রাজবধূ পর্ব ২০
রেহানা পুতুল
আচম্বিতে ঘুমন্ত নূরী নড়ে উঠে বিভ্রান্তি নিয়ে। মনে হলো চৌকিতে তার মাথা বরাবর জানালার বাইরে টোকা পড়লো। সে চৌকির কিনারায় পা নামিয়ে বসে। থরথর করে কাঁপতে থাকে। এত বিভৎস! এত কুৎসিত স্বপ্ন কেন দেখলো সে? কেন? একটা সুরাহা করতে হবে অতি দ্রুত।
নূরী ভয়ের দোয়া পাঠ করলো মনে মনে। “আল্লাহুম্মা ইন্না নাজআলুকা ফি নুহুরিহিম, ওয়া নাউজুবিকা মিং শুরুরিহিম।”
” আল্লাহ আমরা তোমাকে শত্রুর মোকাবিলায় পেশ করছি। তুমি তাদের দমন করো, আর তাদের অনিষ্ট থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই।” ( সূরা আবু দাউদ, নাসাঈ, মিশকাত, রিয়াদুস সালিহিন ৯৮১)
পরেরদিন শিখা পরিক্ষা দিতে চলে গেলো স্কুলে। নূরীর মনে তুমুল অস্থিরতা ও উদ্বিগ্নতা! বাদশার কথা মনে হলো তার। বাদশা ছেলেটা আসলে তার খুব উপকার হতো।
“জীবনের কঠিন সময়ে মানুষের সবার আগে তার কথাই মনে পড়ে,যাকে তার প্রয়োজন। ”
নূরীর ভাবনা শেষ না হতেই তার ঘরে পা পড়ে বাদশার। নুরী অবাক হয়। স্বস্তির স্বাস ছাড়ে। স্রস্টা মাঝে মাঝে মানুষকে তার ভাবনা ও বাস্তবতার মিশেল ঘটিয়ে চমকে দেন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আরেহ বাদশা মিয়া। আসো। বসো।”
“হুম খালাম্মা আইসা পড়লাম। আপনের চাওয়ামতো। ভাবি কই? স্কুলে?”
“হ স্কুলে। আইতে দেরি হইবো। আইজ টেস্ট পরিক্ষা শ্যাষ হইবো শিখার। পরিক্ষা শ্যাষের দিন বাড়িতে দেরিতে আসে ও। সইগো লগে গল্পগুজব করে।”
“দুপুরে খাইছো। ভাত নিয়া আসি?”
“খালাম্মা আমি খাইয়া আসছি। পেট ভরা। ব্যস্ত হইয়েন না।”
তবুও নূরী বাদশাকে অল্প নাস্তা দিলো। খেতে খেতে বাদশা বলল,
“খালাম্মা আমার উপর তালুকদার পরিবারের অনেক দায়িত্ব। তাই সুযোগ মিললেও সময় বাইর করন টাফ। আমাকে আবার খোঁজা শুরু করবো। নিশ্চিন্তে বলেন খালাম্মা। কি সমস্যা? আমি যথাসাধ্য আপনার উপকার করার চেষ্টা করুম।”
নূরী ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখে নেয় অনুসন্ধিৎসু চোখে। না এই দুপুরে কেউ নেই কোথাও। সবাই গৃহকার্যে ব্যস্ত। নূরী বাদশার কাছাকাছি একটি টুলে বসে। কথা গুছিয়ে নিচ্ছে খানিক সময় নিয়ে। বাদশা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে নূরীর মুখমণ্ডল। নূরী গলার স্বরকে নিচু করে। দুঃখিত গলায় জিজ্ঞেস করে,
“আইচ্ছা বাদশা,তোমাদের ছোট তালুকদারের দাঁড়ি গোঁফ কতবছর ধইরা রাখছে? নাকি অনেক আগে থেইকাই?”
বাদশা চৌকস। নূরীর একটি প্রশ্ন তার ভিতরে সৃষ্টি করে দশটি প্রশ্ন। সে পানি খেয়ে নেয়। নূরীকে পাল্টা প্রশ্ন করে না। তার কৌতুহলও লুকিয়ে রাখে। সঠিক তথ্য বের করতে হলে নূরীর অনুগত হতে হবে তাকে। সে সৌহার্দপূর্ণ কন্ঠে বলল,
“খালাম্মা আমি তালুকদার বাড়িতে আছি দশ বারো বছরের মতো হবে। তখন থেকেই দেখি উনার এমন দাঁড়ি গোঁফ। এখন তার আগে ছিলো কি ছিলনা তাতো জানি না।”
“উমম! উপায় আছে এইটা জানার। একটা হইলো তুমি কথায় কথায় কারো থেকে জাইনা নিতে পারো
আগে তার দাঁড়ি গোঁফ ছিলো কিনা। কিন্তু এতে আমার বিশেষ সুবিধা হইব না।”
বাদশা বুদ্ধিদীপ্ত জবাব দেয়।
“খালাম্মা তাহলে যেইভাবে আপনার বিশেষ সুবিধা হইবো সেইটা করেন।”
“বলা সহজ করা কঠিন বাদশা মিয়া। সেইটা বড় বিপজ্জনক ও ঝামেলার কাম। এর মইধ্যে আমি মহিলা মানুষ। বড় কামগুলা একলা করন যায় না। লগে আপনজনের সাহায্য লাগে। ”
তপ্ত স্বাস ফেলে বলল নূরী। বাদশা চোখ বড় করে তাকায় নূরীর মুখপানে। আশ্বাস দিয়ে বলে,
” খালাম্মা। ডরাইলেই ডর। আল্লাহ ভরসা। যতবড় কাজই হোক,আমি আপনার জন্য করতে রাজী আছি।”
নূরীও বোকা নয়। তার ভিতরে জেগে উঠলো কৌতুহলের চর। মেয়ের স্বশুর বাড়ির এত পুরানা চাকর কেন দুইদিনের পরিচয় হওয়া তাকে সাহায্য করতে চায়?
“তুমি তাদের লোক হইয়া তাদের নয়া আত্মীয়ের লগে হাত মিলাইতে চাও। কারণটা কি বাদশা মিয়া?”
হেয়ালি হেসে জিজ্ঞেস করলো নূরী।
বাদশা সোজাসাপটা উত্তর দেয়।
” হাত মিলানোর কিছু নাই খালাম্মা। বাদশা একাই দশজনের সমান শক্তিশালী। এত বছর ধইরা তাদের কাজ করি। আপনে তাদের আত্মীয়। ছোট তালুকদারকে নিয়া আপনের কথা শুইনা মনে হইলো বড় ধরনের কোন গাফলা আছে। তারা আপনাদেরকে নিচু চোখে দ্যাখে। এইটা আমার সহ্য হয় না খালাম্মা। তাই আমি চাই আপনার উপকার করতে
যদি তা আমার সাধ্যের ভিতরে হয়।”
“তুমি একলাই দশজন? তাইলেতো তোমার মতো একজন হইলেই আমার চলে।”
“হুম বলেন আপনার বিশেষ সুবিধা হয় ক্যামনে?”
নূরী একটু দম নেয়। কন্ঠকে খাদে নামিয়ে বলে,
“তোমারে বিশ্বাস করন যায় বাদশা। তুমি মানুষ হিসেবে ভালো মনের। শোন, তুমি কি কোনভাবে ছোট তালুকদারের মুখের দাঁড়িগোঁফ কামানোর ব্যবস্থা করতে পারবা? সেইটা গোপনে করতে হইবো। এবং আমি থাকমু। নইলে সিউর হমু ক্যামনে তার বিষয়ে।”
বাদশা এবারও কোন প্রশ্ন করে না। ক্ষণকাল ব্যয় করে। চিন্তিত মুখে বিজ্ঞের মতো বলে,
” গোপন থাকবো। ধূলিকণাও জানব না। যদি কেউ জানেও,সে আমার পক্ষের হবে। পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণী হইলো মানুষ। মানুষের অসাধ্য কিছুই নাই। বিজ্ঞানিরা গবেষণা কইরা দুনিয়া ওলট-পালট কইরা ফেলতে পারে। আর আমি এইটা পারুম না। তাইলে আমি বাদশা হইয়া কি লাভ হইলো। বাদশা নামেরওতো একটা হিম্মত আছে খালাম্মা। ইনশাআল্লাহ পারুম। তবে টাইম লাগবো সব সেট করতে। আর কি করতে হইবো কন?”
“আর কিছু না আপাতত। আমি ছোট তালুকদারের শুধু দাঁড়িগোঁফ ছাড়া মুখটা দেখতে চাই।”
“আমি কতটুক কি করতে পারলাম জানামু আইসা। আপনিও মানসিকভাবে রেডি থাইকেন। এখন যাই খালাম্মা। দোয়া কইরেন। ”
“আইচ্ছা বাদশা। আল্লার হাওলা।সাবধানে যাইও।”
বাদশা চলে যায় লম্বা লম্বা পা ফেলে। তার এগোতে হবে ধীরে। কাজ করতে হবে ঠান্ডা মাথায়। এক তালুকদারকে নিঃশ্চিহ্ন করা মামুলি বিষয় নয়। খুব কৌশলী হতে হবে তাকে। জগতের বড় বড় সব হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে ঠান্ডা মাথায়। এবং খুব বিশ্বস্ত ও কাছের মানুষের দ্বারা।
নূরীও মনে মনে ফন্দী আঁটতে থাকে কিভাবে কি করবে।
শিখার পরিক্ষা শেষ। তাই ফুরফুরে মেজাজে আছে। পরিক্ষা মানেই বাড়তি চাপ ব্রেনে। সে বাড়িতে আজ দেরীতে যাবে। কুসুমের সঙ্গে বরের গল্প করবে। শিখা ও কুসুম হাত ধরাধরি করে মাঠে ঘুরে ঘুরে হাঁটলো সামান্যক্ষণ। কিছুটা ক্ষুধা লেগে গেলো দুজনের। তারা চানাচুর,বুট,বাদাম বিক্রেতার কাছে গেলো। নাম কব্বর আলী। সে মাঠের একপাশে বট গাছের ছায়ায় বসে রোজ। বড় ঢালার মধ্যে কয়েক ভাগে এমন ভাজাপোড়ার জিনিসগুলো রাখে সে। বিক্রি ভালই। তার কাস্টমার এখানের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। যদিও মাধ্যমিক বিদ্যালয় হলো গার্লস স্কুল। সে ক্ষুদে সিজন ব্যবসায়ী। যখন যেটা চলবে তখন সেটাই রাখবে। শিখা ও কুসুম দুই টাকার বাদাম ও দুই টাকার চানাচুর কিনলো। টাকা শিখা দিলো। কারণ এখন তার কাছে টাকা থাকে সবসময়। অভাব তার আর নূরীর জীবন থেকে বোধহয় পালিয়েছে।
” চল ঐখানটায় গিয়া বসি।”
বলল শিখা।
মাঠ পেরিয়ে গেলে একটা বড় পুকুর আছে দিঘিসমেত। দুই সখী সেই পুকুর পাড়ে গিয়ে পা ছড়িয়ে সবুজ ঘাসের উপরে বসে পড়লো। দুলে দুলে তাদের শীতল ছায়া দিয়ে যাচ্ছে মাথার উপরে থাকা নারকেল গাছের পরিপক্ক শাখাগুলো। কুটকুট করে দুই বন্ধু বাদাম ও চানাচুর খেতে লাগলো। এবং শিখা তার বরের গল্প করছে। তার ফাঁকেই কুসুম হুট করে বলে উঠলো,
” শোন সই। একটা কথা। কাউরে কইবি না কইলাম।”
“কি কইয়া ফালা? কমু না।”
“কসম?”
“কি এমন গোপনীয় কথারে। কসম খাইতে হইবো? আইচ্ছা কসম। এই নাইয়েল গাছের কসম। পবিত্র পানির কসম। ওই যে পানকৌড়িটা ডুব দিলো। সেইটার কসম।”
“আমার প্রেম হইতে পারে একটা ছেলের সঙ্গে।”
উদাস ভঙ্গিতে সুখ সুখ গলায় বলল কুসুম।
” ওরে সই, কস কি তুও?
কে হে তিনি? গুড় না চিনি?”
শব্দ করে হেসে জানতে চাইলো শিখা।
“গুড় না চিনি মানে?”
নাক কুঁচকে বলল কুসুম।
“এইটা হলো তোর কাছে তার অবস্থান বোঝার প্রতীকী ভাষা। চিনি হইলো গুড়ের চেয়ে বেশী মজার। বুঝলি গাধী। এবার ক?”
কুসুমের মাথায় গাট্টা মেরে বলল শিখা।
“আমি নিজেই চিনিনা। স্কুলে আসা যাওয়ার সময় মাঝে মাঝেই দেখি আমার দিকে ড্যাবড্যাব কইরা বোয়াল মাছের মতো চাইয়া থাকে।”
“কস কি? খালি চাইয়াই থাকে? বোবা মনে হয়?”
“নাহ। কিসের বোবা? সেদিন আমারে একটা চিরকুট দিছে।”
শিখা চোখ কপালে তুলে,
“কই? কি লিখছে তিনি?”
“বাড়িতে আছে। লুকায়া রাখছি। মুখস্থ আছে আমার। কই তোরে শুন,
” চঞ্চলা, তোমার নাম কিগো? তোমার কাজল কালো দুটি আঁখিতে এক সমুদ্র মায়া। আমাকে সেখান থেকে কিছু মায়া ধার দিবে? জবাব দিও। মটরের ক্ষেতের পাশের খেজুর গাছের গোড়ায় রেখে দিলেই আমি পাবো।”
“ওরেব্বাস! তুই জবাব দিছিস?”
“হুম।”
“কি লিখলি?”
লিখলাম,
” আমি কুসুম। আপনি কে? আপনার পরিচয় কি? সব জানাবেন।”
“জবাব আসছে?”
” নাহ।”
“তোর কাছেত সে গুড় নয়। এক্কেবারে সাদা,লাল চিনি সব। গুড় হইলেও সেইটা খেজুরের গুড়। বাটালি গুড়। নট আখের গুড়।”
গল্প শেষে ওরা উঠে দাঁড়ায়। জামার পিছনটা হাত দিয়ে ঝেড়ে নেয় দুজনে।স্কুলের প্রাঙ্গণ ছেড়ে বাড়ির পথ ধরে দুজন দুদিকে।
পরিক্ষার জন্য রাজকে শিখা রাজের চিঠির জবাব দিতে পারেনি। টেলিফোনও করতে পারেনি। তাই সে পরেরদিন সকাল এগারোটার দিকে মাকে নিয়ে বড় বাজারে গেলো। ফোনফ্যাক্সের দোকানে একাধিক ল্যান্ডফোন রয়েছে কয়েক ভাগে।
দোকানের পিছনে একটি রুম। সেখানে বসে নারীরা প্রবাসী ও শহরে থাকা প্রিয়জনদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারে। সামনের থেকে তখন কোন পুরুষ পিছনে আসে না। মানুষ টাকার বিনিময়ে কথা বলবে। কত জরুরী আলাপ থাকতে পারে। সুবিধার কমতি হবে কেন। তাই ফোনফ্যাক্সের সৎ মালিক সকল সুব্যবস্থা রেখেছে সবার জন্য।
নূরী মেয়েকে বলল,
“তুই জামাইয়ের লগে কথা ক। আমি বাইরে থেইকা কিছু সদাইপাতি কিইনা আনি।”
শিখা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো মায়ের দিকে চেয়ে।
শিখা নাম্বার দিলে দোকানের একজন স্টাফ ছেলে ডিজিটগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ডায়াল করলো। শিখাকে দেখিয়ে দিলো কিভাবে রিসিভার কানে চেপে ধরে কথা বলতে হবে। ছেলেটি চলে গেলো। পিছনের রুমে কেউ যাচ্ছে না। নূরী বের হয়ে যেতে টেবিলে বসা,ম্যানেজারকে অনুরোধ করে বলল,
“পিছনের রুমে যেন কেউ না যায়। একটু দেইখেন। আমার মাইয়া জামাইয়ের লগে কথা কইবো। নতুন বিয়া হইছে। তাই শরম পাইবো।”
“ঠিক আছে। কেউই যাইব না।”
বলল ম্যানেজার।
শিখা কখনোই টি এণ্ড টি ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলেনি। বলার মতো তাদের কাছের কেউ বাইরে বা দূরে ছিল না। রিং বেজে যাচ্ছে। শিখা রিসিভার কানে চেপে ধরে আছে।
রাজ নাস্তা সেরে মাত্রই অফিসে এলো। ল্যান্ডফোন বেজে যাচ্ছে। রিসিভ করে বলল,
“হ্যালো.. নওশাদ স্পিকিং। ”
রাজের গম্ভীর ভরাট কন্ঠস্বর শুনে শিখা নারভাস হয়ে গেলো। কিছু বলতে পারছে না। শিখা চঞ্চল হলেও কিছুটা ভীতু প্রকৃতির মেয়ে।
ফোনের এপ্রান্তে কারো সাড়া না পেয়ে রাজ ধমকে উঠলো।
“হোয়াট ননসেন্স! নওশাদ তালুকদারকে ফোন দিয়ে ইয়ার্কি। আমার এক আঙ্গুলের ইশারায় কি হতে পারে ধারণা নেই মনে হচ্ছে?”
শিখা ভড়কে গেলো। ওমাগো! কি কয় উনি।তবুও শিশুসুলভ কন্ঠে আস্তে করে সালাম দিলো নমনীয় গলায়।
“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”
রাজের শরীর মৃদু ঝাঁকুনি খেলো। কন্ঠের রুক্ষতা দূর হয়ে ভর করলো মিষ্টতা। হাত মুঠি করে দেয়ালে ঘুষি মেরে বসলো। নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো। কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত গলায় হড়বড় করে বলল,
“মাই গড! মাই গড! আমার বাটারফ্লাই! খুব সরি। ভেরি সরি। বুঝতেই পারিনি তুমি। ইসসস বোঝার যদি কোন ওয়ে থাকতো। কতই না ভালো হতো। চুপ করে ছিলে কেন নিষ্পাপ বধূ? জানো, অফিসে মাঝে মাঝেই এমন ফোন আসে। চুপ করে থাকে ওপাশে। তো আমি এভাবে হুমকিধামকি দিয়ে কথা বললে আর কিছুদিন আসে না। রং নাম্বারগুলো প্রায়ই এমন জ্বালাতন করে। তুমি কেমন আছো? পরিক্ষা কেমন হয়েছে?”
