রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬৯

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬৯
সিমরান মিমি

একটানা আধঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছে স্পর্শী।শেষমেশ বাধ্য হয়ে নেমে এলো বাইরে।একদম বারোটায় আসার কথা বলেও আসেন নি পরশ শিকদার।বারোটা পেরিয়ে এখন মিনিটের কাঁটা গিয়েছে তেত্রিশ এর কোটায়।বিরক্ত হয়ে আর ফোন ও দিলো না।আসার সময় গাড়ি নিয়ে আসেনি। প্রায় দুপুরের এই সময়টাতে পিরোজপুর সদরে গাড়ির অবস্থান ও কম।বিশেষ করে এই পাশ টায়।যা-ও গাড়ি চলাচল করছে সেটাও বেশিরভাগ বিপরীত দিকে গতিশীল।ব্রিজের ওদিকে যাওয়া গাড়ির সংখ্যা খুব’ই কম।ফুটপাত থেকে মেইন রোডে নেমে এলো স্পর্শী।হাত বাড়িয়ে গাড়ি থামানোর প্রয়াস করতেই দ্রুতগতিতে এগিয়ে এলো এক কালো রঙের গাড়ি।

স্পর্শী তখন সামনের দিকে তাকানো।পেছনে তাকানোর সুযোগ টাও পেল না।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গাড়িটি তার পাশে থামিয়ে দরজাটা খুলে নিমিষেই তাকে টেনে মধ্যে নিয়ে যায়।আচমকা তাল সামলাতে না পেরে আগুন্তকের বলের সামনে হার মানলো সে।যেন কোনো এক পণ্যের দলা নিমিষেই গাড়ির মধ্যে টেনে নিয়ে পুণরায় পুরোদমে গাড়ি চলতে লাগলো।এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় হতভম্ব হয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো সে।আন্দাজ করতে পারলো গাড়ির মধ্যে সিটে বসে থাকা কোনো এক আগুন্তকের কোলের উপর সে বসা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

লোকটার ডান হাত টা স্পর্শীর পেট জড়িয়ে কাঁধের কাছে ঝাপটে ধরা।এভাবেই টেনে এনেছে সে।আর সেই হাতের-ই মাংসপেশিতে মাথা নুইয়ে মুখ লাগিয়ে বসে আছে স্পর্শী।নাহ!সে চুমু খাচ্ছে না লোকটাকে।বরং টেনে নেওয়ার সাথে সাথেই ওই মাংসপেশিতে স্বজোরে কামড় বসিয়েছে।যেই দাঁত-গুলো এখনো অবস্থান করছে সেখানে।লোকটা চলন্ত গাড়ির মধ্যে-ই ছিঁটকে পাশের সিটে ফেলে দিলো স্পর্শীকে।স্বীয় হাত টাকে কয়েক বার ঝাড়ি মেরে নাক মুখ বিষ-যন্ত্রণায় কুঁচকে ফেললো।রাগ এবং কটাক্ষের তীব্রতা মিশিয়ে বললো,_”এভাবে কালনাগিনী’র মতো কামড়ে ধরে ছিলে কেন?”

চমকে তাকালো স্পর্শী।পাশের সিটে পরশকে দেখতেই কয়েকবার আশেপাশে তাকালো।অচেনা গাড়ি, সামনেও অচেনা ড্রাইভার;আর পাশে পরিচিত মানুষ টা।সব মিলিয়ে অনুভূতি গুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।কয়েকবার ঘন নিঃশ্বাস নিয়ে পরশের হাতের দিকে তাকালো।দাঁত বসে গেছে।ইশশ!এতোটা জোরে কেন দিলো সে?কিন্তু মুখে স্বীকার করলো না।বরং রাগ নিয়ে বললো, _”এসব কি ধরণের ছেলেমানুষী? এভাবে কেউ গাড়িতে ওঠায়?আমিতো ভেবেছি অপরিচিত কেউ।আর আপনার কি ধারণা যে কেউ আমাকে জোর করে গাড়িতে তুললে আমি স্বেচ্ছায় তার কোলে উঠে বসে থাকবো?তাও কোনো রিয়াকশন ছাড়া?”

