রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৩৮
সিমরান মিমি
“আমি সকালে ঢাকায় চলে যাচ্ছি।তুই ও চল আমার সাথে।”
চমকে মায়ের দিকে তাকালো।মায়ের মুখ এখনো গম্ভীর।তার চোখে-মুখে স্পষ্ট অভিমানের ছাপ।এড়িয়ে গেল স্পর্শী।এই মুহূর্তে প্রশ্ন করলে তিনি আহ্লাদী হয়ে উঠবেন।তখন আর কোনোভাবেই তাকে কড়া কথা বলে যাবে না।হয়তো কেঁদেও ফেলতে পারেন।
“পার্লারে কি খুব বেশীই চাপ?চম্পা আপু কি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে?”
মেয়ের দিকে ম্লান দৃষ্টিতে তাকালো পিপাসা।পরক্ষণেই মাথা নিচু করে ফেললো।”পার্লারের জন্য আমি যাচ্ছি না স্পর্শী।নিজের টাকায় ভাড়া রাখা বাড়িতে যাচ্ছি।অন্তত সেখানে তো আর কেউ কথা শোনাতে পারবে না।এখানে কি জন্য থাকবো আমি?সারাদিন ঘরের মধ্যে বসে থাকি আর খাবার সময় নির্লজ্জের মতো খাই।আমি তো এ বাড়ির কেউ নই।তোর বাবা আজ অবধি আমার সাথে একটু টু শব্দটাও করলো না।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
আমি এ বাড়িতে থাকলে ওনার খারাপ লাগে।হয়তো তোদের খারাপ লাগবে বলেই সেটা প্রকাশ করতে পারে না।তার থেকে আমি বরং ঢাকায় চলে যাই।তুই বরং তোর বাবার কাছে থাক।আর্শি টা তো আমাকে মানুষ মনেই করলো না।আজ কতগুলো দিন হলো গেছে।এরমধ্যে একটু যোগাযোগ করার চেষ্টা ও করলো না।আমার ফোন নাম্বার টাও তো ওর মুখস্ত।একটা মিনিট ফোন দিলে আর কি হতো?সুখে থাকুক।তুই সুখে থাক।পারলে একটু মাঝেমধ্যে ওই বাড়ির খবরাখবর নিস।বোন টা কেমন আছে একটু খেয়াল রাখিস।আমি মনে হয় আর পিরোজপুর আসবো না।”
মায়ের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো স্পর্শী।”ঠিক আছে।তুমি যাও।আমিও সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই যাবতীয় ডিসিশন নিয়ে ঢাকায় চলে আসবো।চিন্তা করো না।”
নিচ থেকে বাবার ডাক শুনতেই ফোন রাখলো স্পর্শী।ব্রাইটনেস একদম কমিয়ে চার্জে দিয়ে ওড়না পড়ে নিলো।রাত প্রায় দশটা।নিত্যদিনের নিয়ম অনুসারে এই সময়টাতেই সরদার বাড়ির রাতের খাবার খাওয়া হয়।আর বাবাও প্রতিদিন আর্শি-স্পর্শীকে ডেকে তার পর খেতে বসে।নিজের রুমের ড্রিম লাইট জ্বালানো ছিলো এতক্ষণ।হঠাৎই ড্রয়িংরুমের তীব্র আলো চোখে পড়তে চোখ বন্ধ করে ফেললো।মাথার ভেতরটা কেমন চক্কর মেরে উঠলো।সিঁড়ি দিয়ে ঢলে পড়তেই সোভাম ধরে ফেললো।এক হাত দিয়ে মাথা চেপে সোভাম কে ধরে নিজেকে সামলালো স্পর্শী।চমকে গেল উপস্থিত সবাই।এগিয়ে এলো দ্রুত।পিপাসা মেয়েকে ধরে আলগোছে সোফায় বসালো।”কি হয়েছে তোর?শরীর খারাপ লাগছে মা?”
ছোট কাকি এগিয়ে এলো।একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো স্পর্শীর দিকে।কিন্তু নিরব রইলো।আশেপাশের সবার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো স্পর্শী।বিরক্তি নিয়ে বললো,
“আরে বাবা,সবাই এমন ভান করছো যেন আমি বিরাট কোনো রোগী।রুমে লাইট নেভানো ছিলো।তাও হঠাৎ করে এতো কড়া আলোয় মাথা ঘুরে গেছিলো।আমি ঠিক আছি।”
এরপর ধীর পায়ে চেয়ার টেনে বসলো।সোভাম অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্পর্শীর দিকে।স্পর্শী তাকাতেই চোখ ঘুরিয়ে নিলো।এ পর্যায়ে পুরো সময়টা নিরবতায় কেটে গেল।খাওয়ার মাঝামাঝি পর্যায়ে নিরবতা ভেঙে খুক করে কেশে উঠলেন শামসুল।গলা পরিস্কার করে স্পর্শীর উদ্দেশ্যে বললেন,”তোমার বড় ফুপু শান্তি, যে তোমাকে দেখতে আসছিলো। মনে আছে?”
স্পর্শী মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।শামসুল সরদার পুণরায় বললেন,”ওর একটা ছেলে আছে, আরিয়ান।ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করেছে আরো তিন বছর আগে।ঢাকায়’ই থাকে।তুমি চিনবে না।ও সচারচর পিরোজপুরে আসে না।সোভামের সাথে মাঝেমধ্যে কথা হয়।ওর বয়সীই।”
স্পর্শী খেতে খেতেই বাবার দিকে তাকালো।বাবা যে এই ছেলের ব্যাপারে বিয়ের কথা বলবে সেটা আন্দাজ করতে পারলো না।বরাবরের মতো মাথা নেড়ে বললো,”হুম।তারপর?”সোভাম চমকে বোনের দিকে তাকালো।ভেবেছিলো রিয়াক্ট করবে অনেক।কিন্তু এমন গা ছাড়া ভাব দেখে অবাক হয়ে তাকালো।শামসুল মেয়ের দিকে তাকালো।”তোমার ফুপি তোমাকে দেখে অনেক পছন্দ করেছে।যখন শুনলো তোমার বিয়ের জন্য ছেলে খুঁজছি তখন ও আরিয়ানের কথা বললো।ওরা কাল/পরশুর মধ্যে আসতে চাইছে তোমাকে দেখতে। তুমি কি বলো?”
“আমি আর কি বলবো?আসুক।”
সোভাম দ্বিতীয় বারের মতো অবাক হলো।সন্দেহী চোখে বললো,”ওরা কিন্তু কাল/পরশুর মধ্যেই আসবে।যদি তোমাকে পছন্দ হয় তাহলে আংটি পড়িয়ে যাবে।তুমি কি বিয়েটাকে আদৌ ছেলেখেলা মনে করেছো?”
হাসলো স্পর্শী।বললো,”তুমিও কি আমায় ছেলেমানুষ মনে করেছো?যে বিয়ের কথা বললেই আমি চিৎকার চেঁচামেচি করবো।অবশ্য এটা আশা করাই স্বাভাবিক।কারন তোমরা মনে করেছো আমি পরশ শিকদারের সাথে রিলেশনে আছি।”
“তুমি কি সত্যিই পরশের সাথে রিলেশনে নেই?”
ভাইয়ের প্রশ্ন শুনে এবারে সিরিয়াস হলো স্পর্শী।কাঠখোট্টা কন্ঠে বললো,”না নেই।তার সাথে আমার কোনো প্রেম/ভালোবাসার মতো সম্পর্ক নেই।ঠিক আছে,ওদের আসতে বলো।তারাও আমাকে দেখুক, আমার বিষয়ে জানুক।আমিও দেখি।এরপর পছন্দ হলে বিয়ে করে নিবো না হয়।”
খাওয়া অলরেডি শেষ স্পর্শীর।হাত ধুয়ে টিস্যু নিয়ে গুনগুন করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল।অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সবাই।শামসুল সরদার আদৌ খুশি হবে নাকি আশ্চর্য হবে সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।দরজা ভেতর থেকে দরজা ভেড়াতেই হুড়মুড় করে ঢুকলো পিপাসা।তার চোখমুখে ভয়ের ছাপ।মেয়ের হাত ধরে আর্তনাদ করে বললো,
“এটা কি করেছিস তুই?তুই কি পাগল?”
অবাক হলো স্পর্শী।গা ছাড়া ভাব নিয়ে বললো,
“কি করেছি? ”
“তুই বুঝতে পারছিস না স্পর্শী।তোর ওই ফুপি দুনিয়ার খচ্চর।আমার মেয়ে আমি ওই খচ্চরের ঘরে দেবো না।”
অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়লো স্পর্শী।”মা,তুমি বাচ্চাদের মতো কথা বলছো।ফুপি ঝগড়ুটে বলে কি তার ছেলেকে কেউ বিয়ে করবে না?”
“সব মেয়েরা করুক।তাতে আমার কোনো সমস্যা নাই।কিন্তু আমার মেয়ে আমি দিবো না ওই ঘরে।”
শান্ত হলো স্পর্শী। বললো,”আচ্ছা ঠিক আছে আসুক।তারপর দেখা যাবে।”
শুনলো না পিপাসা।অনবরত বলতে লাগলো,”তুই বুঝতে পারছিস না।আংটি পড়ানোর পর আর কিচ্ছু করার থাকবে না।”
“দ্রুত আসো।এখানে খুব মশা।”
চমকে উঠে বসলো স্পর্শী।ঘুমিয়ে পড়েছিলো।মনেই ছিলো না পরশের আসার কথা।দ্রুত পায়ে উঠে দরজা খুলে উঁকি মারলো বাইরে।কেউ নেই।হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।পা টিপে টিপে বের হলো।সদর দরজা খুলে বের হয়ে গেল বাইরে।দ্রুত হাঁটতে লাগলো পেছনের প্রাচীরের দিকে।আম গাছের পাশ থেকে মই টা নিয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে গেল।এক হাত দিয়ে গাছ ধরে মইটাকে দেয়ালের ওপাশে রাখলো।এরপর নেমে গেল নিচে।চমকে তাকালো পরশ।অবাকের সুরে বললো,”গাছ বাইতেও পারো?বাহ!”
স্পর্শী উত্তর দিলো না।দ্রুত লাগেজ টাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে খুললো।”কি চেইক করছো?তোমার কি মনে হয় তোমার লাগেজ থেকে আমি চুরি করেছি?”
“করতেই পারেন।এইজন্যই তো দেখে নিচ্ছি।জামা-কাপড় কম কম লাগছে।এই আপনি সরান নি তো আবার?”
আশ্চর্য হয়ে গেল পরশ।”তোমার কি মনে হয় এই জামা-কাপড় নিয়ে আমি পড়ে বসে থাকবো?”
“থাকতেও পারেন। বাই দা ওয়ে।ওইদিনের জন্য সরি।আমার জন্য ভাইয়ার ধমক শুনতে হয়েছে আপনার।”
“না ঠিক আছে।আমি কিছু মনে করি নি।”
শুনলো স্পর্শী।লাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে রইলো মিনিট খানেক।চোখ দুটো তার মাটির দিকে। ম্লান কন্ঠে বললো,
“আমার বিয়ে।সম্ভবত কাল এনগেজমেন্ট। ফুপাতো ভাইয়ের সাথে।”
বাকহারা হয়ে গেল পরশ।ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো স্পর্শীর দিকে।”তোমাকে কি ফ্যামিলি থেকে খুব চাপ দেওয়া হচ্ছে,স্পর্শীয়া?”