শিখার ভীতিভাব উধাও হয়ে গেলো নিমিষেই। বয়সটা আবেগের। তাই কিছু ভুলতে সময় লাগে না। মুখচ্ছবি রূপোর থাকার মতো চকচক করতে লাগলো। লাজুক হয়েও গদগদ কন্ঠে জবাব দিলো।
“হ্যাঁ ভাইয়া,আমি ভালো আছি। পরিক্ষা ভালো হইছে। আপনি কেমন আছেন? ”
“এরপর যদি আর এমন ভাইয়া বলো। দু’ঠোট দখল করে নিবো কিন্তু। আর রক্ষা পাবে না। তুমি ছাড়া আমি ভালো থাকি কি করে? তোমাকে বুকে পাওয়ার প্রতিক্ষার অবসান হবে যেদিন, পুরোপুরি ভালো থাকবো সেদিন। আম্মা কেমন আছে? আলো আপা,দুলাভাই সবাই কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছে।”
“বড় ভাইজান মারা গেলে বাড়ি গেলাম। ইচ্ছে করেই দেখা দেইনি তোমাকে। পাষাণের মতো চলে আসতে হয়েছে। হাতের কাছে সমুদ্র। অথচ পথিক পিপাসায় কাতর। সে জল তার মুখে নেওয়া বারণ! কি কষ্ট! কি যাতনা! বুঝো।”
“আপনি কবি হইলে ভালো হইতো। তা না হয়ে বড় বিজনেসম্যান হয়েছেন।”
“আমি তোমার জন্য কবি। বুঝলে। নয়তো আমার সর্বক্ষণ ব্যবসায়ী রূপ। এবার বলতো আমাদের বাড়ি নিয়ে কি কি যেন অভিযোগ ছিলো তোমার?”
“নাহ।তেমন কিছু না। সবাই আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। ভালো করে কেউ কথা বলে না। আমাকে থাকতে দিলো অসুন্দর একটা রুমে। আমারে বিয়া করন আপনার ভুল হইছে।”
রাজ সংকোচবোধ করলো। বলল,
“বাড়ির বিষয়টা তোমাকে আগেও ক্লিয়ার করেছি। তোমাকে বিয়ে করি এটা কেউই চায়নি আমার ফাদার ছাড়া। আর আমার ভুল? ভুল যদি আমি করেও থাকি, তার মাসুলও আমিই দিবো। অন্য কেউই নয়।”
“আচ্ছা। আমি রাখি। আরো দুজন সিরিয়াল ধরছে ফোনে কথা বলার জন্য।”
” জাস্ট মিনিট বাটারফ্লাই,আমার চিঠির উত্তরের অপেক্ষায় আছি। তোমার কাঁপা হাতের ছোট ছোট কালো অক্ষরগুলো আমাকে কতটা আনন্দ দেয়, তা কেবল এই মন জানে। আর জানে ওই বিধাতা। তুমি কবে জানবে জানিনা। ভালোবাসি এক পৃথিবী। ”
ফোনের অনেক বিল এলো। নূরী এতক্ষণ সামনে টুলে বসে ছিলো। শিখা ভ্যানিটিব্যাগ খুলে বিল মিটিয়ে মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরে এলো। নূরীর তর সইছে না।
“হ্যাঁরে মা। জামাই ভালো কইরা কথা কইছে? বহুতক্ষণ কথা কইলি। আমগো কথা জিগাইছে?”
“হ আম্মা। বুবু,দুলাভাইয়ের কথাও জিগাইলো। আরো নানান কথা।”
চোখ নামিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে মায়ের জিজ্ঞাসার উত্তর দিলো শিখা।
রানী অল্পপাওয়া স্বামীশোক কাটিয়ে উঠেছে অনেকখানি। পরনে এখনো শ্বেতশুভ্র শাড়ি। পুরোদস্তুর বিধবার বেশ। সে পুকুরের নির্জন পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালো। গাছের শাখা থেকে শীতের রুক্ষতায় রঙ হারানো কিছু ধূসর পাতা ঝরে পড়ছে তার গায়ে।সে মাথা উঁচিয়ে সেদিকে চাইলো। কুটিল হেসে মনে মনে উচ্চারণ করলো,
রাজবধূ পর্ব ১৯
“তালুকদার পরিবারে আমি শেষ নিঃশ্বাস অবধি থাকমু। এর একটা কারণ আপনাগো সবার জানা। মায়া মমতা। বাকি কারণটা বাকিই থাকুক। নয়তো দ্বিতীয় বিয়া না বইসা,না সন্তান জন্ম দিয়া এইখানে পইড়া থাকনের মানেটা কিহে?”