রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৯
সিমরান মিমি
রৌদ্র প্রজ্জ্বলিত ধরনী।দিনের তৃতীয় প্রহরের সূচনা হয়েছে মাত্র।চেয়ারে হেলান দিয়ে একদৃষ্টিতে হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে আছে পরশ।সেই তালুতে অগাধ যত্নে আগলে রেখেছে একটা কানের দুল।সেটাকে বারংবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিচ্ছে। কপালের মাঝখানটায় চিন্তিত রেখাগুলো ভাঁজ খেয়ে পড়ে আছে।অদ্ভুত ব্যাপার!এই দুলটা সে তার টেবিলেই পেয়েছে। কিন্তু এটা কার হতে পারে?এ যাবৎ তিন জন কে এই দুলের কথা জিজ্ঞেস করলেও কেউ ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারেনি।বরং সবার’ই এক অদ্ভুত দৃষ্টি লক্ষ করেছে পরশ।প্রত্যেকেই এক সন্দেহের দৃষ্টিতে পরশকে অবলোকন করেছে।বিষয়টা বড্ড অপমান জনক।যার দরুন চতুর্থ ব্যক্তিকে আর জিজ্ঞেস করেনি।
এ যাবৎ আট/ন-বার পাভেল কে ফোন দিলেও সে কোনো রেসপন্স করছে না।বেশ কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল তাকে।তাও দোতলা থেকে নামছে।ভ্রুঁ কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে রইলো পরশ।বললো,
“এ যাবৎ কতগুলো ফোন দিয়েছি আমি?”
পাভেল নিরুত্তর।এক প্রকার বড় ভাইকে অবজ্ঞা করেই সোফায় চিৎ হয়ে পড়লো।আশ্চর্য হয়ে গেল পরশ।চেয়ার থেকে উঠে সোফার পাশে গেল। কান টেনে ধরে উঠাতেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো পাভেল।ছনছন করে ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“তুই সব সময় বিপদ গুলো আমার উপর চাপিয়ে দিয়ে নিজে ফ্রি থাকিস।তুই বিয়ে করবি না ভালো কথা,আমার কথা বলতে গেলি কেন?এখন বাড়ির সবাই আমাকে নিয়ে পড়ে আছে।বিয়েও ফাইনাল।আমার মাস্টার্স কম্পিলিট করার পরপর’ই বিয়ে।খুশি তুই?”
পরশ হেসে বললো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“দারুন ব্যাপার।এটা তো খুশির খবর।এভাবে মুখ গোমড়া করে আছিস কেন?তুই ই তো এতোদিন আমাকে বলতি যেন বিয়ে করে তোকে সূযোগ দিয়ে দেই।দিয়ে দিলাম।এখন আমার আগেই বিয়ে করে ফেল।”
পাভেল তীর্যক হাসলো।দাঁত কেলিয়ে বললো,
“তুই কি জানিস আমি আগে বিয়ে করলে শেষে তোকে আর কেউ বিয়ে করবে না।সবাই ভাববে বড় ভাইয়ের কোনো সমস্যা আছে বলেই ছোট ভাই বিয়ে করে ফেলেছে।”
পরশ পাত্তা দিলো না।হাতের এয়ারিং টা দেখিয়ে সন্দেহী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“এটা কার?পার্টি অফিসে কি কোনো মেয়ে আসছিলো?”
