রাজবধূ পর্ব ৪০

রাজবধূ পর্ব ৪০
রেহানা পুতুল

শিখা তাজ্জব হয়ে গেলো চেনা মুখটা দেখে। সে দপ করে জ্বলে উঠলো। ফুঁসে উঠলো। মনে মনে শপথ করলো,
ইয়েস! তোকে দিয়েই শুরু করবো অগ্নিশিখার প্রলয়ঙ্কারী মিশন। এখন থেকে একটু একটু করে সাহসী হতে হবে আমাকে। প্রতিবাদী, যুক্তিবাদী হতে হবে। সবাইকে বুঝিয়ে দিতে হবে আমি ফেলনা কেউ নয়। যদিও এসব বহু সময়ের ব্যাপার। কষ্টসাধ্য! তবুও পারতে হবে। জিততে হবে আমাকে। বদলে ফেলতে হবে আমার মুখের ভাষাও। পড়ার সময় বই যেভাবে পড়ি। সেভাবেই কথা বলবো এখন থেকে। নয়তো এদের বৃহৎ সংসারে আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন! যন্ত্রণাদায়ক হবে।

সেই ছেলেটি লুঙ্গিকে হাঁটু অবধি তুলে ঘাটের মাঝখানে বসে পানিতে হাত ধুয়ে নিচ্ছে বারবার। ট্যারা চোখে শিখার বুকের দিকে তার ইতর চাহনি তাক করছে। ছেলেটির ধারণা ছিলো শিখা এদের ঘরে প্রায় নতুন বউ। অল্পবয়েসী মেয়ে। বাবার বাড়ি থেকে এই বাড়িতে এলো মাত্র কয়েকদিন হলো। এত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সংকোচে কাউকে কিছু বলবে না। নিজেতো চুপ রবেই।
অপরদিকে সে এটাও বুঝতে পেরেছে তালুকদার পরিবারে শিখাকে কেউই তেমন পছন্দ করে না। শিখার কোন মূল্যই নেই এখানে। নামেই তালুকদার পরিবারের ছোট বউ। যা একটু করে তালুকদার চাচা। উনিতো এখন গ্রামের বাইরে আছেন। তাবলীগ জামাতে গিয়েছেন তিন সপ্তাহের জন্য।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সে কন্ঠে রসসূধা ঢেলে শিখাকে বলল,
“ভাবিসাব ভিজা জামায় খাড়ায়া আছেন ক্যান? জামা পরেন না। শরীরে ঠান্ডা লাইগা যাইবো আপনার।”
আকষ্মিক শিখার তেতে উঠা বিক্ষিপ্ত মেজাজ তার কথা শুনে আরো উস্কানি পেলো। শেষমেশ বাড়ির একটা চাকরেরও কুদৃষ্টি গেলো তার শরীরের দিকে। আগুনঝরা চোখে পুরু গলায় ধমকে উঠে বলল,
“এই পশু কোথাকার। তুই না উঠে গেলে কিভাবে চেঞ্জ করবো?”
বলেই শিখা কষে সজোরে একটা লাথি মারলো নিজামের গায়ে। নিজাম পানিতে পড়ে গেলো। হতবিহ্বল হয়ে গেলো তার ধারণা ও বাস্তবতার বিস্তর ফারাক দেখে।
সে জেদী সুরে বলল,

“আপনারে যে সবাই ক্যান দেখতে পারে না,তা এখন টের পাইলাম। আপনি আসলেই খারাপ। মেয়ে মানুষ হইয়া একটা ছেলের গায়ে পা তোলেন। আমি আপনার বয়সে বড়। তুই তোকারি করে কথা কন ক্যা? এইটা খুব খারাপি করলেন আমার লগে। আমি ত হাত ধুইতে আইছি। এখুনি যাইয়া খালাম্মার কাছে নালিশ দিতাছি।”
ক্ষণিকেই ফের শিখা বোমের মতো ফেটে পড়লো। তার গায়ে অসুরের শক্তি ভর করলো। সে নিজামের গায়ে আরেকটা উষ্ঠা মেরে বলল,

