রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৫৯

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৫৯
সিমরান মিমি

রাত তখন সাড়ে বারোটা।সময়টা কম নয়।শহর অঞ্চলে এই সময়টাকে পাত্তা না দিলেও গ্রাম্য এলাকায় এটা গভীর রাত।আশপাশ থাকে তখন নিস্তব্ধ।পবিবেশ থাকে থমথমে।দূর জঙ্গলের ওই নিশাচর পশুপাখির আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শ্রবণ হয় না।স্পর্শীর সাথে পুরো কথা শেষ করলো না পরশ।কেটে দিলো ফোন। নিজ কক্ষের বাতি জ্বালিয়ে টিশার্ট টা পড়ে নিলো।

এরপর ফোন হাতে বেরিয়ে পড়লো কক্ষ ত্যাগ করে।মা-বাবার ঘরের সামনে আসতেই থমকে দাঁড়ালো।রাত কম হয়নি।নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে।এই রাতে কি বিরক্ত করা উচিত হবে?ভেবে পেল না।পায়ের কদম ঘুরিয়ে আবারো নিজের রুমের দিকে এলো।কিন্তু পৌছাতে পারলো না।এরমধ্যেই মনের মধ্যে অসম্পূর্ণতা গুলো নাড়া দিলো।নাহ!এভাবে আজ নয় কাল,কাল নয় আজ করতে করতে আজ কতগুলো দিন পেরিয়ে গেল।এমনভাবে আর সময় নষ্ট করা যাবে না।যা বলার আজ’ই বলবে।বাবা যে মত দেবে না সে বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত পরশ।কিন্তু তাও জানানো উচিত।একবার তাকে জানালে বিষয়টা খুব একটা খারাপ হবে না।বরঞ্চ পরবর্তীতে আর কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পুনরায় দিক পরিবর্তন করলো পরশ।এগিয়ে গেল বাবা-মায়ের কক্ষের দিকে।বাইরের জানালা টা পুরোপুরি বন্ধ নিয়।ভেতরে ড্রিম লাইট জ্বলছে এবং সেটার আলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।পরশ আলতো হাতে দুবার টোকা দিলো দরজায়।দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ শুনতেই তড়িঘড়ি করে উঠে বসলেন পিয়াশা।এতো রাতে কে দরজা ধাক্কাচ্ছে?হুট করে এমন চমকপ্রদ ঘটনা ঘটাতে তিনি সাময়িক ভাবে চমকে গেছেন।বাইরে কে আছে?কোনো চোর বা ছ্যাঁচোর নয়তো?আদৌ কি দরজা খোলা উচিত হবে?
কক্ষের ভেতর থেকে কোনোপ্রকার আওয়াজ না পেয়ে পরশ আবারো টোকা মারলো।কেঁপে উঠলেন পিয়াশা।স্ত্রী’র নড়াচড়ার প্রভাবে জেগে গিয়েছেন আমজাদ শিকদার।বিরক্ত হয়ে বললেন,
_”আরে দরজা টা তো খোলো।”

স্বামীর কথায় পাত্তা দিলেন না পিয়াশা।উলটো ধমক মেরে চাপাস্বরে বললেন,
_”সময়ের দিকে খেয়াল আছে আপনার।মাঝরাত এখন।এতো রাতে দরজার ওপাশে কে আসবে?যদি চোর-ছ্যাচড় হয় তাহলে?আপনি গিয়ে খুলুন না,আমাকে বলছেন কেন?”
বিরক্ত হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলেন আমজাদ।পড়নের লুঙ্গীটার গিট খুলে পুণরায় শক্ত করে কঁষে বাঁধলেন।ভেতর থেকে মা-বাবার চাপা কন্ঠের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।এরমানে তারা জেগে আছে।পরশ গলাখাকারি দিলো।কন্ঠকে খাদে নামিয়ে বললো,

