রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬৬(৪)
সিমরান মিমি
কুয়াশা মাখা স্নিগ্ধ ভোর।নভেম্বরের এই মাঝামাঝি এসেও প্রকৃতি যেন মানবকুলের সাথে এক অদ্ভুত খেলায় মেতে উঠেছে।ভোররাত থেকে এগারোটা পর্যন্ত শীত।দুপুর থেকে রাত দশটা পর্যন্ত গরম আর বাকিটা বসন্ত।নির্দিষ্ট ভাবে যেন আবহাওয়া প্রকৃতি কে ছুতেই পারছে না।সকাল তখন আটটা।নিজেকে পরিপাটি করে হাতে ছোট্ট একটা ব্যাগ নিলো স্পর্শী।এরপর ত্রস্ত পায়ে নিচে চলে এলো।বাড়ির বাকি সদস্যরা নাস্তার টেবিলে।এইতো আধঘন্টা আগেই মা তার নাস্তা নিয়ে কক্ষে গেছিলেন।মেয়েকে নিজ হাতে খাইয়ে,ওষুধ খাওয়ানোর পর তবেই ফিরলেন।স্পর্শী নিজেও দ্বিমত করেনি।পিপাসা নরম গলায় মেয়েকে অনেক বোঝালেন।কিন্তু স্পর্শীর থেকে কোনো রকম ইঙ্গিত পান নি।সে চুপ করে শুনছিলো সবটা।সিঁড়ি থেকে নেমে সদর দরজার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই থেমে গেল স্পর্শী।দিক পরিবর্তন করে হেঁটে গেল ডাইনিং টেবিলের দিকে।বাবার চেয়ারের পেছনে গিয়ে শান্ত হয়ে দাঁড়াতেই সবাই চমকালো।শামসুল পিছনে তাকিয়ে অবাক হলেন।আশ্চর্যের সুরে বললেন,
_”তুমি কি বাইরে যাচ্ছো?”
স্পর্শী আলতো হাসলো। বাবার হাত ধরে অনুরোধের ন্যায় দাঁড়ালো।কন্ঠে আহ্লাদী সুরে ফুটিয়ে বললো,
_”আব্বু প্লিজ!আমার শরীর যথেষ্ট ঠিক আছে এখন।কিছু দরকারী কেনাকাটা করতে হবে।ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই চলে আসবো।আর গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।চিন্তার কোনো কারন নেই।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
শামসুল সরদার মানলেন না।মেয়ের দিকে তাকিয়ে বাঁধা দিয়ে বললেন,_”মামুনি,কিছু কেনার থাকলে আমাকে বলো।তোমার কাকিকে বলো।তোমার এই অসুস্থ শরীর নিয়ে যাওয়ার কোনো দরকার নাই।”
আচমকাই শরীর টানটান করে দাঁড়িয়ে পড়লো স্পর্শী।বুকে হাত বেঁধে বললো,_”দরকার নেই।আমি পছন্দ করে কিনবো বলেই যাচ্ছি।তাড়াতাড়ি এসে পড়বো।শরীর খারাপ লাগলে ফোন করে জানাবো।এখন আসি।”
বলেই গটগট পায়ে বেরিয়ে গেল সদর দরজা দিয়ে।সকালের মিষ্টি রোদ টা গায়ে লাগতেই চোখ বন্ধ করে নিলো।অসুস্থ ভেঙে পড়া শরীর টা যেন মুহুর্তেই চাঙ্গা হয়ে উঠলো।মুখের হাসিটাকে আলতো প্রসারিত করে এগিয়ে গেল গেরেজের দিকে।
_”স্যার ব্যস্ত আছেন উনি আজ দেখা করতে পারবেন না।”
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির বলা কথাগুলো শুনতেই কপাল কুঁচকে ফেললো স্পর্শী। তড়িৎ গতিতে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো।কন্ঠে তীব্র রুক্ষতা নিয়ে বললেন,
_”আজ দেখা করতে পারবেন না মানে?সেই সকালে এসেছি।এ যাবৎ তিন তিন বার সময় বলে অপেক্ষা করিয়েছেন।আর এখন দু ঘন্টা পর এসে বলছেন আজ দেখা করতে পারবেন না।”
লোকটি একটুও টললো না।বরং বিরক্ত হয়ে বললো,_”দেখুন,কমিশনার সাহেব আপনাদের কথা শোনার জন্য সারাদিন বসে থাকেন না।ওনার আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।আপনি আরেকদিন আসুন।”
কপালের কুঞ্চিত হওয়া চামড়ার ভাঁজ গুলোকে নিমিষেই স্বাভাবিক করে ফেললো স্পর্শী।এরপর টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
_”কমিশনার সাহেব কে বলুন,পিরোজপুর ৩ এর সাবেক সংসদ সদস্য শামসুল সরদারের বড় মেয়ে দেখা করতে এসেছে।”
লোকটি এপর্যায়ে অবাক হলেন।কিন্তু প্রকাশ হলেন না।কিছুটা চিন্তা-ভাবনা করে আবারো ঢুকে গেলেন অফিসের ভেতরে।মিনিট পাঁচেক পর ফিরে এসে পূর্বের ন্যায় বিরক্তিমাখা কন্ঠে বললো,
_”আসুন।তবে অল্পতে কথা সারবেন।”
লোকটাকে আর উত্তর দিলো না স্পর্শী।ত্রস্ত পায়ে ঢুকে গেল তার পিছু পিছু।কক্ষে ঢুকতেই লোকটি বাইরে থেকে দরজা চাপিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।স্পর্শী বিনয়ের সাথে সালাম দিলেন কমিশনার কে।তিনি উত্তর নিয়ে বললেন,
_”বসুন।তা আপনার বাবা কেমন আছেন?কোনো দরকার থাকলে তো নিজেই আসতেন।কিন্তু আপনাকে কেন পাঠিয়েছে বুঝতে পারলাম না।”
_”আসলে দরকার টা বাবার নয়,আমার।”
_’বলুন।”
স্পর্শী নড়েচড়ে বসলো।ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে রেকর্ডিং এ ঢুকলো।এরপর সরাসরি দৃষ্টি দিলো কমিশনারের দিকে।বললো,
_”পিরোজপুরে সদ্য একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে।পূজা নামক এক কলেজ ছাত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে।শুনেছেন নিশ্চয়?”
