ত্রীয়ের কথা শুনে রাগ করে আমাকে ধমক দিয়ে চলে গেলেন না খেয়েই।ভাবলাম হয়তো আপনার স্ত্রী আপনাকে ভীষণ অত্যাচার করে।যার কারনে তার নাম’টা শুনেও আপনার রাগ হয়,ভয় হয়।এইজন্যই তো জানতে চাইলাম।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আহাম্মক হয়ে গেল শামসুল সরদার।তাকে কি এই মেয়ে দুর্বল ভাবে যে বউকে ভয় পাবে।বউ শব্দটা মাথায় বিচরণ করতেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো।বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো বেদনায়।এখানে আর এক মুহুর্ত ও নয়।হনহন করে বের হয়ে গেল কক্ষ থেকে।যাওয়ার আগমুহূর্তে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঝরঝরে কন্ঠে বললেন,
“সোনালী,ওকে যেন রাতে আমার বাড়িতে আর না দেখি।কোনো অভদ্র মেয়েকে শামসুল সরদার আশ্রয় দেয় না।”
আঁতকে উঠলেন সোনালী।দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল স্পর্শীর নিকট।মাথায় হাত দিয়ে বললো,

“তুমি সত্যিই বড্ড বেয়াদব মেয়ে।একটা মানুষের দুর্বল জায়গা গুলো নিয়ে খুব’ই মজা নিতে ভাল্লাগে।তাই না?দেখছো ভাইজান রাগ করে তারপরেও বারবার একিই কথা।বড়দের সাথে এভাবে কথা বলে?শেখো নি কিছু আদব-কায়দা?এবারে কি করবে?উনিই তো বলেই দিলো তোমাকে আর রাখবে না।এবারে এবারে ভালোয় ভালোয় কাল সকালে বিদায় হও।কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে সংসারে অশান্তি করছো।”
বলেই দরজার দিকে ফিরে যাওয়ার প্রয়াস করলেন।কথাগুলো স্পর্শীর একদম বাম পাশ বরাবর লেগেছে।সে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে?হ্যাঁ বসেছেই তো।এতোটা অপমান,এতোটা অবহেলা সওয়া সত্ত্বেও কিছু প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য পড়ে আছে আবর্জনা হিসেবে।স্নিগ্ধ কন্ঠে কান্না চেপে স্পর্শী আবারো জিজ্ঞেস করলো,
“আনটি,কাল তো চলেই যাবো।আর বিরক্ত করবো না কখনো।একটু বলুন না,উনি কেন তার স্ত্রীয়ের নাম শুনলে রেগে যান।আর ওনার স্ত্রী ই বা কোথায়?”

পিছু ফিরে তাকালো সোনালী।স্পর্শীর টলমল করা অশ্রুসিক্ত চোখদুটো দেখে মায়া হলো ভীষণ। এগিয়ে এলো তার কাছে।ঘাড়ে হাত বুলিয়ে বললেন,
“ভাইজানের কথায় কষ্ট পেয়েছো?”
চোখ দুটো নিচু করে মাথা নাড়লো স্পর্শী।মুহুর্তে ‘ই দু-ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো ফ্লোরে।গলে গেলেন সোনালী। স্পর্শীকে বিছানায় বসিয়ে তার পাশে বসলেন।এরপর মুচকি হেসে বললেন,
“অন্যের ব্যাপারে জানার এত্তো ইচ্ছে।যে কেঁদেই ফেলেছো।শোনো মা,তুমি ভাইজান কে না জেনেই কষ্ট দিচ্ছো বারবার।উনি কখনো এভাবে কাউকে বকে না, আর নাতো কারন ছাড়া ধমক দেয়।উনার স্ত্রীর প্রতি প্রবল রাগ তার।এইজন্য রাগ করে,মনে করতে চায় না আগের ঘটনাগুলা।

এবাড়ির সবার বড় হচ্ছে ভাইজান।রাজনীতি করতো ছোট ভাই দুটোকে সাথে নিয়ে।জীবনের প্রথম নির্বাচনে এমপি ও হলো।তখন তার বয়স প্রায় ত্রিশ পেরিয়ে গেছে।সারাদিন ছেলেপেলে নিয়ে ঘোরে, বিভিন্ন ঝামেলায় থাকার কারনে বাড়িই আসে না মাসের মধ্যে এক দিন ও।ওই বাজারে থাকতো।ছেলেকে বাড়িমুখো করার জন্য আমার শশুর-শাশুড়ি মেয়ে পছন্দ করে বিয়ে দেয় সোভামের মায়ের সাথে।সংসার ভালোই চলছিলো।ভাইজান ও সংসারী হইছিলেন।কিন্তু তারপরেও প্রায়’ই রাজনৈতিক কাজে বাড়ির বাইরে থাকতেন।