“কই না তো।আব্বু আগেও বিয়ের কথা বলেছিলো। ভাবলাম বয়স হয়েছে।বিয়েটা সেরেই ফেলি।এমনতো না যে কারো সাথে প্রেম করি।তাই অমত করার কিচ্ছু নেই।ওর নাম আরিয়ান।ইঞ্জিনিয়ার। আমার বড় ফুপির ছেলে।দেখতেও ভীষণ স্মার্ট।আব্বুর ও পছন্দের।তাই ভাবলাম বিয়েটা এবার সেরেই ফেলি।”
বসে যাওয়া কন্ঠে পরশ বললো,”ওহ।”কোনো উত্তর দিলো না স্পর্শী।পরশের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে পিছু ঘুরে মই রাখলো ঠিক করে।
“স্পর্শীয়া…”
আচমকা পিছুডাক শুনতেই এগিয়ে এলো স্পর্শী।”বলুন না,কিছু বলবেন।”
অসস্তিতে পরলো পরশ।আমতা-আমতা করে বললো,”হ্যাঁ, মানে কংগ্রাচুলেশনস। নতুন জীবনে সুখী হও।”
চোয়াল শক্ত করে ফেললো স্পর্শী।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”থ্যাংকস।”এরপর গুটিগুটি পায়ে উঠে গেল প্রাচীরের উপরে।পরশের হাত থেকে লাগেজ নিয়ে সেটাকে ফেললো ভেতরের দিকে।ইতোমধ্যে বাইক চালিয়ে যাওয়ার শব্দ এলো কানে।নিশ্চয়ই চলে গেছে পরশ শিকদার।পাত্তা দিলো না ওদিকে।বরাবরের মতো নেমে এলো নিচে।লাগেজ কুড়িয়ে হাতে নিয়ে পিছু ঘুরতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো দাঁড়ালো।সামনেই সোভাম ভাই দাঁড়িয়ে।আর তার পেছনে আব্বু আর বাহাদুর চাচা।চোখ বন্ধ করে বড় করে নিঃশ্বাস ফেললো।লাগেজ টাকে খাঁমচে ধরে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে।
“বাহার, বাড়ির পুব দিকের রাস্তায় দাঁড়া।যেটাকে যেতে দেখবি ধরে আগে পিটাবি।এরপর সদরের বড় খাম্বাটার সাথে বাঁধবি।”
ঘাবড়ে গেল স্পর্শী।ইশশ!ধরা পড়ে যাবে না তো আবার।
“ছেলেটা কে ছিলো?কার সাথে পালাচ্ছিলে?”
বাবার প্রশ্নে অবাক হয়ে গেল স্পর্শী।”পালাচ্ছিলাম মানে?পালালে এখনো এখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম নাকি?আর পালাবোই বা কেন?”
“স্পর্শী,আমার মাথা গরম করো না। যদি তুমি পালাবেই তাহলে বিয়েতে রাজি হয়েছো কেন?”
বিরক্ত হলো স্পর্শী।”দেখো,আমি কোথাও পালাচ্ছিলাম না।আর ছেলেটা পরশ শিকদার ছিলো।আমিই ওকে আসতে বলেছিলাম।কারন আমার লাগেজ টা সেদিনকে তোমরা এয়ারপোর্টেই ফেলে এসেছিলে।আমাকেও আনতে দাও নি পর্যন্ত।উনি নিয়ে এসেছিলেন।তাই সেটা ফেরত নিয়েছি।দ্যাটস ইট।”
“তুমি বললেই বিশ্বাস করবো নাকি?লাগেজ যদি নেওয়ার ই থাকতো তাহলে এতো রাতে কেন?”
“সেফটির জন্য।কারন তোমাদের ভাবনা-চিন্তা তো খুব বেশীই উন্নত।এরকারনে আড়ালেই নিতে এসেছিলাম।কিন্তু তা আর হলো না।আর শোনো,যদি ওর হাত ধরে যাওয়ার ই হতো তাহলে পালাবো কেন?তোমাদের সামনে থেকে হেঁটে যাবো।কে আটকাবে আমাকে?”
বলে আর পিছু ফিরলো না স্পর্শী।সোজা হেঁটে গেলো বাড়ির দিকে।রুমের মধ্যে ঢুকে দরজা আঁটকে লাগেজ টা ছুঁড়ে ফেললো অন্যদিকে।ফোন টাকে নিয়ে কল করলো পরশের নাম্বারে।”পৌছেছেন?”
শান্ত কন্ঠে পরশ বললো,”নাহ এইতো বাড়ির সামনেই আছি।”
“বাড়ির সবাই টের পেয়েছে।লাগেজ দেখে ভেবেছিলো আমি পালাচ্ছিলাম আপনার সাথে।পূব রাস্তার মোড়ে ভাইয়ার লোক দাঁড়ানো আছে।গেলেন কিভাবে?”
বাইক টা সাইড করলো পরশ।”তাই নাকি।আমিতো চিকন রাস্তা দিয়ে আসলাম। জানলে ওই রাস্তা দিয়েই যেতাম।আগে বলবা না।”
রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৩৭ (২)
ভেঙচি মারলো স্পর্শী।ফোন কেটে বিছানার দিকে ছুঁড়ে মেরে গিজগিজ করতে করতে বললো,
“বা*লে*র সাহস!এই সাহস দিয়ে উদ্ধার করেছে আমায়।সামান্য একটা মেয়ে মানুষের সামনে ভালোলাগা প্রকাশ করতে পারে না।আসছে এখন সাহস মা’রা’তে।