চমকে সোফা থেকে উঠে বসলো পাভেল।হাত থেকে এয়ারিং টা নিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো।এরপর জহুরি চোখে বললো,
“কাল থেকে আমার জানামতে চারজন মহিলা আসছিলো।এরমধ্যে একজন একদম বৃদ্ধ, আর দুইজন বাচ্চা নিয়ে আধমাঝারী বয়সের। দুল টা হোয়াইট স্টোনের।এরকম দুল নিশ্চয়ই ঐসব মহিলারা পড়বে না।তারমানে এটা ওই চতুর্থ মেয়েটার।”
পরশ ভ্রুঁ যুগল সামান্য কুঁচকালো।বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,
“এতোটা ভণিতা করতে বলি নি আমি।সোজাসাপটা জানলে বল।”
“আরে বাবা, এখনো বুঝিস নি নাকি?এটা শিকদার বাড়ির ভয়ঙ্কর মানবীর।যে তোকে চুল দাঁড়ি কাঁটতে দুশো টাকা দিছিলো।এমনকি চুল বাধাঁর জন্য নিজের মাথা থেকে হেয়ারক্লিপ ও খুলে দিছিলো।
থেমে উত্তেজিত হয়ে বললো,
” এই একমিনিট।দুল টা হয়তো মাথার ক্লিপ খুলতে গিয়ে পড়ে গেছিলো।বাই দা ওয়ে,তুই এটাকে এতটা যত্নে রাখছিস কেন?মনে হচ্ছে মূল্যবান হিরা পেয়েছিস।পেতেই পারিস,প্রেমিকার মাথার উঁকুন ও আজকাল প্রেমিকের কাছে জোঁনাকি পোকার মতো মনে হয়।সেখানে সামান্য একটা স্টোনের দুলকে হিরার দুল ভাবা কি অস্বাভাবিক কিছু নাকি?এটা খুবই নরমাল ব্যাপার।আমি কিছু মনে করছি না এতে।বাই দা ওয়ে ভাই,তোকে একটা সোনার সিন্দুক বানিয়ে দিব নাকি? হিরার দুল টাকে লুকিয়ে রাখার জন্য?”
আশ্চর্য হয়ে গেলো পরশ।হা হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।মস্তিষ্ক যেন হুট করে হোচট খেল।চোখ দুটো বারকয়েক বন্ধ করে কন্ঠকে খাদে নামিয়ে নিচু আওয়াজে বললো,
“সিরিয়াসলি?এসব উদ্ভট কথা-বার্তা তোর মাথায় আসলো কি করে?তুই এসব কিসব আবোল-তাবোল বলছিস?তাও আবার অফিসে বসে।কেউ যদি শুনে নেয় তখন কি হবে? এরকম ইয়ার্কি আমি মোটেও পছন্দ করি না পাভেল।ফার্দার এমন সব আউল-ফাউল কথা বললে থাপ্পড় খাবি।”
পাভেল চুপ হয়ে গেল।ভাই রেগে গেছে সেটা ভালো করেই বুঝতে পেরে গেছে সে।আমতা-আমতা করে সোফা থেকে উঠে বসলো।ইনিয়ে বিনিয়ে বসলো,
“তো তুই আমার ব্যাপারে এমন সব উদ্ভট কথা বলিস কেন?নিজে বিয়ে করবি না ভালো কথা,তাই বলে আমাকে বিপদে ফেললি কেন?তুই একটা হু উচ্চারণ করলেই আব্বু হ্যাঁ মেনে নেয়।অথচ আমি সারাদিন ঘ্যানঘ্যান করলেও আমার কথা শুনবে না।শুধু শুধু নতুন ঝামেলায় ফেললি।”
পরশ কাঠকাঠ কন্ঠে বললো,
“তো আমি তোর কথা বললেই তুই মেনে নিবি কেন?খাবার সময় চুপ ছিলি কেন?কেন বলিসনি পুরবী কে বিয়ে করবি না।”
পাভেল আড়চোখে ভাইয়ের দিকে চাইলো।এরপর কথা ঘুরিয়ে বললো,
“আচ্ছা বাদ দে।স্টোনের নিচে লাল লাল দেখেছিস।মে বি এটা স্বর্ণের।আমি বরং এটা আর্শিকে দিয়ে দিবো।তা না হলে দেখা যাবে ওর বোন এসে যুদ্ধ শুরু করে দিবে।বলবে তুই ওর দুল চুরি করেছিস।যে ভয়ংকর মহিলা।ওর কাছে অসম্ভব কিছু না।”
খপ করে পাভেলের হাত থেকে দুল টা নিয়ে নিলো পরশ।দুপা এগিয়ে গিয়ে শাসনের সুরে বললো,
“তুই কি ভেবেছিস? এই দুলের অজুহাত দিয়ে ওই মেয়েটার সাথে কন্টাক্ট করবি?নতুন করে আবার ঝামেলা পাকাবি?তোর ওই লুচ্চাগিরি ছুটিয়ে দিবো আমি।একটা কথা মনে রাখিস; পরশ শিকদার খুনের সাফাই গাইলেও লুচ্চামির সাফাই কখনো গাইবে না।বের হ এখন।তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে না।”
