রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬৭

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬৭
সিমরান মিমি

বিশাল এক ছায়া।চাঁদের স্নিগ্ধ জ্যোৎন্সার আলোয় লম্বা আমলকি গাছ টার ছায়ার আকার হয়েছে হ্রাস।ফলসহ ঝাঁকড়া পাতা গুলো মাটির অধিকাংশ জায়গা জুড়ে বিরাজ করছে।সেই ছায়ার মধ্যেই আরেকটা ছায়া।এর বর্ণ বিভীষিকাময় অন্ধকারের মতো।গাছ-গাছালির ফাঁক-ফোঁকর থেকে ছায়াটিকে পূর্ণ দেখা গেল না।আদৌ সে মানব নাকি মানবী সেটুকুও বোঝা গেল না।শুধু শোনা গেল হিংস্র বাক্য ক-খানি।কারোর উপর তেজ নিয়ে হুংকার দিয়ে বলছে,_”হলো না।কোন কাজ’ই হলো না।সেই যা-ই হোক,দিনশেষে সব ঠিক হয়ে যায়।ঘটনা ঘটার দিন যতখানি উষ্ণতা আমি ওর মধ্যে দেখেছি ধীরে ধীরে সেটা সব বিলীন হয়ে যাচ্ছে।এমন হলে তো আবারো পরিকল্পনায় ব্যর্থ হবো।এমনটা তো হতে দেওয়া যাবেই না।জ্বালাতে হবে,আবারো সেই আগুন জ্বালাতে হবে।”

হঠাৎই আমলকি গাছের পেছন থেকে আরেকটা ছায়া বের হলো।অর্ধ সেই চাঁদর মুড়ি দেওয়া ছায়াটি হাঁপিয়ে গিয়েছে।তার শরীরের নড়ন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।বললো,_”কম তো করলাম না।এবারে আবার কি করতে হবে?”
_”কিছুই না।শুধুমাত্র প্রথম দিনের সন্দেহকে সত্যিতে রুপান্তর করবি।এ মেয়ে কোনো কাজেই আসলো না।শুধু শুধু হাত নষ্ট।”
রাত তখন খুব বেশি নয়।ঘড়ির ঘন্টার কাঁটা-টা মাত্র দশ টাকে ছুঁয়েছে।বিছানায় হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে আছে স্পর্শী।পাশেই আর্শী বসে।নানান রকমের আচার খাওয়ায় ব্যস্ত সে।কতক্ষণ পর পর আপুকে সাধলেও সে নিতে নারাজ।একপ্রকার কিঞ্চিৎ সাড়া-ও না দিয়ে বিভোর হয়ে রইলো নিজ ভাবনায়।এখন আর কিচ্ছু করার নেই তার হাতে।বাকি শুধুমাত্র অপেক্ষা।এই অপেক্ষা বিনে কোনো কাজ করা সম্ভব নয়।চারদিক বন্ধ।আর্শি বোনের দিকে তাকিয়ে আবারো ডাকলো।আদুরে কন্ঠে বললো,_”আপু,এটা একটু টেস্ট করে দেখ।ভীষণ মজা।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বিরক্ত হলো স্পর্শী।বোনের দিকে তাকিয়ে চক্ষু গরম করে বললো,_”তুই কি যাবি এখান থেকে।বিরক্ত করিস না।মাথা ব্যথা করছে।”আর্শি এ পর্যায়ে আরো উৎফুল্ল হলো।অতি উৎসাহী কন্ঠে বললো,_মাথা ব্যাথা করছে?তাহলে আচার খাও।কমে যাবে।ভালো-ও লাগবে।একবার খেয়ে দেখো।”
হাত বাড়িয়ে সামান্য একটু নিলো স্পর্শী।মুখে তুলে খেতে খেতে পুনরায় ভাবনায় নিমজ্জিত হলো।কিয়দংশ চিন্তায় মগ্ন থাকার পর মনে পড়লো ফোনের কথা।বালিশের নিচ হাতড়ে ফোন হাতে নিয়ে লক খুলতেই চোখ গেল কন্টাক্ট লিস্টের দিকে।পরশ শিকদারের নাম্বার থেকে কল এসেছিলো বিকালে।একটা নয় বরং ছয়-ছয় টা মিসড কল।এই কল কেন যেন এখন আর টানে না তাকে।অদ্ভুত এক বিতৃষ্ণা জন্মাচ্ছে প্রতিনিয়ত।কিছু একটা ভেবে কল ব্যাক করলো স্পর্শী।রিং পড়ার সাথে সাথেই রিসিভড হলো।পরপর’ই ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে এক দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ এলো।মুখে বললো,_”অবশেষে! ”

