রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬২
সিমরান মিমি
বসন্তের মাঝামাঝি। সময়টা তখন ভোর।সূর্য্যিমামা প্রকাশ পেয়েছে বেশিক্ষণ হয় নি।গাছে গাছে নতুন, সতেজ স্বচ্ছ পাতা জন্মানো প্রকৃতিটা সদ্য উদয় হওয়া সূর্য্যের আলোয় চমৎকার দেখাচ্ছে।এমনই এক চমৎকার সকালে চমৎকার একটা ঘটনা ঘটলো।গেটের দারোয়ান হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মেইন রোডে সাইড করা গাড়িটার দিকে। এরপর হতভম্ব হয়ে পেছনের দিকে ছুটলো।সদর দরজার সামনে আসতেই চিৎকার করে ডাকলো। আমজাদ শিকদার মাত্রই কফির মগে চুমুক দিয়েছিলো।এরইমধ্যে দারোয়ানের আওয়াজ কানে আসতেই সেটাকে টেবিলের উপর রেখে দিলো।ত্রস্ত পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।পিয়াশা ও ভেতরে আর দাঁড়ালো না।কথা শোনার জন্য নিজেও সামনে এগিয়ে গেল।
_”স্যার,শামসুল সরদারের গাড়ি।আমাগো গেটের সামনে।”
ভ্রুঁ কিঞ্চিৎ কুঁচকে তাকালো আমজাদ।চোয়াল শক্ত হয়ে গেল মুহুর্তেই।কিছু বলার প্রয়াস করতেই পিয়াশা জমে গেল।অনুরোধ করে বললো,
_”আপনার হাতে ধরি, আপনি কোনো ঝামেলা করবেন না।তারা আপনার ছোট ছেলের শশুর বাড়ির আত্মীয়।দেখেন, আগে কি বলে।”
আমজাদ স্ত্রীয়ের কথা শুনলেন।নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে সোফায় বসলেন।দারোয়ান পিয়াশার কথা অনুযায়ী গেট খুলে তাদের বিনয়ের সাথে গ্রহণ করলেন।সোভাম অসস্তিতে পড়লো।বাবার উদ্দেশ্যে অভিমানী কন্ঠে বললো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
_”আমার না গেলে কি হতো না?তুমি গেলেই তো হতো।আমাকে কি দরকার?আমি কে?”
উত্তর দিলো না শামসুল।গম্ভীর কন্ঠে বললো,
_”তোমার ইচ্ছা হলে এখনই চলে যেতে পারো,তবে আমি চাই তুমি আমার সাথে থাকো।”
আর কথা বললো না সোভাম।চুপ করে গম্ভীর হয়ে রইলো।সদর দরজার সামনে যেতেই পাভেল এগিয়ে এলো।বিনয়ের সাথে সালাম দিয়ে তাদেরকে ভেতরে নিয়ে গেল।অবাক হলো শামসুল।তাদের ব্যাবহারের যথেষ্ট ফিডব্যাক সে আশা করেছিলো।কিন্তু ঘটনা পুরোই উলটো হচ্ছে।তারপরেও প্রকাশ করলো না।শান্ত ভঙ্গিতে সোফায় গিয়ে বসলো। এদিকে আমজাদ শিকদার নিরব থাকলেও আলতাফ শিকদার ইতোমধ্যে গল্প জুড়ে দিয়েছে।সেগুলোর সাথেই মাথা নাড়াচ্ছেন শামসুল সরদার।বেশ কিছুক্ষণ পর কন্ঠে নমনীয়তা এনে বললেন,
_”আমি গতকালের প্রস্তাব টা নিয়েই কিছু কথা বলতে এসেছি।”
_”হ্যাঁ,হ্যাঁ, বলুন ভাইজান।আমরা আপনার উত্তরের অপেক্ষাই করছিলাম।যদিও হুট করে রেগে গিয়েছিলেন, তবে সেটা মনে রাখি নি।এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক।”
উত্তর দিলেন না শামসুল।আলতাফ শিকদারের কথা শুনে মাথা নিচু করলো।ধীরে ধীরে অসস্তি বাড়ছে তার।কন্ঠে স্নিগ্ধতা এনে বললো,
_”আমি বিষয়টা নিয়ে ভেবেছি।মেয়ের সাথে কথাও বলেছি।হয়তো আমরা রাজনৈতিক আর ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো গুলিয়ে ফেলছি যেটা হওয়া উচিত নয়।”
এ পর্যায়েও কথা বলে উঠলেন আলতাফ।বললেন,
_”তা মেয়ে কি বললো?আপনাদের মত কি?”
_”এই মুহুর্তে মত দেওয়া সম্ভব না।আমি পরশের সাথে কথা বলতে চাইছি।তার সাথে কথা না বলে মত দিতে পারছি না।”
শশুর কে সোফায় এনে বসিয়েই সোজা দোতলায় ছুটেছে পাভেল।এ বারে আর পূর্বের মতো ভুল করলো না।আসার সাথে সাথেই ভাইকে ঘুম থেকে উঠিয়েছে সে।সারারাত ঝই-ঝামেলা শেষ করে ভোর রাতের দিকে ঘুমিয়েছে।ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতেই পাভেল এগিয়ে গেল।বললো,
_”ছোট কাকা নিচে ডাকছে তোকে।”
শুনলো পরশ। মুখ মুছে রুম থেকে বের হতেই চোখ পড়লো শামসুল সরদারের দিকে।তিনি দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে।পরশ সাময়িক ভাবে কিছুক্ষণের জন্য অবাক হলো।কিছু বলে ওঠার আগেই শামসুল পাভেলের উদ্দেশ্যে বললো,
_”আমি একা কথা বলতে চাই।তুমি যেতে পারো।”
কিছুটা বিরক্ত হলো পাভেল।আঁড়চোখে শশুরের দিকে তাকাতে তাকাতে রুমের বাইরে এলো।বিড়বিড় করে বললো,
_”আরে আমিও তো জামাই।ও এখনো হবু হলেও আমি অরিজিনার জামাই।আমাকে রেখে একান্তে কি বলবে?আমার কি শোনার অধিকার নাই।সবার আগে অধিকার আমার থাকার কথা।অথচ…..ধুর!”
রুমের মধ্যে থাকা সিংগেল সোফাটাতে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছেন শামসুল।তার মনে নানা রকম উৎকন্ঠা এবং সন্দেহ।সামনেই বিছানায় বসে আছে পরশ।ভাবনায় মশগুল সে।কি এমন কথা যেটা নিচে সবার সাথে না বলে একেবারে উপরে একাকী এসেছে তার কাছে?
_”তোমাকে আমার পছন্দ না।আশা করি এর কারন খুলে বলতে হবে না।তুমি আমার প্রতি কোনো বড় ভুল বা অন্যায় না করলেও তোমার গোটাটাই আমার অপছন্দ।কখনো কল্পনায় অ ভাবিনি আমারই দুই মেয়েকে তোমাদের দু ভাই এর সাথে বিয়ে দিতে হবে।শোনো পরশ,হয়তো তুমি বর্তমানে ক্ষমতায় থাকতে পারো।কিন্তু রাজনীতিতে প্রচুর কাঁচা। গত দুই যুগ ধরে রাজনীতি করছি আমি ক্ষমতার সাথে।সেখানে তুমি আমার সামনে চুনোপুঁটি।রাজনীতির ট্রিকস আমার সাথে খাটাতে এসো না।মেয়ের ব্রেনওয়াশ ঠিকমতোই করেছো।যেটা আমার কাছে স্পষ্ট।হোক এটা ভালোবাসা অথবা স্বার্থ।কিন্তু তোমার কারনেই আমার মেয়ে আজ আমার থেকেও তোমাকে প্রায়োরিটি দিচ্ছে।
সেটা দিক,এতে আমার কোনো অসুবিধা নেই।মেয়ে বিয়ে দিতে হবে,নিজের থেকে দূরে রাখতে হবে এটা আমিও জানি।স্পর্শীয়া তোমায় পছন্দ করে, বিয়ে করতে চাইছে এটাতেও আমার কোনো সমস্যা নেই।সমস্যা থাকার কথাও না।ভালোবাসা বিষয়টা স্বাভাবিক।তবে তুমি যদি ক্ষুনাক্ষরেও এই সম্পর্কের পেছনে কোনো স্বার্থের প্রয়াস করে ছক কষে বসে থাকো সেটা তোমার জন্য মোটেও ভালো হবে না।আমার মেয়েরা আমার দুর্বলতা নয়।যদি ভেবে থাকো,ওদেরকে হাতিয়ার করে আমাকে দুর্বল করবে তাহলে তুমি কল্পনার স্বর্গে আছো।আর এর প্রতিবাদ করার জন্য শামসুল সরদারকে প্রয়োজন হবে না।একটা কথা মাথায় রেখো সবসময় আমার মেয়ে কখনো আপোষ করবে না।ওকে দুর্বল মেয়ে ভেবে ব্যবহার করতে যেও না, পস্তাবে।শেষে সব হারাবে।”
পরশ ভেবে পেল না কিছু।এটা কি আদৌ হুমকি স্বরুপ কোনো বার্তা ছিলো নাকি অন্যকিছু।যাই হোক,এমনিতেই একটু গোছগাছ হয়ে এসেছে।এখন যদি এই ত্যাড়ামি কথাবার্তার উত্তর ত্যাড়ামি করে দিতে যায় তাহলে ক্ষতিটা তারই।শামসুল সরদারকে বুঝিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
_”আপনিও ভেবে দেখবেন।স্পর্শীয়া এখন আপনার মেয়ে।আর বিয়ের পর সে আমার স্ত্রী হবে।একজন স্ত্রীর কাছে বিয়ের পর বাবার থেকে স্বামীই বেশি আপন হয়।আর নিজের স্ত্রীকে গুটি বানিয়ে রাজনীতি করার মতো কাপুরুষ শিকদার রা না।সে আমার কাছে আপনার থেকেও সুরক্ষিত থাকবে।”
কথাটা বেশ অপমানজনক হলেও গায়ে মাখলেন না শামসুল।বরং খুশিই হলেন।কিন্তু সেটা প্রকাশ করলেন না।শুধু মুখে বললেন,
_”বিয়ের পর কখনো পরিবর্তন হয়ো না।দাম্ভিকতা যেন এভাবেই থাকে।”
যাবতীয় কথাবার্তা বলা শেষ।পিয়াশা হাসিমুখে নাস্তা নিয়ে এলো মেয়েকে নিয়ে।প্রেমা যথেষ্ট সাহায্য করেছে মাকে।শরবত বানিয়েছে সে।ট্রে তে করে সাতটা শরবতের গ্লাসকে সাজিয়ে নিলো।এবারে গভীর ভাবনায় পড়লো।লোকটা তাকে অপমান করেছে।তাও জনসম্মুখে চরিত্রহীন হিসেবে প্রমাণ করে।একে তো কোনো ফিডব্যাক করাই উচিত। কিন্তু কি করা উচিত সেটা ভেবে পেল না।আচ্ছা শরবত টা আপাতত তার কব্জায়।সে কি একটু থুতু মিশিয়ে দেবে শরবতে।লোকটাকে নিজের থুতু খাওয়াবে।
পরক্ষণেই নিজের উপরেই বিতৃষ্ণা এলো।ইয়াক!ছিহঃ!না না,এতটা বিশ্রীভাবে অসভ্যতা করা উচিত হবে না।আচ্ছা,তাহলে কি একটু মরিচের গুড়া বা বোম্বাই মরিচ মিশিয়ে নিবে?না না,যদি ঝাল লেগে শেষে চিৎকার করে থাপ্পড় মারে।সবাইকে বলে শরবতে ঝাল ছিলো।তখন সবাই মিলে ইচ্ছা করে প্যাদাবে।তখন যে সে ইচ্ছা করে মিশিয়েছে সেটা প্রমাণ হয়ে যাবে।আবারো ভাবনায় পড়লো প্রেমা।সবশেষে সিলেক্ট হলো লবণ।হ্যাঁ লবণ মেশাবে সে।কেউ যদি বুঝতেও পারে তাহলে বলে দেবে ভুল করে চিনি ভেবে লবণ মিশিয়ে ফেলেছে।যেই ভাবনা সেই কাজ।ইচ্ছামতন লবণ মিশিয়ে গুলে নিয়ে ট্রে হাতে নিলো।এরপর ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেল ড্রয়িং রুমের দিকে।প্রথমে সালাম দিয়ে শামসুল সরদারের হাতে শরবতের গ্লাস দিলো।এরপর চিহ্নিত গ্লাস টা সোভামের হাতে দিয়ে একেক করে বাকিদের হাতে তুলে দিলো।
সোভাম গ্লাস ধরেই বসে রইলো।এখানে মুহুর্ত ও ব্যয় করতে ইচ্ছুক নয় সে।শুধুমাত্র বাবার কথায় বসে আছে এখানে।
_”একি বাবা, খাচ্ছো না কেন?”
