রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬৬(২)
সিমরান মিমি
ক্লান্ত দুপুর।রোদের তীব্র তাপদাহে মানুষ কূল অস্থির।ঘেঁমে-নেয়ে একাকার দুপুরের কর্মরত মানব।মাটির উপরের নরম স্তর টা পর্যন্ত শুকিয়ে ধুলোয় রুপ নিয়েছে।আশপাশ টা গাছ-গাছালি তে ঘেরা।কতক্ষণ পর পর বসার জন্য বেঞ্চি।চারপাশে অসংখ্য নিদর্শন। হ্যাঁ এটা একটা পার্ক।তার’ই মাঝখানে ক্লান্ত হয়ে বসে আছে এক মানবী।মাথাটাকে হেলিয়ে আকাশের দিকে ফিরে আছে।নাহ!তাকিয়ে নয়।তার চোখজোড়া ক্লান্তির সর্বোচ্চ ছাপ তুলে বন্ধ হয়ে আছে।বিভিন্ন সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত মস্তিষ্ক। কিছুক্ষণ আগেই ফোন দেওয়া হয়েছে পরশ শিকদার কে।তিনি ফোন রিসিভড করেন নি।একনাগারে বেশ কিছুক্ষণ দেওয়ার পরে ধমকের সুরে মেসেজ দিয়েছেন।সেখানে স্পষ্ট করে বলা আছে ‘তিনি ব্যস্ত।হুটহাট এমন ছেলেমানুষী স্পর্শীয়ার ক্ষেত্রে সাজে না।সে যেন তাকে আর দ্বিতীয়বার কল না করে।অবসর পেলে তিনিই ব্যাক করবেন।”
স্পর্শী থেমেছে।আর কল বা মেসেজ করেনি অপরপক্ষ কে।প্রায় ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। কিন্তু সে এখনো নড়েনি।সেভাবেই বেঞ্চের উপর বসে আছে ফোনের অপেক্ষায়।পূজার সাথে কথা হয়েছে ফোনে।তাকে কৌশলে বুঝিয়ে শুনিয়ে কথার প্যাঁচে ফেলে স্বীকারোক্তি এনেছে।সে বিচার চায় এবং দোষীদের শাস্তি চায়।স্পর্শী খুব একটা কাঁচা খেলোয়ার নয়।তার উদ্দেশ্যই ছিলো স্বীকারোক্তি আনা।ফোন রিসিভড করার সাথে সাথেই রেকর্ড অন করেছে এবং গত পনেরো মিনিট ধরে এডিটিং করে,কাঁটছাট করে একটা স্পষ্ট স্বীকারোক্তির ক্লিপ ক্রিয়েট করেছে।যেখানে পূজা বলছে,_”তারা আমার জীবন টা নষ্ট করে দিয়েছে।নিজেকে পঁচা নর্দমার মতো লাগছে।আমি কেন তাদের ক্ষমা করে দেব।বিচার চাই আমি,শাস্তি চাই।”
ব্যাস কাজ হয়ে গেছে।ক্লিপ টাকে সযত্নে সংরক্ষণ করে নিয়েছে স্পর্শী।সে এটার শেষ দেখে ছাড়বে।ভাবনার মধ্যেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো।ফোন টাকে বেঞ্চ থেকে উঠিয়ে হাতে নিলো।স্ক্রিনে জ্বলজল করছে অদ্ভুত নামটি।’না হওয়া বর”_এটা গত এনগেইজমেন্টের আগের দিনই সেভ করেছে।রিসিভড করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে ধমক এলো।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
_”তোমার কি কোনো কমনসেন্স নাই?বাচ্চা তুমি?ফোন একবার না ধরলে তো একটা বাচ্চাও বুঝতে পারে যে অপরপক্ষের মানুষ টা ব্যস্ত আছে।কেন এমন খামখেয়ালি করছো তুমি?আমি কমিশনারের সাথে ছিলাম।নানান রকম আলাপ-আলোচনা,সম্মেলন,মিটিং এ থাকতে হয় আমাকে।এটা জেনেও কেন পাগলামি করো?”
স্পর্শী শুনলো।এরপর শান্ত কন্ঠে বললো,
_”তা কতদুর হলো মিটিং এর?কমিশনার কি রাজী হয়েছে কেস টা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য?কত টাকা গেল মোট?”
স্তব্ধ হয়ে গেলো পরশ।কন্ঠে সর্বোচ্চ জোর এনে বললো,
_”হোয়াট!!কি বলছো তুমি?মাথা কি ঠিক আছে?
_”মাথা আমার ঠিকই আছে।কিন্তু খারাপ হয়েছে আপনার টা।আমার লজ্জাও করছে না।জাস্ট ঘেন্না হচ্ছে।আমি কি করে আপনাকে চিনতে ভুল করলাম?এতোটা জঘন্য মানুষ আপনি।একটা আঠারো বছরের মেয়েকে তিন তিনটা জোয়ান ছেলে মিলে গণধর্ষণ করলো,মার্ডার করার চেষ্টা করলো,আর আপনি তাদেরকে বাঁচাতে চাইছেন?শুধুমাত্র আপনার দলের লোক দেখে?ছিহ!আরে মেয়েটা মরতে মরতে বেঁচেছে।ওর বয়সী আপনার ঘরে একটা বোন আছে।আপনি ওর জায়গায় প্রেমাকে বসিয়ে দেখুন।আজ আপনার বোন নয় দেখে অন্য একটা মেয়ের ধর্ষক দের বাঁচাচ্ছেন।একটা কথা মনে রাখবেন, ধর্ষক মানুষ আর পশু আলাদা করে দেখে না।তাদের শুধু মাত্র ক্ষুধাটাই থাকে।আজ এই মেয়েটা,কাল ওর জায়গায় আপনার বোন হতে একটুও দেরি হবে না।তখন পারবেন তো এভাবে চুপ করে থাকতে?আচ্ছা,একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছা হচ্ছে।ওই মেয়েটার জায়গায় যদি আমি হতাম,ওরা যদি আমাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেত ;তাহলেও কি ঠিক এমন ভাবেই নিরব থাকতেন?”
চারপাশ টা জনসমাগমে ভরপুর।সবাইকে দেখে চোখ বন্ধ করে নিলো পরশ।শান্ত গলায় কন্ঠকে স্বাভাবিক করে বললো,
_”আমাকে রাগিয়ে দেওয়া যদি তোর উদ্দেশ্য হয় তাহলে সেটা তোর জন্য মোটেও সুখকর হবে না।ভাবিস না আমি দূরে আছি বলে ফোনে তুই যা খুশি তাই বলবি।তোকে ছুঁতে আমার দশ মিনিট ও লাগবে না।বারবার সাবধান করছি,আমি যেমন আছি সেরকম ই থাকতে দে।তোকে খুন করতে আমার হাত এক বার ও কাঁপবে না।আমাকে তুই চিনিস না।”
_”চিনছি তো।ধীরে ধীরে চিনছি।হয়তো বিয়ের আগে বাকিটাও চিনে নেবো।আপনি চিন্তা করবেন না।আমি ভুল করলেও সেটা খুব দ্রুতই শুধরে নিতে জানি।”
কেটে দিলো ফোন।ক্লান্ত,পরিশ্রান্ত, নুইয়ে পড়া দেহটাকে কোনোরকম টেনে রাস্তায় নিলো।ভর দুপুর।আশেপাশে তেমন গাড়ি নেই।হস্পিটালে দ্বিতীয়বার যাওয়ার পর পরই ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিয়েছে গাড়ি নিয়ে।তখন সিদ্ধান্ত টা সঠিক মনে হলেও এখন সেটাকে বোকামি মনে হচ্ছে।এখন গাড়ি টা থাকলে নিশ্চিন্তায় এক টানে বাড়ি পৌছানো যেতো।এখন এখান থেকে হেটে ব্রিজের ওপাশে যেতে হবে।তবেই পাওয়া যাবে গাড়ির স্ট্যান্ড।এলোমেলো পায়ে হেঁটে সামনের দিকে এগোতে লাগলো।সারা শরীর টা বিষাদে ছেঁয়ে গেছে।মস্তিষ্ক টা যেন শূণ্য।বাহ্যিক কোনো কিছুই তাকে ছুঁতে পারছে।পেছন থেকে হর্ণের আওয়াজ আসছে।হয়তো সে রাস্তার মাঝখানে হাঁটছে।
এই জন্যই ড্রাইভার তাকে বারবার সরে যাওয়ার ইশারা দিচ্ছে।কিন্তু স্পর্শী পেছনে ফিরলো না।এই মুহুর্তে রাস্তার পাশে যেতেও ইচ্ছে করছে না।অনবরত হর্ণের শব্দে বিরক্ত লাগলো স্পর্শীর।মনের মধ্যে অকারণেই জেদ চেপে গেল।ভেতর থেকে খামখেয়ালী চেপে ধরলো প্রবল ভাবে।হুট করেই দাঁড়িয়ে পড়লো রাস্তার মাঝখানে।পেছনে ফিরে গাড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
_”আর একবার হর্ণ বাজাবি তো তোর গাড়ির একটা গ্লাস ও অক্ষত থাকবে না।আমি সরবো না এখান থেকে।এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো।তোর সাহস কত্ত বড় আমি দেখবো।পারলে আমায় উঁড়িয়ে দিয়ে দেখা?”
আশ্চর্যের সপ্তমে পৌছালো সোভাম।তড়িঘড়ি করে নেমে এলো গাড়ি থেকে।স্পর্শীর পাশে আসতেই পুণরায় অবাক হলো।উস্কোখুস্কো চুল,লাল চোখ,টলমলে শরীরে তাকে ভীষণই অস্বাভাবিক লাগছে।দুহাতে কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে সোভাম বললো,
_”তুমি না বলে কেন বেরিয়েছো?চিন্তায় ছিলাম না আমরা।সারাদিনে খাওয়া নেই নাওয়া নেই কোথায় ছিলে?এরকম পাগলামি সাভারে গিয়ে যতখুশি করো;এখানে না।আরে আশ্চর্য! তোমার হয়েছে টা কি?”
কোনো উত্তর দিলো না স্পর্শী।শরীরটা ক্লান্ত লাগছে খুব।আলগোছে মাথাটা নুইয়ে দিলো ভাইয়ের বুকে।অস্ফুটস্বরে বললো,
_”আমাকে একটু বাড়ি নিয়ে চলো প্লিজ!খিদে পেয়েছে খুব।”
ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো সোভাম।দ্রুত হাতে ধরে গাড়ির ভেতরে বসালো।সিটে বসিয়ে হাতে পানি দিয়ে বললো,
_”খুব বেশি কি খিদে পেয়েছে তোমার?কিছু কিনে আনবো?”
_”উঁহু!না।বাড়ি গিয়ে খাবো।”
গলার উপরটা পা দিয়ে পিষে চেপে ধরলো পরশ।শরীরের সর্বোচ্চ জোড় দিয়ে লাথি মারলো বুকের উপর।মুখ দিয়ে কুঁকড়ানোর আওয়াজ আসতেই পেটের উপর পুণরায় লাথি মেরে হিংস্রতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছালো।রাগে থরথর করে কাঁপছে শরীর।গায়ের পাঞ্জাবি টা ঘামের লবণাক্ত পানিতে ভিজে একাকার হয়ে গেছে।কন্ঠে হিংস্রতা ছড়িয়ে গলা চেপে ধরলো সাকিবের।বললো,
_”খুব জ্বালা না শরীরের?ভর সন্ধ্যাবেলায় চলে গেছিস জ্বালা মেটাতে।জানো’য়া’রের বা’চ্চা!তোদের টাকা কি কম দেই আমি?যখন, যেখানে যে অবস্থায় টাকা চাইছিস পাঠিয়ে দিয়েছি। তাই বলে আমার খেয়ে, আমার পরে আমাকেই ফাঁসাবি।ভর সন্ধ্যাবেলায় মদ গিলেছিলিস কেন?এখন তোদের জন্য প্রতি পদে পদে আমাকে অপমানের স্বীকার হতে হচ্ছে কু*ত্তা*র বা*চ্চা!পিরোজপুরে কি প*ল্লী ছিল না যে তোদের ওই মেয়েটার পেছনে লাগতে হবে?তাও সন্ধ্যায় ;যখন মানুষ চিনে ফেলবে।শুধুমাত্র সামনে উপজেলা নির্বাচন টা না থাকলে কি অবস্থা করতাম কল্পনায় ও আনতে পারতি না।আজ রাতের মধ্যে পালাবি।বরিশালের আশেপাশেও যেন না দেখি।অন্তত দু মাসের জন্য।তা না হলে গণধোলাই খেয়ে মরবি।”
রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬৬
সুজনের শার্টের বোতাম একটাও সুরক্ষিত নেই।শার্টের এক কোনা ছিঁড়ে কনুই তে নেমে গেছে।ক্ষোভ পুর্ণ শীতল দৃষ্টি নিয়ে পরশের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।গোডাউন থেকে বের হতেই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো।রক্তের ফোঁটা মাখা ফাঁটা ঠোঁটজোড়া কে নাড়িয়ে অস্ফুটস্বরে বললো,_”ভাই?তুমিতো ফেঁসে গেছো।যার কারনে তুমি আমারে ছাড়লা,তারে দিয়াই আমি তোমারে দুনিয়া ছাড়া করবো।”