আর কোনো শব্দ উচ্চারণ করলো না পরশ।এটুকু বলেই থেমে গেল সে।স্পর্শী চোখ বন্ধ করে নিলো।শান্ত আওয়াজে বললো,_”ঘুমাচ্ছিলাম।ফোন সাইলেন্ট করা ছিলো বিধায় খেয়াল হয় নি।”পরমুহূর্তেই দুপ্রান্তে নিস্তব্ধতা বিরাজ করলো।দুজনই অপেক্ষা করলো একে -অপরের প্রশ্নের আশায়।কিন্তু মিনিট খানেক ব্যায়ের পরেও কোনো টু শব্দটিও হলো না তাদের মধ্যে।শুয়ে আছে পরশ।ফোন টাকে রিসিভড করে খোলা বস্ত্রশূণ্য প্রশস্ত লোমযুক্ত বুক খানির উপর রাখলো।আর অপেক্ষা করলো না স্পর্শী।নিজেই প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলো।বললো,_”ফোন দিয়েছিলেন কেন?কিছু বলবেন?”

পরশ উত্তর দিলো না।কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর উলটো প্রশ্ন ছুঁড়লো।শান্ত কন্ঠে বললো,_”তোমার আর আমার সম্পর্ক কি শুধুমাত্র কিছু বলার উপরই ডিপেন্ড করবে স্পর্শীয়া।এমনি কি কল করতে পারি না আমি?”স্পর্শী থমকালো।বুকের বাঁ পাশটা থেকে সুক্ষ্ম ভাবে চিনচিনে ব্যাথা উঠছে।অপরপক্ষকে কি বলবে ভেবে পেল না।কিন্তু তাও বলার চেষ্টা করলো।অভিমান মিশ্রিত কন্ঠে বললো,_”জানিনা,সবকিছু কেমন অচেনা ঠেকছে।আমার জীবন টা-ই আজকাল অপরিচিত লাগছে আমার কাছে।কি ছিলাম আমি,আর কি হচ্ছি।আজকাল ওই ইট-পাথরের নগরগুলোকে খুব মিস করছি।আর যা-ই হোক,অন্তত পক্ষে প্রতিনিয়ত ব্যস্ততার সাথে জীবন পার করতাম।ভাবার সময়-ই পেতাম না।কেন যে এই সুন্দর পরিবেশের আশা করলাম?নিজেই মাঝেমধ্যে ভেবে পাই না।না এই স্নিগ্ধ পরিবেশের মধ্যে আসতাম,আর না-তো অনুভূতি জাগতো।আর না-তো প্রতিনিয়ত এমন গুমরে মরতাম।”

অতি সুক্ষ্ম ভাবে প্রশ্ন টা এড়িয়ে গেল স্পর্শী।পরশ বুঝতে পেরে হাসলো।কটাক্ষ করে বললো,_”তা আজকাল বুঝি আমাকেই কোনঠাসা করে এর জন্য দায়ী করছো?”
_”দায়ী করলেও কি সেটা খুব বেশি ভুল হয়ে যাবে এমপিসাহেব?আপনি নিজেই বলুন না এর জন্য আদৌ আপনি কতটুকু দায়ী?”
_”হুম,ভুল ই।তবে এসবের জন্য আমি দায়ী নই।দায়ী তোমার কৌতূহল,দাবী তোমার উড়নচণ্ডী স্বভাব। আমি বুঝি না প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে তোমার কেন এত ঢুকতে হবে।তুমি কে?নিজেকে কি ভাবো তুমি?এতো মাতব্বরি কেন করতে চাও?”