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো কমিশনার।তীর্যক দৃষ্টি দিয়ে স্পর্শীকে একবার পরোখ করে নিলো।গম্ভীর কন্ঠে বললো,
_”হ্যাঁ, না শোনার তো কিছু নেই।মেয়েটাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিভাগীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
_”যখন এই বিষয়ে শুনেছেন ই তখন আসামীদের এখনো গ্রেফতার কেন করছেন না?”
_”দেখুন,আমরা যে হাতে হাত লাগিয়ে বসে আছি এমন টা না।ধর্ষক দের পরিচয় জানামাত্রই আমরা তাদের গ্রেফতার করতে চেয়েছি।কিন্তু ওখানকার এমপি মিঃ পরশ শিকদার বলেছেন,বিষয়টা তিনি সামলে নিবেন।যদিও আমরা তার কথার উপর ভরসা করে বসে থাকিনি।কারন তিনি তো আর আইনের লোক না।আমরা অফিসার পাঠিয়েছিলাম।মেয়ের বাবা-মা দুজনেই এই বিষয়ে ঘাটতে বারন করেছেন।এতে তাদের মেয়ের সম্মান জড়িত।তারা জরিমানা নিতে রাজী হয়েছেন। এক্ষেত্রে আমাদের কি করার আছে?”
_”অবশ্যই করার আছে।কারন ধর্ষণ ওর মা-বাবা নয়,ওই মেয়েটা হয়ে ছে।আর পূজা নিজেই চায় ধর্ষকদের শাস্তি।সেক্ষেত্রে আপনি তার মা-বাবার কথা শুনে কেন বসে থাকবেন।”
কমিশনার কথার প্যাঁচে পড়ে সাময়িকভাবে চুপ হয়ে গেলেন।কিছুক্ষণ পর বললেন,
_”সেই মেয়ে এ ব্যাপারে কোনো মত ই দেয় নি।তিনি যাবতীয় সাহায্য সহযোগীতা নেওয়ার আগ্রহ জানিয়েছে।”
বেঁকে বসলো স্পর্শী।বললো,_”তো?চিকিৎসার টাকা, লেখাপড়ার টাকা একজন এমপি হিসেবে পরশ শিকদার দিতে চেয়েছেন আর মেয়েটা নিয়েছে।এর জন্য কি ধর্ষকরা মুক্তি পাবে?পরশ শিকদার বা আপনারা কি সাহায্য সহযোগীতা করার আগে বলে দিয়েছিলেন যে এই সাহায্যের বিনিময়ে ধর্ষকদের ভুলে যেতে হবে?”
চুপ করে তাকিয়ে রইলেন কমিশনার।স্পর্শী ফোন থেকে রেকর্ডিং টা শোনালো।বললো,
_”এটা পূজার জবানবন্দি।সে নিজে এই ধর্ষকদের বিচার চেয়েছে।এখন ও কি আপনি চুপ করে থাকবেন?”
হুট করেই উলটো গান গেয়ে বসলেন কমিশনার।বললেন,
_”না, ভুক্তভোগী নিজে বিচার চাইলে আমরা কেন চুপ থাকবো?তবে এই প্রমাণ টা আপনি আপনাদের থানায় জমা দিন।যেখানে কেস টা করা হয়েছে।বাকিটা আমি দেখে নেবো।”
আশ্বাস পেলো স্পর্শী।সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তবেই ত্যাগ করলো কমিশনারের কার্যালয়।মুহুর্তেই হাতে ফোন তুলে নিলো কমিশনার।ওপাশ থেকে পরশ রিসিভড করতেই ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
_”ঝামেলা হয়ে গেছে ভাই।শামসুল সরদারের মেয়ে এসেছিলো আমার এখানে।সেতো পুরো প্রমাণ নিয়ে হাজির।এখন তো আর চুপ থাকা যায় না।তাহলে তো আমাদের উপর আঙুল উঠবে।”
পরশ অবাক হয়ে গেলো।আশ্চর্যের সুরে বললো,_”স্পর্শীয়া ওখানে গেছিলো?”পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,_”ঠিক আছে।কি প্রমাণ নিয়ে গেছে ও?আর কি কি বলেছে?বিস্তারিত বলো।”সবটা শোনার পর একহাত দিয়ে চেয়ারের হাতল টা চেপে ধরলো।মাথায় রক্ত উঠে গেছে।রাগে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে বললো,
_”বেশ!আমি দেখছি।”
থানার সামনে গাড়ি থামতেই দ্রুতপায়ে নেমে গেলো স্পর্শী।সূর্য টা এখন মাথার উপরে।সেই সকালের মিষ্টি রোদ টা এখন অসহ্যকর ঠেকছে।টপ টপ করে ঘামের ফোঁটা বেয়ে পড়ছে কানের দুপাশ থেকে।ত্রস্ত পায়ে থানার ভেতরে ঢুকতেই ইনস্পেকটর বাঁকা হাসলো।তোষামোদ করে বললো,
_”আরে আসুন,আসুন।ম্যাডাম যে ;তা এই ভর দুপুরে কি মনে করে?কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?”
সম্বোধন টা খুবই বিরক্তিকর ঠেকলো স্পর্শীর কাছে।কোনো প্রকার কথা না বলেই বসে পড়লো চেয়ারে।ফোন হাতে রেকর্ডিং বের করে বললো,
_”মাত্র’ই কমিশনারের সাথে কথা বলে এসেছি।তিনি কেস টা নিয়ে ঘাটতে বলেছে।পূজা নিজেই চায় ধর্ষকদের বিচার হোক।আপনারা দ্রুত ধর্ষকদের গ্রেফতার করুন।”
ইনস্পেকটর মন দিয়ে রেকর্ডিং টা শুনলো।এরপর হেয়ালি করে বললো,_”এই প্রমাণ টার তো কোনো প্রয়োজন নেই এখন।”ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো স্পর্শী।ক্লান্ত কন্ঠে বললো,_মানে?”
_”কেস টা তুলে নেওয়া হয়েছে।”
অবাক হলো স্পর্শী। কন্ঠে আশ্চর্যের সুর তুলে আর্তচিৎকার করে বললো,”হোয়াট!কেস তুলে নেওয়া হয়েছে মানে?কে তুলেছে?আর কখন?”
_”দেখুন পূজার বাবা সকালে কেস তুলে নিয়েছে।তারা চান না এটা নিয়ে আর ঘাটাঘাটি হোক।”
_”কিন্তু পূজা চায় না এটা।ও চায় বিচার হোক।আপনি কেন কেস তুললেন?”
_”কারন কেস করেছেই পূজার বাবা আর ।সেখানে তারা যদি স্বেচ্ছায় মামলা তুলে নিতে চায় তাহলে আমি কেন আটকাবো?”
_”বেশ তো।আমি আবারো মামলা করবো ধর্ষকদের নামে।আপনি কেস লিখুন।”
ইনস্পেকটর বেঁকে বসলেন।বললেন,_”সে আপনি করতেই পারেন।কিন্তু এখানে ভুক্তভোগী নিজেই যখন বেঁচে আছেন তখন তার সম্মতি লাগবে।তার অবর্তমানে তার মা-বাবার সম্মতি লাগতো।যেহেতু তারা নিজেই চাইছেন না সেক্ষেত্রে আপনি একজন অপরিচিত ব্যক্তি,তার উপর ঘটনা স্থলে উপস্থিত ও ছিলেন না;আপনার থেকে কেস নেওয়া যাবে না।সাক্ষী হিসেবেই তো নেওয়া যায় না আপনাকে,সেখানে কেস তো দূর।বাদ দিন ম্যাডাম!কেন করছেন এমন?নিজের’ই হবু স্বামীর বিরুদ্ধে কেন লড়তে চাইছেন?এর থেকে শান্তিপূর্ণ ভাবে বিয়েটা করুন।আমরাও দাওয়াত খাই।”
রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬৬(৩)
স্বজোরে ইন্সপেক্টর এর হাত থেকে মোবাইল টা কেড়ে নিলো স্পর্শী।চেয়ার থেকে দুপ করে উঠে দাঁড়ালো।কন্ঠে তেজ নিয়ে বললো,_”তার মানে আপনি পূজাকে ছাড়া কেস নিবেন না,তাই তো?”
মাথাটাতে উপর নিচ করে হ্যাঁ সরুপ উত্তর দিলো ইনস্পেকটর। বললো,_”জ্বী!ওনার সম্মতি প্রয়োজন।”
চুপ করে থানা থেকে বের হয়ে যাওয়ার প্রয়াস করলো স্পর্শী।দু কদম এগোতেই থেমে গেলো।পুনরায় ইনস্পেকটর এর ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়ালো।বললো,
_”আপনাদের এমপি সাহেব কে বলে দেবেন-‘বাপের ও বাপ আছে।’ক্ষমতা নিয়ে যেন কম দৌঁড়ায়।”