পিয়াশার কথা শুনতেই বিনয়ী হাসলো সোভাম।এক চুমুক মুখে নিতেই চোখ মুখ বিকৃত হয়ে গেলো।এই শরবত গিলে নেওয়ার মতো হয় নি।ফেলে দেওয়াটাই এই মুহুর্তে অসম্ভব।চোখ মুখ কুঁচকে গিলে ফেলে দ্রুত পাশ থেকে মিষ্টি নিলো।এরপর রান্নাঘরের দিকে তাকাতেই দেখলো প্রেমা লুকিয়ে পড়েছে।এতোক্ষণ যে সে উঁকি মেরে তাদেরকে দেখেছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত।এই বিষয়ে আর তেমন মাথা ঘামালো না সোভাম।তবে কোন ঘটনার উপর ভিত্তি করে ঘটনা টা সে ঘটিয়েছে সেটা তার জানা।
_”আব্বু কোথায় আম্মু?”
_”জানি না তো।কেন রুমে নেই?”
_নাহ!দেখছি না। তোমাকে কিছু বলে নি।”
দ্রুত রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন পিপাসা।হাত মুছে বললেন,
_”না।আমি আসলে রাতে আর্শির সাথেই ছিলাম। সকালে আর যাওয়া হয় নি।আর নিচেও তো দেখলাম না।ওহহো,মনে পড়েছে।তোর বাবা তো সোভাম কে নিয়ে বের হয়ে গেলো সকাল সকাল।কাল রাতে নাকি অনেক ঝামেলা হয়েছে।হয়তো সেখানেই গেছে।”
ভাবনায় পড়লো স্পর্শী।কিছু কি ভেবেছে তার বাবা?তার উত্তর টা কেমন হতে পারে?চিন্তিত হয়ে সোফায় বসলো।কন্ঠকে খাদে নামিয়ে বললো,
_”ওহহ!”
সকাল প্রায় নয়টা বাজে।আজকে অনেক বেশিই ঘুমিয়েছে স্পর্শী।হয়তো সারারাত জেগে থাকার ফলে। এখনো নাস্তা করা হয় নি।ত্রস্ত পায়ে ডাইনিং এ এসে বসলো।হুট করেই সদর দরজা দিয়ে কারো ঢোকার আওয়াজ এলো।ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাতেই দাঁড়িয়ে পড়লো।বাবা এসেছেন।পেছনে সোভাম ও। তাদের মুখশ্রী গুরুগম্ভীর। দুজনেই নিশ্চুপ।কোনোপ্রকার কথা না বলে ত্রস্ত পায়ে উঠে গেল দোতলায়।হতাশ হলো স্পর্শী।হয়তো তাদের মেজাজ এখন বিগড়ানো।এই মুহুর্তে উত্তর চাওয়াটা বোকামি হবে।নাস্তা নিয়ে টেবিলে বসতেই মিনিট খানেকের মধ্যেই বাবা এবং ভাই এলো।ডাইনিং এ বসতে বসতেই হাঁক ছেড়ে বললো,
_”নাস্তা দাও।”
তড়িঘড়ি করে খাবার দিলো সোনালী এবং পিপাসা।খাওয়ার এক পর্যায়ে গলা পরিস্কার করে পিপাসার দিকে তাকালেন শামসুল।বললেন,
_”আজ কি বার?”
_”মঙ্গলবার।কেন?
_”এই শুক্রবারের পরের শুক্রবার স্পর্শীয়ার বিয়ে।পুরো বাড়িটা গুছিয়ে পরিস্কার করে নিও।সামনে শুক্রবার এনগেইজমেন্ট।”
রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬১
হতবাক হয়ে চেয়ে রইলেন সবাই।চমকে উঠলো স্পর্শী।অবাকে চোখ দুটো যেন কপালে উঠে যাবে।পিপাসা হাহাকার করে উঠলেন।বললেন,
_”মেয়ের বিয়ে মানে?কবে ঠিক করলেন?আর কার সাথেই বা বিয়ে?”
শীতল চাহনি তে স্ত্রীর দিকে তাকালেন শামসুল।দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
_”তোমার বেয়াই এর বড় ছেলের সাথে।”