” এই নোংরা কোথাকার? বড় আর বয়সের ইজ্জত রাখছিস তুই? মুখের উপর কথা বলিস? তোর মতো মানুষদের সাথে কুত্তার মতো আচরণ করা উচিত। হাত ধুইতে এতক্ষণ লাগে? তোর হাতে কি গু লেগে আছে? হাত ধোয়ার জন্য আর ঘাট নাই? কল নাই? আমি বলদ? এইভাবে ঢলে ঢলে ধুইতে হয়? জানে বাঁচতে চাইলে আমার সামনে আর কখনো যেন তোরে না দেখি। যা ভাগ বলছি।”
নিজাম ভেজা লুঙ্গি নিয়ে উপরে উঠে গেলো। ভারি ভারি পা ফেলে রান্নাঘরের উঠানে গিয়ে সুফিয়াকে ডাক দিলো খালাম্মা বলে। নিজামের উচ্চস্বর শুনে একে একে সবাই জড়ো হলো তার সামনে।
“কিরে কি হইছে? তোর লুঙ্গি ভিজলো ক্যামনে?পইড়া গ্যালি?”

জিজ্ঞেস করলো সুফিয়া বিবি।
নিজাম অমাবস্যার মতো মুখ আঁধার করে অতি নিরীহ সুরে বলল,
“আমি আর আপনাগো চাকরি করমু না। কালই আমারে বিদায় দিয়া দেন।”
“ওমা! কি আচানক কথা? কি হইছে?”
“আপনার ছোট বউরে জ্বিনে ধরছে। আমি হাত ধুইতে গেলাম পুকুর ঘাটে। উনি গোসল কইরা উঠছে। অমনি কি আমারে লাথথি মাইরা পানিতে ফালাইলো। কিছু কইতে গেলাম, আবার লাথি মারলো। আমি নাকি উনারে দেইখাই ঘাটে নামছি। কই ঘরেত আরো ভাবিরা আছে। আমার চলাফেরায় কোন বাজে কিছু দেখছে? জিগান না? আমি কইলাম সকালেই চইলা যামু।”

সুফিয়া নিজামের উপর ক্ষেপে গেল না। তোষামোদের সুরে বলল,
“এমন চেতিস না। আমি হেতিরে জিগাই। তুই যা।”
“জ্বিনে ধরা বউরে কবিরাজ দেখান। নইলে বিপদে পড়বেন। সুন্দরী মাইয়ারে দুপুরবেলায় একলা পুকুর ঘাটে পাইয়া জ্বীন ভর করছে তার উপরে। আর জ্বাল মিটাইলো আমার উপরে। ”
বলেই নিজাম ফণা তোলা সাপের মতো ফোঁসফোঁস করতে করতে চলে গেলো কাচারিঘরের দিকে।
মতির মা বলল,

“ভাবি রাজের বউ আজাইরা এমন করার মতন মাইয়া না। সে হগল সময় ধীর,চুপচাপ থাহে। মুখে রাও টুকু করে না। যে যা কয় হুনে। মাইনা নেয়। ফিরা কথা কয়না। মুখে মুখে তর্ক করে না। নিজাম হয়তো ঠিকই বদ নজরে হের গোসল করা দেখছে। তাই সহ্য করতে পারেনাই। মেজাজ চড়ায় উঠছে আর লাথি মারছে। সতী মাইয়া যে।”
পাশে দাঁড়ানো আদুরী গোপনে বলল,
“সতীরে অসতী করা যায় চাইলেই। আমি স্বামীর ঘরে সতী হইতে পারলাম না। আমাদের ঘরেও সে সতী থাকতে পারবে না।”
সুফিয়া মতির মায়ের দিকে চেয়ে বলল,

“তুই সব সময় রাজের বউর দিকে টানস। ভর দুপুরকালে গোসল করতে গ্যাছে। জ্বিনই ধরছে হয়তো। নইলে যত কিছুই হউক রাজের বউর এই হিম্মত হওয়ার কতা না। মাইয়া হইয়া একটা পোলারে লাথি মাইরা ফালাইয়া দিবো। তাই আমারো ডাউট হইতাছে জ্বিন ধরা নিয়া।”
পাশ থেকে রানী,সুমনা,ডলি বলে উঠলো,
“আম্মা, আমাগো ডর করতাছে। কখন কারে সে চুবায়া মারে পানিতে। লালচাঁন ফকিররে আনায়া একটা ঝাড়ফুঁক করাইলে মনে হয় ভালো হইবো।”
আদুরী বলল,

“আগে শিখারে জিজ্ঞেস করেন আম্মা। তারপর ভালো একটা কবিরাজ দেখাতে হবে। আলগা কিছু আছে নাকি তারসঙ্গে। আজকের বিষয়টা কিন্তু ডেঞ্জারাস। হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নাই।”
শিখা নিজের ধোয়া জামাকাপড় রোদে শুকাতে দিলো। নিজের রুমে গিয়ে জোহরের নামাজ আদায় করলো। হাতে পায়ে সরিষার তেল দিলো। মুখে তিব্বত স্নো ক্রিম মাখলো। রুম থেকে বের হয়ে দেখলো সবাই জটলা বেঁধে আছে ঘরের দাওয়ার সামনে। সে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তারা সবাই বাঁকা চোখে শিখার দিকে তাকালো। সুফিয়া বিবি শিখাকে বিষয়টা জিজ্ঞেস করলো কপাল কুঁচকে। শিখা সত্যতা স্বীকার করলো।
সুফিয়া মরিচ গলায় বলল,

“তাইলে ত নিজামের কথাই হাঁচা। তোমারে জ্বিনে ধরছে।”
শিখা তখন সত্যিটা বলল। কিন্তু কেউই বিশ্বাস করল না তার মুখের কথা। শিখার অন্তরখানি বিরক্তিতে ভরে উঠলো তাদের উপরে। কিন্তু কিছু বলল না আর। শিখা সবাইর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ভাবি,আপা দুপুরের ভাত কখন খাবেন? আমার ক্ষুধা লাগছে।”
” কেউই খায়নাই। খাইতে দেরী আছে। ”
“তাহলে আমি নিয়া খাই? ক্ষুধা লাগছে। নাকি খালা দিবেন ভাত আমারে?”
মতির মায়ের দিকে চেয়ে ম্লান কণ্ঠে বলল শিখা।
মতির মা সুফিয়ার দিকে চাইলো। সুফিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।
“ভাতের হাঁড়ির ঢাকনা কেউ যেন না তোলে। ঘরের মুরুব্বিরা না খাইতে কিসের জোয়ান ছেমরি ভাত খায়। প্যাট পুইড়া যাইতাছে? কয়বেলার উপাস তুমি?”

“মা, এরে ত আসলেই জ্বিনে ধরছে। নইলে আইজ ক্যান সে হঠাৎ এমন ভাত চাইবো? হের মুখের ভাষাও বদলাইয়া গ্যাছে। দ্যাহেন। রাজ আর জুবায়েরের মতন কথা কইতাছে শুদ্ধ ভাষায়।”
চনচনে গলায় বলল আদুরী।
শিখা কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে জোর গলায় বলল,
“আগে বলিনাই বলে কি কখনো বলতে পারবো না? রোজই আমার ক্ষুধা লাগে। কষ্ট করে থাকতাম। ভয়ে,লজ্জায় বলতাম না। চাইতাম না। আমাদের বাড়িতে গোসলের পরেই আমি ভাত খেতাম। এখানে আপনারা দিলে খেতে পাই। নইলে খেতেও পাই না। অথচ ঘর ভর্তি খাওয়া। আপনারা অকারণেই শুরু থেকে আমার উপর ছোট বড় অবিচার করে আসছেন। ভিক্ষুকের মতন আমারে আলাদা ভাত দেন। আপনাদের সাথে টেবিলে বসতে দেন না। আমি মেনে নিছি। কিছু বলি না। থাকুক না। তবুও আপনারা শান্তিতে থাকুন। কিন্তু আজকের বিষয় মেনে নিতে পারিনাই।”
শিখার কথা শুনে উপস্থিত সবাই আহাম্মক বনে গেলো। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো অদ্ভুত চোখে। শিখা ক্ষুধা নিয়ে থাকে দুপুরে সেজন্যে নয়। শিখাকে জ্বিনে ধরেছে এই বিশ্বাসেই তারা দৃষ্টি বিনিময় করলো। জ্বিনেই তাকে দিয়ে এসব বলাচ্ছে।
ঘরের বাইরে চেঁচামেচি শুনে আমেনা ও তার মা এলো। আমেনা, কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই কারণ শুনলো। সে সুফিয়াকে বলল,

“ভাবি মাইয়ার খিদা লাগছে। খাওক না নিয়া ভাত। কি হইবো? গোসলের পর সবাইর খিদা লাগে কমবেশি।”
” ওরে মাগগো মা। তোগো মা পোলার দরদ উতলাইয়া উঠছে দেহি এই ছেমরির লাইগা। এই মাইয়া তোর ঘরের বউ হইলেই ভালো হইতো তাইলে।”
বিষ কণ্ঠে বলল সুফিয়া।
“হাঁচাই কইছেন ভাবি। শিখার সন্ধান আগে পাইলে জুবায়েরের লাইগা প্রস্তাব দিতাম হের মায়ের কাছে।”
শিখা ক্ষুধায় প্যাট চেপে ধরে ঢেলায় উপর দুই হাঁটু ভাঁজ করে বসে রইলো।
বিষিয়ে আসা কণ্ঠে বলল সুফিয়া বলল,

“কি বেশরম,বেলাজ মায়ের মাইয়া তুমি। একটা জোয়ান পোলার গায়ে হাত তুলছো মামুলি বিষয় নিয়া। তারজন্য অনুতাপ নাই। আবার ভাত খাইতে চাও। তুমি কি পর্দাওয়ালী নাকি? যে তুমি থাকলে ঘাটে কোন পুরুষ যাইতে পারব না? আইজকার পর নিজামের সঙ্গে আর কোনদিন তুমি খারাপ ব্যবহার করবা না। ওই পোলা যদি কাইল বেয়ানকালে সত্য সত্যই চইলা যায় কামে ইস্তফা দিয়া, তোমার মা আইসা তার কামগুলান কইরা দিবো?”
“নিজাম ইস্তফা দিতে হবে না। তার চাকরি বাদ। সে দুই একদিনের ভিতর বিদায় নিয়ে চলে যাবে। কারণ নিজামের চোখ ভালো না। তার দায়িত্ব ও কাজ সব আমিই পালন করবো। বাদশা ভাই ছিল না? উনাকে নিয়ে কোন অভিযোগ ছিলো আমার বলেন?”

ওড়না দিয়ে চোখের কোন মুছে টনটনে গলায় বলল শিখা।
“ওরেহ আল্লাহো গো আল্লাহ! উনি কয় কি? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। দুই পয়সার মুরোদ নাই। আর উনি নাকি তালুকদার সাম্রাজ্য চালাবে। কঠিন জ্বিনে ধরছে এরে।”
বিষিয়ে আসা কণ্ঠে বলল আদুরী।
শিখা নিরব পায়ে রান্নাঘরে ঢুকলো দরজা ঠেলে। নিজহাতে ভাত তরকারি নিয়ে খেলো পিঁড়িতে বসে। মতির মা ভীতসন্ত্রস্ত চোখে সবার মুখের দিকে তাকালো। এবং পা ঘুরিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো। সুফিয়া ছোট জা আমেনা ও হারিছার দিকে চেয়ে বলল,

“এরপরেও আপনারা কইবেন এরে জ্বিন ভূতে ধরেনাই।”
“বড় বউ হুনো,এমনিই একজন মাওলানা বা পীরসাব আনায়া রাজের বউরে একটু ফুঁ টু দিয়া নিও। তেল পানি পড়াও নিও। আলগা কিছু থাকলে কাইটা যাইবো।”
ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল জুবায়েরের নানী হারিছা খাতুন।
শিখা ভাত খেয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সবার পাশ কাটিয়ে। তাকে কেউই আর কিছু বলল না। কারণ তার সাথের জ্বিনটা বড় বেয়াড়া। অবাধ্য। এরে ফকির দিয়া ঝাড়ু মেরে তাড়াতে হবে। শিখার আজকের সীমা ছাড়ানো আস্পর্ধা দেখে সবাই আশ্চর্য হয়ে গেলো।
রাতে জুবায়ের বাড়ি এলে আমেনা সব জানালো। জুবায়ের ভীষণ মর্মাহত হলো শুনে। শিখার জন্য মায়ের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলল,

“ওর বয়স কম। এই বয়সে খেতে চাওয়া ক্ষুধা লাগা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর আগে ভীতু ছিলো বলে কি সবসময় সে ভীতু থাকবে নাকি? নিজামের বিষয়টা আমার মিথ্যা মনে হয় না। শিখা কি মেন্টাল নাকি অকারণে কাউকে মারবে? সে দেড় বছর ধরে এ ঘরের বউ। এর আগে ত এমন কিছু শুনিনি তার সম্পর্কে। আমি সকালেই নিজামকে শাসিয়ে দিবো।”
“হ জিগাইস। তবে পরিস্থিতি ভয়ংকর। তাদের ভাবসাব সুবিধার ঠেকল না আমার কাছে।”
জুবায়ের মহাচিন্তায় পড়ে গেলো।
পরেরদিন সকালে শিখা কলেজে যাওয়ার আগে নিজামকে খুঁজে বের করলো। আদেশ দিয়ে বলল,
“আপনি এই সপ্তাহ শেষে চলে যাবেন। আমাদের বাড়ি আমরা সামলাবো।”

নিজাম ভ্রুকুটি করে তাকালো শিখার দিকে। শিখা চলে গেলে মনে মনে বলল,
“যদি যাইতেই হয়, তোরে মজা করা খাইয়াই যামু। তার আগে যামুই না। ধরলাম না,ছুঁইলাম না,দূরে খাড়ায়া তোরে দেখতাম খালি। তাতেই মাইর খাইলাম। চাকরি যাইবো। তাইলে এমনিই ছাইড়া দিমু তোরে? তুই কপাল গুণে তালুকদার ঘরের বউ হইলি। নইলে তোর যোগ্যতা হিসেবে আমার মতন কারো লগেই বিয়া হইতো।”
শিখা চলে গেলে পরে জুবায়ের এলো নিজামের সামনে। নিজামের শার্টের কলার সে শক্ত হাতে মুঠি করে চেপে ধরলো। কটমট চোখে গর্জন করে বলল,

“তালুকদার পরিবারের সবচেয়ে মূল্যবান মানুষের দিকে তুই কুনজর দিয়েছিস। ইচ্ছে করছে তোর দু’চোখ উপড়ে ফেলি। শিখার কথাই আমার কথা। তুই এই সপ্তাহ শেষে চলে যাবি তোর পাওনা বুঝে নিয়ে।”
নিজাম অনুগত চোখে চুপ থাকে। জুবায়ের চলে গেলে নিজাম তাকে নিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
“তোর হাবভাবে মনে হয় রাজ ভাইর বউ তোর মিঠা মধুর চাক। কেউ মুখ দিতে আইলেই তোর জ্বলে খুব।”
শিখা কলেজে চলে গেলো। জুবায়ের মার্কেটে চলে গেলো। তখন নিজাম বাড়ির অন্দরে গিয়ে সবাইকে জানালো শিখার কথাটা। সুফিয়াসহ অন্যরা নিজামকে আস্বস্ত করলো এইবলে,
“তুই সবুর কর। তোর দায়িত্ব পালন কর। দরকার হলে তারকাছে মাফ চেয়ে নিস। বাকিটা তালুকদার আসলে তোর বিষয় ফয়সালা হবে। আশাকরি তোর চাকরিতে ইস্তফা দিতে হবে না।”

শুনে নিজাম শান্তমনে চলে যায়।
শিখা কলেজে চলে গেলে সুফিয়া বিবি, মেয়ের ও বউদের সঙ্গে শলা পরামর্শে মেতে উঠে। বোরকা পরে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। একাধিক কবিরাজের বাড়ি দৌড়াদৌড়ি করে। কে ভালো করে জ্বিন তাড়াতে পারবে সেই খবর নিতে লাগলো। শিখার ডানা ভাঙ্গতে হবে বড় হওয়ার আগেই। এই মেয়ের চোখে যে জলন্ত অগ্নীকুণ্ড দেখা গেলো, তাতে সবাইকে পুড়িয়ে ভষ্ম করে ফেলবে। পরে চূড়ান্ত হলো লালচাঁন ফকিরই। শুক্রবারে আসতে নিষেধ করলো সুফিয়া তাকে। কারণ সেদিন জুবায়ের বাড়িতে থাকে। সে ফকিরকে বাঁধা দিবে। অন্যদিন বিকেলে আসতে হবে। তার আগে এলে কাজ হবে না। শিখা কলেজে থাকে।

বুধবার বিকেলে লালচাঁন ফকির এলো তালুকদার বাড়ি। ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে হোক মাওলা বলে হাঁক দিলো। তার হেঁড়ে গলার আওয়াজ শুনে সুফিয়া ও বাকিরা মুচকি হেসে ঘরের সামনে গেলো।
“পীর বাবা বসেন। এই কইরে বরকত,মোড়া আইনা দে পীরসাবরে। আর পান সাজায়া দে উনারে।”
সুফিয়া দরাজ কন্ঠে আদেশ দিলো বরকতরে। বরকত দ্রুতপায়ে আদেশ পালন করলো। পান খাওয়া শেষে লালচাঁন বলল,
“রোগীনি হাজির আছে গৃহে? তাইলে আমি আসন পাইতা লই।”
“হ আছে। আনতাছে। আপনে সব রেডি করেন।”
লালচাঁন আসন প্রস্তুত করলো। তার কাঁধের ঝোলা থেকে প্রয়োজনীয় সব বের করলো। নিজে যোগাসনের মতো হয়ে বসলো।
শিখাকে আদুরী ডাকতে গেলো। দেখলো শিখা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আদুরী দরদ মাখা সুরে শিখাকে ডেকে তুললো। শিখা চোখ কচলাতে কচলাতে জানতে চাইলো,
“কোন সমস্যা আপা? কাঁচা ঘুম থেকে আমাকে জাগালেন যে?”
আদুরী বলল,

“আমাদের পূর্ব পরিচিত একজন দরবেশ বাবা আসছে। নাম লালচাঁন পীর। আম্মা তোমাকে তার কাছে নিয়ে যেতে বলছে। তোমাকে একটু ঝাঁড়ফুঁক করে দিবে উনি। কলেজে যাওয়া আসা করো। তাহলে খারাপ কিছু থাকলেও তা দূর হইয়া যাইবো।”
“নাহ। আমি যাব না। এসব আমার পছন্দ না। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি।”
দৃঢ় স্বরে বলল শিখা।
“সব পাগলেই নিজেকে সুস্থ দাবী করে।”
বিরক্তি নিয়ে বলল আদুরী।

তবুও শিখা তার সিদ্ধান্তে অবিচল রইলো। রুম থেকে বের হলো না। আদুরী গিয়ে তার মাকে বলল। সুফিয়ার কড়া নির্দেশে রানী,সুমনা,ডলি,আদুরী মিলে শিখাকে জোর করে উঠানে নিয়ে গেলো। দরবেশের সামনে বসিয়ে দিলো। শিখা উঠতে গিয়েও আর পারল না। তাকে ধরে রাখলো তারা। শিখা দরবেশের দিকে তাকালো এক ঝলক। লালসালু কাপড় পরিহিত দরবেশের নাম কেন লালচাঁন বুঝতে পারলো। দরবেশ খপ করে শিখার একহাতের সরু কবজিটা ধরে ফেলল। গমগমে স্বরে বলল,

“আপনারা ছাইড়া দেন তারে। দূরে সইরা যান সবাই। নইলে কাজ হবে না। জ্বীনের বাচ্চা জ্বিন এখন আমার কবজায়। আইজ ওরে বোতল বন্দী কইরাই ছাড়মু। লালচাঁন পীরের সাথে বিতলামি করে।”
সবাই দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে, বসে আছে। লালচাঁন শিখার কনিষ্ঠ আঙ্গুলে বল প্রয়োগ করে গরম চোখে জিজ্ঞেস করলো,
“তুই এর লগে কবে শোয়ার হইছিস ক? ঠিক ঠিক জবাব দে। নইলে যাবজ্জীবনের জন্য বোতল বন্দী কইরা ফেলমু?”
“আমাকে ছেড়ে দেন বলছি। আমি ব্যাথা পাচ্ছি আঙ্গুলে।”
কোঁকানো স্বরে বলল শিখা।
সুফিয়া বলল,
“নাহ পীর ছাইড়েন না। এই খবিস জ্বিন আমার বউয়ের মুখ দিয়া বহুত লম্বা লম্বা কথা বইলা ফালাইছে। যেমনেই হোক জ্বীনটারে তাড়ায়া দেন।”
“দিতাছি। দেহেন না কি করি।”

এই বলে সে নারকেল শলার ঝাড়ু দিয়ে শিখার গায়ের এপাশ ওপাশ করে প্রহার করতে লাগলো। শিখা আর্তচিৎকার দিয়ে উঠলো অসীম যন্ত্রণায়।
“আল্লাগো! আম্মা আমাকে বাঁচান। এরা আমাকে মেরে ফেলতেছে। আমাকে ছাড়েন বলছি। কোনো জ্বীনে ধরেনাই আমাকে। পীর বাবা আমাকে মারবেন না। দয়া করুন। আমি অনেক ব্যথা পাচ্ছি।”
আদুরী ও সুফিয়ার বোবা সংকেত পেয়ে লালচাঁন শিখাকে এলোপাতাড়ি প্রহার করতে লাগলো জ্বীন তাড়ানোর নামে। সুফিয়া তাকে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে রেখেছে। যেন জ্বীনও তাড়ায় এবং সেই ছুতোয় শিখাকে কিছু উত্তম মধ্যম দেয় ভালো করে। তারাতো চাইলেও গায়ে হাত তুলে মারতে পারছে না। এতে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙ্গবে না। তাদের অন্তরের বহুদিনের লুকায়িত ক্ষোভও কিছুটা পশমিত হবে। লালচাঁনের বলিষ্ঠ হাতে থেকে শিখা ছুটতে পারছে না। ঝাড়ু রেখে এবার তার পায়ের চটি দিয়ে শিখাকে মারতে লাগলো।

বারবার প্রশ্ন করতে লাগলো,
“তুই স্বীকার করবি না কিছুই? এরে ছাইড়া যাবি না? তাইলে উত্তম মধ্যম খেতে থাক।”
শিখার মাঝে কথা বলার শক্তিটুকু আর অবিশিষ্ট নেই। সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে আসছে তার। চারপাশ আধাঁর করে সন্ধ্যাও ঘনিয়ে এলো। সান্ধ্যকালীন কাজ সারতে সবাই এদিক সেদিক চলে গেলো। ঠিক তখনই উল্কার ন্যায় জুবায়ের চলে এলো উঠানে। সে বাইক থামিয়ে দরবেশের সামনে এসে দাঁড়ালো।
ক্ষিপ্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“কি হচ্ছে এখানে?”

দরবেশ প্রহার বন্ধ করলো। শিখা অনবরত টলছে। জুবায়ের দাঁড়ানো থেকেই শিখার মাথায় হাত রেখে বলল,
“শিখা কি হচ্ছে তোমাকে নিয়ে?”
শিখা জবাব দিতে পারল না। জুবায়েরের দুই পায়ের উপর ঢলে পড়লো নিস্তেজ হয়ে আসা পুরো শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে। জ্ঞান হারিয়ে ফেললো শিখা।
লালচাঁন উঠে দাঁড়ালো প্রস্থান নেওয়ার জন্য। জুবায়ের নিষ্ঠুর গলায় তাকে বলল,
“এখন যান। আপনার হিসাব পরে করছি আমি।”

রাজবধূ পর্ব ৩৯

লালচাঁন ঘাবড়ানো মনে উঠে চলে যায়।
জুবায়ের শিখাকে পাঁজাকোলা করে তার রুমে নিয়ে যায়। তারপর,
“ওই অমানুদের দলেরা,কে কই আছিস এদিকে আয়।”
বলে ব্যাঘ্রকন্ঠে হুংকার দিয়ে সবাইকে ডাক দিলো জুবায়ের।

রাজবধূ পর্ব ৪১