এই ধরো সপ্তাহে দুই তিন বাড়ি আসতেন তাও একদম গভীর রাতে।কিন্তু সোভামের মায়ের মনে কি ছিলো কে জানে?এত সুখ,জীবনের প্রথম ওমন একটা ফুটফুটে ছেলে রেখে অন্য এক পুরুষের সাথে পালাইয়া গেল।জানো?সোভামের তখন বয়স মাত্র সাত মাস।আমি তখন নতুন বউ।বেশিরভাগ বাপের বাড়িতেই থাকতাম।ছেলেটা নাকি সারাদিন কান্নাকাটি করতো।এরপর সোভামের নানা-নানি নিয়া গেল তাদের কাছে।যদিও ভাইজান দিত না কিন্তু সোভামের মামীর ও তখন ওর বয়সী বাচ্চা ছিলো।এক সাথে দুধ খাওয়াইয়া মায়ের মতন পালবে দেইখাই ভাইজান দিছিলো।তাছাড়া রাজনীতির জন্য উনিও সময় দিতে পারতো না।

এরপর প্রায়ই ছেলেরে দেখতে যাইতেন, আবার বড় হবার সাথে নিজের কাছেও নিয়া রাখতেন।ভাইজান এরপর গম্ভীর হইয়া গেলেন।বাড়ি থেকে বিয়ার কথা বললেও রাগ করতেন।কিন্তু সোভামের যখন ছয় বছর তখন ভাইজান বগুড়ার এক মেয়েকে বিয়া করলেন।হুট কইরা ই এমন কাজ আমরা অবাক হয়ে গেছিলাম।কিন্তু খুশি ছিলাম।এর পর পিপাসা আসার পর ভাইজান যেন কেমন পরিবর্তন হইয়া গেলেন।সময়মতো বাড়ি আসে,কি সুন্দর হাসিখুশি ছিলেন।জানো তো? কাজে ফাঁকি দিয়াও উনি বাড়ি আইসা বইসা থাকতেন।কিন্তু সুখ হয়তো সইলো না।এরমধ্যে সোভামের মা’রে তালাক দিলো তার সেই স্বামী।এরপর আবার ছেলের দোহাই দিয়া আমাদের বাড়িতে উঠলেন।

সবাই এত্তো অপমান করলাম তাও শুনলো না।বেহায়ার মতো আসতেন যেতেন।সামনে নির্বাচন থাকায় ভাইজান ও তেমন কিছু বলতে পারলেন না।এর মধ্যেই ওই মহিলা আমাদের সবাইরে বললো ওরে নাকি লুকাইয়া আবারো ভাইজান বিয়া করছে।পিপাসা আমাদের সবার ছোট ছিলো।একদম ছোট্ট একটা মেয়ে।কি-বুঝ হইলো আল্লাহ ই জানে।ওইদিন রাতে সাড়ে তিন বছরের বাচ্চা টা নিয়া পালাইয়া গেল।এত্তো খুঁজলাম পাইলাম’ই না।কত্ত জায়গায় ভাইজান খুঁজলো।পাগলের মতো দৌড়াইলো।

রাজনীতি ছাড়লো কিন্তু পাইলো না।ওই বছরে’ই শিকদার বাড়ির আমজাদ শিকদার এমপি হইলো। এরপর সোভামের মা দশ বারোদিন বেহায়ার মতো পইড়া ছিলো বাড়িতে।কিন্তু যখন দেখলো ভাইজানরে দিয়া আর সুবিধার হইবে না, দিন রাত উনি পাগলের মতো সারা শহর পিপাসারে খুঁজতে থাকে তখন আর অপেক্ষা করলো।পরের সপ্তাহেই অন্য জায়গায় বিয়ে করলো।তখন আর ছেলের কথা মনেই করলো না।ছেলেটা কত্ত কান্নাকাটি করছে মার কাছে যাওয়ার জন্য কিন্তু নিলোই না।এরপর ভাইজান ধীরে ধীরে কঠিন হইয়া গেলেন।পিপাসারে আর খুঁজলেন না।ছেলে আর রাজনীতি নিয়ে পইড়া রইলেন আজ প্রায় উনিশ টা বছর।

এই তার স্ত্রীর উপর রাগের কারন।এখন তুমি যদি বারবার ওনারে এসব মনে করাইয়া দিয়া কষ্ট দাও তাইলে তো রাগ করবেই।”
দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে স্পর্শীর।চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে।চোখ দিয়ে অশ্রুরা একের পর এক বিসর্জন নিচ্ছে।কিন্তু নিঃশব্দে।উফফ!তার বাবা আজ কতগুলো বছর কষ্ট করছে।মায়ের কাছে তাও মেয়ে দুটো ছিলো।রাত হলে মেয়েদের জড়িয়ে কাঁদতে পারতেন,তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারতেন।কিন্তু বাবা?তার কাছে কি ছিলো?শুধুমাত্র কিছু স্মৃতি। ইচ্ছে করছে বাবাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে।কিন্তু এই মুহুর্তে সেটা সম্ভব নয়।স্পর্শী কান্না জড়িত কন্ঠে বললো,

“উনার দ্বিতীয় স্ত্রীর কি কোনো খোঁজ ই নেই?”
আফসোসের স্বরে সোনালী বললেন,”জানিনা,আদোও বেঁচে আছে কি না মরে গেছে মেয়েটাকে নিয়ে সেটাই জানিনা।ভাইজান কে বলছিলাম নিউজপেপার,টিভিতে বিজ্ঞপ্তি দিতে কিন্তু উনি রাজী হন নি।”
দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে বিছানায় পড়ে গেল স্পর্শী।সোনালীর উদ্দেশ্যে বললো,
“আনটি,আমার মাথা ব্যাথা করছে।আপনি যাওয়ার আগে দরজা’টা চাপিয়ে যাবেন প্লিজ।”
সোনালী আর কথা বাড়ালো না।ত্রস্ত পায়ে হেটে বেরিয়ে গেল দরজা চাপিয়ে।দ্রুত উঠে বসলো স্পর্শী।ফোন হাতে নিয়ে মায়ের নাম্বারে কল লাগালো।ক্রোধ এবং কষ্ট দুটোই অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌছেছে। ওপাশ থেকে রিসিভড হলো না।রেগে আবারো ফোন করলো।টানা চারবারের পর ওপাশ থেকে ফোন রিসিভড হতেই স্পর্শী চেঁচিয়ে উঠলো।বললো,

“এতোবার ফোন দিচ্ছি ধরছো না কেন?মেয়ের থেকেও কি তোমার কাছে পার্লার বেশি?”
অবাক হয়ে গেল পিপাসা।ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“কি হয়েছে তোর?এভাবে কথা বলছিস কেন মা?”
আর চেপে রাখতে পারলো না স্পর্শী।ফোন হাতে হাটু মুড়িয়ে বসে পড়লো ফ্লোরে।হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আম্মু,আম্মু-আব্বু বিয়ে করেনি। আব্বু এখনো বিয়ে করে নি।তোমার অপেক্ষায় বসে আছে সে।ওমা,তুমি এতো পাষান কেন?কি করে হতে পারলে পাষান।একবার ও মনে হলো না যে লোকটাকে ছুঁড়ে রেখে দিয়ে এসেছো সে কেমন আছে?কি করছে?আদোও বিয়ে করছে কি না নাকি তোমার জন্য আজ উনিশ টা বছর বসে আছে।
দুহাত দিয়ে চোখমুখ মুছে কঠোর গলায় বললো,

” তুমি এক্ষুণি গাড়িতে উঠবে।কালকের মধ্যে পিরোজপুরে আসবে বুঝেছো?তুমি তোমার স্বামীর সাথে স্বাভাবিক হও বা না হয় আমরা আমাদের বাবার কাছে থাকতে চাই।ওনাকে জড়িয়ে ধরতে চাই।সারাক্ষণ আব্বু বলে ডাকতে চাই।প্লিজ তুমি আসো মা।আব্বুকে বলে দাও আমরা দুজন তার’ই মেয়ে।আমি কিভাবে আব্বুকে নিজের পরিচয় দিবো?ওনাকে বললে উনি প্রমাণ চাইবেন আমার কাছে।বিশ্বাস করতে চাইবেন না।আমি পারবা না এসব।আমি পারবো না নিজের বাবার কাছে তার মেয়ে হওয়ার প্রমাণ দিতে।আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে বিশ্বাস করো।তুমি কাল আসবে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে”আমরা তার মেয়ে।”এরপর তোমার যা ইচ্ছা তুমি তাই করো।বাঁধা দিবো না।আরে তুমি যাবার এক সপ্তাহের মাথায় ই ওই মহিলার বিয়ে হয়েছে অন্যজায়গায়।আর তুমি তাকে জড়িয়ে আজ এতোগূলো বছর বাবাকে কষ্ট দিচ্ছো।”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২১

ওপাশ থেকে অনবরত কাঁদছে পিপাসা।নিজের উপর ই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।একদিকে বহু বছরের এক পাথর যেন বুক থেকে সরে গেল।ভেতরটা ভালো লাগায় ছেয়ে গেল,’তার স্বামী তার’ই আছে,অন্য কোনো নারীতে মজে নি।অন্যদিকে ভয় হচ্ছে।ভীষণ ভয়।কি করে দাঁড়াবে ওই মানু্ষ টার সামনে।নিজেকে বহু কষ্টে সামলে পিপাসা বললো,
“ওমা,আমি কি করে দাঁড়াবো ওই মানুষ টার সামনে?আমার যে ভীষণ লজ্জা করছে।”
স্পর্শী শুনলো না।পুনরায় কঠোর কন্ঠে বললো,
“কাল সকালে যেন তোমাকে সরদার বাড়িতে দেখি।এর অন্যথা হলে বিশ্বাস করো খুব খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলবো আমি।”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৩