পাভেল চুপচাপ চোরের মতো বেরিয়ে গেল।এখনো সারা মুখে বিরক্তি ছেয়ে আছে পরশের।নিজেকে যথাসম্ভব কন্ট্রোলে নিয়ে ফাইল ঘাটতে লাগলো।কিন্তু মোটেও মন বসছে না।সামনেই উপজেলা নির্বাচন।দলের মধ্যে একজন যোগ্য প্রার্থীকে দার করাতে হবে যাতে জনগণের ভোটে জিততে পারে। এরপর একদম স্বীয় শাসনে পুরো পিরোজপুর (৩) এর চেহারা বদলে দেবে পরশ।প্রত্যেকটা গ্রামে পৌছে দেবে আধুনিকতার ছোঁয়া।যাতে কয়েক যুগ পরেও জনগণ তাকে নিয়ে গর্ব করে বলে,”এমপি একজন ছিলো,যিনি কিনা পুরো পিরোজপুর এর আদল বদলে দিয়েছেন।”
কিন্তু এই মুহুর্তে মোটেও এসব টানছে না পরশ কে।না চাইতেও স্পর্শীর সাথে পূর্বে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে।হয়তো পাভেলের অদ্ভুত কথাবার্তাগুলোর প্রভাব পড়েছে তার উপর।এটা মোটেও সুবিধাজনক নয়।এই মুহুর্তে মাইন্ডকে রিফ্রেশ করা প্রয়োজন।আর এর জন্য ঘুম টাই বেস্ট অপশন।
ধীর পায়ে উঠে গেল তিনতলায়।ভবনের দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত ছেলেপেলেদের বিচরণ থাকলেও তিনতলায় ওঠা নিষিদ্ধ। এখানে পরশ প্রায়শই থাকে।কারো আসার অনুমতি নেই।যেখানে পাভেল ই ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে ঢোকে সেখানে অন্যসবাই দুধভাত।নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমটাতে ঢুকে পাঞ্জাবি খুলে নিলো।হালকা ফ্রেশ হয়ে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। কোলবালিশ টা পাশে টানতেই মুঠো হয়ে থাকা হাতের দিকে নজর হলো।সেটাকে খুলতেই আশ্চর্যের চরম পর্যন্ত পৌছালো পরশ।হাতের মধ্যে এখনো সে দুলটাকে মুঠোভর্তি করে রেখেছে।তখন পাভেলের থেকে আনার পর এখনো এটাকে ফেলে দেওয়া হয়নি।নিজের উপরেই রাগ উঠলো ক্রমশ।বিরক্তির সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছে ছুঁড়ে রুমের কোনায় ফেলে চোখ বন্ধ করে নিলো।
ক্লাবঘর।একপাশে ক্রাম,অন্যপাশে তাস,অন্যপাশে কেউ কেউ মধু টানছে ছেলেপেলেরা।পাভেল হতাশ হয়ে ভেতরে ঢুকলো।তাকে দেখতেই হইহই করে উঠলো।কেউ বললো,
“আরে পাভেল ভাই যে,আসেন ক্রাম খেলি।আপনার সাথে অনেক দিন খেলা হয় না।”
আবার কেউ কেউ বললো,
“পাভেল আসো,দু দান চালো তো।দেখি আমারে হারাইতে পারো কি না।”
আবার সমবয়সী কেউ কেউ বললো,
“আরে এদিকে আয়।দুই একটা টান মার।অমৃত ভাই,নতুন আইছে।দেখা মাত্রই সুজন ভাই নিয়া আইছে।”
পাভেল কারো কথা শুনলো না।হতাশ হয়ে চেয়ারে বসে বললো,
“নাহ রে।ভাই রেগে গেছে আমার উপর।এখন যদি আবার এসে দেখে তাস খেলছি বা তোদের সাথে নেশা করছি তাহলে আজকে আমাকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না।আমি বরং একটু উপরে যাই।এখন আমার জন্য সেফ জোন এই ক্লাবঘর টাই।বাড়িতেও একটু শান্তি নাই।”
সবার সামনে একটু দুঃখ প্রকাশ করে হতাশ ভঙ্গিতে টোঙে উঠলো পাভেল।ক্লাবঘর টা কাঠের।তবে বেশ শক্তপোক্ত। উপরে মাঁচার সাথে ঘরের পেছন দিকে টোঙ পাতা রয়েছে বেলকুনির মতো।সেদিকে পা বাড়াতেই ফোন বেজে উঠলো।আননৌন নাম্বার।কিন্ত অবাক হলো না সে।কারন এটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।ফোন রিসিভড করে সালাম দিতেই ওপাশ থেকে রিনরিনে কন্ঠে বলে উঠলো,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।আপনি আমার কন্ঠ চিনতে পেরেছেন?এটা আমার নাম্বার।আমি তো ভাবলাম পারবেন না।”
ভ্রুঁ কুঁচকে ফেললো পাভেল। সোজাসাপ্টা কন্ঠে বললো,
“আপনি কে?”
মনোঃক্ষুণ্ণ হলো ওপাশের কিশোরী।কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিলো।আলতো স্বরে বললো,
“ওহ, চিনতে পারেন নি?আমি বলছি।”
এমনিতেই মন -মেজাজ ভালো নেই পাভেলের।তার উপর এতোটা হেয়ালি সহ্য হলো না।ধমক দিয়ে বললো,
“সেটাই তো জানতে চাইছি।আমি টা কে?”
?
বিষাদে ছেয়ে গেল কিশোরীর অন্তর।চোখ দুটো হয়ে গেল টইটম্বুর। পাভেল ভাই তাকে ধমক মারলো?কই এর আগে তো কি সুন্দর করে কথা বলতো।তাহলে এখন এমন করলো কেন?নিমিষেই অপমানিত হয়ে কেটে দিলো ফোন।অভিমানে গাঢ় হলো হৃদয়।সে আর ফোন করবে না এই পাষাণ পুরুষকে।যার ইচ্ছে হলো সুন্দর করে কথা বললো, আবার ইচ্ছে হলো ধমক মারলো।
রাগ করেছে আর্শি।সাথে প্রগাঢ় অভিমান।কিন্তু এই অভিমান কি ওপাশের পুরুষ বুঝতে পেরেছে?নাহ,পারেনি তো। এটা তো নতুন নাম্বার।সে তো জানবেই না নাম্বার টা কার?সেখানে অভিমান তো দুরের কথা।কিন্তু নাহ,এটা তো হওয়া উচিত না।তাকে বুঝতে হবে আর্শি তার উপর রাগ করেছে।নইলে তো এই রাগ বৃথা।এর কোনো মূল্যই থাকলো না।অনেক ভেবেচিন্তে আর্শি ফোন টা আবার হাতে নিলো।গুটি গুটি অক্ষরে লিখলো,
“আমি আর্শি। ”
ব্যাস এটুকুই।এরপর আরো কিছু লিখেও সেটা ডিলিট করে দিয়েছে আর্শি।কেননা সে বাক্য গুলো মোটেও মানানসই ছিলো না।
মেসেজ পেয়েই চমকে গেল পাভেল।পুণরায় কল লাগালো নাম্বারে।এতোক্ষণের রাগ,অভিমান কে যেন বুড়ে আঙুল দেখিয়ে দিলো আর্শির মন।কল ঢোকার সাথে সাথে ঝাপিয়ে পড়লো ফোনের উপর।রিসিভড করে ধরে রাখলো কানে।নিরবতা ছেঁয়ে গেল দুপাশে।পাভেল শান্ত কন্ঠে বললো,
“এটা কার নাম্বার?”
আর্শি গম্ভীর কন্ঠে অভিমান জড়িত গলায় বললো,
“আমার’ই।আব্বু কিনে দিয়েছে সকালে।আপু আর আম্মু সকালেই ঢাকায় চলে গেছে।ভাবলাম,আপনি যদি আবার আপুকে ফোন করেন ;তাহলে তো ও বুঝে ফেলবে।তাই আমার নাম্বার টা দিয়ে রাখলাম।ফোন করলে এখানেই করবেন।”
কপালে ভাঁজ পড়লো পাভেলের।প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো পুণরায়।বললো,
“তোমাকে কেন ফোন দেব?”
বুকের ভেতর টা কেমন করে উঠলো আর্শির।অপমানে দগদগে ক্ষত হয়ে গেল বাঁ পাশটায়।সেও প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো পাভেল ভাইকে। বললো,
“সেদিন কি জন্য ফোন দিয়েছিলেন আপুর নাম্বারে?সেজন্যই না হয় দিবেন।”
চমকে উঠলো পাভেল।আমতা-আমতা করে বললো,
“সেদিন তো ওই এমনিই ফোন দিয়েছিলাম।তুমি অন্য কিছু ভাবছো কেন?”
আলতো হাসলো আর্শি।শান্ত কন্ঠে বললো,
“এমনিতে তো দেন নি পাভেল ভাই।আপনি ফোন দিয়েছিলেন আমায় ম্যানেজ করতে।যাতে আমি আব্বুকে কিছু না জানাই।আর নাতো আপনারা কোনো ঝামেলায় না পড়েন।”
চুপ করে রইলো পাভেল।মেয়েটা সামনাসামনি বোকাসোকা,সরল-সোজা ভাব দেখালেও ভেতরে ভেতরে ঠিক’ই বোনের মতো মিচকা শয়তান সেটা ভালো করেই টের পেলো।তবে সে যে তার উপর সামান্য হলেও দুর্বল হয়ে পড়েছে সে ব্যাপারেও নিশ্চিত সে।
পাভেলের নিরবতা আর্শিকে দ্বিগুণ যন্ত্রণা দিলো।পুনরায় শান্ত কন্ঠে বললো,
“ভয় পাবেন না। আব্বুকে কিচ্ছু বলবো না।আমি ওই ঘটনাগুলো ভুলে গেছি।রাখছি,বিরক্ত করার জন্য সরি।”
বলেই ফোন কেটে দিলো।অবাক হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো পাভেল।তারপর পর’ই মাথা থেকে ঝেড়ে নিলো সব।
আর্শি মুখ চেপে কান্না করে দিলো । ভীষণ খারাপ লাগছে তার।কেন সবসময় তার ভাবনা গুলোই ভুল হয়।কেন তাকে সবাই ব্যাবহার করে?প্রথমে তো আপুকে ভয় দেখানোর জন্য গোটা তিন দিন তাকে আটকে রাখলো।এখন আবার তাকে ব্যাবহার করেই সেই ঝামেলা মেটাতে চাইছে।কেন?
পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো।এসব ব্যাপারে সে মোটেই আর ভাববে না।সামনে পরিক্ষা।খুব ভালো করে পরিক্ষা দেবে সে।বই আনেনি তো কি হয়েছে?তাই বলে সে কি পড়তে পারবে না?অবশ্যই পারবে। সে জিহানের বই নিয়ে পড়বে।
বিশাল জনসমাবেশ।অকাতরে বক্তৃতা দিচ্ছে পরশ।এরমধ্যেই ফোন হাতে ছুটে এলো পাভেল।হাতের ফোন তার সামনে দিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“অনেকক্ষণ ধরে এই মেয়ে ফোন দিচ্ছে। কেঁটে দিয়েছি বেশ কয়েকবার।কিন্তু তাও থামেনি।ধরে জিজ্ঞেস করলাম’ফোন দিচ্ছো কেন?’বললো,’আর্জেন্ট। ‘
পরশ অবাক হয়ে গেল।স্পর্শীয়ার নম্বর থেকে ফোন আসছে বারবার।অদ্ভুত। রিসিভড করা ফোন কানে আনতেই ওপাশ থেকে কান্নার স্বর ভেসে আসলো।পরশ চমকে গেল।এই মেয়ে তো কখনো কাঁদে না।তাহলে এমন করে কাঁদছে কেন?কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” এই মেয়ে, কাঁদছো কেন?কি হয়েছে?”
ওপাশ থেকে অনবরত কেঁদেই চলেছে স্পর্শী।সে কি কান্না!কলিজাটা ধুঁক করে উঠলো পরশের।নেমে গেল স্টেজ থেকে।ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“আরে বলছো না কেন?কি হয়েছে?কাঁদছো কেন?”
স্পর্শী কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমাকে প্লিজ বাঁচান।আমি মরে যাবো।প্লিজ বাঁচান।”
চমকে গেল পরশ।কি হয়েছে স্পর্শীর।কোনো বিপদে পড়েছে কি?আর তাকেই বা কেন ফোন করেছে?সেকি তাকে এতোটাই বিশ্বাস করে যে এতটা বিপদেও তার কাছে সাহায্য চাইছে।উত্তেজিত কন্ঠে বললো,
“তুমি কোথায় আছো?কি হয়েছে?এড্রেস টা বলো।”
ওপাশ থেকে নিরবতা ভেসে আসলো।ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে গেল পরশ।বারংবার ডাকতে লাগলো ‘স্পর্শী ‘বলে।কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো উত্তর আসছে না।কেটে গেল ফোন।এরপর বারকয়েক ওই নাম্বারে ফোন দিলেও কানেক্ট করতে পারছিলো না পরশ।পরক্ষণেই একই নাম্বার থেকে কল আসলো।।হঠাৎ ই নতুন কন্ঠের কোনো এক পুরুষ হ্যালো বললো।অবাক হলো পরশ।বললো,
“আপনি কে?ওর ফোন আপনি কেন ধরেছেন?ওর কাছে দিন।”
কিন্তু পুরুষটি দিলো না।বললো,
“দেখুন ওনার কললিস্টের শুরুতেই আপনার নাম্বারটা ছিলো বিধায় আমি আপনাকে কল করেছি।উনি তো এক্সসিডেন্ট করেছেন বাসের সাথে।অবস্থা খুব’ই খারাপ।হস্পিটালে এনেছি।কিন্তু ডাক্তার বলেছে উনি মারা গেছেন।তাই জানালাম।
বাক হারা হয়ে গেল পরশ।উত্তেজিত হয়ে বললো,
” আমি এক্ষুনি ওর সাথে কথা বললাম।আর আপনি এসব কি আবোল তাবোল বলছেন?ওর হাতে ফোন দিন।”
দিলো না লোকটি।হাসতে শুরু করলো বিকট ভাবে।কি বিচ্ছিরি জ্বালাময়ী সেই হাসি।দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলো পরশ।শুনতে পারছে না এই শব্দ।ফোনটাকে ছুড়ে ফেলে দিলো মাঠে।ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল সেই ফোন।কিন্তু তাও থামছে না সেই শব্দ।মাথা যন্ত্রণা উঠেছে ক্রমশ।চিৎকার করে উঠলো।
সারা গা ঘেমে নেয়ে গেছে পরশ।চারপাশে অন্ধকার।মাথা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।দ্রুতপায়ে উঠে লাইট জ্বালালো।মুহুর্তে উ নিজেকে আবিষ্কার করলো পার্টি অফিসের তিনতলার সেই প্রাইভেট রুমে।কোথাও নেই সেই জনসমাবেশ।নেই সেই চিৎকার।ফোন টা পরে আছে বিছানার এক পাশে।তাও অক্ষত।তাহলে কি এসব স্বপ্ন দেখছিলো সে?শরীর টা নুয়ে পড়েছে।পাগল পাগল লাগছে।দিনের বেলায় এমন জীবন্ত স্বপ্ন পুরোপুরি নাড়িয়ে দিয়েছে।শরীর টাকে ছেঁড়ে দিলো বিছানায়।চোখ দুটো খুলে তাকিয়ে রইলো ছাদের দিকে।ভাবতে লাগলো স্বপ্নের কথা।কি হাস্যকর!
রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ২৮
এরকম কোনো ঘটনা বাস্তবে ঘটলে মরে গেলেও স্পর্শী কি তার নাম্বারে ফোন দিবে?জীবনেও না।আর নাতো তার নাম্বার কল লিস্টের প্রথমে রাখবে।তবে ব্লক লিস্টের প্রথমে রাখলে রাখতে পারে।মুহুর্তে ই নিজেকে নিয়ে অবাক হয়ে গেল পরশ।সে আবিষ্কার করলো মিনিটের মধ্যেই স্বপ্নের অধিকাংশ ঘটনা ভুলে যাচ্ছে।দিবাস্বপ্ন কি এমনভাবেই হারিয়ে যায় মুহুর্তের মধ্যে?হতেও পারে।জানা নেই পরশের।লোকের মুখে শুনেছে দিবাস্বপ্ন খুবই খারাপ হয়।ওই ভয়ংকর মানবীকে কি সত্যিই এবার কোনো বিপদ ছুঁলো?আচ্ছা, সে কি একবার নতুন কোনো সিম দিয়ে অপরিচিত হয়ে খোঁজ নিয়ে জানবে মেয়েটার অবস্থা?