দাঁতের চিহ্নটার উপরে আরেকবার হাত বোলালো পরশ।সামনের মিররে তাকাতেই দেখলো ড্রাইভারের হাস্যোজ্জ্বল মুখ।মুহুর্তেই ধমক মেরে বললো,_”মিরর নিচে নামাও।আর ভুলেও পেছনে তাকাবে না।”
লোকটা ভয় পেয়ে গেলো।দ্রুত মাথা নাড়িয়ে আয়না টাকে নিচে ঘুরিয়ে দিলো।এরপর মনযোগ সহিত পুণরায় গাড়ি চালাতে আরম্ভ করলো।পরশ স্পর্শীর দিকে তাকালো।এরপর কন্ঠে সহজতা এনে বললো,_”ভয়ের কিছু নেই।আমি-ই তো।স্বাভাবিক হও।”স্পর্শী নড়েচড়ে বসলো।কিন্তু সন্দেহ কমলো না।সেতো কেএফসি তে আসতে রাজি’ই ছিলো।তারপরেও কেন এভাবে জোর করে গাড়িতে তুললো।এমনটা করার কারন-ই বা কি?পরশের দিকে তাকিয়ে সন্দেহী কন্ঠে বললো,

_”আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
_”কাজি অফিসে?”
সেকি নির্ভেজাল স্বাভাবিক গলা।শব্দ দুটোর মধ্যে নেই কোনো প্রশ্ন,সংকোচ বা সন্দেহ।যেন আজ তাদের কাজি অফিসে যাওয়ার-ই কথা ছিলো।স্পর্শী চমকালো,থমকালো।কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে আর্তচিৎকার করলো।বললো,_”হোয়াট!!!”
ভ্রুঁ দুটো কুঁচকে স্পর্শীর দিকে তাকালো পরশ।ব্যঙ্গ করে বললো,_”এতো অবাক হওয়ার কি আছে?এমন ভাবে চিৎকার করছো যেন তোমাকে জাহান্নামে নিয়ে যাচ্ছি।আরে কাজি অফিস-ই তো।আজ নয় কাল বিয়ে তো হবেই।সেটা আজ করে নিলে সমস্যা কোথায়?খুব বেশি সমস্যা হলে গোপন থাকবে কথাটা।”

_”আমি বিয়ে করবো না।গাড়ি থামান।আমি নেমে যাবো।।”
_”এমনভাবে নির্দেশ দিচ্ছো যেন স্বেচ্ছায় তোমাকে নিয়ে এসেছি।আরে আমি জানি তো তুমি আর তোমার বাপ দুটোই তাঁরছিড়া।ভালো কথা তো কখনো কানে যায় না।ভালো ভাবে বললে কখনো রাজি-ও হতে আসতে।তাই জোর করে নিয়ে এসেছি।”
চোখ দুটো বড় বড় করে ফেললো স্পর্শী।সন্দেহকে নিশ্চিত করে বিস্ময় নিয়ে বললো,_”তারমানে আপনি আমাকে অপহরণ করেছেন?”
ভ্রুঁ-যুগল দুলিয়ে অন্যপাশে তাকালো পরশ।ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,_”হবে হয়তো এরকম-ই কিছু একটা।”
অবাক হলো স্পর্শী।দাঁতে দাঁতে চেপে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বললো, _”এই গাড়ি থামান।এক্ষুণি,আমি নেমে যাবো।”
পুণরায় নাক ছিটালো পরশ।ব্যঙ্গ করে বললো,_”এহহ!জামাই বাড়ির আবদার।তুমি বললেই ও শুনবে নাকি?মাসের শেষে বাইশ হাজার টাকা দেই আমি।আর নির্দেশ দিচ্ছো তুমি।হাস্যকর!তবে হ্যাঁ, আমাকে বিয়ে করলে ও হয়তো সব কথা শুনবে।”

থেমে সামনে সিটে বসা ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বললো,_”কি সাইদ,শুনবে তো?”
ড্রাইভার মিটিমিটি হাসলো।এরপর পেছনে না তাকিয়েই বললো,_”জ্বী স্যার!”
ধীরে ধীরে ভেতরকার উত্তেজনা বাড়ছে স্পর্শীর।কন্ঠে তীব্র রাগ নিয়ে বললো,_”দেখুন, ভালো হচ্ছে না কিন্তু।আপনার ড্রাইভার কে গাড়ি থামাতে বলুন।নইলে কিন্তু আমি চেঁচাবো।”
পরশ হাসলো।কটাক্ষ করে বললো,_”সে তো তুমি অলওয়েজ চেঁচাও।আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।যাই হোক, তোমার ভালো লাগলে তুমি চেঁচাতে পারো।আমার কোনো সমস্যা নেই।এইই সাইদ,তোমার কি সমস্যা আছে?হলে কান চেপে রাখতে পারো।”

সাইদ আবারো হাসি আটকে কোনো রকমে বললো,_”জ্বী না স্যার।”
স্পর্শী এবারে রাগের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছালো।এদিকে গাড়ি থামানোর কোনো নাম-ই নেই।বরঞ্চ ধীরে ধীরে এর গতি বাড়ছে।চিৎকার করে বললো,_”হচ্ছে টা কি এসব?”
পরশ চমকে তাকালো।এরপর গম্ভীর কন্ঠে বললো,_”আচ্ছা রাগ করো না।শোনো,তোমাকে আমি অপহরণ-ই করেছি।এবার যদি তুমি আমার থেকে অনুমতি চেয়ে চেঁচাতে চাও তাহলে আমি ঠিক কি করবো বুঝতে পারছি না।আদৌ কোনো অপহরণ কারী ভিক্টিম-কে চেচানোর অনুমতি দেয় কি না জানি না।তবে তুমি চাইলে চেঁচাতেই পারো।”
_”আপনি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছেন?”
সরাসরি দৃষ্টি দিলো স্পর্শীর দিকে।গম্ভীর কন্ঠে বললো,_”তোমার কানে কি কখনো সিরিয়াস কথা ঢুকেছে?তাই ভাবলাম এ বারে মজা-ই করি।”

স্পর্শী নিজেকে শান্ত করলো।যা-ই হোক না কেন উত্তেজিত হওয়া যাবে না।এতে উলটো নিজের-ই ক্ষতি।এতোক্ষণের উত্তেজনায় শরীর টা নেতিয়ে পড়েছে।ক্লান্ত মাথাটা ইচ্ছে করেই পরশের কাঁধে হেলিয়ে দিলো।চমকে তাকালো পরক্ষণেই ঠোঁট কামড়ে বললো,_”পটানোর চেষ্টা করছো?করতেই পারো।আমি আবার এসবে একটুতেই গলে যাই।সাইদ,পেছনে তাকাবে না।”
সাইদ আবারো মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।স্পর্শী চোখ বন্ধ করে নিলো।এই লোকের সাথে ত্যাড়ামি করা যাবে না।তাহলে উলটো নিজের-ই ক্ষতি।কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ওভাবেই পড়ে রইলো।এরপর শান্ত কন্ঠে বললো,_”সকালে কিচ্ছু খাই নি।আপনি বলেছেন কেএফসি তে আসতে।তাই না খেয়েই বেরিয়েছি।এখন আমার খিদে পেয়েছে।”
পরশ স্পর্শীর মুখের দিকে তাকালো।বললো,_”ঘন্টাখানেক না খেয়ে থাকো।আরো খিদে বাড়াও।এরপর একসাথে আস্ত একটা বিয়ে খেও।”

চারদিকে ঘন সবুজ ঝাউবন। পাখির কলকাকলি। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। তীরে এসে আছড়ে পড়া সাগরের ঢেউ।
প্রকৃতির এই দৃষ্টিনন্দন লীলাভূমিটির নাম ‘শুভসন্ধ্যা সমুদ্রসৈকত’। এর অবস্থান বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার সোনাকাটা ইকোপার্ক-সংলগ্ন নলবুনিয়ার চরে। কিছুদিন আগেও স্থানীয়দের কাছে এ স্থানের পরিচয় ছিল বালুর চর ও শুঁটকি পল্লি হিসেবে। পরে পর্যটক আকৃষ্ট করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায়তের পরিচিতি ছড়িয়ে দিতে সেখানে ২০১৯ সালের ২৩ নভেম্বর দেশের বৃহৎ জ্যোৎস্না উৎসবের আয়োজন করে বরগুনা জেলা প্রশাসন। এর পর থেকেই প্রতিদিন ভ্রমণপিপাসু মানুষ আসছেন এখানে। দেশি-বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করতে প্রতি বছরই জ্যোৎস্না উৎসবের আয়োজন করা হয়।

সবুজ ছায়াঘেরা গাছপালার শাখা-প্রশাখায় পাখপাখালির কিচিরমিচির শব্দে মুখর টেংরাগিরি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। সাগরের ঢেউয়ের তালে পাখির দল উড়ে যাচ্ছে এদিক-সেদিক। ছোট-বড় ট্রলার নিয়ে জেলেরা ছুটছে গভীর সাগরের দিকে। এমন দৃশ্য চোখে পড়বে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে প্রাকৃতিকভাবে জেগে ওঠা এই সোনাকাটা বনে।
এটি স্থানীয়ভাবে ফাতরার বন হিসেবে পরিচিত। সুন্দরবনের পর এটিই সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। সমুদ্রের কোল ঘেঁষে বনটির অবস্থান। বানর, শূকর, বনমোরগ, মদনটাক, কাঠবিড়ালি, মেছোবাঘ, লাল কাঁকড়া, বকসহ বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি আর সাপের অবাধ বিচরণ সোনাকাটা বনে।

সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে উপভোগ করা যাবে সূর্যাস্ত কিংবা সূর্যোদয়ের পাশাপাশি ছোট ছোট ট্রলারে জেলেদের জাল ফেলে ইলিশ ধরার দৃশ্য। নাগরিক কোলাহল থেকে দূরে প্রশান্তির ছোঁয়া পেতে পর্যটকদের হাতছানি দিচ্ছে শুভসন্ধ্যা সমুদ্রসৈকত ও সোনাকাটা ইকোপর্ক।স্থানীয় এবং দুর-দুরান্তের মানুষরা একে মিনি কুয়াকাটা বলেও চেনে।ইকোপার্কের ভেতর ছোট্ট একটা টেবিলে বসে আছে পরশ।সামনেই মুখমন্ডল অন্ধকার করে বসে আছে স্পর্শী।রাগে গজগজ করছে সারাশরীর।ঠোঁট ভেংচি মেরে বললো,

_”পাষাণ!
পরশ চমকালো।ভ্রুঁ উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কেন?ভালো লাগছে না?
_” কতক্ষণ ধরে না খেয়ে আছি।”
পরশ হাসলো বললো,_”আসছে খাবার।”স্পর্শী সিগ্ধ দৃষ্টিতে চারপাশ টা একবার দেখলো।এখানকার বাতাস টা যেন একটু বেশি-ই শুদ্ধ।_”এখানে কেন এনেছেন আমাকে?”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৬৮

পরশ স্পর্শীর দিকে তাকালো।তার চোখেমুখে স্পষ্ট সন্দেহ লেপ্টে আছে।সেই সন্দেহকে আরেকটু গাঢ় করতে পরশ বললো,_”ভাবছি বিয়ে শেষে হানিমুনটা সেরে তারপর পিরোজপুরে ফিরবো।তুমি কি বলো?”

রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৭০