ভ্রু-যুগল মুহুর্তেই কুঁচকে ফেললো স্পর্শী। ধীরে ধীরে পরশের কথাগুলো খুবই হিংস্র ঠেকছে।দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলালো স্পর্শী।কটাক্ষ করে বললো,_”আমি মাতব্বরি করছি বলেই তো আপনার এতো জ্বলছে।নইলে তো কেউ জানতেই পারতো না গণধর্ষণের পেছনে আপনার-ই লোকেদের হাত আছে।আর আপনি তাদেরকে রক্ষা করতে চাইছেন।সিরিয়াসলি?আচ্ছা আপনার কি লজ্জা করছে না?আমার তো ভাবতেই আপনার উপর ঘেন্না চলে আসছে।কিভাবে বিয়ে করবো আপনাকে?আপনাকে তো আমার রুচিতেই আসছে না।আচ্ছা,একটা কথা বলুন।এতো এতো মানুষ আপনাকে ভালোবেসে ভোট দিয়ে এমপি বানালো। অথচ সেই তাদের-ই মেয়েদের রক্ত-ইজ্জত দিয়ে নিজের দলের জানোয়ার-দের তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন।আপনি কি শুধুমাত্র ওদের এই স্বাধীনতা দেওয়ার জন্যই ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন?”

নিশ্চুপ হয়ে রইলো পরশ।কথা গুলো প্রত্যেক-টা বিষাক্ত তীরের ন্যায় গায়ে ফুটছিলো।শরীরের প্রতিটা শিরা উপশিরা অগ্নিকান্ডের ন্যায় জ্বলজ্বল করে উঠছে।এই মুহুর্তে কল কেটে দেওয়াই উত্তম।না-হয় গত রাতের ন্যায় রাগ চেপে যাবে মাথায়।যেটা পরবর্তীতে আরো ভয়ংকর ঘটন ঘটাবে।চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে ফোন টা কেটে দিতে গেল।কিন্তু পারলো না।কন্ঠকে অতি শীতল করে বললো, _ “তুমি পিরোজপুরে এসেছো মাত্র আড়াই মাস।আর আমি আছি আড়াই যুগ।আমাকে কিছু বোঝাতে এসো না।শুধুমাত্র সাবধান করছি।যে ঘটনা আমাকে কেন্দ্র করে ঘটছে, সেই ঘটনায় তুমি জড়িয়ো না।তুমি কি জানো,গোছানো ঘটনাগুলো পুণরায় খুঁড়ে তুমি অগোছালো করে দিচ্ছো।আমি তোমাকে ব্যক্তিগতভাবে চাইছি বলে এটা না যে তুমি আমার রাজনৈতিক জীবনে জড়াবে।স্পর্শীয়া,দূরে থাকো।কারোর গুটি হয়ে আমাকে দূর্বল করো না।”

কেটে গেল ফোন।অবাক হলো স্পর্শী।মাথার মধ্যে অজস্র প্রশ্ন কিলবিল করছে।কিন্তু কে দেবে এই উত্তর?একবার-দুইবার করে অজস্রবার কল দিলেও ওপাশ থেকে ধরলো না পরশ।শঙ্কায় নুইয়ে পড়লো স্পর্শী।সত্যিই কি সে ভুল ছিলো।তার কি উচিত হয় নি এসবে জড়ানো।কিন্তু চক্ষুসম্মুখে দেখেও কিভাবে চুপ থাকবে।আর পরশ-ই বা কেন সব এড়িয়ে যেতে চাইছে।কোন ঘটনাকে নস্যাৎ করতে ঘটনা চাপাতে চাইছে।ভাবতে ভাবতে পাগল প্রায় সে।এরইমধ্যে নিচ থেকে ডাক এলো আর্শির।সেকি উৎফুল্ল কন্ঠ।নিচ থেকে হাসির শব্দ ও শোনা যাচ্ছে ভীষণ। দ্রুত বিছানা থেকে উঠে পড়লো।কি এমন ঘটেছে নিচে?ওড়না গায়ে দিয়ে নিচতলার দিকে চাইতেই অবাক হলো।বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য সেখানে।স্পর্শীকে দেখতেই বাবা ডাকলো।ত্রস্ত পায়ে থেমে থেমে কৌতূহল নিয়ে নিচে নামলো স্পর্শী।সবার মাঝখানে লাল চাদর দিয়ে কিছু একটা ঢাকা।এটা কি?সিঁড়ি থেকে নেমে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।আমতা-আমতা কন্ঠে বললো, _”এটা কি?”