_”আম্মু,তোমরা কি জেগে আছো?”
দরজার সামনে এসেও দাঁড়িয়ে পড়লেন আমজাদ।পেছনে ফিরে স্ত্রী’র উদ্দেশ্যে চোখ রাঙালেন।অর্থাৎ তার স্ত্রী যে ভুল ছিলেন সেটাই জানান দিলেন ইশারায়।ছিটকিনি খুলে দিয়ে পুণরায় খাটের দিকে এগিয়ে গেলেন।আধশোয়া হয়ে শুতেই পরশ থমথমে গলায় বললো,
_”তোমার সাথেই কথা বলতে এসেছি।ঘুমাবে না।”
ভ্রুঁ কুঁচকে ফেললেন আমজাদ।কিছু না বুঝতে পারার মুখভঙ্গী নিয়ে বললেন,
_”আমার সাথে?আমার সাথে আবার কি কথা তোমার?আর থাকলেও এই মাঝরাতে কেন?সকাল কি হতো না।”
উত্তর দিলো না পরশ।মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
_”তুমি কি কিছু বলেছিলে?”

দাঁত দিয়ে জিভ কাটলেন পিয়াশা।পরশ যা বোঝার বুঝে নিলো।বাবার দিকে তাকাতেই দেখলো সে এখনো স্ত্রী এবং ছেলের মুখপানে তাকিয়ে আছেন।পুণরায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বললো,
_”আমার কাছে কি বলবে তোমার মা?কিছু কি বলার ছিলো?”
এপর্যায়েও উত্তর দিলো না পরশ।মাথানিচু করে ভেবে নিলো কিছুক্ষণ।এরপর মাথাতুলে সরাসরি দৃষ্টি দিলো বাবার দিকে।গম্ভীর কন্ঠে সাজিয়ে বললো,
_”আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য কম অপমানিত হও নি তুমি।আর এর সমস্ত দায়ভার আমার’ই।তবে এক্ষেত্রে তোমার ভাগ্য ও যে খুব বেশী ভালো ছিলো তা না।ভাগ্য ভালো হলে আরো বছর পাঁচেক আগেই ছেলের বউ দেখার সৌভাগ্য হতো।”

কথা শেষ করার আগেই ভ্রুঁ কুঁচকে ফেললেন আমজাদ।ছেলেকে পিঞ্চ মেরে বললেন,
_”ওহ।বিয়ে করতে পারো নি তুমি।আর সেখানে ভাগ্য খারাপ আমার।ভালো সমীকরণ।এরপর?বলো।”
_”হ্যাঁ এখানে ভাগ্য খারাপ তো তোমারই।তোমার ভাগ্য ভালো হলে তো এতদিনে দাদা হয়ে যেতে। সেখানে বিয়েই এখনো দিতে পারো নি।তাহলে এটা কি তোমার দুর্ভাগ্য নয়?”
দাঁতে দাঁত চেপে ধরলেন আমজাদ।পিয়াশা মুখ টিপে হাসছে।ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
_”হ্যাঁ,বাপ।এটা আমার ‘ই দূর্ভাগ্য।না হলে তোর মতো ছেলে আমার কেন হলো।দেশে বাবার কি অভাব ছিলো?
থেমে গটগট করে বললো,

_”কি বলতে এসেছিস দ্রুত বল।এই রাত একটার সময়ে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে।”
পরশ ঠোঁট গোল করে শ্বাস নিলো।বাবার দিকে পুনরায় তাকিয়ে বললো,
_দেখো আব্বু,তুমি ভেবোনা এই মাঝরাতে আমি তোমার সাথে মজা করতে এসেছি।যা বলছি সব সিরিয়াস ভাবে নাও।আমি বিয়ে করবো খুব তাড়াতাড়ি। মেয়ে টেয়ে দেখা সব শেষ।তোমার কোনো বাড়তি কাজ নেই।শুধুমাত্র কাল গিয়ে মেয়েকে আংটি পড়িয়ে আসবে।এতে মেয়ের বাপ রাজি হলো কি না হলো আমার দেখার বিষয় নয়।মেয়ের বাবাকে তুমি সামলাতে পারলে পারবে আর নাহয় দরকার নাই।বাপ ছাড়াও বিয়ে হয়।”
সজাগ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন আমজাদ।ভ্রুঁ কুঁচকে বললেন,

“মেয়েটা কে?”
_”স্পর্শিয়া,স্পর্শীয়া সরদার।বাবা শামসুল সরদার;আমার বিরোধী পার্টির নেতা।ভাই সোভাম সরদার; তোমার রিসোর্টের বিপরীতে ব্যবসা ধরা অভদ্রলোক।মা পিপাসা সরদার;তোমার’ই ছোট ছেলের শাশুড়ী, আই মিন তোমার বেয়ান।”
খুব একটা অবাক হলেন না আমজাদ।তার সন্দেহ ঠিক।আরো আগেই এই মেয়েকে নিয়ে সন্দেহ করেছিলেন তিনি।আর ঘটেছেও ঠিক তাই।কিন্তু ছেলের সামনে এই উদাসীনতা ধরা দিলেন না।বরং রাগের ভান ধরে ধমক দিয়ে বললেন,
_ওহহ!ছোট ভাইয়ের পিছন পিছন ঘুরছো।দুই ভাই মিলে একই ঝামেলায় জড়াচ্ছো। লজ্জা করে না এতো কিছুর পরেও…..”
শেষ করতে দিলো না পরশ।এর আগেই থমথমে কন্ঠে বললো,

_”ভুল বললে।তোমার ছোট ছেলেই আমার পেছন পেছন ঝামেলায় জড়িয়েছে।শুধুমাত্র লক্ষ্যে আমার আগেই পৌছে গেছে।আফসোস!আমি পারি নি।আর এটা সত্যিই আমার জন্য লজ্জার ব্যাপার।আর এই লজ্জাকে গর্ব হিসেবে রুপান্তর করার একমাত্র দায়িত্ব তোমার।ও বাড়ি কালকে যাও আর বিয়ের অর্ধেক ঠিকঠাক করে আসো।বেশি দেরি করা উচিত হবে না।শেষে পাভেলের বাচ্চা সাথে নিয়ে আমার বিয়ে করতে হবে।এটা ভীষণ’ই লজ্জার।অবশ্য এই অনুভূতি তোমার জানার কথা।ছোট চাচ্চু ও তো তোমার আগেই বিয়ে করেছিলো।তাই না?”
কথাটা গায়ে লাগলো আমজাদ শিকদারের।হাঁসফাঁস করে বলে উঠলো,
_”আমি পারবো না।আমাকে এসব বিষয়ে জড়াবে না।তোমাদের যা ইচ্ছা তাই করো।আমি কখনো সরদার বাড়িতে পা রাখবো না।”

বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো পরশ।মুখভঙ্গি কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে।নাহ!এভাবে আর নয়।যতই সুন্দর করে বুঝিয়ে কথা গুলো বোঝানো হোক সেটা বুঝবে না আমজাদ শিকদার।ছেলেকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে চমকে গেলো আমজাদ।ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাতেই পরশ পুণরায় কথা বলে উঠলো।এবার আর শান্ত কন্ঠে মজার কথা নয়।বরাবরের মতো থ্রেট দিয়ে বললো,

_”নিজের ছেলেকে চেনার মতো যথেষ্ট জ্ঞান এবং বুদ্ধি তোমার আছে।এটা অবশ্য বুঝতেই পারছো পাভেলের মতো বোকামি আমি করবো না।পরশ শিকদার পালাবে না।নিজের জিনিস কিভাবে নিজের কাছে আনতে হয় সেটা খুব ভালো করে জানে।প্রয়োজনে সামাজিকতার বদলে ভয়ংকর থাবা মেরে আমার পাখি আমি খাঁচায় ভরে নেব।কাউকে প্রয়োজন নেই।অবশ্য এরপর আমার উপর অনেক চাপ আসবে।মামলা হবে,আদালতে যেতে হবে একেবারে লাস্ট অবধি না হয় সদস্য পদ টাই বাতিল হয়ে যাবে।এর থেকে তো আর বেশি কিছু নয়।তো, এতে আমার কিচ্ছু আসে যায় না।বিয়ে যদি করতে হয় আমি ওই সরদারের বড় মেয়েকেই করবো।আগে ইলেকশন আসলেই সরদার-শিকদারের মধ্যে ঝামেলা হতো।এরপর থেকে না হয় প্রতিদিন ঝামেলা হবে।মারামারি,খুনোখুনি হতেই থাকবে।কিন্তু কোনো আফসোস নেই।অবশ্য তুমিও দোষ দিতে পারবে না।কিন্তু বিয়ে আমি স্পর্শীয়াকেই করবো।”

_”তুমি কি আমাকে থ্রেট দিচ্ছো?”
_”উঁহুম!তোমাকে থ্রেট দিতে যাবো কেন?এখানে যাই ঘটুক তোমার তো আর কোনো ক্ষতি হবে না।বড়জোর রাস্তায় নামলে লোকজন আগের মতো সম্মান দেবে না।সবাই দূরে বসে টিটকারি মারবে,”আমজাদ শিকদারের ছেলে এমপি হয়েও ছয় মাস ও টিকতে পারলো না।”ব্যাস!এটুকুই। এর থেকে বেশি কিছু না।
থেমে নিজেকে শান্ত করলো পরশ।বললো,

_”শোনো আব্বু,আমি তোমাকে লাস্ট বারের মতো অনুরোধ করছি।তুমি যদি ভেবে থাকো এভাবে নিশ্চুপ থাকবে।এতে আমি ক-দিন পর স্পর্শীয়াকে ভুলে যাবো,অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করলে ঠিক হয়ে যাবো তাহলে তুমি ভুল।আমার ওকে ভালো লাগে।যদি পুণরায় শিকদার বাড়ির সম্মান নষ্ট করতে না চাও তাহলে কাল সকালে সরদার বাড়িতে যাবে।চাচ্চু অলরেডি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।সে তোমার মতো অবুঝ না।সরদার বাড়ি অলরেডি তোমার ছোট ছেলের শশুর বাড়ি।নাতি-নাতনী ও হচ্ছে।আজ হোক,কাল হোক সম্পর্ক ঠিক হবেই।কিন্তু জেদ ধরে যেটুকু বজায় আছে সেটুকুও নষ্ট করো না।ও বাড়িতে যাও।শান্ত ভাবে বুঝিয়ে কথা বলো।মানলে তো মানবে, না মানলে নাই।কিন্তু অন্তত নিজেকে বোঝাতে তো পারবো “আমার বাবা আমার সাথেই ছিলো আমার শক্তি হয়ে।”

আর এক সেকেন্ড ও দাঁড়ালো না পরশ।ত্যাগ করলো বাবা-মায়ের কক্ষ।নিজের কক্ষে গিয়ে বন্ধ করে দিলো দরজা।লাইট নিভিয়ে চুপ করে শুয়ে পড়লো।এতে কাজ হলে তো হবে।নাহলে তার বিকল্প পরিকল্পনা অলরেডি ভাবা আছে।প্রয়োগ করতে বেশিক্ষণ লাগবে না।

গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে।রাস্তার ধুলো দু পাশে উঁড়িয়ে সদরের কাছাকাছি এসে পড়েছে।এরপর দিক পরিবর্তন করে সোজা সরদার মঞ্জিলের দিকে ছুটলো।পরশ বাবার গম্ভীর মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে নিরবে হাসলো।কটাক্ষ করে বললো,
_”বাহ!আমার এক কথাতেই রাজি হয়ে গেলে।শুধু শুধু রাতে ওমন ত্যাড়ামি করলে কেন?”
ফুঁসে ছেলের দিকে তাকালেন।এরপর স্ত্রী’র দিকে চেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
_”রাজী না হয়ে আর কোনো উপায় আছে?সেই মাঝরাতে রেডিও ছেড়ে চলে গেছো তুমি।গিয়ে শান্তিতে ঘুমিয়েছো।আর আমি?সারারাত কানের কাছে ভ্যানড়-ভ্যানড় শব্দ শুনেছি।তার এই মেয়েই লাগবে।সেও পছন্দ করে।এই মেয়ে ছাড়া আর কাউকে পুত্রবধু করবে না।”

পরশ চমকে মায়ের দিকে তাকালো।তিনি মুচকি হাসলেন।এই মুহূর্তে গাড়িতে তারা ছয়জন উপস্থিত।একদম পেছনের সিটে পরশ ও তার চাচা বসে আছেন।মাঝখানে বাবা-মা এবং সামনে ড্রাইভারের পাশে পাভেল।শিকদার বাড়িতে আসবে শুনতেই গেড়ে বসেছে।স্ত্রী’র জন্য বেশ কিছু বাচ্চাদের খাবার কিনেছে;যেগুলো বরাবর’ই আর্শির পছন্দ।বিশেষ করে কয়েক স্বাদের বয়াম ভর্তি আচার,চানাচুর,চিপ’স, ললিপপ ইত্যাদি।পিয়াশা নিজেও মনে করে ছেলে বউ এর জন্য ফল-মিষ্টি কিনেছেন।সরদার বাড়ির গেটের সামনে গাড়ি থামতেই চমকে গেল দাঁরোয়ান বাহাদুর।গেট না খুলেই ছুঁটলো সদর দরজার দিকে।গত বার’ই সোভাম সরদার তাকে ঝেঁড়েছে।যাকে তাকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়ার পারমিশন নেই বিশেষ করে শিকদার দের মধ্যে কারো।স্পর্শী বাড়ির সামনেই পাইপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে।বেশ কিছু ফুল লাগিয়েছে গত পরশু।সেগুলোতেই পানি দিয়েছে।দারোয়ান কে আসতে দেখেই ভ্রুঁ কুঁচকালো।বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো সামনে।বললো,

_”কাকা কি হয়েছে?গেট ছেড়ে ভেতরে যাচ্ছেন কেন?”
_”শিকদার বাড়ির গাড়ি আইছে বড় আপা।ছোট ভাইজান কইছে ওই বাড়ির কাউরে যেন ঢুকতে না দেই।”
ধমকে উঠলো স্পর্শী।রাগ মিশ্রিত গলায় বললো,
_”আরে আজব!আপনার ভাইজান বললেই হবে?মেহমান গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে ভেতরে এসেছেন জানাতে।আপনি জানেন না ওরা আর্শির শশুর বাড়ির মানুষ,আমাদের আত্মীয়?দ্রুত গেট খুলে দিন।”
বাহাদুর পিছু হটতে গিয়েও হটলো না।বরং নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে বললো,
_”কিন্তু ভাইজান যে কইলো ওনার পারমিশন ছাড়া যেন ঢুকতে না দেই।যদি দেই তাইলে আমার চাকরি নিয়া…..”
কথা শেষ করতে দিলো না স্পর্শী।বললো,

_”আপনাকে আমি বললাম না গেট খুলে দিন।দেখুন কাকা,কিচ্ছু হবে না।আমি কথা বলে নিবো ভাইয়ার সাথে।আপনাকে জিজ্ঞেস করলে বলবেন,”বড় আপা খুলে দিছে।”
মাথা নাড়িয়ে চলে গেল দারোয়ান।তাও খুঁতখুতানি স্বভাব গেলো না।বারকয়েক পিছু ফিরে যখন দেখলো স্পর্শী এখনো তাকিয়ে আছে তখন আর থামলো না।গাড়ি থেকে ইতোমধ্যে সবাই বের হয়ে গেছে।ড্রাইভার রাস্তার এক কোণে গাড়িটা পার্ক করে যাবতীয় ফল মিষ্টি পাভেলের সাথে ভাগ করে নিলো।কিন্তু পরশ এলো না।সে গাড়ির মধ্যে বসেই অপেক্ষা করছে।এই মুহুর্তে ভেতরে যাওয়াটা মোটেও যুক্তিসংগত লাগছে না তার কাছে।গেট খুলতেই একে একে ভেতরে ঢুকে গেল সবাই।আমজাদ শিকদার অপমানে থমথমে হয়ে ভেতরে ঢুকছেন।কমপক্ষে পাঁচ মিনিট গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে।এটা কি কম অপমান?ইচ্ছে করছে সব কিছু ছেড়ে এক্ষুণি এই সীমানা থেকে বের হতে।কিন্তু পারলেন না।ছেলের আবদার, স্ত্রী’র অনুরোধ মনে পড়তেই নিজেকে সামলে নিলো।সদর দরজা খোলা।হয়তো পরশ রা আসবে দেখে স্পর্শী নিজেই সেটাকে খুলে রেখেছে।

সকাল তখন নয়টা।এ বাড়ির নাস্তা করা শেষ হয়েছে আরো মিনিট পনেরো আগে।দুপুরের জন্য রান্নার তরি-তরকারি কাঁটছেন পিপাসা এবং সোনালী।ছোট জা বাপের বাড়িতে গেছে আজ তিন দিন হলো।রান্নার মহিলাও অসুস্থ বলে আসেনি।আর্শি সোফায় বসে একমনে টিভি দেখছে।স্পর্শী পাশেই দাঁড়িয়ে আছে পরশ দের অপেক্ষায়।ও বাড়ি থেকে যে লোক এসেছে সেটা এখনো কাউকে জানায় নি সে।কি দরকার আগে-ভাগে জানানোর।আসলে তো দেখতেই পাবে।তাছাড়া বাবা-ভাই আজ বাড়িতেই উপস্থিত।যদি কোনোভাবে ঝামেলা বেঁধেই যায় তখন সবাই ভাববে স্পর্শী নিজে ওদের কে ডেকেছে এবং ওরা যে আসছে সেটাও সে জানে।

টিভির দিক থেকে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকাতেই থমকে গেল আর্শি।আচমকাই উৎফুল্ল হয়ে দাঁড়ালো।সদর দরজার সামনে পাভেল সহ বাকিরা দাঁড়ানো।ইচ্ছে করলো ছুটে গিয়ে হাতটা ধরতে।কিন্তু পারলো না।হুট করে বুক টা কেমন ধুক করে উঠলো।বাবা-ভাই দুজনই বাড়িতে।না জানি কি অঘটন ঘটে।স্পর্শী যে তাদের দেখেছে সেটা ধরা দিলো না।বরং অবাক হওয়ার ভান ধরে বললো,
_”আরে আপনারা?আসুন আসুন।ওমা,মেঝো কাকি!এদিকে আসো তো।”
স্পর্শীর হাঁক ছেড়ে ডাক দেওয়াতে বের হয়ে এলো সোনালী।পিছু পিছু পিপাসা ও এলো।শিকদার বাড়ির লোকদের দেখতেই পিলে চমকে গেলো ।পিপাসা এগিয়ে এলেন।পিয়াশা কে ধরে ভেতরে নিয়ে এলেন।বাকিদের কেও আতিথেয়তার সাথে গ্রহণ করে সোফায় বসালেন।

_”কেমন আছেন আপনারা?বেয়াই ও আসছেন।আমি খুব খুশি হয়েছি।”
সোনালী রান্নাঘরে ছুটলো নাস্তার জোগাড় করতে।তাকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে স্পর্শী ও পা বাড়ালো।কিন্তু যেতে পারলো না।এরমধ্যে হাত ধরলো পিয়াশা।কাছে টেনে নিয়ে সোফায় বসলো।তার একপাশে আর্শি এবং অন্যপাশে স্পর্শী।ইনিয়েবিনিয়ে বললো,
_”আসলে অসুস্থ মেয়েটাকে নিয়ে এলেন। তাই ভাবলাম একবার দেখে আসি।তা বেয়াই কোথায়?ডাকুন।”
হাঁসফাঁশ করতে লাগলেন পিপাশা।আমতা-আমতা করে বললে,
_”হ্যাঁ, ডাকছি।আপনারা বসুন।”
পরক্ষণেই মিষ্টি এবং খাবারের প্যাকেট গুলো দেখে হেসে বললো,
_”আরেহ,একি!এসবের কি দরকার ছিলো।”

ড্রয়িংরুমের আমেজ উপরের রুমে বসেই টের পেল শামসুল।দরজা খুলে নিচের দিকে উঁকি মারতেই চোখ ছানাবড়া।রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে তার।এই মুহুর্তে নিচে নামাটা মোটেও উচিত হবে না।রাগে গিজগিজ করতে করতে জোর হাতে দরজা আটকালো।আকস্মিক এই শব্দে উপরে তাকালো সবাই।লজ্জা পেল পিপাসা।আমতাআমতা করে ডেকে বললো,
_”শুনুন,একটু নিচে আসুন।বেয়াই -বেয়ান আসছে।”

রাগে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে শামসুল সরদারের।নিজ স্ত্রী’র মুখে এমন আদুরে বেয়াই শব্দ যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো।সোভাম দরজা আটকানোর শব্দ শুনতেই বেরিয়েছে।মুহুর্ত খানেক দরজার সাথে হেলান দিয়ে সবটা পর্যবেক্ষণ করে নিলো।এরপর ধীর পায়ে বাবার রুমের সামনে গেল।কি বললো সেটা ঠিক বোঝা গেল না।তবে ঠিক মিনিট দুয়েক পর শামসুল সরদার দরজা খুলে সোভামের সাথে নিচে চলে এলো।নিজের রুম থেকে খলিল সরদার ও বের হলেন ভাইয়ের পিছু পিছু।ইতোমধ্যে নাস্তা দিয়ে দিয়েছে সোনালী।আলতাফ শিকদার চামচ দিয়ে একটা মিষ্টি মুখে নিলেন।এরপর নিজেকে সাজিয়ে নিলেন পুণরায়।বাড়ি থেকেই পুরো পরিকল্পনা সাঁজানো।যা বলার এবং বোঝানোর তাকেই করতে হবে।মিষ্টি টা পুরোটা খেয়ে পানি খেয়ে নিলেন।এরপর শামসুল সরদারের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন।অথচ মনের মধ্যে তার বেজায় জেদ।নিজের উপর’ই মায়া হচ্ছে।আজ পরশের জন্য তাকে এই ভাবে নিচু হতে হচ্ছে।নাহয় এই সরদারের ছায়াও মারাতেন না।

_”কেমন আছেন ভাইজান? ”
থমথমে মুখে বাচ্চাদের মতো অন্যদিকে তাকালেন শামসুল।পরক্ষণেই ছেলের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন।মিনমিন করে বললেন,
_”ভালো।”
_”দেখেন ভাইজান,আপনাদের পরিবার আর আমাদের পরিবারের মধ্যে কিন্তু রাজনৈতিক বিরোধিতা ছাড়া ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা নেই।শুধু শুধুই আমরা নিজেদের জেদকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যক্তিজীবনে শত্রুতা বাড়াচ্ছি।এমন মনে হচ্ছে যেন আমরা এক পরিবার অন্য পরিবারকে খুন করার জন্য ওৎ পেতে বসে থাকি।এখন দেখুন,ছোট ছোট বাচ্চা ছেলে-মেয়ে। যাই ভুল করেছে, এখন তো আর ওদের ফেলে দিতে পারি না।দুদিন পর আরেকটা ছোট্ট বাচ্চা আসবে।আমরা যদি দু পরিবার এমনভাবেই রেশারেষির মধ্যে থাকি তাহলে বাচ্চাটা ট্রমার মধ্যে থাকবে।

ও নানা বাড়ি আর দাদাবাড়ির মধ্যকার সেই ভালোবাসা টা পাবে না।দুদিন পর ও নিজেই তুলনা খুঁজবে কোন পরিবার ভালো।সেক্ষেত্রে দেখা গেল নিজ পরিবার রেখে ও কখনোই নানা বাড়ির পক্ষ নেবে না।এটা খুবই হতাশার হবে।আমরা ও চাই না আমাদের নাতি-নাতনী নানা-নানুর আদর, মামার ভালোবাসা ছাড়া বড় হোক।এদের মধ্যে কাউকে ও পর হিসেবে দেখুক এটাও চাই না।তাই বলছিলাম সব টা মানিয়ে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।আপনাদের মেয়ের ই বা বয়স কত বলুন?বেচারি ছোট।এখন যদি ও নিজেই এই অবস্থায় শশুর বাড়ি-বাবার বাড়ি নিয়ে একটা ট্রমার মধ্যে থাকে তাহলে কি সেটা ভালো হবে?কোথায় হাসিখুশি থাকবে তা না সবসময় মনমরা হয়ে থাকে।”

বিশাল এক আলোচনা করে থামলেন আলতাফ।উপস্থিত সবাই চুপ।কিন্তু পিয়াশা নিজের মতো কথা বলছে স্পর্শীয়ার সাথে।সে কোথায় পড়ে,কোন ক্লাসে পড়ে,আদৌ কখনো প্রেমের সম্পর্ক ছিলো কি না,বিয়ে করবে কবে এসব নিয়েই যাবতীয় প্রশ্ন।স্পর্শী উত্তর দিলেও তার অসস্তি লাগছে।এই যে পিয়াশা আসার পর হাত ধরেছে অথচ এখনো ছাড়ছে না। শামসুল সরদার মন দিয়ে শুনলেন।কিন্তু কোনো উত্তর দিলেন না।পাশেই খলিলুর সরদার বসা।তিনি মাথা নাড়িয়ে আলতাফ শিকদারের সাথে তাল মিলিয়ে বললেন,

_”হ্যাঁ হ্যাঁ, এই কথাটা তো একদম ঠিক।আমিও বুঝিয়েছিলাম ভাইজান কে।”
একটু আস্কারা পেলেন আলতাফ।নড়েচড়ে বসে পুণরায় বললেন,
_”আমি আরেকটা প্রস্তাব দিতে চাইছিলাম ভাইজান।যেখানে ছোট দুজনকে নিয়ে এতো বিরোধিতা। তাই চেয়েছিলাম এবার পারিবারিক ভাবে বড় দুজনের বিয়ে দিলে কেমন হয়?আমার কিন্তু বেশ লাগবে।পুরো পিরোজপুর জুড়ে অনুষ্ঠান করবো।আমাদের কিন্তু স্পর্শী মাকে বেশ লাগে।ভাবির ও ভীষণ পছন্দ।ভাবলাম দুবোন এক সাথে সংসারে থাকলে মিলিয়ে নিতে সহজ হবে।ভালোও লাগবে।আর তাছাড়া আমাদের পরশের সাথে ভালো মানাবে।আপনারা কি বলেন?

স্তব্ধ হয়ে গেলো সোভাম।শামসুল তড়িৎ গতিতে বসা থেকে উঠলো।বাবাকে সামলে সোভাম বিনীতভাবে বললো,
_”দেখুন সম্পর্ক ঠিক যতটুকু পর্যন্ত আছে এটাই অনেক।এটুকুই আদৌ টিকবে কি না জানা নেই।সেখানে নতুন সম্পর্ক নিয়ে ভাবা তো বিলাসিতা। আমার বোন বিয়ে দেব না আমি।আপনারা এবার আসতে পারেন।”
স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো স্পর্শী।সোভামের দিকে নয়।নিজের হাতের দিকে।বাবা-ভাইয়ের কথার ফাঁকেই পিয়াশা বেগম চুরি পড়িয়ে দিয়েছে তার হাতে।সে দেখেছে,চাইলে বাঁধাও দিতে পারতো। কিন্তু শরীর টা কেমন অবশ হয়ে গেলো।হাতটা সামান্য নাড়ায় ওনি পর্যন্ত।চুপচাপ দেখে গেল।
পিয়াশা সোভামের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।বিনীতভাবে বললো,

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৫৮

_”এমা!এটা বললে কি হবে?আমিতো চুড়ি পড়িয়ে দিয়েছি।এবারে ছেলের বউ করেও নিয়ে যাবো খুব তাড়াতাড়ি। ছেলে রাজী,মেয়ে রাজী,ছেলের পরিবার রাজী-মেয়ের পরিবার ও রাজী।শুধুমাত্র আপনারা বাপ-ভাই রাজী না থাকলে তো বিয়ে আটকে থাকবে না।মেয়ে আমি বউ করে নেবোই।

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬০