রাজবধূ পর্ব ৫৩
রেহানা পুতুল
সেই সন্ধ্যায় শিখার প্রচন্ড পেট ব্যথা আরম্ভ হয়। সে আম্মাগো! বাঁচান বলে চিৎকার করতে থাকে। মতির মা, সুমনা,আদুরী ছুটে যায়। তাদের হায় হুতাশে সময় অতিক্রম হয়। শিখা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে।
সুমনার অনুরোধে মতির মা বিক্ষিপ্ত পায়ে ছুটে গিয়ে তালুকদারকে জানায়। তালুকদার শশব্যস্ত হয়ে বরকতকে পাঠায় বাজারে গিয়ে বেবিট্যাক্সি নিয়ে আসার জন্য। বরকত দৌড়ে দৌড়ে বাজারে যায়। এই ভিতরে মতির মা ও হারিছা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু ঘরোয়া টোটকা প্রয়োগ শুরু করলো। কচি চালতা পাতার রস,থানকুনি পাতার রস খাওয়ানো, পেটে গরম পানির ছ্যাঁক দেওয়া, সূরা ফাতিহা পড়ে শিখায় শরীরে ফুঁ দেওয়া কিছুই বাকি রাখল না। কিছুতেই কিছু কাজ হচ্ছে না। পেট ব্যথা ও বুক জ্বালাপোড়া করছে শিখার। সুফিয়া বিবি,ও ঘরের বাকি সবাই জড়ো হলো। সবাই শিখার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। বেবিট্যাক্সি করে বরকত উঠানে চলে এলো।
তালুকদার,বরকত,আদুরী,জোছনা মিলে শিখাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলো। ইমার্জেন্সি বিভাগে ভর্তি করা হলো। তালুকদার বরকতকে আদেশ দিলো।
“তুই জুবায়েরের দোকানে চইলা যা। আসতে ক জলদি কইরা।”
বরকত হাসপাতালের গেট হতে ট্যাম্পু করে মার্কেটে যায়। জুবায়েরের দোকানে গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,
“তাতারি আহেন ভাইজান। ছোট ভাবি মইরা যাইতাছে। পেট ব্যথা। বুক ব্যথা। কাকায় পাঠাইছে আমারে। হাসতাপালে ভর্তি। ইমার্জেন্সিতে।”
জুবায়ের থমকে যায়। সে মুহূর্ত বিলম্ব করে না। নিজের দোকানের ল্যান্ডফোন থেকে রাজের বাসায় ল্যান্ডফোনে টেলিফোন করে। রাজের জ্ঞান হারানোর দশা। সঙ্গে সঙ্গে রাজ নিজের জীপ ড্রাইভ করে রওনা দিলো গ্রামের উদ্দেশ্যে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পরক্ষণেই জুবায়ের বাইকে করে বরকতকে নিয়ে উদভ্রান্তের ন্যায় ছুটে যায় হাসপাতালে। তালুকদারের চুপসে যাওয়া কলিজা বড় হয়ে গেলো জুবায়েরকে দেখে৷ জুবায়ের দেখলো পরিক্ষা নীরিক্ষা চলছে শিখার। হাতে সাল্যাইন। নাকে মুখে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বসানো। রক্ত নেওয়া হচ্ছে শিখার হাত থেকে। সবার বুক ধড়ফড় করছে।
জুবায়ের আদুরীকে উৎকন্ঠাজনিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে রে?”
“আল্লায় জানে। কলেজ থেকে এসে ভাত খাইলো। আধ ঘন্টার বেশি হলো পেট ব্যথা আরম্ভ হইছে। বুকেও ব্যথা৷ উল্টাপাল্টা কিছু খাইলো মনে হয়।”
জুবায়ের আর কিছু বলল না। এই মুহূর্তে শিখার বেঁচে উঠা জরুরী।
রিপোর্ট হাতে এলো। ডাক্তার সবাইকে জানালো,
“পেশেন্ট বিষাক্ত কিছু বা বিষ খেয়েছে। আরো লেট হলে আমাদের কিছুই করার থাকতো না। যদিও এখনো রিস্ক রয়েছে। বিষক্রিয়া সারা শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে রক্তে মিশে গিয়ে। সেই দূষিত রক্তগুলো চেঞ্জ করে নতুন রক্ত দিতে হবে। জরুরী এ পজেটিভ তিন ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। আমরা সাময়িক একটা ইনজেকশন পুশ করেছি। যেন আর বেশী ছড়াতে না পারে বিষক্রিয়া।”
জুবায়ের হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে চলে গেলো। তিন ব্যাগ রক্ত কিনে আনলো। কারণ তাদের কারোই এ পজেটিভ ব্লাড গ্রুপ নয়।
তালুকদার পাগলের মতো হয়ে গেলো। কিছু হলে রাজ ও নূরীকে কি জবাব দিবেন। ভেবে পাচ্ছেন না শিখার মাকে জানানো ঠিক হবে কিনা । এদিকেও বরকতকে প্রয়োজন। সরকারি হসপিটালে মূল চিকিৎসা ভালো। তবে টুকটাক অনেক কিছুই পেশেন্টের লোকদের কিনে দিতে হয়।
তার বেশ পরে জুবায়েরের পরামর্শ নিয়ে বরকতকে মধুপুর পাঠানো হলো। বাড়ি থেকেও বাকি সবাই চলে এলো। যেহেতু সরকারি হসপিটাল তাই সব প্রসেস করতে করতে বেশ সময় অতিবাহিত হয়ে গেলো। কর্তব্যরত ডাক্তারদের হাতে ব্লাড বুঝিয়ে দিলো জুবায়ের। শিখার বুকের নিচের দিকে একপাশে ছিদ্র করা হলো। দূষিত ব্লাডগুলো সম্পূর্ণভাবে বের করা হলো। নতুন রক্ত দেওয়া শুরু হলো। কিন্তু দেরী হলো বলে,শিখার শরীর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে এলো। তার শরীরের সকল ব্যথার অবসান হলো। বুঁজে থাকা দু’চোখের পাতা কিছুতেই মেলছে না। অর্ধমৃত অবস্থায় শিখার কোমল দেহখানি মরা লতার মতো পড়ে আছে হাসপাতালের শয্যায়। ডাক্তাররা প্রাণপ্রণে চেষ্টা করছে শিখার জ্ঞান ফিরিয়ে আনার। ব্লাড যাচ্ছে খুবই স্লোলি।
সুফিয়াসহ সবাই আল্লাহকে স্মরণ করছে শব্দ করেই। তালুকদার দু’হাত তুলে স্রস্টার কাছে ফরিয়াদ করলো শিখার জন্য। জুবায়ের সবার আড়ালে গিয়ে নিরবে অশ্রু বির্সজন দিয়ে যাচ্ছে। তারপর তালুকদারসহ একে একে সবাই শিখার কানের কাছে গিয়ে মমতার সঙ্গে তাকে ডাকলো। কাজ হলো না। তালুকদারের নির্দেশে জুবায়েরও ডাকলো শিখাকে। আলতো করে শিখার হাতের পাতায় সে মৃদু ছোঁয়া দিলো। নূন্যতম লাভ হলো না।
এভাবে সময় গড়িয়ে গেলো আরো। নূরী এলো বরকতের সঙ্গে। নূরী নিজের বাড়িতে ছিলো না বলে অনেক দেরী হলো। সে এক আত্মীয়ের বাড়ি ছিলো। সেখান থেকে বাড়ির মানুষ লোক পাঠিয়ে তাকে খবর দিয়েছে। নূরী তার আদরের ছোট মেয়েকে নির্জীব অবস্থায় দেখেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো।
কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে ধমক দিয়ে বলল,
“না কেঁদে মেয়েকে ডাকতে থাকুন।”
নূরী মেয়ের শিয়রের কাছে বসে মুখ ঝুঁকিয়ে ডাকতে লাগলেন। এক হাত দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন। সবাই উদ্বিগ্নতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে।
“মা শিখা, চোখ খোল মা। চাইয়া দেখ তোর আম্মা আইসা পড়ছে। আর কোন চিন্তা নাই তোর। তোরে সারা জনমের লাইগা মায়ের কাছে নিয়া যামু।”
নূরীর দু-চোখের জল অবিরাম ধারায় টপটপ করে শিখার চোখের পাতায় পড়তে লাগলো। ঠিক তখনই শিখার চোখের পাতা নড়ে উঠলো। আঙ্গুলগুলো সামান্য নড়ে উঠলো। শরীরে রক্তে যাওয়ার গতি বাড়তে লাগলো একটু একটু করে।
ডাক্তাররা বললেন,
“বিপদ কেটে গিয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ।”
সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো একসঙ্গে। তালুকদার আবারো দু’হাত তুলে ধরলো উপরের দিকে। আদ্রকণ্ঠে বলল,
“হে মাবুদ! তুমি আবারো প্রমাণ কইরা দিলা,এই দুনিয়াতে সন্তানের লাইগা মায়ের শক্তি বড় শক্তি। তুমি আমাগো কারো ডাক শুননাই। কিন্তু মায়ের ডাক শুনছো। মায়ের চোখের পানির মূল্য দিছো।”
তালুকদার নূরীর দিকে বিনয়ী ও অপরাধী চোখে তাকায়। নূরীর ভিতরে একশো চুল্লীর আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। সে কারো সঙ্গেই কোন কথা বলছে না।
জুবায়ের যেন নতুন করে জীবনী শক্তি পেলো। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করলো লক্ষ কোটি শুকরিয়া জ্ঞাপন করে। জুবায়ের সবাইকে বলল,
“রাজও এসে পড়বে। তখনই পথ ধরেছে সে। আমি দোকান থেকে টেলিফোন করে তাকে জানিয়েছি।”
শুনে সবাই ঘাবড়ে গেলো ভয়ানকভাবে।
“তোর সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি জুবা। কাজ কামে থাকে পোলা। ক্যান ওরে হুনাইলি? তোর প্যাটের ভাত হজম হয় না। নাহ?”
বিষকণ্ঠে বলল সুফিয়া।
“আমি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেছি মাত্র।”
সুফিয়া বিবি মনে মনে বলল,
“এখন ত দেখি তোরেই মারার প্ল্যান করতে হইবো। তোর জন্য শান্তি পাই না। কিন্তুক ভর্তায় বিষ মিশাইলো ক্যাডায়? আমার ফন্দী ত ছিলো অন্যরকম।”
রাতে নিজে তার গাড়ি ড্রাইভ করে সরাসরি হাসপাতালে চলে এলো। গাড়ি রেখে মেডিসিন বিভাগে চলে গেলো। জুবায়ের, রাজের অপেক্ষায় ওয়ার্ডের সামনে পায়চারি করছে। রাজকে দেখতে পেয়েই ম্লান মুখে বলল,
“কিরে এলি? আয়। বিপদ মুক্ত তোর শিখা। মৃত্যুর মুখ থেকে সে ফিরে এসেছে। তবে এটার অন্যতম কারণ তার হায়াত ছিলো। এবং তার মায়ের অশ্রু ও প্রার্থনা। নয়তো কারো ডাকেই তার জ্ঞান ফিরছিলো না। ব্লাডও নিচ্ছিল না তেমন তার শরীর।”
রাজ লম্বা লম্বা পায়ে জুবায়েরের সাথে ওয়ার্ডে শিখার বেডের কাছে গেলো। তার বাবাকে সালাম দিলো। কিন্তু মা এবং পরিবারের অন্যদের দিকে ফিরেও তাকাল না সে। নূরীকে নম্রস্বরে সালাম দিলো। নুরী মাথার ঘোমটা আরো বড় করে টেনে দিলো। শিখার পাশে বসা থেকে সরে দাঁড়ালো।
বলল,
“বাবা আইছো। বসো।”
সবাই বের হয়ে গেলো নূরীসহ। রাজ শিখায় হাতের পিঠে,কপালে ভালোবাসার পবিত্র চুম্বন এঁকে দিলো। শিখার কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“প্রজাপতি, একটু তাকাবে তোমার ফড়িংয়ের মুখপানে?”
শিখা ক্লান্ত আঁখিজোড়া যৎকিঞ্চিত মেলে ধরলো। মেলানো ঠোঁট ফাঁক করতে পারছে না। তার বোবা চোখদুটো জলে ভরে গেলো। একই সঙ্গে রাজেরও। রাজ জুবায়েরকে নিয়ে ডাক্তারদের শরনাপন্ন হলো। তারা পূর্বের কথাগুলো রিপিট করে রাজকে বলল। এবং বলল,
” আংশক মুক্ত পেশেন্ট। কাল রিলিজ দিয়ে দিবো। উনি টাইমলি ব্লাড ম্যানেজ করে দিলোই বলেই এ যাত্রায় রক্ষা পেলো পেশেন্ট। তবে লক্ষ্য রাখবেন। পেশেন্ট যেনো দ্বিতীয়বার একই কায়দায় আত্মহত্যা করার চেষ্টা না করে। একই বিষক্রিয়া যদি পেশেন্টের দেহে দ্বিতীয়বার প্রবেশ করে, তাহলে আর বাঁচানো সম্ভব নয়।”
রাজ ও জুবায়ের ভূমিকম্পের ন্যায় কেঁপে উঠলো। দুজনেই সমস্বরে আঁতকে গিয়ে,
“আত্মহত্যা?”
“হ্যাঁ। তো বলছি কি আপনাদের।”
তারা দুজন একে অপরের দিকে চাইলো। উঠে গেলো ডাক্তারের সামনে হতে। সবার সামনে গিয়ে রাজ জুবায়েরকে বলল,
“আমি বললে মনে করবে বাড়িয়ে বলছি। তুই বল ডাক্তার কি বলেছে?”
জুবায়ের সবাইকে শুনিয়ে ডাক্তারের বলা কথাগুলো বলল। সবাই মৌন রইলো। রাজ সবাইকে বলল,
” রাত হয়ে গিয়েছে। সবাই বাড়িতে চলে যান। বাবাও চলে যান। রাতে আমি থাকবো শিখার কাছে। আম্মা,আপনিও আমাদের বাড়িতে চলে যান।”
পাশ থেকে জুবায়ের বলল,
“হ্যাঁ। খালাম্মা আসুন। আমরা সবাই একসঙ্গে চলে যাবো।”
“আমি তোমাদের বাড়ি কাইল বিকালে যামু ফয়সালা করতে। থানায় যামু সকালেই। তোমাগো সবার নামে মামলা দিমু। আমার মাইয়ারে বিষ দিয়া মারার চেষ্টা করনের জইন্য। আমার মাইয়ার কেউ নাই না? আমি একজন নূরীই যথেষ্ট আমার মাইয়ার লাইগা। ”
রাজ নূরীর দিকে চেয়ে শীতল গলায়,
“আম্মা,একটু ধৈর্য ধরুন। আমার উপরে ছেড়ে দিন না বিষয়টা।”
নূরী এক সমুদ্র দুঃখ ও অভিযোগ নিয়ে নিজবাড়ি চলে গেলো বরকতকে নিয়ে। জুবায়েরও সবাইকে নিয়ে বাড়ি চলে গেলো। সবার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেলো ভয়ে। সুফিয়া বিবি সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন ভর্তায় কে কি মিশালো। কেউই স্বীকার গেল না।
রাজ সারারাত জেগে রইলো। নৈশ প্রহরীর মতো অসুস্থ প্রিয়তমা স্ত্রীকে পাহারা দিলো। সেবা করলো পরম আদরে,যত্নে।
পরেরদিন সকালে জুবায়ের মার্কেটে যাওয়ার আগে হাসপাতালে গেলো শিখাকে দেখতে। একটু হেসে শিখার সঙ্গে কথা বলল। রাজ শিখাকে বলল,
“ডাক্তার বলছে জুবায়ের টাইমলি ব্লাড ম্যানেজ করতে পারলো বলেই রক্ষা পেলে। এবং তোমার মায়ের দোয়া ও কান্না আল্লাহ কবুল করেছে।”
শিখা তার কচি কণ্ঠে ছোট বাচ্চার মতো করে টেনে টেনে বলল,
“জুবায়ের ভাই এই পর্যন্ত কতভাবে যে আমাকে বাঁচালেন। আমার পাশে রইলেন। এর ঋণ কোনদিন শোধ হবার নয়।”
“এটা ভুল শিখা। চাইলে যত বড় ঋণই হোক শোধ করা যায়।”
রাজ জুবায়েরের কাঁধ পেঁচিয়ে ধরে চাপাহাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তুই বিনিময় যাস উপকারের?”
“চাই না। তবে কেউ শোধ করতে চাইলে নেওয়াটা কি ভুল?”
“পারিসও বটে তুই।”
হেসে বলল রাজ।
“পারলাম আর কই বন্ধু? বিজয়ের মালা তোমার গলায়।”
জুবায়ের চলে যায় হাসপাতাল থেকে। রাজ শিখাকে বলল,
“আসলে যতই বলি না কেন,ওর জেলাস হওয়া,মুখ দিয়ে অমন ব্যর্থতার কথা বের হয়ে আসা স্বাভাবিক। চোখের সামনে আমরা জীবনকে নিংড়ে নিংড়ে উপভোগ করছি। ও শুধু দেখেই যাচ্ছে। পুরাই মজনু হয়ে আছে।”
“হ্যাঁ তাইতো দেখছি।”
দুপুরে রাজ শিখাকে নিয়ে বাড়িতে চলে গেলো। দোতলায় তার রুমে শিখাকে নিয়ে শুইয়ে দিলো। দরজা বন্ধ করে দিলো। শিখার হাত ধরে বলল,
“আমি ক্ষমাপ্রার্থী শিখা। একটা অনিশ্চিত জীবন তোমাকে উপহার দিলাম বলে। তোমার ফাইনাল পরিক্ষার জন্য ফেঁসে গিয়েছি। তারপরেই তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাবো।”
শিখা রাজের দু’হাত চেপে ধরে বলল,
“অমন বলবেন না। আপনার ভালোবাসা পাই। আমার ভালোথাকার জন্য এই যথেষ্ট। আর কিছুই চাই না আমি।”
রাজ উঠে গিয়ে ড্রয়ার টেনে তার বাড়িতে ব্যবহৃত লুঙ্গি, টিশার্ট,তাওয়েল বের করলো। দু’তিনদিনের জন্য গ্রামে এলে সে কিছুই আনে না। বাড়িতেই তার পর্যাপ্ত পরিমাণে পরিধেয় বস্র রয়েছে। সে ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে নিলো। বিছানায় এসে শিখাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। শিখাও আদুরী ভঙ্গিতে বিড়াল ছানার মতো রাজের বুকে লেপ্টে ঘুমিয়ে গেলো। শেষ দুপুরে দুজনের ঘুম ভাঙলো। দরজায় টোকা পড়লে রাজ দরজা খুললো।
“ভাইজান, আপনারা দুপুরের ভাত খাইবেন না? খালাম্মা পাঠাইলো।”
বলল জোছনা।
” খাব না। আমরা বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।”
জোছনা চলে যায়। সিঁড়ি ডিঙাতে ডিঙাতে গুনগুন করে বলল,
“কবে যে আমার বিয়ার ফুল ফুটবো? রাজ ভাইর মতন একখান জামাই পাইলে মইরাও শান্তি। পারে না বউরে কোলে কোলে রাখে। লেমনচুস হইলে মনে হয় চুইসা খাই ফালাইতো ভাবিরে।”
বিকেলে রাজ শিখাকে নিয়ে নিচে বৈঠকখানায় গেলো। সবাইকে ডাকলো তার পিতাসহ। রাজের দৃষ্টি গম্ভীর! শীতল! চোয়াল শক্ত! কন্ঠ গুমোট! সব মিলিয়ে তার মুখমণ্ডল ভয়ানক রূপ ধারণ করে আছে। ঝড়ের পূর্বাভাস! যে কোন মুহূর্তেই তাণ্ডব শুরু হবে। রাজের আগে সুফিয়া বিবি ছেলের মন রক্ষার্থে সবাইকে কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো,
কে বিষ মিশালো। সবাই দৃঢ়চিত্তে জানালো তারা কেউই মিশায়নি।
পরে রাজে একে একে সবাইকে জিজ্ঞেস করলো,
“শিখার ভাগের ভর্তায় বিষ মিশিয়েছিলো কে?”
সবাই উত্তর দিলো তারা কেউই মিশায় নি। রাজের বড় ভাবি রানী তার পুরোনো কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করলো। সে নিরীহ গলায় বলল,
“ছোড় মিয়া, আল্লায় রহম করছে শিখা বাঁইচা আছে। বাসি হওয়া কাহিনীর সুর তুইলা কি লাভ কন? এমনতো হইতে পারে,রসুই ঘরের টং থেইকা ভর্তায় তেল্লাচোরা,বা অন্য পোকাটোকার বিষ্ঠা পড়ছে। এগুলো কি কম বিষাক্ত?”
রাজের চক্ষুদ্বয় লালবর্ণ ধারণ করলো রক্তজবার ন্যায়। সে বসা থেকে উঠে এসে রানীর গলা টিপে ধরলো। গমগমে স্বরে বলল,
” বাহ! বাহ! ভালই নাটকিয়তা তৈরি করতে পারো দেখি। বড় ভাবি হিসেবে অনেক রেস্পেক্ট করেছি। আর নয়। তুমি আমার কাছে সম্মান হারিয়েছো সেদিনই, যেদিন তোমার কদর্য রূপ আমি জেনে গেলাম। আর সেজন্যই তুমি শিখার ভর্তায় বিষ মিশিয়েছো। কারণ তোমার স্থানে তুমি শিখার উপর তেতে আছো।”
রানীর দম আটকে আসছে। সে গোঁ গোঁ করছে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য। আদুরী বড় ভাবির ভক্ত। সে সহ্য করতে না পেরে বিষাক্ত স্বরে বলে উঠলো,
“ছিহ! ভাইয়া আপনার এই অধঃপতন? দুইদিনের বিয়ে করা বউয়ের জন্য বাইশ বছরের সম্পর্কের বড় ভাবির গায়ে হাত তুললেন? ভর্তায় বিষাক্ত কিছু মানেই বিষ। এটা সত্য। কিন্তু সেটা কি মানুষেই দিছে? চাক্ষুষ প্রমাণ ছাড়া কাউকে এমন টর্চার করা উচিত নয়। ভাবির গলা ছাড়েন বলছি।”
রাজ রানীর গলা ছেড়ে দিয়ে আদুরীর গলা টিপে ধরলো।
” তাহলে কি তুই দিছিস শিখাকে মারার বিষ? তোরা দুজন একই ঘাটের মাঝি। একই সুরে কথা বলস দুজন। দুজন দুজনের অপকর্মে সাপোর্ট দিস। ধরা পড়লে সাক্ষ্য দিস পক্ষ নিয়ে। এটাই ত দেখে আসছি। তোরা কেউই স্বীকার যাবি না। এইতো? শুনে রাখ কান খুলে,এই বিষের রহস্য আমি বের করবই।”
ভয়ে অন্যরা রাজের হাত ছাড়াতে চেষ্টা করছে না। সুফিয়া কেঁদে উঠলো। তালুকদার রাজকে ধমক দিয়ে থামালো। আদুরী নিজের গলা ধরে কেঁদে ফেলল। রাজ গর্জন করে উঠলো দানবের মতো। সবার দিকে চেয়ে বলল,
“কি অপরাধ এই মেয়েটার? বলতে পারেন মা? বাবাকে বারবার তার পরিবারের কাছে ছোট করে দিচ্ছেন। এসব কোন মানুষের আচরণ মা? ভর্তায় বিষ কি কোন দৈববলে মিশে গিয়েছে? এটা সম্ভব? আমি তো তারমাঝে কোন কমতি দেখি না। রূপে,গুণে,শিক্ষায়,মেধায়,বুদ্ধিতে,জ্ঞানে,নম্রতায়,ভদ্রতায়,মার্জিত আচরণে, কোন অংশে আমাদের পরিবারের চেয়ে সে কম? বরং অনেক বেশী। বলবেন, আমরা জমিদার,তালুকদার। সমাজে আমাদের উঁচু স্থান। হ্যাঁ আমি কায়মোনবাক্যে স্বীকার করছি শিখাদের এসব নেই। কারণ তাদের অর্থবিত্ত নেই। এইতো পার্থক্য? দরকার নেই আমার এমন অর্থবিত্ত ও প্রাচুর্যের। যেই ধনসম্পদ মানুষে মানুষে বিভেদ ও বৈষম্য সৃষ্টি করে। চাই না সেসবকিছু।”
বলেই রাজ মাতালের মতো কাণ্ড জুড়ে দিলো অকস্মাৎ। সেন্টার টেবিলের উপরে থাকা কাঁচের ফুলদানিটা মেঝেতে ছুঁড়ে মারলো। কাঁচের গ্লাস,মগ সজোরে মেঝেতে ফেলে দিলো। হাতুড়ি দিয়ে ঘরের সব কাঁচের জিনিসপত্র ভেঙ্গে তছনছ করে ফেলল। টিভি ভেঙ্গে ফেলল। শিখা ভয়ে জোঁকের মতো চুপসে গেলো। অন্যরাও। তালুকদার শিখাকে অনুরোধ করলো,
রাজবধূ পর্ব ৫২
“মা, তুমি ছাড়া আমরা কেউই এই পাগলটাকে এখন থামাতে পারব না।”
শিখা নিরুপায় হয়ে উঠে গেলো। রাজকে জড়িয়ে ধরে অনুনয় করে,
“আল্লারওয়াস্তে থামুন না। থামুন। আমাকে ত হারান নি আপনি। আমি আছি।”
রাজের হাত থেমে যায় যাদুকরের যাদুর মতো। শিখা যেন তার জীবনে কখনো ম্যাজিক। কখনো চুম্বকের আকর্ষণ শক্তি।
তখন আঙিনায় দু’জন পুলিশসহ কয়েকজন মানুষের পদধ্বনি দেখা গেলো। শিখা,রাজ, তালুকদারসহ সবাই ভীত ও অদ্ভুত চোখে নির্বিকার ভঙ্গিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।