শামসুল সরদার হাসলেন।ঘটনা টা যেন তার প্রাণ জুড়িয়ে দিয়েছে।বললো,_”খুলে দেখো।”
আর কৌতূহল দমাতে পারলো না।কাঁপা হাতে চাঁদর টা সরাতেই থমকে গেলো।তড়িৎ গতিতে পেছনে তাকিয়ে বাবার উদ্দেশ্যে বললো,_”এটা কার?”
_”কার আবার?তোমার।”
এতোকিছুর মধ্যেও প্রবল উত্তেজনা কাজ করছে স্পর্শী।ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে বললো,_”তুমি দিয়েছো আব্বু?”
শামসুল সরদার মাথা টা দুপাশে না স্বরুপ নাড়ালেন।ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো,_”আমি দেইনি তো।তোমার ভাই দিয়েছে।”

এতক্ষণে মাথা তুললো সোভাম।তার কেমন অসস্তি লাগছে।কিছুটা লজ্জা লাগছে কি না বুঝা গেল না।বরাবরের মতো অগোছালো কন্ঠে বললো,_”এটা আসলে আমি আরো আগেই কিনেছিলাম।তোমার সাথে এ বাড়িতে ফার্স্ট যখন দেখা হয়েছিলো তখন তুমিই স্কুটির কথা বলেছিলে।আমি একা বাইকে ঘুরছি কিন্তু তুমি ঘুরতে পারছো না এরকম কিছু।ভেবেছিলাম তোমার বিয়ের দিন দিবো।কিন্তু এরমধ্যেই বিয়েটা পিছিয়ে গেল।আর ওরাও সন্ধ্যায় পৌছে দিয়ে গেল।তাই…”

আর কিছু বলতে পারলো না সোভাম।এরমধ্যেই স্পর্শী হামলে পড়লো বুকের মাঝখান টায়।স্ব-স্নেহে জড়িয়ে ধরলো সোভাম।স্পর্শী আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল।কি বলবে সেটা ভেবে পেল না।অনেকক্ষণ এভাবে থাকার পর ব্যর্থতার সুরে বললো, _”কিন্তু আমি তো চালাতে পারি না।”
হাসলো সোভাম।বললো,_”সমস্যা নেই।কাল থেকে আমি শিখিয়ে দেব।”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬৬(৪)

ফুঁসে উঠলো আর্শি।মুখ গোমড়া করে বললো,_”ওহ!আমি তো এখন কেউ-ই না।আপুকে স্কুটি গিফট দিয়েছো,কিন্তু আমাকে একটা সুতোও না।ভালো হয়েছে।আমার লাগবেও না।”
সোভাম চমকালো।সত্যিই তো।আর্শির কথা খেয়ালেই ছিলো না।এটা ভীষণ অন্যায়।কাল পরশুর মধ্যে হুট করে কিছু একটা দিয়ে দিতে হবে।কোনোমতে দোষ এড়াতে বললো,_”তুমি তো অঘটন ঘটিয়েই ফেলেছো।এখন যা পাওয়ার সেটা আমার বোনঝি রা পাবে।তোমাকেও দেব,বাচ্চাদের ও দেবো।ইহুম!আমি এতটাও বড়লোক নই।যা দেওয়ার যেকোনো একজন কে দেবো।”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬৮