রাজনীতির রংমহল সিজন ২ শেষ পর্ব
সিমরান মিমি
ঘড়ির কাঁটা’টা এগারোটার ঘরে আসতেই ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে উঠলো পুরো বাড়ি।যেন প্রতিটি মানুষ স্বেচ্ছায় হয়ে গেলো বোবা।একটা সুন্দর, কোলাহল মুক্ত রাত্রি নববধুকে উপহার দেওয়ার জন্য প্রত্যেকেই দ্রুত চলে গেল যে যার কক্ষে।হয়তো তাদের চোখের পাতায় এখনো ঘুম আসেনি।তবুও নব্য দম্পতি দের আলাদা সস্তি দেওয়ার জন্য ইতোমধ্যেই বন্ধ করে দিয়েছে বাড়ির অধিকাংশ বাতি।
বিছানার উপরে মখমলের মতো সাদা চাদর বিছানো, যার উপরে লাল গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে রাখা হয়েছে যেন কোনো শিল্পীর নিখুঁত তুলির আঁচড়। বিছানার মাথার দিকে গোলাপি রঙের নরম কুশন রাখা। বিছানার চারদিকে মেলে আছে গোলাপের মালা। প্রতিটি ফুল থেকে বের হওয়া মিষ্টি সুবাস ঘর ভরে দিয়েছে এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে।
ঘরের দেয়ালে ঝুলছে মৃদু আলোছায়ার মোমবাতি স্ট্যান্ড। আলোর প্রতিফলনে পুরো ঘরটা যেন রুপকথার কোনো প্রাসাদের মতো মনে হচ্ছে। জানালার পাশে একটি ছোট টেবিল রাখা, যেখানে সাজানো একটি ফুলদানি।তাতে রয়েছে সুবিশাল গোলাপের তোড়া।কক্ষের ডান দিকের বড় জানালা টা ঢেকে আছে শুভ্র বর্নের পাতলা পর্দায়।যেই পর্দাকে ছাঁপিয়ে চাঁদের জ্যোৎস্নারা ঢুকছে দলে দলে।যেন নতুন বউকে দেখার কতই না তাড়া তাদের।প্রেমা চোখ দুটো সযত্নে বন্ধ করে জ্যোৎস্না মাখতে লাগলো গায়ে।হঠাৎই দরজার উপর ঠকঠক আওয়াজ পেতেই চমকে গেলো।হৃৎপিন্ড থমকে গেল তখনই।কক্ষের দুয়ারে বুকে হাত দিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সোভাম।প্রেমার শ্বাস রোধ হয়ে আসছে ক্রমশ।নিজেকে সংযত করে সোভামের উদ্দেশ্যে বললো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
-এইতো ক-দিন আগেই এই রুমে ঢোকার জন্য অনুমতি চেয়ে আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম।আর আজ আপনি আমার কাছে অনুমতি চাইছেন।ব্যাপারটা দারুণ না?
ঠোঁট কামড়ে ধরে নিশ্চুপ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সোভাম।এরপর ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
-আরো একটা ব্যাপার আছে,যেটা আরো বেশি দারুন।
প্রেমা অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলো। সোভাম দু-পা সামনে এগিয়ে ভ্রুঁ উঁচিয়ে বললো,
-এই যে এতোদিন তুমি অন্য রুমে শুতে।আর এখন আমার সাথে আমারই বিছানায় শোবে।এটা আরো দারুন তাই না?
চোখ দুটো নিমিষেই বন্ধ করে নিলো প্রেমা।লজ্জায়,ভয়ে,সংকোচে নুইয়ে পড়ে বললো,
-এটা একটুও দারুন না।এটা আতংকজনক।
চমকে প্রেমার দিকে তাকালো সোভাম।সরাসরি দৃষ্টি দিলো তার দিকে।এরপর বিস্ময় মাখানো কন্ঠে ভ্রুঁ উঁচিয়ে বললো,
-হোয়াট ডু ইউ মিন বাই আতংকজনক?
জিভ কাঁটলো প্রেমা।আমতা-আমতা কন্ঠে বললো,
-তেমন কিছুই না।আপনি এতো বড় একটা মানুষ।আমার মুরুব্বি, তাই বলেছি।আর কিছু বলি নি।
ছেড়ে দিলো সোভাম।ওয়াশ রুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
-স্টুপিড!
প্রেমা চোখ -মুখ খিঁচে বসে রইলো।লজ্জায় মাথা চুলকাতে চুলকাতে মনে মনে নিজেকে কড়া করে শাসালো।বললো,
-প্রেমা,সারা রাত এই মুখ টাকে বন্ধ রাখতে হবে।নইলে তুই যে কোনো সময় অঘটন ঘটিয়ে ফেলবি।
সোভাম ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো।তোয়ালে দিয়ে হাত মুখ মুছতে মুছতে প্রেমার উদ্দেশ্যে বললো,
-সালাম করো।মুরব্বিদের সালাম করতে হয়।
লজ্জা পেল প্রেমা।দ্রুত বসা থেকে উঠলো ।সোভামকে সালাম করতেই সে একটা বক্স বের করে দিলো।সেটা হাতে নিয়ে পুণরায় গিয়ে বিছানায় বসলো।ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো সোভাম।বললো,
-পোশাক কেন খোলো নি?এগুলো পরেই কি ঘুমাবে?
আবারো চমকালো প্রেমা।মুখ ফসলে বলে উঠলো
-ওহহ!আমি খুলবো?
এরপর দ্রুত আয়নার সামনে গেলো।একে একে শাড়ির পিন খুলতে লাগলো।ঠোঁট কামড়ে অগোচরে হাসলো সোভাম।শাড়ির পিন এবং গয়না খোলামাত্রই আলতো ধমকের সুরে বললো,
-হয়েছে,আর খুলতে হবে না।বাকিগুলো আমি খুলে নেবো।
থমকে দাঁড়িয়ে রইলো প্রেমা।হুট করেই সারা শরীর কাঁপতে শুরু করলো।ক্রমশ অস্থিরতা বাড়লো হৃদয়ের।নড়তে পারলো না আয়নার সামনে থেকে।যেন নিচ থেকে কেউ পা আঁটকে রেখেছে।সোভাম কিছু মুহুর্ত ফোন ঘেঁটে পুণরায় তাকালো আয়নার দিকে।প্রেমাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো। পুণরায় ধমক দিয়ে বললো,
-আসছো না কেন?ওভাবেই সং সেজে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?
কেঁপে উঠলো প্রেমা।ঢোক গিলে আমতা-আমতা করে বললো,
-আসছি।
এরপরেও কিছু সময় কাঁটলো।কিন্তু এক পা ও নড়লো না। বরং বারংবার ভাবনায় মশগুল সে।বিরক্ত হয়ে বিছানা থেকে নামলো সোভাম।প্রেমার দিকে এগিয়ে যেতেই সে দু-পা পিছিয়ে গেল।ঠোঁট ভেঙে করুন স্বরে ভাঙা ভাঙা শব্দে বললো,
-আমার খু…উ…ব ভয় করছে।
শুনলো না সোভাম।কথার মধ্যখানেই কোলে তুলে নিলো প্রেমাকে।বিছানার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
-বিয়ের আগে মনে ছিলো না?
লাইট নিভিয়ে দিলো পাষাণ পুরুষ।সযত্নে স্বীয় বক্ষপিঞ্জরের নিচে স্ত্রীকে ফেলে গলায় মুখ ডুবালো।ঢুকরে কেঁদে উঠলো প্রেমা।মুহুর্ত’টা ভীষণ ভয়ংকর। সোভাম আবারো চুমু খেলো ঠোঁটে।ঘোর লাগানো কন্ঠে বললো,
-ব্যথা দেব না।
এরপর নিস্তব্ধতায় ডুবে গেলো পুরো রুম।বিভীষিকাময় অন্ধকারের মধ্যে রুমের এক কোনায় জ্বলছে একটা মোমবাতি।জ্বলন্ত তরল মোমের ফোঁটাগুলো গড়াতে গড়াতে এক সময় সেটাও গেলো নিভে।এ পর্যায়ে কক্ষটি হয়ে উঠলো পুরোপুরি অস্তিত্বহীন।শুধুমাত্র শোনা যাচ্ছে ঘন নিঃশ্বাসের আওয়াজ।
দিনের শুভ্রতাকে গ্রাস করে সময়ের পরিক্রমায় ধরণীতে স্থান নিলো অন্ধকার।সন্ধ্যায় মাগরিবের আজান দেওয়ার শেষে যেন তারা সময়ের চেয়েও দ্বিগুণ গতিতে ছেয়ে দেয় নিজেদের কালো ছায়া।শরীরটা আগের থেকে মিইয়ে পড়েছে।মন ও ভালো নেই ক-দিন ধরে।এইযে এতো বড় বাড়িটার মধ্যে শুধু সে একা।এভাবে কি দিন কাঁটানো যায়।প্রেমার বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় সাড়ে চার মাস।এরমধ্যে দু-তিন বার আসলেও সেটা স্বল্প সময়ের জন্য।সোভাম সরদারের সাথে পরশ শিকদারের সম্পর্ক টা এখনো সেই আগের মতোই গুপ্ত সাপে-নেউল অবস্থা।যার কারনেই দুজন দু-বউ নিয়ে টানা হেঁচড়া করা শুরু করে দিয়েছে।এইতো গত মাসে প্রেমার আসার কথা ছিলো এ বাড়িতে।স্পর্শী নিজেও যেতে চেয়েছিলো বাবার বাড়িতে।কিন্তু হুট করেই বেঁকে বসলো পরশ।আগামী মাসে দু-সপ্তাহের জন্য ঢাকা থাকতে হবে তাকে।যার কারনেই সময়টা ওলোট-পালোট করে নিয়েছে স্ত্রীর সাথে।কিন্তু এটা মানতে পারেনি সোভাম সরদার।বোনকে কেন আসতে দেবে না এটা নিয়া বিশাল ক্ষোভ তার।শেষমেষ অভিমানের বশবর্তী হয়েই বাঁধা দিয়েছে প্রেমাকে।এতে অবশ্য প্রেমার মোটেও খারাপ লাগে নি।বরং খুঁজে পেয়েছে এক প্রগাঢ় ভালোবাসা।এমনিতেও স্বামী তার শিকদার বাড়িতে একদিনের বেশি টিকতে চায় না।থাকতে হবে পুরো সপ্তাহজুড়ে তাকেই।এটা কি মানা যায়?
রান্নাঘর থেকে প্লেট-চামচের টুংটাং আওয়াজ আসছে।স্পর্শী সন্ধ্যার নাস্তা বানাচ্ছে।পিয়াশা নিচের পাটিতে বসে রুটি বেলে দিচ্ছে।আর সে সিঙারার প্যাঁচ দুটো দিয়েই তেলে ছেড়ে দিচ্ছে।বাড়িতে শুধুমাত্র মহিলা-পুরুষের মধ্যে তারা দুজন আর শশুর-শ্বাশুড়ী আছে।পাভেল বাড়ি ছেড়ে শশুর বাড়িতে উঠেছে আজ দুই-সপ্তাহ।মাঝেমধ্যে দিনের বেলা ঢু মেরে দেখা দিয়ে গেলেও রাতটা কাঁটায় আর্শির সাথে।দিন ঘনিয়ে এসেছে।প্রায়স’ই ব্যথা ওঠে,অসুস্থ হয়ে যায়।আজকাল একা একা ওয়াশরুম ইউজ করতেও বেগ পেতে হয় আর্শিকে।
প্রথমবারের শিঙারা গুলো লাল হতেই সেগুলো নামিয়ে নিলো স্পর্শী।চুলার আঁচ কমিয়ে বাকিগুলো দিয়ে একটা শিঙারা ভেঙে ঠান্ডা করে নিলো।এরপর শাশুড়ীর মুখে দিয়ে বেশ অ্যাটিটিউট নিয়ে বললো,
-বলো বলো,টেস্ট কেমন হয়েছে?
বলতে বলতে নিজেও খেলো বাকি অর্ধেক।সেকেন্ড খানেক চুপ থেকে উৎফুল্ল স্বরে বললো,
-ভাবছি শিঙারার ব্যবসা শুরু করে দিবো।এতো স্বাদের শিঙারা থেকে যদি পিরোজপুরের বাকিদের বঞ্চিত করি তাহলে ব্যাপারটা ভালো দেখায় না।কি বলো?
পিয়াশা হাসলেন।কিছু বলার প্রয়াস করতেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো।‘বেয়ান’ নামটা স্ক্রিনে ভেসে উঠতেই রিসিভড করলেন।সুরেলা কন্ঠে সালাম ও দিলেন। কিন্তু ওপাশ থেকে শোনা গেলো পিপাসার তড়িঘড়ি আওয়াজ।সে সালাম টা দ্রুত নিয়ে বললো,
-আর্শির ব্যথা উঠছে বেয়ান।সদরে নিয়ে যাচ্ছি।
আর কিছু বলার বা শোনার প্রয়াস করলেন না কেউই।দ্রুত সবকিছু রেখে হাত ধুয়ে নিলেন।স্পর্শী রুম থেকে ফোন আনলো।পরশকে ফোন দিতেই সে ওপাশ থেকে বললো,
-আমি আছি এখানে।তুমি মাকে নিয়ে সাবধানে আসো।
সামান্য একটু ব্যস্ততা,একটু তাড়াহুড়ো,একটু টেনশন।এর মধ্যেই পেটের মধ্যে পুণরায় চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়ে গেলো স্পর্শীর।হস্পিটালের বাইরে সবার সাথে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না।ধীর পায়ে কিছুটা দূরে গিয়ে আলগোছে বেঞ্চিতে বসলো।দূর থেকে’ই স্পর্শীর এই ব্যথাতুর মুখটা অবলোকন করলো পরশ।ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে সযত্নে হাত ধরলো।কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বললো,
-কি হয়েছে?
_আবারো সেই চিনচিনে ব্যথা।
এ পর্যায়ে কিছুটা রেগে গেল পরশ।আলতো ধমক দিয়ে বললো,
-গ্যাসের ওষুধ খেয়েছিলে?
উপরনিচ মাথা তুলিয়ে ব্যথাতুর আওয়াজে স্পর্শীয়া বললো,
-হুম।
বুঝে উঠতে পারলো না পরশ।আচমকাই হাত ধরে টেনে উঠালো।তৃতীয় তলায় মহিলা ডক্টর ডিউটিরত রয়েছে।তার অফিসের সামনে গিয়ে হাস্যোজ্জ্বল চোখে-মুখে বিনয় দেখালো পরশ।ডক্টর সদ্য এমপি হওয়া পরশ কে দেখতেই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।হাস্যোজ্জ্বল মুখে তড়িঘড়ি করে বললেন,
-আরে হ আপনি আমার অফিসে।বসুন বসুন।ইনি কি আপনার স্ত্রী?কি খাবেন বলুন;চা না কফি?ওয়ার্ডবয়!!
_ব্যস্ত হবেন না।আমি কিছুই খাবো না।আপনি ওকে দেখুন।
এ পর্যায়ে থামলেন ডক্টর আফরোজা।তাকালেন স্পর্শীর দিকে। বললেন,
-কি হয়েছে আপনার?
স্পর্শী একে একে সব বললো।ডক্টর তার চোখের রঙ,জিহবার রঙ পরীক্ষা করলেন।এরপর একজন সেবিকাকে ডেকে স্পর্শীয়াকে নিয়ে যেতে বললেন ভেতরে।কিছুক্ষণ পর সেবিকা ফিরে এসে পরশের অগোচরে কিছু একটা তুলে দিলেন ডক্টরের হাতে।পরশ অবাক হলো।ভেতরের দিকে বারংবার তাকালেও স্পর্শীকে আর বের হতে দেখলো না।চিন্তিত কন্ঠে বললো,
-কি হয়েছে ওর?
ডক্টর আফরোজা হাসলেন।সেই ক্রুর হাসি দেখে পরশ নিশ্চুপ হয়ে গেলো।কৌতূহল মিশ্রিত কন্ঠে ভাঙা ভাঙা শব্দে বললো,
-ও কি প্রেগন্যান্ট?
মাথা নাড়লেন ডক্টর।সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ালো পরশ।ইতোমধ্যে লজ্জালু মুখ নিয়ে বের হলো স্পর্শী।পরশ ডক্টরের ভিজিট দিয়ে বললো,
-থ্যাংক ইউ!
এরপর স্পর্শীর হাত ধরে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে পড়লো। ত্রস্ত পায়ে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে নামলো।পরশের এই মুখভঙ্গি মোটেও পছন্দ হলো না স্পর্শীর।এতোক্ষণের যাবতীয় খুশি,উত্তেজনা,উৎফুল্লতা নিমিষেই চুরমার হয়ে গেলো।পা থামিয়ে দিলো স্পর্শী।থমথমে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-আপনি খুশি হন নি?
চমকে গেলো পরশ।স্পর্শীর ভার হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে ফেললো।জিজ্ঞেস করলো,
-এমনটা মনে হওয়ার কারন?
-মুখ-চোখ এমন ভোঁতা করে হাঁটলে আর কিইবা মনে হবে?
পরশ ঠোঁট টিপে হাসলো।বললো,
-তাহলে কি আমার উচিত এই মুহুর্তে হস্পিটালের মধ্যে বসে দু-চার টা জোরছে চিৎকার মারা,এরপর বউকে জড়িয়ে গোটা দশেক চুমু খাওয়া।ডক্টর-পেশেন্ট যখন সব এক ফ্লোরে নেমে আসবে তখন তাদেরকে বলা যে,তোমাদের এমপি বাপ হবে।এটাই তো?
চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললো স্পর্শী। কোনো কিছু না বলেই এগিয়ে গেলো সামনের দিকে।সবার হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে নিমিষেই ভুলে গেল নিজের কথা।আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ছলছল চোখে বললো,
-ছেলে বেবি হয়েছে নাকি মেয়ে বেবি?
পিপাসা বাচ্চা হাতে এগিয়ে এলো।স্পর্শীর কোলে শুভ্র চাঁদরে মোড়ানো সদ্য মেয়েটাকে কোলে দিয়ে বললো,
-মেয়ে আর্শির হলে কি হবে?স্বভাব চরিত্র হয়েছে একদম তোর মতো।দেখ দেখ কেমন নাক ছিঁটকে তাকাচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর।নাকটাও তোর মতোই খাঁড়া হয়েছে।
এগিয়ে এলো পাভেল।মুখ-চোখ ভোঁতা করে বললো,
-আরেহ বাহ!মেয়ে আমার।আর এদিকে নাক-চোখ কান সব অন্যদের মতো হবে?আমার মেয়ে ফুল টু ফুল আমার মতোই হয়েছে।
স্পর্শী আলগোছে পরশের কোলে দিলো বাচ্চাটাকে।পাভেল এগিয়ে গেল সেদিকে।ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আফসোসের স্বরে নিচু গলায় বললো,
-দেখেছিস আমি কতটা ফার্স্ট।একটু লজ্জা কর ভাই,আমার মেয়ে কোলে নিয়েছিস তুই।যেখানে তোর বাচ্চার সুন্নতে খৎনা ইতোমধ্যে হওয়ার কথা ছিলো।
পরশ হাসলো।চাপাস্বরে বললো,
-এর জবাব আগামী সাতমাস পর পাবি তুই।আমার জন ও আসছে।
চোখ দুটো বড় বড় করে ফেললো পাভেল।উত্তেজনা ধরে রাখতে না পেরে চিৎকার করে উঠলো।দ্রুতপায়ে স্পর্শীর দিকে গিয়ে বললো,
-কনগ্রাচুলেশন্স!কংগ্রাচুলেশনস! তাহলে কি কেবিন টা এখন থেকেই বুক করে রাখবো নাকি?
নতুন ভাবে সাজসজ্জায় সেজে উঠেছে সরদার বাড়ি।চারপাশে নানান রঙের আলোকসজ্জ।পা ফেলার জায়গাটুকুও যেন অবশিষ্ট নেই।হ্যাঁ এটা বিয়ের অনুষ্ঠান।আর বিবাহ টা সরদার বাড়ির ছোট ছেলে জিহানের।স্পর্শী ব্যস্ত পায়ে অতিথিদের সামলাচ্ছে।হুট করেই কানে এলো কান্নাকাটির আওয়াজ।দ্রুত সেদিকে ছুটে গেলো সে।পিছু পিছু আর্শিও দৌড়ে এলো।আট বছরের একটা ছেলেকে মাটিতে ফেলে তার উপর বসে পিঠ কামড়ে ধরে বসে আছে ছয় বছরের মোটাতাজা স্পর্শ।ছেলেটা কাঁদছে, আর ইশি চিৎকার করে মামনিকে ডাকছে আর স্পর্শকে ছাড়াচ্ছে।স্পর্শী ছুটে এসে ছেলেকে টেনে সরালো।নিচে কান্না করতে থাকা বাচ্চা ছেলেটাকে তুলে আদুরে সরে বোঝাতে লাগলো।এরইমধ্যে ছুটে এলো তার মা।ছেলের কান্না থামানোর প্রয়াস করতেই স্পর্শী স্পর্শকে ধরলো।চোখ রাঙিয়ে ধমকে বললো,
-ওকে মারছো কেন তুমি?বড় ভাইয়া হয় না তোমার?
মুখ চোখ ফুলিয়ে ক্ষোভ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো স্পর্শ।স্পর্শী পুণরায় ধমক মারার আগেই আর্শি স্পর্শকে টেনে নিয়ে গেলো নিজের কাছে।ইশি ফোঁপাতে ফোপাঁতে মামনির কোলে বসলো।তাকে দেখতেই স্পর্শী বললো,
-ভাই মারামারি করছিলো কেন মামুনি?তুমি ওকে আটকাবে না?
ইশি আবারো ফোঁপাতে শুরু করলো।এরপর ভাঙা ভাঙা শব্দে বললো,
-আমি আদনানের সাথে খেলছিলাম বলে ও রাগ করে ওকে কাঁমড়ে দিয়েছে।
হেসে ফেললো সবাই।স্পর্শী পুণরায় ধমকের সুরে বললো,
-বোন কি তোমার সাথেই খেলবে বলে চুক্তি করে এসেছে?ও সবার সাথে খেলবে।একদম মারামারি করবে না।সোজা বাড়িতে রেখে আসবো।
ঠোঁট ফুলিয়ে গম্ভীর হয়ে সেভাবেই আর্শির কোলে বসে রইলো।দূর থেকে বাবাকে দেখতেই দ্রুত পায়ে নেমে দৌড় দিলো।ছেলেকে ছুটে আসতে দেখে এগিয়ে আসলো পরশ।সযত্নে কোলে নিয়ে গালে চুমু দিয়ে বললো,
-কি হয়েছে আমার বাবার?কে বকেছে?
বাবার গলা জড়িয়ে ধরে নাক টেনে স্পর্শ বললো,-আম্মু।
সময়টা পৌষের মাঝামাঝি।শীতের ছোঁয়া ধরণীতে লাগতেই গাছ গুলো লজ্জাবতী লতার ন্যায় নিজের সমস্ত পুরোনো পাতাকে ত্যাগ করে নতুন ভাবে সবুজ বর্নে আবৃত হলো।স্থান টা পিরোজপুর কেন্দ্রীয় কারাগার, সোমবার -দুপুর বারোটা পয়তাল্লিশ মিনিট।জীর্নশীর্ণ শুকনো একটা দেহ নিয়ে বের হলেন এক ছয়ত্রিশ বছরের যুবক।গায়ে তার পুরোনো ছেঁড়া,ময়লাযুক্ত এক সোয়াটার।শুকিয়ে যেন হাঁড় বেরিয়ে গেছে তার।চোখে মুখে তার তান্ডব সৃষ্টির রক্তিম আভা ;যেন দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর শিকার হাতে পাবে সে।জেল থেকে বের হতেই চোখের সামনে বৃদ্ধ বাবার অবয়ব দেখলো।সুদূর ভাণ্ডারিয়া থেকে এসেছেন তিনি।তাকে জড়িয়ে ধরতেই বৃদ্ধা অনুরোধের স্বরে বললেন,
-পুরো যৌবন টা রাজনীতির পেছনে খোয়ালি পরশ শিকদারের জন্য।আর এ পথে পা বাড়াস না।বিয়ে দেব খুব শীঘ্রই।ব্যবসা কর,স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখে থাক।তাও আর রাজনীতিতে ঢুকিস না বাপ।
চোখ দুটো দানবের ন্যায় হিংস্র লাল হয়ে উঠলো।চোয়াল শক্ত করে বললো,
রাজনীতির রংমহল সিজন ২ পর্ব ৮২
-পরশ শিকদার!পুরো আটটা বছর ভুগেছি।চিন্তা নেই,এতোদিন ওর জন্য গোলামী খেঁটেছি,নিজের জীবনের পরোয়া না করে ওর শত্রুদের সাথে লড়াই করেছি।আর আজ এই মুহুর্ত থেকে আমি নিজেই ওর শত্রুতে পরিণত হলাম।ওকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত রাজনীতি থেকে কি করে বের হবো?ওকে জানিয়ে দিও,সুজন মির্জা জেল থেকে বেরিয়েছে।যেন সাবধানে থাকে তার বউ-সন্তান নিয়ে।